২০. আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্য; তার সংগতি; বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক পদ্ধতি
২০.১ সাম্রাজ্য: তার বিস্তৃতি ও রাজস্ব
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময় (১৭০৭) তাঁর সাম্রাজ্য গঠিত ছিল ২১টা সুবা বা আলাদা আলাদা প্রদেশে, যার মধ্যে ১৪টা হিন্দুস্তান বা উত্তর ভারতে, ছয়টা দাক্ষিণাত্যে, আর একটা (কাবুল) হলো বর্তমানের আফগানিস্তান। সেগুলোর নাম হলো:
(i) হিন্দুস্তানের অন্তর্গত সুবা-আগ্রা, আজমীর, এলাহাবাদ, বাংলা, বিহার, দিল্লি, গুজরাট, কাশ্মির, লাহোর, মালওয়া, মুলতান, উড়িষ্যা, অযযাধ্যা, আর টাট্টা (সিন্ধ)।
(ii) দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত সুবা-খাদেশ, বেরার, আওরঙ্গাবাদ (সাবেক আহমদনগর), বিদার (সাবেক তেলেঙ্গানা), বিজাপুর, আর হায়দরাবাদ।
এক শতাব্দী আগে, অর্থাৎ, আকবরের শাসনামলের শেষে (১৬০৫) মোগল সাম্রাজ্য গঠিত ছিল হিন্দুস্তানের চৌদ্দটা সুবার সবগুলো আর দাক্ষিণাত্যের উপরোল্লিখিত দুটো প্রদেশে-আকবরের আহমদনগর সংযুক্ত করাটা ছিল নামেমাত্র। কান্দাহার বা দক্ষিণ আফগানিস্তান অনেক আগে থেকেই কাগজে কলমে ছিল মোগল সাম্রাজ্যের সুবা, কিন্তু সেটা কেবল কাগজে-কলমেই, যেহেতু প্রায়ই সেটা হাতবদল হয়েছে পারস্য আর দিল্লির সম্রাটদের মধ্যে, এবং শেষমেশ মোগলেরা যেটা হারিয়ে ফেলেছিল (১৬৪৯); সেরা সময়েও খুবই লোকসানের ছিল ঊষর এই সুবা। নাদির শাহ সংযুক্ত করার (১৭৩৯) আগ পর্যন্ত কাবুল বা উত্তর আফগানিস্তান যদিও ধরে রেখেছিলেন মোগল সম্রাটগণ, আকবরের আমলে সেটার রাজস্ব ছিল মাত্র ২০ লাখ টাকা, আর আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ৪০ লাখ, যার অনেকটাই প্রায়শ আদায় হতো না। সুতরাং এই অধ্যায়ে আমরা আফগানিস্তানের এই দুটো প্রদেশকে হিসাবের বাইরে রাখব।
আওরঙ্গজেবের অধীনে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল উত্তর কাশ্মির আর হিন্দু কুশের দক্ষিণের পুরো আফগানিস্তান; গজনির দক্ষিণে ৩৬ মাইলের দক্ষিণ পশ্চিমের একটা রেখা এটাকে পারস্য রাজ্য থেকে আলাদা করেছে। পশ্চিম উপকূলে এটা উত্তর সীমান্তের গোয়া এবং ভেতরের দিকে বেলগা (বোম্বে কর্ণাটক বা কানারার অন্তর্গত) আর তুঙ্গভদ্রা নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। তদনুযায়ী সীমানাটা পশ্চিম থেকে পুবের একটা বিতর্কিত রেখা ধরে মহীশূরের মাঝখান দিয়ে গিয়ে নেমেছে দক্ষিণ-পুবের কোরান নদীতে (তাঞ্জোরের উত্তরে)। সর্ব উত্তর-পুবের মোনাস নদী (গৌহাটির পশ্চিমে) সাম্রাজ্যকে বিভক্ত করেছে স্বাধীন আসাম রাজ্য থেকে। কিন্তু একটা কথা সব সময় মনে রাখা উচিত যে দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পুবে, অর্থাৎ, মহারাষ্ট্র, কানারা, মহীশূর আর পুব কর্ণাটক জুড়ে,
সম্রাটের শাসন ছিল বিতর্কিত; ইংরেজ আর ফরাসি ফ্যাক্টরি রেকর্ডে দুঃখজনক। এই চিত্র দেখা যাচ্ছে যে সেখানকার বেশির ভাগ জায়গাতেই চলত সম্রাট আর লুণ্ঠনকারীদের দ্বৈত শাসন (দো-আমলি)।
আফগানিস্তান বাদে আকবরের অধীনে মোগল সাম্রাজ্যের রাজস্ব ছিল ১৩ কোটি ২১ লাখ, আর আওরঙ্গজেবের অধীনে ৩৩ কোটি ২৫ লাখ । ভূমি থেকে এটাই ছিল রাষ্ট্রের আদর্শ বা সর্বোচ্চ চাহিদা, কিন্তু রাজস্বের এই পরিমাণ কখনোই পুরোপুরি আদায় হতো না, বরং বলা উচিত, আদায় হতো অনেক কম। এটা কেবলই ভূমি রাজস্বের হিসাব, জাকাত (মুসলমানদের বার্ষিক আয়ের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ, যেটা প্রধানত ব্যয়িত হয় ধর্মীয় দান হিসেবে) আর জিজিয়া করকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় আয়ের বিভিন্ন খাতের অনুপাত বোঝার খাতিরে আওরঙ্গজেবের শাসনামলের গুজরাটের একটা চিত্র দেওয়া যেতে পারে: ভূমি রাজস্ব ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা, জিজিয়া ৫ লাখ, সুরাট বন্দরের প্রতিবছরের আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ১২ লাখ । (শাসনামলের শেষের দিকে মসুলিপট্টম আর হুগলি ছাড়া অন্যান্য বন্দরের ব্যবসা ছিল তুচ্ছ ৷)
২০.২ অফিসসংক্রান্ত চিত্র
বেসামরিক আর সামরিক উভয় সরকারই পরিচালিত হতো সামরিক তালিকাভুক্ত অফিসারদের দ্বারা, আর তাদের আবার শ্রেণী বিভাগ করা হতো বিশ হাজার ঘোড়ার মনসব (সেনাপতি) থেকে মাত্র বিশজন মানুষের (আকবরের শাসনামলে দশ) মনসব পর্যন্ত। ৩-হাজারি থেকে ওপর দিকের মনসবকে বলা হতো সম্ভ্রান্ত অমাত্য (উমারা-ই-আজম) বা সম্ভ্রান্ত সেনাপতি (প্রচলিত আখ্যায় ‘উমদাত-উল মুলক’ বা ‘উমদা’), ৫০০ থেকে ২৫০০ ঘোড়ার নেতৃত্বে যারা থাকত তাদের বলা হতো ‘উমারা’, আর ৫০০ ঘোড়ার কম নেতৃত্বকারীদের আখ্যা ছিল মনসবদার বা অফিসার।
সম্ভ্রান্ত অমাত্যের সংখ্যা | ১৫৯৬ | ১৬২০ | ১৬৪৭ | ১৬৯০ |
(শাহজাদাসহ ৩-হাজারির ওপরে) | ৬৩ | ১১২ | ৯৯ | — |
মোট উমারা আর মনসবদার | ১৮০৩ | ২৯৪৫ | ৮০০০ | ১৪৪৪৯ |
ওপরের চিত্র থেকে আমরা বুঝতে পারি আওরঙ্গজেবের অধীনে বিপুল সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি আর অর্থনৈতিক বোঝার কথা।
আওরঙ্গজেবের অধীনে ১৪৪৪৯ মনসবদারের মধ্যে প্রায় ৭,০০০ ছিল জায়গিরদার আর ৭৪৫০ ‘নকদি’ (নগদ বেতনভুক্ত), অর্থাৎ, প্রায় আধাআধি । মনসবদারদের বার্ষিক বেতন আর ভাতা ছিল নিম্নরূপ:
৭-হাজারি …………….. সাড়ে তিন লাখ টাকা
৫-হাজারি …………….. আড়াই লাখ টাকা
হাজারি ……………….. পঞ্চাশ হাজার টাকা
বিশজনের সেনাপতি …….. এক হাজার টাকা
১৬৪৭ সালে সাম্রাজ্যের আসল সশস্ত্র শক্তি ছিল : ২ লাখ সেনা, ৮০০০ মনসবদার, ৭০০০ আহাদি আর বরকন্দাজ; শাহজাদা, উমারা আর মনসবদারদের অতিরিক্ত ১৮৫০০০ সেনা, আর ৪০০০০ পদাতিক মাস্কেটিয়ার, গোলন্দাজ আর রকেট-ম্যান।
আওরঙ্গজেবের নতুন যুদ্ধবিগ্রহের ফলে আরও বেড়েছিল এই সংখ্যা, আর সেনাদের পাওনা মেটাতে শেষমেশ অসহায়ভাবে ভেঙে পড়েছিল অর্থনীতি।
বার্নিয়ার বলেছেন যে মোগল সাম্রাজ্যে চালু ছিল সেবারত অবস্থায় মারা যাওয়া সবার সম্পত্তি সম্রাট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করার বর্বর আর প্রাচীন প্রথা। অন্যভাবে বলতে গেলে, অমাত্যদের ছিল না উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কোনো সম্পত্তি। অমাত্যদের মৃত্যুর পর সম্রাট সবকিছুর দখল নিতেন আর তাদের সন্তানদের দিতেন তাঁর ইচ্ছেমাফিক সামান্য কিছু। এর ফল ছিল রাষ্ট্র আর ভারতীয় সভ্যতার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অসংযত জীবনযাপন করত অমাত্যেরা আর বিলাসিতার পেছনে উড়িয়ে দিত সব টাকা, যেহেতু তাদের জানা ছিল যে তারা মিতব্যয়ী হলে তাদের পরিবার মোটেই উপকৃত হবে না, লাভবান হবেন কেবল সম্রাট। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যক্তিগত মূলধনও গড়ে তুলত না অমাত্যরা, অথচ দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নির্ভর করে এই মূলধনের ওপর।
এর ফলে মোগল অমাত্যরা পরিণত হয়েছে স্বার্থপর একটা দলে, উত্তরাধিকারের লড়াই বা বিদেশি আক্রমণের পর দ্রুত যারা যোগ দিত জয়ী দলের সঙ্গে, কারণ, তারা জানত যে জমি আর এমনকি ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপরও নেই তাদের আইনগত অধিকার, সবকিছু নির্ভরশীল ‘অধিকার থাক বা না থাক প্রকৃতপ্রস্তাবে’ অধিকারী সম্রাটের ওপর। মধ্যযুগীয় ভারতে ছিল না কোনো স্বাধীন অমাত্য বা শক্তিশালী বণিক শ্রেণী, যারা সর্বোচ্চ সর্বশক্তিমান সম্রাট আর সর্বনিম অসংখ্য গরিব কৃষক ও মজুরের মাঝখানে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে।
২০.৩ উৎপাদন আর বাণিজ্য
মোগল সরকার বিভিন্ন ধরনের জিনিস নিজেরাই রাষ্ট্রীয় কারখানাতে উৎপাদন করত। এই বিষয়টা আমার মোগল প্রশাসন বইয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। অল্প পরিমাণে হওয়ায় বিদেশি বাণিজ্যের অবস্থান মোগল অর্থনীতিতে তুচ্ছ-আমদানি শুল্ক হিসেবে বার্ষিক আয় হতো সম্ভবত ৩০ লাখ টাকার কম, যেখানে ভূমি রাজস্ব রাষ্ট্রকে দিত তার একশো এগারো গুণ বেশি।
ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বাণিজ্যের জন্য প্রথম ষাট বছরে (১৬১২-১৬৭২) ভারতীয় যে পণ্য আমদানি করেছে, তা প্রতিবছর গড়ে এক লাখ পাউন্ডের (বা আট লাখ টাকা) বেশি ছিল না। তখন ডাচ কোম্পানির বাণিজ্য সম্ভবত ইংরেজ কোম্পানির সমানই ছিল, পর্তুগিজদের ছিল অবশ্যই তার চেয়ে কম।
মোগল সম্রাটগণের আরোপিত কম আমদানি শুল্ক (মূল্যানুসারে শতকরা ৩ ভাগ, যার মধ্যে শতকরা ১ ভাগ জিজিয়া) প্রমাণ করে যে তারা বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতেই চেয়েছিলেন। দেশীয় উৎপাদকদেরও কোনোভাবেই নিরুৎসাহিত করা হয়নি।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের বেশির ভাগই ছিল পাঁচটা দ্রব্য নিয়ে। ইংরেজ বাজারে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন দ্রব্য ছিল দ্বীপপুঞ্জের মসলা, পারস্যের কাঁচা রেশম, ভারতের শোরা আর নীল, এ ছাড়া ভালো মানের সুতি কাপড়। কিন্তু কোম্পানি বেশির ভাগ সুতির জিনিস কিনত দূরপ্রাচ্য আর পারস্যের বাজারের জন্য, ইংল্যান্ডে আমদানি করার লক্ষ্যে নয়। সুতি জিনিস উৎপাদনে ভারত ছিল একচেটিয়া, কিন্তু তাদের রেশম রপ্তানি উল্লেখযোগ্যও ছিল না। ইংল্যান্ডে কাঁচা রেশম আসত প্রধানত পারস্য আর চীন থেকে।
মোগল আমলে ভারত প্রধানত আমদানি করত রুপা আর সোনা (মুদ্রার আকারে), এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণে তামা আর সিসা। উচ্চমানের পশমি কাপড় ভারতে আনা হতো ইয়োরোপ (বিশেষভাবে ফ্রান্স) থেকে। প্রচুর পরিমাণে আমদানিকৃত বনাত আর অন্যান্য জাতের পশমি কাপড় ব্যবহার করত দরবার আর ধনীরা। দলে দলে ঘোড়া আসত জাহাজে করে পারস্য উপসাগর থেকে এবং স্থলপথে খোরাসান আর উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথ দিয়ে কাবুল থেকে। পুব হিমালয়ের রাষ্ট্র তিব্বত আর ভুটান থেকে পাহাড়ি টাটু ঘোড়া আমদানি করা হতো বাংলা, কুচবিহার, মোরাং আর অযোধ্যার ভেতর দিয়ে। শীতে তাজা আর সারা বছর শুকনো ফল আসত মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান আর পারস্য থেকে। মসলার ক্ষেত্রে একচেটিয়া ওলন্দাজেরা পাঠাত লবঙ্গ, জায়ফল, দারুচিনি আর এলাচ। বিলাসদ্রব্যের মধ্যে কস্তুরী আর পোর্সেলিন আসত চীন থেকে, মুক্তা বাহরাইন আর সিংহল থেকে, পেগু আর সিংহল থেকে হাতি, আমেরিকা থেকে উন্নতমানের তামাক, ইয়োরোপ থেকে কাঁচের জিনিসপত্র, ওয়াইন আর দুর্লভ বস্তু এবং আবিসিনিয়া থেকে ক্রীতদাস। স্থানীয় শাসকদের আকস্মিক প্রয়োজনে ইয়োরোপিয়ান কোম্পানিগুলো কখনো কখনো বিক্রি করত কামান আর যুদ্ধোপকরণ (অল্প পরিমাণে), কিন্তু এসবের বাণিজ্য নিয়মিত চলত না, আর বেআইনি বলে বেশির ভাগ সময়েই লেনদেন হতো গোপনে। হিমালয় অঞ্চল থেকে অযযাদ্ধা হয়ে (পরে পাটনা হয়ে) টাটু ঘোড়ায় চাপিয়ে তারা আনত অল্প পরিমাণে সোনা, তামা, কস্তুরী আর চমরি গাইয়ের লেজ (পাখা হিসেবে বা মাছি তাড়ানোর কাজে ব্যবহার করার জন্য); আর এগুলো বিক্রি করে নিয়ে যেত লবণ, তুলা, কাঁচের জিনিসপত্র ইত্যাদি। ইয়োররাপিয়ান কাগজ আমদানি করত পর্তুগিজ আর পরে ওলন্দাজেরা, যার বেশির ভাগই ব্যবহার করতেন দাক্ষিণাত্যের স্বাধীন সুলতানগণ। কিন্তু মোগল সম্রাটগণের কাশ্মির এবং আরও কয়েকটা জায়গার নিজেদের কারখানাতেই তৈরি হতো চমৎকার কাগজ, আর সাধারণ অফিসের কাজ আর মানুষজনের জন্য কাগজ তৈরি করত একশ্রেণীর মুসলমান কারিগর (কাগজি), প্রত্যেক শহরে ছিল তাদের কারখানা, আর নিজেদের একটা করে শহরতলি (পুরা), রাজধানীগুলোর কাছে।
সে সময় আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানিদ্রব্য ছিল সাধারণ সুতি কাপড় (ক্যালিকো), যার বেশির ভাগ চলত ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে, আর সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংল্যান্ডেও, এ ছাড়া মসলিন বা অতি চমৎকার সুতি কাপড়, শোরা, নীল, রেশম আর মরিচ । হুগলি থেকে রপ্তানি করা হতো অল্প পরিমাণে সাদা চিনি, মসুলিপট্টম হয়ে হীরা আর চুনি, বাংলা আর মাদ্রাজ থেকে ক্রীতদাস এবং ইংল্যান্ডে মোমবাতির সলতে তৈরির জন্য সুতির সুতো। শতাব্দীর শেষের দিকে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতে থাকে রেশম টাফেটা আর কিংখাব।
২০.৪ প্রশাসনিক পদ্ধতি
মুসলমান রাষ্ট্র ছিল অপরিহার্যভাবে একটা সামরিক সরকার, যে তার অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে সম্রাটের সর্বময় ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। সম্রাট যুদ্ধের সময় বিশ্বাসীদের প্রধান সেনাপতি। তার নিয়মিত কোনো মন্ত্রিপরিষদ নেই। সম্রাটের পর উজির আর দেওয়ানই সর্বোচ্চ দুই অফিসার, অন্যান্য মন্ত্রী কোনোভাবেই তাঁর সহকর্মী নয়, কিন্তু অবশ্যই তার চেয়ে নিমপদস্থ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অন্যান্য মন্ত্রীকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেন সম্রাট আর উজির। কিন্তু কোনো মন্ত্রী, এমনকি স্বয়ং উজিরও সম্রাটের ইচ্ছায় বাধা দিতে পারে না; তাদের কাজকর্ম সম্পূর্ণ নির্ভরশীল তার খেয়ালের ওপর। সুতরাং তারা, আধুনিক যুগের মতো একটা পরিষদ গঠন করতে পারে না।
মোগল প্রশাসনের প্রধান বিভাগগুলো ছিল:
১. শুল্ক আর রাজস্ব (দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে)।
২. সম্রাটের পরিবার (খান-ই-সামান বা উচচ তত্ত্বাবধায়কের অধীনে)।
৩. বেতন বা পাওনা আর হিসাব অফিস (বকশির অধীনে)।
৪. অনুশাসন (কাজিদের কাজির অধীনে)।
৫. ধর্মীয় বৃত্তি আর দাঁতব্য (সদরদের সদরের অধীনে)।
৬. জনসাধারণের নৈতিক অনুমোদন (মুহতাসিবের অধীনে)। এগুলোর নিচে হলেও পদে প্রায় বিভাগের মতো ছিল:
৭. গোলন্দাজ বাহিনী (মীর আতিশের অধীনে), এবং
৮. গোয়েন্দা আর ডাক (ডাকচৌকির দারোগার অধীনে)।
সম্রাটের দেওয়ান গ্রহণ করে প্রদেশ আর সেনাদের পাঠানো রাজস্বসংক্রান্ত যাবতীয় কাগজপত্র, রাজস্ব সংগ্রহ বা ধার্যসংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তও নেয় সে। সমস্ত প্রদেশের দেওয়ান নিয়োগ আর তাদের নিয়ন্ত্রণের কাজও সে করে । যাবতীয় পাওনার আদেশনামা তাকে দিয়েই স্বাক্ষর করিয়ে নিতে হয়। তার হাতের লেখা চিঠির মাধ্যমেই প্রকাশিত হয় সম্রাটের ইচ্ছে (হসব-উল-হুঁকুম), এবং প্রায়শ সে-ই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা বিদেশি শাসকের কাছে লেখা সম্রাটের চিঠির মুসাবিদা করে।
বেসামরিক আর সামরিক, সব অফিসারের বেতন হিসাব করে অনুমোদন দিতে হয় বকশিকে। আওরঙ্গজেবের শাসনামলের শেষ দিকে মোগল সাম্রাজ্য বিশাল বিস্তৃতি লাভ করায়, সেখানে ছিল একজন প্রধান বকশি (বলা হতো প্রথম বকশি) আর তার তিন সহকারী, যাদের বলা হতো ২য়, ৩য় আর ৪র্থ বকশি। প্রত্যেকটা সেনাকে রাখা হতো একজন সেনাপতির অধীনে। যদিও অনেক সময়েই অফিসারকে উপাধি দেওয়া হয়েছে ‘সিপাহসালার’ বা ‘সেনাপ্রধান’, তা আসলে কেবল একটা সম্মানসূচক উপাধি, সে সমগ্র মোগল সেনাবাহিনীর অধিপতি নয়। একমাত্র সম্রাটই হলেন সেনাপ্রধান।
খান-ই-সামান বা উচ্চ তত্ত্বাবধায়ক হলো সম্রাটের পরিবার বিভাগের মাথা; সে নিয়ন্ত্রণ করে সম্রাটের সমস্ত খাস ভৃত্যকে, তত্ত্বাবধান করে তার প্রাত্যহিক খরচ, খাবার, মজুত ইত্যাদি। সম্রাটের যাত্রা চলাকালীন সঙ্গ দেয় সে। এবং তার হাতেই রাষ্ট্রীয় কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপনা করা আর পাওনা মেটানোর ভার।
তত্ত্বগতভাবে সাম্রাজ্যে সম্রাটই হলেন প্রধান বিচারক, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিচার করার চেষ্টা করেন প্রত্যেক বুধবার। কিন্তু সম্রাট যে আদালতে বসেন সেটা কোনো প্রথম আদালত নয়, বরং সর্বোচ্চ আপিলের ট্রাইব্যুনাল। মুসলমানদের ফৌজদারি আর দেওয়ানি উভয় আদালতেরই প্রধান বিচারক হলো কাজি, যাকে সহায়তা করে একজন মুফতি; আরবি জুরিসপ্রুডেন্সের বই পর্যালোচনা করে আইনের বিবরণ পড়ে শোনায় মুফতি, আর কাজি রায় দেয়।
সম্রাটের কাজিকে বলে কাজি-উল-কুজাত, সে সব সময় সম্রাটকে সঙ্গ দেয় এবং প্রত্যেক প্রদেশের বড় গ্রাম আর শহরের স্থানীয় কাজিকে নিয়োগ দেয় আর বরখাস্ত করে।
ধার্মিক মানুষ, পণ্ডিত আর সন্ন্যাসীদের সহায়তার জন্য সম্রাট আর শাহজাদাগণ যে জমির বন্দোবস্ত দেন, সেগুলোর মীমাংসা আর তত্ত্বাবধান করে প্রধান সদর (বলা হতো সদর-উস-সদর)। তার দায়িত্ব এসব মঞ্জুরি দেওয়ার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে কি না সেটা দেখা, আর নতুন মঞ্জুরির আবেদন নিরীক্ষণ করা। সে সম্রাটের ভিক্ষাবণ্টক, তাই রাষ্ট্রের দাঁতব্য তহবিল বিতরণ করাও তার। কাজ। এবং তার কাজ হলো প্রাদেশিক সদরদের নিয়োগ দেওয়া আর তাদের। তত্ত্বাবধান করা।
মুহতাসিবের দায়িত্ব কুরআনের কঠোর অনুশাসন অনুসারে জনসাধারণকে জীবন চালিত করতে দেওয়া, এবং মহানবীর আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তাদের মদ, ভাং ও অন্যান্য তরল মাদকদ্রব্য পান আর জুয়াখেলা কিংবা প্রকাশ্যে বা গোপনে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা। ধর্মবিরুদ্ধ মতামত, মহানবীর নিন্দা, রোজ পাঁচবার নামাজ পড়ায় অবহেলা বা রমজান মাসে রোজা না রাখার জন্য শাস্তির বিধান করাও তার ক্ষমতার আওতায়। এবং তার দায়িত্ব হলো নবনির্মিত মন্দিরের ধ্বংসসাধন।
প্রদেশগুলোর প্রশাসনিক প্রতিনিধি ছিল যেন মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় সরকারেরই ক্ষুদ্র রূপ। সেখানে ছিল শাসক (আমলাতান্ত্রিক নাম নাজিম’ আর প্রচলিতভাবে সুবাদার), দেওয়ান, বকশি, কাজি, সদর, বুয়ুতাত (সরকারি সম্পদের তত্ত্বাবধায়ক আর দাপ্তরিক ট্রাস্টি), মুহতাসিব, কিন্তু কোনো খান-ই সামান নেই। আপন অধিকারের সীমানায় প্রত্যেক সুবাদার পালন করার চেষ্টা। করত সম্রাটের ভূমিকা।
প্রাদেশিক প্রশাসন কেন্দ্রীভূত ছিল সেটার প্রধান শহরে। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বা মহকুমায় শৃঙ্খলা বজায়, বিদ্রোহী আর অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া এবং রাজস্ব সংগ্রহে বিরোধিতা ঘটলে সহায়তা করা ছিল ফৌজদারের দায়িত্ব। গ্রামগুলো ছিল অবহেলিত, হয় অবজ্ঞায় নয়ত আমলাতান্ত্রিক অযোগ্যতায় সেগুলোকে চলতে দেওয়া হয়েছে যথেচ্ছভাবে।
বড় শহরে কোতোয়াল বা পুলিশের কর্তা কেবল আইন আর শৃঙ্খলাই বজায় রাখেনি, বর্তমান ধাচের পৌরসভাকে ভারমুক্ত করেছে অনেক দায়িত্ব থেকে, নিয়ন্ত্রণ করেছে বাজার (ওজন আর মূল্য) এবং বজায় রেখেছে নৈতিকতাসংক্রান্ত কুরআনের অনুশাসন।
কেন্দ্রীয় সরকার দেশের কোথায় কী ঘটল তার সংবাদ সংগ্রহ করে গুপ্তচর আর সংবাদদাতা মারফত, প্রকাশ্যে এবং গোপনে। এই প্রতিনিধিরা চার শ্ৰেণীর: ওয়াকাই-নবিস, স্বনিথ-নিগার, খুফিয়া-নবিস (গোপন পত্ৰলেখক), আর হরকরা (গুপ্তচর এবং রানার)। তাদের সংবাদ পাঠাতে হতো নিয়মিত বিরতিতে। এবং যাবতীয় এসব সংবাদ সম্রাটের কাছে পৌঁছাত পোস্টমাস্টার-জেনারেল মারফত (দারোগা-ই-ডাকচৌকি)।
সম্রাটগণের বারংবার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনেক স্থানীয় আমলা (এমনকি অনেক সুবাদারও) বেআইনি আদায় করেছে শিল্পী, কারিগর, বণিক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষনির্বিশেষে। আরেকটা অত্যাচার হলো, সুবাদাররা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাল নিত অল্প মূল্যে বা বিনা মূল্যে, তারপর হয় সেটা ভোলা বাজারে বিক্রি করে লাভ করত, নয়ত লাগাত নিজের কাজে। এসব বন্ধ করতে পারতেন কেবল পরাক্রমশালী আর সদাসতর্ক একজন সম্রাট।