১৮. আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কিছু প্রদেশ

১৮. আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কিছু প্রদেশ

১৮.১ বাংলা : মোগল শান্তির অধীনে এটার প্রাকৃতিক সম্পদ ও সমৃদ্ধি

মোগল সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলোর মধ্যে বাংলার প্রতি রয়েছে প্রকৃতির অকৃপণ দান। এখানকার প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে চাষাবাদে কৃত্রিম সেচের প্রয়োজন পড়ে না। এখানকার অসংখ্য নদী ও পুকুর ভরা মাছ আর ফলে নুয়ে পড়া গাছ শস্যখেতের অভাব পূরণ করে। এ রকম একটা দেশ সম্পদে পূর্ণ করে তোলার জন্য চাই কেবল শান্তি। সেই শান্তি আর ভালো সরকার মোগল সাম্রাজ্য বাংলাকে দিয়েছে। সপ্তদশ শতাব্দী জুড়েই।

ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলায় অশান্তি ছিল অরাজকতা, প্রাদেশিক সুলতানাতগুলোর অবক্ষয় আর মোগলদের দীর্ঘদিনব্যাপী যুদ্ধের ফলে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মানুষের দুর্দশা ছিল চরমে। এমতাবস্থায় আকবরের বিজয় এই প্রদেশের জন্য বয়ে আনল আশীর্বাদ। কিন্তু সম্রাট আকবরের শাসনামলে বাংলায় মোগল আইন ছিল যতটা না স্থিরীকৃত প্রশাসন তার চেয়ে বেশি সশস্ত্র দখল। সুবাদারেরা সন্তুষ্ট ছিল স্বাধীন আফগান ক্ষুদ্র নৃপতি আর হিন্দু জমিদারদের নামমাত্র বশ্যতায়। সম্রাটের সুবাদারেরা কেবল কর আদায় করত, জনসাধারণের ওপর প্রতিষ্ঠা করত না প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যিক প্রশাসন; তখন সত্যিকার আইনের শাসন ছিল কেবল রাজধানীর চারপাশের জেলা, আর তাদের সহকারী, অর্থাৎ, ফৌজদারদের শাসিত কৌশলগত শহরগুলোতে। বিভিন্ন জমিদারের অধীনে বড় বড় বাহিনী থাকত শান্ত অথচ বিনাশহীন। জমিদারেরা থাকত সম্রাটের দুর্বলতা, দিল্লির কোনো আকস্মিক বিপত্তির অপেক্ষায়, যেন আবার জাহির করা যায় নিজেদের স্বাধীনতা। জাহাঙ্গীরের সিংহাসনারোহণের পর তাঁর নতুন সুবাদার এই প্রদেশ ছয় বছর শাসন করা (মে, ১৬০৮ থেকে ১১ আগস্ট, ১৬১৩) ইসলাম খান ছিল একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তৎপর আর তেজোময় অমাত্য। অভিযানের পর অভিযান চালিয়ে সে পরাজিত করেছিল বাংলার সব স্বাধীন জমিদারকে, ধ্বংস করেছিল ময়মনসিংহ, সিলেট আর উড়িষ্যার আফগান শক্তির অবশিষ্ট এবং পুরো বাংলায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল মোগল শান্তি আর প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যিক প্রশাসন। তারপর বাংলা ভোগ করেছিল প্রায় দেড় শতাব্দীর গভীর এক অভ্যন্তরীণ সুখ, ফিরে পেয়েছিল সম্পদ আর জনসংখ্যা, বিস্তৃত হয়েছিল বাণিজ্য, উন্নত হয়েছিল শিল্প, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হাতে গড়ে উঠেছিল চমৎকার এক স্বদেশজাত সাহিত্য। চাটগাঁর আরাকানি আর পর্তুগিজ জলদস্যুরা ছিল পূর্ব বাংলার নদী তীরের জেলাগুলোর এক ভয়াবহ যন্ত্রণা; কিন্তু আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৬৬) এই অভিশাপ দূর করেছিলেন শায়েস্তা খান; শতাব্দীর মাঝ থেকেই দ্রুত উন্নতিসাধন হয়েছিল ইংরেজ আর ওলন্দাজদের বাণিজ্যের, তাদের কারখানা আর ক্রয়ের আড়তগুলো দেশে এনেছিল উৎপাদন আর সম্পদের জোয়ার।

১৮.২ আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার শাসকগণ

বাংলায় শায়েস্তা খানের শাসনকাল বিস্তৃত ছিল ১৪ বছর (১৬৬৪-৭৭)। একটা প্রদেশের পক্ষে অস্বাভাবিক এই লম্বা সময়ে প্রথমে বাংলার নদী আর সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন তিনি জলদস্যুদের চাটগাঁর আবাস ভেঙে দিয়ে, আর ফিরিঙ্গিদের পরাজিত করে ঢাকার কাছে পুনর্বাসন করে। তার অভ্যন্তরীণ শাসনও ছিল একইরকম শান্ত ও উপকারী।

ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা আর অন্যায়ের দ্রুত প্রতিকারের জন্য প্রত্যেক দিন তিনি বসাতেন খোলা দরবার। এটাকে তিনি মনে করতেন তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। শায়েস্তা খান ফিরিয়ে এনেছিলেন কেনা আর বেচার পূর্ণ স্বাধীনতা, সেই সঙ্গে বাতিল করেছিলেন পূর্বসূরিদের বেআইনি দুটো আদায়-ব্যবসায়ী আর পর্যটকদের আয়ের ওপর চল্লিশ ভাগের এক ভাগ কর (জাকাত) এবং সব জাতের শিল্পী আর কারিগরদের ওপর ধার্য একটা দ্বারাদেয় শুল্ক । রাজধানী ঢাকায় তিনি নির্মাণ করেছিলেন সুন্দর সুন্দর অনেক দালান আর দেশজুড়ে সরাইখানা। মোটের ওপর তিনি ছিলেন একজন সদাশয় মানুষ। শায়েস্তা খানকে বাংলায় ফিরিয়ে আনা হয় ১৬৮০ সালের জানুয়ারিতে। দ্বিতীয় পর্বে নয় বছর থাকেন তিনি ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত; এই সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধ, যা ইতিমধ্যেই বর্ণিত হয়েছে। জনপ্রিয় একটা কাহিনি চালু আছে যে তার শাসনকালে বাংলায় আট মণ চাউল বিক্রি হতো এক টাকা দরে; আসলে, যেহেতু সেই আমলে রপ্তানি হতো না, এটা এমন অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনা ছিল না ঢাকা ও বরিশালের অঢেল চাউলের মধ্যে।

১৬৮৯ সালের জুনে সুবাদার হিসেবে এল ইব্রাহিম খান। সে ছিল কোমল মনের অত্যন্ত বই প্রেমিক, বসে বসে কাজ করায় অভ্যস্ত একজন বৃদ্ধ। উদ্দেশ্যসাধনে শক্তিহীন আর কর্মতৎপরতায় অসমর্থ হওয়ায় ফলে সে ঘটনার রাশ টেনে ধরল না, শেষমেশ ভেঙে পড়ল প্রদেশের প্রশাসন, যার যা খুশি তা-ই করতে লাগল। ব্যক্তিগতভাবে সে ছিল ন্যায়পরায়ণ, খামখেয়াল থেকে মুক্ত, কৃষি আর বাণিজ্যকে উন্নত করেছিল। বাংলায় এসে প্রথমেই সে চেয়েছিল ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে আর আবার তাদের বাংলায় স্থায়ী করতে।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকের বাংলা একজন বইয়ের পোকার উপযোগী ছিল না। প্রদেশের অরাজকেরা ইব্রাহিম খানের অলস প্রশাসনের সুযোগ নিল। মেদিনীপুর জেলার চেটো-বর্দার জমিদার শোভা সিং বিদ্রোহ করে উড়িষ্যার আফগানদের প্রধান রহিম খানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটপাট চালাতে লাগল বর্ধমান জেলার রাজা কৃষ্ণ রামের জমিদারিতে। ছোট একটা বাহিনী নিয়ে কৃষ্ণ রাম অগ্রসর হলো তাদের বিপক্ষে, কিন্তু পরাজিত এবং নিহত হলো সে, তার স্ত্রী, কন্যা, সমস্ত সম্পত্তিসহ বর্ধমান শহর দখল করল বিদ্রোহীরা। পশ্চিম বাংলার ফৌজদার, নূরুল্লাহ খান হাত গুটিয়ে বসে রইল হুগলি দুর্গে, বিদ্রোহীরা শিগগিরই তাকে অবরোধ করল। পৈতৃক প্রাণ নিয়ে সে পালিয়ে গেল রাতের আঁধারে, কিন্তু তার সম্পদ আর দুর্গ চলে গেল শোভা সিংয়ের হাতে।

এই বিদ্রোহের প্রারম্ভে, বাংলার তিন ইয়োরাপিয়ান জাতি সেনা অন্তর্ভুক্ত করেছিল তাদের সম্পত্তি পাহারা দিতে এবং তাদের কলকাতা, চন্দরনগর আর চিনপুরা উপনিবেশের শক্তি বৃদ্ধি করতে নিয়েছিল সুবাদারের অনুমতি । বাংলায় কোনো গোলমাল হলে এই জায়গাগুলোই হয়ে দাঁড়াল একমাত্র আশ্রয় । আগস্টে সাম্রাজ্যিক সরকারের পক্ষে হুগলি দুর্গ উদ্ধার করল চিনসুরার ওলন্দাজেরা।

এবার শোভা সিং বাহিনীর মূল অংশসহ রহিম খানকে পাঠাল সম্পদশালী শহর নদীয়া আর মুর্শিদাবাদ দখল করতে এবং নিজে ফিরে গেল তার সদর দপ্তর বর্ধমানে। সেখানে ছুরি মেরে তাকে হত্যা করল রাজা কৃষ্ণ রামের এক কন্যা। বিদ্রোহী সেনারা রহিমকে বেছে নিল তাদের প্রধান হিসেবে, আর নিজেকে সে ভূষিত করল রহিম শাহ উপাধিতে। এই সময় গঙ্গার পশ্চিমের পুরো বাংলা চলে গেল বিদ্রোহীদের হাতে, ওদিকে ইব্রাহিম খান চুপচাপ বসে রইল ঢাকায়। ইতিমধ্যে রহিমের সেনাবাহিনী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০,০০০ অশ্বারোহী আর ৬০,০০০ পদাতিকে। সে লুট করল সম্পদশালী শহর মুর্শিদাবাদ, মালদা আর রাজমহল।

এই বিদ্রোহের বিবরণ আর ইব্রাহিম খানের অবহেলার কথা শোনার পরপরই সম্রাট তাকে বরখাস্ত করলেন সুবাদারি থেকে, আর সেই পদে নিয়োগ দিলেন তার নাতি আজিম-উস-শানকে (১৬৯৭ সালের মাঝামাঝি)। শাহজাদা তখন ছিলেন দাক্ষিণাত্যে, তিনি আসার আগেই জবরদস্ত খান (ইব্রাহিম খানের পুত্র এবং বর্ধমানের ফৌজদার) উদ্ধার করল রাজমহল আর মালদা, তারপর আক্রমণ করল ভগবানগোলার বিদ্রোহী শিবির, আর দুই দিন যুদ্ধের পর সেটা দখল করল (মে, ১৬৯৭)। মুর্শিদাবাদ আর বর্ধমান থেকে বিতাড়িত হয়ে রহিম পালিয়ে গেল জঙ্গলে।

নভেম্বরে শাহজাদা আজিম বর্ধমানে এসে অনেকগুলো মাস থাকলেন সেখানে। জবরদস্ত প্রদেশ ছেড়ে যাওয়ায় বিদ্রোহীরা ফিরে এসে আবার শুরু করল তাদের কার্যকলাপ। নদীয়া আর হুগলি জেলায় লুটপাট চালিয়ে রহিম এল সম্রাট বাহিনীর মোকাবিলা করতে । একটা সাক্ষাৎকারের প্রতারণা করে এখানে সে হত্যা করল শাহজাদার প্রধানমন্ত্রী খাজা আনোয়ারকে, তারপর সম্রাট-বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে নিজেই নিহত হলো। নেতা মারা যাওয়ায় ধীরে ধীরে ভেঙে গেল বিদ্রোহী বাহিনী।

মুহম্মদ হাদি নামক অত্যন্ত যোগ্য একজন রাজস্ব অফিসারকে কর তলব খান (নভেম্বর, ১৭০০) উপাধি দিয়ে হায়দরাবাদের দেওয়ানি থেকে সম্রাট পাঠালেন বাংলায়, তারপর মুর্শিদ কুলি খান উপাধি দিয়ে পাঠালেন উড়িষ্যার সুবাদার করে (জানুয়ারি, ১৭০৩)। নতুন দেওয়ানের বিজ্ঞ ব্যবস্থাপনায় শিগগিরই বাংলা উঠে গেল উন্নতির শিখরে। বিশেষভাবে যত্নবান হলেন তিনি অফিসার নির্বাচনে আর তাদের মাধ্যমে নিলেন ভূমিসংক্রান্ত যাবতীয় প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহের ভার দেওয়ান নিলেন নিজের হাতে এবং জমিদার আর জায়গিরদারদের আত্মসাৎ বন্ধ করে বাড়িয়ে দিলেন বার্ষিক রাজস্ব।

মুর্শিদ কুলি রাজস্বের ব্যাপারে আজিম-উস-শানকে নাক গলাতে দিতে অস্বীকার করলেন। বোকা শাহজাদা তখন বিদ্রোহ করে দেওয়ানকে হত্যার একটা ষড়যন্ত্র আঁটলেন। তবে এই ষড়যন্ত্র বানচাল হয়ে গেল মুর্শিদ কুলি খানের উপস্থিত বুদ্ধি, সাহস আর তৎপরতায় । কিন্তু তার জীবন যেন আর কোনো হুমকির মুখে না পড়ে, সে জন্য ঢাকা থেকে রাজস্ব অফিস সরিয়ে নিয়ে গেলেন তিনি মকসুদাবাদে (১৭০৩), পরে নিজের নামানুসারে যার নাম তিনি রাখলেন মুর্শিদাবাদ। অষ্টাদশ শতাব্দীর অর্ধেক পর্যন্ত এটাই পরে হবে বাংলার রাজধানী । ঘটনার কথা শুনে আওরঙ্গজেব খুব রেগে গেলেন, আর শাহজাদাকে সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দিলেন বিহারে (জানুয়ারি ১৭০৩)। পরবর্তী তিন বছর (১৭০৪ ০৭) আজিম থাকলেন পাটনায়, আর সম্রাটের অনুমতি নিয়ে নিজের নামানুসারে সেটার নাম রাখলেন তিনি আজিমাবাদ।

মুর্শিদ কুলি খান প্রদেশ থেকে সম্রাটকে পাঠাতে লাগলেন উদ্বৃত্ত রাজস্ব। মুর্শিদ কুলি খানের অধীনে সবাই বুঝতে পারল যে এত দিনে প্রদেশে এসেছে শক্ত একজন প্রভু। নিজের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বয়ং রাজস্ব সংগ্রহ করার ফলে বাঁচালেন তিনি লাভের অংশ, যা এত দিন ভোগ করে এসেছে দালাল আর জমিদারেরা। মুর্শিদ কুলি খানের আদেশ ছিল এতই চরম যে সবচেয়ে অবাধ্য লোকও তার সামনে ঠক ঠক করে কাঁপত, আর মুখ বুজে মান্য করত সেই আদেশ। সপ্তাহে দুই দিন তিনি বসতেন বিচার করতে, আর সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন এতই পক্ষপাতহীন আর শাস্তি দানে কঠোর যে কেউই কারও ওপর অত্যাচার। করার সাহস পেত না।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক বছর পর তিনি হয়েছিলেন বাংলার সুবাদার, আর দিল্লি সরকারের হতাশাজনক পতনের পর এখানকার স্বাধীন শাসক। তাঁর অধীনে বাংলা ভরে গিয়েছিল শান্তি আর বাস্তব উন্নতিতে যা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। কেবল তার অযোগ্য উত্তরসূরিদের ভুল আর অপরাধে ।

১৮.৩ মালওয়া, মোগল আমলে এটার গুরুত্ব

মোগল সাম্রাজ্যের প্রদেশ মালওয়া যমুনা আর নর্মদা নদীর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে । তার পশ্চিমে, চম্বলের ওপারে রাজপুতানা, আর তার পুবে বুন্দেলখণ্ড। এখানকার জনসংখ্যার বেশির ভাগই রাজপুত, যারা বহুসংখ্যক ছোট ছোট গোত্র বা বিখ্যাত গোত্রের অখ্যাত শাখায় বিভক্ত। কিন্তু তাদের অনেক গোত্রের প্রভাব এখানকার অন্য অধিবাসীদের তুচ্ছ করে দেয়নি। এখানকার উত্তরে ছড়িয়ে আছে জাঠ, দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পুবে গোল, এ ছাড়া আছে মুসলমান অভিবাসী (প্রধানত আফগান)। অনুন্নত আদিম কিছু উপজাতি বাস করে পাহাড় আর জঙ্গলে।

মালওয়া কৃষি সম্পদে সম্পদশালী-এখানে ফলে আফিম, আখ, আঙুর, খরমুজা আর পান, এ ছাড়া বনে রয়েছে হাতির বড় বড় পাল। শিল্পে মোগল সুবা গুজরাটের পরই এটার স্থান। মোগল আমলে মালওয়ার গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছিল উত্তরের রাজধানী আগ্রা আর দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার বড় বড় সামরিক রাস্তাগুলো এটার ওপর দিয়ে যাওয়ার কারণে।

হিন্দু এই প্রদেশ আওরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংস আর হিন্দুদের ওপর মাথট বসানোর ব্যাপারটা মাথা নিচু করে মেনে নেয়নি। তবে বিশৃঙ্খলাও তেমন হয়নি এখানে। ছত্র শাল বুন্দেলা আর বখত বুলন্দ গোন্দের আক্রমণ ছাড়া সপ্তদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ পর্যন্ত মালওয়ায় বজায় থেকেছে শান্তি। জিনজি থেকে রাজারামের গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর শুরু হয়েছিল একটা বিক্ষোভ, যা পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল প্রদেশটার রাজনৈতিক ইতিহাস।

১৮.৪ মালওয়ায় মারাঠি আক্রমণ, ১৬৯৯-১৭০৬

১৬৯৯ সালে কৃষ্ণ সাবান্তের নেতৃত্বে মারাঠি একটা দল প্রথমবারের মতো নর্মদা অতিক্রম করে মালওয়ায় আক্রমণ চালায় ধামুনির প্রান্ত পর্যন্ত । ১৭০৩ সালের জানুয়ারিতে মারাঠিরা আবার নর্মদা অতিক্রম করে উজ্জয়িনীর আশপাশ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ১৭০৩ সালের অক্টোবরে নিমা সিন্ধিয়া বেরারে হামলে পড়ে, পরাজিত এবং বন্দী করে প্রদেশের সহকারী শাসক (ফিরুজ জংয়ের পক্ষে) রুস্তম খানকে, তারপর ছত্র শালের আমন্ত্রণে নর্মদা পেরিয়ে অগ্রসর হয় মালওয়ার দিকে। অনেক গ্রাম আর শহরে লুটপাট চালিয়ে সে অবরোধ করে শিরোঞ্জ, কিন্তু শিগগিরই আক্রমণ করে ফিরুজ জং (নভেম্বরের মাঝামাঝি)। নিমা পালিয়ে যায় ঘোড়া ছুটিয়ে। হতাহত হয় অনেক মারাঠি এবং তাদের স্থানীয় রাজপুত আর। আফগান মিত্র।

১৭০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফিরুজ জং ধামুনির জঙ্গলের কাছে নিমার সেনাবাহিনীর ওপর আকস্মিক এক আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করল তাদের অনেককে আর পেল অনেক লুটের মাল । মোগল পক্ষেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো।

ফিরুজ জংয়ের সাহসিকতায় মালওয়া রক্ষা পেতে আওরঙ্গজেব উপলব্ধি করলেন পরিস্থিতির গুরুত্ব। সাহসী আর দক্ষ সেনাপতি শাহজাদা বিদার বখত তখন ছিলেন আওরঙ্গাবাদ আর খান্দেশের সুবাদার, তাঁকে মালওয়ার শাসক নিয়োগ করা হলো ১৭০৪ সালের ৩ আগস্ট। ১৭০৬ সালের মার্চ পর্যন্ত মালওয়া শাসন করলেন তিনি, তারপর জরুরি আদেশ পেয়ে গুজরাট গেলেন আর নিলেন সেখানকার প্রতিরক্ষার ভার।

শাহজাদার প্রিয় লেফটেনান্ট ছিল জয়পুরের নতুন রাজা, জয় সিংহ (সওয়াই)। মালওয়ায় ঝামেলা সৃষ্টি করা বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিল নাসিরি আফগান, গোপাল সিংহ চন্দ্রবত, শিরোঞ্জের গোপাল চৌধুরী, আব্বাস আফগান, আর উমর পাঠান। সত্যি বলতে কি, শাসনকালের শেষ দিকে মালওয়ায় অশান্তি সৃষ্টিকারীরা ছিল অসংখ্য। প্রদেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছে মারাঠি, বুন্দেলা, আর আফগানেরা। (১৭০৪)। আওরঙ্গজেবের নিজের ভাষায়: খান্দেশের প্রদেশ সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে গেছে…ধ্বংস হয়ে গেছে মালওয়াও-অতি অল্প বাসস্থানই আর অবশিষ্ট আছে।

১৮.৫ ছত্র শাল বুন্দেলার প্রথম জীবন

চম্পত রাও বুন্দেলার চতুর্থ পুত্ৰ ছত্র শাল (১৬৫০ সালে জন্ম), অর্ধ শতাব্দী জুড়ে সাফল্যের সঙ্গে সাম্রাজ্যিক সরকারের বিরোধিতা করেছে, নিজের প্রদেশকে রেখেছে সার্বক্ষণিক বিক্ষোভে, আক্রমণ করেছে মালওয়াকে, শেষমেশ স্বাধীন ছোট একটা রাষ্ট্র লাভ করেছে পুব মালওয়ায়, যার রাজধানী ছিল পান্না। তার ৮১ বছরের দীর্ঘ জীবন শেষ হয়েছে ১৭৩১ সালে।

বাবার দস্যু জীবন আর মৃত্যুতে অসহায় হয়ে ছত্র শাল আর তার বড় ভাই অঙ্গদ প্রথমে জয় সিংহের সেনাদলে নিয়োগ পেয়ে যুদ্ধ করতে গেল শিবাজীর বিপক্ষে (১৬৬৫), তারপর সাহসিকতার জন্য পেল মনসবদারি ।

পরবর্তী সময়ে দিলির খানের সেনাদলে নিয়োগ পেয়ে ছত্র শাল গেল মোগল বাহিনীর দেওগড় আক্রমণে। কিন্তু তরুণ বুন্দেলা যুবরাজ অনুভব করল যে যোগ্যতা অনুসারে তার পুরস্কার যথেষ্ট নয়, আর মোগল সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেনের চেয়েও নিমপদস্থ একজন অফিসার হয়ে থেকে তার উচ্চাশা পূরণ হবে না। সে স্বপ্ন দেখতে লাগল শিবাজীর মতো একটা জীবনের, যেখানে রয়েছে স্বাধীনতা আর রোমাঞ্চের হাতছানি।

কিন্তু সাক্ষাক্তারের পর মারাঠি রাজা তাকে পরামর্শ দিল দেশে ফিরে নিজের স্থানীয় প্রভাব আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে। ছত্র শাল দেশে ফিরে আক্রমণ চালাতে লাগল মোগল সাম্রাজ্যে।

১৬৭০ সালে আওরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংস শুরু করার পর, হিন্দুদের ভেতরে যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হলো, সেই সুযোগটাই আঁকড়ে ধরল ছত্র শাল এবং হিন্দুরাও তাকে বরণ করে নিল হিন্দু বিশ্বাস আর ক্ষত্রিয় সম্মানের বীর হিসেবে। এমনকি উছার বিশ্বস্ত বুন্দেলা রাজা সুজন সিংহ তাকে পাঠাল প্রশংসা আর শুভেচ্ছার গোপন বার্তা।

১৮.৬ মোগল সরকারের সঙ্গে ছত্র শালের যুদ্ধ

বিদ্রোহীরা ছত্র শালকে নির্বাচিত করল তাদের নেতা আর সব বুন্দেলার রাজা হিসেবে। প্রথমে তার বাহিনীতে ৩৩৫ জন থাকলেও দ্রুত সেই সংখ্যা বাড়ল। ছত্র শাল প্রধানত লুটপাট চালাতে লাগল ধামুনি জেলা আর তার ৬৫ মাইল পশ্চিমের শিরোজ শহরে। এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে সে লুটপাট করল বছরের পর বছর।

তার ক্রমাগত সাফল্যে ছোটখাটো অন্য সব সর্দার যোগ দিল তার সঙ্গে। মারাঠিদের অনুকরণে চৌথ আদায় করতে লাগল ছত্র শাল। যতই দাক্ষিণাত্যে জড়িয়ে পড়লেন আওরঙ্গজেব, ততই বাড়ল ছত্র শালের জয়ের সংখ্যা, দখল করল সে কালিঞ্জর আর ধামুনি, লুটপাট চালাল ভিলসাতে ।

১৬৯৯ সালের মার্চে শিরোঞ্জের ৭০ মাইল উত্তরের রাননাডের ফৌজদার, শের আফকান খান, আক্রমণ করল তাকে সুরজ-মাউয়ের কাছে। ভীষণ এক যুদ্ধের পর ছত্র শাল পালিয়ে গিয়ে ঢুকল দুর্গে, খান সেটা অবরোধ করল, কিন্তু সেখান থেকে পালিয়ে গেল বুন্দেলা সর্দার। ১৭০০ সালের ২৪ এপ্রিল শের আফকান খান আবার তাকে আক্রমণ করল ঝুনা আর বার্নার কাছে, প্রায় ৭০০ জনকে হত্যা করে ছত্রভঙ্গ করে দিল তার বাহিনী, আহত হলো ছত্র শাল স্বয়ং। কিন্তু খান মারাত্মকভাবে জখম হলো মাস্কেটের গুলিতে।

১৭০৫ সালে সম্রাটকে অদম্য এই বুন্দেলার সঙ্গে সমঝোতা করার পরামর্শ দিল ফিরুজ জং। ছত্র শালকে ৪-হাজারি মনসবদারি দিয়ে সাক্ষাৎ করতে বলা হলো সম্রাটের সঙ্গে। দাক্ষিণাত্যে শান্তিতেই কাটাল সে দেড় বছর, আর আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দেশে ফিরে গিয়ে আবার শুরু করল তার স্বাধীন পেশা।

১৮.৭ গোন্দ রাজ্য আর মোগলদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক

গন্দোয়ানা ছিল বর্তমান মধ্য প্রদেশের অনেকটা জুড়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে এই অঞ্চলের উত্তর অর্ধে বিরাট এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল গড়হার গোন্দ রাজা । কিন্তু আকবরের সেনাপতিরা খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেছিল এই রাজ্য আর ধ্বংস করেছিল এটার রাজধানী গড়হা আর চৌরাগড়। পরবর্তী রাজারা রাজত্ব করেছে চৌরাগড়ে, হ্রাসকৃত শক্তি আর ভূখণ্ড নিয়ে এবং সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি দ্রুত হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে।

গোন্দদের শ্রেষ্ঠত্ব চলে গেল গন্দোয়ানার কেন্দ্র আর নর্মদা নদীর দক্ষিণের দেওগড়ের সর্দারদের হাতে। দেওগড়ের ২৫ মাইল মতো দক্ষিণে রয়েছে চান্দা, যেখানে বাস করে দেওগড়ের সার্বক্ষণিক শক্ত আর প্রতিদ্বন্দ্বী গোন্দের আরেক রাজা। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে কেবল এই কটা গোন্দ রাজ্যই ছিল উল্লেখযোগ্য; এখানকার হাতির পাল, স্থানীয়ভাবে খুঁড়ে ভোলা রত্নের ওপর পড়ল মোগল সরকারের লোলুপ দৃষ্টি। ১৬৩৭ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে মুক্ত একটা মোগল সেনাবাহিনী গন্দোয়ানায় ঢুকে, স্থানীয় সর্দারদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় শুরু করল। আক্রমণ চালাল তারা দেওগড়ের রাজা কুকিয়ার আবাস নাগপুরে। দুৰ্গটা তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো তার বার্ষিক কর দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে।

কিন্তু কর বকেয়া পড়ল, আর ১৬৫৫ সালে মোগল একটা সেনাবাহিনী ঢুকল দেওগড় ভূখণ্ডে, রাজাকে (কেশরী সিংহ) বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করাল। ১৬৬৬ সালের শেষে বকেয়া দাঁড়াল ১৫ লাখে ।

১৬৬৭ সালের জানুয়ারিতে গন্দোয়ানায় গেল দিলির খানের অধীন একটা মোগল সেনাবাহিনী। চান্দার রাজা মনজী মলার ছিল বিরোধী মনোভাবাপন্ন। কিন্তু মোগল সেনাবাহিনী তার সীমান্ত মান্দুরাতে এসে উপস্থিত হতে (ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৭), বশ্যতার প্রস্তাব পাঠিয়ে, সে দিতে চাইল এক কোটি টাকার যুদ্ধের চাঁদা আর বার্ষিক কর দুই লাখ। সেখানে দুই মাস থেকে প্রতিশ্রুত টাকার ৭৭ লাখ আদায় করল দিলির খান।

চান্দার রাজার নিয়তি দেখে আতঙ্কিত হলো দেওগড়ের রাজা কাক সিংহ। দিলির খান এসে পৌঁছাতে জরিমানা হিসেবে সে দিতে চাইল তিন লাখ টাকা, আর নির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে ১৮ লাখ। যা-ই হোক, কথা রাখতে পারল না রাজা, ফলে ১৬৬৯ সালের আগস্টে আবার আক্রমণ চালাল দিলির খান। মোগলেরা বিধ্বস্ত করে ফেলল দেওগড়। রাজ্য পুনরুদ্ধারের খাতিরে পরিবারসহ (দুই ভাই আর এক বোন) রাজা গ্রহণ করল ইসলাম ধর্ম, আর ২৯ মার্চ দিলির খান নাগপুর ত্যাগ করে রওনা দিল দক্ষিণে ।

কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করলেও গোন্দ রাজার মনোভাবের পরিবর্তন হলো না। সে বিরোধিতা করেই চলল । ১৬৮৬ সালের মার্চে এই রাজ্যের একজন দাবিদার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে সিংহাসনে বসল রাজা বখত বুলন্দ নাম নিয়ে। সে রাজ্যের আয়তন, শক্তি আর উন্নতি বৃদ্ধি করল বেশ অনেকটা, আর আওরঙ্গজেবকে ভীষণ বেগ দিল তার শাসনামলের শেষ বছরগুলোতে।

১৬৮৩ সালের অক্টোবরে সিংহাসনচ্যুত করা হলো গোন্দের রাজা রাম সিংহকে, আর সিংহাসন দেওয়া হলো কিষাণ সিংহকে। কিন্তু পুরাতন রাজা তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে অধিকার ছেড়ে দিতে অস্বীকার করল। সুতরাং ইতিকাদ খানের অধীন একটা মোগল সেনাবাহিনী ১৬৮৪ সালের ২ নভেম্বর তার রাজধানীতে এসে কিষাণ সিংহকে বসিয়ে দিল সিংহাসনে। কর বকেয়া পড়ায় ১৭০০ সালের আগস্টে কিষাণ সিংহকে ডেকে পাঠানো হলো সম্রাট-শিবিরে। ১৭০১ সালের ২৭ এপ্রিল সে এক লাখ টাকা জমা দিল বেরারের কোষে।

১৮.৮ দেওগড়ের গোন্দ রাজা, বখত বুলন্দের স্বাধীনতার চাহিদা

১৬৯১ সালের জুনে বখত বুলন্দকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে সম্রাট দেওগড়ে বসালেন দিনদার নামক আরেক মুসলমান গোলকে। বখত বুলন্দ কয়েক বছর কড়া নজরে থাকার পর ফিরে পেল তার স্বাধীনতা (আগস্ট, ১৬৯৫)। শিগগিরই অশান্তি শুরু হলো দেওগড়ে। বিরোধিতা করল দিনদার, আর চান্দার রাজা কিষাণ সিংহের সহায়তায় একটা মোগল সেনাবাহিনী দেওগড় দখল করে তাড়িয়ে দিল দিনদারকে (মার্চ, ১৬৯৬)। কিষাণ সিংহের দ্বিতীয় পুত্র কান সিংহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে দেওগড়ের সিংহাসনে বসল রাজা নেকনাম নামে। বখত বুলন্দ হারিয়ে ফেলল সিংহাসন ফিরে পাওয়ার সব আশা। তবে ১৬৯৬ সালেই দেওগড় আর চান্দার রাজা পরিবর্তিত হওয়ায় আশার সঞ্চার হলো তার মনে। দেওগড়ে ফিরে বিদ্রোহ করল সে আর একের পর এক লাভ করতে লাগল সাফল্য। সম্রাট তখন অসহায় রাগে তার বখত বুলন্দ (সৌভাগ্যবান’) নাম পরিবর্তন করে রাখলেন নাগুন বখত (‘দুর্ভাগা’)। বিদ্রোহীর কার্যকলাপ ক্রমেই বিস্তৃত হলো বেরারসহ অন্যান্য জায়গায়। তারপর ফিরুজ জংয়ের একটা সেনাবাহিনী বখত বুলন্দকে পরাজিত করে দখল করে নিল দেওগড় (জুন, ১৬৯৯)। বিদ্রোহী এবার মালওয়ায় প্রবেশ করে দখল করল গড়হা (জুলাই)।

বিখ্যাত বুন্দেলা মাস্কেটিয়ারদের একটা দল নেওয়ার জন্য জুলাইয়ে বখত বুলন্দ ৩০,০০০ টাকা পাঠাল ছত্র শালকে। অক্টোবরে সাতারা দুর্গে দুজন দূত পাঠিয়ে রাজারামকে সে আসতে বলল দেওগড়ে, কিন্তু মারাঠি রাজা এল না তার সেনাপতিদের পরামর্শে। ১৭০১ সালের মার্চের শুরুতে বখত বুলন্দ তার চাচা জামগড়ের জমিদার নওয়াল শাহ আর মারাঠিদের সঙ্গে ৪,০০০ অশ্বারোহী আর ১২,০০০ পদাতিক নিয়ে আক্রমণ করল বেরারের সুবাদার আলী মর্দান খানকে, কিন্তু তারা পরাজিত হলো শোচনীয়ভাবে । নওয়াল শাহ নিহত আর বখত বুলন্দ জখম হলো।

১৮.৯ মোগলদের অধীনে কাশ্মিরের অবস্থা

মোগল সম্রাটগণ কাশ্মিরকে দেখেছেন কেবল আনন্দ পাওয়ার একটা জায়গা হিসেবে। তারা কখনোই এই দেশের বা এখানকার মানুষের উন্নতির চেষ্টা করেননি।

কাশ্মিরের সাধারণ মানুষ তলিয়ে গেছে মুখতা আর দারিদ্রের অতলে; কাপড়ের অভাবে অনেক গ্রামবাসী ঘুরে বেড়ায় প্রায় নগ্ন হয়ে; উষ্ণতার জন্য তারা শরীরে জড়িয়ে রাখে কেবল একটা কম্বল। লম্বা দূরত্ব আর রাস্তার অভাবে তারা বাইরে থেকে শস্য আনতে পারে না, ফলে প্রত্যেকটা উপত্যকাকেই হতে হয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ; যখন বন্যা বা ভারী তুষারপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, দুর্ভিক্ষে অসহায়ভাবে মারা যায় হাজার হাজার অধিবাসী। সভ্য জগতের সঙ্গে প্রদেশটার সড়ক যোগাযোগ নেই; মালবহনের অসুবিধার কারণে মূল্য বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের উৎপাদিত দ্রব্য তারা বাজারজাত করতে পারে না। প্রদেশটার কোনো স্থানীয় শিল্প নেই। এমনকি শাল বোনাতেও সরকারেরই প্রায় একচেটিয়া অধিকার, রাষ্ট্রীয় কারখানা থেকে বয়নকারীরা পায় কেবল প্রতিদিনের মজুরি। চমৎকার কাশ্মিরি কাগজ ব্যবহার করে শুধু দরবার, আর সেটা তৈরি করানো হয় ফরমাশ দিয়ে ।

কাশ্মিরের উচ্চ শ্রেণীর মানুষও ছিল এতই অনুপযুক্ত যে আওরঙ্গজেবের শাসনামলের প্রায় শেষে তাদের কাজে লাগানো হয়েছে মনসবদার হিসেবে। (১৬৯৯)। কোনো কাশ্মিরি হিন্দু মোগল সাম্রাজ্যের কর্মচারী হতে পারেনি, ওদিকে প্রদেশের মুসলমান গ্রামবাসীদের মনে করা হতো মূর্খ জংলি, এবং শহুরেদের চাটুকার আর ভীতু প্রতারক। মোগল ভারতে এক কথায় কাশ্মিরিদের মনে করা হতো মিষ্টভাষী দুবৃত্ত। অজ্ঞতা, দারিদ্র্য আর সমাজের সামন্ততান্ত্রিক সংগঠন সাধারণ মানুষকে ক্রীতদাসসুলভ জীবনে ঠেলে দেওয়ার কারণে অনেক সময় তারা বাধ্য হতো স্ত্রী আর কন্যার সতীত্ব বিক্রি করতে।

এই অজ্ঞতার কারণেই এখানে জেঁকে বসেছিল কুসংস্কার। বহু মুসলমান সাধু আর তার চেলাদের হাতে সাধারণ মানুষ হতো বিশ্বাসের বলি। কাশ্মিরের শহরে ছিল শিয়া আর সুন্নির হিংস্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা এমনকি গৃহযুদ্ধের রূপ নিত। রাজধানীতে সুন্নিদের বিবাদ কখনো কখনো এমন ভয়ংকর আকার ধারণ করত যে তারা লুটপাট করে জ্বালিয়ে দিত শিয়াদের বাড়িঘর, সামনে যে শিয়াকে পেত তাকেই হত্যা করত। এ রকম কলহ বন্ধ হতো কেবল সরকারি হস্তক্ষেপে। কখনো হতো মুখোমুখি যুদ্ধ। সুন্নিরা হত্যা করতে চায়, এমন কোনো শিয়াকে আশ্রয় দিলে রাজ্যপালের বাসভবনও তাদের হাত থেকে নিরাপদ থাকত না।

এখানে প্রায়ই ভূমিকম্প হয় বলে অধিবাসীরা বাড়ি তৈরি করে হালকা কাঠ দিয়ে। প্রচণ্ড শীতের কারণে বাড়িগুলোতে দিনরাত জ্বালিয়ে রাখতে হয় আগুন। এতে অনেক সময় সৃষ্টি হয় অগ্নিকাণ্ড, আর তখন শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যায় এসব কাঠ আর ঘাসের বস্তি।

১৮.১০ কাশ্মিরে আওরঙ্গজেবের সুবাদারদের কার্যকলাপ

আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ৪৮ বছরে কাশ্মিরে ছিল বারোজন সুবাদার। তাদের চরিত্রানুসারে প্রদেশটার চরিত্রও ওঠা-নামা করেছে। ইতিমাদ খান আর ফাজিল খানের মতো সুবাদার সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেছে ন্যায়বিচার, আবার সাইফ খান এবং অন্যান্যরা অন্যায্য আদায়ের মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভরিয়েছে।

আওরঙ্গজেবের শাসনের অর্ধ শতাব্দীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে এখানে। হয়েছে দুটো ভূমিকম্প (১৬৬৯ আর ১৬৮১), রাজধানীতে দুটো অগ্নিকাণ্ড (১৬৭৩ আর ১৬৭৮), একটা বন্যা (১৬৮১), আর একটা দুর্ভিক্ষ।

১৬৮৪ সালে সংঘটিত হলো সম্ভবত শিয়া আর সুন্নিদের সবচেয়ে ভয়াবহ লড়াই। শ্রীনগরের হাসনাবাদ শিয়াদের একটা দুর্গ। আবদুস শাকুর নামক সেখানকার এক অধিবাসী আর তার পুত্রেরা মিলে একদিন আহত করল সাদিক নামক এক সুন্নিকে। এই শিয়ারা সর্বসমক্ষে খোলাফায়ে রাশেদিনের প্রথম তিন খলিফা সম্বন্ধেও বাজে মন্তব্য করল (শিয়াদের ঈশ্বরতত্ত্ব অনুযায়ী, প্রথম তিন খলিফাই বলপূর্বক সম্পদ অপহরণকারী)। তারপর তারা আশ্রয় নিল শাসক ইব্রাহিম খানের কাছে। কাজী মুহম্মদ ইউসুফ ধর্মোন্মাদনায় খেপিয়ে তুলল শহরের লোকজনকে, আর তারা আগুন দিল হাসনাবাদে। শুরু হলো তুমুল দাঙ্গা। উভয় পক্ষেই অনেক হতাহত হলো।

ইব্রাহিম খান অবস্থা বেগতিক দেখে আবদুস শাকুর আর অন্যান্য শিয়া অভিযুক্তকে তুলে দিল কাজীর হাতে এবং সে শাকুর, তার দুই পুত্র, আর এক জামাইকে দিল মৃত্যুদণ্ড। সুন্নি দাঙ্গাকারীরা ধ্বংস করল মুফতির বাড়ি, যদিও সে ছিল একজন সুন্নি । রাস্তায় পেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো শিয়া গুরু বাবা কাশিমকে। ইতিমধ্যে শেখ বাকা বাবা আরেক দল লোক জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দিল ইব্রাহিম খানের বাসভবনে! শাসক তখন গ্রেপ্তার করল বাকা বাবা, কাজী, সংবাদদাতা, বকশি এবং রাজধানীর বেশ কয়েকজন গণ্যমান্যকে। এই কঠোর পদক্ষেপে জনগণ দমে গেল। আওরঙ্গজেব ঘটনা শুনে বরখাস্ত করলেন ইব্রাহিম খানকে, আর সুন্নি বন্দীদের মুক্ত করে দিতে বললেন।

১৬৯৮-৯৯ সালে ঘটল আরেক ঘটনা। নবী মুহম্মদের একটা চুল পাঠানো হলো কাশ্মিরে আর পবিত্র সেই স্মৃতিচিহ্ন একনজর দেখা বা স্পর্শ করার জন্য প্রত্যেকটা রাস্তায় নামল মানুষের ঢল।

১৬৯২ সালেও ঘটেছিল এক ঘটনা। মে মাস, তখন রমজান চলছে। মীর হুসাইন নামক একজন আগন্তুক কাশ্মিরে এসে তখত-ই-সুলাইমান পাহাড়ের কাছে গড়ে তুলল তার আশ্রম। রমজান মাসের সম্মানে সে করতে চাইল একটা আলোকসজ্জা। বিকেলের কিছু আগে হঠাৎ শুরু হলো তুমুল ঝড়, বৃষ্টি, বজ্বের গর্জন আর ঝলকানি। পুরো শহর এত অন্ধকারে ছেয়ে গেল যে সূর্য ডুবে গেছে ভেবে ইফতার করল মানুষ। কিন্তু ঘণ্টা দুই পর ঝড় সরে যেতে বেরিয়ে এল সূর্য, আর অপমানিত বোধ করল সবাই, কারণ, মুসলমানেরা রমজান মাসে দিনের বেলা কিছু খাওয়া মহাপাপ মনে করে। কাশ্মিরের উচ্চ, নীচ-সব শ্রেণীর মানুষ ভাবল, এই ঘটনা ঘটেছে ধর্মবিরোধী ওই আগন্তুক সাধুর জাদুবিদ্যায়। বিশ্বাস রক্ষাকারী, সত্য-জ্ঞানী’ সম্রাট এই অভিযোগ বিশ্বাস করে, সেই জাদুকরকে বহিষ্কারের আদেশ দিলেন।

১৮.১১ গুজরাট, এটার সুবিধাজনক অবস্থান আর বিচিত্র জনসাধারণ

গুজরাটের সম্পদের মূলে আছে প্রধানত তার হস্তশিল্প আর বাণিজ্য। এখানকার হিন্দু আর মুসলমান, উভয়েরই আছে এক স্বাভাবিক ব্যবসায়িক যোগ্যতা, কিন্তু তার পাশাপাশি গুজরাটের আছে এক অসাধারণ সুবিধাজনক অবস্থান। সম্পদশালী জেলা খান্দেশ, বেরার, মালওয়ার সমস্ত পণ্য জাহাজযোগে বিদেশ যাওয়ার সময় গুজরাট অতিক্রম করতে হয়। এই প্রদেশের উপকূলে রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় বন্দর-হিন্দুদের সময়ে ব্রোচ আর মুসলমানদের সময়ে সুরাট। সুতরাং মুসলমান বহির্জগতের বিবেচনায় মোগলদের সময়ে গুজরাট ছিল ভারতের সেরা প্রবেশদ্বার। সুরাট হয়ে অসংখ্য মুসলমান তীর্থযাত্রী যেত পবিত্র নগর মক্কায় এবং শিয়ারা নাজাফ আর কারবালার তীর্থে। পারস্য, আরব, তুরস্ক, মিসর, জাঞ্জিবার, এমনকি খোরাসান আর বার্বারির পর্যটক, ব্যবসায়ী, ছাত্র, ভাগ্যঅম্বেষণকারী আর রাজনৈতিক শরণার্থীরা ভারতে প্রবেশ করত গুজরাট দিয়ে, অবহেলিত ছিল সুলাইমান আর হিন্দু কুশ পাহাড়শ্রেণীর সড়ক পথ।

ভৌগোলিক এই সুবিধার কারণে বহু পূর্বের অগ্নি উপাসক পারসি, বোহরা নামে সুপরিচিত ভিন্নমতাবলম্বী ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়, আর মাহদীদের সময় থেকেই গুজরাটে গড়ে উঠেছে এক বিচিত্র জনসাধারণ। সপ্তদশ শতাব্দীতে হিন্দুদের মধ্যে এখানে ছিল সভ্যতা আর সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে প্রায় অপরিচিত আদিম সব জাতি, যেমন কোলি (দক্ষিণে), বাগলানার ভীল (দক্ষিণ পূর্ব), পূর্ব সীমান্তে বুনন আর জাল রাজপুত, সারা দেশে ছড়ানো লুণ্ঠনজীবী গ্রাসিয়া, আর পশ্চিমের কাথি। আওরঙ্গজেবের সময়ে তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছিল মারাঠিরা।

১৮.১২ আওরঙ্গজেবের অধীনে গুজরাটের সব সুবাদার

আওরঙ্গজেবের ৫০ বছরের শাসনামলে গুজরাট শাসন করেছে বারোজন সুবাদার, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ছিল মহব্বত খান (৬ বছর, ১৬৬২-৬৮), মো. আমিন খান (১০ বছর, ১৬৭২-৮২), সুজায়েত খান (১৭ বছর, ১৬৮৪-১৭০১), আর শাহজাদা মো. আজম (৪ বছর, ১৭০১-০৫)। বাকি ১৩ বছরে ছিল আটজন সুবাদার।

মধ্যযুগের গুজরাট ছিল দুর্ভিক্ষের জন্য কুখ্যাত, আওরঙ্গজেবের সময়েও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে দুর্ভিক্ষ হয়েছে ১৬৮১, ১৬৮৪, ১৬৯০-৯১, ১৬৯৫-৯৬ আর ১৬৯৮ সালে। ১৬৯৬ সালের অনাবৃষ্টি এতই ভয়ংকর ছিল যে, ‘পাটান থেকে যোধপুর পর্যন্ত কোনো পানি বা ঘাস চোখে পড়েনি। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি ছিল মহামারী। উল্লেখযোগ্য অশান্তির ঘটনা বলতে এখানে ঘটেছে উত্তর-পূর্ব সীমান্তের রাজপুত যুদ্ধ (১৬৮০) যখন ভীম সিংহ আর তার পুত্র মহারানা রাজ সিংহ আক্রমণ করেছে বাদনগর, বিশালনগর আর অন্যান্য কয়েকটা সম্পদশালী শহর।

১৮.১৩ গুজরাটে মারাঠি আক্রমণ, ১৭০৬

মারাঠিরা সম্রাট-বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে ১৭০৬ সালের প্রথম দিকে, শাহজাদা আজমের আহমেদাবাদ ত্যাগ করা (২৫ নভেম্বর, ১৭০৫) আর বিদার বখতের সেখানে উপস্থিত হওয়ার (৩০ জুলাই, ১৭০৬) মাঝামাঝি সময়ে। ধানা যাদবের অধীন মারাঠিরা নিল এই সাময়িক নিরাপত্তাহীন অবস্থার সুযোগ। রতনপুরে (রাজপিপলার অন্তর্গত) সম্রাটের দুটো বাহিনী একের পর এক পরাজিত হলো ধানার কাছে। তাদের দুই সেনাপতি সফদর খান বাবি আর নজর খানকে বন্দী করে রাখা হলো মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে; লুট করা হলো তাদের শিবির, বহুসংখ্যক মুসলমান নিহত কিংবা বন্দী হলো (১৫ মার্চ, ১৭০৬)।

আবদুল হামিদ খান এল আরেক সেনাবাহিনী নিয়ে, কিন্তু তার ছোট বাহিনীকে উল্লসিত বিজয়ীরা ঘেরাও করে ফেলল বাবা পিয়ারা স্রোতস্বিনীর কাছে । হামিদ খানকে বন্দী করে লুট করা হলো তাদের পুরো শিবির। বিশৃঙ্খল এই অবস্থার সুযোগে দুই দিন ধরে বরোদার বাণিজ্যকেন্দ্র ধ্বংস করল কোলিরা।

১৮.১৪ বোহরা আর খোঁজা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নির্যাতন

আওরঙ্গজেবের শাসনামলের প্রথম দিকে তাঁর আদেশে হত্যা করা হয়েছিল কুতব নামক এক আধাত্মিক গুরুকে। ১৭০৫ সালে সম্রাট জানতে পারলেন, ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান আর কুতবের উত্তরসূরি খানজী বারোজনকে পাঠিয়েছে গোপনে মুসলমানদের বিকৃত করতে, আর সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রেপ্তার করার আদেশ দিলেন সংগৃহীত টাকা আর বইপত্রসহ । তা-ই করা হলো। তারপর গোঁড়া শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হলো প্রত্যেক গ্রাম আর শহরের বোহরা শিশু আর মূর্খ সাধারণ মানুষকে সুন্নি মতবাদে শিক্ষিত করে তুলতে।

এই সম্প্রদায়ের আরেকটা শাখাকে কাথিয়াবাড়ে বলে খোঁজা আর গুজরাটে মুমিন (বা মেহতা)। এদের বেশির ভাগই হিন্দু, যাদের মুসলমানে ধর্মান্তরিত করেছে সাঈদ ইমাম-উদ-দীন নামের এক সাধু । জাকজমকপূর্ণ রাজকীয় একটা পর্দার আড়ালে বসে থাকা আধ্যাত্মিক গুরুর পায়ে চুমু খায় তারা, গুরুর পায়ের ওপর স্তূপ করে ফেলে সোনা আর রুপা এবং নিয়মিতভাবে গুরুকে দেয় তাদের বার্ষিক আয়ের এক-দশমাংশ। আওরঙ্গজেব এই গুরু সাঈদ শাহজীকে গ্রেপ্তারের আদেশ দিলেন। পথিমধ্যে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল মানুষটা, কিন্তু আওরঙ্গজেবের কাছে পাঠানো হলো তার বারো বছরের পুত্রকে। গুজরাটে তার অনুসারীরা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাইল সেখানকার সুবাদারের ওপর, বলল যে সে তাদের ধর্মীয় প্রধানকে হত্যা করেছে। ৪,০০০ মানুষের একটা দল নিয়ে লড়াই করল তারা, আর ব্রোচের ফৌজদারকে হত্যা করে দখল করে নিল শহর (অক্টোবর, ১৬৮৫)। দীর্ঘ একটা অবরোধের পর দুর্গ পুনরুদ্ধার করে ভেতরের সমস্ত ধর্মোন্মাদকে হত্যা করল সুবাদার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *