১৫. মারাঠিদের সঙ্গে বিবাদ : ১৭০০ সাল পর্যন্ত

১৫. মারাঠিদের সঙ্গে বিবাদ : ১৭০০ সাল পর্যন্ত

১৫.১ শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধে আওরঙ্গজেবের গতিবিধি

১৬৮১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজপুতানা ত্যাগ করে আওরঙ্গাবাদ পৌঁছালেন আওরঙ্গজেব পরবর্তী বছরের ২২ মার্চ, আর কৌশলগত সেই কেন্দ্র দখল করে চারপাশে তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে লাগলেন ১৬৮৩ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত, তারপর এগোলেন আরও দক্ষিণের আহমদনগরে। সেখান থেকে শোলাপুর পৌঁছালেন তিনি ১৬৮৫ সালের ২৪ মে। তারপর বিজাপুরের উপকণ্ঠের রসুলপুরে গেলেন তার সেনাদের অবরোধের একটা উপসংহার টানতে। আদিল শাহি রাজধানীর বিজয় সম্পূর্ণ হতে ৩০ অক্টোবর সেই জায়গা ছেড়ে কুলবর্গা আর বিদার পরিদর্শন করে গোলকুণ্ডার সামনে এলেন তিনি ১৬৮৭ সালের ২৮ জানুয়ারি। এখানে শিবির গেড়ে থাকলেন তিনি এক বছর। তারপর আবার বিজাপুর পৌঁছালেন ১৬৮৮ সালের ১৫ মার্চ। এই শহরে বাস করলেন আওরঙ্গজেব পরবর্তী নয় মাস, তারপর জায়গাটা ছাড়তে বাধ্য হলেন (১৪ ডিসেম্বর) ভয়ংকর এক প্লেগের প্রাদুর্ভাবে। আকলুজ আর বাহাদুরগড় যাওয়ার পথে পৌঁছালেন তিনি পুনা জেলার কোরগাঁয়ে, সেখানে শিবির পেতে থাকলেন ১৬৮৯ সালের ৩ মার্চ থেকে ১৮ ডিসেম্বর, তারপর আবার বিজাপুর ফিরলেন ১৬৯০ সালের ১১ জানুয়ারি। কিন্তু শিগগিরই বিজাপুর ছেড়ে শহরটার দক্ষিণের কৃষ্ণ নদীর তীরের বিভিন্ন জায়গায় কাটালেন তিনি ফেব্রুয়ারি, মার্চ আর এপ্রিল; শেষমেশ নদীটার দক্ষিণ তীরের গলগলায় (বিজাপুরের ৩৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে) শিবির গাড়লেন ১৬৯০ সালের ২১ মে-র দিকে। সেখানে কাটালেন তিনি সেই বছরের অবশিষ্ট কয়েকটা আর পরবর্তী বছরের দুই মাস; তারপর আবার বিজাপুরের শহরতলিতে ফিরলেন চৌদ্দ মাসের জন্য (মার্চ ১৬৯১ থেকে মে ১৬৯২)। তারপর আবার গলগলা তাঁর বাসস্থান হলো প্রায় তিন বছরের জন্য (মে ১৬৯২ থেকে মার্চ ১৬৯৫)।

অবশেষে বিজাপুরে পাঁচ সপ্তাহের (এপ্রিল-মে ১৬৯৫) পঞ্চম আর সর্বশেষ পরিদর্শন সেরে থিতু হলেন তিনি ভীমার দক্ষিণ তীরের ব্রহ্মপুরীতে আর সেটার নতুন নাম দিলেন ইসলামপুরী। এখানে বাস করলেন তিনি সাড়ে চার বছর (২১ মে ১৬৯৫ থেকে ১৯ অক্টোবর ১৬৯৯)। ইসলামপুরীর শিবিরে তাঁর পরিবারের ভার উজিরের ওপর ছেড়ে ১৬৯৯ সালের ১৯ অক্টোবর মারাঠি দুর্গগুলোর বিপক্ষে আওরঙ্গজেব বেরিয়ে পড়লেন এক অনন্ত অভিযানে এবং জীবনের শেষ বছরগুলো জীর্ণ করে আহমদনগর ফিরলেন (২০ জানুয়ারি, ১৭০৬) তিনি, কেবল এক বছর পর পরপারে পাড়ি জমাবার জন্য (২০ ফেব্রুয়ারি, ১৭০৭)।

১৫.২ মারাঠি পুনরুন্নয়ন, ১৬৯০-৯৫

১৬৮৮ আর ১৬৮৯ এই বছর দুটোতে সম্রাট লাভ করলেন অব্যাহত বিজয়। তার সেনাবাহিনী নিল বিজাপুর আর গোলকুণ্ডা রাজ্যের দুর্গ আর প্রদেশগুলোর দখল, অর্থাৎ সাগর (বেরাদের রাজধানী), রাইচুর আর আদোনি (পুবে), শেরা আর ব্যাঙ্গালোর (মহীশূরে), ওয়ান্দিওয়াশ আর কঞ্জিভেরাম (মাদ্ৰাজ কৰ্ণাটকে), বাঙ্কাপুর আর বেলগাঁ (সর্বদক্ষিণ-পশ্চিমে), পাশাপাশি রাইগড় (রাজধানী) এবং অন্যান্য মারাঠি দুর্গ। উত্তর ভারতেও জুটল লক্ষণীয় বিজয়: দমন করা হলো রাজারামের নেতৃত্বে জাঠ বিদ্রোহ আর হত্যা করা হলো (৮ জুলাই, ১৬৮৮) নেতাকে।

আওরঙ্গজেবের ঝামেলা আরও বাড়ল মারাঠিদের নির্দিষ্ট কোনো নেতা না থাকায়। বিভিন্ন জায়গায় তারা লড়াই করতে লাগল মোগলদের সঙ্গে তাদের লড়াই পরিণত হলো জনসাধারণের লড়াইয়ে। শম্ভুজীর পতনের পর শত্রুদের যেসব দুর্গ মোগলেরা দখল করেছিল বা কিনেছিল, সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে লাগল মারাঠিরা। স্রোত আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রথম ঘুরে গেল ১৬৯০ সালের মে মাসে, যখন মারাঠিরা তাঁর সেনাপতি রুস্তম খানকে বন্দী করে লুট করল তার পুরো শিবির।

১৬৯১ সালের শরতে জিনজির সামনে মোগলদের অবস্থা এমনই বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল যে সম্রাটকে সেখানে পাঠাতে হলো বড় বড় সেনাবাহিনী। ১৬৯২ সালে কিছুই অর্জন করতে পারল না সাম্রাজ্যবাদীরা পশ্চিম রঙ্গমঞ্চে, ওদিকে পুব উপকূলে বন্দী হলো দুই মোগল সেনাপতি আর শাহজাদা কাম বখশ। ১৬৯২ সালের অক্টোবর থেকে অসফলভাবে পানহালা অবরোধ করে থাকা শাহজাদা মুইজ-উদ-দীনকে শেষমেশ মারাঠিরা তাড়িয়ে দিল ১৬৯৪ সালের মার্চে। এসবের পাশাপাশি ছিল দেশরক্ষায় ব্রতী মারাঠি নেতাদের অবিরাম আক্রমণ–যাদের মধ্যে ছিল সান্তা ঘোড়পারে, ধানা যাদব, নিমা সিন্ধিয়া, হনুমন্ত রাও এবং অন্যান্য।

ইতিমধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিদার থেকে বিজাপুর আর রাইচুর থেকে মালখেদে কষ্টসহিষ্ণু উপজাতীয় বেরাদ গোত্রের কার্যকলাপ পিডিয়া নায়কের নেতৃত্বে এমনই বিপজ্জনক আকার ধারণ করল যে ১৬৯১ সালের জুন থেকে ১৬৯২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর একজন সেনাপতির অধীনে বিশাল এক সেনাবাহিনীকে অবস্থান করাতে হলো সাগরে। তখন বশ্যতা স্বীকার করল বেরাদ নেতা, কিন্তু তিন বছর পর আবার শুরু করল তার উগ্র কার্যকলাপ, ফলে আরেকটা বিশাল সেনাবাহিনী পাঠাতে হলো তার বিপক্ষে (১৬৯৬)। মোগল সেনাপতি বেশকিছু জয় পেল কেবল মাদ্রাজ কর্ণাটকে।

অবশেষে ১৬৯৫ সালের এপ্রিলের দিকে আওরঙ্গজেব উপলব্ধি করতে পারলেন যে আদিল শাহি আর কুতব শাহি রাজধানীর বিপক্ষে জয়লাভ করা সত্ত্বেও তিনি আসলে কিছুই অর্জন করতে পারেননি। এত দিনে তিনি বুঝতে পারলেন যে শিবাজী এমনকি শম্ভুজীর আমলের চেয়েও মারাঠা সমস্যা এখন ঘোরতর।

দিল্লি ফিরে যেতে পারলেন না আওরঙ্গজেব; দাক্ষিণাত্যে তাঁর কাজ এখনো শেষ হয়নি; সত্যি বলতে কি, এটা ছিল কেবল শুরু।

১৫.৩ ইসলামপুরীতে সম্রাটের অবস্থান, ১৬৯৫-৯৯

১৬৯৫ সালের মে মাসে তিনি তাঁর পুত্র শাহ আলমকে পাঠালেন সাম্রাজ্যের উত্তর দক্ষিণ অংশ (পাঞ্জাব, সিন্ধ আর পরে আফগানিস্তান) শাসন করতে আর পরবর্তী ৪.৫ বছরের জন্য নিজে আসন গাড়লেন ইসলামপুরীতে। এ সময় (১৬৯৫-৯৯) আরও দ্রুত এবং অপ্রত্যাশিত আক্রমণ চালাতে লাগল মারাঠিরা, ফলে মোগলেরা হয়ে পড়ল রক্ষণাত্মক। সম্রাটের নিজস্ব প্রতিনিধিরা অলিখিত শর্তে রাজস্বের এক চতুর্থাংশ (চৌথ) মারাঠিদের দিতে রাজি হলো বার্ষিক ব্ল্যাকমেইল হিসেবে। তারচেয়েও খারাপ অনেক সাম্রাজ্যবাদী অফিসার শক্রর সঙ্গে হাত মিলিয়ে, নিজেরা ধনী হতে লাগল সম্রাটের আপন প্রজা আর নিরীহ ব্যবসায়ীদের ধন অপহরণ করে। মোগল প্রশাসন আসলে ভেঙে পড়েছিল, কেবল তাঁর সমস্ত সেনাবাহিনী নিয়ে এই দেশে সম্রাটের উপস্থিতি সেটাকে টিকিয়ে রাখল কোনো মতে।

ইসলামপুরী আমলের প্রধান ঘটনাগুলো হলো-সান্তার হাতে মোগল দুই বড় সেনাপতি, কাশিম খান (নভেম্বর, ১৬৯৫) আর হিম্মত খানের (জানুয়ারি, ১৬৯৬)। বিনাশ, অন্তর্গত এক কলহে সান্তার হত্যাকাণ্ড (জুন, ১৬৯৭) মোগলদের জিনজি দখল (৭ জানুয়ারি, ১৬৯৮), আর মহারাষ্ট্রে রাজারামের প্রত্যাবর্তন।

১৫.৪ আওরঙ্গজেবের শেষ অভিযানসমূহ, ১৬৯৯-১৭০৫

শেষ ঘটনাগুলো আওরঙ্গজেবের শাসনপ্রণালিতে পরিবর্তন আনল । পুব উপকূলের দখল অবিসংবাদিত হয়ে যাওয়ায়, তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি এখন কেন্দ্রীভূত করতে পারলেন যুদ্ধের পশ্চিম রঙ্গমঞ্চে। শুরু হলো আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ অধ্যায়–একের পর এক মারাঠি দুর্গগুলো অবরোধ করলেন সম্রাট স্বয়ং। তার জীবনের এই শেষ অধ্যায় (১৬৯৯-১৭০৭) বোঝাই কেবল একই গল্পের ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিতে: অনেক সময়, মানুষ আর অর্থ ব্যয় করে একটা পাহাড়ে-দুর্গ দখল, কয়েক মাস পর দুর্বল মোগল সেনাদের হাত থেকে মারাঠিদের সেই দুর্গ পুনর্দখল, তারপর এক বা দুই বছরের মধ্যে আবার সেটার মোগল অবরোধ শুরু! বন্যার ভরা নদী, কর্দমাক্ত রাস্তা, আর ভাঙাচোরা পাহাড়ে পথ পেরোতে গিয়ে তাঁর সেনা আর অসামরিক পরিচারক-পরিচারিকারা ভোগ করল অবর্ণনীয় কষ্ট; মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম আর অনাহারে মারা গেল মালবাহী পশু; শিবিরে লেগেই থাকল শস্যের অভাব। তাঁর অফিসারেরা ক্লান্ত হয়ে পড়ল এই সিসিফাসমাফিক (Sisyphus) পরিশ্রমে; কারও উত্তর ভারতে ফেরার কথা ভোলামাত্র ফেটে পড়ে আওরঙ্গজেব তাকে উপহাস করলেন কাপুরুষ আর আরামপ্রিয় বলে। তার সেনাপতিদের পারস্পরিক ঈর্ষা ধ্বংস করে ফেলেছিল তাঁর আক্রমণগুলো, ঠিক যেমন উপদ্বীপের যুদ্ধে (Peninsular War) নেপোলিয়নকে ধ্বংস করে ফেলেছিল তার মার্শালদের ঈর্ষা। সুতরাং ফল লাভের আশায় প্রত্যেকটা আক্রমণ পরিচালনা করতে হলো স্বয়ং সম্রাটকে। আটটা দুর্গের অবরোধ- সাতারা, পার্লি, পানহালা, খেলনা, কোন্দানা, রাজগড়, তোরনা আর ওয়াজিনজেরা–তাঁকে ব্যস্ত রাখল সাড়ে পাঁচ বছর (১৬৯৯-১৭০৫)।

ওয়াজিনজেরার অবরোধই (৮ ফেব্রুয়ারি-২৭ এপ্রিল ১৭০৫) ছিল আটাশি বছরের বৃদ্ধ যোদ্ধার সর্বশেষ সামরিক অভিযান। এই দুর্গ দখলের পর দেবাপুরে অবস্থান করার সময় (মে থেকে অক্টোবর, ১৭০৫) মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন সম্রাট। পুরো শিবিরে ছড়িয়ে পড়ল হতাশা আর বিশৃঙ্খলা। শেষমেশ তাদের সনির্বন্ধ অনুরোধের কাছে হার মেনে আর মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেয়ে আওরঙ্গজেব আহমদনগরে ফিরলেন (২০ জানুয়ারি, ১৭০৬) এক বছর পর সেখানেই মরার জন্য।

১৫.৫ আওরঙ্গজেবের শেষ বছরগুলোর দুঃখ ও দুর্দশা

তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ছিল অবর্ণনীয় বিষণ্ণতায় ভরা। অর্ধ শতাব্দীর দীর্ঘ রাজত্ব তাঁর ছিল এক বিশাল ব্যর্থতা। দাক্ষিণাত্যের অনন্ত যুদ্ধ শূন্য করে ফেলেছিল তার কোষ; দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল সরকার; সেনারা বিদ্রোহ করেছিল তিন বছর ধরে বেতন না পেয়ে; রাজত্বের শেষ বছরগুলোতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠাতেন কেবল বাংলার সৎ আর সমর্থ দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খান, একমাত্র এই সহায়তাটি আসার অপেক্ষায় থাকতেন সম্রাট। সুদূর দক্ষিণের অফিসারদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল না, প্রশাসন হয়ে পড়েছিল শিথিল আর কলুষিত; সর্দার আর জমিদারেরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের জাহির করা নিয়ে ছিল ব্যস্ত, ফলে এমনকি আওরঙ্গজেব চোখ মুদবার আগেই দেশ ভরে গিয়েছিল বিক্ষোভ আর অরাজকতায়।

দাক্ষিণাত্যে মারাঠি প্রধানরা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যথাসাধ্য ক্ষতিসাধন করে চলেছিল সাম্রাজ্যবাদীদের। বারবার শত্রুর পিছু ধাওয়া করেও তাদের বিনাশসাধনে ব্যর্থ হচ্ছিল মোগল সেনারা।

প্রায় বিশ বছর ধরে চলা দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে প্রত্যেক বছর মোগল সেনা আর পরিচারক নিহত হয়েছিল এক লাখ করে আর তার তিন গুণ ঘোড়া, হাতি, উট আর বলদ। প্রায়ই মহামারী হানা দিচ্ছিল সাম্রাজ্যিক শিবিরে। দাক্ষিণাত্যের অর্থনৈতিক ধসের ষোলোকলা হয়েছিল পূর্ণ: ‘জমিতে ছিল না কোনো গাছ বা শস্য, সেই স্থান দখল করেছিল মানুষ আর পশুর হাড়গোড়। দেশ এমনই জনশূন্য হয়ে পড়েছিল যে অনেক সময় তিন বা চার দিনের ভ্রমণেও চোখে পড়ত না কোনো আগুন কিংবা আলো।’ (মানুচি)

১৫.৬ রাজারামের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকালীন মারাঠি সব মুখ্যমন্ত্রী আর সেনাপতি

শম্ভুজীর সন্তানেরা বন্দী হওয়ার পরের ভীষণ জাতীয় সংকটে মারাঠি জনসাধারণের প্রখর বুদ্ধিমত্তাই রক্ষা করল তাদের নিরাপত্তা আর স্বাধীনতা। সুতরাং এই সময়ের প্রায় রাজাহীন এই রাষ্ট্রের নেতাদের দিকে একটা নজর দেওয়া প্রয়োজন। এই সময়ে (১৬৮৯ সালের শেষের দিকে) মারাঠি রাষ্ট্রের মুখ্য ব্যক্তিবর্গ ছিল চারজন: পেশওয়া নীলকান্ত মোরেশ্বর পিঙ্গল, অমাত্য রামচন্দ্র নীলকান্ত বাবদেকর, সচিব শঙ্করাজী মলহার, আর মৃত প্রধান বিচারপতি নীরজী রাবজীর পুত্র প্রহ্লাদ। এই প্রহ্লাদ ছিল গোলকুণ্ডার মারাঠি কূটনীতিক। অধীনস্ত পদের অন্য তিনজন মানুষ তাদের বুদ্ধিমত্তা আর তৎপরতার গুণে মারাঠি ইতিহাসের এই সংকটে পরিণত হলো প্রথম শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় কর্মচারী আর জনপ্রিয় নেতাতে। তারা হলো ধানা সিংহ যাদব এবং সান্তাজী ঘোড়পারে (সেনাপতি পদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী), আর পরশুরাম জিম্বক, শেষমেশ যে প্রতিনিধির পদ পেয়েছিল ১৭০১ সালে।

যোগ্য সেনাপতি জুলফিকার খান মারাঠি রাজধানী রাইগড় অবরোধ করল ১৬৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু এটার পতনের (১৯ অক্টোবর) আগেই নিহত শম্ভুজীর উত্তরাধিকারী সদ্য সিংহাসনে আসীন রাজারাম ৫ এপ্রিল হিন্দু এক যোগীর ছদ্মবেশে দুর্গ থেকে বেরিয়ে চলে গেল পানহালায়। রামচন্দ্র তাকে পরামর্শ দিল যে বিজ্ঞ কৌশল হবে শক্রর শক্তিকে বিভক্ত করে ফেলা, আর সেটা করার জন্য মারাঠিদের এক অংশের কার্যকলাপ স্থানান্তরিত করতে হবে পুব কর্ণাটকের ওপারে, অন্য অংশ মোগলদের ব্যস্ত রাখবে পশ্চিমে।

ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হলো এভাবে: পুব প্রদেশের দায়িত্ব নিয়ে রাজারাম থাকবে জিনজিতে। স্বদেশের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকবে রামচন্দ্র নীলকান্ত বাবদেকরের (অমাত্য) ওপর যার নতুন উপাধি হলো হুকুমত-পানাহ বা একনায়ক এবং যার সদর দপ্তর হবে প্রথমে বিশালগড় আর তারপর পার্লিতে, তাকে সহায়তা করবে শঙ্করাজী মলহার (সচিব) আর অন্যান্য কয়েকজন নির্দিষ্ট অফিসার । স্বদেশের সমস্ত কর্মকর্তা আর ক্যাপটেন রামচন্দ্রের আদেশেই চলবে আর তাকে মানবে ঠিক একজন রাজার মতো। রামচন্দ্রের ছিল নেতৃত্ব আর সংগঠনের এক জন্মগত প্রতিভা। সমস্ত যোগ্য লেফটেন্যান্টকে সে জড়ো করল তার পাশে, ঈর্ষাপরায়ণ ও কলহপ্রিয় গেরিলা নেতাদের কাজ করাতে পারল হাতে হাত মিলিয়ে।

১৬৮১ সালের ১ নভেম্বর জিনজি পৌঁছে সরকারের কর্তৃত্ব রাজারাম নিল হরজী মহাদিকের বিধবা আর পুত্রের অনিচ্ছুক হাত থেকে আর পূর্ণ একটা সভা গঠন করে রাজত্ব করতে লাগল রাজার মতো, যদিও চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মধ্যে । পেশওয়া নীলকান্ত মোরেশ্বর পিঙ্গল তার প্রভুর সঙ্গে জিনজি এলেও তাকে থাকতে হলো দ্বিতীয় অবস্থানে রাজার প্রধান উপদেষ্টা আর প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী হলো প্রহ্লাদ নীরজী, তাকে ভূষিত করা হলো উচ্চ খেতাবে (প্রতিনিধি), ফলে সে রইল আটজন মন্ত্রী (অষ্ট-প্রধান) সংবলিত মন্ত্রিসভার বাইরে আর সবার ওপর।

১৫.৭ ১৬৮৯ সালে আওরঙ্গজেবের সাফল্য আর কর্মপন্থা

রাজারাম মহারাষ্ট্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময়েই অনেক মারাঠি দুর্গ দখল করেছিলেন আওরঙ্গজেব আর দ্রুত অন্যগুলো দখল করছিলেন অর্থ বা বাহুবলে । ইতিমধ্যেই দখল করা হয়েছিল সর্ব উত্তরের শালহির (২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬৮৯) আর ত্রিম্বক (৮ জানুয়ারি, ১৬৮৯), কেন্দ্রের সিংহ-গড় (নভেম্বর, ১৬৮৪) আর রাজগড় (মে, ১৬৮৯); বছর শেষ হওয়ার আগেই পতন হলো রাইগড় আর পানহালার, ওদিকে উত্তর কঙ্কানের অনেক জায়গা দখল করল তার যোগ্য প্রতিনিধি মাতবর খান। মধ্য আর দক্ষিণ কঙ্কানের অন্তর্দেশীয় অংশগুলো মারাঠি অধিকারে থাকলেও উপকূলের বেশির ভাগই চলে গেল মোগলদের হাতে। মারাঠিরা হারাতে বাধ্য হলো চউলের বন্দর, অপসারণ করতে বাধ্য হলো খান্দেরি দ্বীপের ডিপো, আর তাদের নৌ সদর দপ্তর স্থানান্তর করতে হলে আরও দক্ষিণের ঘেরিয়া বা বিজয়দুর্গে।

১৬৮৯ সালে অনেক মারাঠি দুর্গ সহজেই চলে গেল আওরঙ্গজেবের হাতে। অধিকার করতে চাইলেন তিনি পরাজিত আদিল শাহি আর কুতব শাহি রাজ্যের সমৃদ্ধ আর সীমাহীন সম্পদ। সুতরাং ১৬৮৯, ১৬৯০ আর ১৬৯১ সালে দক্ষিণ আর পুবের সমভূমিতে আওরঙ্গজেব অত্যন্ত ব্যস্ত রইলেন তার সংস্থানগুলো পশ্চিমের নিষ্ফলা পাহাড়ে-দুর্গগুলোতে নিয়ে যেতে।

১৫.৮ মারাঠি পুনরুন্নয়ন : রুস্তম খানের বন্দিত্ব, মে, ১৬৯০; পানহালা অবরোধ

কিন্তু ১৬৯০ সালে দেখা গেল মারাঠি পুনরুন্নয়নের চিহ্ন। প্রথম বিশিষ্ট জয়লাভ করল তারা ১৬৯০ সালের ২৫ মে। সম্রাটের জন্য সাতারা দুর্গ দখলের পরিকল্পনায় পরিবার আর সেনাদল নিয়ে সেটার আশপাশে ঘুরঘুর করছিল মোগল সেনাপতি রুস্তম খান। এই সময় রামচন্দ্র, শঙ্করাজী, সান্তা, ধানা প্রমুখ মারাঠি নেতারা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। অনেকগুলো জখম হওয়ার পর হাতির পিঠ থেকে নিচে পড়ে বন্দী হলো রুস্তম খান। মারা গেল পনেরোশো মোগল । পাশাপাশি মারাঠিরা পেল ৪,০০০ ঘোড়া, আটটা হাতি আর রুস্তমের সেনাবাহিনীর লটবহর। ষোলো দিন পর রুস্তম খান তার বন্দিত্ব মোচন করল এক লাখ টাকার মুক্তিপণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। তারপর রামচন্দ্র আর শঙ্করাজী ওই একই বছর (১৬৯০) পুনরুদ্ধার করল প্রতাপগড়, রোহিরা, রাজগড় আর তোরনা দুর্গ। রাইগড়ের পতনের পর পানহালার মারাঠি সেনারা হতোদম হয়ে দুর্গটা বিক্রি করেছিল (ডিসেম্বরের দিকে) সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে। কিন্তু মোগল সেনারা সেটা ধরে রাখার ব্যাপারে এমনই অবহেলা করল যে পরশুরামের অধীন মারাঠিরা। পরে তা সহজেই পুনরুদ্ধার করল আচমকা আক্রমণ চালিয়ে (১৬৯২ সালের মাঝামাঝি)।

১৬৯২ সালের অক্টোবর থেকে ১৬৯৪ পর্যন্ত শাহজাদা মুইজ-উদ-দীন। পানহালায় চালালেন এক ব্যর্থ অবরোধ। আসলে ১৬৯৩ সালের অক্টোবরেই অবরোধ ভেঙে দিয়েছিল ধানা যাদব, কিন্তু তার পরও শাহজাদা ঢিলেঢালা অবরোধ চালিয়ে গেছেন স্রেফ সম্রাটের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য।

১৬৯৪ সালের মার্চে সম্রাটের অনুমতি মিলতে ফিরে গেলেন শাহজাদা। তারপর বিদার বখতের (শাহজাদা মো. আজমের জ্যেষ্ঠ পুত্র) ওপর পড়ল অবরোধের ভার। গলগলার সভা থেকে তিনি রওনা হলেন ৫ এপ্রিল।

১৬৯৬ সালের জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত এলোমেলো এক অবরোধ চালালেন শাহজাদা, কিন্তু এই সময় আরও দক্ষিণে কাশিম খান আর হিম্মত খানের সর্বনাশা দুর্ঘটনা ঘটতে সম্রাট তাঁকে পাঠালেন বাসবপাটানে। তারপর পানহালা অবরোধের ভার পড়ল ফিরুজ জংয়ের কাঁধে, কিন্তু সে-ও মোটেই সুবিধা করতে পারল না।

১৫.৯ সান্তাজী ঘোরপারে আর ধানা যাদবের সঙ্গে লড়াই, ১৬৯৪-৯৫

১৬৯৩ সালের শেষের দিকে পশ্চিমে নতুন করে আবার শুরু হলো মারাঠি কার্যকলাপ। অমৃত রাও নিম্বলকর ভীমা পেরিয়ে গেল মোগল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাতে। তার পিছু নিল হিম্মত খান কিন্তু তাকে ধরতে পারল না। একই সময় পানহালার সামনের মোগল সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাল ধানা, শঙ্করাজী এবং অন্যান্য নেতা। সান্তা ঘোড়পারে জিনজি থেকে ফিরে আবার আক্রমণ শুরু করল স্বদেশে। ধাওয়া করে সান্তা আর তার বেরাদ মিত্রদের ওপর হিম্মত খান একটা বিশিষ্ট বিজয় অর্জন করল (১৪ নভেম্বরের দিকে) বিক্রমহালি গ্রামে। তারপর শুরু হলো মোগল সেনাপতিদের কলহ: শত্রুর পেছনে হিম্মত খানকে একা রেখে কুলবর্গার দিকে ফিরে এল হামিদ-উদ-দীন আর খাজা খান। ফলে সান্তা এবার তার বাহিনীকে দুই ভাগ করে অমৃত রাওয়ের অধীনে ৪,০০০ সেনা পাঠাল বেরাদ আক্রমণ করতে, আর নিজে ৬,০০০ অশ্বারোহীসহ এগোল মালখেদের দিকে। তারপর অনেক মাস ধরে বিশৃঙ্খল লড়াই চালাল মোগলরা, তবে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারল না।

১৬৯৪ আর ১৬৯৫ সালে মারাঠি আর বেরাদেরাও পেল না তেমন কোনো সাফল্য, কিন্তু ১৬৯৫ সালের শেষের দিকে সান্তা হত্যা করল প্রথম সারির দুই মোগল সেনাপতি কাশিম খান আর হিম্মত খানকে।

১৫.১০ পূর্ব কৰ্ণাটক, এটার বিভাগ ও ইতিহাস

পূর্ব বা মাদ্ৰাজ কৰ্ণাটককে অবশ্যই পশ্চিম কর্ণাটক বা বোম্বে প্রেসিডেন্সির কানারিভাষী অংশ থেকে আলাদা করে দেখা উচিত। ১৭ শতাব্দীর শেষের দিকে এটা পালার নদী বা ভেলোর থেকে মাদ্রাজ পর্যন্ত একটা কাল্পনিক রেখায় বিভক্ত ছিল। এই দুই অংশকে বলা হতো হায়দরাবাদি কর্ণাটক আর বিজাপুরী কর্ণাটক, আর প্রত্যেকটা অংশকে আবার ভাগ করা হয়েছিল উচ্চভূমি অঞ্চল (ফারসি ভাষায়-বালাঘাট) আর সমভূমি অঞ্চলে (পেয়িনঘাট)। হায়দরাবাদি উচ্চভূমি অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল সিধুট, গাণ্ডিকোটা, গুটি, গরমকোন্দা আর কাড়াপা; বিজাপুরী বালাঘাটের অন্তর্গত ছিল মহীশূর জেলার শেরা আর ব্যাঙ্গালোর এবং সেগুলোর অধীন জমিদারি। নিমভূমি অঞ্চলে হায়দরাবাদি কর্ণাটক বিস্তৃত ছিল গার থেকে সাম্রাজ্যের সমুদ্র উপকূলে; বিজাপুরী পেয়িনঘাট বিস্তৃত ছিল দক্ষিণের সাদ্রাজ থেকে তাঞ্জোর পর্যন্ত। কিন্তু বিজয় সেখানে সুদৃঢ় ছিল না; দেশের বেশির ভাগ ছিল ছোটখাটো স্থানীয় সর্দারদের হাতে। আদিল শাহের হাতে ছিল কেবল নির্দিষ্ট কিছু দুর্গ আর সেগুলোর আশপাশ। পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করল যখন শিবাজীর সেই দেশ দখলের (১৬৭৭-৭৮) ফলে নতুন একটা মারাঠা সরকার সৃষ্ট হলো দক্ষিণ আরকট জেলায় (রাজধানী, জিনজি)। শিবাজী সেখানে রাজ্যপাল হিসেবে বসাল রঘুনাথ নারায়ণ হনুমন্তকে। সিংহাসনারোহণের পরপরই শম্ভুজী বরখাস্ত এবং বন্দী করল রঘুনাথকে (১৬৯১ সালের জানুয়ারির শুরুতে), আর জিনজি শাসনের জন্য পাঠাল তার আপন ভগ্নিপতি হরজী মহাদিককে। কিন্তু মারাঠি রাজার কলুষিত চরিত্র আর আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত নির্দেশে পরিচালিত মহারাষ্ট্রের ওপর ক্রমবৃদ্ধিমান মোগল চাপের ফলে শম্ভুজীর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ল। মহারাজা উপাধি নিয়ে রাইগড়ে উদ্বৃত্ত রাজস্ব পাঠাতে অবহেলা করতে লাগল হরজী।

১৬৮৬ সালের অক্টোবরে শম্ভুজী ১২,০০০ অশ্বারোহীসহ কেশো ব্রিক পিঙ্গলকে পাঠাল অবাধ্য হরজী রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার গোপন আদেশ দিয়ে। কেশো ত্রিম্বক জিনজির কাছাকাছি এল ১৬৮৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু স্থানীয় সেনারা তত দিনে হরজীর প্রতি পুরো নিবেদিত হয়ে পড়েছে। কোনো লাভ হবে

বুঝে ১৮,০০০ অশ্বারোহীসহ কেশো গেল মহীশূরে। কিন্তু সেখানেও মোটেই সুবিধা করতে না পেরে শিগগিরই ফিরে এল জিনজির কাছাকাছি।

১৫.১১ পূর্ব কর্ণাটকে মোগলদের প্রবেশ, ১৬৮৭

গোলকুণ্ডা বিজয়ের পর আওরঙ্গজেব কিছুদিন ভূতপূর্ব কুতব শাহি অফিসারদের নিজ নিজ পদে বহাল রাখলেন, যা ছিল তার একটা বিজ্ঞ পদক্ষেপ। সর্বপ্রধান গোলকুণ্ডা অমাত্য মুহম্মদ ইব্রাহিমকে মহব্বত খান নাম দিয়ে তিনি নিয়োগ দিলেন হায়দরাবাদের সুবাদার হিসেবে, আর খানের অন্তরঙ্গ বন্ধু মুহম্মদ আলী বেগকে আলী আসকর খান নাম দিয়ে নির্বাচিত করলেন কুতব শাহি কর্ণাটকের ফৌজদার, যার অধীনে থাকল অন্যান্য কিলাদার এবং চিঙ্গলপাট, কঞ্জিভেরাম আর পুনামালির শাসকবর্গ। এই অফিসারেরা আওরঙ্গজেবকে তাদের সার্বভৌম নেতা হিসেবে মেনে নিল (অক্টোবর, ১৬৮৭)। কিন্তু শিগগিরই পরিবর্তিত হলো সম্রাটের মন; মহব্বত খানের পরিবর্তে হায়দারবাদের সুবাদার হলো রুহুল্লাহ খান, আর আলী আসকরের স্থলে কাশিম খানকে কর্ণাটকে পাঠানো হলো মারাঠিদের বিরুদ্ধে প্রবল যুদ্ধ করার জন্য (জানুয়ারি, ১৬৮৮)।

মোগলেরা গোলকুণ্ডা জয় করলেও তখনো সেখানকার দুর্গগুলো সুদৃঢ় করে উঠতে পারেনি বলে ২,০০০ অশ্বারোহী আর ৫,০০০ পদাতিক নিয়ে এগিয়ে হরজী দখল করে নিল সেই অঞ্চলের বেশ কয়েকটা দুর্গ আর একশোটা শহর। ২৪ ডিসেম্বর দখল করা হলো আরকট। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে লুটপাট চালাতে লাগল মারাঠিরা। পরিবার আর সম্পদ রক্ষার্থে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে কঞ্জিভেরামের বেশ কয়েকজন উচ্চবংশজাত ব্রাহ্মণ আশ্রয় নিল (২৭ ডিসেম্বর, ১৬৮৭-১০ জানুয়ারি, ১৬৮৮) মাদ্রাজে । ১১ জানুয়ারি মারাঠিরা কঞ্জিভেরাম শহরে হামলে পড়ে, প্রায় ৫০০ জন লোক হত্যা করে, ধ্বংস করল বাড়িঘর, পালিয়ে গেল আতঙ্কিত অধিবাসীরা। কেশো ব্রিম্বকও তার দলবল নিয়ে চালাতে লাগল এই লাভজনক ব্যবসা; চিৎপট আর কাবেরীপাক দখল করে শিবির পাতল সে কঞ্জিভেরামে (জানুয়ারি, ১৬৮৮)।

কিন্তু মারাঠিদের এই দখল হলে ক্ষণস্থায়ী। আওরঙ্গজেব ভূতপূর্ব গোলকুণ্ডা সরকারের চারজন বড় সেনাপতি ইসমাইল খান মাকা, ইয়াচাপা নায়ক, রুস্তম খান, আর মুহম্মদ সাদিককে অবিলম্বে কর্ণাটকে যাওয়ার আদেশ দিলেন সম্রাটের প্রতিরক্ষা দলের শক্তি বৃদ্ধি করতে। তারা কঞ্জিভেরামে গেল ১৬৮৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। শহর খালি করে দিল মারাঠিরা; মোগলদের সর্বাগ্রভাগ তেড়ে গিয়ে যুদ্ধ করল তাদের সঙ্গে, ওয়ান্দিওয়াশ দখল করে শিবির পাতল সেখানে। মারাঠিরা শিবির পাতল চিৎপটে, দক্ষিণের একদিনের হাঁটাপথ দূরত্বে। দুই দলের সেনারা এভাবেই থেকে গেল এক বছর, কেবল লক্ষ করতে লাগল একে অপরের গতিবিধি, কিন্তু লুটপাটকারী দল তারা পাঠাতে লাগল প্রতিদিন। ফলে দুর্ভাগা মানুষদের এবার একটার বদলে পড়তে হলো দুই দল ডাকাতের কবলে। ধ্বংস হয়ে গেল জেলাটার ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্ধ হয়ে গেল শিল্প, দুর্লভ হয়ে পড়ল শস্য আর তেলবীজ। অনেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল উপকূলের শক্তিশালী ইয়োরোপীয় উপনিবেশে।

১৬৮৯ সালে গত বছরের মতোই কর্ণাটকের দুরবস্থা অব্যাহত রইল। হরজী মারা গেল ১৯ সেপ্টেম্বরের দিকে। তার স্ত্রী অম্বিকা বাই (শিবাজীর মেয়ে) দুর্গ আর প্রদেশ শাসন করে চলল তার নাবালক পুত্রদের পক্ষে।

১৫.১২ জিনজিতে রাজারাম

রাজারাম জিনজিতে উপস্থিত হওয়ার (১ নভেম্বর, ১৬৮৯) পরপরই ঘটল একটা শান্তিপূর্ণ বিপ্লব। হরজীর বিধবা আর তার ব্রাহ্মণ উপদেষ্টারা আট বছরের অনধিকার কর্তৃত্ব আর স্থানীয় স্বাধীনতা হাতছাড়া করতে চাইছিল না। কিন্তু রাজারামের অধিকারও অস্বীকার করার নয়: জিনজির সরকার চলে গেল তার হাতে। বন্দী করা হলো হরজীর পুত্রকে আর টাকা দাবি করা হলো তার বিধবার কাছে। তাকে তিন লাখ হুন আর সান্তাজী ভোঁসলেকে এক লাখ দিয়ে শান্তি স্থাপন করল মহিলা। প্রতিনিধি প্রহ্লাদ নীরজী রাজারামকে নিক্ষেপ করল এক লাম্পট্যের জীবনে, এবং অবিরাম রাখল তাকে গাঁজা আর আফিমের নেশায় বুঁদ করে।

জিনজির মন্ত্রীরা টাকা তুলতে চাইল পুব উপকূলের ইয়োরোপীয় উপনিবেশ থেকে; ধনী ব্যবসায়ীদের প্রত্যেককে দিতে অনুরোধ করা হলো ৫,০০০ বা এমনকি ১,০০০ হুন। সম্রাটের কাজে নিযুক্ত করা হায়দরাবাদের স্থানীয় অফিসাররা, অর্থাৎ, মুহম্মদ সাদিক, ইয়াচাপা নায়ক আর ইসমাইল মাকা, সম্রাটের পুরনো কর্মচারীদের এনে তাদের স্থলাভিষিক্ত করা হতে পারে ভেবে নতুন প্রভুর পক্ষ ত্যাগ করে হাত মেলাল রাজারামের সঙ্গে, তারপর শুরু করল সেই দেশে অনধিকার হস্তক্ষেপ আর রাজস্ব আদায়। মাদ্রাজ থেকে কুনিমেডুর সম্রাটের প্রতিনিধিরা তাদের সঙ্গে পেরে না উঠে পালাতে বাধ্য হলো উপকূলের ইয়োরোপীয় উপনিবেশে (এপ্রিল)। এই বিদ্রোহ শেষ হলো কেবল মোগল সর্বাধিনায়ক জুলফিকার খানের আগমনে, আগস্টে এসে পৌঁছাল সে কঞ্জিভেরামে আর জিনজিতে সেপ্টেম্বরের শুরুতে।

সামরিক পরিস্থিতি গেল পাল্টে; মারাঠি আক্রমণকারী দলগুলোকে তাড়িয়ে দিল মোগলেরা, আর রাজারামের রাজত্বই হলো হুমকির সম্মুখীন। আতঙ্কিত রাজারাম জিনজি ত্যাগ করে চলে গেল কর্ণাটকের আরও দক্ষিণে, তার মিত্র তাঞ্জোরের রাজার কাছাকাছি। জিনজি থেকে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত এই দেশ সুষ্ঠিত হতে লাগল উভয় পক্ষের পরিচারক আর দূতদের হাতে। নিরাপত্তার কারণে স্থানীয় মানুষজন তাদের পরিবার নিয়ে পালাল হয় তাঞ্জোরে, নয়ত উপকূলের ইয়োরোপীয় কারখানাগুলোতে।

১৫.১৩ জিনজি অবরোধের শুরু

জিনজির পাহাড়ে-দুর্গ একটামাত্র দুর্গ ছিল না, ওটা আসলে ছিল তিনটে দুর্গের সমাহার-রাজগিরি, কৃষ্ণগিরি আর চন্দ্রায়নদুর্গ। সবই টিলার ওপর, পথ এতই খাড়া আর বড় বড় পাথরখণ্ডে বোঝাই যে সেদিক দিয়ে ওঠা প্রায় অসাধ্য। এটার দরজা আছে তিনটে: উত্তরের দেয়ালেরটাকে বর্তমানে বলে ভেলোর বা আরকট দরজা, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে সেটাকে বলত ত্ৰিনোমালি দরজা; পুবেরটাকে বর্তমানে বলে পণ্ডিচেরী দরজা, দুর্গে প্রবেশের এটাই মূল দরজা ছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে; আর এই দ্বিতীয় দরজার সোজা পশ্চিমে আছে ছোট একটা খিড়কি দরজা, ভারতীয়রা যেটাকে বলে শয়তান-দ্বারি।

জুলফিকার খান জিনজিতে উপস্থিত হলো ১৬৯০ সালের সেপ্টেম্বরের শুরুতে, কিন্তু সেখানে অবরোধ চালানো বা গোলা নিক্ষেপের উপযুক্ত বড় কামান কিংবা যুদ্ধোপকরণ তার কাছে ছিল না। ওদিকে প্রথম আতঙ্ক কাটিয়ে উঠল মারাঠিরা। পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজারাম ফিরল জিনজিতে।

১৬৯১ সালের এপ্রিলের পর থেকে মোগলরা দ্রুত হারাতে লাগল তাদের সামরিক প্রভুত্ব, পক্ষান্তরে বাড়তে লাগল মারাঠি কার্যকলাপ, বিচ্ছিন্ন করে দিল তারা জুলফিকারের শিবিরে আসা শস্যের সরবরাহ। তাই জরুরি শক্তিবৃদ্ধির আবেদন করল সে। বিশাল এক সেনাবাহিনীসহ সেনাপতির বাবা উজির আসাদ খান আর ওয়াজিনজেরা থেকে শাহজাদা কাম বখশ জিনজি এসে পৌঁছালেন ১৬৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।

ইসমাইল খান মাকাকে প্রলোভন দেখিয়ে আবার ফিরিয়ে আনা হলে সম্রাটের পক্ষে, নিজ দলবল নিয়ে যোগ দিল সে জুলফিকারের শিবিরে। ১৬৯২ সালে জুলফিকার শুরু করল জিনজি অবরোধ, কিন্তু মোটেই সুবিধা করতে পারল না।

১৬৯২ সালের বর্ষাকালে মোগল শিবিরের অবস্থার একজন প্রত্যক্ষদর্শী বর্ণনা দিয়েছে এভাবে: ‘অবিরাম চলছে মুষলধারে বৃষ্টি। শস্য মিলছে না। ট্রেঞ্চে দিনরাত কাটানো সেনাদের কষ্টের সীমা নেই; পুরো অঞ্চলটাই যেন পরিণত হয়েছে একটা হ্রদে।

১৫.১৪ সান্তা ঘোড়পারে আর ধানা যাদবের হাতে বন্দী আলী মর্দান আর ইসমাইল খান, ১৬৯২

মোগলদের টিকে থাকাও কষ্টকর হয়ে উঠল শীতে। ডিসেম্বরের শুরুতে রামচন্দ্রের পশ্চিম ভারতে গড়া ৩০,০০০ অশ্বারোহীর এক বিশাল মারাঠি বাহিনী পূর্ব কর্ণাটকে এসে পৌঁছাল বিখ্যাত সেনাপতিদ্বয় ধানা সিংহ যাদব আর সান্তা ঘোড়পারের অধীনে।

প্রথমে মারাঠি অশ্বারোহী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল কঞ্জিভেরাম জেলার ওপর। আতঙ্কিত অধিবাসীরা আশ্রয়ের জন্য ছুটে গেল মাদ্রাজে। সান্তার অধীন বাহিনী কাবেরীপাকের কাছে যেতে তার মোকাবিলা করতে এল কঞ্জিভেরামের মোগল ফৌজদার আলী মর্দান খান। কিন্তু তার ছোট বাহিনীকে ঘিরে ফেলে তাকে বন্দী করা হলো ১,৫০০ ঘোড়া আর ছয়টা হাতিসহ । লুট করা হলো (১৩ ডিসেম্বর) তার সেনাবাহিনীর যাবতীয় সম্পদ আর জিনিসপত্র। আলী মর্দান খানকে নিয়ে যাওয়া হলো জিনজিতে, আর বন্দিদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করল সে এক লাখ হুনের বিরাট পণ দিয়ে।

ধানা যাদবের অধীন অপর মারাঠি বাহিনী আক্রমণ চালাল জিনজির চারপাশে। জুলফিকার বুদ্ধিমানের মতো তার ছোট বাহিনীগুলোকে আদেশ দিল তার মূল বাহিনীর সঙ্গে এসে যোগ দিতে। কিন্তু ইসমাইল খানের দল ছিল বেশ খানিকটা দূরে। দশ গুণ বেশি শক্রর সঙ্গে বীরের মতো যুদ্ধ করল ইসমাইল খান, কিন্তু আহত হয়ে শেষমেশ বন্দী হলো সে ৫০০ ঘোড়া আর দুটো হাতিসহ এবং বন্দী অবস্থাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো জিনজিতে।

১৫.১৫ মারাঠিদের সঙ্গে শাহজাদা কাম বখশের ষড়যন্ত্র; তার গ্রেপ্তার

দেশের চারপাশে মারাঠিদের উজ্জীবিত কার্যকলাপে বন্ধ হয়ে গেল মোগল শিবিরে শস্যের সরবরাহ। বন্ধ হয়ে গেল সম্রাটের দরবার থেকে চিঠি আসাও। শাহজাদা কাম বখশ ছিলেন তাঁর পিতার বৃদ্ধ বয়সের এক বখাটে ছেলে, আবেগের লাগাম চাপতে জানতেন না, খামখেয়ালির দোলায় দুলতেন সর্বক্ষণ, আর শুনতেন প্রিয় কিছু বাজে ছোকরার পরামর্শ। গোপনে যোগাযোগ করলেন তিনি রাজারামের সঙ্গে। শিগগিরই জুলফিকার খান জেনে ফেললেন শাহজাদার এই গোপন কথা, আর তার ওপর কড়া নজর রাখার অনুমতি চেয়ে নিলেন সম্রাটের কাছ থেকে। ওদিকে দরবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আশঙ্কাজনক এক গুজব রটল যে আওরঙ্গজেব মারা গেছেন আর সিংহাসনে বসেছেন শাহ আলম। এই গুজবে কাম বখশ নিজেকে মনে করলেন এক অতি বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে। আসাদ আর জুলফিকার তার শত্রু; নতুন সম্রাটের অনুগ্রহ লাভের আশায় তারা বন্দী করবে কাম বখশকে। তার পরামর্শদাতারা পরামর্শ দিল যে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো রাজারামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পরিবারসহ রাতের আঁধারে তার দুর্গে পালিয়ে যাওয়া, আর তারপর মারাঠিদের সহায়তায় দিল্লির সিংহাসন লাভের চেষ্টা করা।

এই কথাও আসাদ খানকে জানাল তার গুপ্তচরেরা। উজির আর তার ছেলে আলোচনা করল সম্রাট-বাহিনীর নেতৃস্থানীয় অফিসারদের সঙ্গে; সবাই একবাক্যে অনুরোধ করল শাহজাদার ওপর কড়া নজর রাখতে।

এবার শাহজাদা তাঁর হাবা সভাসদদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন যে দুই সেনাপতিকে গ্রেপ্তার করে দখল করতে হবে সর্বময় ক্ষমতা। যথারীতি এই ষড়যন্ত্রও ফাস হতে দেরি হলো না। জুলফিকার খান আর তার বাবা সিদ্ধান্ত নিল যে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা আর সম্রাটের সম্মান রক্ষার স্বার্থে কাম বখশকে আর কোনো দুরভিসন্ধি করতে দেওয়া যেতে পারে না। দ্রুত এগোল তারা শাহজাদাকে গ্রেপ্তার করতে।

রেগে আগুন হয়ে উজির বলল, শাসন বা যুদ্ধ কোনোটাই করার যোগ্যতা আপনার নেই। আপনি নিজের সম্মান হারিয়েছেন, আমার পাকা চুলেও লেপে দিয়েছেন অপমানের চুনকালি।’ বন্দীকে আসাদ খানের খাস তাঁবুতে নিয়ে গিয়ে করা হলো সদয় আচরণ। আপাতত নিয়ন্ত্রণহীনতা থেকে রক্ষা পেল মোগল সেনাবাহিনী।

সান্তাজী ঘোড়পারে আলী মর্দান খানের সঙ্গে বিশিষ্ট বিজয় অর্জন করার পর জিনজি উপস্থিত হলো জুলফিকার খানের মোকাবিলা করতে। প্রতিদিন চলতে লাগল যুদ্ধ; শত্রুসেনার সংখ্যা ২০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে, পক্ষান্তরে সম্রাট-বাহিনী অনেক ছোট, যার মধ্যে অনেকে আবার শাহজাদার পাহারায় ব্যস্ত। প্রতিরক্ষায় কোনো রকম সহযোগিতা করল না কাম বখশের বাহিনী। ফলে যুদ্ধের সমস্ত চাপ গেল জুলফিকার খান আর অন্য কয়েকজন মনসবদারের মাত্র ২,০০০ অশ্বারোহীর ওপর দিয়ে।

১৫.১৬ জুলফিকারের সেনাবাহিনীতে দুর্ভিক্ষ, তার জিনজি থেকে ওয়ান্দিওয়াশে পশ্চাদপসরণ

দুর্ভিক্ষ দেখা দিল মোগল সেনাবাহিনীতে। নিজ বাহিনী নিয়ে জুলফিকার রওনা দিল ওয়ান্দিওয়াশ থেকে শস্য আনতে। ২০,০০০ সেনা নিয়ে সান্তা তার পথরোধ করল দেশুড়ে। তুমুল যুদ্ধের পর মোগলরা রাতে পৌঁছাল দেড় দুর্গে। পরদিন সকালে আবার রওনা দিতে বিরাট এক বাহিনী নিয়ে আবার আক্রমণ চালাল মারাঠিরা। কিন্তু দলপতের অসীম সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের জন্য মারাঠিরা পিছু হটতে বাধ্য হলো।

তাই গোপন যোগাযোগের মাধ্যমে রাজারামকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে চাইল আসাদ খান, যার বিনিময়ে নিরাপদে সেনাদের সে যেতে দেবে ওয়ান্দিওয়াশে । রাজারাম রাজি হলো। ওদিকে দলপত জুলফিকারকে বলল তার জন্য অপমানকর এই প্রস্তাব মেনে না নিতে। কিন্তু জুলফিকারের উপায় ছিল না। দীর্ঘ অনাহারে ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছিল বেশির ভাগ ঘোড়া, উট এবং অন্যান্য মালবাহী পশু। তিন দিনে সম্রাট-বাহিনী ওয়ান্দিওয়াশে পৌঁছাল ১৬৯৩ সালের ২২ বা ২৩ জানুয়ারি। আবার পর্যাপ্ত খাবার পেল মোগল সেনারা, দরবারের এই সংবাদ পেয়েও তারা আশ্বস্ত হলো যে সম্রাট জীবিত আছেন। জুলফিকার চার মাসের জন্য তার শিবির পাতল ওয়ান্দিওয়াশে (ফেব্রুয়ারি-মে, ১৬৯৩)। আসাদ খান ১১ জুন। শাহজাদা কাম বখশকে নিয়ে গেল গলগলার সম্রাট শিবিরে।

১৫.১৭ ১৬৯৩-৯৪ সালে কর্ণাটকে কার্যকলাপ

গোলকুণ্ডার প্রাক্তন সেনাপতি আর স্থানীয় একজন জমিদার, ইসমাইল খান মাকা যোগ দিল মোগলদের সঙ্গে। মার্চে ত্রিচিনোপলি অবরোধ করল সান্তাজী ঘোড়পারে; কিছুদিন পর রাজারামও পৌঁছাল সেখানে। তারপর শুরু হলো মারাঠিদের এক কলহ। অসহ্য হয়ে উঠল সান্তাজীর রাগ, আর রাগ করেই সে চলে গেল মহারাষ্ট্রে, তার পরিবর্তে সেনাপতি করা হলো ধানাজীকে।

১৬৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে জুলফিকার রওনা দিল দক্ষিণ আরকট জেলা দখল করতে। পণ্ডিচেরীর ১৮ মাইল উত্তরের পেরু-মাক্কাল দুর্গ তার হয়ে দখল করল দলপত রাওয়ের বুন্দেলারা। তারপর পণ্ডিচেরী হয়ে রওনা দিল সে তাঞ্জোরের দিকে, দখল করল দক্ষিণ আরকট জেলার অনেক দুর্গ। ১৬৯৪ সালের মার্চে মোগল সেনাপতি তাঞ্জোরের কাছাকাছি পৌঁছাতে, প্রতিরক্ষার চেষ্টা নির্মূল বুঝে মোগলদের সঙ্গে যোগ দিল মহারাজা ২য় শাহজী । বশ্যতা মেনে নিয়ে ২২ মে শাহজী এই মর্মে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করল যে ভবিষ্যতে সম্রাটের আদেশ পালন করবে সে বিশ্বস্ত একজন সামন্তের মতো, কোনোভাবেই রাজারামকে সহায়তা করবে না, বার্ষিক ৩০ লাখ টাকা কর দেবে মোগল সরকারকে, এবং ছেড়ে দেবে পালামকোটা, সিট্রানুর আর টাঙ্গানুর দুর্গসহ সেগুলোর নির্ভরশীল জেলা ও অন্যান্য আরও অনেক জায়গা।

কিন্তু রাজারাম পালামকোটা দুর্গ ভ্যাঙ্কোজীকে বন্ধক দেওয়ার জন্য জুলফিকারকে সেই দুর্গ অবরোধ করতে হলো। ছয় দিন পর আত্মসমর্পণ করল দুর্গের সেনারা। তখন মোগল সেনারা ফিরে এল ওয়ান্দিওয়াশে আর সেপ্টেম্বরে আরেকটা আক্রমণ চালাল জিনজিতে। এই মাসেই ইয়াচাপাকে গ্রেপ্তার করল জুলফিকার আর তার শিরচ্ছেদ করল দেশদ্রোহিতার অভিযোগে ।

১৫.১৮ জুলফিকারের গতিবিধি ও অসুবিধা, ১৬৯৫

১৬৯৪ সালের শেষের দিকে আবার জিনজি অবরোধ করল জুলফিকার, কিন্তু সেটা ছিল সম্রাটের চোখে ধূলো দেওয়ার একটা কৌশলমাত্র। ইতিমধ্যে রাজারামের সঙ্গে সে একটা সমঝোতায় গিয়েছিল, এই প্রত্যাশায় যে মারা যাবেন অতি বৃদ্ধ সম্রাট আওরঙ্গজেব, আর মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই শুরু হবে গৃহযুদ্ধ । ‘নিজের লাভ আর আরামের খাতিরে অবরোধ দীর্ঘ করা সেনাপতিদের অভ্যাস।

১৬৯৫ সালে কিছুই অর্জন করতে পারল না মোগলরা, বরং বছর জুড়ে শস্যের অভাব তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়াল। অক্টোবরে অবরোধ করা হলো ভেলোর আর তা চলল অনেক বছর ধরে।

১৫.১৯ ১৬৯৬ সালে জুলফিকারের কার্যকলাপ

ডিসেম্বরের শেষে ধানা যাদব এল ভেলোরের কাছাকাছি। জুলফিকার সঙ্গে সঙ্গে অবরোধ তুলে নিয়ে তার শিবিরের লটবহর আর পরিবার আরকটে পাঠিয়ে দিয়ে প্রস্তুতি নিল আক্রমণের জন্য। ১৬৯৬ সালের মার্চে সান্তা ঘোড়পারেও এসে উপস্থিত হলো দৃশ্যপটে। মারাঠি দলগুলো ছড়িয়ে পড়ল দেশের বিভিন্ন জায়গায়, কমসংখ্যক সেনা নিয়ে সম্রাট-বাহিনী এত বেশি জায়গা রক্ষা করতে পারল না। জুলফিকার বুদ্ধিমানের মতো একত্র করে রাখল তার বাহিনী, কিন্তু এই পুরো বছরটা (১৬৯৬) ভুগল টাকার চূড়ান্ত অভাবে। তাই আরকট দুর্গে চুপচাপ রইল সে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে । মারাঠিরা যথারীতি ঘুরঘুর করল তার চারপাশে, কিন্তু দুই দলের মধ্যে গোপন একটা সমঝোতা হয়েছিল যে কেউ কাউকে আক্রমণ করবে না। নভেম্বর আর ডিসেম্বরে সান্তা প্রবেশ করল কেন্দ্রীয় মহীশূরে, আর সম্রাটের আদেশে জুলফিকার তার পিছু নিয়ে সেখানে গিয়ে, সহায়তা করল উত্তর-পশ্চিম থেকে মারাঠিদের তাড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে সেখানে আসা শাহজাদা বিদার বখতকে। এই দুই মোগল সেনাবাহিনী মিলিত হলো ব্যাঙ্গালোরের ৭৫ মাইল উত্তরের পেনু-কোন্দায় । যুদ্ধ না করে অদৃশ্য হয়ে গেল মারাঠিরা, আর জুলফিকার আরকটে ফিরে এল ১৬৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

১৫.২০ আবার জিনজি অবরোধ: দুর্গের পতন

আবার আরকট ত্যাগ করল সে তাঞ্জোর এবং দক্ষিণের অন্যান্য জায়গা থেকে কর সংগ্রহ করতে। তারপর ওয়ান্দিওয়াশে ফিরে এল ১৬৯৭ সালের বর্ষাকালে। তার জন্য সুখের কথা, ইতিমধ্যে মারাঠি শক্তি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল ধানা আর সান্তাজীর তিক্ত এক বিচ্ছেদে। রাজারাম অবলম্বন করেছিল ধানার পক্ষ, মারাঠিরা লিপ্ত হয়েছিল পরম্পর-ধ্বংসকারী এক যুদ্ধে আর শেষমেশ প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পরাজিত হয়ে ধানা বিতাড়িত হয়েছিল মহারাষ্ট্রে (মে, ১৬৯৬)। ১৬৯৭ সালের নভেম্বরের শুরুতে আবার জিনজি অবরোধ করল জুলফিকার ।

সে নিজে অবস্থান নিল উত্তর দরজার উল্টো পাশে রাম সিংহ হাদা শয়তান দ্বারিতে, আর দাউদ খান পানি জিনজির আধা মাইল দক্ষিণের চিক্কালি-দুর্গের সামনে। দাউদ খান এক দিনের ভয়াবহ এক সংঘর্ষে দখল করে নিল চিক্কালি দুর্গ, তারপর জিনজিতে এসে ট্রেঞ্চ খুঁড়ল দক্ষিণ দুর্গ চন্দ্রায়নগড়ের উল্টো পাশে। জুলফিকার ইচ্ছে করলে পরদিনই দখল করতে পারত পুরো দুর্গ। কিন্তু ভাতাদিসহ বেতন লাভ আর বেশি কষ্ট এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সে অবরোধ দীর্ঘায়িত করল আরও দুই মাস।

শেষমেশ অসম্মান আর প্রভুর শাস্তি এড়াতে দুর্গ জয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল জুলফিকারের জন্য। সময়োচিত সাবধানবাণী পেয়ে প্রধান অফিসারদের নিয়ে ভেলোরে পালিয়ে গেল রাজারাম, কিন্তু পেছনে ফেলে গেল তার পরিবার। এবার পূর্ণ আক্রমণের আদেশ দিল জুলফিকার। দলপত রাও কৃষ্ণগিরির উত্তর দেয়াল পেরিয়ে বাইরের দুর্গটা দখল করে নিল ভয়ংকর এক যুদ্ধের পর। সেনারা পিছিয়ে গেল কালাকোট নামের এক ভেতরের দুর্গে। সেটাও দখল করে নিল দলপতের বুন্দেলারা। অবশিষ্ট মারাঠিরা আশ্রয় নিল সর্বোচ্চ দুর্গ রাজগিরিতে । ইতিমধ্যে দাউদ খান চন্দ্রায়নগড়ে ঢুকে এগোল কৃষ্ণগিরির দিকে। অধিবাসীরা পালাল কৃষ্ণগিরির চূড়ায়, কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তা নেই দেখে আত্মসমর্পণ করল। সাম্রাজ্যবাদীরা পেল প্রচুর ঘোড়া, উট এবং অন্যান্য লুটের মাল (৮ জানুয়ারি, ১৬৯৮)। রাজারামের পরিবার রাজগিরিতে আশ্রয় নিলেও তাদের আর কোনো আশা রইল না। রাম সিংহ হাদা রাজগিরির চূড়ায় উঠে নিরাপত্তার আশ্বাস দিলে নগরদুর্গ থেকে বেরিয়ে এল রাজারামের চার স্ত্রী, তিন ছেলে আর দুই মেয়ে, বন্দী করে রাখা হলো তাদের সসম্মানে। আরেক স্ত্রী আত্মসমর্পণ এড়ানোর জন্য দুর্গের চূড়া থেকে নিচের অতলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। প্রায় ৪,০০০ পুরুষ, নারী আর শিশু পাওয়া গেল দুর্গে কিন্তু যোদ্ধার সংখ্যা সেখানে হাতেগোনা।

জিনজি থেকে জুলফিকার (বর্তমানে নসরত জং উপাধিতে সম্মানিত) ফিরে এল ওয়ান্দিওয়াশে, তারপর রাজারামকে তাড়া করল ভেলোর থেকে গরমকোন্দা পর্যন্ত। কিন্তু রাজারাম পালিয়ে গেল বিশালগড়ের নিরাপত্তায় (ফেব্রুয়ারি)। এভাবে জিনজিতে সম্রাটের দীর্ঘ অবরোধ কোনো কাজেই এল না। উড়ে চলে গেছে পাখি।

১৫.২১ সান্তা ঘোড়পারের কাছে কাশিম খানের পরাজয়, দোদেরিতে মৃত্যু, ১৬৯৫

১৬৯৫ সালের অক্টোবর আর নভেম্বর জুড়ে মারাঠি ক্যাপ্টেনরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল মোগল দাক্ষিণাত্যে। নভেম্বরের শুরুতে বিজাপুর লুট করার সময় হিম্মত খানের অধীন এক মোগল বাহিনীর তাড়া খেয়ে সান্তা এল উত্তর পশ্চিম মহীশূরে।

সে সময় ইসলামপুরীতে শিবির পেতে থাকা আওরঙ্গজেব কাশিম খানকে আদেশ দিলেন আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করতে। কাশিম খানের শক্তি বাড়াতে আপন শিবির থেকে তিনি একটা বাহিনী পাঠালেন খানাজাদ খানসহ তাঁর কয়েকজন সেরা তরুণ অফিসারের অধীনে। সান্তা তার শত্রুদের অবস্থানের কথা জেনে দারুণ কুশলী এক পরিকল্পনা করল তাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। তার সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করল সে তিন ভাগে: এক ভাগ যাবে মোগল শিবির লুট করতে, আরেকটা যাবে সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, আর তৃতীয় ভাগ সংরক্ষিত থাকবে প্রয়োজন বুঝে কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়ার আদেশের অপেক্ষায়। চিতলদুর্গ জেলার জমিদার বরমাপ্পা নায়ক মারাঠিদের পক্ষ নিল লুটের ভাগ পাওয়ার আশায়।

সূর্যোদয়ের দেড় ঘণ্টা পর (২০ নভেম্বরের দিকে) মারাঠি প্রথম বাহিনী ছয় মাইল সামনের কাশিম খানের শিবিরে হামলে পড়ে, প্রহরী আর ভৃত্যদের হতাহত করে, যথাসম্ভব লুটপাট চালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে দিল ভারী তাঁবুগুলোতে। সংবাদটা পাওয়ামাত্র কাশিম খান ছুটে গেল অকুস্থলের দিকে। দুই মাইল না যেতেই শত্রুর দ্বিতীয় বাহিনী এসে দাঁড়াল সামনে আর শুরু হলো যুদ্ধ। অনেক হতাহত হলো দুই পক্ষেই। এবার সান্তার সংরক্ষিত তৃতীয় বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল মোগলদের ফেলে যাওয়া শিবির আর মালপত্রের ওপর। এই সংবাদ পেয়ে কাশিম আর খানাজাদ পরামর্শ করে পিছিয়ে এল দোদেরিতে। এই দোদেরি দুর্গ ছিল ছোট আর সেটার খাদ্যের মজুতও সীমিত। তাই দরজা বন্ধ করে দিল তারা। ফলে দুই খানকেই তবু পাততে হলো বাইরে। রাত নামতে শক্ত তাদের ঘিরে ধরল; তিন দিন মারাঠিরা কোনো যুদ্ধ করল না, তারপর বরমাপ্পা নায়কের পাঠানো কয়েক হাজার পদাতিক যোগ দিল তাদের সঙ্গে। সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাল তারা চতুর্থ দিনে। আপন প্রাণ বাঁচাতে দুই প্রধান সেনাদের ফেলে গিয়ে ঢুকল দুর্গে। মুসলমান সেনারা হলো প্রচণ্ড অনাহারের সম্মুখীন। কাশিম খানের ছিল ভীষণ আফিমের নেশা, আর আফিম জোগাড় করতে না পেরে মারা গেল সে তৃতীয় দিনে। কিন্তু অনেকেই সন্দেহ করে যে কাশিম খান আত্মহত্যা করেছিল শত্রুর হাতে অসম্মান আর সম্রাটের ভর্ৎসনা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ।

খাবারের সরবরাহ একদম শেষ হয়ে যেতে আর দুর্গের পানি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে উঠতে খানাজাদ খান হতাশায় ভেঙে পড়ে তার দেওয়ান আর সম্রাট বাহিনীর দাক্ষিণাত্যের এক ক্যাপ্টেনকে সান্তার কাছে পাঠাল আত্মসমর্পণের শর্ত ঠিক করতে; মুক্তিপণ ধার্য করা হলো ২০ লাখ টাকা। দুই দিন বিশ্রাম নিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে মারাঠিদের একটা দলের পাহারায় খানাজাদ রওনা দিল দরবারের উদ্দেশে।

১৫.২২ বাসবপাটানে সান্তার হাতে হিম্মত খান নিহত

এক মাসেরও কম সময়ে আরেকটা বড় অর্জন হলো সান্তার, হত্যা করল সে হিম্মত খান বাহাদুরকে, যে ছিল কাশিম খানের সহকারী আর তার সেনাসংখ্যা কম হওয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল দোদেরির ৪০ মাইল পশ্চিমের বাসবপাটানে। ১৬৯৬ সালের ২০ জানুয়ারি দশ হাজার অশ্বারোহী আর প্রায় সমানসংখ্যক পদাতিক নিয়ে সান্তা হলো হিম্মত খানের মুখোমুখি। তার পদাতিক মাস্কেটিয়াররা-যারা ছিল দাক্ষিণাত্যের সেরা-অবস্থান নিল একটা পাহাড়ের ওপর। ছোট সেনাবাহিনী নিয়েও বেশ সাহসিকতার সঙ্গেই যুদ্ধ করল হিম্মত খান, কিন্তু হাতির পিঠে সান্তার দিকে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা বুলেট ভেদ করল তার কপাল । কয়েক দিন পর মারাঠিরা চলে গেল সেখান থেকে।

২৮ জানুয়ারি সম্রাট জানতে পারলেন হিম্মত খানের মৃত্যুর কথা আর ফিরে পেতে চাইলেন উত্তর-পশ্চিম মহীশূরের কর্তৃত্ব।১ ফেব্রুয়ারি হামিদ-উদ-দীন খান রওনা দিল বাসবপাটান মুক্ত করতে। গন্তব্যস্থলের ২০ মাইল সামনে তাকে আক্রমণ করল সান্তা (২৬ ফেব্রুয়ারি)। কিন্তু পরাজয় বরণ করে মারাঠিরা বিতাড়িত হলো ওই অঞ্চল থেকে এবং মুক্ত হলো বাসবপাটান।

১৫.২৩ ১৬৯৬ সালে সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক আয়োজন

শাহজাদা বিদার বখতকে আদেশ করা হলো (জানুয়ারির শেষে) পানহালা থেকে বাসবপাটানে যেতে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেখানে পৌঁছে অবস্থান করলেন তিনি কিছু দিন, আর বিভিন্ন বাহিনী পাঠালেন জেলার বিদ্রোহী জমিদারদের শায়েস্তা করতে। ১৬ মে বশ্যতা স্বীকার করল চিতলদুর্গের বরমাপ্পা নায়ক। ১৬৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সম্রাটের ইসলামপুরী শিবির থেকে শাহজাদা মুহম্মদ আজমকে পাঠানো হলো ৯০ মাইল উত্তরের পেডগায়ে (বাহাদুরগড়), আর তিন বছর পর সম্রাট তাঁকে মিরাজে ডেকে না পাঠানো পর্যন্ত সেটাই হলো তাঁর সদর দপ্তর।

১৬৯৭ সালের মার্চে পুব উপকূল থেকে সান্তা ঘোড়পারে ফিরে এল সাতারা জেলায়, তার বিপক্ষে পাঠানো হলো ফিরুজ জংকে। কিন্তু মারাঠি সেনাপতিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া একটা গৃহযুদ্ধ তাদের শক্তি খর্ব করে রাখল ১৬৯৭ সালের প্রথম অর্ধ ।

১৫.২৪ সান্তা ঘোড়পারে আর ধানা যাদবের মধ্যে গৃহযুদ্ধ; সান্তার মৃত্যু

পশ্চিমে প্রথম শ্রেণীর দুই মোগল সেনাপতির ওপর আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিজয় অর্জনের পর জিনজি গিয়ে সান্তা রইল রাজারামের সঙ্গে (মার্চ, ১৬৯৬)। ধানা যাদবের ছোটখাটো জয়গুলোর তুলনায় তার নিজেরগুলো এত বড় ছিল যে মনে হয় সে সেনাপতির পদ দাবি করতে গিয়েছিল। কিন্তু তার অহংকার, স্বেচ্ছাচারী মেজাজ আর বশ্যতাহীন তেজের ফলে বিচ্ছেদ ঘটেছিল ধানার সঙ্গে। রাজারাম ধানার পক্ষ নিল আর অমৃত রাও নিম্বলকরকে সেনাবাহিনীর সর্বাগ্রভাগে রেখে আক্রমণ চালাল সাস্তার ওপর। কিন্তু যুদ্ধে মারা গেল অমৃত রাও আর ধানা পরাজিত হয়ে বিতাড়িত হলো পশ্চিম ভারতে।

অনেক মাস যাবৎ উত্তর কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে স্বদেশ ফিরল সান্তা ১৬৯৭ সালের মার্চে। এখানে তার আর ধানার মধ্যে শুরু হলো এক পরস্পর ধ্বংসকারী যুদ্ধ। এবার ভাগ্য সান্তার সহায় হলো না। তার ঔদ্ধত্য আর কৃচ্ছতা বিরক্ত করে তুলেছিল তার অফিসারদের, ফলে তাদের বেশির ভাগই নিল থানার পক্ষ। অল্প কয়েকজন অনুসারী নিয়ে সান্তা পালিয়ে গেল মহাস্বাদে; এখানে নাগোজী মানের বাড়ি, যার স্ত্রীর ভাইকে হত্যা করেছিল অমৃত রাও। কয়েক দিন খাবার আর আশ্রয় দেওয়ার পর নাগোজী তাকে বিদায় দিল নিরাপদে। কিন্তু তার স্ত্রী রাধা বাই একজন নারীর স্বভাবজাত অনির্বাণ প্রতিহিংসাপরায়ণতা নিয়ে তার অন্য এক ভাইকে পাঠিয়ে দিল সান্তার পেছনে। সাতারা জেলায় শম্ভু মহাদেব পাহাড়ের কাছে যাওয়ার পর পথশ্রমে ক্লান্ত সান্তা গোসল করতে নামল এক নালায়। মহাস্বাদ থেকে পিছু নেওয়া দলটা সেখানে খুঁজে পেল তাকে আর ওই অসহায় অবস্থাতেই কেটে নিল তার মাথা (জুন, ১৬৯৭)।

সান্তাজীর ছিল বড় সেনাবাহিনী পরিচালনার এক জন্মগত ক্ষমতা। শত্রুর যেকোনো পরিকল্পনা আঁচ করতে পারত সে। তার সাফল্য নির্ভর করত সেনাদের বিদ্যুৎগতি আর তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার ওপর। বাহিনীতে অফিসারদের আনুগত্য আর সেনাদের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেছিল সে কঠোর শাস্তির মাধ্যমে; ফলে স্বভাবতই ‘বেশির ভাগ মারাঠি অমাত্যই পরিণত হয়েছিল তার শত্রুতে।

জীবনভর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী, সান্তা আর ধানা উভয়েই ছিল সেনানায়ক, সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ যোগ্যতা, সাহসিকতা আর কর্মক্ষমতাসম্পন্ন সংগঠক, কিন্তু তাদের চরিত্র ছিল পরস্পরবিরোধী। ধানা যুদ্ধ করত একজন ভদ্রলোকের মতো। বিজয়েও সে থাকত অবিচল, পরাজিতের প্রতি সদাশয়, ভাষণে নম্র, আত্মসংযমে অভ্যস্ত। যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও মোগল সেনাপতিদের প্রতি তার সহজাত শিষ্টাচার মুসলমান ঐতিহাসিকদের প্রশংসা আদায় করে নিয়েছে। সর্বোপরি, অনেক বছর সে তার দেশের সরকারকে দিয়েছে নিঃস্বার্থ সেবা।

অপর পক্ষে, ধানার তুলনায় সান্তাজী ঘোড়পারে ছিল অমার্জিত এক বর্বর, সে টেনে ধরতে পারত না আবেগের লাগাম, কল্পনা করতে পারত না দূর ভবিষ্যতের কথা। সবার এমনকি তার রাজার সঙ্গেও সে হইচই করতে ভালোবাসত। সে কাউকে দয়া দেখাত না, কারও কাছে দয়া আশাও করত না। মেজাজি সান্তা ছিল কাউকে সহযোগিতা করতে অসমর্থ, জাতির প্রয়োজনে অন্য কারও মত মেনে নেওয়ার মতো দেশপ্রেম তার ছিল না। মারাঠিদের রাজনৈতিক ইতিহাস কিংবা এমনকি আওরঙ্গজেবের অভিযানগুলোর সাধারণ ফলাফলের ওপরও কোনো প্রভাব বিস্তার সে করতে পারেনি। সে ছিল দাক্ষিণাত্যের আকাশে ছুটে যাওয়া এক নিঃসঙ্গ উল্কা।

১৫.২৫ ১৬৯৮-১৬৯৯ সালে রাজারামের গৃহ প্রত্যাবর্তন ও কার্যকলাপ

১৬৯৭ সালের দ্বিতীয়ার্ধেও স্মরণীয় কিছু ঘটল না, কেবল ভীমা নদীর প্রবল এক বন্যা ভাসিয়ে নিয়ে গেল পেডগা ও ইসলামপুরীর মোগল শিবির (১৯ জুলাই) আর ছড়িয়ে দিল এক সর্বজনীন দুর্দশা ও সর্বনাশ। পরবর্তী বছরের জানুয়ারিতে জিনজির পতন হলো মোগলদের হাতে। পরবর্তী মাসে রাজারাম পালিয়ে গেল মহারাষ্ট্রের বিশালগড়ে। রাজারামের গৃহ প্রত্যাবর্তনের পরপরই মারাঠিরা হঠকারী কোনো কাজ করল না। এই সময় হতাশ হয়ে কিছু অনুসারী তার পক্ষ ত্যাগ করে যোগ দিল মোগলদের সঙ্গে।

১৬৯৯ সালের শুরুতে রাজারাম গেল কঙ্কান পরিদর্শনে, আর সব দুর্গ দেখে সাতারা ফিরে এল জুনের শেষে। খান্দেশ আর বেরারে এক ব্যাপক আক্রমণের পরিকল্পনা কেঁদে সাতারা ত্যাগ করল সে ২৬ অক্টোবর।

আওরঙ্গজেবের এই দুর্গ অবরোধের অভিপ্রায় স্পষ্টতই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল, কারণ, সম্রাট ইসলামপুরী থেকে রওনা (১৯ অক্টোবর) দেওয়ার পরপরই সম্রাটের হাতে ধরা পড়া এড়ানোর জন্য রাজারাম তার পরিবার স্থানান্তরিত করেছিল সাতারা থেকে খেলনায়। ধানা যাদব, রামচন্দ্র, দাদো মলহার আর অন্যান্য সেনাপতি ৭,০০০ অশ্বারোহীসহ তার সঙ্গে গেল চন্দন-ওয়ান পর্যন্ত, সেখানে তিন দিন অবস্থানের পর সে ধরল সুরাটের পথ।

জরুরি আদেশ দিয়ে সম্রাট পাঠালেন শাহজাদা বিদার বখতকে। পারো দুর্গের ৪ মাইল ওপারে বিদার বখত হলেন মারাঠিদের সম্মুখীন। রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষের পর বিতাড়িত মারাঠিরা চলে গেল আহমদনগরের দিকে (১৩ বা ১৪ নভেম্বর)।

১৭০০ সালের ৯ জানুয়ারি নসরত জং (জুলফিকার) মসুরের ওপারে যুদ্ধ করল ধানা, রানুজী ঘোড়পারে আর হনুমন্ত রাওয়ের সঙ্গে এবং তাদের পরাজিত করে হত্যা করল তাদের ৫০০ সেনা। কয়েক দিন পর খানাপুরের মোগল আউটপোস্ট আক্রমণ করে ধানা তুলে নিয়ে গেল তাদের অফিসার অবজী আধালকে।

১৫.২৬ রাজারামের মৃত্যু; তারা বাইয়ের কূটনীতি

১৭০০ সালের ২ মার্চ জ্বরে ভুগে সিংহগড়ে মারা গেল রাজারাম, খুব সম্ভব তার এই অসুখ হয়েছিল নিজ আক্রমণ আর মোগলদের অবিরাম প্রচণ্ড তাড়া খাওয়ার দুর্বহ শারীরিক পরিশ্রমে। তার পরিবার তখন ছিল বিশালগড় দুর্গে। মন্ত্রিবর্গ আর ধানা যাদবের সহায়তায় রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসানো হলো তার প্রিয় জারজ পুত্র কর্ণকে, কিন্তু গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গেল সে তিন সপ্তাহের মধ্যেই। তারপর তার স্ত্রী তারা বাইয়ের পুত্রকে সিংহাসনে বসানো হলো ৩য় শিবাজী নাম দিয়ে। এবার পরস্পর-ধ্বংসকারী এক কলহ শুরু হলো রাজারামের দুই বিধবা, তারা বাই আর রজস বাইয়ের মধ্যে। দুজনেই দাঁড়াল আপন আপন পুত্রের পক্ষে। কিন্তু যোগ্যতা আর সক্রিয়তায় বড় স্ত্রী তারা বাইয়ের হাতেই ছিল রাষ্ট্রীয় চূড়ান্ত ক্ষমতা।

স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পরপরই সম্রাটের কাছে বশ্যতা স্বীকারের প্রস্তাব দিল তারা বাই, বিনিময়ে রাজারামের বৈধ সন্তানকে দিতে হবে ৭-হাজারি মনসবদারি, দাক্ষিণাত্যে ক্ষমতা, ৫,০০০ সেনা, আর সাতটা দুর্গ। আওরঙ্গজেব এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। মে মাসের শেষের দিকে রামচন্দ্রের প্রতিনিধি রামজী পণ্ডিত আর পরশুরামের প্রতিনিধি অম্বাজী শাহজাদা আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অনুরোধ জানাল, যেন তিনি সম্রাটকে বলে রাজারামের তরুণ ছেলেকে রেহাই পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন মারাঠি দুর্গ আত্মসমর্পণের বিনিময়ে। সম্ভবত প্রস্তাবগুলো কপট ছিল বলে সেসবে কোনো কাজ হলো না।

১৫.২৭ কঙ্কানের যুদ্ধ, ১৬৮৯-১৭০৪

সুরাট থেকে কোনো ভ্রমণকারী দক্ষিণ দিকে রওনা দিলে পশ্চিম ঘাট আর আরব সাগরের মধ্যের লম্বা উপকূলে সে পাবে ধারাবাহিক কয়েকটা বিভাগ-প্রথমত কোলবান বা বিচ্ছিন্ন দেশ, যেখানে বাস করে বুনো কোলি উপজাতি (গঠিত হয়েছে জওহর আর ধরমপুর রাষ্ট্র), তারপর উত্তর কঙ্কান (বা বর্তমান থানা আর কোলাবা জেলা, যেগুলোর অবস্থান ঘাটের পুবের নাসিক আর পুনা জেলার সমান্তরালে), আর শেষে দক্ষিণ কঙ্কান (বা বর্তমান রত্নগিরি জেলা, যার অবস্থান। দাক্ষিণাত্য মালভূমির সাতারা আর কোলাপুর জেলার সমান্তরালে)। রত্নগিরির সর্ব দক্ষিণে ভিজুরলার কাছে উপকূল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে প্রাচীন মারাঠি পরিবার বাদির সাবান্ত’দের (সপ্তদশ শতাব্দীতে সুপরিচিত ছিল কুদালের দেশাই’ হিসেবে ভূখণ্ড। আর তার ঠিক দক্ষিণের পর্তুগিজদের প্রদেশ গোয়া থাকার ফলে । আরও দক্ষিণে কানারা, উপকূল বরাবর কারওয়ার জেলা এবং ভেতরের দিকে সুন্দা আর বেদনুর রাষ্ট্র।

ধরমপুরের কিছু উত্তরের আর নান্দরবার শহরের কাছের পশ্চিম ঘাটের এক ফাঁক দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চল ধরে এগিয়ে আসা হানাদার কোনো বাহিনী সহজেই প্রবেশ করতে পারবে সম্পদশালী প্রদেশ খাদেশ আর বেরারে এবং কোলবানে মূল ঘাঁটি গেড়ে যথেচ্ছ লুটপাট চালাতে পারবে উত্তরের সুরাট বা পুবের বাগলানায়।

শিবাজী কঙ্কান জয় করেছিল ১৬৫৭ আর ১৬৬২ সালের মাঝামাঝি, আর কোলি ১৬৭০-৭৩ সালে। তার মৃত্যুর পর মোগলরা উত্তর কঙ্কানে আক্রমণ চালাল ১৬৮২ আর ১৬৮৩ সালে, আর অস্থায়ীভাবে দখল করল রাজধানী কালিয়ান, যতটা না সেটা ধরে রাখতে তার চেয়ে বেশি জ্বালাও-পোড়াও করতে। ১৬৮৩ সালের ডিসেম্বরে কালিয়ান পুনর্দখল করে মারাঠিরা শান্তিতেই কঙ্কানে থাকল পাঁচ বছর, কেবল উপকূলীয় গ্রামগুলোতে ছিল সিদ্দিদের লুণ্ঠনের ভয়। মাত্র ১৬৮৯ সালে এই অঞ্চলে মোগলদের অগ্রগতি শুরু হলো অত্যন্ত যোগ্য একজন স্থানীয় অফিসারের অধীনে।

অনেক দিন আগে কালিয়ানে থিতু হয়েছিল আরবের নবাইয়াত গোত্রের একজন সাঈদ, মাতবর খান। নাসিক জেলার থানাদার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার (১৬৮৮) পরই নিজেকে সে বিশিষ্ট করে তুলেছিল তার উদ্যমী সাহসিকতা আর দূরদর্শিতার গুণে । স্থানীয় পাহাড়িদের নিয়ে সে গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী এক পদাতিক বাহিনী, জয় করেছিল প্রতিবেশী অনেক জমিদার, আর বাহুবলে বা ঘুষ দিয়ে দখল করেছিল মারাঠি অনেক দুর্গ, যেমন, পাট্টা (বিশ্রামগড়), কুলাং ত্রিম্বক (৮ জানুয়ারি, ১৬৮৯), এবং শম্ভুজীর পতনের পর আরও অনেক ছোটখাটো দুর্গ। বিজয়ী মোগল সেনাপতি ঘাট পেরিয়ে চলে এসেছিল কঙ্কানে। এই প্রদেশে সে জয় করল কালিয়ান (২৭ মার্চ), প্রবাল, কারনালা, দুগাড়, মানিকগড়, আর শেষে মহুলি (আগস্টে)। এভাবে উত্তর কঙ্কানে প্রতিষ্ঠিত হলো সাম্রাজ্যিক অধিকার। জেলার বেশির ভাগ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল মারাঠিদের বিশ বছরের ঘন ঘন যুদ্ধে। সে সেখানে কায়েম করল শাসন, শৃঙ্খলা, গড়ে তুলল কৃষক উপনিবেশ, তাদের চাষাবাদ আর উন্নতি ফিরিয়ে আনতে।

এসব সফল অভিযানের পর মাতবর খান কালিয়ানে ফিরে এসে (১৬৯০) কয়েক বছর বাস করল শান্তিতে, শহরটার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করল একটা শাসকের বাসভবন, জনসাধারণের একটা হল, একটা মসজিদ, একটা টার্কিশ বাথ, একটা পোর্টিকো এবং পুকুর আর ঝরনাসহ একটা বাগান আর টেরেস নির্মাণ করে। কালিয়ানে তার স্ত্রীর অপূর্ব স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে এক লাখ টাকা ব্যয়ে।

কিন্তু ১৬৯৩ সালের শুরুতে মারাঠিরা ফিরে পেল তাদের শক্তি আর মোগলেরা হারাল তাদের প্রভুত্ব। মারাঠি ভ্রাম্যমাণ দলগুলো আক্রমণ চালাতে লাগল মোগল ভূখণ্ডে, পুনর্দখল করতে লাগল সম্প্রতি হাতছাড়া হওয়া দুর্গ। স্থানীয় পর্তুগিজ শাসককে ঘুষ দিয়ে তারা পেল আশ্রয় এবং তাদের দুর্গ আর উত্তর কঙ্কানের গ্রামগুলোর জন্য রসদের সরবরাহ।

সুতরাং মাতবর খান আক্রমণ চালাল পর্তুগিজ ভূখণ্ডের ব্যাসেইন আর দমনে, বন্দী করল শত্রুদের প্রজা আর পরাজিত করল তাদের সেনাবাহিনীকে। অবশেষে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করল গোঁয়ার রাজ্যপাল।

আওরঙ্গজেবের দরবারের হস্তলিখিত বিবরণীতে মাতবর খানের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে প্রশাসনিক দক্ষতা বজায় রাখা আর সম্রাটের শক্তি সমুন্নত রাখতে জানজিরার সিদ্দি প্রধানকে সামরিক সহযোগিতা দেওয়ার জন্য। যোগ্য আর বিশ্বস্ত এই কর্মচারীকে মৃত্যু তার রাজ্যে নিয়ে গেছে ১৭০৪ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *