এ শর্ট হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব – স্যার যদুনাথ সরকার / অনুবাদ : খসরু চৌধুরী
উৎসর্গ
জনাব আবদুল খালেক খান
আমার শ্রদ্ধেয় বেহাই সাহেব
একজন খাঁটি ধার্মিক মানুষ
স্যার যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮)
জন্ম করচমাড়িয়া গ্রাম, নাটোর-রাজশাহী, ১০ ডিসেম্বর ১৮৭০। ইতিহাসবিদ। জমিদার পরিবারে জন্ম। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে এন্ট্রান্স (১৮৮৭) ও রাজশাহী কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে দশম স্থান অধিকার করে এফ.এ. (১৮৮৯) পাস। অতঃপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি। এ কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসে অনার্সসহ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বি.এ. (১৮৯১) ও ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ. (১৮৯২) ডিগ্রি লাভ। ১৮৯৩-তে রিপন কলেজে (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত। ১৮৯৬-তে মেট্রোপলিটান কলেজে (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) যোগদান। ১৮৯৭-তে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ। ১৮৯৮-তে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল এডুকেশন সার্ভিসে যোগদান। একই বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক নিযুক্ত। ১৮৯৯-তে পাটনা কলেজে বদলি। ১৯০১-এ আবার প্রেসিডেন্সি কলেজে স্থানান্তরিত । ১৯০২-১৯১৭ পর্যন্ত পাটনা কলেজে অধ্যাপনা। ১৯১৭-১৯১৯ পর্যন্ত কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা। ১৯১৮-তে ইন্ডিয়ান এডুকেশনাল সার্ভিসে উন্নীত। ১৯১৯-১৯২৩ পর্যন্ত কটক র্যাভেনশ কলেজে ও ১৯২৩-১৯২৬ পর্যন্ত পাটনা কলেজে অধ্যাপনা। ১৯২৬-এ অধ্যাপনার কর্ম থেকে অবসর গ্রহণ। একই বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত। ১৯২৮ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক। মোগল যুগের ইতিহাস রচনায় গভীর পাণ্ডিত্য, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের পরিচয় প্রদান। সত্যনিষ্ঠ তথ্যসমৃদ্ধ ও প্রামাণিক ইতিহাস রচনার জন্য উর্দু, ফারসি, মারাঠি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা গ্রহণ এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান ও বিদেশ থেকে বহু দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, পাণ্ডুলিপি ও দলিলপত্র সংগ্রহ।
প্রকাশিত গ্রন্থ: India of Aurangzib: Topography, Statistics and Roads (1901), Economics of British India (1909), History of Aurangzib (vol. I & II 1912, vol.III-1916, vol.IV-1919, vol.V-1924), Anecdotes of Aurangzib, and Historical Essays (1912), Chaitanya: His Pilgrimages and Teachings (1913), Shivaji and His Times (1919), Studies of Mughal India (1919), Mughal Administration (1st Series 1920, 2nd Series 1925), Later Mughals (1928), India Through the Ages (1928), A Short History of Aurangzib (1930), Bihar and Orissa During the Fall of the Mughal Empire (1932), Fall of the Mughal Empire (vol. I-1932, vol. II-1934, vol. III-1938, vol. IV-1950), Studies in Aurangzib’s Reign (1933), House of Shivaji (1940), History of Bengal (vol. II, Published by Dhaka University] (1948), Bengal Nawabs (1952), Military History of India (1961), Nadir Shah in India (1973), পাটনার কথা (১৯১৬), শিবাজী (১৯২৯) ও মারাঠা জাতীয় বিকাশ (১৯৩৬)। History of Aurangzib তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা গ্রন্থ। ১৯৩৪-এ বিলাতের রয়াল হিস্টরিকাল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত। নবগঠিত বঙ্গীয় আইন সভার মনোনীত সদস্য (১৯৩০-১৯৩২)। তিন বার (১৯৩৫, ১৯৪০ ও ১৯৪৮) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত। সি.আই.ই. (১৯২৬) ও নাইট (১৯২৯) উপাধিতে ভূষিত ।১৯৩৬-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৪৪-এ পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান। মৃত্যু, কলকাতা, ১৯ মে ১৯৫৮।
১. প্রথম জীবন : ১৬১৮-১৬৫২
১.১ আওরঙ্গজেবের শাসনকালের গুরুত্ব
আওরঙ্গজেবের ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষেরই ষাট বছরের ইতিহাস। সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধব্যাপী তাঁর নিজ শাসনকাল (১৬৫৮-১৭০৭) আমাদের দেশের ইতিহাসে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার অধীনেই মোগল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বিস্তৃতি লাভ করে, আর ইতিহাসের প্রারম্ভ থেকে ব্রিটিশ শক্তির উত্থান পর্যন্ত এটাই ছিল ভারতের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্র। গজনি থেকে চাটগাঁ, কাশ্মির থেকে কর্ণাটক, সমগ্র ভারতবর্ষ মেনে চলত একই রাজদণ্ডের অনুশাসন। এই শাসনকালই ছিল ভারতবর্ষে ইসলামের সর্বশেষ অগ্রযাত্রার কাল। নজিরবিহীন বিশাল এই সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল একক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে। প্রদেশগুলো অধীন রাজাদের দ্বারা পরোক্ষভাবে নয়, বরং প্রত্যক্ষভাবে শাসিত হতে সম্রাটের কর্মচারীদের দ্বারা। সেই হিসেবে আওরঙ্গজেবের ভারতীয় সাম্রাজ্য ছিল অশোক, সমুদ্র গুপ্ত কিংবা হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যের চেয়েও বড়।
কিন্তু যে শাসনকাল ব্রিটিশ-পূর্ববর্তী সর্ববৃহৎ ভারতীয় সাম্রাজ্যের উত্থান দেখেছিল, সেটাই আবার দেখেছিল তার অনিবার্য ভাঙন আর পতনের চিহ্ন। পারস্যের নাদির শাহ কিংবা আফগানিস্তানের আহমদ শাহ বাদশাহিকে রাজতন্ত্রের এক অক্ষম ছায়া হিসেবে প্রমাণ করার অনেক আগে, মারাঠা ষড়যন্ত্রের অনেক আগে, এমনকি আওরঙ্গজেব চোখ বুজবার আগেই মোগল সাম্রাজ্য অর্থ এবং গৌরবের দিক থেকে দেউলিয়া হয়ে পড়েছিল, শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, প্রকাণ্ড এই সাম্রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের প্রশ্নে সাম্রাজ্যিক শক্তি স্বীকার করেছিল তার অক্ষমতা।
আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মারাঠা জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল, শিখ সম্প্রদায়ও মাথা চাড়া দিয়েছিল শাসকদের সশস্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সুতরাং অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের ভারতীয় ইতিহাসের কর্তৃত্বকারী উপাদানগুলোর বীজ নিহিত আছে আওরঙ্গজেবের শাসন এবং কূটনীতির মধ্যে।
যে শাসনকালে মোগল সাম্রাজ্যের ভাগ্যাকাশ হয়েছিল পূর্ণিমায় পূর্ণ প্রস্ফুটিত, তার পরই শুরু হয়েছিল ক্ষয়, সেই শাসনকালেই আমাদের রাজনীতির আকাশে ফুটে উঠেছিল এক নতুন আলোর আভাস। আমাদের দেশের নিয়তির ভবিষ্যৎ প্রভুরা তাদের পায়ের তলায় খুঁজে পেয়েছিল শক্ত মাটি। যথাক্রমে ১৬৫৩ এবং ১৬৮৭ সালে মাদ্রাজ এবং বোম্বে হয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রেসিডেন্সি; কলকাতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৬৯০ সালে। ইয়োরোপিয়ানদের আশ্রয়স্থলগুলো এভাবে গড়ে উঠেছিল রাজ্যের অন্তর্গত আরেক রাজ্য হিসেবে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে মোগল সাম্রাজ্যের দৈন্যদশা একেবারে প্রকট হয়ে পড়েছিল। রাজকোষ শূন্য। শত্রুর হাতে মার খেতে খেতে ক্লান্ত সেনাবাহিনী। সাম্রাজ্যের নৈতিক দুর্বলতা পৌঁছেছিল বস্তুগত দুর্বলতার চেয়েও চরমে : প্রজাদের শ্রদ্ধা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল সরকার; সাধারণ কর্মচারীরা হারিয়েছিল সততা এবং যোগ্যতা, মন্ত্রী এবং শাহজাদাগণ হারিয়েছিলেন কূটনৈতিক দক্ষতা; শক্তির সহায়ক হিসেবে আর ভূমিকা পালন করতে না পেরে ভেঙে পড়েছিল সেনাবাহিনী।
কিন্তু এমনটা হয়েছিল কেন? শাসক ছিলেন অনৈতিকতা, মূর্খতা এবং অলসতা থেকে মুক্ত। তাঁর জ্ঞানের প্রখরতা ছিল কিংবদন্তিতুল্য, পাশাপাশি শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি ছিলেন এমনই উদ্যমী, যে রকম উদ্যম মানুষ সাধারণত দেখায় ভোগ-সুখের পেছনে ধাবিত হলে। পরিশ্রম এবং জনসাধারণের প্রতি মনোযোগের বিচারে সামান্য কেরানিও তার কাছে হার মানত। তাঁর ধৈর্য এবং অধ্যবসায় ছিল আইনশৃঙ্খলার প্রতি তার ভালোবাসার মতোই বিখ্যাত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ, একজন সাধুর মতোই মিতাচারী। সামরিক অভিযান বা দলগত গমনের কষ্ট তিনি মুখ বুজে সহ্য করেছেন দারুণভাবে অভ্যস্ত অতি সাধারণ একজন সেপাইয়ের মতো। কোনো আতঙ্কেই তার হৃদয় কম্পিত হতো না, সেখানে ছিল না অহেতুক দয়ার কোনো দুর্বলতা। নীতিশাস্ত্রের গ্রন্থ থেকে প্রাচীন জ্ঞানীদের জ্ঞান আহরণের বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন ওস্তাদ। এসবের পাশাপাশি পিতার শাসনকালে যুদ্ধ এবং কূটনীতিতে তিনি পেয়েছিলেন এক দীর্ঘ, সফল অনুশীলনের সুযোগ।
এতদসত্ত্বেও এ রকম একজন শাসকের শাসনকাল শেষমেশ পর্যবসিত হয়েছিল ব্যর্থতা এবং বিশৃঙ্খলায়! রাজনৈতিক এই স্ববিরোধিতার ফলেই আওরঙ্গজেবের শাসনকাল হয়ে পড়েছে ভারতীয় ইতিহাসের ছাত্রদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দর্শনের ছাত্রদের কাছেও এক চূড়ান্ত আগ্রহের বিষয়।
১.২ আওরঙ্গজেবের জীবনের ট্র্যাজেডি
আওরঙ্গজেবের জীবন ছিল সুদীর্ঘ এক ট্রাজেডি- এটা এমন একজন মানুষের গল্প, যিনি অদৃশ্য এবং অপ্রতিরোধ্য নিয়তির বিপক্ষে এক অসম লড়াইয়ে রত, এই গল্পে আমরা দেখতে পাই মানুষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাও কীভাবে সমসাময়িক শক্তির সামনে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। সুদীর্ঘ ৫০ বছরের শ্রমসাধ্য শাসন পর্যবসিত হয়েছিল এক বিশাল ব্যর্থতায়। কিন্তু তার পরও বুদ্ধি, চরিত্র এবং কর্মপ্রচেষ্টার বিচারে আওরঙ্গজেব ছিলেন এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের অন্যতম। ইতিহাসের এই ট্র্যাজেডি বেড়ে উঠেছিল নিখুঁত এক নাটকের আদলে।
জীবনের প্রথম ৪০টা বছর তাঁর কেটে গেল নিজেকে দিল্লির সিংহাসনের উপযুক্ত করে তোলার কঠোর পরিশ্রমেই। বীজ বপনের এই সময়ের পরের একটা বছর চলল সিংহাসন নিয়ে ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, অবশেষে মিলল তার উদ্যম, সাহস এবং বিচক্ষণতার পুরস্কার। সিংহাসনে আরোহণের পর ২৩ বছর কেটে গেল শান্তি, উন্নতি এবং উত্তর ভারতের বড় রাজধানীগুলোতে বাসস্থান তৈরির মধ্য দিয়ে। সমস্ত শত্রুকে অপসারণ করলেন আওরঙ্গজেব, তার দৃঢ় এবং সতর্ক শাসনে দেশের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতি হলো। মনে হলো, আওরঙ্গজেব যেন মানবীয় সুখ এবং গৌরবের চূড়ায় আরোহণ করেছেন। কিন্তু জীবনের এই তৃতীয় অঙ্কের পরই শুরু হলো তাঁর পতন। গ্রিক ট্র্যাজেডির নিষ্ঠুর নেমেসিসের মতো শক্ত মাথা চাড়া দিল আওরঙ্গজেবের আপন পরিবারে। শাহজাহানের বিদ্রোহী সন্তান তাঁর নিজ সন্তান মুহম্মদ আকবরের (১৬৮১) বিদ্রোহের সম্মুখীন হলেন।
পরাজিত বিদ্রোহী সন্তান মারাঠা রাজার কাছে পালিয়ে যাওয়ার ফলে আওরঙ্গজেবকে আসতে হলো দক্ষিণ ভারতে, ক্ষয় পেতে থাকল সাম্রাজ্যের রাজস্ব, সেনাবাহিনী, সংগঠিত প্রশাসন, পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে ক্ষয়ে গেল তার স্বাস্থ্য। নিয়তি অবশ্য প্রথমে তার চোখের সামনে ঝুলিয়ে দিল পর্দা, বুঝতেও দিল na যে বিদ্রোহ দমনের এই নিষ্ফল প্রয়াসে জীবনের শেষ ২৬টা বছর তাঁকে কাটাতে হবে তাঁবু থেকে তাঁবুতে। জীবনের চতুর্থ অঙ্কে সবকিছুই যেন এসে পড়ল তার আয়ত্তের মধ্যে-বিজাপুর আর গোলকুণ্ডাকে সংযুক্ত করা হলো, বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হলো সাগরের বেরাদ গোত্রপ্রধান, ঝামেলা সৃষ্টিকারী মারাঠা রাজার রাজধানী দখল করে বন্দী করা হলো তার পুরো পরিবারকে (১৬৮৯)। প্রায় সবার চোখের সামনে তখন ঝলমল করছে বিজয়ী আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের ছবি, কিন্তু কিছু চিন্তাশীল মানুষ ঠিকই দেখতে পেল অশুভের চিহ্ন। বিবেচনা না করে জীবনের তৃতীয় অঙ্কে আওরঙ্গজেব বুনেছিলেন ধ্বংসের বীজ, চতুর্থ অঙ্কে তা ডালপালা মেলল, তারপর পঞ্চম এবং শেষ অঙ্কে বিধ্বংসী সেই গাছ তার হাতে ধরিয়ে দিল বিষাক্ত ফল।
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওরঙ্গজেবের ট্র্যাজেডি কেন্দ্রীভূত হয়েছে তাঁর জীবনের শেষ ১৮ বছরে (১৬৮৯-১৭০৭)। ধীর অথচ অব্যর্থভাবে ট্র্যাজিক এই ঘটনাপ্রবাহ উন্মোচন করেছে নিজেদের, শেষমেশ যা ধরা পড়েছে আওরঙ্গজেবের চোখে। কিন্তু তিনি যেন বুঝেও বুঝতে চাননি। তাই এক প্রতিকার ব্যর্থ হলে তিনি হাত বাড়িয়েছেন আরেক প্রতিকারের দিকে; কৌশল পরিবর্তন করেছেন, পরিবর্তন এনেছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সেনা বিভাজনে। প্রথমে তিনি পাঠিয়েছেন সেনাপতিদের, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা এবং নির্দেশ দেওয়ার জন্য নিজের দখলে রেখেছেন কেন্দ্রীয় একটা অবস্থান। সিদ্ধান্ত নিতে যখন ব্যর্থ হয়েছে সেনাপতিরা, তখন ৮২ বছরের এই বৃদ্ধ ছয় বছর ধরে (১৬৯৯-১৭০৫) সশরীরে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য উপস্থিত হয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অবশেষে অবসর নেওয়ার জন্য গিয়েছেন তিনি আহমদনগরে, যখন মৃত্যু দিয়েছে তার প্রথম হাতছানি। এবং তখন, একমাত্র তখনই, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আওরঙ্গজেব উপলব্ধি করেছেন যে আহমদনগরই তার যাত্রার শেষ’ (খতম-উস-সফর)।
১.৩ আওরঙ্গজেবের ইতিহাসের উপাদান
সুখের বিষয়, মোগল ভারতের সাহিত্য ভাষা- ফারসিতে ছড়িয়ে রয়েছে আওরঙ্গজেবের ইতিহাসের অজস্র উপাদান। প্রথমে আমরা পাই সরকারি ঐতিহাসিক বিবরণী- পাদি-নামা (তিন লেখকের দ্বারা তিন খণ্ডে লিখিত) এবং আলমগিরনামা, যাতে রয়েছে শাহজাহানের সিংহাসনারোহণ থেকে শুরু করে আওরঙ্গজেবের শাসনকালের ১১ বছর পর্যন্ত ৪১ বছরের ঘটনাবলি । এগুলো যথাযথভাবে লিখিত হয়েছে রাজকীয় মহাফেজখানায় সংরক্ষিত সরকারি আদান প্রদানসংক্রান্ত ডাক, বার্তা প্রেরণ, হস্তলিখিত সংবাদ, চুক্তিপত্র এবং রাজস্ব বিবরণীর ওপর ভিত্তি করে। তারিখ এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের বর্ণনার প্রশ্নে উল্লিখিত দুই ঐতিহাসিক বিবরণী নিখুঁত এবং অমূল্য। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ ৪০ বছরের ঘটনাবলির জন্য আমরা পাই তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সংক্ষিপ্ত মসির-ই আলমগিরি, যা রচিত হয়েছে ওই একই ধরনের সরকারি রেকর্ডের ভিত্তিতে।
এগুলোর পর উপাদান হিসেবে আমরা পাই ব্যক্তিগতভাবে লিখিত বাংলার রজবাণী এক সেনা, মাসুম আকিল খান এবং খাফি খানের ইতিহাস। এগুলোতে নাম এবং তারিখসংক্রান্ত কিছু ভুল, সেইসঙ্গে বর্ণনার অপ্রতুলতা সত্ত্বেও রয়েছে রাজসভার অনেক অজানা ঘটনা ।
আওরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্বন্ধে এমনকি রয়েছে ফারসি ভাষায় রচিত দুজন হিন্দু লেখকের ইতিহাস। একটা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দলপত রাও বুন্দেলার ব্যবসাদার ভীমসেন বুরহানপুরীর নাশখা-ই-দিলকাশা। এই গ্রন্থকার একজন ভালো পর্যটক এবং নির্দিষ্ট অঞ্চলের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনায় পারদর্শী, সযত্নে তিনি রেকর্ড করেছেন মথুরা থেকে মালাবারের স্বচক্ষে দেখা ঘটনাবলি । দাক্ষিণাত্যের ঘটনাপ্রবাহের ব্যাপারে তার এই কাজের বিশেষ মূল্য রয়েছে। কারণ, প্রায় সারাটা জীবনই তাঁর কেটেছে সেখানে। আরেকটা গুজরাটের পাট্টান নিবাসী ঈশ্বরদাস নাগরের ফতুহাত-ই-আলমগিরি। নাগর দীর্ঘ দিন সেবা প্রদান করেছেন শেখ উল-ইসলামকে। রাজপুত ঘটনাপ্রবাহের জন্য তার এই কাজ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এই সব সাধারণ ইতিহাসের পাশাপাশি আমরা পাই তদানীন্তন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক ক্ষুদ্রাকারে রচিত উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা কিংবা উপাখ্যান, যেমন, নিয়ামত খান আলীর গোলকুণ্ডা অবরোধ, শিহাব-উদ-দীন তালিশের কুচবিহার, আসাম এবং চাটগাঁ বিজয়, এ ছাড়া প্রথম বাহাদুর শাহের কর্মচারী ইরাদত খান এবং অন্য কয়েকজন কর্মচারীর স্মৃতিচারণ। দাক্ষিণাত্যের দুই রাজধানী গোলকুপ্তা এবং বিজাপুর বিষয়ে আমরা পাই ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস, যেগুলো দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে মোগল সরকারের সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেছে। আসাম সম্বন্ধে জানার জন্য আমরা পাই বুরানজিস নামক অতি মূল্যবান স্থানীয় ঐতিহাসিক বিবরণী।
পরম সৌভাগ্যক্রমে, আওরঙ্গজেবের শাসনকালের অনেকখানি জানার জন্য আমি পেয়ে যাই ইতিহাসের একেবারে প্রত্যক্ষ কিছু উপাদান, যেগুলো উল্লিখিত ঐতিহাসিক বিবরণীর চেয়েও মূল্যবান। এগুলো হলো, জয়পুর এবং লন্ডনের রয়াল এশিয়াটিক সোসাইটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত সম্রাটের দরবারসভার হস্তলিখিত বিবরণী (আখবরাত-ই-দরবার-ই-মুয়ালা)। এ ছাড়া আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে সপ্তদশ শতাব্দীর রাজনৈতিক নাটকের অভিনেতাদের প্রায় ছয়। হাজার চিঠিপত্র, যেগুলোর এক হাজারেরও বেশি লিখেছেন আওরঙ্গজেব স্বয়ং। পরবর্তীতে অনেক লেখকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রং চড়ানো লেখার চেয়ে এই চিঠিগুলোতে বরং আমরা পাই দৈনন্দিন ঘটনাপ্রবাহের জলজ্যান্ত বিবরণ । এসবেই আছে ভারতীয় ইতিহাসের স্থপতিদের আশা, আতঙ্ক, পরিকল্পনা এবং মতামতের খটি চিত্র।
আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ভারতবর্ষে আসা ইয়োরোপীয় পর্যটক ট্যাভার্নিয়ার, বার্নিয়ার, কারেরি, মানুচি প্রমুখও রেখে গেছেন অনেক বিবরণ। তাঁদের কাজ জনসাধারণের অবস্থা, বাণিজ্য ও শিল্প-পরিস্থিতি এবং ভারতের খ্রিষ্টীয় গির্জার ইতিহাসের ওপর নিঃসন্দেহে আলোকপাত করেছে। ভারতীয় আচার-আচরণ এবং প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সমালোচনায়ও রয়েছে এক তরতাজা নতুন ভাব। কিন্তু ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের বেলায়, স্বচক্ষে দেখা কিংবা নিজে জড়িত থাকা দু-চারটে ঘটনা ছাড়া তাঁরা নির্ভর করেছেন বাজার-চলতি গুজব এবং জনসাধারণের গল্পগাছার ওপর। ফলে প্রমাণ হিসেবে এগুলো সমসাময়িক ইতিহাস এবং ফারসি ভাষায় লিখিত চিঠিপত্রের সমকক্ষ নয়।
১.৪ শৈশব ও শিক্ষা
মুহী-উদ-দীন মুহম্মদ আওরঙ্গজেব ছিলেন শাহজাহান এবং মমতাজ মহলের ষষ্ঠ সন্তান। তিনি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন প্রথম আলমগীর নামে। ১৫ জিলকদ, ১০২৭ হিজরি, ২৪ অক্টোবর, ১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দে রাতের বেলায় তিনি দোহারে জন্মগ্রহণ করেন।
১৬২২ সাল থেকে পিতার শাসনকালের শেষ পর্যন্ত শাহজাহান বৃদ্ধ সম্রাটের বিরাগভাজন থাকায় আত্মরক্ষার্থে বেছে নেন বিদ্রোহের পথ। কিন্তু বিদ্রোহ সফল না হওয়ায় তিনি পিতার বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য হন এবং শিশু দুই পুত্র দারা এবং আওরঙ্গজেবকে দেন জামিন হিসেবে। ১৬২৬ সালের জুনে দুজনকে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাঙ্গীরের লাহোর দরবারে । জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরই সিংহাসনে আরোহণ করেন শাহজাহান এবং দুই বালককে আগ্রায় নিয়ে আসেন আসফ খান (২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৬২৮)।
দশ বছর বয়সেই একটা স্থির জীবনে পদার্পণ করেন তিনি এবং তার জন্য নিয়মিত শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জিলানের মীর মুহম্মদ হাশিম ছিলেন তাঁর শিক্ষক। বার্নিয়ার মোল্লা সলিহকে তার পুরনো শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করলেও ফারসি ইতিহাসগুলো এই কথার সত্যতা স্বীকার করে না।
আওরঙ্গজেব ছিলেন বুদ্ধিমান এবং যেকোনো শিক্ষাই দ্রুত আয়ত্তে আনতে পারতেন, এটা আমরা সহজেই বিশ্বাস করতে পারি। তার চিঠিপত্র প্রমাণ করে যে কুরআন আর মহানবীর হাদিসের ওপর তার ছিল অসামান্য দখল, এবং প্রয়োজনে সেগুলো থেকে ঝটপট দিতে পারতেন যথাযথ উদ্ধৃতি । আরবি আর ফারসি তিনি বলতে এবং লিখতে পারতেন একজন ওস্তাদের মতোই। হিন্দি ছিল তাঁর মাতৃভাষা, মোগল প্রাসাদের ব্যক্তিগত জীবনে এই ভাষার ব্যবহার ছিল। হিন্দিতেও মোটামুটি জ্ঞান ছিল তাঁর, এই ভাষায় জনপ্রিয় কিছু বাণী কিংবা প্রবচনের উল্লেখ তিনি করতে পারতেন।
আওরঙ্গজেব আরবি লিখতেন বলিষ্ঠ নশ’ স্টাইলে। এই স্টাইলেই তিনি কুরআন নকল করতেন। চমৎকারভাবে বাধাই আর সাজসজ্জা করে এ রকম দুটো নকল তিনি উপহার হিসেবে পাঠান মক্কা এবং মদিনায়। তাঁর নসতালিক’, এবং ‘শিকস্তা’ স্টাইলের লেখাও ছিল অপূর্ব,’ বলেছেন সাকি মুসতাদ খান। এই কথাও বিশ্বাসযোগ্য, কারণ, আওরঙ্গজেব প্রচুর চিঠিপত্র লিখতেন এবং সমস্ত দরখাস্তে নিজ হাতে আদেশ লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি অর্থহীন, গুণকীর্তনমূলক কবিতা শুনতে মোটেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু সৎ উপদেশসংবলিত কবিতার ওপরে তাঁর একটা টান ছিল। আধ্যাত্মিক বইপত্রই ছিল তাঁর প্রিয় পড়াশোনার বিষয়-কুরআন সম্বন্ধীয় মন্তব্য, মহানবীর ঐতিহ্য, ইমাম গাজ্জালির রচনাবলি, শেখ শরফ ইয়াহিয়া আর শেখ জইন-উদ-দীন কুতব মুহী শিরাজির চিঠিপত্রের বাছাই অংশ এবং ওই-জাতীয় অন্যান্য রচনা।
চিত্রকলা আওরঙ্গজেব একেবারেই পছন্দ করতেন না, এবং তাঁর রাজত্বের দশম বছরেই দরবার থেকে তিনি বিতাড়িত করেছিলেন সংগীতকে। সুন্দর চিনামাটির পাত্রের ওপর টান ছিল তাঁর, কিন্তু পিতার মতো সুন্দর ইমারত নির্মাণের কোনো রকম ঝোঁক ছিল না। একমাত্র মতি মসজিদ ছাড়া স্থাপত্যশিল্পের আর কোনো ধ্রুপদি কীর্তি তার শাসনকালে নির্মিত হয়নি। যা কিছুই তিনি নির্মাণ করেছেন, তা সাধারণ প্রয়োজনের খাতিরে, যেমন, তার বিজয়ের দৃশ্যচিহ্নিত কিছু মসজিদ এবং দক্ষিণ আর পশ্চিমগামী রাজপথের পাশে অসংখ্য সরাইখানা।
১.৫ হাতির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের লড়াই
বাল্যকালের এক ঘটনায় আওরঙ্গজেবের নাম ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে। ১৬৩৩ সালের ২৮ মে শাহজাহান আগ্রায় যমুনার তীরে সুধাকর আর সুরত-সুন্দর নামের বিশালদেহী দুই হাতির লড়াইয়ের আয়োজন করলেন। খানিকটা ছুটোছুটি করল জানোয়ার দুটো, তারপর ভীষণ এক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলো দুর্গের ঝুলবারান্দার নিচে। সম্রাট ছুটে গেলেন লড়াই দেখার জন্য, সামনে সামনে ঘোড়ার পিঠে তাঁর তিন পুত্র। লড়াই দেখার বাড়তি কৌতূহলে আওরঙ্গজেব চলে গেলেন হাতি দুটোর একেবারে কাছে।
কিছুক্ষণ পর একে অপরকে ছেড়ে হাতি দুটো খানিকটা করে পিছিয়ে এল। কিন্তু সুধাকরের মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখতে না পেয়ে তেড়ে গেল সে আওরঙ্গজেবের দিকে। মাত্র ১৪ বছর বয়স হলেও ঠান্ডা মাথায় তিনি তার ঘোড়াকে পালিয়ে যাওয়া থেকে নিরস্ত করলেন, তারপর বর্শা ছুঁড়ে মারলেন সোজা হাতির মাথায়। চারপাশে তখন এক দারুণ হুলস্থুল। চিৎকার শুরু করল সভাসদেরা, হাতিকে ভয় দেখানোর জন্য আতশবাজি পোড়ানো হলো, কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। হাতিটার লম্বা দাঁতের এক আঘাতে ভূপতিত হলো আওরঙ্গজেবের ঘোড়া। এক লাফে মাটি থেকে উঠে ক্রুদ্ধ জানোয়ারটার মুখোমুখি হলেন তিনি তরবারি হাতে। জনতা, ধোঁয়ার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে ঘোড় লাফিয়ে ওঠায় মাটিতে ছিটকে পড়লেন তার বড় ভাই সুজা। রাজা জয়সিংহও এগিয়ে এলেন। এই সময় নতুনভাবে লড়াই শুরু করার জন্য ছুটে এল সুরত-সুন্দর । ইতিমধ্যে বর্শার খোঁচায় আর তার দিকে ছাড়া আতশবাজিতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল সুধাকর, পালাল সে লড়াইয়ের মাঠ থেকে, মাটি কাঁপিয়ে সুরত-সুন্দর তেড়ে গেল পেছনে পেছনে। রক্ষা পেয়ে গেলেন দুই শাহজাদা। আওরঙ্গজেবকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁর সাহসের প্রশংসা করলেন শাহজাহান, তাঁকে ভূষিত করলেন বাহাদুর’ খেতাবে। সভাসদেরা জয়ধ্বনি দিয়ে বলল যে পুত্র পেয়েছে পিতারই অসীম সাহসের উত্তরাধিকার। তারা স্মৃতিচারণ করতে থাকল, যৌবনে শাহজাহান একবার জাহাঙ্গীরের উপস্থিতিতে খোলা তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক বুনো বাঘের ওপর।
এই ঘটনায় আওরঙ্গজেবের মহান চরিত্রের একটা পূর্বাভাস পাওয়া গেল। পিতার প্রশংসার জবাবে তিনি বললেন, “এই লড়াইয়ে যদি মৃত্যুও হতো, আপসোস করার কিছু ছিল না আমার, কারণ, এটা অগৌরবের মৃত্যু হতো না। মৃত্যুর হাত থেকে এমনকি সম্রাটদেরও রেহাই নেই।
১৬৩৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাঁকে দশ হাজার ঘোড়ার সেনাপতি নিযুক্ত করা হলো। পরের সেপ্টেম্বরেই যুদ্ধ এবং সেনা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য তাঁকে পাঠানো হলো বুন্দেলা অভিযানে।
১.৬ বুন্দেলার যুদ্ধ ১৬৩৫
বুন্দেলার উছার রাজা বীর সিংহ দেব প্রভূত ধনসম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারী ছিল। সে ছিল জাহাঙ্গীরের অনুরাগভাজন এবং তাঁরই আদেশে আবুল ফজলকে হত্যা করেছিল। বীর সিংহের মৃত্যুর পর ১৬২৭ সালে রাজা হয়েছিল তার পুত্র বুঝর সিংহ। শাহজাহানের শাসনকালে নতুন এই রাজাকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। সে চৌরাগড়ের প্রাচীন গোন্দ রাজধানী আক্রমণ করে, রাজা প্রেম নারায়ণকে হত্যা করে এবং তার দশ লাখ টাকার সম্পদ হাতিয়ে নেয়। তখন তার পুত্র শাহজাহানের সাহায্য প্রার্থনা করে (১৬৩৫)।
বুন্দেলখণ্ড আক্রমণের জন্য তিনটে সেনাবাহিনী পাঠালেন সম্রাট, বুন্দেলার রাজ পরিবারের আরেক গোষ্ঠীর উত্তরাধিকারী দেবী সিংহকে সিংহাসনের প্রস্তাব দিয়ে তার সাহায্য নেওয়া হলো। কিন্তু যুদ্ধে একজন সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন হয়ে পড়ল, যে পরিকল্পনা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ব্যাপারে একই পদমর্যাদার তিন মোগল সেনাপতির মধ্যে সমন্বয়সাধন, সেইসঙ্গে সেনাবাহিনীতে একতা বজায় রাখতে পারবে। এই লক্ষ্যে আওরঙ্গজেবকে এই অভিযানের প্রধান নিযুক্ত করা হলো। তিনি থাকবেন সবার পেছনে, কিন্তু কোনো সেনাপতিই তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবে না।
১৬৩৫ সালের ২ অক্টোবর উছার নিকটবর্তী এক টিলা তছনছ করে ফেলল দেবী সিংহের লোকেরা, ৪ তারিখে মোগলেরা দখল করে নিল খোদ উছা। মনোবল হারিয়ে বুঝর প্রথমে ধামুনি, তারপর নর্মদা পেরিয়ে পালিয়ে গেল চৌরাগড়ে। ধামুনি দখল (১৪ অক্টোবর) করার পর মোগলেরা বুঝরের পিছু নিল । দেওগড়, চান্দা প্রভৃতি গোল দেশের ভেতর দিয়ে পালাতে পালাতে অভাব আর অবসাদে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল ঝুঝির, পদে পদে হারাল সে জনবল আর সম্পত্তি। অবশেষে জঙ্গলের গভীরে পলাতক রাজকুমারদের খুঁজে পেয়ে তাদের সেখানেই হত্যা করল গোন্দেরা (ডিসেম্বর)। তাদের স্ত্রী এবং কন্যারা জহরব্রত পালন করে নিজেদের ঠেলে দিল মৃত্যুর মুখে। যে দু-চারজন জীবিত রইল, তাদের এনে ঢোকানো হলো মোগল হেরেমে। বুঝরের কমবয়সী দুই পুত্র আর এক নাতিকে মুসলমান করা হলো। আরেক পুত্র এবং মৃত রাজার এক মন্ত্রী স্বধর্ম ত্যাগে রাজি না হওয়ায় দুজনকেই হত্যা করা হলো নৃশংসভাবে। উৰ্ছায় অবস্থিত বীর সিংহের বিশাল মন্দির ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে নির্মাণ করা হলো এক মসজিদ। ঝাসির দুর্গ দখল করে, যুদ্ধে অর্জিত অন্য দ্রব্যাদির সঙ্গে বীর সিংহের মাটিতে পুঁতে রাখা এক কোটি টাকার গুপ্তধন পাঠিয়ে দেওয়া হলো দিল্লিতে।
১.৭ দাক্ষিণাত্যের প্রথম সুবাদারি ১৬৩৬-১৬৪৪
আকবরের শাসনকালের শেষের দিকে মোগল সাম্রাজ্য নর্মদা নদী পেরিয়ে দক্ষিণে বিস্তৃতি লাভ করল। ১৫৯৯ সালে খান্দেশ সংযুক্ত হলো, তারপর বেরার এবং অবশেষে ১৬০০ সালে আহমদনগর। বালক সুলতান নিজাম শাহকে পদচ্যুত করে, তার রাজধানী মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করা হলো। তবে এই সংযুক্তি ছিল নামেমাত্র, কারণ, মোগলেরা এই বিজয়ের তেমন সুফল পায়নি। জাহাঙ্গীরের দুর্বল শাসনকালে দুর্লভ জ্ঞান এবং সামর্থ্যের অধিকারী এক আবিসিনীয় ক্রীতদাস মালিক অম্বরের বুদ্ধিদীপ্ত এবং সক্রিয় শাসনাধীনে নিজাম। শাহি বংশের পুনর্জাগরণ হলো, তার রাজস্ব পদ্ধতি রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির পাশাপাশি চাষি সম্প্রদায়কে সুখী করল। একজন জাত নেতা হিসেবে সে সমস্ত দলের বিরোধ মিটিয়ে, শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে, সুবিচার, সক্রিয়তা এবং জনসাধারণের উপকারের এমন এক নাম রেখে গেল, যা মানুষ আজও ভুলে যায়নি। দাক্ষিণাত্যের শক্তিগুলোকে একত্র এবং মারাঠি হালকা অশ্বারোহী বাহিনী ব্যবহার করে, সে পিছু হটতে বাধ্য করেছে মোগলদের।
১৬২৭ সালে মালিক অম্বরের মৃত্যুর পরপরই সিংহাসনে বসলেন শাহজাহান এবং দাক্ষিণাত্যে এক সক্রিয় পদ্ধতি চালু করলেন। নিজাম শাহি নতুন রাজধানী দৌলতাবাদ দখল করে বংশের শেষ সুলতান হোসেন শাহকে বন্দী করা হলো (১৬৩৩)। কিন্তু শুরু হলো নতুন এক ঝামেলা। বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার। সুলতানদ্বয় আদিল শাহ আর কুতব শাহ আহমদনগর-সংলগ্ন অংশগুলো দখলের চেষ্টা চালাল। বিখ্যাত শিবাজীর বাবা শাহজী বিজাপুরী সাহায্যে বলীয়ান হয়ে, নিজাম শাহকে পুতুল হিসেবে খাড়া করল এবং রাজ্যের এক-চতুর্থাংশের শাসনভার তুলে নিল নিজের নামে।
অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শাহজাহান বীরোচিত প্রয়াস চালালেন। অধিকতর দক্ষ প্রশাসনের খাতিরে দৌলতাবাদ এবং আহমদনগরকে খাদেশ প্রদেশ থেকে আলাদা করে দেওয়া হলো আরেক সুবার অধীনে (নভেম্বর ১৬৩৪)। ১৬৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সম্রাট স্বয়ং এলেন দাক্ষিণাত্যে। ৫০,০০০ সেনাসমৃদ্ধ তিনটে মোগল বাহিনী বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত থাকল, ওদিকে ৮,০০০ সেনার চতুর্থ বাহিনী মহারাষ্ট্র আক্রমণ করল। আতঙ্কে তৎক্ষণাৎ বশ্যতা স্বীকার করল কুতব শাহ, বাত্সরিক দুই লাখ হুন কর দিতে রাজি হলো, এবং মোগল সম্রাটকে মেনে নিল তার অধীশ্বর বলে।
বিজাপুরের রাজা স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করল। কিন্তু তিন মোগল বাহিনী তার রাজধানীতে প্রবেশ করে, মাঠ-ঘাট-গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিল, জনসাধারণকে ক্রীতদাসে পরিণত করল। অবশেষে ১৬৩৬ সালের মে মাসে একটা সন্ধি হলো। এই সন্ধিচুক্তির ফলে, বিগত নিজাম শাহি রাজ্য বিভক্ত হয়ে গেল দুই শক্তির মধ্যে, বিজাপুরের সুলতানের ভাগে পড়ল ভীমা আর শিনা নদীর মধ্যবর্তী শোলাপুর আর ওয়াঙ্গি, এবং উত্তর-পুবের ভালকি আর চিড়গুপা, সেইসঙ্গে পুনা জেলা আর উত্তর কঙ্কান–সব মিলিয়ে যার রাজস্ব আয় ২০ লাখ হুন (আশি লাখ টাকা)। আহমদনগরের বাদবাকি অংশ সংযুক্ত হলো মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে। পাশাপাশি, আদিল শাহ মোগল সাম্রাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্তৃত্ব মেনে নিল, গোলকুণ্ডার সুলতানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার কথা দিল, আর ২০ লাখ টাকা দিতে সম্মত হলো ক্ষতিপূরণ হিসেবে, কিন্তু কোনো বার্ষিক কর নয়।
শেষমেশ এভাবেই মিটে গেল দাক্ষিণাত্যের বিবাদ, পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হলো মোগল সাম্রাজ্যের সীমানা আর খোলাখুলিভাবে তা মেনে নিল স্থানীয় যুবরাজেরা, শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করে (১৪ জুলাই, ১৬৩৬), ফিরে এলেন উত্তর ভারতে, আওরঙ্গজেবের আবাস হলো আওরঙ্গাবাদে। মালিক অম্বর খিরকি গ্রামে এই শহর প্রতিষ্ঠা করে, শাহজাহানের অনুমতিক্রমে তার তৃতীয় সন্তানের নামানুসারে যার নাম হয় আওরঙ্গাবাদ।
দাক্ষিণাত্যে মোগলদের বিজয় সম্পূর্ণ হলো উদগির (২৮ সেপ্টেম্বর) আর আউসা (১৯ অক্টোবর) দুর্গদ্বয় দখল আর শাহজী ভোসলের শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে, যে, মোগল সেনাপতি খান-ই-জামান আর তার বিজাপুরী সহকারী রণদৌলা খানের তাড়া খেতে খেতে অক্টোবরের শেষে আত্মসমর্পণ করল উত্তর কঙ্কানের মহুলিতে। সে তার পুতুল সরকার নিজাম শাহকে মোগলদের হাতে তুলে দিল তার রাজকীয় সম্পত্তি, সাতটা দুর্গ আর মহারাষ্ট্রের সমস্ত ভূখণ্ডসহ। নিজাম শাহের অধীনে রয়ে গেল কেবল পুনা জেলার ছোট্ট একটা জায়গিরি।
আরেক মোগল সেনাপতি খান-ই-দৌরান প্রচুর কর আদায় করল দেওগড়ের গোন্দ রাজা আর অন্য দলপতিদের কাছ থেকে। ১৬৩৮ সালের জানুয়ারিতে আওরঙ্গজেব একটা সেনাদল পাঠালেন বাগলানা জয়ের উদ্দেশ্যে। চাদোর অঞ্চলের পুবের ছোট্ট এই রাজ্যটি অবস্থিত দাক্ষিণাত্য থেকে গুজরাটে যাওয়ার প্রধান পথের ওপর, আর এখানেই আছে বিখ্যাত দুই পাহাড়ে দুর্গ শালহির এবং মালহির । পতন ঘটল মালহির আর পিপলার আর পুরো রাজ্যকেই সংযুক্ত করা হলো জুনের শেষাশেষি। পরবর্তী বছরের (১৬৩৯) অক্টোবরে আওরঙ্গজেব শাহজীর চাচার এক পুত্র, মারাঠা দস্যু খিলোজী ভোঁসলেকে বন্দী এবং হত্যা করলেন।
১.৮ আওরঙ্গজেবের পরিবার
আওরঙ্গজেবের ছিল চার স্ত্রী, নাম :
১. দিলরাস বানু বেগম, তিনি ছিলেন শাহ নওয়াজ খানের কন্যা (শাহ নওয়াজ খানের পিতার দাদা ছিলেন পারস্যের বাদশাহ প্রথম শাহ ইসমাইল সাফাভির এক ছোট পুত্র)। ১৬৩৭ সালের ৮ মে আগ্রায় আওরঙ্গজেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় জাঁকজমকে ভরা অনুষ্ঠানে। পুত্র মুহম্মদ আকবরের জন্মের পরপরই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি, এবং ১৬৫৭ সালের ৮ অক্টোবর আওরঙ্গাবাদে মৃত্যুবরণ করেন। শহরের বাইরে কবর দেওয়া হয় তাকে, উপাধি দেওয়া হয় রাবিয়া-উল দৌয়ানি, যার অর্থ আধুনিক তাপসী রাবেয়া। দিলরাস বানুর সমাধিকে জনসাধারণ বলে, দাক্ষিণাত্যের তাজমহল, আওরঙ্গজেবের আদেশে এই সমাধির সংস্কার করেন দিলরাসের পুত্র আজম। যতদূর মনে হয়, মহিলা ছিলেন উদ্ধত প্রকৃতির, শরীরে রাজবংশের রক্ত ধারণ করার গর্বে গর্বিত, তাঁর প্রতি তার স্বামীর ছিল একধরনের ভীতিমিশ্রিত শ্রদ্ধা।
২. রহমত-উন-নিসা ওরফে নওয়াব বাই, তিনি ছিলেন কাশ্মিরের রাজাউরি রাষ্ট্রের রাজা রাজুর কন্যা, তাঁর শরীরে ছিল পাহাড়ি রাজপুতের রক্ত। কিন্তু তাঁর পুত্র বাহাদুর শাহ দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করার পর মহিলার জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছিল এক মিথ্যে বংশপরিচয়, যেন সম্রাট ইচ্ছে করলে তার নামের সঙ্গে সৈয়দ পদবি যুক্ত করতে পারেন। রহমত ফরদাপুরে, গিরিপথের পাদদেশে একটা সরাই নির্মাণ করেন, বৈজিপুরা নামে আওরঙ্গাবাদের একটা শহরতলিরও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। অশুভ উপদেষ্টাদের প্রভাবে তাঁর দুই পুত্র মুহম্মদ সুলতান আর মুয়াজ্জম সম্রাটকে অমান্য করেন, আর পুত্রদ্বয়ের এই অসদাচরণ মহিলাকে শেষ জীবনে খুব কষ্ট দেয়। তার উপদেশ এবং ব্যক্তিগত অনুরোধও মুয়াজ্জমকে তাঁর অসৎ কর্ম থেকে বিরত করতে পারে না, ফলে শেষমেশ মুয়াজ্জমকে বন্দী করা হয়। জীবনের প্রায় প্রথম ভাগেই নওয়াব বাই সম্রাটের কৃপাদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হন, এবং বহু বছর স্বামী এবং সন্তানদের থেকে আলাদা থাকার পর ১৬৯১ সালে দিল্লিতে চুকিয়ে দেন তাঁর জীবনের হিসাবনিকাশ।
৩. আওরঙ্গাবাদি মহল, তার এ রকম নামকরণ হয়েছিল আওরঙ্গাবাদ শহরে যুবরাজের হেরেমে প্রবেশ করার ফলে। ১৬৮৮ সালের অক্টোবর কিংবা নভেম্বরে বিজাপুর শহরে বিউবনিক প্লেগ এসে উপস্থিত হলে সেই অসুখের আক্রমণেই আওরঙ্গাবাদিমহল মৃত্যুবরণ করেন।
৪. উদিপুরী মহল, তিনি ছিলেন কাম বখশের মাতা। সমসাময়িক ভেনিসীয় পর্যটক মানুচির বক্তব্য অনুসারে, তিনি ছিলেন দারা শুকোর হেরেমের এক জর্জীয় ক্রীতদাসী বালিকা, যিনি তাঁর প্রথম প্রভুর পরাজয়ের পর বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীর হেরেমের অন্তর্ভুক্ত হন। ১৬৬৭ সালে প্রথমবারের মতো মা হওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল খুবই কম। সম্রাটের মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ওপর প্রভাব ছিল উদিপুরী মহলের, এবং বিশিষ্টা সুন্দরী এই মহিলা ছিলেন সম্রাটের বৃদ্ধ বয়সের প্রিয়তমা। তার সৌন্দর্যের প্রভাবে কাম বখশের অনেক অপরাধ সম্রাট ক্ষমা করে দেন এবং এড়িয়ে যান মাঝেমধ্যে মহিলার মাতাল হয়ে যাওয়ার অভ্যাস যে অভ্যাস নিশ্চয় এত ধার্মিক একজন মুসলমানকে যথেষ্ট মানসিক কষ্ট দিয়েছিল ।
উপরোক্ত চারজন ছাড়াও আরও এক মহিলার কথা জানা যায়, যিনি তাঁর কমনীয় মাধুর্য, সাংগীতিক দক্ষতা, এবং মিষ্টি কথায় প্রলুব্ধ করার প্রভূত ক্ষমতার বলে হয়েছিলেন কট্টর এই সম্রাটের জীবনের একমাত্র রোমান্টিক অধ্যায়। হীরা বাই ওরফে জয়নাবাদি ছিলেন মীর খলিলের হেরেমের এক তরুণী ক্রীতদাসী । মীর খলিলের বিয়ে হয়েছিল আওরঙ্গজেবের মায়ের এক বোনের সঙ্গে। দাক্ষিণাত্যের সুবাদার থাকাকালীন শাহজাদা একবার বেড়াতে গিয়েছিলেন বুরহানপুরে তার খালুর বাড়িতে। সেখানেই, তপতীর উল্টো পাশের জয়নাবাদ পার্কে পায়চারি করার সময় শাহজাদা প্রথম দেখেন নেকাবহীন হীরা বাইকে । অপূর্ব সেই সুন্দরী ‘ফলে-নুয়ে-পড়া এক আমগাছ দেখে হাসতে হাসতে সেদিকে এগিয়ে যান অঙ্গে ঢেউ তুলে, লাফিয়ে ওঠেন, পেড়ে আনেন একটা আম, শাহজাদার উপস্থিতি তিনি যেন টেরই পাননি। তার সৌন্দর্যের অতুলনীয় কলা আওরঙ্গজেবের বুকে ঝড় তোলে; ‘নির্লজ্জ কাকুতি-মিনতির পর তিনি মহিলাকে ভাগিয়ে নিয়ে যান তার খালুর বাড়ি থেকে আর জড়িয়ে পড়েন প্রচণ্ড এক ভালোবাসায়’, এতটাই যে, একদিন তিনি এক কাপ ওয়াইন নিয়ে তাঁকে পান করতে বলেন। তাঁর সমস্ত অনুনয়-বিনয় ব্যর্থ হওয়ার পর অসহায় প্রেমিক যখন নিষিদ্ধ সেই পানীয় পান করার জন্য প্রায় প্রস্তুত, তখন মায়াবিনী সেই মহিলা তার ঠোঁটের কাছ থেকে কাপটা কেড়ে নিয়ে বলেন, “আমি তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম মাত্র, তোমাকে মদ্যপানের পাপের অংশীদার করতে চাইনি’ যুবতী বয়স পেরোনোর আগেই তার মৃত্যুতে এই গল্পে যবনিকা নেমে আসে। হীরা বাইয়ের মৃত্যুতে আওরঙ্গজেব গভীর শোকে নিমজ্জিত হন, আর তাকে সমাধিস্থ করেন আওরঙ্গাবাদের বিশাল দিঘির পাশে।
আওরঙ্গজেবের বংশধরের সংখ্যা ছিল অনেক। তাঁর প্রধান স্ত্রী, দিলরাস বানু বেগম, তার পাঁচ সন্তানের জন্ম দেন :
১. জেব-উন-নিসা, এই কন্যা দৌলতাবাদে জন্মগ্রহণ করেন ১৬৩৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, আর ১৭০২ সালের ২৬ মে দিল্লিতে মারা যাওয়ার পর তাকে সমাধিস্থ করা হয় তিরিশ হাজার গাছ’-এর বাগানে, কাবুল গেটের বাইরে। রেলপথের জায়গা করে দেওয়ার জন্য তার সমাধি ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। উত্তরাধিকারিণী হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন বাবার ক্ষুরধার বুদ্ধি আর সাহিত্যিক রুচি। ব্যক্তিগত সংগ্রহের বিচারে তার লাইব্রেরি সবাইকে হার মানিয়েছিল, আর তিনি প্রচুর বেতনে অনেক পণ্ডিত নিযুক্ত করেছিলেন, যারা তাঁর আদেশ অনুসারে সাহিত্যকর্ম করতেন কিংবা তার পাণ্ডুলিপি কপি করে দিতেন। যেহেতু আওরঙ্গজেব কবিতা পছন্দ করতেন না, জেব-উন-নিসার বদান্যতা দরবারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবকে অনেকটা দূর করত, আর সমসাময়িক বেশির ভাগ কবি তার কাছেই আশ্রয় খুঁজে নিত। পারসি গীতিকবিতা (ode) লিখতেন তিনি মাকফি’ ছদ্মনামে, যার অর্থ আড়ালের একজন’, তবে আজও বিদ্যমান দিওয়ান ই-মাকফিঅবশ্যই জেব-উন-নিসার সাহিত্যকর্ম নয়।
২. জিনাত-উন-নিসা, পরে যে কন্যাটির আরেক নাম হয়েছিল পাদিশাহ বেগম, তিনি সম্ভবত আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬৪৩ সালের ৫ অক্টোবর। সিকি শতাব্দী ধরে তিনি তাঁর বুড়ো বাবার মৃত্যু পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের বাড়ির দেখাশোনা করেছেন, আর আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরও অনেক দিন বেঁচে থেকে মহান এক যুগের প্রতিভূ হিসেবে উপভোগ করেছেন তাঁর উত্তরাধিকারীদের সমীহ। ঐতিহাসিকেরা জিনাত-উন-নিসার ধর্মানুরাগ এবং হাত খুলে দানের খুবই প্রশংসা করেছে। ১৭২১ সালের ৭ মে তিনি দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন আর তাঁরই খরচে নির্মিত (১৭০০) চমৎকার জিনাত-উল-মসজিদে সমাধিস্থ হন।
৩. জুবদাত-উন-নিসা, মুলতানে জন্মগ্রহণ করেন ১৬৫১ সালের ২ সেপ্টেম্বর, বড় চাচার পুত্র শিপির শুকোর (হতভাগ্য দারা শুকোর দ্বিতীয় পুত্র) সঙ্গে বিবাহ। বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৬৭৩ সালের ৩০ জানুয়ারি, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৭০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
৪. মুহম্মদ আজম, এই পুত্র বুরহানপুরে জন্মগ্রহণ করেন ১৬৫৩ সালের ২৮ জুন, এবং বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারীর লড়াইয়ে জাওতে নিহত হন ১৭০৭ সালের ৮ জুন।
৫. মুহম্মদ আকবর, ১৬৫৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন, পারস্যে নির্বাসনে থাকাকালীন মারা যান ১৭০৪ সালের নভেম্বরের দিকে, আর মাশহাদে সমাধিস্থ হন।
নওয়াব বাইয়ের কাছ থেকে সম্রাট লাভ করেন তিন সন্তান :
৬. মুহম্মদ সুলতান, ১৬৩৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মথুরায়, আর বন্দী অবস্থায় মারা যান ১৬৭৬ সালের ৩ ডিসেম্বর। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় খাজা কুতব-উদ-দীনের সমাধির বেষ্টনীর মধ্যেই।
৭. মুহম্মদ মুয়াজ্জম, ওরফে শাহ আলম, যিনি বাবার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন প্রথম বাহাদুর শাহ নামে, বুরহানপুরে জন্মগ্রহণ করেন ১৬৪৩ সালের ৪ অক্টোবর, আর ১৭১২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন লাহোরে ।
৮. বদর-উন-নিসা, এই কন্যা জন্মগ্রহণ করেন ১৬৪৭ সালের ১৭ নভেম্বর, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৬৭০ সালের ৯ এপ্রিল।
আওরঙ্গাবাদি মহল আওরঙ্গজেবকে দিয়েছিলেন মাত্র একটি কন্যাসন্তান:
৯. মিহর-উন-নিসা জন্মগ্রহণ করেন ১৬৬১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, চাচাতো ভাই ইজিদ বখশের (নিহত মুরাদ বখশের ছেলে) সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৬৭২ সালের ২৭ নভেম্বর, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৭০৬ সালের জুন মাসে।
উদিপুরী মহল ছিলেন–
১০. মুহম্মদ কাম বখশের মা। এই পুত্র দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন ১৬৬৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, আর ১৭০৯ সালের ৩ জানুয়ারি হায়দরাবাদের কাছে নিহত হন উত্তরাধিকারীর লড়াইয়ে।
১.৯ আওরঙ্গজেবের মর্যাদাহানি
১৬৪৪ সালে আকস্মিকভাবে আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যের প্রথম সুবাদারি খারিজের মাধ্যমে তার মর্যাদাহানি হয়।
১৬৪৪ সালের ২৬ মার্চের এক রাতে আগ্রা দুর্গে শাহজাদি জাহানারা তাঁর পিতার কক্ষ থেকে নিজের কক্ষে ফেরার সময় বারান্দায় রাখা মোমবাতিতে ছোঁয়া লেগে তাঁর ঘাগরায় আগুন ধরে গেল। জাহানারার শরীর এমন মারাত্মকভাবে পুড়ে গেল যে চার মাস তিনি দুলতে থাকলেন জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি।
দিল্লির প্রধান রাজকীয় চিকিৎসক অনেক চেষ্টা করেও পোড়া ক্ষত সারাতে ব্যর্থ হলেন, কিন্তু আরিফ নামের এক ক্রীতদাসের তৈরি করা মলম ব্যবহার করে শাহজাদির ক্ষত সম্পূর্ণ সেরে গেল। শাহজাদির আরোগ্য লাভের আনন্দ উদযাপনের জন্য ২৫ নভেম্বর শুরু হলো খুবই চমৎকার আর জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। আর এই অনুষ্ঠানেই জাহানারার অনুরোধে আওরঙ্গজেব তাঁর পিতার কৃপা এবং হারানো পদ ফিরে পেলেন।
বোনকে দেখতে আওরঙ্গজেব আগ্রা এসেছিলেন ২ মে। এখানেই, তিন সপ্তাহ পর, তিনি আকস্মিকভাবে তাঁর পদমর্যাদা আর মাসোহারা থেকে বঞ্চিত হন। তার একটা চিঠি থেকে জানা যায় যে দারার অটল হিংস্রতা আর জ্যেষ্ঠ পুত্রের প্রতি শাহজাহানের পক্ষপাতের ফলে সম্রাটের আস্থা এবং সমর্থন থেকে বঞ্চিত আওরঙ্গজেব প্রতিবাদ হিসেবে পদত্যাগ করেন। তিনি অনুভব করেন যে জনসাধারণের চোখে তিনি ছোট হয়ে গেছেন এবং এই পরিস্থিতিতে তার পক্ষে আত্মসম্মান বজায় রেখে দাক্ষিণাত্য শাসন করা সম্ভব নয়।
জাহানারার মধ্যস্থতায় সম্রাট আবার আওরঙ্গজেবের প্রতি সদয় হন, আর ১৬৪৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে প্রেরণ করেন গুজরাটের সুবাদার হিসেবে। ১৬৪৭ সালের জানুয়ারিতে বলখে নিযুক্তি পাওয়ার পর তাঁর এই প্রদেশের সুবাদারির অবসান হয়। কিন্তু মাত্র এই দুই বছরেরও কম সময়ে গুজরাটে আওরঙ্গজেব তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রভূত চিহ্ন প্রদর্শন করতে সক্ষম হন।
গুজরাটের দস্যু আর বিদ্রোহীদের দমন করতে আওরঙ্গজেব এক সক্রিয় এবং দৃঢ় পন্থা অবলম্বন করেন। কার্যকরভাবে বিদ্রোহ দমন করতে তিনি নামিয়ে দেন সেনাবাহিনী। আর এভাবেই পিতার চোখে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন সমর্থ এবং সাহসী একজন মানুষ হিসেবে, যার ফলে অচিরেই শাসনকর্তা এবং সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সুদূর বলখ আর বাদাখশানে (২১ জানুয়ারি, ১৬৪৭), যেখানে তার এসব গুণাবলির বড়ই প্রয়োজন ছিল।
১.১০ বলখে আওরঙ্গজেবের সামরিক অভিযান ১৬৪৭
কাবুলের উত্তরের হিন্দু কুশ পর্বতমালার ঠিক ওপারের বলখ আর বাদাখশান প্রদেশ ছিল বুখারা রাজ্যের উপনিবেশ। তাদের রাজা, নজর মুহম্মদ খান ছিল একজন দুর্বল আর অযোগ্য শাসক, যে তার প্রজাদের সমস্ত শ্রেণীর মধ্যে একটা বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করেছিল। তার সিংহাসনারোহণের তিন বছরের মধ্যেই বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তার বিশাল রাজ্যের অনেক অংশে (১৬৪৫)। এই সুযোগে শাহজাহান একটা অভিযান চালালেন বলখ আর বাদাখশান দখলের উদ্দেশ্যে, কারণ, এই দুই প্রদেশে ছিল বাবরের উত্তরাধিকার, আর এগুলো বিস্তৃত সমরকন্দ যাওয়ার পথের ওপর, যে সমরকন্দ ছিল মোগল বংশের প্রতিষ্ঠাতা তৈমুর লংয়ের রাজধানী।
১৬৪৬ সালের জুন মাসে, শাহজাদা মুরাদ বখশ বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে সহজেই বাদাখশান আর বলখ জয় করলেন। কিন্তু শাহজাদা এবং তাঁর কর্মচারীরা উভয়ে মধ্য এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত, নীরস আর রুচিহীন অঞ্চলে কাজ করতে ঘৃণাবোধ করত, পাশাপাশি তাদের ছিল আমুদরিয়ার ওপার থেকে আসা। হিংস্র উজবেকদের সঙ্গে লড়াইয়ে মুখোমুখি হওয়ার ভয়। আগস্ট মাসে সম্রাটের ইচ্ছের বিরুদ্ধে মুরাদ বলখ থেকে ফিরে এলেন তার সেনাবাহিনীকে নেতৃত্বহীন করে! বিশ্রী এই পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে তখন সেখানে পাঠানো হলো আওরঙ্গজেবকে। ১৬৪৭ সালের ৭ এপ্রিল আলী মর্দান খানকে তাঁর ডান হাত করে কাবুল ত্যাগ করলেন আওরঙ্গজেব, আর উজবেক যাযাবরদের সঙ্গে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ করতে করতে বলখ শহরে পৌঁছলেন ২৫ মে।
বুখারা জাতীয় প্রতিরক্ষার পুরোভাগে ছিল নজর মুহম্মদের যোগ্য আর বীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল আজিজ খান। তার নির্দেশে উজবেক যাযাবরেরা বলখের বিভিন্ন জায়গায় মিলিত হয়ে মোগল বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ এবং অবরোধ করার হুমকি দিতে লাগল। আকচাতে (৪০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে) সমবেত হওয়া শত্রুবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করতে আওরঙ্গজেব যখন বেরিয়ে গেলেন বলখ ছেড়ে, প্রতিদিন তাঁকে হতে হলো উজবেকদের আক্রমণের সম্মুখীন, ওদিকে শত্রুবাহিনীর আরেকটা অংশ বুখারা থেকে এগিয়ে এল বলখ শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে। এই সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব রাজধানীর ফিরতি পথ ধরতে বাধ্য হলেন, পদে পদে যুদ্ধ করতে করতে। এই এগোনো আর ফিরে আসায় সময় লাগল দশ দিন, যার পুরোটা জুড়ে মোগল সেনাবাহিনী বিশ্রাম বলতে কিছু পেল না। দিনের পর দিন। কঠিন লড়াইয়ে তাদের ব্যস্ত থাকতে হলো এক অক্লান্ত আর ভ্রাম্যমাণ শত্রুর বিপক্ষে, এদিকে সেনারা কাতর হয়ে পড়ল খিদেয়। সব সময় এগিয়ে চলা অব্যাহত রাখতে হলো তাদের, খাবার রান্নার জন্য ব্যবহার করা গেল কেবল চলমান হাতির পিঠ! রুটি বিক্রি হলো প্রতিটা এক টাকা এমনকি দুই টাকা করে, পাশাপাশি দেখা দিল পানির সংকট, যথেষ্ট খরচ করা সত্ত্বেও সেনাদের পর্যাপ্ত রুটি সরবরাহ করা গেল না। কিন্তু এত কষ্ট আর বিপদের মধ্যেও আওরঙ্গজেবের দৃঢ়তা আর নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীকে কোনো প্রকার শিথিলতা কিংবা বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করতে পারল; তার সতর্ক চোখ আর কর্মতৎপর শরীর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছুটে গেল যেকোনো দুর্দশাগ্রস্ত স্থানে, এবং তার জ্ঞান আর সাহস শেষমেশ সেনাবাহিনীকে ফিরিয়ে আনল নিরাপদে।
আওরঙ্গজেবের প্রচণ্ড একগুঁয়ে স্বভাব উদ্দেশ্য সফলে সমর্থ হলো। শান্তি স্থাপন করতে চাইল আবদুল আজিজ। ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো তার আওরঙ্গজেবকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার আশা । একদিন স্বচক্ষেই সে দেখতে পেল শাহজাদার সীমাহীন সাহস–তখন বিকেলবেলা, ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে, এ রকম পরিস্থিতিতে এসে গেল নামাজের সময়, যুদ্ধক্ষেত্রেই জায়নামাজ বিছালেন আওরঙ্গজেব, হাঁটু মুড়ে বসে নামাজ পড়তে লাগলেন সম্পূর্ণ শান্ত মনে, চারপাশের ভীষণ কোলাহল আর অস্ত্রের ঝনঝনানিকে চুল পরিমাণ গ্রাহ্য করলেন না। সে সময় ঢাল বা তলোয়ার কিছুই ছিল না তাঁর কাছে। বুখারার সেনারা অবাক হয়ে দেখতে লাগল এই দৃশ্য, আর যুদ্ধ থামিয়ে আবদুল আজিজ চিৎকার দিয়ে উঠল, এমন মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করার অর্থ হলো নিজের অনিবার্য ধ্বংস ডেকে আনা।
আবদুল আজিজ প্রস্তাব করল যে শাহজাহান যেহেতু সর্বসমক্ষেই বলখকে তার পিতার হাতে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এখন আওরঙ্গজেবের উচিত এই দেশটাকে তাঁর ছোট ভাই সোবহান কুলির হাতে ছেড়ে দেওয়া। আওরঙ্গজেব এর সমাধানের ভার ছেড়ে দিলেন সম্রাটের হাতে, যিনি নজর মুহম্মদকে এই দেশ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, যদি সে সম্রাটের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার বাদশাহি সম্মান রক্ষা করে!
ক্ষমা চাওয়া হলো। ফলে ১ অক্টোবর বলখ দুর্গকে হস্তান্তর করা হলো নজর মুহম্মদের প্রতিনিধিদের কাছে, আর মোগল সেনাবাহিনী ধরল কাবুলের ফিরতি পথ; ভয়াবহ অভাবের মুখোমুখি হওয়ার পাশাপাশি অর্থ আর প্রাণহানি ঘটল তাদের, হিন্দু কুশ গিরিপথ অতিক্রম করতে গিয়ে তাদের সামনে আর পেছন থেকে মোকাবিলা করতে হলো উজবেক আর হাজারীদের আক্রমণ। এই অঞ্চলে সম্রাট-বাহিনী হারাল তাদের ৫০০০ মানুষ, সেই সঙ্গে ওই একই সংখ্যক মালবাহী পশু। যে পরিমাণ শস্য, অন্যান্য খাবার আর সামরিক মজুত ফেলে যেতে হলো মোগল বাহিনীকে, সেসবের মূল্য লাখ লাখ টাকা। এই যুদ্ধে ভারতীয় রাজকোষ থেকে ব্যয় হলো চার কোটি টাকা, অথচ তার বিনিময়ে দখল করা গেল না এক ইঞ্চি ভূখণ্ড।
বলখ অভিযানের পর ১৬৪৮ সালের মার্চ থেকে ১৬৫২ সালের জুলাই পর্যন্ত আওরঙ্গজেব কাজ করলেন মুলতান আর সিন্ধের শাসনকর্তা হিসেবে। এই সময়ের মধ্যে তাঁকে দুবার তাঁর প্রদেশ থেকে পাঠানো হলো কান্দাহার অবরোধ করে। দুৰ্গটা পারসিদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করার জন্য, (১৬৪৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর আর ১৬৫২ সালের মার্চ থেকে জুলাই)। তাঁর নতুন প্রদেশে ছিল প্রচণ্ডতম বুনো স্বভাব আর বশ মানানোর অসাধ্য আফগান আর বেলুচ গোত্রের বসবাস। এই স্বল্প সময়ে আওরঙ্গজেব কুখ্যাত কয়েকজন দস্যু দলপতিকে হত্যা করার পাশাপাশি সম্রাটের প্রতি সীমান্তবর্তী গোত্রগুলোর নামেমাত্র একটা আনুগত্য নিশ্চিত করাতে পারলেন।
এই সময়ে প্রদেশের বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে তিনি বাড়িয়ে দিলেন সামুদ্রিক বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধা। নদীমুখে বালি জমে বন্দর হিসেবে অচল হয়ে পড়েছিল টাট্টা, আওরঙ্গজেব নতুন একটা বন্দর চালু করলেন সিন্ধু নদের আরও ভেতরের দিকে, আর সেখানে নির্মাণ করলেন একটা দুর্গ আর একটা জাহাজঘাটা।
১.১১ আওরঙ্গজেবের কান্দাহার অবরোধ ১৬৪৯-১৬৫২
কান্দাহার দুর্গ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিম থেকে ভারত আর দক্ষিণ থেকে কাবুল যাওয়ার পথের ওপর। রণকৌশলের বিচারে এই জায়গাটার গুরুত্ব এ জন্য যে ৩৬০ মাইলব্যাপী একটা সমতল দেশ এটাকে বিচ্ছিন্ন করেছে হিরাট থেকে, যেখানে গিয়ে সুউচ্চ হিন্দু কুশ পর্বতমালা হঠাৎ করেই নিচু হয়ে গেছে, যার ফলে সুগম হয়েছে মধ্য এশিয়া কিংবা পারস্য থেকে আসা আক্রমণকারীদের পথ। এই ধরনের যেকোনো সেনাবাহিনীকে অবশ্যই যেতে হবে কান্দাহার অতিক্রম করে, আবার ফিরতেও হবে সেই পথেই। কাবুল যখন দিল্লি সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, তখন কান্দাহার ছিল আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য অপরিহার্য।
সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন পর্তুগিজ নৌবাহিনী প্রভুত্ব করত ভারত মহাসাগরে, আর ভারত থেকে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার সামুদ্রিক পথ তারা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল, তখন কান্দাহারের বাণিজ্যিক গুরুত্বও তাদের রণকৌশল-সংক্রান্ত গুরুত্বের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। পাশ্চাত্যগামী সমস্ত পণ্যদ্রব্য, এমনকি মসলাসমৃদ্ধ দ্বীপগুলোও তাদের মসলা নিয়ে মুলতান, পিশিন আর কান্দাহারের স্থলপথ ধরে এগিয়ে প্রথমে যেত পারস্যে আর তারপর ইয়োরোপে। ১৬১৫ সালে এই পথে এগিয়েছিল ১৪ হাজার ভারবাহী উট, আর কান্দাহার শহর অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত ফুলেফেঁপে উঠে পরিণত হয়েছিল পণ্যদ্রব্য লেনদেনের এক দারুণ উপযোগী স্থানে।
অবস্থানগত কারণেই কান্দাহার নিয়ে টানাটানি শুরু হয় পারস্য আর ভারতের শাসকদের মধ্যে। ১৫২২ সালে বাবর এটাকে দখল করলেন আফগান শাসকের কাছ থেকে, কিন্তু পারস্যের রাজা এটাকে আবার জয় করে নিলেন ১৫৫৮ সালে। তারপর ১৫৯৪ সালে আকবর এটা কিনে নিলেন পারস্যের শাহজাদা-শাসকের কাছ থেকে; কিন্তু জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ বয়সে শাহ আব্বাস দ্য গ্রেট আবার এটাকে দখল করলেন ৪৫ দিনের অবরোধের পর (১৬২৩)। ১৬৩৮ সালে পারস্যের শাসক আলী মর্দান খান প্রভুর রোষ থেকে বাঁচার জন্য এই দুর্গ তুলে দিলেন শাহজাহানের হাতে। কিন্তু পারসিরা উপেক্ষা করার মতো জাতি নয়; ১৬৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শাহজাহান উদ্ধারকারী সেনাবাহিনী পাঠাতে দেরি করার ফলে ৫৭ দিনের অবরোধের পর শেষমেশ তারা এটা কেড়ে নেয় মোগলদের হাত থেকে।
রাজকীয় সম্মান পুনরুদ্ধার করার জন্য কান্দাহার পারসিদের কাছ থেকে আবার জয় করে নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল, আর সেই লক্ষ্যেই শাহজাহানের পুত্রগণ এখানে তিনবার অভিযান চালান বহু টাকা খরচ করে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রথম অভিযানে ৫০,০০০ সেনার এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে আওরঙ্গজেব আর ওয়াজির সাদুল্লাহ খান কান্দাহার পৌঁছলেন ১৬৪৯ সালের ১৪ মে, আর পুরোপুরিভাবে দুর্গ অবরোধ করলেন; কিন্তু বড় কামানের অভাবে দুর্গের পতন ঘটানো সম্ভব হলো না। দিল্লি দরবারের ঐতিহাসিকেরা খোলাখুলি স্বীকার করেছে, তুর্কিদের সঙ্গে দীর্ঘ দিনব্যাপী যুদ্ধ করার ফলে পারসিরা দুর্গ প্রতিরোধে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। তারা ছিল আগ্নেয়াস্ত্র আর গোলার বিষয়ে ওস্তাদ। পর্যাপ্ত খাবার, দূরপাল্লার কামান আর দক্ষ গোলন্দাজ সেনা নিয়ে তারা দুর্গে এমন। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল…সম্রাট-বাহিনী যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে এঁটে উঠতে পারেনি। ৩ মাস ২০ দিন অবরোধ করার পর ৫ সেপ্টেম্বর আওরঙ্গজেব কান্দাহার থেকে ফিরতি পথ ধরলেন। তবে, আরঘান্দারের তীরে, কান্দাহারের ২৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের এক নির্দিষ্ট যুদ্ধে, তাঁর সেনাপতিদ্বয় কালিচ খান আর রুস্তম খান বিশাল এক পারসি সেনাবাহিনীকে দারুণভাবে পরাজিত করে তাড়িয়ে নিয়ে গেল কুশ-ই-নাখুদের ওপারে।
কান্দাহার দখলের দ্বিতীয় প্রচেষ্টা শুরু হলো আরও জোরেশোরে । আওরঙ্গজেব আর সাদুল্লাহ খান আবার দুর্গ অবরোধ করলেন (১৬৫২ সালের ২ মে)। গোলন্দাজ বাহিনী নিযুক্ত করা হলো দেয়াল ভাঙার জন্য, ট্রেঞ্চ খোঁড়া হলো দুর্গের নালার দিকে; নালার পানি শুকিয়ে, একটা নৈশ আক্রমণের প্রচেষ্টাও চালানো হলো ৪০ ধাপ (চিহিল জিনা) গম্বুজের পেছনের শৈলশিরার ওপর দিয়ে। কিন্তু মোগলদের কোনো প্রচেষ্টাই সফলতার মুখ দেখতে পেল না। দুর্গপ্রাকার থেকে রাশি রাশি গুলিবর্ষণের ফলে ট্রেঞ্চগুলো আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না…তিন দিক থেকে শত্রুসেনা দুর্গপ্রাকারের গায়ে নির্মিত ফুটো দিয়ে মাস্কেটের অবিরাম গুলিবর্ষণ করে চলল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, যেন আওরঙ্গজেবের সেনারা কিছুতেই এগোতে না পারে। সত্যি বলতে কি, পারসি গোলন্দাজ বাহিনী ছিল ততটাই দক্ষ যতটা অযোগ্য ছিল মোগল গোলন্দাজ বাহিনী। ভারতীয় গোলন্দাজেরা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হওয়ায় তারা দুর্গপ্রাকারের। কোনো রকম ক্ষতিসাধন করতে পারেনি।
অবরোধ শুরু করার এক মাসের মধ্যেই মালমসলার অভাবে ট্রেঞ্চ খোঁড়া বন্ধ করে দিতে হলো মোগলদের। ওদিকে আকস্মিকভাবে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে বারবার ঝটিকা আক্রমণ চালাতে লাগল পারসিরা, যার ফলে ট্রেঞ্চে অবস্থান নেওয়া অনেক মোগল সেনা হতাহত হলো, ধ্বংস হয়ে গেল কামান। পুরো দুই মাস গোলাবর্ষণ করেও মোগলেরা দুর্গপ্রাকারে কোনো ফাটল ধরাতে পারল না, সুতরাং এ রকম একটা দুর্গের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখাটা হতো পাগলামির শামিল। শেষমেশ শাহজাহানের আদেশে অবরোধ তুলে নিল মোগল সেনাবাহিনী আর কান্দাহার থেকে ফিরতি পথ ধরল তারা ৯ জুলাই।
এই অসাফল্যের জন্য আওরঙ্গজেবের ওপর খুবই রাগান্বিত হলেন শাহজাহান, অযোগ্যতার দুর্নাম আরোপ করলেন তিনি শাহজাদার ওপর । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কান্দাহার দখলে ব্যর্থতার কারণে আওরঙ্গজেবকে দোষারোপ করাটা। ছিল অন্যায় । অবরোধের সময়টা জুড়ে তিনি আসলে ছিলেন সহকারী সেনাপতি হিসেবে। কাবুল থেকে সম্রাট প্রত্যেকটা পদক্ষেপ নেওয়ার আদেশ পাঠাচ্ছিলেন সাদুল্লাহ খান মারফত। কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তিনি সম্রাটের আদেশ ছাড়া নিতে পারেননি।
আওরঙ্গজেব যে অযোগ্য ছিলেন না, তা প্রমাণিত হয়ে গেল পরবর্তী বছরেই, যখন দারা শুকোর নেতৃত্বে আরও বড় আর ব্যয়বহুল একটা অভিযান কান্দাহারে পরাজিত হলো শোচনীয়ভাবে। দুর্বল এই তিন অবরোধে ভারতীয় রাজকোষ থেকে ব্যয় হলো দশ কোটি টাকারও বেশি, আর সেইসঙ্গে মোগল সম্মান ভূলুণ্ঠিত হলো সমগ্র এশিয়ার চোখে । পারস্যের রাজার এই দম্ভোক্তি না মেনে উপায় রইল না যে দিল্লির শাসকেরা কেবল টাকা দিয়ে দুর্গ কিনতে জানে, কিন্তু বাহুবলে তা দখল করতে জানে না। স্বাভাবিকভাবেই পারস্যের সামরিক শক্তির সুনাম হলো। আকাশছোঁয়া। শতাব্দীর শেষভাগটুকু সম্ভাব্য এক পারসি আক্রমণের গুজব সন্ত্রস্ত করে রাখল দিল্লির দরবারকে। বছরের পর বছর পারসি এই বিপদ ঝোড়ো এক কালো মেঘের মতো ঝুলে রইল ভারতের পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের ওপর, আর। সম্রাট আওরঙ্গজেব আর তার মন্ত্রিবর্গ মাঝেমধ্যে ফেললেন স্বস্তির নিশ্বাস, যখনই মারা গেল পারস্যের যেকোনো একজন যুদ্ধংদেহী শাহ।