০৭. সীমান্তে যুদ্ধ : আসাম ও আফগানিস্তান

৭. সীমান্তে যুদ্ধ : আসাম ও আফগানিস্তান

৭.১ ১৬৫৮ সালের আগে কুচবিহার এবং আসামের সঙ্গে মোগলদের সম্পর্ক

যোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মোঙ্গলদের মতো চেহারার এক সেনা, বিশ্ব সিং (শাসনকাল ১৫১৫-৪০) একটা বংশের পত্তন করেছিল, যারা আজও কুচবিহার শাসন করছে। সে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতি গ্রহণ করে, আর সাফল্যের সঙ্গে তার প্রশাসন এবং সৈন্য সংগঠিত করতে সমর্থ হয়। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আর উত্তরাধিকারী নর নারায়ণ (শাসনকাল ১৫৪০-১৫৮৪) ছিল সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ; কিন্তু এই রাজার ভাইয়ের পুত্র রঘুদেব, তাকে সঙ্কোশ নদী আর বড় নদীর মধ্যবর্তী পুব কুচ দেশের কামরূপের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত করাতে বাধ্য করে; এই কুচ দেশটাকেই মুসলমান ঐতিহাসিকগণ বলেছেন কুচ হাজো প্রদেশ, যেটা বর্তমানে পশ্চিম আসামের গোয়ালপাড়া আর কামরূপ জেলা হিসেবে গড়ে উঠেছে। রঘুদেবের পুত্র পরীক্ষিত নর নারায়ণের পুত্র লক্ষ্মী নারায়ণকে আক্রমণ করলে সে বাংলার মোগল রাজ্যপালের সহায়তা চাইল। মুসলমান সেনারা কুচ হাজো জয় করে (১৬১২) সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার ফলে তার সীমান্ত প্রসারিত হলো উত্তর-পুবের বড় নদী পর্যন্ত, আর এভাবেই মোগল সরকার ওই নদীর ওপারের মধ্য আর পুব আসামের শাসনকারী অহম রাজাদের সংস্পর্শে এল।

অহমরা হলো শান বংশের একটা শাখা, যে বংশের আদি ভূমি উচ্চতর বার্মার উত্তর আর পুবের পাহাড়ে অঞ্চল। এয়োদশ শতাব্দীতে তাদের প্রাচীন রাজ্য পং-এর এক যুবরাজ এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দক্ষিণ-পুব কোণে। তারপর পথিমধ্যের উপজাতিদের জয় করতে করতে এগিয়েছিল সে পশ্চিম দিকে । অহমরা কষ্টসহিষ্ণু একটা দানব-পূজারি জাত, গরুর মাংস, মুরগি আর স্পিরিট-জাতীয় মদপান করে, আর গোঁজের বেড়া, বাঁশের সাঁকো আর নৌকা তৈরি এবং রাতের বেলা আক্রমণ চালানোয় তারা বার্মিজদের মতোই পাকা। সামন্ততান্ত্রিকভাবে তারা কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির অধীনে সংগঠিত; যেমন, গোহাইন, বড়ুয়া আর ফুকন। গণ্যমান্য এই ব্যক্তিরা ক্রীতদাস শ্রমিকদের দিয়ে তাদের ভূসম্পত্তি চাষ করায়। পুরুষদের সবাই সামরিক সেবা দিতে বাধ্য। তাদের পুরো সেনাবাহিনীই পদাতিক সেনা দিয়ে গঠিত, পাশাপাশি শক্তি বাড়ানোর জন্য রয়েছে হাতি।

রাজা তাদের গোষ্ঠীপ্রধান, যে প্রায় দেবতার মতোই শ্রদ্ধেয় এবং তাদের রক্ষাকারী দেবতা সোমদেওয়ের তত্ত্বাবধায়ক। অহমদের শাস্তি অত্যন্ত নির্মম, সামান্য ভুলেও সেখানে মানুষের ওপর নেমে আসে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।

কিন্তু দীর্ঘ দিন আসামে থেকে ভারতীয় সভ্যতা আর হিন্দু ধর্মের প্রভাবে অহমরা পরিবর্তিত হতে শুরু করল। কুচ জাতির রানিদের অনুচর হিসেবে আসামে প্রবেশ করেছিল হিন্দু পুরোহিত আর কারিগরেরা। বাংলার পাঠান সুলতানদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে অহমরা শিখেছিল আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার, আর অসংখ্য বাঙালি বন্দীর (প্রধানত মুসলমান) উপনিবেশ গড়ে তোলা। এ ছাড়া শঙ্করদেব এবং অন্যান্য সাধুরা বৈষ্ণব ধর্মের দীক্ষা দিয়ে দেশটার খুবই উন্নতিসাধন করেছিল।

অহম রাজ্যের দুর্বলতা ছিল আদিবাসীদের বৈচিত্র্যে। সর্বোচ্চ স্তরে ছিল অহমরা। মধ্যের স্তরে স্থানীয় আসামিরা, যাদের মধ্যে ছিল শারীরিক শক্তি, সহিষ্ণুতা আর সামরিক তেজের বিচারে ত্রুটিপূর্ণ সমভূমি অঞ্চল আর বৈবাহিক সম্পর্কের বাঙালি। সমাজের সর্বনিম স্তরে ছিল প্রচুরসংখ্যক ক্রীতদাস, যাদের কিছু মঙ্গোলীয় চাষি, কিন্তু বেশির ভাগই বাঙালি যুদ্ধবন্দি । সর্বনিম্ন এই স্তরটি ছিল এখানকার অনিচ্ছুক অধিবাসী।

সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে, মোগলেরা কুচ হাজো সংযুক্ত (১৬১২) করার পর অহমদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল এক দীর্ঘ যুদ্ধে। অবশেষে ১৬৩৮ সালে শান্তি স্থাপিত হলো, যার ফলে মুসলমানেরা পেল উত্তর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বড় নদীর পশ্চিম আর দক্ষিণের দেশে বসবাসের অনুমতি। এই শান্তি স্থায়ী হলো ২০ বছর।

৭.২ অহমদের কামরূপ বিজয় ১৬৫৮

১৬৫৭ সালে সুজা যখন বাংলার অধিকাংশ সেনাসহ নেমে গেলেন তাঁর পিতার সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে, প্রদেশের অরক্ষিত এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে কুচবিহারের রাজা প্রাণ নারায়ণ তার উজির ভবনাথের অধীনে একদল সেনা পাঠাল মোগল ভূখণ্ডে (হাজো) পালিয়ে যাওয়া জঘন্য এক সামন্তকে গ্রেপ্তার করার জন্য। ওই একই সময়ে পশ্চিম অহমের সুবাদার মোগল কামরূপে প্রবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গৌহাটির ফৌজদার মীর লুস্থুল্লাহ শিরাজী, দুদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আর এখন বাংলা থেকে কোনো সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনে নৌকাযোগে পালিয়ে গেল ঢাকা। একটা আঘাতও না হেনে আসামিরা দখল করে নিল কামরূপের রাজধানী গৌহাটি, আর লুট করল সেখানকার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি।

এই ঘটনা ঘটেছিল ১৬৫৮ সালের প্রথম দিকে। কিন্তু ১৬৬০ সালের জুন মাসে গৃহযুদ্ধের অবসান হলো, আর মীর জুমলাকে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত করা হলো প্রদেশের অরাজক সব জমিদার, বিশেষ করে আসাম আর মগদের (আরাকান) কঠিন শাস্তির আদেশ দিয়ে।

৭.৩ মীর জুমলার কুচবিহার ও আসাম বিজয়

১৬৬১ সালের ১ নভেম্বর, সুবাদার ঢাকা থেকে অগ্রসর হলেন ১২,০০০ অশ্বারোহী আর ৩০,০০০ পদাতিক সেনাসহ। এগুলোর সঙ্গে চলল বিশাল এক নৌবহর (নানা জাতের সবসুদ্ধ অন্তত ৩২৩টা নৌকা), যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হলো ‘ঘুরব বা ভাসমান গোলন্দাজ বাহিনী। প্রত্যেক ঘুরবে থাকে ১৪টা করে কামান আর ৬০ জন মানুষ, আর তার একেকটাকে টেনে নিয়ে যায় চারটে করে লম্বা কোষা নৌকা।

মীর জুমলা এগোলেন পতিত এক রাস্তা ধরে। ছয় দিনে মোগল সেনাবাহিনী পৌঁছাল কুচবিহারের রাজধানীতে (১৯ ডিসেম্বর), ইতিমধ্যেই রাজা তার লোজনসহ সেখান থেকে পালিয়ে গেছে আতঙ্কে। শহরটার নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো আলমগিরনগর; প্রধান মন্দিরটা ভেঙে তৈরি করা হলো একটা মসজিদ, আর পুরো রাজ্যটাই সংযুক্ত করা হলো মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে।

১৬ দিন অবস্থান করার পর সেনাপতি কুচবিহার ত্যাগ করলেন (৪ জানুয়ারি, ১৬৬২), আর আক্রমণ করলেন আসাম। জঙ্গল আর অসংখ্য নালা থাকায় দিনে ৪ বা ৫ মাইলের বেশি এগোনো গেল না। তার সেনাদের এগোতে হলো অবর্ণনীয় পরিশ্রম করে। কলেরায় কাহিল অহম সেনাবাহিনী প্রতিরোধ গড়তে পারল না বললেই চলে, সব সময় তারা পালিয়ে চলে গেল আক্রমণকারীদের সামনে থেকে, আর যে দু-একবার মুখোমুখি হওয়ার চেষ্টা করল, তাদের হলো প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি। বেড়া, পরিখা, বাঁশের চোখা খোঁটায় ভরা গর্ত খুঁড়িয়ে দিয়ে মুসলমানরা ব্ৰহ্মপুত্র পর্যন্ত এগিয়ে গেল বিজয়ীর বেশে। একের পর এক দুর্গ অধিকৃত হলো–মোনা নদীর মোহনার যোগীগুফা (২০ জানুয়ারি), গৌহাটি, বড় নদীর মোহনার শ্রীঘাট (৫ ফেব্রুয়ারি), পাণ্ড, বেলতলা, কালাং নদীর মোহনার কাজলী, ভরালী নদীর মোহনার সমধারা আর তার উল্টো পাশে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরের সিমলাগড় (২৫ ফেব্রুয়ারি)। ৩ মার্চ রাতে মোগল নৌবহরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেল অহমের নৌশক্তি, ৩০০টা নৌকা দখল করলেন মীর জুমলা।

আক্রমণকারীরা ১৭ মার্চ পৌঁছাল গড়গাঁ। সমস্ত সম্পদ ফেলে রেখে রাজধানী থেকে পালিয়ে গেছে রাজা জয়ধ্বজ। আসামে পাওয়া গেল প্রচুর পরিমাণ লুটের মাল-৮২টা হাতি, নগদ ৩ লাখ টাকা, ৬৭৫টা কামান, ৬৭৫০টা গাদা বন্দুক, ৩৪০ মণ বারুদ, এক হাজারের মতো নৌকা, আর ১৭৩টা ধানের গোলা, যার প্রত্যেকটাতে রয়েছে ১০ থেকে ১০০০ মণ শস্য।

এবার সেনা ছাউনিতে প্রবেশের চেষ্টা করলেন মীর জুমলা, যেন আসন্ন। বর্ষাকালে জয় করা দেশটার ওপর ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়। কিন্তু রাজধানীর কাছে নদীর অগভীরতার কারণে মোগল নৌবহরকে থামতে হলো শহরটার ১৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমের লখাউতে। বাহিনীর মূল অংশসহ সেনাপতি গেলেন গড়গাঁর ৭ মাইল দক্ষিণ-পুবের উচ্চ ভূমিতে অবস্থিত গ্রাম মথুরাপুরের সেনাশিবিরে। মোগল সেনাদের যাবতীয় গোলন্দাজ বাহিনী, হাতি, খাদ্যভাণ্ডার আর সম্পত্তিসহ মীর মর্তুজার অধীনে একটা গ্যারিসন নির্মিত হলো অহমের রাজধানীতে বসানো হলো অনেক আউটপোস্ট।

শত্রুসেনারা ছড়িয়ে পড়েছিল এভাবে : বড় গোহাইন গিয়েছিল গড়গাঁর দক্ষিণের পাহাড়শ্রেণীতে, অমাত্যরা তাদের অনুসারীসহ ব্রহ্মপুত্র আর দিহিংয়ের কেন্দ্রস্থলের বিরাট দ্বীপ মাজুলিতে, আর রাজা পালিয়েছিল তার রাজ্যের সর্ব পুবের প্রদেশ নামরূপে।

৭.৪ অহমদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ

মোগলদের আউটপোস্টে অবশ্য প্রথম থেকেই বিশ্রাম বলতে কিছু ছিল না। শিগগিরই রাতের বেলা আউটপোস্টে হামলা চালাতে শুরু করল অহমরা। এমনকি হামলা চলল গড়গাঁয়েও; কিন্তু তা ব্যর্থ হলো। মে মাসের শুরুতে নামল মুষলধারে বৃষ্টি, বন্যা হয়ে গেল নদীগুলোতে, স্থলপথে সেনা চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ল, আর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল সম্রাট-বাহিনীর আউটপোস্টগুলো। প্রত্যেকটা আউটপোস্ট দাঁড়িয়ে রইল পানিঘেরা দ্বীপের মতো, ওদিকে গড়গাঁ নদী যথেষ্ট গভীর না থাকায় খাবার নিয়ে লখাউতে পৌঁছাতে পারল না মোগল নৌবহর।

সুষম খাদ্যের অভাবে সেনাবাহিনীর ঘোড়া আর ভারবাহী গবাদিপশু মরতে লাগল হাজারে হাজারে। কোনো রকম সরবরাহ, এমনকি সংবাদ আসাও বন্ধ হয়ে গেল।

১০ মে মোগলদের গজপুর আউটপোস্টের পতন হলো, ফলে অহমরা তাদের স্থল আর নৌবাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে পারল। গড়গাঁয়ের গ্যারিসনে শুরু হলো এক সার্বক্ষণিক সতর্কাবস্থা । লখাউয়ের পুবের পুরো দেশটাই পুনরুদ্ধার করল অহমের রাজা। মোগলদের দখলে রইল কেবল গড়গাঁ আর মথুরাপুর।

দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল অহম আক্রমণের তেজ। প্রতিদিন ছোটখাটো যেসব সংঘর্ষ হলো, তার হিসাব রাখা সম্ভব নয়। রোদে পোড়া, পানিতে ভেজা, কাদায় মাখা উপেক্ষা করে শত্রু তাড়ানোয় অতন্দ্র হয়ে রইল দিল্লির সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী।

প্রায় প্রতিদিনের এসব ছোটখাটো হামলার পর গড়গাঁয়ে বড় একটা আক্রমণ হলো ৮ জুলাই রাতে। প্রাসাদের পরিবেষ্টনীর উত্তর পাশের বাঁশের গরাদ ভেঙে ঢুকে পড়ল অহমরা, আর সেখানকার পাহারারত গাদাবন্দুকধারীদের সম্পূর্ণ পরাজিত করে দখল করে নিল পরিবেষ্টনীর অর্ধেক। গ্যারিসনের সবার অক্লান্ত চেষ্টায় শেষমেশ পুনরুদ্ধার হলো জায়গাটা, কেটে গেল রাতের সংকট। ১২ জুলাই রাতে চারপাশ থেকে একই সঙ্গে আক্রমণ চালাল অহমদের চারটে সেনা দল; কিন্তু সব আক্রমণই ব্যর্থ হলো, পরিবেষ্টনীর ভেতরে শত্রুরা আর কখনোই ঢুকতে পারেনি।

আগস্টে মারাত্মক এক মহামারী শুরু হলো মথুরাপুরের মোগল শিবিরে; কলেরায় প্রতিদিন মারা পড়তে লাগল প্রায় একশোজন করে মানুষ। দিলির খানের বাহিনীর ১,৫০০ সেনার অবশিষ্ট রইল মাত্র ৪৫০ জন। পুরো আসাম আক্রান্ত হলো এই মহামারীতে, আর সেই বছর সেখানকার লোক মারা গেল দুই লাখ ত্রিশ হাজার। মোগল শিবিরেও রোগীদের জন্য কোনো উপযুক্ত খাদ্য বা আরামের ব্যবস্থা করা গেল না; সবাইকে খেতে হলো মোটা চালের ভাত; গম, ডাল, ঘি, চিনি উধাও হয়ে গেল; আফিম বা তামাকেরও একই অবস্থা কিংবা অতি সামান্য পাওয়া গেল অত্যন্ত চড়া মূল্যে। একটা পাইপ পরিমাণ তামাক বিক্রি হলো ৩ টাকায়। এক তোলা আফিম একটা সোনার মোহরে, মুগডাল আর লবণের সের দশ টাকা করে। গমের রুটির অভাবে নিস্তেজ হয়ে গেল হিন্দুস্তানি আর তুর্কি সেনা; দলে দলে ঘোড়া মারা গেল চাল খেয়ে।

অবশেষে মথুরাপুরের জীবনযাত্রা হয়ে উঠল সহ্যের অতীত, ১৭ আগস্ট সেনাবাহিনী ফিরে এল গড়গাঁয়ে; অনেক রোগীকে ফেলে আসতে হলো বাহনের অভাবে।

উল্লসিত অহমরা গড়গাঁয়ে আক্রমণ চালাল নতুন উদ্যমে, প্রতি রাতেই দুর্গের বাইরে চলতে লাগল খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। মথুরাপুর থেকে আসা সেনাদের মাধ্যমে গ্যারিসন সংক্রমিত হওয়ায় মহামারী পৌঁছে গেল চরমে। স্বয়ং মীর জুমলা খেলেন এবং বাস করলেন সেপাইদের মতো।

সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চরম অবস্থা কেটে গেল। বৃষ্টি কমে এল, সরে গেল বন্যার পানি, আবার দেখা দিতে লাগল ডুবে যাওয়া সব রাস্তাঘাট।

৭.৫ আবার মীর জুমলার আক্রমণ

বর্ষাকাল আর মহামারীর মাসগুলো লখাউতে অবস্থান নেওয়া নৌ-সেনাপতি ইবনে হুসাইনের অধীন মোগল নৌবাহিনী নিজেদের রক্ষা করল, আর সেই সঙ্গে পুরো সেনাবাহিনী। তার নৌকাগুলো টহল দিল নদীতে, আর একটা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখল গৌহাটি, ঢাকা আর দিল্লির সঙ্গে। তারপর ইবনে হুসাইন স্থলভাগে নেমে প্রতিশোধ নিল মাজুলি দ্বীপে আশ্রয় গ্রহণ করা অহমের অমাত্যদের বিরুদ্ধে। অবশেষে বৃষ্টি কমতে শুরু করলে গড়গাঁর রাস্তা উন্মুক্ত করায় সহায়তা দিতে এগিয়ে গেল সে উত্তর থেকে। ২৪ আর ৩১ অক্টোবর স্থল আর জলপথে লখাউ থেকে প্রচুর খাবারও পাঠাল সে গড়গাঁয়ে।

মাটি শুকিয়ে আসায় আবার অদম্য হয়ে উঠল মোগল অশ্বারোহী বাহিনী, ফলে রাজা জয়ধ্বজ আর তার সভাসদেরা দ্বিতীয়বারের মতো পালাল নামরূপ পাহাড়ে। আবার আক্রমণ শুরু করলেন মীর জুমলা, শোলাগুড়ি হয়ে পৌঁছালেন। তিনি টিপমে (১৮ ডিসেম্বর)। এটাই ছিল তাঁর অগ্রসর হওয়ার সর্বশেষ সীমানা। ২০ নভেম্বর হঠাৎ করে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন, তবু জেদের বশবর্তী হয়ে। উদ্দেশ্য থেকে পিছু হটলেন না। ৩০ নভেম্বর বাদুলি ফুকন যোগ দিল মোগলদের সঙ্গে, তাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করে সম্রাটের তরফ থেকে দেওয়া হলো পুব আসামের সুবাদারের পদ। অহমের আরও উল্লেখযোগ্য অমাত্য অনুসরণ করল। এই লাভজনক উদাহরণ। নামরূপ পাহাড়ে একাকী এবং অসহায় হয়ে পড়ল রাজা জয়ধ্বজ ।

১০ ডিসেম্বর মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মীর জুমলা; জ্বরে পুড়ে গেল সারা শরীর, শিগগিরই তার সঙ্গে যোগ হলো পরিসি। পুরো মোগল বাহিনী যেতে অস্বীকার করল মহামারী-আক্রান্ত আর অজানা নামরূপ পাহাড়ে, তারা তাদের সেনাপতিকে ত্যাগ করে নিজ নিজ বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করল।

৭.৬ আসামের সঙ্গে শান্তি চুক্তি

দিলির খানের মধ্যস্থতায় অহমের রাজার সঙ্গে একটা শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, যার শর্তাবলি ছিল নিমরূপ :

১. জয়ধ্বজ তার কন্যা আর টিপমের রাজার পুত্রদের পাঠাবে মোগল দরবারে।

২. যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অহমের রাজা এই মুহূর্তে ২০,০০০ ভোলা সোনা, ১,২০,০০০ তোলা রুপা আর ২০টা হাতি পাঠাবে সম্রাট বরাবর (পাশাপাশি ১৫টা এবং ৫টা হাতি পাঠাবে যথাক্রমে মীর জুমলা আর দিলির খানকে)।

৩. ক্ষতিপূরণের বকেয়া পরিশোধ করবে সে পরবর্তী ১২ মাসে তিনটে সমান কিস্তিতে, ৩ লাখ ভোলা রুপা এবং ৯০টা হাতি দিয়ে ।

৪. তারপর বার্ষিক কর হিসেবে সে দিতে থাকবে ২০টা করে হাতি।

৫. ক্ষতিপূরণ সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত নওয়াবের কাছে জামিন হিসেবে থাকবে বুরহা গোহাইন, বড় গোহাইন, গড়গাঁইয়া ফুকন আর বড় পত্র ফুকনের পুত্রেরা।

৬. ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরে ভরালী নদীর পশ্চিম আর দক্ষিণ তীরে কালাং নদীর পশ্চিমে আসামের যতখানি অংশ, তা সংযুক্ত হবে সাম্রাজ্যের সঙ্গে। এর ফলে মোগলেরা পেয়ে যাবে হাতির জন্য বিখ্যাত দারাং প্রদেশের অর্ধেকেরও বেশি।

৭. মোগল ভূখণ্ড (বিশেষ করে কামরূপ) থেকে অহমদের নিয়ে যাওয়া বন্দী, সেই সঙ্গে রাজার হাতে কারাগারে নিক্ষিপ্ত বাদুলি ফুকনের স্ত্রী আর সন্তানদের মুক্ত করে দিতে হবে।

১৬৬৩ সালের ৫ জানুয়ারি, ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে কিছু সোনা, রুপা আর হাতি এসে পৌঁছাল মোগল শিবিরে, আর পাঁচ দিন পর মীর জুমলা শুরু করলেন তাঁর ফিরতি যাত্রা । অবশেষে ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে নৌকাযোগে রওনা দিলেন তিনি ঢাকার উদ্দেশে, আর পথিমধ্যেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন ১৬৬৩ সালের ৩১ মার্চ।

৭.৭ মীর জুমলার চরিত্রের মহত্ত্ব

সামরিক কৃতিত্বের বিচারে মীর জুমলার আসাম আক্রমণ সফল। রাজাকে তিনি বাধ্য করেছেন অসম্মানজনক একটা চুক্তি স্বাক্ষরে, আদায় করেছেন যুদ্ধের একটা বড়সড় ক্ষতিপূরণ, নিশ্চিত করেছেন ভূখণ্ডের একটা বড় অংশের সমর্পণ এবং আরও সব পাওনা। এটার রাজনৈতিক পরিণতি যদি স্থায়ী না হয়, যদি ছেড়ে দেওয়া জেলাগুলো আর, এমনকি গৌহাটিও মোগলদের মুঠো গলে চলে যায় তার মৃত্যুর মাত্র চার বছর পর, সে জন্য তাঁকে দায়ী করা চলে না।

যদিও মীর জুমলার অভিযান শেষ হয়েছে অনেক প্রাণহানির ভেতর দিয়ে, তাঁর নিজেরও মৃত্যু হয়েছে রোগ আর ক্লান্তিতে, দ্রুত হাতছাড়া হয়ে গেছে। কুচবিহার আর আসামের অর্জন, তবু এই অভিযানের কারণে তাঁর চরিত্র ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করবে মহত্তম এক দীপ্তিতে। সেই যুগের আর কোনো সেনাপতি এত মানবিকতা আর ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারেননি, কিংবা বড় সেনা কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সর্বনিমপদস্থ পর্যন্ত বজায় রাখতে পারেননি সমমানের শৃঙ্খলা; এমন ভয়ংকর বিপদ আর দুর্ভোগের মধ্যে আর কোনো সেনাপতিই সম্ভবত তাঁর মতো একদম শেষ পর্যন্ত নিমপদস্থদের আস্থা এমনকি ভালোবাসা ধরে রাখতে পারতেন না। ২০ মণ হীরের মালিক এবং সমৃদ্ধ বাংলার সুবাদার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেপাইদের মতো কষ্টই কেবল মেনে নেননি, বরং আমোদ-প্রমোদ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে বরণ করেছেন অকালমৃত্যু। লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং জনসাধারণের ওপর অত্যাচার রোধ করে তিনি কেবল কঠোর আদেশ জারি করেই ক্ষান্ত হননি, লক্ষ রেখেছেন সেই আদেশ যথাযথ পালিত হচ্ছে কি না। প্রথম আদেশ অমান্যকারী কজনকে তিনি দিয়েছেন এমনই কঠিন শাস্তি, যার প্রতিক্রিয়া হয়েছে অত্যন্ত উপকারী। অন্যের সঙ্গে তুলনা করলে মীর জুমলার মহত্ত্ব আমাদের চোখে আরও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে। মীর জুমলার মতো একজন বীরকে নিয়ে তাই ঐতিহাসিক তালিশের অলংকারপূর্ণ প্রশংসা মোটেই আতিশয্য দোষে দুষ্ট নয়; তালিশ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এমন এক মহান সেনাপতিকে, যিনি ছিলেন সেই শ্রদ্ধার সোলোআনা যোগ্য।

৭.৮ মোগলদের কামরূপ হারানো ১৬৬৭-৮১

১৬৬৭ সাল পর্যন্ত মোগলেরা উপভোগ করল মীর জুমলার আসাম জয়ের সুবিধাগুলো। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের সবটুকুই পরিশোধ করল অহমরা, কিন্তু পাঁচ বছরে। নতুন রাজা চক্ৰধ্বজ সিংহাসনে বসে (নভেম্বর, ১৬৬৩) যুদ্ধ করবে বলে সঙ্কল্পবদ্ধ হলো, আর সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে লাগল, ১৬৬৭ সালের আগস্টে তার অমাত্যদের অধীনে দুটো সেনাদল পাঠাল সে ব্রহ্মপুত্রের দুই তীরে। দ্রুত পতন হলো পথের মধ্যের মোগল দুর্গগুলোর, আর শেষমেশ গৌহাটিও দখলকৃত হলো নভেম্বরের শুরুতেই। বিজয়ীরা পেল প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া এবং অন্যান্য সামগ্রী আর কর্মকর্তাসহ অনেক মুসলমানকে বন্দী করে নিয়ে গিয়ে তারা চালাল নৃশংস হত্যাকাণ্ড। একটামাত্র আঘাতে মোগল সীমান্ত পিছিয়ে গেল মোনা নদীর কাছে । গৌহাটি হলো এক অহম সুবাদারের আবাস।

হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করল মোগলেরা, কিন্তু দীর্ঘ এক বিশৃঙ্খল যুদ্ধ শেষমেশ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। ১৬৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধের ভার নিতে সম্রাটের দরবার থেকে রাম সিংহ (মীরজা রাজা জয় সিংহের পুত্র এবং উত্তরাধিকারী) এল রাঙ্গামাটিতে। কিন্তু প্রথম থেকেই তার কাজকর্ম ছিল নিরাশাজনক। মাত্র ৮,০০০ সেনা নিয়ে তার হলো ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি। কারণ, অহমদের মোট সেনাসংখ্যা এখন এক লাখ। আর মীর জুমলার সময়কার পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে নৌপথে তারা এখন প্রভুত্ব অর্জন করেছে, ফলে ব্রহ্মপুত্রে মোগলদের ৪০টা যুদ্ধ-নৌকা তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারল না।

যুদ্ধে রাম সিংহের মনও ছিল না, কারণ সে জানত যে ১৬৬৬ সালে শিবাজীকে আগ্রা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করার শাস্তি হিসেবে তাকে আসামে পাঠানো হয়েছে জ্বরে ভুগে মরার জন্য। আসার পরপরই গৌহাটি অবরোধ করল সে, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। ১৬৭১ সালের মার্চে রাঙ্গামাটি ফিরে সে হাত গুটিয়ে বসে থাকল কয়েক বছর। অবশেষে ১৬৭৬ সালে তাকে দেওয়া হলো দরবারে ফিরে যাওয়ার অনুমতি ।

চক্ৰধ্বজের মৃত্যুর (১৬৭০) পর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে গেল অহমের রাজতন্ত্র। ১৬৭০ থেকে ১৬৮১ সালের মাত্র এগারো বছরের মধ্যে রাজা হলো সাত-সাতজন, যাদের কারোরই হলো না স্বাভাবিক মৃত্যু। ১৬৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বড় ফুকন তার প্রতিদ্বন্দ্বী বুরহা গোহাইনের ভয়ে, বিশ্বাসঘাতকতা করে গৌহাটি তুলে দিল মোগলদের হাতে।

কিন্তু ১৬৮১ সালে গদাধর সিং অহমের সিংহাসনে বসে খুব সহজেই আবার দখল করে নিল গৌহাটি। আর, এভাবেই কামরূপকে চিরদিনের মতো হারিয়ে ফেলল বাংলা।

মীর জুমলা যখন গড়গাঁ অবরোধ করেছিলেন (১৬৬২), তখন কুচবিহারের রাজা পুনরুদ্ধার করেছিল কুচবিহার। ১৬৪৪ সালের মার্চে, শায়েস্তা খান বাংলার নতুন সুবাদার হয়ে রাজমহলে আসতে, মোগল সেনাবাহিনীর ভয়ে তার বশ্যতা মেনে নিল কুচ রাজা, আর যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিল সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। এই রাজা, প্রাণ নারায়ণ, মারা গেল ১৬৬৬ সালে, আর তারপর থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী যাবৎ তার রাজ্য অসাড় হয়ে রইল গৃহযুদ্ধ, রাজকীয় অত্যাচার আর। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলায় । আর এই সুযোগে মোগলেরা দক্ষিণ আর পুবে সাম্রাজ্য বিস্তৃত করার খাতিরে অধিকার করে নিল বর্তমান রংপুর জেলার অধিকাংশ আর পশ্চিম কামরূপ এবং ১৭১১ সালে তারা তাদের এই অধিকৃত রাজ্যগুলো বৈধ। করিয়ে নিল রাজাকে বলপূর্বক চুক্তিতে স্বাক্ষর করিয়ে।

৭.৯ চাটগাঁর জলদস্যু এবং বাংলায় তাদের ধ্বংসলীলা

চাটগাঁ জেলা নিয়ে অনেক শতাব্দী যাবৎ বাংলার মুসলমান শাসক আর আরাকানের গোত্রপ্রধানদের মধ্যে একটা বিতর্ক ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দুই শক্তির মধ্যে সীমানা হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছিল ফেনি নদীকে, কিন্তু পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অলস প্রশাসন, তার উত্তরাধিকারী শাহজাহানের বিদ্রোহ আর আরাকানিদের নৌশক্তি বৃদ্ধির পরিণতিতে পূর্ব বাংলার নদী এবং খাড়িগুলোতে মগদের কর্তৃত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আরাকানি নৌশক্তি বৃদ্ধির পেছনে কাজ করেছে একটা বিদেশি উপাদান, যথা, চাটগাঁয় বসবাসকারী ফিরিঙ্গি বা পর্তুগিজ অভিযানকারী এবং তাদের দো-আঁশলা সন্তানেরা ছিল স্থানীয় রাজার বড়ই বাধ্য।

‘আরাকানি জলদস্যুরা, মগ আর ফিরিঙ্গি উভয়ে, প্রায় জলপথে এসে বাংলায় লুটপাট চালাত। হিন্দু আর মুসলমানদের বন্দী করেও নিয়ে যেত তারা। বাড়ি ফেরার পর যাত্রার ধকল সয়েও যেসব বন্দী টিকে যেত, জলদস্যুরা তাদের লাগিয়ে দিত চাষবাস কিংবা অন্যান্য নিম শ্রেণীর কাজে। আর কিছু বন্দীকে তারা ওলন্দাজ, ইংরেজ আর ফরাসি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত দাক্ষিণাত্যের বন্দরে। দিনে দিনে যত বেড়ে চলল জলদস্যুদের হামলা, বাংলার মানুষ ততই হারিয়ে ফেলল তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। যে বাকলা জেলা (বাকেরগঞ্জ আর ঢাকার কিছু অংশ) একদা ছিল বাড়িঘর আর ফসলি জমিতে পরিপূর্ণ, যেখান থেকে সুপারির কর হিসেবে আদায় হতো প্রচুর রাজস্ব, তাদের লুটপাট আর অপহরণে সেখানে এমন অবস্থা হলো যে একটা বাড়িও আর রইল না, যেটায় বাস করে কোনো মানুষ, কিংবা সহ্মেবাতি জ্বালে আঁধার নামার পর।’

‘বাংলার নৌবহরের নাবিকেরা জলদস্যুদের এতই ভয় পেত যে একশো যুদ্ধ নৌকা নিয়ে কোথাও যাওয়ার সময় জলদস্যুদের মাত্র চারটে নৌকা দেখলেও তারা কাঁপতে লাগত ঠকঠক করে, আর নৌকাগুলো দৃষ্টিসীমার বাইরে হারিয়ে যাওয়ার পর নিজ নিজ ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিত আক্রান্ত হয়নি বলে।’

‘ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা তাদের লুটের মালের অর্ধেক দিত আরাকানের রাজাকে আর বাকি অর্ধেক রেখে দিত। তারা পরিচিত ছিল ‘হার্মাদ’ বলে (পর্তুগিজ শব্দ ‘আর্মাদা’র বিকৃতি, যার অর্থ নৌবহর), আর সব সময় ঘুরে বেড়াত যুদ্ধোপকরণে সজ্জিত শতখানেক দ্রুতগামী ছিপ-নৌকা নিয়ে। মানুচি তাদের বলেছেন ‘নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ, হত্যায় অভ্যস্ত, এমনকি শিশুকে হত্যা করতেও তাদের বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হয় না।

পূর্ব বাংলার নদীতীরের অঞ্চলগুলো জনশূন্য হয়ে পড়ায় সম্রাটের রাজস্বের খুব ক্ষতি হলো, কিন্তু তার চেয়েও তাঁর সম্মানের ক্ষতি হলো অনেক বেশি। প্রদেশের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে এখন চাটগাঁর জলদস্যুদের আড্ডা ভেঙে দিতে হবে।

শায়েস্তা খানের কাঁধে চাপল মীর জুমলার অসমাপ্ত কাজের ভার। প্রথমটায় মনে হলো, তার এই কাজ করা একেবারেই অসম্ভব। মোগল নৌবহরের (নওয়ারা) রক্ষণাবেক্ষণের বার্ষিক যে ১৪ লাখ টাকা আসত ভূমি অনুদান থেকে, তার মারাত্মক অবনতি হয়েছিল সুজার শিথিল প্রশাসন আর অফিসারদের তহবিল তছরুপের কারণে। অবনতির যেটুকু বাকি ছিল তা-ও পূর্ণ হয়েছিল মীর জুমলার আসাম আক্রমণের সময়। মোট কথা, বাংলার নৌবাহিনীর আর অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। সুতরাং শায়েস্তা খানের প্রথম কাজ হলো নৌবাহিনী পুনর্গঠিত করা।

এবং তা-ই তিনি করলেন। তাঁর তেজ আর কর্মচাঞ্চল্যের সামনে কোনো বাধাই টিকল না। ঢাকা, হুগলি, যশোর, বালেশ্বর, কারিবারি ইত্যাদি ডকে শুরু হলো নতুন জাহাজ তৈরির কাজ, আর এক বছরের সামান্য বেশি সময়ের মধ্যেই প্রস্তুত হয়ে গেল ৩০০ নৌকার নতুন এক বহর। ঢাকা শহরের ছয় মাইল দক্ষিণ পুবের ধাপায় হলো একশো যুদ্ধ-নৌকার একটা দপ্তর এবং আরও ৩০ মাইল দক্ষিণের সংগ্রামগড়ে ২০০ নৌকার আরেকটা, আর এই দুই দপ্তরের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষিত হলো বন্যাসীমার চেয়েও উঁচু একটা সামরিক পথের মাধ্যমে। সংগ্রামগড় আর চাটগাঁর মধ্যবর্তী সন্দ্বীপও ছিল দপ্তর হিসেবে উপযোগী, যে দ্বীপটা থেকে নৌপথে চাটগাঁ যাওয়া যায় মাত্র ছয় ঘণ্টায়। সন্দ্বীপের বর্তমান প্রভু হলো দিলাওয়ার, মোগল নৌবাহিনীর এক পলাতক সেনাপতি, যোদ্ধা এবং শাসক হিসেবে যার রয়েছে উল্লেখযোগ্য দক্ষতা।

দপ্তর হিসেবে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ১৬৬৫ সালের নভেম্বরে আক্রমণ চালিয়ে সন্দ্বীপ দখল করে নিল নৌ-সেনাপতি আবুল হাসান; ৮০ বছর বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বীরের মতো যুদ্ধ করল দিলাওয়ার, কিন্তু শেষমেশ আহত হওয়ায় হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে তাকে আনা হলো ঢাকায়, আর দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত হলো একটা মোগল গ্যারিসন।

মোগলদের অধীনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ফিরিঙ্গিদের বশ করলেন শায়েস্তা খান। তবে তার কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল আরাকানি প্রভুদের সঙ্গে তাদের এক মারাত্মক বিবাদে। পরিবার আর ধনসম্পদসহ চাটগাঁর পুরো ফিরিঙ্গি উপনিবেশ তড়িঘড়ি পালিয়ে গেল মোগল ভূখণ্ডে (ডিসেম্বর, ১৬৬৫)। মোটা বেতনে তাদের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো সম্রাটের নৌবাহিনীতে। ফিরিঙ্গিদের এই বশ মানায় ঘুম নামল বাংলার মানুষের চোখে।

৭.১০ মোগলদের চাটগাঁ বিজয়

১৬৬৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর ৬,৫০০ সেনার একটা শক্তিশালী বাহিনী ঢাকা ত্যাগ করল শায়েস্তা খানের এক পুত্র, বুজুর্গ উম্মিদ খানের অধীনে। সম্রাটের নৌবাহিনীতে ছিল সবসুদ্ধ ২৮৮টা বিভিন্ন ধরনের নৌযান; ফিরিঙ্গিরা তাদের নিজস্ব ৪০টা নৌযান নিয়ে মিত্রবাহিনী হিসেবে কাজ করল। পরিকল্পনা অনুসারে ইবনে হুসাইনের অধীন নৌবহর অগ্রসর হবে উপকূলের পাশ দিয়ে, তাদের সমান্তরাল বরাবর সাগরতীরের ওপর দিয়ে পদাতিক বাহিনী এগোবে জঙ্গল কেটে পথ করতে করতে, শাখা দুটো পরস্পর পরস্পরকে সহায়তা করবে। সর্বাগ্রভাগের নেতৃত্বে থাকা ফরহাদ খান ১৬৬৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ফেনি নদী পেরিয়ে প্রবেশ করল আরাকান ভূখণ্ডে।

২৩ তারিখে মোগল নৌ-সেনাপতি কুমারিয়া খড়ি থেকে বেরোতেই কাঠালিয়া খাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা শত্রু নৌবহরের মুখোমুখি হলো, যেখানে ছিল ১০টা ঘুরব আর ৪৫টা জালিয়া। মোগল সর্বাগ্রভাগের ফিরিঙ্গিদের প্রচণ্ড আক্রমণেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। ঘুরব ফেলে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মগেরা, আর জালিয়াগুলো পালিয়ে গেল।

কিন্তু ওটা ছিল শত্রু নৌবহরের হালকা একটা অংশ। তাদের বড় জাহাজগুলো এবার বেশি আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হার্লা খাড়ি থেকে বেরিয়ে এল খোলা সাগরে।

পরদিন সকালে (২৪ জানুয়ারি) অর্জিত হলো দ্বিতীয় এবং আরও বড় বিজয়। কামানের গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে মুসলমানেরা এগিয়ে গেল শত্রুর দিকে। সামনের মোগলদের ওপর গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে আরাকানি নৌবহর পিছিয়ে গেল কর্ণফুলী নদীতে। বেলা তিনটেয় নদীর মোহনায় পৌঁছে তাদের জাহাজগুলোকে তারা দাঁড় করাল সারিবদ্ধভাবে ।

তারপর মোগলেরা ছুটে গেল শত্রুবহরের দিকে। তুমুল যুদ্ধ হলো। চাটগাঁ দুর্গ থেকেও গোলাবর্ষণ করা হলো মোগলদের ওপর। অবশেষে শক্ত পরাজিত হলো; তাদের অনেক নাবিক জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পালিয়ে গেল, কিছু ডুবে মরল; অবশিষ্টরা হয় নিহত নয়ত বন্দী হলো। জয়ীরা পেল একশো পঁয়ত্রিশটা নৌযান। পরদিন (২৫ জানুয়ারি) অবরোধ করা হলো চাটগা দুর্গ। ২৬ তারিখ খুব সকালে দুর্গ আত্মসমর্পণ করল ইবনে হুসাইনের কাছে; কিন্তু লুটপাটের উদ্দেশ্যে আগেই ঢুকে পড়া জমিদার মুনাওয়ার খানের কিছু উচ্ছল অনুসারী বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিল, ফলে শহরের অনেকখানিসহ পুড়ে গেল রাষ্ট্রীয় দুটো হাতি। কর্ণফুলীর অপর তীরের দুর্গ থেকেও পালিয়ে গেল আরাকানিরা, কিন্তু পথিমধ্যে পলাতকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সর্বস্ব লুট করে নিল তাদের প্রাক্তন ক্রীতদাসেরা, বাংলার যেসব মুসলমানদের অপহরণ করে এনে তারা লাগিয়ে দিয়েছিল চাষবাসের কাজে।

ইতিমধ্যে ঘন জঙ্গল কেটে পথ করে এগিয়ে, চাটগা এসে উপস্থিত হলো ফরহাদ খানের বাহিনী। তার আগমনে মগেরা পালাল তাদের আউটপোস্ট ছেড়ে। ২৬ তারিখে চাটগাঁ পৌঁছাল সর্বাধিনায়ক স্বয়ং আর পরদিন বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করল দুর্গে। সম্পত্তি যা পাওয়া গেল, তার মূল্য খুবই কম। তিনটে হাতি, পিতল আর লোহার ১,০২৬টা কামান (প্রায় সবই একদম ছোট ছোট, বর্ষণ করতে পারে মাত্র ১/২ কেজি বা তার চেয়েও হালকা গোলা), অনেক গাদাবন্দুক আর গোলাবারুদ। তবে এই বিজয়ের সবচেয়ে বড় কীর্তি ছিল, এর ফলে জলদস্যুদের দ্বারা অপহৃত বাংলার হাজার হাজার চাষি মুক্ত হয়ে আবার ফিরে আসতে পেরেছিল নিজ নিজ বাড়িতে; আবার ফসলের ভারে নুয়ে পড়েছিল বাংলার মাঠ। এই বিজয়ের পর চাটগাঁ হলো এক মোগল ফৌজদারের আবাস, আর শহরটার নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো ইসলামাবাদ।

৭.১১ আফগান এবং মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক

ভারত থেকে কাশ্মির আর আফগানিস্তানে গমনপথের উপত্যকা আর চারপাশ। ঘেরা পাহাড়গুলোয় বাস করে অসংখ্য তুর্কি-ইরানীয় উপজাতি, যাদের উত্তরে বলে পাঠান আর দক্ষিণে বালুচ। ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণের পরও তারা বজায় রেখেছে তাদের পুরনো বাচনভঙ্গি, পুরনো উপজাতীয় সংগঠন, আর স্মরণাতীত কালের রাহাজানির পেশা।

দুঃসাহসী আর কষ্টসহিষ্ণু এই উপজাতিগুলো ভীষণ ভুগেছে দীর্ঘকালব্যাপী তাদের উপজাতি-উপজাতি কিংবা পরিবারে-পরিবারে দ্বন্দ্বে । তারা কখনোই একটা বড় দৃঢ় রাষ্ট্র, কিংবা স্থায়ী উপজাতীয় মিত্রসংঘ গড়ে তুলতে পারেনি। কখনোই তারা একটা জাতি হয়ে ওঠেনি, সব সময়ই থেকেছে উপজাতীয় হয়ে। এমনকি তাদের উপজাতিদের মধ্যেও নেই রাজপুতদের মতো কঠোর শৃঙ্খলা ইউসুফজাঈ আর আফ্রিদিরা কেবল তাদের সর্দারকে মানে, সে-ও নিজের কোনো স্বার্থে মানার ইচ্ছে হলে। আফগান সমাজে খাঁটি ঐক্য রয়েছে কেবল পরিবারে।

মোগল আমলেও তাদের অবস্থা এ রকমই ছিল । রাহাজানি ছিল বেপরোয়া এই উপজাতিগুলোর বংশগত পেশা। আফ্রিদি, শিনওয়ারি, ইউসুফজাঈ, খটকদের এই ব্যাপারটা মোগল সরকার এক রকম মেনেই নিয়েছিল, দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে তারা জানত যে উপজাতীয়দের দমন করার চেয়ে ঘুষ দেওয়া সোজা। যত দিন লুটের মালের ভাগ ঠিকঠাক পেত, মিলেমিশেই থাকত উপজাতিগুলো; কিন্তু তাতে কোনো টান পড়লে কিংবা সমবণ্টনের ব্যাপারে সন্দেহ হলেই একে অপরের বিরুদ্ধে হাত নাচাতে শুরু করত এই জন্মগত গণতন্ত্রীরা, তাদের মৈত্রী ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত।

মোগল সম্রাটগণ যখন এদের দমন করতে চেয়েছেন, তখন পাঠিয়ে দিয়েছেন এখানে সেনাবাহিনী; অনেক ক্ষতি স্বীকার করার পর সেনারা তাদের প্রতিরোধ। ভেঙে দিয়েছে, ঘরবাড়ি ধ্বংস করেছে, ফসল কেটে নিয়েছে; আফগান জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে মোগল তরবারির আঘাতে। কিন্তু তার পরও তারা মাঝেমধ্যেই ধ্বংস বা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে দুর্বল কোনো গ্যারিসন; শীতকালে প্রত্যাহার করতে হয়েছে মোগল আউটপোস্ট, বসন্তে তারা আবার কাজ শুরু করেছে নতুনভাবে ।

মোগল তরবারিতে হ্রাসকৃত জনসংখ্যা আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে কয়েক বছরের মধ্যেই, তারাও আবার ক্ষুধার্তের মতো হামলে পড়া শুরু করেছে কাফেলার ওপর।

এই অঞ্চলের মোগলদের প্রথম দুর্দশা হলো ১৫৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যখন রাজা বীরবলের অধীন ৮,০০০ সেনা প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল সোয়াতের এক গিরিসংকটে। সম্রাট শেষমেশ তাদের লুণ্ঠন পেশাকে এড়িয়ে গিয়ে একটা শান্তি স্থাপন করলেন উপজাতীয় সর্দারদের বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে। জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের শাসনকালেও চলল এই একই অবস্থা।

৭.১২ ১৬৬৭ সালের ইউসুফজাঈ উত্থান

ইউসুফজাঈদের বাস সোয়াত আর বাজাউর উপত্যকা এবং উত্তর পেশোয়ারের সমভূমিতে। ১৬৬৭ সালের শুরুতে ইউসুফজাঈদের উত্থান হলো তাদের এক গণ্যমান্য ব্যক্তি ভগুর নেতৃত্বে, যে তার উপজাতির আস্থা নিশ্চিত করেছিল মানী ধর্মগুরু মোল্লা চালকের অনুষঙ্গে। ৫,০০০ মানুষের উপজাতীয় একটা দল নিয়ে আটকের ওপরের সিন্ধু নদ পেরিয়ে, আক্রমণ চালাল ভণ্ড হাজারা জেলার পাখলীতে, যে সমভূমিটার ওপর দিয়ে চলে গেছে কাশ্মিরে যাওয়ার প্রধান রাস্তা। এখানে তারা দখল করে নিল সাদমান দুর্গ আর জোরপূর্বক কর আদায় করল স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে। প্রতিদিন বাড়ল আক্রমণকারীর সংখ্যা, আর ঘন ঘন আক্রান্ত হতে লাগল মোগলদের আউটপোস্ট। ইউসুফজাঈদের অন্যান্য দলও লুটপাট শুরু করল পশ্চিম পেশোয়ার আর আটক জেলার সাম্রাজ্যের ভূখণ্ডে।

সম্রাট ক্রুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহী দেশটাকে আক্রমণের আদেশ দিলেন। শত্রুরা অনুমান করল যে আক্রমণটা আসবে সিন্ধুর দক্ষিণ থেকে, তাই তারা এমনভাবে অবস্থান নিল যেন সিন্ধু পেরিয়ে মোগলেরা এপারে আসতে না পারে। ১৬৬৭ সালের ১ এপ্রিল তাদের আক্রমণ করল কামিল খান (আটকের ফৌজদার)। ভীষণ যুদ্ধের পর শত্রুরা গিয়ে নামল নদীতে; নিহত হলো তাদের দুই হাজার, অনেকে আহত হলো, আর অনেকে ডুবে মরল। সিন্ধু নদের এপারে সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড শত্রুমুক্ত হলো।

মে মাসে আফগানিস্তান থেকে বড়সড় একটা সেনাবাহিনী নিয়ে, সিন্ধু পেরিয়ে শমশির খান প্রবেশ করল ইউসুফজাঈদের দেশে।

তাদের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করল শমসির আর সাফল্যও পেল অনেক। উলে শিবির গেড়ে সে দখল করে নিল মন্দৌর সমভূমি যেখানে ইউসুফজাঈরা তাদের ফসল ফলায়, আর ধ্বংস করে দিল তাদের নিমভূমি অঞ্চলের সমস্ত খামার আর ভিটেমাটি। ৪ জুন ভগুর বর্তমান অবস্থানে আক্রমণ চালানোর জন্য উন্দ থেকে। অগ্রসর হলো শমশির খান। কঠিন যুদ্ধ আর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পর সে দখল করল বেশ কয়েকটা গ্রাম; বিদ্রোহীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করা হলো, ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা হলো, শস্যের কণামাত্র অবশিষ্ট রইল না। পঞ্জশীর নদীর কাছের মনসুরে শত্রুদের পরিখাগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হলো (২৮ জুন, ১৬৬৭)। আগস্টের শেষে মুহম্মদ আমিন খান নামক রাজ্যের এক অমাত্য এসে উপস্থিত হলো বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে, আর শমশিরের কাছ থেকে গ্রহণ করল সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব। শাহবাজগরহির কাছের গ্রামগুলোতে আর কারাহমার উপত্যকায় চলল অবাধ লুটপাট, আর সোয়াত উপত্যকার হিজস গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হলো (অক্টোবর)। এসব শক্ত মার খেয়ে মনে হলো ঝিমিয়ে পড়ল ইউসুফজাঈরা; ১৬৭২ সালের আগে সীমান্তের উপজাতিগুলোর মধ্যে আর কোনো বিদ্রোহের আভাস পাওয়া গেল না।

৭.১৩ ১৬৭২ সালের আফ্রিদি এবং খটক উত্থান; মোগল সেনাপতিদের দুর্দশা

১৬৭২ সালে জালালাবাদের ফৌজদারের কৌশলহীন আচরণে খুবই অসন্তুষ্ট হলো খাইবারের উপজাতিরা । আফ্রিদিরা মাথা চাড়া দিল তাদের সর্দার আকমল খানের নেতৃত্বে। জন্মগতভাবে সেনাপতি এই মানুষটা নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করল, নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করল, আর মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সমস্ত পাঠান উপজাতিকে এই জাতীয় দায়িত্বে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বন্ধ করে দিল খাইবার গিরিপথ ।

১৬৭২ সালের বসন্তকালে আফগানিস্তানের সুবাদার মুহম্মদ আমিন খান তার সেনাবাহিনীসহ পেশোয়ার থেকে রওনা দিল কাবুলের উদ্দেশে, সঙ্গে তার পরিবার আর পারিবারিক কিছু সম্পদ। জামরুদে পৌঁছাতে সে জানতে পারল যে সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে আফগানরা। কিন্তু ঐশ্বর্য এবং ক্ষমতার মদে মত্ত হয়ে আর আফগানদের শৌর্যকে খাটো করে দেখে না থেমে সে এগিয়ে চলল তার সর্বনাশের পথে। আলী মসজিদ পর্যন্ত এগিয়ে (২১ এপ্রিল) সে পরিখা খুঁড়ল । রাতে আফ্রিদিরা পাহাড় থেকে নেমে এসে বিচ্ছিন্ন করে দিল তাকে স্রোতস্বিনী থেকে, যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করত পানি। পরদিন প্রচণ্ড গরমে পিপাসায় মরতে শুরু করল সম্রাট-বাহিনীর মানুষ আর পশু। ইতিমধ্যে গিরিসংকটে গাদাগাদি করে থাকা তাদের ওপর বড় বড় পাথর ফেলতে লাগল আফগানরা তারতারা পাহাড়ের চুড়ো থেকে। শিগগিরই নিহত হলো নেতারা, আর মোগল বাহিনীতে শুরু হয়ে গেল এক দারুণ বিশৃঙ্খলা । হাতি, ঘোড়া আর মানুষ যেন। তালগোল পাকিয়ে গেল। এবার আফগানরা পাহাড় থেকে নেমে এসে হত্যা আর লুটপাট চালাল পুরো মোগল শিবিরে।

মুহম্মদ আমিন খান আর তার উচ্চপদস্থ কয়েকজন অফিসার তাদের পৈতৃক প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পারল পেশোয়ারে; কিন্তু বাকি সবকিছুই তারা হারাল। ‘দশ হাজার মানুষ প্রাণ দিল শক্রর তরবারিতে, আর দুই কোটি টাকার বেশি মূল্যের জিনিস লুষ্ঠিত হলো। বিশ হাজার নারী-পুরুষকে ধরে বিক্রির জন্য তারা পাঠিয়ে দিল মধ্য এশিয়ায়। তাদের হাতে বন্দী মা, স্ত্রী আর কন্যাকে উদ্ধার করল সুবাদার প্রচুর মুক্তিপণের বিনিময়ে। এই জয়ের ফলে আফ্রিদি নেতাদের খ্যাতি আর সংগতি অনেকখানি বেড়ে গেল।

খটক একটা বড় আর যুদ্ধপ্রিয় উপজাতি, যারা বাস করে পেশোয়ার জেলার দক্ষিণাংশ এবং কোহাট আর বানুর অনেকটা জুড়ে। তারা ইউসুফজাঈদের বংশগত শত্রু, কারণ, এই দুই উপজাতির সীমানা মিশেছে পেশোয়ার জেলার মাঝখানে। তাদের সর্দার খুশ-হাল খান একজন বিখ্যাত কবি। অনেক বছর আগেই সে তার উপজাতিকে মোগল-বিরোধিতার প্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু এক বিশ্বাসঘাতকতার ফলে গ্রেপ্তার হয়ে হিন্দুস্তানে সে বন্দী থেকেছে তিন বছর। ১৬৬৭ সালে ইউসুফজাঈদের আক্রমণকারী মোগল বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল সে, আর এখন যোগ দিয়েছে আকমলের সঙ্গে। নিজের উপজাতিকে তরবারির পাশাপাশি কলমের সাহায্যেও সে দিয়েছে যথেষ্ট প্রেরণা।

সাম্রাজ্যের পক্ষে একটা খুবই বড় ধরনের বিপদ। কান্দাহার থেকে আটক পর্যন্ত সব পাঠানই এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে, আর তাদের নেতারা একসময় হিন্দুস্তান আর দাক্ষিণাত্যের সম্রাট-বাহিনীতে চাকরি করার ফলে মোগলদের সাংগঠনিক দক্ষতা আর কৌশলের বিষয়ে পুরোপুরিই ওয়াকিফহাল। দুই দলের অস্ত্রশস্ত্রও প্রায় একই রকম, কেবল আফগানদের রয়েছে বড় কামানের ঘাটতি, কিন্তু তাদের আবার রয়েছে রুক্ষ দেশে যুদ্ধ করার মতো কষ্টসহিষ্ণুতা, যেখানে

ভারতীয় বাহিনী পাহাড়ে যুদ্ধের কথা শুনলেই আতঙ্কে ভোগে।

এই দুর্দশার কথা শুনে আফগানদের হাত থেকে পেশোয়ার রক্ষার খাতিরে সম্রাট কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। মুহম্মদ আমিন খানকে হীনপদস্থ করা হলো; তিন-তিনবার সাফল্যের সঙ্গে আফগানিস্তান শাসন করা মহব্বত খানকে দাক্ষিণাত্য থেকে ডেকে পাঠিয়ে চতুর্থবারের মতো পাঠানো হলো কাবুলে । কিন্তু নতুন সুবাদার তার পূর্বসূরির ভাগ্য বরণ করতে চাইল না; আর তাই যুদ্ধবিগ্রহের পথ এড়িয়ে গোপনে সে তাদের সঙ্গে একটা ব্যবস্থা করে নিল যে তারা কেউ কারও ব্যাপারে নাক গলাবে না। পরবর্তী বসন্তকালে আফগানদের ঘুষ দিয়ে কারাপা গিরিপথ ধরে সে গেল কাবুলে। কিন্তু খাইবার গিরিপথ যথারীতি বন্ধ রইল। ভীষণ অসন্তুষ্ট সম্রাট আফগানদের শায়েস্তা করার জন্য প্রচুর যুদ্ধোপকরণ আর গোলাবারুদসহ বিশাল এক সেনাবাহিনী পাঠালেন সুজায়েত খানের স্বাধীন নেতৃত্বে (১৪ নভেম্বর, ১৬৭৩)। তাকে সহায়তা করতে সঙ্গে এলেন যশোবন্ত সিংহ।

সাধারণ বংশের মানুষ সুজায়েত খান উচ্চপদস্থ হয়েছে সাতনামি বিদ্রোহ দমনের মাধ্যমে সম্রাটের কৃপাদৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে মহব্বত খান আর মহারাজা যশোবন্ত সিংহের মতো অভিজাত-বংশীয় অফিসারেরা তাকে ঈর্ষার চোখে দেখত। পক্ষান্তরে, সুজায়েত ছিল তার প্রভুর কৃপা আর নিজের অতীত সাফল্যের জন্য গর্বিত। তাই যশোবন্তের কোনো রকম পরামর্শের ধার না ধেরে সে স্থির করল তার নিজস্ব কর্মপদ্ধতি। আর পারস্পরিক সহযোগিতার এই অভাবই ১৬৭৪ সালে মোগলদের দুর্দশা বয়ে আনল।

গান্দাব পেরিয়ে সুজায়েত খান উপস্থিত হলো কারাপা গিরিপথে (২১ ফেব্রুয়ারি) । রাতে হলো এত ভারী বৃষ্টি আর তুষারপাত যে প্রচণ্ড ঠান্ডায় ভারতীয় শিবির পৌঁছে গেল প্রায় মৃত্যুর দুয়ারে। সম্রাট-বাহিনীর এই অসাড় অবস্থার সুযোগে ভোরেই আফগানরা আক্রমণ চালাল চারপাশ থেকে। একজন সেনাপতির দায়িত্ব ভুলে গিয়ে, একদম সামনে যাওয়ার ফলে সুজায়েত খান বরণ করল সেপাইসুলভ মৃত্যু। তার নেতৃত্বহীন সেনারা যখন দিশেহারা, তখন যশোবন্ত বুদ্ধিমানের মতো পাঠাল ৫০০ বন্দুকধারী রাঠোরের একটা দল, যারা শক্রব্যুহ ভেঙে অবশিষ্ট সেনাকে ফিরিয়ে আনল শিবিরে। বীরত্বপূর্ণ এই কাজে প্রাণ বিসর্জন দিল ৩০০ জন রাজপুত। সুজায়েতের কয়েক হাজার সেনা নিহত হয়েছে আগেই।

সম্রাটের সম্মান পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে এবার রাওয়ালপিণ্ডি আর পেশোয়ারের মধ্যবর্তী হাসান আবদালে এলেন আওরঙ্গজেব স্বয়ং (২৬ জুন, ১৬৭৪), আর এখানে দেড় বছর থেকে নিজেই পরিচালনা করলেন যাবতীয় কর্মকাণ্ড। পর্যাপ্ত গোলাবারুদসহ তার সঙ্গে এল সুবিশাল এক সেনাবাহিনী। আগহার খান নামক আফগানদের বিপক্ষে যুদ্ধে পটু এক তুর্কি অমাত্যকে দাক্ষিণাত্য থেকে তড়িঘড়ি ডেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো খাইবার অঞ্চল মুক্ত করার ভার (জুলাই)। মহব্বত খানের সুবাদারের পদ কেড়ে নেওয়া হলো সুজায়েত খানের মৃত্যুর পেছনে তার নীরব সমর্থন থাকার সন্দেহে।

আওরঙ্গজেবের আগমনে সশস্ত্র-ব্যবস্থার পাশাপাশি কাজ করতে শুরু করল সম্রাটের কূটনীতি। অনেক উপজাতিকে বশ করা হলো উপহার, বৃত্তি, জায়গির, আর তাদের সর্দারকে মোগল বাহিনীতে নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে। যাদের বশ মানানো গেল না, তাদের উপত্যকা আক্রমণ করল পেশোয়ার থেকে আসা বাহিনী। এভাবে, অল্প সময়ের মধ্যেই ঘোরাই, ঘিলজাঈ, শিরানি আর ইউসুফজাঈ উপজাতিকে পরাজিত করে বিতাড়িত করা হলো তাদের গ্রাম থেকে। অতীত অপকর্ম ক্ষমা করা হলে আফ্রিদির ভান করা আকমল খানের শির হাজির করার প্রতিশ্রুতি দিল দরিয়া খান আফ্রিদির অনুসারীরা (আগস্টের শেষে)।

ইতিমধ্যে আগহার খান অর্জন করল অনেক বড় বড় সাফল্য। প্রথমত, মোহমন্দ আর তার মৈত্রীদের একটা রাতের আক্রমণ ব্যর্থ করে দিয়ে সে হত্যা করল তাদের ৩০০ জন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে নিয়ে গেল ২,০০০ বন্দী আর অনেক লুটের মাল । এবার সে খাইবার গিরিপথ মুক্ত করার চেষ্টা করল, কিন্তু আলী মসজিদের কাছে এক দীর্ঘ যুদ্ধের পর দুই পক্ষেরই ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি হলো, আর আগহার খান মারাত্মকভাবে আহত হলে পরিত্যক্ত হলো এই প্রচেষ্টা। তার সহকর্মী, বিশেষ করে হিন্দুস্তানি অমাত্যদের ঈর্ষাও আগহার খানের কাজে বাধার সৃষ্টি করল। তারপর বন্ধুভাবাপন্ন রাজপুত আর আফগানদের ৫,০০০ সেনার একটা দল নিয়ে সে অধিকার করল নাংরাহার আর মুক্ত রাখার চেষ্টা করল আশপাশের রাস্তা। জগদলক গিরিপথ অবরোধ করে থাকা ঘিলজাঈরা বারবার পরাজিত হওয়ার পর শেষমেশ বিতাড়িত হলো। মোগল সেনাপতিদের মধ্যে। একমাত্র আগহার খানই সীমান্তের উপজাতিদের বিপক্ষে অবিচল বিজয় অর্জন করেছে। কথিত আছে, আফগান মায়েরা নাকি তাদের দুষ্টু শিশুকে আগহার খানের ভয়ংকর নাম বলে ঘুম পাড়াত ।

১৬৭৫ সালের বসন্তকালে, ফিদাই খান কাবুল থেকে পেশোয়ারে ফেরার পথে, আফগানরা তার ওপর হামলা চালাল জগদলক গিরিপথে। তার সর্বাগ্রভাগ পরাজিত হলো, নিহত হলো সেটার আরব সেনাপতি; অনেক হাতি, গোলাবারুদ, মালপত্র আর মহিলাকে নিয়ে চলে গেল শক্ররা। কিন্তু রাজ্যপালের সাহস আর অবিচলতা তার কেন্দ্রভাগকে রক্ষা করল। তখন গন্দমাক থানার দায়িত্বে থাকা আগহার খান এই জটিল পরিস্থিতির সংবাদ পেয়ে দ্রুত এগিয়ে এল তার সহায়তায় আর পাহাড়চুড়ো থেকে শত্রুদের তাড়িয়ে দখল করল জগদলক গিরিপথ।

জুনের শুরুতে ‘সম্রাট-বাহিনীর একটা শোচনীয় পরাজয় হলো। বড় একটা সেনাবাহিনী নিয়ে আফগানদের বিরুদ্ধে মুকাররম খান লড়াই করছিল বাজাউরের পাশের খাপুসে, একদিন প্রলোভন দেখিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ওত পেতে থাকা বিদ্রোহীদের কাছে, আর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো সে।

নেওয়া হলো প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা, আফগানিস্তানের সমস্ত মোগল অবস্থানকে জোরদার করা হলো।

আগস্টের শেষে পুত্রসহ নিহত হলো জগদলকের দাবোগা হিজবর খান; বেশ কিছু সেনাকে খতম করার পর তাড়িয়ে দেওয়া হলো বঙ্গব আর সুরখবের দারোগা আবদুল্লাহকে। কিন্তু পাঠান দেশটার কৌশলগত স্থানগুলোতে। আউটপোস্ট আর দুর্গ নির্মাণের ফলে মোগল বাহিনী তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারল। ১৬৭৫ সালের শেষের দিকে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হওয়ায় হাসান আবদাল ত্যাগ করে সম্রাট ফিরলেন দিল্লিতে।

৭.১৪ আফগানিস্তানে আমির খানের সফল শাসন ১৬৭৮-৯৮

খলিলুল্লাহর পুত্র মীর খান আগে পরিচিত হয়ে উঠেছিল শাহবাজগরহির ইউসুফজাঈ আর বিহারে আফগান দুই বিদ্রোহী সর্দারকে দমন করার সুবাদে। ১৬৭৫ সালে তাকে উপাধি দেওয়া হলো আমির খান, আর ১৬৭৭ সালের ১৯ মার্চ নিযুক্ত করা হলো কাবুলের সুবাদার। ১৬৭৮ সালের ৮ জুন পদে আসীন হওয়ার পর থেকে ২০ বছর আফগানিস্তানকে সে শাসন করল অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। অনেক চেষ্টার পর সে আফগানদের হৃদয় জয় করে নিল, এমনকি আফগান সর্দারেরা তাদের লাজুক আর অসামাজিক আচরণ ত্যাগ করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লাগল সন্দেহমুক্ত হয়ে। তারা খুবই বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠল, আর সবাই তার কাছ থেকে নিতে লাগল পারিবারিক বিষয়ের পরামর্শ। তার বিচক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আফগানরা যেমন আর সম্রাটের ঝামেলার কারণ হলো না, তেমনই নিজেদের শক্তিও ক্ষয় করল না পারস্পরিক কলহে। বুদ্ধির বলে সে আকমলের অনুসারীদের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো। আমির খানের প্রশাসনিক সাফল্যের পেছনে রয়েছে যে বিচক্ষণ পরামর্শ, সেগুলোর বেশির ভাগই জোগান দিত তার স্ত্রী, সাহিজি, আলী মর্দান খানের এক কন্যা।

সম্রাট আফগানিস্তানে সফল হলেন ভর্তুকি দিয়ে, আর এক উপজাতির বিপক্ষে আরেক উপজাতিকে প্ররোচিত করে। সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড আর আক্রান্ত হলো না সীমান্তের ওপার থেকে। খাইবার গিরিপথ সব সময় মুক্ত রাখা গেল পাহাড়িদের নিয়মিত বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে। আমির খানের কূটনীতি আকমলের অনুসারীদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, আর স্বঘোষিত সেই রাজা মারা যাওয়ার পর আফ্রিদিরা সম্রাটের সঙ্গে সন্ধি করল।

তবে বিদ্রোহের আগুন সম্পূর্ণ নিবে গেল না। বছরের পর বছর ধরে একাই যুদ্ধ চালিয়ে গেল স্বাধীনতাকামী, বশের অসাধ্য, খুশ-হাল খান খটক। বাঙ্গাস আর ইউসুফজাঈ উপজাতি, এমনকি তার পুত্র আশরাফ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করল মোগল সেনাবাহিনীর হয়ে; কিন্তু বয়স, উদ্দেশ্যের অসহায়তা, বেদনাদায়ক অনুভূতি কিছুই তার আত্মার অমিত তেজকে দমাতে পারল না। একাই সে বয়ে চলল পাঠানদের স্বাধীনতার পতাকা, যতক্ষণ না তার আপন পুত্র বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে তুলে দিল শত্রুর হাতে। নিজ দেশ থেকে নির্বাসনে শত্রুর দুর্গে বন্দী হয়েও সে গর্বভরে বলল:

আমার মতো আর কেউই জখম করতে পারেনি আওরঙ্গজেবের হৃদয় ।

খাইবার গিরিপথ আমি মোগলদের কিনিয়েছি সর্বোচ্চ মূল্যে।

এই আফগান যুদ্ধ আসন্ন রাজপুত যুদ্ধে সেনাবাহিনীতে আফগানদের অন্তর্ভুক্তি অসম্ভব করে তুলল। তা ছাড়া এটা শিবাজীর ওপর থেকেও চাপ কমাল দাক্ষিণাত্য থেকে সেরা মোগল সেনাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার ফলে। শত্রুর এই অপসারণের জন্যই মারাঠি সর্দারের পক্ষে অবিরাম সাফল্যের ঝলক প্রদর্শনের সুযোগ এসেছিল। আফ্রিদি আর খটকরাই সম্ভব করে তুলেছিল তার সেই সময়ের অটুট সফলতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *