১১. শিবাজী ১৬৭০-৮০

১১. শিবাজী ১৬৭০-৮০

১১.১ মোগলদের সঙ্গে শিবাজীর বিচ্ছেদ এবং দুর্গ পুনরুদ্ধার

মোগলদের সঙ্গে নতুন চুক্তি অনুসারে শিবাজী আওরঙ্গাবাদে একদল মারাঠি সেনা পাঠাল প্রতাপ রাও আর নিরজী রাওজীর অধীনে (আগস্ট, ১৬৬৮)। শম্ভুজীকে আবার দেওয়া হলো পাঁচ হাজারি মনসবদারির পদ এবং উপহার হিসেবে একটা হাতি আর একটা রত্নখচিত তরবারি। ১৬৬৭, ১৬৬৮ আর ১৬৬৯ সাল শিবাজী খুবই শান্ত রইল। আসলে এই তিন বছর সে ব্যস্ত ছিল অত্যন্ত বিচক্ষণ কিছু প্রবিধান গঠনে, যা তার সরকারকে বিস্তৃত আর গভীর করার ভিত্তি স্থাপন করেছে।

কিন্তু দুই পক্ষের জন্যই শান্তি স্থাপনটা ছিল শূন্যগর্ভ। পুত্রদের নিয়ে চির সন্দেহপ্রবণ আওরঙ্গজেব শিবাজী আর মুয়াজ্জমের বন্ধুত্বকে মনে করলেন সিংহাসনের জন্য এক সম্ভাব্য বিপদ। তাই শিবাজীকে আরেক বার ফাঁদে ফেলার জন্য তিনি করলেন গোপন এক পরিকল্পনা। আরেকটা অবিবেচনাপূর্ণ পদক্ষেপ নিলেন তিনি, দরবারে আসার জন্য ১৬৬৬ সালে শিবাজী যে এক লাখ টাকা অগ্রিম নিয়েছিল, তার দায়ে ক্রোক করলেন মারাঠি সর্দারের বেরারের নতুন জায়গিরের একটা অংশ। এই সংবাদ শিবাজীর কানে যেতে মোগলদের সঙ্গে সে বিচ্ছেদ ঘটাল ১৬৬৯ সালের শেষাশেষি ।

তার দল আবার লুটপাট শুরু করল মোগল ভূখণ্ডে । পুরন্দর চুক্তি মোতাবেক আওরঙ্গজেবকে যে কয়টা দুর্গ ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তার বেশ কয়টা পুনরুদ্ধার করল সে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো রাজপুত কিলাদার উদয়-ভানের কাছ থেকে কোন্দানা পুনরুদ্ধার (৪ ফেব্রুয়ারি, ১৬৭০)। গাঢ় অন্ধকার এক রাতে ৩০০ বাছাই মাবল পদাতিকসহ দড়ির মই বেয়ে পাহাড়ে উঠে পড়ল তানাজী। মালুসারে। দুর্গের সবাই যুদ্ধ করল মরিয়া হয়ে, কিন্তু মাবলদের রণহুঙ্কার ‘হর! হর! মহাদেব!’ তাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করল। দুই দলের দুই প্রধান মুখোমুখি হলো ভয়াবহ এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, যার শেষে নিহত হলো উভয়েই। বারোশো রাজপুত মারা গেল, আরও অনেকে খতম হলো পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে। সিংহের মতো বিক্রমে দুৰ্গটা পুনরুদ্ধার করা হলো বলে শিবাজী এটার নতুন নাম রাখল-সিংহগড়।

কঙ্কানের ফৌজদার লুদি খান মারাঠিদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রথমে আহত আর দ্বিতীয়বার পরাজিত হয়ে বহিষ্কৃত হলো তার জেলা থেকে। নান্দারের মোগল ফৌজদার পালিয়ে গেল সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে। দাক্ষিণাত্যে দাউদ খান কোরেশী কেবল সম্রাটের সম্মান সমুন্নত রাখল সফলভাবে পানির আর জুন্নারে দখল বজায় রেখে।

১৬৭০ সালের এপ্রিল শেষ হতে হতে শিবাজী লুট করল আহমদনগর, জুন্নার আর পারেন্দার আশপাশের ৫১টা গ্রাম।

১১.২ মুয়াজ্জম ও দিলিরের কলহ

১৬৭০ সালের অর্ধেক জুড়ে দাক্ষিণাত্যের মোগল প্রশাসন মারাত্মক এক হুমকির সম্মুখীন হলো সুবাদার শাহ আলম আর সেনাপতি দিলির খানের কলহের ফলে। দিলির শাহজাদার হুকুম তামিল করতে রাজি নয়; তার ভয়, শাহজাদা বিশ্বাসঘাতকতা করে তাকে হত্যা বা বন্দী করতে পারে! শাহজাদা আর তাঁর প্রিয় সেনাপতি যশোবন্ত দিলির খানকে বিদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করে সম্রাটের কাছে চিঠি লিখলেন। ওদিকে খান ইতিমধ্যেই সম্রাটের কাছে শিবাজীর সঙ্গে শাহজাদার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে বসে আছে। আওরঙ্গজেব তখন মুয়াজ্জমের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন; শাহজাদা কোনো আদেশ পালন করেন না, সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষার বেলাতেও তার অবহেলার শেষ নেই। দাক্ষিণাত্যের জনসাধারণ শিবাজীর প্রকাশ্য ধৃষ্টতা আর শাহজাদার নিষ্ক্রিয়তার যোগফল হিসেব করেছে এই যে মুয়াজ্জম মারাঠিদের সঙ্গে আঁতাত করে পিতার সিংহাসন দখলের মতলব আঁটছেন।

তাই ১৬৭০ সালের মার্চের শেষে আওরঙ্গজেব তাঁর চেম্বারলিন (খান-ই সামান), ইফতিখার খানকে আওরঙ্গাবাদে তদন্ত করতে পাঠিয়েছিলেন যে মুয়াজ্জম কি সত্যিই রাষ্ট্রদ্রোহিতা শুরু করেছেন কিংবা শিবাজীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কী। এবার সম্রাট ইফতিখারকে দিলিরের বিরুদ্ধে শাহ আলমের অভিযোগটাও তলিয়ে দেখার নির্দেশ দিলেন।

দাক্ষিণাত্য অসহনীয় হয়ে ওঠায় তাঁবু আর খাদ্যভাণ্ডার পুড়িয়ে ফেলে নিজের সেনাবাহিনীসহ দিলির পালাল উত্তরের উজ্জয়িনীতে। মোগল সেনা নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটলেন শাহজাদা মুয়াজ্জম আর যশোবন্ত। কিন্তু খান্দেশের সীমান্তে যেতেই সম্রাট মুয়াজ্জমকে আওরঙ্গাবাদে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন (সেপ্টেম্বর)। কারণ, ইতিমধ্যে গুজরাটের রাজ্যপাল সম্রাটের কাছে চিঠি লিখেছে যে দিলির খান বর্তমানে তার কাছে আছে, সে অত্যন্ত বিশ্বস্ত, আর তাকে তার অধীনে কাথিয়াড়ের ফৌজদার নিযুক্ত করা যেতে পারে। সম্রাট বাহাদুর খানের এই চিঠির ব্যাপারে তাঁর সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। মুয়াজ্জম তাঁর পিতার আদেশ মেনে আওরঙ্গাবাদে ফিরে এলেন ১৬৭০ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে।

এসব অন্তঃকলহ মোগল সেনাদের প্রায় অসাড় করে ফেলেছিল, আর সুবর্ণ সেই সুযোগই গ্রহণ করেছে শিবাজী। মার্চে সুরাটের ইংরেজ গোমস্তা লিখেছে, ‘শিবাজী এখন আর আগের মতো চুপিসারে আসে না, ৩০,০০০ সেনা নিয়ে বীরদর্পে আসে সে জয় করতে করতে, যদিও শাহজাদা (শাহ আলম) কাছেপিঠেই হাত গুটিয়ে বসে থাকেন।

১১.৩ সুরাটের দ্বিতীয় ধ্বংস

২ অক্টোবর সংবাদ পাওয়া গেল, ১৫,০০০ অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনাসহ শিবাজী এসে গেছে সুরাটের ২০ মাইলের মধ্যে। ৩ তারিখে শহরটাকে আক্রমণ করল সে, যেটাকে সম্প্রতি আওরঙ্গজেব ঘিরে দিয়েছেন দেয়াল তুলে। চলল ইচ্ছে মতো লুটতরাজ; ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, পারসি আর তুর্কিরা ছাড়া কেউ রেহাই পেল না। ফরাসিরা আক্রমণকারীদের কাছ থেকে তাদের নিরাপত্তা কিনে নিল মূল্যবান উপহারের বিনিময়ে। ভালো প্রতিরোধ গড়ে তুলে তুর্কিরা আক্রমণকারীদের বরং কিছুটা ক্ষতিই করল। কিন্তু শহরের প্রায় অর্ধেক পুড়িয়ে ছারখার করে মারাঠিরা ফিরে চলে গেল ৫ অক্টোবর।

সরকারি হিসাবে জানা গেল, শিবাজী নিয়ে গেছে ৬৬ লাখ টাকার সম্পদ। কিন্তু সুরাটের প্রকৃত ক্ষতি হলে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভারতের সেরা সম্পদশালী এই বন্দর বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে একদম ধ্বংস হয়ে গেল।

১১.৪ দিন্দোরিতে শিবাজীর হাতে দাউদ খানের পরাজয়, অক্টোবর ১৬৭০; বেরার আক্রমণ

সুরাটের দ্বিতীয় ধ্বংসের পর, বাগলানায় প্রবেশ করে শিবাজী লুটতরাজ চালাল। মালহির দুর্গের পাদদেশের গ্রামগুলোতে। এবার মারাঠিদের যুদ্ধ লাগল বুরহানপুর থেকে আসা দাউদ খানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। মোগলদের বুন্দেলা পদাতিকের অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে মারাঠিরা বিশেষ সুবিধা করতে পারল না, কিন্তু রাতের বেলা মোগল সেনারা যখন শুয়ে পড়ল শরতের খোলা আকাশের নিচে, অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মারাঠিরা তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করল। যুদ্ধের একদিন পর ভাঙাচোরা বাহিনী নিয়ে নাসিকে এসে এক মাস থাকল দাউদ খান, তারপর আহমদনগরে ফিরে গেল নভেম্বরের শেষে।

এবার শিবাজী ঝাঁপিয়ে পড়ল বেরারের সম্পদশালী শহর করিনজার ওপর, আর চার হাজার বলদ আর গাধার পিঠে চাপিয়ে নিয়ে গেল দামি কাপড়, রুপা আর সোনা, যার মূল্য এক কোটি টাকা। শহরের সমস্ত ধনী মানুষকে ধরে নিয়ে গেল তারা মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে।

প্রতাপ রাওয়ের করিনজা লুটের সময়, মোয়রা জিম্বক পিঙ্গল লুট করল পশ্চিম খান্দেশ আর বাগলানা, তারপর দুজনের দুই বাহিনী শালহিরের কাছে একত্র হয়ে অবরোধ করল দুৰ্গটা। শিবাজী শালহির অবরোধ করেছিল ২০,০০০ অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনা নিয়ে। কিলাদার ফতুল্লাহ খান যুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার শ্যালক দুর্গ সমর্পণ করল শত্রুপক্ষের হাতে (৫ জানুয়ারি, ১৬৭১)।

মারাঠিদের সাফল্য অব্যাহত রইল। তারা বিচ্ছিন্ন করে দিল বাগলানার ফৌজদার নেকনাম খানের খাদ্যশস্যের সরবরাহ।

১১.৫ মোগল সেনাপতিদের অভিযান, ১৬৭১-৭২

এসব পরাজয়ের ফলে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করলেন আওরঙ্গজেব । মহব্বত খানকে তিনি নিযুক্ত করলেন দাক্ষিণাত্যের প্রধান সেনাপতি। বেশি বেশি করে সেনা, টাকা আর রসদ পাঠানো হলো বাগলানায় (জানুয়ারি, ১৬৭১)।

জানুয়ারির শেষের দিকে মহব্বত খান চাঁদোরের কাছে দাউদ খানের সঙ্গে যোগ দিয়ে শিবাজীর সম্প্রতি দখলকৃত অহিবন্ত অবরোধ করল। এক মাস পর দুৰ্গটা আত্মসমর্পণ করলে, অহিবন্তের দায়িত্বে একটা বাহিনী রেখে মহব্বত তিন মাস কাটাল নাসিকে, আর তারপর আহমদনগরের ২০ মাইল পশ্চিমের পানিরে গেল বর্ষাকাল (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) কাটানোর জন্য।

মহব্বতের এই নিষ্ক্রিয়তায় অসম্ভষ্ট হলেন সম্রাট, তার সঙ্গে শিবাজীর একটা গোপন সমঝোতার ব্যাপারেও সন্দেহ করলেন তিনি। তাই পরবর্তী শীতে তিনি দাক্ষিণাত্যে পাঠালেন বাহাদুর খান আর দিলির খানকে। তারা গুজরাট থেকে বাগলানা এসে শালহির অবরোধ করল, আর ইখলাস খান মিয়ানা, রাও অমর সিংহ চন্দ্রবত এবং আরও কয়েকজন অফিসারকে অবরোধ চালিয়ে যেতে বলে, অগ্রসর হলো আহমদনগরের দিকে। পুনা পুনরুদ্ধার করে দিলির খান সেখানে চালাল এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড, নয় বছরের বেশি বয়সের একজন অধিবাসীও রেহাই পেল না মোগল তরবারি থেকে (১৬৭১, ডিসেম্বরের শেষে)। কিন্তু শালহির অবরোধে রেখে আসা বাহিনীটাকে আক্রমণ করল প্রতাপ রাও, আনন্দ রাও আর পেশওয়ার অধীন এক বিশাল মারাঠি বাহিনী। ভয়াবহ যুদ্ধের পর ৩০

জন প্রধান অফিসারসহ আহত অবস্থায় বন্দী হলো ইখলাস খান আর মুহাম সিংহ (রাও অমর সিংহ চন্দ্রবতের পুত্র), আর রাও অমর সিংহ আর বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত হলো কয়েক হাজার সেপাই। পুরো অবরোধ শিবিরই চলে গেল শত্রুদের হাতে। মাত্র কদিন পরেই মোয়রা পন্ত দখল করে নিল মালহির। ঘটনা দুটো ঘটল ১৬৭২ সালের জানুয়ারির শেষে আর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এবং এই সাফল্যের ফলে বেড়ে গেল শিবাজীর সম্মান আর তার নিজের শক্তির ওপর আস্থা।

১৬৭২ সালের মাঝামাঝি মহব্বত আর শাহ আলমকে হিন্দুস্তানে ডেকে নিয়ে বাহাদুর খানকে নিযুক্ত করা হলো দাক্ষিণাত্যের প্রধান সেনাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত সুবাদার। ১৬৭৩ সালের জানুয়ারিতে বাহাদুর খান হলো স্বাধীন সুবাদার, আর রইল সেখানে ১৬৭৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ।

১১.৬ মারাঠিদের কোলি দখল এবং সুরাটের কাছে চৌথ দাবি, ১৬৭২

৫ জুন, মোয়রা ত্রিম্বক পিঙ্গলের অধীন বিশাল এক মারাঠি বাহিনী জওহর দখল করল ওটার কোলি রাজা, বিক্রম শাহের কাছ থেকে, সেই সঙ্গে ১৭ লাখ টাকার সম্পদ। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে আরও উত্তরে অগ্রসর হয়ে দখল করল সে রামনগর নামক আরেকটা কোলি রাজ্য।

জওহর আর রামনগর দখলের ফলে সুরাটের দূরত্ব এত কমে গেল যে মারাঠিদের কাছে বন্দরটা হয়ে পড়ল পুরোপুরি অসহায়।

সুরাটের রাজ্যপাল আর বিখ্যাত ব্যবসায়ীদের কাছে মোয়রা ব্রিক পিঙ্গল তার প্রভুর নামে পর পর তিনটে চিঠি পাঠাল চার লাখ টাকা দাবি করে, আর হুমকি দিল যে টাকা না দিলে তৎক্ষণাৎ সুরাটে হামলা চালানো হবে।

কোলির সদর দপ্তর থেকে পশ্চিম ঘাট পার হয়ে মোয়রা ত্রিম্বকের অধীন একটা মারাঠি বাহিনী গেল নাসিক জেলায় (১৬৭২ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি), আর দক্ষিণ আর উত্তর মহকুমার মোগল থানাদার যাদব রাও আর সিদ্দি হালালকে পরাজিত করে চালাল যথেচ্ছ লুটপাট। এই ব্যর্থতার জন্য বাহাদুর খান অফিসার দুজনকে এমনই তিরস্কার করল যে ক্ষিপ্ত হয়ে উভয়েই যোগদান করল মারাঠিদের দলে!

১১.৭ ১৬৭৩ সালে মারাঠি তৎপরতা

পরবর্তী নভেম্বরে শিবাজী তার অশ্বারোহী বাহিনীকে পাঠাল বেরার আর তেলেঙ্গানাতে একটা বিদ্যুৎগতির আক্রমণ চালানোর জন্য। লুটতরাজ সেরে ফিরে। যাওয়ার সময় তাদের দুই ভাগে বিভক্ত বাহিনীর একটার কাছ থেকে প্রচুর মালপত্র কেড়ে নিল দিলির খান। দ্বিতীয় বাহিনীটা আওরঙ্গাবাদের ৩৮ মাইল উত্তরের অন্তুরে মোগল বাহিনীর সম্মুখীন হলে, তাদেরও প্রচুর মাল উদ্ধার করে মালিকদের ফিরিয়ে দিল বাহাদুর খান। আওরঙ্গাবাদের ছয় মাইল দূরে সংঘটিত হলো আরেকটা যুদ্ধ, যেখানে শুভ-করণের অধীন বুন্দেলারা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করল মারাঠিদের (ডিসেম্বর), পেছনে ফেলে যেতে হলো তাদের ৪০০ সেনার লাশ।

মারাঠিদের খান্দেশ আর বেরারের এবারের আক্রমণ ১৬৭০ সালের ডিসেম্বরের মতো হলো না, মোগলেরা প্রশংসনীয়ভাবে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দিল।

১৬৭৩ সালে বাহাদুর খান শিবির পাতল পেডগাঁয়ে ভীমার উত্তর তীরে চামরগন্ধার ৮ মাইল দক্ষিণে। এখানেই অনেক বছর যাবৎ ছিল তার সেনাদের বাসস্থান, আর এই সেনানিবাস ঘিরেই গড়ে উঠেছিল একটা দুর্গ আর একটা শহর, সম্রাট যার নাম রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন বাহাদুরগড়।

১৬৭২ সালের ২৪ নভেম্বর দ্বিতীয় আলী আদিল শাহ মারা গেল, আর কয়েক মাসের মধ্যেই বিজাপুরে শুরু হলো বিশৃঙ্খলা । শিবাজীর জন্য এটা ছিল একটা সুযোগ। ১৬৭৩ সালের ৬ মার্চ ঘুষ দিয়ে সে পানহালা দখল করল দ্বিতীয়বারের মতো, আর ২৭ জুলাই পাহাড়ে-দুর্গ সাতারা অধিকার করল ওই একই প্রক্রিয়ায়।

দশহরার দিনে (১০ অক্টোবর, ১৬৭৩) ২৫,০০০ সেনার শক্তিশালী একটা বাহিনী নিয়ে শিবাজী স্বয়ং ঝাঁপিয়ে পড়ল বিজাপুরী ভূখণ্ডে, লুট করল অনেক সম্পদশালী শহর, তারপর আরও লুট করার জন্য চলে গেল কানারায়। এখানেই তারা ব্যস্ত রইল ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত ।

১৬৭৪ সালের জানুয়ারির শেষাশেষি মোগল একটা বাহিনী নামতে চাইল কানে, কিন্তু রাস্তা ভেঙে দিয়ে শিবাজী তাদের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করল।

শিগগিরই দাক্ষিণাত্যে মোগল শক্তি পঙ্গু হয়ে গেল। আফগানদের বিদ্রোহ এমন মারাত্মক রূপ নিল যে দিল্লি ত্যাগ করে (৭ এপ্রিল), আওরঙ্গজেবকেই রওনা দিতে হলো হাসান আবদালের উদ্দেশে। পরবর্তী মাসে দিলির খানের ডাক পড়ল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। দাক্ষিণাত্যে বাহাদুর খান একা রয়ে গেল অনেক দুর্বল এক সেনাবাহিনী নিয়ে। এই সুযোগে রাইগড়ে, মহাজাকজমক আর আনন্দোৎসবের মধ্যে শিবাজী নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করল ১৬৭৪ সালের ৬ জুন।

১১.৮ বাহাদুর খানের শিবির লুট এবং মোগলদের সঙ্গে ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ১৬৭৪

 রাজ্যাভিষেকের অতি জাঁকজমকের ফলে শিবাজীর কোষ শূন্য হয়ে গেল, সেনাদের বেতন দেওয়ার জন্য এখন চাই টাকা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি ২,০০০ অশ্বারোহীর একটা বাহিনী বাহাদুর খানকে প্রলুব্ধ করে সরিয়ে নিয়ে গেল পেডগার ৫০ মাইল দূরে, এদিকে ৭,০০০ সেনার আরেকটা বাহিনী নিয়ে ঘুরপথে এসে শিবাজী ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিরোধহীন শিবিরের ওপর, আর লুট করে নিয়ে গেল এক কোটি টাকা আর ২০০টা চমৎকার ঘোড়া। অক্টোবরের শেষে বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে ঘাট পেরিয়ে গেল শিবাজী স্বয়ং, আর লুট করল আওরঙ্গাবাদের কাছের বেশ কয়েকটা শহর, আর তারপর বাগলানা আর খান্দেশ লুট করল এক মাসেরও বেশি সময় ধরে (নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি) । অন্যান্য জায়গার মধ্যে লুটতরাজ চালাল আর পুড়িয়ে দিল তারা এরাওলের ১০ মাইল উত্তরের ধরনগা, আর সেখানকার ইংরেজদের কারখানা।

তারপর বাহাদুর খানের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্য শিবাজী শুরু করল এক প্রতারণাপূর্ণ যোগাযোগ। তিন মাস (মার্চ-মে) মোগলদের সঙ্গে খেলা করল সে শান্তির মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু ফন্দা দখল (জুলাই, ১৬৭৫) হতেই মুখোশ খুলে ফেলে মোগল দূতদের তাড়িয়ে দিল শিবাজী উপহাস করে।

১৬৭৬ সালের জানুয়ারিতে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ল শিবাজী, আর বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিন মাস কাটিয়ে দিল সাতারায় ।

১১.৯ শিবাজীর কর্ণাটক অভিযানের প্রস্তুতি

পরবর্তী জানুয়ারিতে (১৬৭৭) মারাঠি রাজা প্রস্তুতি নিতে লাগল তার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযানের জন্য উত্তর কর্ণাটক আক্রমণ। প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এখন তার পরিকল্পনার অনুকূলে। সম্রাটের সেরা বাহিনীগুলো আজও আফগানদের বিদ্রোহ সামলাতে ব্যস্ত।

শিবাজী তার প্রধান বিচারপতি নিরজী রাওজীকে দামি দামি উপহারসহ বাহাদুর খানের কাছে পাঠিয়ে তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলল যে কর্ণাটক অভিযানের যে মোটামুটি এক বছর সে অনুপস্থিত থাকবে, সেই সময়টুকু সে যেন নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।

গোলকুণ্ডার সঙ্গে তার সম্পর্ক আগে থেকেই ভালো ছিল। আবুল হাসান কুতব শাহের সর্বময় ক্ষমতাবান উজির মদনা পণ্ডিত ইতিমধ্যেই তাকে বার্ষিক এক লাখ হুন কর দিতে চেয়েছে রাজ্যের নিরাপত্তার বিনিময়ে। অভিযানের ব্যয় আর সহায়ক সেনা শিবাজী গোলকুণ্ডা থেকেই নেবে বলে স্থির করল, বিনিময়ে কুতব শাহকে সে দেবে তার বিজয়ের একটা অংশ।

১১.১০ গোলকুণ্ডার সঙ্গে শিবাজীর মৈত্রী ও কর্ণাটক বিজয়

১৬৭৭ সালের জানুয়ারির প্রথমে ৫০,০০০ সেনাসহ রাইগড় থেকে যাত্রা করে, হায়দরাবাদ পৌঁছাল শিবাজী ফেব্রুয়ারির শুরুতে। কুতব শাহি ভূখণ্ডে প্রবেশের পর সে কড়া আদেশ জারি করল যে এখানে যেন ভুলেও কেউ লুটতরাজ না করে।

রাজ্যের রক্ষাকারী আর বিশিষ্ট বন্ধুর আগমন উপলক্ষে সুন্দরভাবে সজ্জিত করা হয়েছে হায়দরাবাদ শহর। মারাঠি সেনাবাহিনী গিয়ে থামল দাদ মহল প্রাসাদের সামনে, আর পাঁচজন অফিসারসহ ওপরতলায় গিয়ে সুলতানের সঙ্গে আলাপ করল শিবাজী তিন ঘণ্টা। শিবাজীকে দেখে এতই চমৎকৃত হলো আবুল হাসান যে তার যা কিছু প্রয়োজন দিয়ে দিতে বলল তার উজিরকে। আসন্ন অভিযান বিষয়ে একটা গোপন চুক্তি হলো। সুলতান প্রতিদিন শিবাজীকে দেবে ৩,০০০ হুন বা মাসে সাড়ে চার লাখ টাকা, সেই সঙ্গে সেনাপতি মীর্জা মুহম্মদ আমিনের অধীনে ৫,০০০ সেনার একটা বাহিনী। শিবাজী কথা দিল, বিজয়ের পর সে সুলতানকে দেবে কর্ণাটকের এত বড় একটা অংশ, যতখানি তার পিতা শাহজীরও ছিল না।

এক মাস পর হায়দরাবাদ ত্যাগ করে দ্রুতগতিতে শিবাজী দক্ষিণে এগোল কারনুল, শ্রী শৈলম, অনন্তপুর, তিরুপতি, কলহস্ত্রি আর মাদ্রাজের ৭ মাইল পশ্চিমের পেপোলম হয়ে। জিনজি দুর্গ দখল করল সে ওটার মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে, তারপর অবরোধ করল ভেলোর, যার রাজ্যপাল চৌদ্দ মাসের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের পর একটা মূল্যের বিনিময়ে ওটা সমর্পণ করল ১৬৭৮ সালের ২১ আগস্ট।

কর্ণাটক সমভূমির ওপর দিয়ে যেন বয়ে গেল মারাঠি আক্রমণের বন্যা। দু একটা মাত্র জায়গা ছাড়া কোথাও প্রতিরোধ গড়ে উঠল না। ধনীরা তাদের আসার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে গেল বনে কিংবা উপকূলের ইয়োনরাপীয় দুর্গগুলোতে। ২৬ জুন কাচ্ছালোরের ১৩ মাইল পশ্চিমের তিরুবাদিতে পরাজিত হয়ে শের খান লোদি তার পুরো ভূখণ্ড তুলে দিতে বাধ্য হলো মারাঠিদের হাতে।

১৬৭৭ আর ১৬৭৮ সালে কর্ণাটকের যেসব ভূখণ্ড সংযুক্ত করল শিবাজী, সেগুলোতে ছিল একশোটা দুর্গ, আর সেখান থেকে আদায় হবে বার্ষিক ২০ লাখ হুন।

১৬৭৭ সালের নভেম্বরের প্রথমে কর্ণাটক সমভূমি ত্যাগ করে মহীশূর মালভূমিতে প্রবেশ করল শিবাজী, আর দখল করল সেটার পুব আর মধ্য অংশ। তারপর মহীশূর রাজ্যের কেন্দ্রস্থলের শেরা থেকে ধরল সে ফিরতি পথ এবং কোপাল, গদগ, বাঙ্কাপুর, বেলগম জেলার বেলবাদি, আর তুর্গাল হয়ে আপন পানহালা দুর্গে এসে পৌঁছাল ১৬৭৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে।

১১.১১ মোগল, বিজাপুর ও শিবাজী, ১৬৭৮-৭৯

১৬৭৮ সালের মে মাসে মারাঠিরা দ্বিতীয়বার শিবনার দখলের চেষ্টা করল। তিনশো মারাঠি দড়ির মইয়ের সাহায্য উঠল দুর্গের দেয়াল বেয়ে। কিন্তু আবদুল আজিজ খান একজন অভিজ্ঞ কিলাদার; রাতের অন্ধকারে দুর্গে প্রবেশ করা সত্ত্বেও শিবাজীর সমস্ত পদাতিককে হত্যা করল সে, আর শিবাজীকে একটা কাগজে লিখে পাঠাল: ‘যতক্ষণ আমি কিলাদার আছি, এই দুর্গ জয়ের সাধ তোমার কোনো দিনই পূরণ হবে না।’

একটা বিচ্ছেদ হলো শিবাজী আর কুতব শাহের, ফলে ভেঙে খানখান হয়ে গেল মদনা পণ্ডিতের এত যত্নে গড়া কূটনৈতিক মৈত্রী। এটা বুঝতে পেরে কুতব শাহের ক্রোধ এত চরমে পৌঁছাল যে কর্ণাটক অভিযানে সে শিবাজীর দাবার খুঁটি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সে বহন করেছে অভিযানের সমস্ত খরচ, পাশাপাশি দিয়েছে সহায়ক একটা সেনাদল আর গোলন্দাজ বাহিনী, অথচ তাকে দেওয়া হয়নি একটা দুর্গ কিংবা শিবাজীর সীমাহীন লুটের অংশ। তাই শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার লক্ষ্যে আবুল হাসান হাত বাড়াল বিজাপুরী অন্তর্বর্তীকালীন শাসক সিদ্দি মাসাউদের দিকে। কিন্তু বিজাপুরে আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিল দিলির খান।

শিবাজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শম্ভুজী ছিল তার বৃদ্ধ বয়সের অভিশাপ। একুশ বছরের এই যুবক যেমন হিংস্র, খেয়ালি, হঠকারী, তেমনই ভীষণ রকম লম্পট । তাকে পার্লিতে পাঠানো হলো সাধক রামদাসের কাছে, কিন্তু সে তার স্ত্রী যেসু বাইকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিল দিলির খানের সঙ্গে (১৩ ডিসেম্বর, ১৬৭৮)। খান তার মূল্যবান মিত্রসহ গিয়ে থামল বাহাদুরগড়ের ৫০ মাইল দক্ষিণের আকলুজে, বিজাপুর আক্রমণের আগে কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।

বিপদ দেখে সিদ্দি মাসাউদ সহায়তা চাইল শিবাজীর কাছে। রাজা পাঠিয়ে দিল ছয়-সাত হাজার অশ্বারোহীর একটা দল। মাসাউদ অবশ্য শিবাজীকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না। আর তার দল সত্যিই লুটতরাজ শুরু করল আদিল শাহি ভূখণ্ডে। ফলে মাসাউদ এবার সন্ধি করল দিলির খানের সঙ্গে। একটা মোগল বাহিনীকে সসম্মানে নিয়ে যাওয়া হলো বিজাপুরে।

১৬৭৯ সালের ২ এপ্রিল সকাল নয়টায় দিলির খান আক্রমণ চালাল শিবাজীর ভূপালগড় দুর্গে। উভয় পক্ষেই প্রচুর হতাহত হওয়ার পর দুর্গের পতন হলো দুপুরবেলা। দুর্গের জীবিত সাতশো সেনার প্রত্যেকের একটা করে হাত কেটে নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হলো; অন্য বন্দীদের বিক্রি করে দেওয়া হলো ক্রীতদাস হিসেবে।

১১.১২ শিবাজীর শেষ অভিযান

১৬৭৯ সালের ৪ ডিসেম্বর দিলির খানের কাছ থেকে পালিয়ে শম্ভুজী ফিরল পানহালায়। ৪ নভেম্বর ১৮,০০০ অশ্বারোহী সেনাকে দুভাগ করে শিবাজী আর আনন্দ রাও বেরিয়ে পড়ল বিজাপুরের ৫৫ মাইল পশ্চিমের সেলগুড় থেকে। পথিমধ্যে মোগল দাক্ষিণাত্যের প্রত্যেকটা জেলায় লুটতরাজ চালাল তারা আর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিল। মাসের মাঝামাঝি লুট করল তারা আওরঙ্গাবাদের ৪০ মাইল পুবের বাণিজ্যিক শহর জালনা। এখানকার শহরতলিতে বাস করে মুসলমান সাধু সাঈদ জান মুহম্মদ। বেশির ভাগ ধনী মানুষ তাদের টাকা আর সোদানাসহ আশ্রয় নিল সাধুর আশ্রমে। আক্রমণকারীরা গিয়ে উপস্থিত হলো সেখানে। পবিত্র মানুষটি তাদের লুটতরাজ করতে নিষেধ করল। তারা নিষেধ তো মানলই না, বরং সাধুঁকে হুমকি দিল। তখন সাধু অভিশাপ দিল শিবাজীকে। ওখানকার জনসাধারণ বিশ্বাস করে, পাঁচ মাস পর রাজার মৃত্যু হয়েছিল ওই অভিশাপের ফলেই।

চার দিন জালনায় লুটপাট চালানোর পর ফেরার পথে মোগল অফিসার রণমস্ত খানের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা গেল সিধোজী নিম্বলকর এবং অনেক মারাঠি । তারপর কেশরী সিং আর সর্দার খানের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে হারাল তারা ৪,০০০ অশ্বারোহী আর অনেক লুটের মাল । সর্বনাশা এক অভিযান সেরে শিবাজী পাট্টাগড় ফিরল ২২ নভেম্বরের দিকে।

শিবাজী অত্যন্ত অশাস্তি ভোগ করেছে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শম্ভুজীকে নিয়ে। সে বুঝতে পেরেছিল যে এ রকম খেয়ালি, নিষ্ঠুর, দেশাত্মবোধহীন লম্পট যুবক মহারাষ্ট্রের প্রভু হতে পারে না। ফলে শিবাজীর শেষ দিনগুলো কেটেছে হতাশায়।

১৬৮০ সালের ২৩ মার্চ রাজা আক্রান্ত হলো জ্বর আর রক্ত আমাশয়ে। বারো দিন চলল এই অসুস্থতা, অবশেষে মারাঠা জাতির স্রষ্টা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ৪

এপ্রিল রোববার দুপুরে। তখন তার বয়স ৫৩ বছর পূর্ণ হয়নি।

১১.১৩ শিবাজীর রাজ্য, সেনাবাহিনী ও রাজস্ব

শিবাজীর রাজ্য ছিল উত্তরের রামনগর থেকে দক্ষিণের কারওয়ার পর্যন্ত। ওটার পুব সীমানা গেছে বাগলানা স্পর্শ করে তারপর দক্ষিণে ঘুরে নাসিক আর পুনা জেলার মাঝ দিয়ে পুরো সাতারা জেলা আর কোলাপুরের বেশির ভাগ ঘিরে।

শিবাজীর সর্বশেষ সংযুক্তি হলো কোপালের উল্টো পাশের তুঙ্গভদ্রা থেকে ভেলোর আর জিনজি পর্যন্ত।

শিবাজী তার রাজ্যসীমার বাইরের অঞ্চলগুলো থেকে ভয় দেখিয়ে আদায় করত চৌথ, অর্থাৎ প্রচলিত রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ। চৌথ দিলে সেই অঞ্চলে মারাঠিদের লুটপাটের আশঙ্কা আর থাকত না, তবে চৌথের বিনিময়ে সেই অঞ্চলের বিদেশি আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে শিবাজী বাধ্য ছিল না। সভাসদদের হিসেব অনুসারে শিবাজীর রাজস্বের পরিমাণ ছিল এক কোটি হুন, আর চৌথ পুরোপুরি আদায় হলে আসত অতিরিক্ত ৮০ লাখ।

‘শিবাজীর সেনাবাহিনী টাকাপয়সা এবং অন্যান্য সম্পদ আনত বিদেশি রাজ্য থেকে। নিজস্ব ভূখণ্ডে সেনাদের বর্ষাকালে (জুন-সেপ্টেম্বর) ফিরে আসতে হতো সেনানিবাসে। দশহরার দিনে সেনারা আবার ছুটত শিবাজীর মনোনীত দেশ অভিমুখে। কোনো মহিলা, ক্রীতদাসী কিংবা নর্তকীর সেনাবাহিনীর সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। কোনো সেনা এদের কাউকে সঙ্গে রাখলে তার গর্দান নেওয়া হতো। বন্দী করা যেত শুধুই পুরুষকে, কোনো নারী বা শিশুকে নয়। কোনো ব্রাহ্মণকে অত্যাচার করা বা তাকে মুক্তিপণের জামিন হিসেবে নেওয়া যেত না। বাড়ি ফেরার পর প্রত্যেক সেনাকে তার নিজ নিজ লুটের মাল তুলে দিতে হতো রাষ্ট্রের হাতে।’

১১.১৪ শিবাজীর কেন্দ্রীয় প্রশাসন

শিবাজী পরিচালিত হতো আটজন মন্ত্রীবিশিষ্ট একটা সভার (অষ্ট প্রধান) পরামর্শ আর সহযোগিতায়, যাদের মধ্যে ছিল: (১) পেশওয়া বা মুখ্য প্রধান, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, (২) মজুমদার (সংস্কৃত পদবিতে অমাত্য) বা মহাহিসাবরক্ষক, (৩) ওয়াকিয়ানবিস (সংস্কৃতে মন্ত্রী) যে রাজার প্রতিদিনের কার্যকলাপ আর দরবারের ঘটনাবলির একটা রেকর্ড রাখে, (৪) সুর্নিশ (সংস্কৃতে সচিব) বা চিঠিপত্রের তত্ত্বাবধায়ক, (৫) দবির (সংস্কৃতে সুমন্ত) বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর গুপ্তচর বিভাগের প্রধান, (৬) সর-ই-নওবত (সংস্কৃতে সেনাপতি) বা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, (৭) পণ্ডিত রাও (পারসিতে যুগ্মভাবে সদর এবং মুহতাসিব), যার দায়িত্ব ধর্মীয় । এবং জাতসংক্রান্ত বিতর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়া, ধর্মমতবিরোধী কিছু বলা এবং অধার্মিকতার শাস্তিবিধান করা, আর রাজকীয় ভিক্ষা তহবিল থেকে বিদ্বান ব্রাহ্মণদের পুরস্কার দেওয়া এবং (৮) ন্যায়াধিস বা প্রধান বিচারপতি। এই মন্ত্রীদের মধ্যে কেবল সেনাপতি ছাড়া আর সবাই হতো ব্রাহ্মণ, আর প্রথম ছয় মন্ত্রীর যে কাউকে প্রয়োজনে গ্রহণ করতে হতো সেনাপতির দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয় যেকোনো যোগাযোগের আসল কাজটা পরিচালনা করত প্রভুদের (কায়স্থ) কেউ, যাদের প্রায় সবাই খুব ভালো ফারসি জানত। সেনাদের বেতনসংক্রান্ত হিসাব রাখত সবনিস (পারসিতে বখশি) নামক একশ্রেণীর অফিসার।

তবে এই আট মন্ত্রীর সভাকে কোনোভাবেই একটা পরিষদ বলা যাবে না। তাদের ছিল না রাজাকে কোনো পদ্ধতির ব্যাপারে নির্দেশ কিংবা পদত্যাগের হুমকি দেওয়ার ক্ষমতা। তাদের কাজ ছিল কেবল রাজাকে পরামর্শ দেওয়া, অবশ্য রাজা পরামর্শ গ্রহণ করার মতো মেজাজে থাকলে। অন্য সময়ে তাদের কাজ ছিল কেবল সাধারণ নির্দেশাবলি পালন এবং নিজ নিজ বিভাগের পুঙ্খানুপুঙ্খ তত্ত্বাবধান করা । অন্য সাত প্রধানের চেয়ে পেশওয়া বেশি সম্মানিত হলেও তারা কোনোভাবেই তার নিমপদস্থ ছিল না। ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদের সংহতি ক্ষমতার অভাব ছিল মারাঠি আট প্রধানের সভায়। আর প্রশাসনের সমস্ত সুতোই শিবাজী রাখত তার আপন হাতের মুঠোয়, ঠিক চতুর্দশ লুই কিংবা ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটের মতো।

১১.১৫ শিবাজীর চরিত্র এবং ইতিহাসে তার স্থান

শিবাজী যে উপায় অবলম্বন করেছিল, সেটার নৈতিক বৈশিষ্ট্য যেমনই হোক না কেন, তার সাফল্য ছিল চোখধাঁধানো বাস্তব। জায়গিরদারের এই পুত্র নিজেকে প্রমাণ করেছিল মোগল সাম্রাজ্যের একজন অদম্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। দাক্ষিণাত্যে তাঁর সমস্ত বিখ্যাত সেনাপতি ব্যর্থ হওয়ার পর আওরঙ্গজেব হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন এই ভেবে যে কীভাবে তিনি শিবাজীকে দমন করবেন।

নতুনভাবে অত্যাচারিত হওয়ার সেই যুগে হিন্দুদের জগতে তার আবির্ভাব ঘটেছিল নতুন আশার এক তারা হয়ে, তাদের ধর্মের রক্ষাকারী হিসেবে।

ব্যক্তিগত জীবনে শিবাজী ছিল অত্যন্ত নৈতিক। সে ছিল একজন নিবেদিত পুত্র, একজন হেময় পিতা, আর একজন মনোযোগী স্বামী। শৈশব থেকেই ধর্মানুরাগী হওয়ায় সারা জীবনই সে ছিল সংযমী, লালসামুক্ত, আর পবিত্র মানুষদের প্রতি সশ্রদ্ধ । মুসলমান ও হিন্দু সাধুদের প্রতি নিরপেক্ষ শ্রদ্ধা আর যেকোনো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সহনশীলতা তার মানসিক উদারতার পরিচয় বহন করে। নারীদের প্রতি তার বিনয় এবং তাদের রক্ষার লক্ষ্যে নৈতিকতার কড়া অনুশাসন জারি সেই যুগে এতটাই অকল্পনীয় ছিল যে খাফি খানের মতো কঠোর সমালোচকও তার প্রশংসা না করে পারেননি।

সে ছিল জন্মগতভাবে নেতা, ফলে কর্মচারীদের সেরা সেবাটা সে নিংড়ে নিতে পারত অনায়াসে, আর তার সদাহাস্যমুখ সেনাদের কাছে তাকে পরিণত করেছিল আদর্শে। তার সাফল্যের প্রধান কারণ ছিল মানুষের চরিত্র বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা। সেনাপতি, রাজ্যপাল, কূটনীতিক নির্বাচনে সে কখনোই ভুল করেনি। তার সেনা সংগঠন ছিল দক্ষতার এক উদাহরণ; সবকিছুই সরবরাহ করা হতো আগে, আর যথাস্থানে রাখা হতো উপযুক্ত তত্ত্বাবধানে; অভিযানের আগেই সুযোগ্য গুপ্তচরেরা উপস্থিত করত নিখুঁত আর পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য; তার হালকা অশ্বারোহী বাহিনী আর দ্রুতগামী পদাতিক সেনারা ছিল আওরঙ্গজেবের যুগে অদম্য ।

ধারণার মৌলিকত্ব বা রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপ্তির চেয়ে শিবাজীর আসল মহত্ত্ব নিহিত ছিল তার চরিত্র আর বাস্তব সামর্থ্যে। তার জীবনের অবিনশ্বর অর্জন হলো বিক্ষিপ্ত মারাঠিদের একটা জাতিতে পরিণত করা, আর তাদের ভেতরে নিজের তেজ সঞ্চারিত করা। এবং তার এই অর্জন ছিল বৃহৎ চারটে শক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে-মোগল সাম্রাজ্য, বিজাপুর, পর্তুগিজ ভারত, আর জানজিরার আবিসিনীয়।

আধুনিক যুগের আর কোনো হিন্দুই তার মতো গঠনমূলক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি। উদাহরণের মাধ্যমে সে প্রমাণ করেছে যে হিন্দুরাও একটা জাতি নির্মাণ করতে পারে, একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে, পরাজিত করতে পারে শত্রুদের; তারা গড়ে তুলতে পারে তাদের আপন প্রতিরোধ; রক্ষা এবং উন্নত করতে পারে তারা সাহিত্য আর সংস্কৃতি, বাণিজ্য আর শিল্প; রক্ষণাবেক্ষণে সক্ষম তারা নিজস্ব নৌবাহিনী আর সাগরগামী বাণিজ্যবহর; এমনকি নৌযুদ্ধে সক্ষম তারা বিদেশিদের সমদক্ষতায় । শিবাজীই আধুনিক হিন্দুদের শিখিয়েছে তাদের মাথা সম্পূর্ণ উঁচু করে দাঁড়াতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *