১৪. শম্ভুজীর শাসনকাল, ১৬৮০-৮৯
১৪.১ বিতর্কিত উত্তরাধিকার: শম্ভুজীর রাজা হওয়া
শিবাজীর মৃত্যুতে নতুন সৃষ্ট মারাঠা রাজ্যের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে উঠল। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র স্বেচ্ছাচারী শম্ভুজীর ওপর প্রজাদের আস্থা নেই, ইতিমধ্যে শত্রুদের সঙ্গে তার একবার যোগদান তাকে আরও অবিশ্বাসী করে তুলেছে। তাই, শিবাজীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর অন্নজী দত্তোর নেতৃত্বে এবং অন্যান্য মন্ত্রীর উপস্থিতিতে রাইগড়ে শিবাজীর কনিষ্ঠ পুত্র দশ বছরের রাজারাম নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করল ।
উত্তরাধিকারের এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া কার্যকর করার সময় জনসাধারণের সঙ্গে কোনো রকম পরামর্শ না করার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা একটু গুঞ্জন তুলল।
রাজারামের এই সিংহাসনারোহণ মারাঠিদের মধ্যে বিভক্তির ইঙ্গিত দিল। প্রভুর পরিবর্তনে সেনাবাহিনী শিবাজীর লুটের কোনো ভাগ না পাওয়ায় শম্ভুজীর সঙ্গে চক্রান্তে যোগ দেওয়ায় আগ্রহী হয়ে উঠল। ফলে তারা দলে দলে গিয়ে প্রতিদিন শম্ভুজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লাগল পানহালা দুর্গে।
রাজারামের সিংহাসনারোহণের (২১ এপ্রিল) কয়েক দিন পরই পেশওয়াকে নিয়ে অন্নজী পানহালার উদ্দেশে রওনা দিল শম্ভুজীকে বন্দী করার জন্য। কিন্তু ইতিমধ্যে শম্ভুজীর প্রভাবের সংবাদ পেয়ে আক্রমণের ব্যাপারে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল । মে মাসের শেষে প্রধান সেনাপতি হাম্বির রাও মোহিতে অন্নজী আর মোয়রা পস্তকে বন্দী করে নিয়ে গেল পানহালা দুর্গে। সেখানে সব সেনাপতি একত্র হয়ে শম্ভুজীকে মেনে নিল রাজা হিসেবে।
হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে অনুজীকে নিক্ষেপ করা হলো কারাগারে, ওদিকে পেশওয়া যথার্থ সময়ে শম্ভুজীর গুণ গেয়ে রক্ষা করল নিজেকে। ২০,০০০ সেনা নিয়ে নতুন রাজা রওনা দিল রাইগড় অভিমুখে। রাজধানী তার সব দরজা উন্মুক্ত করে দিল শম্ভুজীর জন্য (১৮ জুন)। রাজারাম কোনো প্রতিরোধ করল না, কারণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাই ছিল না তার।
যেহেতু রাজারাম ছিল স্রেফ চক্রান্তকারীদের হাতের পুতুল, তার সঙ্গে করা হলো সহানুভূতিশীল আচরণ।
শম্ভুজী সিংহাসনে বসল ২০ জুলাই। জাঁকজমকের সঙ্গে তার অভিষেক হলো ১৬৮১ সালের ১৬ জানুয়ারি। ১৬৮২ সালের ১৮ মে একটা পুত্র জন্ম নিল তার; নাম তার ২য় শিবাজী হলেও রাজা শাহু হিসেবেই সে সমধিক পরিচিত। ১৪.২ মোগলদের সঙ্গে শম্ভুজীর আবার যুদ্ধ। নতুন রাজা বিদেশি আক্রমণের হাত থেকে একটা লম্বা বিরাম পেল। মোগল সাম্রাজ্যের সমস্ত সামরিক শক্তি তখন তাদের মনোযোগ দিয়েছিল রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দিকে। অক্টোবরের শেষে দশহরার পর যথারীতি বেরিয়ে পড়ল। মারাঠা বাহিনী। অশ্বারোহী আর পদাতিক সেনার একটা ডিভিশন সুরাটের দিকে এগোনোর পরিকল্পনা করল, আরেকটা ডিভিশন বুরহানপুরের দিকে। এই সংবাদ পেয়ে মোগল সেনাপতি বাহাদুর খান (সম্প্রতি খান-ই-জাহান উপাধিতে ভূষিত) আওরঙ্গাবাদ থেকে শিবির তুলে এসে পৌঁছাল খান্দেশে (২৫ নভেম্বরের দিকে)। সাময়িকভাবে পিছিয়ে এল মারাঠিরা।
পরবর্তী বছর (১৬৮১) জানুয়ারির শেষাশেষি ফিরে এল আক্রমণকারীরা, স্পষ্টতই শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহের সংবাদে উজ্জীবিত হয়ে। হাম্বির রাওয়ের নেতৃত্বে একটা বাহিনী ধ্বংস করল ধরনগাঁ আর উত্তর খান্দেশের অন্যান্য জেলা, তারপর অনেকটা পুবে এগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বুরহানপুরের উপকণ্ঠের বাহাদুরপুরার ওপর (৩০ জানুয়ারি)। এভাবে লুট করা হলো আরও সতেরোটা পুরা। অতর্কিত আক্রমণের ফলে কেউই কিছু লুকানোর সময় পায়নি, তাই প্রত্যেক ওয়ার্ড বা পুরাতেই পাওয়া গেল লাখ লাখ টাকা। পারিবারিক সম্ভ্রম রক্ষা করার খাতিরে অনেক সম্মানিত মানুষ হত্যা করল তাদের স্ত্রী আর কন্যাকে, তারপর নিজেরাও প্রাণ দিল রাহাজানদের সঙ্গে দুঃসাহসিক লড়াইয়ে।
তিন দিন ধরে আশ মিটিয়ে লুটপাট চালাল মারাঠিরা, প্রত্যেকটা বাড়ির মেঝে খুঁজে তুলে আনল গুপ্তধন। আসতে অনেক দেরি করে ফেলল খান-ই জাহান, ফলে লুটের মাল নিয়ে সহজেই ভেগে যেতে পারল আক্রমণকারীরা। দাক্ষিণাত্যের জনপ্রিয় ব্যক্তিরা মোগল সুবাদারকে অভিযুক্ত করল যে সে শঙ্কুজীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছে। বুরহানপুরের নাগরিকদের তরফ থেকে এই মর্মে নালিশ গেল সম্রাটের কাছে, মুসলমানেরা হুমকি দিল যে ভবিষ্যতে তাদের জীবন আর ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে তারা আর শুক্রবারের নামাজ পড়তে যাবে না।
শহরের ২৬ মাইল মতো পশ্চিমের বাবুলগাঁয়ে খান-ই-জাহান জানতে পারল যে মারাঠিদের আরেকটা বাহিনী দক্ষিণ থেকে আহমদনগর আর মুঙ্গি-পৈথন হয়ে আসছে আওরঙ্গাবাদ লুট করতে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ায় উঠে তার অশ্বারোহী বাহিনী ছোটাল সে রাত তিনটেয়, আর দুপুরে গিয়ে পৌঁছাল শহরে। তখন শহরজুড়ে বিরাজ করছে তীব্র আতঙ্ক। সমস্ত বাড়ির দরজা বন্ধ, ভেতরে পুরুষেরা অস্ত্র হাতে কাঁপছে আর মেয়েরা কাঁদছে। খান উপস্থিত হতেই লড়াই না করে পালিয়ে গেল শক্ররা।
১৬৮১ সালের অক্টোবরে দশহরার পর যথারীতি বেরিয়ে পড়েছিল মারাঠিদের হালকা অশ্বারোহী বাহিনী। আসলে আক্রমণ করতে চেয়েছিল তারা আহমদনগর, দিলির খানের হাতে বন্দী দুই মারাঠি রাজকুমারীকে (শম্ভুজীর এক স্ত্রী আর এক বোন) উদ্ধার করতে! লুকিয়ে দুর্গে প্রবেশ করা কয়েকজন মারাঠি সেনার ছদ্মবেশ ফাঁস হয়ে পড়ায় তাদের হত্যা করেছিল কিলাদার, অন্যদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল একটা লড়াইয়ে পর (অক্টোবরের শেষাশেষি)।
১৪.৩ শম্ভুজীর আশ্রয়প্রার্থী শাহজাদা আকবর, ১৬৮১
আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহী পুত্র, শাহজাদা মুহম্মদ আকবর, বিশ্বস্ত দুর্গাদাস রাঠোরের সঙ্গে নর্মদা পেরিয়ে (৯ মে) প্রবেশ করলেন মহারাষ্ট্রে। মোগল সীমান্ত পার হতেই তাঁকে স্বাগতম জানাল শম্ভুজীর বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আর সসম্মানে নিয়ে গেল পালিতে (১ জুন)
শাহজাদার সঙ্গে ছিল ৪০০ অশ্বারোহী, ছোট একটা পদাতিক বাহিনী, আর ৫০টা মালবাহী উট।
শোনা যায়, তাঁর দেহরক্ষী হিসেবে নাকি দেওয়া হয়েছিল তিনশো মারাঠি পদাতিক।
১৪.৪ শম্ভুজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র; তার আস্থাভাজন কবি-কলস
রাইগড় লাভ করার পর (১৮ জুন, ১৬৮০) শম্ভুজী তার প্রধান শত্রুদেরসহ তাদের নেতা অন্নজী দত্তো আর নীলকান্ত মোরেশ্বর পিঙ্গলকে (পেশওয়া মোরেশ্বর ত্রিম্বকের পুত্র) কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল । মোরেশ্বর মারা যাওয়ার পর শম্ভুজী তার পুত্র নীলকান্তকে মুক্ত করে বসাল প্রধানমন্ত্রীর শূন্য পদে। সবচেয়ে বড় শত্রু অনুজী দত্তোকেও মুক্ত করে তাকে নিয়োগ দিল সে মহাহিসাবরক্ষক (মজমুয়াদার) হিসেবে।
কিন্তু ১৬৮১ সালের আগস্টে সয়রা বাই আর হীরাজী ফরজন্দের সঙ্গে শম্ভুজীকে হত্যা করে রাজারামকে আবার সিংহাসনে বসানোর একটা ষড়যন্ত্র করল অন্নজী দত্তো। তারা চেয়েছিল শম্ভুজীর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিতে।
কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেল। ফলে অন্নজী দত্তো, তার ভাই সোমাজী, হীরাজী ফরজন্দ, বালাজী অবজী প্রভু, মহাদেব অনন্ত এবং আরও তিনজনকে হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারল শম্ভুজী। পরে আরও বিশজন অপরাধীকেও দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। রাজারামের মা, সয়রা বাইয়ের ভাগ্যেও নেমে এল যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
শম্ভুজীর চরিত্র আর আচরণ রাজ্যের পুরনো কর্মচারীদের কাছে তাকে শিবাজীর মতো শ্রদ্ধেয় করে তোলার পক্ষে ছিল অসম্ভব । পক্ষান্তরে এ কথা শম্ভুজী কখনোই ভুলতে পারল না যে রাজ্যের সমস্ত উল্লেখযোগ্য মন্ত্রী আর সেনাপতি তাকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল। সে অনুভব করল, নিজের দেশেই সে একদম একা।
এ রকম সময়ে সে পেল নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মচারী। কনৌজের এই ব্রাহ্মণ ছিল ভোঁসলে বংশের পুরোহিত। রাজার মন দখল করে সে উপাধি পেল কবি কলস’- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কবি। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল যে প্রশাসন চলে গেছে। তার হাতের মুঠোয়, আর অলস শম্ভুজী মেতে উঠেছে মদ আর মেয়ে নিয়ে।
ওদিকে দূরের এক গ্রামে শাহজাদা আকবর বাস করতে লাগলেন সম্রাটের মতোই সাড়ম্বরে। ভাড়াটে অশ্বারোহী সেনারা এসে যোগ দিতে লাগল তার সঙ্গে, আর আগস্টের মধ্যে তাদের সংখ্যা হলো ২,০০০। কিন্তু মোগল সাম্রাজ্য আক্রমণের সুযোগ আকবরের আর ছিল না। কারণ, মহারানা শান্তি চুক্তি করায় জুনে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে রাজপুতদের বিবাদ শেষ হয়ে গেছে। মোগল সেনারা এখন আবার আকবরকে দমন করার জন্য মুক্ত। ১৩ নভেম্বর সম্রাট স্বয়ং এসে পৌঁছালেন বুরহানপুরে।
১৪.৫ আওরঙ্গজেবের কৌশলগত বিন্যাস, ১৬৮২
১৬৮২ সালের পুরো জানুয়ারি মাস শম্ভুজী ব্যস্ত রইল জানজিরা আক্রমণ নিয়ে। ফলে সুযোগ পেয়ে গেলেন আওরঙ্গজেব। জুন্নার থেকে সাঈদ হাসান আলী খান ১৪,০০০ অশ্বারোহী সেনাসহ রওনা দিয়ে পথিমধ্যে সমস্ত মারাঠি গ্রাম জ্বালাতে জ্বালাতে উত্তর কঙ্কানে এসে দখল করে নিল কালিয়ান (৩০ জানুয়ারি, ১৬৮২)। পরবর্তী বছর মে মাসে প্রদেশ থেকে সরে গেল সে, পশ্চিম উপকূলের প্রবল বৃষ্টিপাতের কবল থেকে তার ঘোড়াগুলোকে রক্ষা করতে ।
১৬৮২ সালের ২২ মার্চ আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদে এসে আজম শাহ আর দিলির খানকে পাঠালেন দক্ষিণের আহমদনগরে এবং শিহাব উদ-দীন-খান আর দলপত রাওকে পশ্চিম সীমান্তের নাসিকে। শিহাব এই অঞ্চলের ছোট ছোট কয়েকটা দুর্গ দখল করার পর (এপ্রিলে) অবরোধ করল নাসিকের ৭ মাইল উত্তরের রামসেজ। কিন্তু মারাঠিদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে মোগলেরা এখানে মোটেই সুবিধা করতে পারল না। অবরোধ জোরদার করার জন্য সম্রাট পাঠালেন খান-ই-জাহানকে। কিন্তু বিখ্যাত এই সেনাপতিও এখানে দেখতে পেল না সাফল্যের কোনো মুখ; বরং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো তার দুটো ব্যর্থ আক্রমণে।
ফুঁসে উঠল আওরঙ্গজেবের তেজ। শম্ভুজীর বিপক্ষে আরও ব্যাপক আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করলেন তিনি। মাথার পাগড়ি ফেলে দিয়ে সম্রাট শপথ করলেন যে শম্ভুজীকে হত্যা, বন্দী বা এই দেশ থেকে না তাড়ানো পর্যন্ত তিনি আর পাগড়ি পরবেন না’ (৩০ জুলাই, ১৬৮২)। প্রথমে রুহুল্লাহ খান (২৩ মে) আর পরে মুইজ-উদ-দীনকে (২৮ সেপ্টেম্বর) পাঠালেন তিনি আহমদনগর জেলা রক্ষা করতে, ওদিকে শাহজাদা আজমকে পাঠানো হলো বিজাপুরে (১৪ জুন), যেন সেখানে মারাঠি কোনো বাহিনী আশ্রয় নিতে না পারে। নাসিক থেকে শিহাব-উদ-দীন খানকে বদলি করা হলো জুন্নারে (জুন), আর খান-ই-জাহানের সুদক্ষ সহকারী সেনাপতি রণমস্ত খানকে দেওয়া হলো (সেপ্টেম্বর) কঙ্কান আক্রমণের আদেশ।
আরও কয়েক মাস রামসেজ অবরোধ করে থাকার পর আরেকটা ব্যর্থ আক্রমণ চালিয়ে অবরোধ তুলে নিল (অক্টোবর, ১৬৮২) খান-ই-জাহান।
কঙ্কানে এসে কালিয়ান দখল করল রণমস্ত খান ১৬৮২ সালের নভেম্বরের শেষাশেষি । রূপাজী ভোঁসলে আর পেশওয়া তার বিপক্ষে কিছুই করতে পারল না।
খান-ই-জাহান আওরঙ্গাবাদের ২৫ মাইল দক্ষিণের গোদাবরীর তীরের রামদুতে শাহজাদার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়ে এগোতে লাগল পুবের নান্দার অভিমুখে। তারপর তার বাহিনী গেল ৮৬ মাইল সোজা দক্ষিণের বিদারে । তারপর লম্বা এক লড়াই করতে করতে আক্রমণকারীদের ধাওয়া করে সে গেল চান্দা আর গোলকুপ্তার সীমান্তে। তার এই বীরত্ব ছিল বিরাট কৃতিত্বের দাবিদার। এই অভিযানে তার সেনাদের সহ্য করতে হয়েছিল প্রচণ্ড কষ্ট।
১৬৮২ সালের জুনে আহমদনগর ছেড়ে শাহজাদা আজম গেলেন আদিল শাহের রাজ্যে আক্রমণ চালাতে। এই অভিযানের পথে তিনি দখল করলেন ধরুর। তারপর স্ত্রী জাহানজেব বানুকে (জানি বেগম নামে সুপরিচিত) শিবিরে রাও অনুরুধ সিংহ হাদা আর তার রাজপুতদের দায়িত্বে রেখে সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি গিয়ে ঢুকলেন শর দেশে। মারাঠিরা একটা বাহিনী পাঠিয়ে আজমকে ব্যস্ত রেখে আরেক বাহিনী নিয়ে এগোল বেগমের শিবির আক্রমণ করতে। দারা শুকোর বীরা কন্যা হাতির আবৃত হাওদায় উঠে ২ মাইল এগোলেন শত্রুর মুখোমুখি হতে।
অনুরুধ সিংহকে হাতির কাছে ডেকে তিনি বললেন, আমার সম্মান রাজপুতদের কাছে আপন সম্মানের মতো। আমি তোমাকে পুত্র বলে ডেকেছি। ছোট এই সেনাবাহিনী নিয়ে আল্লাহ আমাদের জয়ী করেন, ভালো। তা ছাড়া আমাকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না; বসে পড়ব আমি আমার কাজ সেরে [অর্থাৎ, বন্দিত্ব এড়ানোর জন্য আত্মহত্যা]। তারপর শুরু হলো ভয়াবহ এক লড়াই। অনুরুধ সিংহের পক্ষে মারা গেল নয়শো রাজপুত, আর অনেক মারাঠি। অবশেষে অনুরুধ সিংহ জয়লাভ করল আহত হওয়া সত্ত্বেও। নীরার তীরে কয়েকটা মাস থাকার পর আজমকে ডেকে নেওয়া হলো দরবারে ১৬৮৩ সালের জুনে।
১৪.৬ মোগল প্রচেষ্টার ব্যর্থতা; সম্রাটের সন্দেহপ্রবণতা
১৬৮৩ সালের মার্চে আকবরকে দমনের কাজে নিযুক্ত সমস্ত মোগল সেনাবাহিনীকে ফিরে আসতে বলা হলো। রুহুল্লাহ আর রণমস্ত খান ২৩ মার্চ ফিরতে লাগল কালিয়ান থেকে। রূপাজী ভোঁসলের অধীন একটা মারাঠি বাহিনী মোগল সেনার পশ্চাদ্ভাগে আক্রমণ চালাল কালিয়ানের ৭ মাইল উত্তর-পুবের তিতভালাতে, আর অনেক সেনাকে খতম করে নিয়ে চলে গেল বহু ঘোড়া।
১৬৮১ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে ১৬৮৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই এক বছরের বেশি সময়ে সম্রাট উল্লেখযোগ্য কিছুই করতে পারেননি। আসলে এই সময়টাতে তার মানসিক অবস্থা ছিল বিক্ষিপ্ত পরিবারের কাউকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, এটাও নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে কোথায় গেলে তিনি নিরাপদ। ফলে দৃঢ় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১৬৮৩ সালের ২ অক্টোবর সুরাটের গোমশতা লিখেছে, “সম্রাটের মন কীভাবে পরিবর্তন হবে তা বলা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুলতান আকবরের জন্য তিনি সব সময় অস্বস্তিতে ভুগছেন আর তার মেজাজও হয়ে উঠেছে খিটখিটে । সুলতান আজম আর দিলির খানকে তিনি হীনপদস্থ করেছেন কেবল এই অমূলক সন্দেহে যে তাঁরা শাহজাদা আকবরের প্রতি সহানুভূতিশীল।
১৪.৭ মারাঠা নৌবাহিনী ও সিদ্দিদের সঙ্গে লড়াই, ১৬৮০-৮২
শম্ভুজী আর ইংরেজদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব হতে পারেনি সিদ্দিদের নৌবহরের কারণে। দ্বীপের মজাগা অঞ্চলে আসন গাড়া সিদ্দিরা মাঝেসাঝেই আক্রমণ চালাত বোম্বের পুবের মারাঠি মূল ভূখণ্ডে। শম্ভুজী ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছে বন্দর থেকে সিদ্দিদের তাড়িয়ে দেওয়ার বিনিময়ে, কিন্তু ইংরেজরা তাতে রাজি হয়নি।
১৬৮১ সালের ৭ ডিসেম্বর সিদ্দিরা জ্বালিয়ে দিল পানভেলের দশ মাইল দক্ষিণের আপ্তা শহর। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ শম্ভুজী ২০,০০০ সেনা আর অনেক কামানসহ সুলতান আকবরকে নিয়ে রাইগড় থেকে নেমে এল দান্দায় (১৮ ডিসেম্বর)…আর জানজিরার উল্টো পাশের পাহাড় থেকে দ্বীপটার ওপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করল ৩০ দিন। কিন্তু মোগলরা উত্তর কঙ্কান আক্রমণ আর কালিয়ান দখল করায় সে বাধ্য হলো রাইগড়ে ফিরতে।
১৬৮২ সালের জুলাইয়ে কিছু নৌকা নিয়ে মারাঠিরা আক্রমণ চালাল জানজিরায়, কিন্তু পাথুরে সেই দ্বীপে লাভের বদলে তাদের হলো ভীষণ ক্ষয়ক্ষতি।
১৪.৮ পর্তুগিজদের সঙ্গে শম্ভুজীর লড়াই ১৬৮৩
এবার শম্ভুজীর রাগ গিয়ে পড়ল পর্তুগিজদের ওপর। কারণ, তারা দখল করেছিল কারওয়ারের সোজা দক্ষিণের আনজিদিব নামের এক দ্বীপ, যেখানে শম্ভুজী তার নৌ দপ্তর স্থাপন করতে চেয়েছিল সিদ্দিদের জানজিরা দুর্গ মোকাবিলার উদ্দেশ্যে। ১৬৮২ সালের ডিসেম্বরে গোঁয়ার রাজ্যপাল রণমস্ত খানের অধীন মোগল সেনাবাহিনীর রসদ বহনকারী মোগল জাহাজ বহরকে কালিয়ানের খাঁড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিল পর্তুগিজ দুর্গ-থানার নিচ দিয়ে; মোগল সেনাবাহিনীকে পর্তুগিজ প্রদেশ দমনের ভেতর দিয়েও অবাধে যাওয়ার অনুমতি দিল সে মারাঠিদের উত্তর কঙ্কান জেলায়। এই নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করার ফলেই শম্ভুজী প্রতিশোধ নিতে চাইল পর্তুগিজদের ওপর। আক্রমণ চালাল সে ১৬৮৩ সালের ৫ এপ্রিল। ১০০০ অশ্বারোহী আর ২,০০০ পদাতিক সেনা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে তারাপুরের ওপর আর সেই শহরসহ জ্বালিয়ে দিল দমন থেকে ব্যাসেইন পর্যন্ত অন্যান্য সমস্ত শহর। ৩১ জুলাই ৬,০০০ পদাতিক আর ২,০০০ অশ্বারোহী সেনা নিয়ে তার পেশওয়া অবরোধ করল চউল। ৮ অগাস্ট ভোরে শহরটায় আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলো মারাঠিরা। ২৯ অগাস্ট মাঝরাতে পর্তুগিজ রাজ্যপাল গোঁয়ার ভারতীয়দের বিশাল একটা দল পাঠাল নদী পেরিয়ে সাবান্ত বাদির মূল ভূখণ্ডে গিয়ে, শম্ভুজীর গ্রামগুলো লুট করে জ্বালিয়ে দিতে। মারাঠিদের মুলকগিরি’ পদ্ধতি অনুকরণের এই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। কিন্তু অনেক মাসের অবরোধের পরেও মারাঠিরা চউল দখল করতে পারল না।
আক্রমণের ধারা বদলে দিতে গোয়র রাজ্যপাল ফন্দা অবরোধের পরিকল্পনা করল; ৮০০ শ্বেতাঙ্গ, ৮,০০০ কানারি (গোঁয়ার স্থানীয় অধিবাসী), আর পাঁচটা ভারী কামানসহ ২২ অক্টোবর ফন্দার কাছাকাছি পৌঁছার পরপরই গোলাবর্ষণ করতে লাগল সে দুর্গটার ওপর।
ত্রিশ অক্টোবরে দুর্গ দখল করবে বলে মনস্থির করেছিল তারা। কিন্তু সেই দিনই শম্ভুজীর একটা বাহিনীকে দেখতে পেয়ে হতোদম হয়ে তারা অবরোধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল আর পরদিনই (১ নভেম্বর) পশ্চাদপসরণ শুরু করে এল দারবাতায়।
পর্তুগিজদের দারবাতা থেকে ফেরাটা হলো শোচনীয়। মারাঠি অশ্বারোহীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল গোঁয়ার পদাতিকদের ওপর। মাস্কেট ফেলে পালাল কানারিরা। শেষমেশ প্রায় সব পর্তুগিজেরই হলো এই দশা। পালাতে লাগল তারা তুমুল বিশৃঙ্খলায়…নিহত হলে পর্তুগিজ নাবিকদের প্রায় পুরো একটা কোম্পানি, হতাহতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল দুইশোতে।
১৪.৯ শম্ভুজীর গোয়া আক্রমণ, ১৬৮৩
ফন্দা থেকে ৭,০০০ অশ্বারোহী আর ১৫,০০০ পদাতিক নিয়ে শম্ভুজী এগোল গোয়া শহর অভিমুখে। ১৪ নভেম্বর রাত ১০টায় চল্লিশজন মারাঠি প্রবেশ করল গোঁয়ার দুই মাইল উত্তর-পুবের স্যান্টো এস্তেভাও দ্বীপে। শিগগিরই তাদের সঙ্গে যোগ দিল মূল বাহিনীর চার হাজার জন।
পরদিন সকাল ৭টায় ৪০০ জনসহ স্যান্টো এস্তেভাওয়ে এসে মারাঠি পদাতিকদের ওপর আক্রমণ চালাল রাজ্যপাল। কিন্তু মারা গেল তাদের ১৫০ জনের বেশি–এমন একজনও বাকি ছিল না যে বুলেট, তলোয়ার বা পাথরের আঘাতে জখম হয়নি। রাজ্যপালের বাহু ফুটো করে দিয়েছিল একটা বুলেট… অবশিষ্ট ১২০ জনের মতো, কেউ পালাল নদীর দিকে…কেউ আটকা পড়ল কাদায়, আর কেউ সঁতরে পালাল। যারা কাদায় আটকা পড়ল তাদের সবাই মারা গেল । কিন্তু পরদিন (১৬ নভেম্বর) মারাঠিরা দ্বীপ ত্যাগ করল তাড়াহুড়ো করে।
১ ডিসেম্বর এক হাজার মারাঠি অশ্বারোহী আর ৩,০০০ পদাতিক প্রবেশ করল গোঁয়ার যথাক্রমে দক্ষিণ আর উত্তরের স্যালসেটি আর বার্দেশ জেলায়। চালাল তারা লুটপাট, বন্দী করল পুরুষদের আর নারীদের ধর্ষণ করল। এক মাস। পর উদ্ধারকারী হিসেবে গোয়ায় এলেন শাহ আলম, ১৬৮৪ সালের ৫ জানুয়ারি দখল করলেন তিনি শম্ভুজীর গুরুত্বপূর্ণ শহর বিকোলিম, আর তিন দিন পর গোয়া বন্দরে এসে ভিড়ল অত্যন্ত শক্তিশালী একটা মোগল নৌবহর। শাহজাদার আসার সংবাদ পেয়ে শম্ভুজী পালাল (২৩ ডিসেম্বর) রাইগড়ে, কবি-কলস আর আকবরের ওপর পর্তুগিজদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের ভার দিয়ে।
লড়াইয়ের উত্তর রঙ্গমঞ্চে, অর্থাৎ, দমন জেলায় পর্তুগিজরা ভীষণ মার খেয়েছে। তাদের অনেক শহর জ্বালিয়ে দিয়েছে মারাঠিরা; ২২ ডিসেম্বর শম্ভুজী দখল করেছে বোম্বের মাত্র দশ মাইল দক্ষিণ-পুবের দ্বীপ করিনজা। শম্ভুজী তাড়াহুড়ো করে তার উত্তরের রাজধানীতে পালিয়ে যাওয়ার পর, কবি-কলস আর আকবর প্রথম আশ্রয় নিলেন ভীমগড়ের বনে, তারপর ফন্দায়, এবং পর্তুগিজ কূটনীতিক ম্যানুয়েল এস, আলবুকার্কের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করলেন (২০ জানুয়ারির দিকে) পারস্পরিক ক্ষতিপূরণ আর ভবিষ্যতে নিরপেক্ষতা বজায়ের ভিত্তিতে।
কিন্তু শান্তি স্থাপনের এই চুক্তির কোনো মূল্য ছিল না। পর্তুগিজদের সঙ্গে দ্বিতীয় একটা লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিল মারাঠি রাজা। ১৯ সেপ্টেম্বর মারাঠিরা উদ্ধার করল করিনজা দ্বীপ। পর্তুগিজদের সঙ্গে ঢিলেঢালা হিংসাত্মক ঘটনা চলতে থাকল শম্ভুজীর রাজত্বকালের শেষ পর্যন্ত ।
১৪.১০ মারাঠি দরবারে শাহজাদা আকবরের পরিকল্পনা ও হতাশা
সিদ্দি আর পর্তুগিজদের সঙ্গে ছোটখাটো নিষ্ফলা যুদ্ধ করে শক্তি ক্ষয় করতে লাগল শম্ভুজী।
কিন্তু শাহজাদা আকবরের একমাত্র চিন্তা ছিল কীভাবে দখল করা যায় দিল্লির সিংহাসন। তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শভুজীকে দাবার একটা খুঁটি ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবেননি। তবে মহারাষ্ট্রে কেটে চলল একটা করে দিন, আর ক্রমেই বাড়ল শাহজাদার হতাশা । এখানকার দিনগুলো তার পক্ষে ছিল অনভ্যস্ত কষ্টের দিন। তাঁর মনে হতো, মহারাষ্ট্র ত্যাগ করলেই তিনি যেন আবার ফিরে যাবেন সভ্যতার মধ্যে।
কিন্তু আকবরের আকাক্ষার সঙ্গে শম্ভুজীর আকাক্ষার সাদৃশ্য ছিল না। সে ভাবত, দাক্ষিণাত্যের পাহাড় আর জঙ্গলে তার সেনারা যখন নিরাপদে আছে, উত্তর ভারতের খোলা সমভূমিতে পাঠিয়ে তাদের বিপদে ফেলার প্রয়োজনটা কী? তা ছাড়া আকবরের খেপা পরিকল্পনায় সায় দিয়ে হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে গিয়ে সে কেন তার অনুপস্থিতিতে আওরঙ্গজেবকে মহারাষ্ট্র দখলের সুযোগ করে দেবে?
১৮ মাসের অসহনীয় অপেক্ষার পর সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে মহারাষ্ট্র ত্যাগের পরিকল্পনা করলেন শাহজাদা আকবর। রাঠোর সেনাদের নিয়ে পালির আশ্রয় ছেড়ে (ডিসেম্বর, ১৬৮২) তিনি বাস করতে লাগলেন সাবান্তবাদির বান্দায়, জায়গাটা মারাঠা রাজ্যের অন্তর্গত, গোঁয়ার মাত্র পঁচিশ মাইল উত্তরে। এখান থেকেই আকবর তার এক প্রতিনিধি মারফত গোয়র রাজ্যপালকে নিজের রত্নখচিত ছুরি উপহার দিয়ে (জানুয়ারি, ১৬৮৩) সেখানে কিছু রত্ন বিক্রির অনুমতি চাইলেন, সেইসঙ্গে ম্যাঙ্গালোরের পর্তুগিজ শাসককে অনুরোধ করতে বললেন যে সে যেন একটা জাহাজ ভাড়া করে দিয়ে শাহজাদাকে আরবে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু সম্রাটের আদেশে মার্চ আর এপ্রিল মাসে সিদ্দিরা তাদের নৌবহর সাজাল রাজাপুর খাঁড়িতে, যেন আকবর জাহাজ নিয়ে গোয়াতে গেলেও সেখান থেকে আর পালাতে না পারে।
সেপ্টেম্বরে বান্দা থেকে আকবর গেলেন বিকোলিম, শম্ভুজীর ভূখণ্ডেরই আরেক শহরে, গোয়া থেকে যেটার দূরত্ব দশ মাইলেরও কম। শম্ভুজীর ওপর পুরোপুরি বিরক্ত, প্রবঞ্চিত মোগল শাহজাদা, অবশেষে সেখানে কিনলেন একটা জাহাজ (৮ নভেম্বরের দিকে), আর পারস্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠে পড়লেন ভিঙ্গুরলায়, কিন্তু রাজাপুর থেকে তড়িঘড়ি সেখানে এসে উপস্থিত হলো কবি-কলস আর দুর্গাদাস এবং শম্ভুজীর সশস্ত্র সহায়তার নতুন আশার বাণী শুনিয়ে আকবরকে নামিয়ে আনল জাহাজ থেকে। তারপর শুরু হলো লুসসা-মারাঠা যুদ্ধ, যেখানে শাহজাদা পালন করলেন মারাঠিদের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা।
১৬৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এক বছর আকবর থাকলেন রত্নগিরি জেলার শাখারপেন আর মালকাপুরে এবং পুরো সময়টাই কাটল তার ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কবি-কলসকে ডেকে ডেকে।
১৪.১১ শম্ভুজীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; জুলাই, ১৬৮৩ থেকে মোগল কার্যক্রম
১৬৮৩ সালের জুলাই থেকে দাক্ষিণাত্যে সাম্রাজ্যবাদীদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে লাগল। শম্ভুজীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারত ছাড়ার চিন্তাভাবনা করতে লাগলেন শাহজাদা আকবর, ওদিকে পর্তুগিজদের সঙ্গে মারাঠিরা জড়িয়ে পড়ল দীর্ঘ এক লড়াইয়ে। এবং এসব অবস্থার ফলে লাভবান হলো মোগলেরা। শেষ হয়ে গেল সম্রাটের সিদ্ধান্তহীনতা আর সাবধানি তৎপরতাহীনতার দিন, অনেক জায়গাতেই শুরু হলো আক্রমণাত্মক কার্যক্রম।
শভুজীর লাম্পট্য, খামখেয়াল আর উগ্রতা অফিসার আর সামন্তদের অসন্তুষ্ট করে তুলেছিল। আওরঙ্গজেবের ঘুষ অবস্থার আরও অবনতি ঘটাল, প্রায়ই কাজ ফেলে পালাল মারাঠি কর্মচারীরা। ১৬৮৩ সালের ২৬ জুলাই শিবাজির মুনশি-কাজি হায়দার গিয়ে যোগদান করল আওরঙ্গজেবের দলে আর তাকে দেওয়া হলো দুই হাজারি মনসবদারিসহ খান উপাধি এবং পরে (১৭০৬) সে হবে সাম্রাজ্যের প্রধান কাজি।
খেম সাবান্ত (কুদালের শাসক আর শম্ভুজীর একজন সামন্ত) বিদ্রোহ করল তার বিরুদ্ধে আর পর্তুগিজদের বলে বলীয়ান হয়ে জ্বালিয়ে দিল আর লুট করল গোঁয়ার উত্তরের (ফেব্রুয়ারি, ১৬৮৫) মারাঠি রাজধানীর নানা জায়গা। সে, অন্য দুজন বিদ্রোহী, ফন্দার দুলবা নায়ক আর রাম দলভীকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ আসন গাড়ল পর্তুগিজ ভূখণ্ডে এবং বিক্ষুব্ধ করে তুলল দক্ষিণ কঙ্কান আর কানারা । বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে পুরো উপকূলীয় অঞ্চলই অস্ত্র ধারণ করল শম্ভুজীর বিপক্ষে।
মোগল আক্রমণাত্মক ঘটনা শুরু হলো বর্ষার শেষে ১৬৮৩ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। ১৫ সেপ্টেম্বরের কয়েক দিন পর বিরাট এক সেনাবাহিনী নিয়ে সাবান্তবাদি আর দক্ষিণ কঙ্কানে প্রবেশের উদ্দেশ্যে শাহ আলম অগ্রসর হলেন আওরঙ্গাবাদ থেকে; শিহাব-উদ-দীনকে পাঠানো হলো পুনায় (অক্টোবর), সেখান থেকে সে একটা আক্রমণ চালাল (২৭ ডিসেম্বর) নিজামপুরে। ২০ আগস্ট শাহজাদা আজমকে পাঠানো হয়েছিল বিজাপুরী ভূখণ্ডের বিপক্ষে, সেখান থেকে দরবারে ফিরলেন তিনি অক্টোবরে, আর নভেম্বরে নাসিকে গেলেন বাগলানা আর খান্দেশে যাওয়ার উত্তরের পথটা পাহারা দিতে; অক্টোবরে সিদ্দিরা ভিঙ্গুরলা থেকে তাদের নৌবহর সরিয়ে লক্ষ করতে লাগল আকবরের গতিবিধি; সম্রাট স্বয়ং গেলেন (নভেম্বর) আরও দক্ষিণের আহমদনগরে; খান-ই-জাহানের অধীন আরেকটা সেনাবাহিনী বিদার থেকে আকালকোটে অগ্রসর হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখল গোলকুণ্ডা আর বিজাপুরের ওপর, যেন ওই দুটো রাজ্য থেকে মারাঠিরা কোনো রকম সাহায্য না পায় ।
১৪.১২ শাহ আলমের দক্ষিণ কঙ্কান আক্রমণ
আওরঙ্গাবাদ থেকে বিজাপুরী ভূখণ্ডের মাঝ দিয়ে সোজা দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে শাহ আলম দখল করলেন (সেপ্টেম্বর, ১৬৪৩) শাহপুর দুর্গ, শাম্পর্গা আর বড় অন্য কয়েকটা শহর আর প্রচুর লুটের মাল। তারপর সোজা পশ্চিমে ঘুরে তিনি নেমে এলেন সাবান্তবাদির সমভূমিতে।
১৬৮৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিকোলিম পৌঁছে শাহ আলম ধ্বংস করলেন শম্ভুজী আর আকবরের প্রশস্ত বাসভবন আর বাগানবাড়িগুলো। তিন দিন পর বিশাল একটা মোগল নৌবহর শাহজাদার সেনাবাহিনীর জন্য রসদ নিয়ে এসে ভিড়ল গোয়া বন্দরে।
গোয়র কাছে পৌঁছে পর্তুগিজদের কাছে তিনি বিরাট অঙ্কের এক টাকা দাবি করে বসলেন শম্ভুর লুটতরাজ থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য! বিশ্বাসঘাতকতা করে গোয়া অবরোধের একটা পরিকল্পনাও করলেন তিনি। পর্তুগিজদের সঙ্গে এই বিচ্ছেদ সৃষ্টি করা ছিল শাহজাদার সবচেয়ে বড় ভুল।
গোঁয়ার কাছ থেকে শাহ আলম গেলেন উত্তরের মালভানে আর বারুদ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সেখানকার বিখ্যাত সাদা মন্দির এবং মারাঠি রাজার অন্যান্য অট্টালিকা। এই অভিযানের সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হলো কুদাল আর বান্দা (সাবান্ত–বাদির অন্তর্গত) আর ধ্বংস করা হলো ভিঙ্গুরলা।
ফেব্রুয়ারিতে মোগল সেনাবাহিনীর অগ্রগতি থেমে গেল দুর্ভিক্ষে । কারণ, সন্দেহ জাগার ফলে পর্তুগিজরা আর আসতে দিল না রসদবাহী মোগল নৌবহর। অনাহারে শেষনিশ্বাসটুকু কেবল ধরে রাখল সেনারা। হতভম্ব শাহজাদা ঘাটে ফিরে এলেন ২০ ফেব্রুয়ারি।
এতে বিপদ আরও বাড়ল। মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল তার এক-তৃতীয়াংশ লোক। অধিকতর অনুপাতে খতম হয়ে গেল ঘোড়া, হাতি আর উট এবং সেগুলোর মৃতদেহ বিষাক্ত করে তুলল বাতাস। মালবহনের এই ব্যর্থতা ডেকে আনল দ্বিতীয় আরেকটা দুর্ভিক্ষ। অত্যধিক গরম আর পিপাসাতেও মারা গেল তার অনেক লোক।
শাহ আলম নেমে এলেন কানারা সমভূমিতে। এই সুযোগে যেখানে-সেখানে হত্যা আর লুটতরাজ চালাতে লাগল শক্ররা। ১৮ মে আহমদনগর এসে পৌঁছাল সেনাবাহিনীর শোচনীয় অবশিষ্ট।
১৪.১৩ ১৬৮৩ সালের পর শম্ভুজীর কার্যকলাপ
১৬৮৪ সালের প্রথমার্ধে অত্যন্ত সফল হলো মোগল অভিযান; দখল করা হলো মারাঠিদের অনেক দুর্গ, বারংবার পরাজিত হলো তাদের সেনা, অনেক ভূখণ্ড সংযুক্ত করা হলো। সেরা অর্জন হলো শম্ভুজীর দুই স্ত্রী, এক কন্যা আর তিন ক্রীতদাসীকে জুলাইয়ে বাহাদুরগড় দুর্গে বন্দী করা। দিলির খান এর আগেই মারাঠি রাজার এক স্ত্রী আর এক বোনকে বন্দী করেছিল আহমদনগর দুর্গে।
পুরো এই সময়ে কোথায় ছিল শম্ভুজী? ১৬৮৩ সালের শেষাশেষি তার গোয় আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর সে সম্পূর্ণ ডুবে গেল আমোদ-প্রমোদে, তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলো মেয়ে, আমোদ-প্রমোদ, আর ওয়াইন। উত্তরাধিকারী হিসেবে বাবার সদগুণগুলোর কিছুই সে পায়নি।
১৬৮৫ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি শিহাব-উদ-দীন খান আবার কঙ্কান আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দিল রাইগড় দুর্গের পাদদেশের গ্রাম পচাঁদ, ‘অনেক বিধর্মী প্রধানকে হত্যা করে, তাদের ধনসম্পদ লুট করে, অনেককে বন্দী করে অর্জন করল এক বিরাট বিজয়। দারুণ এই সাফল্যের কারণে তাকে উপাধি দেওয়া হলো খান বাহাদুর ফিরুজ জং।
অনেক মারাঠি দলনেতাকে সম্রাট-বাহিনীতে যোগ দিতে প্ররোচিত করল ফিরুজ জং। ডিসেম্বরের শুরুতেই কোন্দানা দখল করল আবদুল কাদির। ১৬৮৫ সালের মার্চের শেষাশেষি মোগল সেনাবাহিনী বিজাপুর অবরোধ শুরু করায় সাময়িকভাবে চাপ কমল মারাঠিদের ওপর থেকে ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড়লাটের পক্ষ থেকে বোম্বে দুর্গ দখল করেছিল ক্যাপটেন রিচার্ড কিগউইন। ১৬৮৪ সালের এপ্রিলে মোগল নৌ সেনাপতি সিদ্দি কাশিমকে সে বোম্বের নিরপেক্ষতা মেনে নিতে বাধ্য করাল, মারাঠি গ্রামগুলোর বিপক্ষে আক্রমণ চালানোর সুবিধার্থে তার দ্বীপটাকে ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়ে । এপ্রিলের শেষাশেষি রাম সেনভিকে দোভাষী করে সে তার দুই দূত ক্যাপ্টেন হেনরি গ্রে আর লেফটেন্যান্ট টমাস উইলকিনসকে পাঠাল শম্ভুজীর কাছে, শিবাজীর আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ইংরেজদের ক্ষতিপূরণ দাবি আর মারাঠি রাজার বন্ধুত্ব কামনা করে। তার এই মিশন হলো সম্পূর্ণ সফল। ইংরেজদের সমস্ত দাবি মেনে নিয়ে দুটো চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করল শম্ভজী।
১৪.১৪ মোগলদের বিজাপুর প্রদেশ বিজয়
১৬৮৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বিজাপুর আত্মসমর্পণ করার পর আওরঙ্গজেব তার সেনাপতিদের সদ্য সংযুক্তকৃত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠালেন রাজস্ব নির্ধারণ, শান্তি স্থাপন আর দুর্গগুলোর দখল নেওয়ার জন্য। কিন্তু পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মোগলরা অবরোধ করল গোলকুণ্ডা আর ১৬৮৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর সেই দুর্গের পতন হওয়ার পরই কেবল পুরনো আদিল শাহি রাজত্বে শুরু হলো তাদের নতুন তৎপরতা।
তাদের প্রথম অভিযান পরিচালিত হলো বেরাদ গোত্রের বিপক্ষে। এক বছরের ব্যবধানে বিজাপুর আর গোলকুপ্তার পতন ঘটিয়ে মোগলরা যে ভীতির সঞ্চার করেছিল, তা এ ক্ষেত্রে কাজ করল। বেরাদ গোত্রপ্রধান পাম নায়ক বশ্যতা স্বীকার করে, তার দুর্গ তুলে দিল (২৮ নভেম্বর) মোগলদের হাতে আর ১৬৮৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর সাক্ষাৎ করল সম্রাটের সঙ্গে, কিন্তু তার পাঁচ দিন পরই মারা গেল হঠাৎ করে। তার দেশ সংযুক্ত করা হলো।
এরপর ফিরুজ জং আক্রমণ করল তুঙ্গভদ্রার দক্ষিণের কারনুল জেলা আর আদোনি দুর্গ, যেখানে সিদ্দি মাসউদ রাজত্ব করছিল স্বাধীনভাবে। ১৬৮৮ সালের ৬ অগাস্ট প্ররোচনার মাধ্যমে শর্তাধীন আত্মসমর্পণ করানো হলো সিদ্দি মাসাউদকে; তার দুর্গ দখলের পর সেটার নতুন নামকরণ করা হলো ইমতিয়াজ গড়, আর তাকে দেওয়া হলো সাত হাজারি মনসবদারি।
একটা অবরোধের (মার্চের দিকে) পর বেলগার শক্তিশালী দুর্গ দখল করলেন শাহজাদা আজম। অন্যান্য দিকেও অসংখ্য দুর্গ দখল করল সাম্রাজ্যবাদীরা।
১৬৮৮ সালের ২৫ জানুয়ারি হায়দরাবাদ ত্যাগ করে সম্রাট বিজাপুর এসে পৌঁছালেন ১৫ মার্চ। প্রথমেই তিনি লক্ষ করলেন, শহর ধ্বংসের ফলে যেসব মানুষ অভাবি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ করা দরকার। মানুষ সবচেয়ে বেশি ভুগছে পানীয় জলের অভাবে, কারণ, অবরোধের সময় নালাগুলো ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুকিয়ে গেছে। একটা নালা কাটার আদেশ দিল মুখলিস খান, যেন সেটা দিয়ে শহরে প্রবাহিত করা যায় কৃষ্ণ নদীর পানি।
১৬৮৮ সালের নভেম্বরের শুরুতে ভয়ংকর এক মহামারী দেখা দিল বিজাপুর শহর আর সম্রাটের শিবিরে। বিউবনিক প্লেগ প্রথম আক্রমণ চালাল বগল আর উরুর কোণে, তারপর ভীষণ জ্বরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া; ডাক্তারি চিকিৎসায় কোনো কাজ হলো না; দু-চারজন দুদিনের বেশি টিকল, বেশির ভাগ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল তার আগেই। এই রোগের শিকার হলেন সম্রাটের বৃদ্ধা স্ত্রী আওরঙ্গাবাদি মহল, মহারাজা যশোবন্তের ১৩ বছরের পুত্র মুহম্মদি-রাজ, ফাজিল খান এবং আরও অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষ। মধ্যবিত্ত আর গরিব শ্রেণীর হিন্দু আর মুসলমান যে কতজন মারা গেল, তা বলা সম্ভব নয়, কিন্তু অনুমান করা হয় যে সংখ্যাটা এক লাখের কম হবে না। অন্ধ হয়ে গেল ফিরুজ জংয়ের চোখ ।
সম্রাট জোর অভিযান চালালেন (১৪ ডিসেম্বর, ১৬৮৮) এই রোগের বিরুদ্ধে, এক সপ্তাহের মধ্যে কমে গেল রোগের প্রকোপ। বিজাপুরের ৮৫ মাইল উত্তরের আকলুজ পর্যন্ত এগিয়ে থামলেন সম্রাট।
১৪.১৫ ভারতে শাহজাদা আকবরের শেষ প্রচেষ্টা
সম্রাট বিজাপুরের অবরোধে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে শোলাপুর ত্যাগ করার পর খর্ব হলো মোগল দাক্ষিণাত্যের সামরিক শক্তি, আর সেই সুযোগে মোগল ভূখণ্ডে আকবর একটা আক্রমণ চালালেন ১৬৮৬ সালের জুনে। কিন্তু তার এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো; সম্রাট তার স্বভাবসুলভ দূরদর্শিতায় আহমদনগর রক্ষার জন্য বড় একটা সেনাবাহিনী রেখে গিয়েছিলেন মারহাম খানের অধীনে, আর তার সঙ্গে চাকনের কাছে এক ভয়াবহ যুদ্ধে পরাজিত হলেন আকবর। ফিরে এলেন শাহজাদা শম্ভুজীর রাজ্যে, আর তারপর কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন মহুলি আর জওহর হয়ে উত্তরের সুরাটে যাওয়ার।
অবশেষে জিয়া-উদ-দীন মুহম্মদ (সুজার একজন ভূতপূর্ব অনুসারী) আর ৪৫ জন পোষ্যসহ রাজাপুর থেকে একটা জাহাজ ভাড়া করে আকবর রওনা দিলেন পারস্যের উদ্দেশে (ফেব্রুয়ারি, ১৬৮৭), কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার মুখে পড়ে ইংরেজ ক্যাপ্টেন বেন্ডাল জাহাজ ভিড়াতে বাধ্য হলো মাস্কট বন্দরে। সেখানে কয়েক মাস অবস্থান করার পর, ১৬৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি পৌঁছালেন তিনি ইস্পাহানের পারসি দরবারে।
শাহজাদাকে নিরাপদে ভারতের বাইরে পাঠানোর পর দুর্গাদাস ফিরে গেল তার আপন দেশ মারওয়ারে।
১৪.১৬ মারাঠি রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং শম্ভুজীর কার্যকলাপ, ১৬৮৫-৮৭
আওরঙ্গজেব যখন তাঁর সাম্রাজের সম্পূর্ণ শক্তি পরিচালিত করছিলেন বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার বিপক্ষে, শম্ভুজী তখন এটাকে পুরো দাক্ষিণাত্যের শক্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ ভেবে সামাল দেওয়ার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। তার সেনারা মোগল ভূখণ্ডের এখানে-সেখানে রুটিনমাফিক লুটপাট চালিয়েছে, কিন্তু এসব আক্রমণ সামরিক পরিস্থিতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ঈষৎ বিরক্তিকর এই কাজগুলোকে গ্রাহ্যই করেননি আওরঙ্গজেব। বিজাপুর আর গোলকুপ্তার ওপর মোগল অবরোধ অন্য পথে পরিচালিত করার মতো জ্ঞানী মারাঠি রাজা ছিল না; তার সরকারও নিরাশাজনকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল তার সামন্ত দের বিদ্রোহ আর সভাসদদের ষড়যন্ত্রে। তার সিংহাসনারোহণের মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই একে একে বিদায় নিয়েছিল তার পিতার রাজত্বকালীন সম্মানে অবদান রাখা প্রায় সমস্ত মন্ত্রী আর সেনাপতি। মাদ্ৰাজ কৰ্ণাটক নামের একটা রাজ্য শম্ভুজীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল তার শ্যালক হরজী মহাদিকের হাতে।
শম্ভুজীর অলস শাসনের সময় মারাঠি রাজ্যের অর্থনৈতিক অবক্ষয়, অফিসারদের দুর্নীতি, আর বিদ্রোহীদের সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে ইংরেজ ফ্যাক্টরি রেকর্ডে : শিবাজীর রাজত্বকালে রাজাপুরের কাছে মরিচ উৎপাদিত হতো প্রায় ১,৫০০ খান্দি (১ খান্দি= ২০ মণ); কিন্তু এখন সেই উৎপাদন এক-দশমাংশেরও কম; বর্তমানে এটা একটা শোচনীয় শহর।
এই ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হওয়ার মূলে ছিল অপশাসন আর ঘুষ নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক খিদে।
কারওয়ারের কাছের পথগুলোতে হামলা চালিয়েছিল শম্ভুজীর বিদ্রোহী সামন্ত রা। তার রাজ্যে নিরাপত্তা ছিল না বললেই চলে, ছিল অনিশ্চয়তা; ব্যবসা প্রায় ক্ষেত্রেই বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
১৪.১৭ শম্ভুজীর বন্দিত্ব এবং মৃত্যু
১৬৮০ সালের জুন আর ১৬৮১ সালের অক্টোবরে শম্ভুজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ভণ্ডুল হওয়ার পর নতুন আরেকটা ষড়যন্ত্র হলো ১৬৮৪ সালের অক্টোবরে, যার পরিণতিতে বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় লোককে সে নিক্ষেপ করল কারাগারে, যারা বন্দী রইল তার মৃত্যু পর্যন্ত। এই ঘটনার পর চার বছর শান্তই থাকল তার দরবারের পরিবেশ। কিন্তু ১৬৮৮ সালের অক্টোবরে আবার তার বিরুদ্ধে মাথা। চাড়া দিল শার্কি পরিবার; তারা কবি-কলসকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিল। খেলনায়। শম্ভুজী তার প্রিয় মানুষটিকে উদ্ধার করার জন্য অগ্রসর হলো রাইগড় থেকে, আর সঙ্গমেশ্বরে বিদ্রোহীদের পরাজিত করে খেলনায় গিয়ে পৌঁছাল। প্রহ্লাদ নিরজী এবং আরও অনেক মন্ত্রীকে বন্দী করার পর খেলনা দুর্গে রসদের ব্যবস্থা করে কবি-কলসকে সঙ্গে নিয়ে সে ধরল রাজধানীর ফিরতি পথ। ফিরতে ফিরতে সে এসে পৌঁছাল অলকানন্দা আর বরুণা নদীর পবিত্র সঙ্গমস্থল রত্নগিরি শহরের ২২ মাইল উত্তর-পুবের সঙ্গমেশ্বরে, যেখানে কবি-কলস তার প্রভুর জন্য নির্মাণ করেছে সুসজ্জিত সব ভবন আর সুন্দর সুন্দর বাগানবাড়ি। এখানে শম্ভুজী। তার সেনাবাহিনী আর পরিবারকে রাইগড়ে পাঠিয়ে দেওয়ার পর গা ভাসাল মদের লোত আর আমোদ-প্রমোদে। জায়গাটা মোগল সেনাদের পক্ষে অগম্য, এই বিশ্বাসে সেখানে পাহারা পর্যন্ত রাখল না অসতর্ক শম্ভুজী।
গোলকুণ্ডা অবরোধের সময় (২৮ মে, ১৬৮৭) কুতব শাহের অন্যতম সেরা কর্মচারী শেখ নিজামকে প্রলুব্ধ করে দলে টেনেছিল মোগলেরা এবং তাকে দিয়েছিল ৬-হাজারি মনসবদারি আর মুকাররব খান উপাধি। দক্ষ এই সেনাপতির ওপরই দেওয়া হয়েছিল পানহালা অবরোধের ভার (১৬৮৮)।
গুপ্তচরদের কাছ থেকে শম্ভুজীর সঙ্গমেশ্বরের অরক্ষিত লম্পট-জীবনের সংবাদ পেয়ে সে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না। মাত্র ২,০০০ বাছাই সেনা আর ১,০০০ পদাতিক সঙ্গে নিয়ে জোর রওনা দিল সে তার কোলাপুরের শিবির থেকে। জঙ্গল পেরিয়ে ভাঙা ভাঙা ভূখণ্ড আর পশ্চিম ঘাটের বড় বড় গিরিপথের ভেতর দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হতে তাদের কষ্টের কোনো সীমা রইল না। ‘বিদ্যুৎ আর ঝড়ের গতিতে’ মাত্র ৩০০ বাছাই সেনা নিয়ে সে গিয়ে পৌঁছাল সঙ্গমেশ্বরে, অতি দুর্গম ৯০ মাইল পথ দুই কি তিন দিনে অতিক্রম করে।
আক্রমণকারীরা শহরে প্রবেশের পর যুদ্ধ করল কবি-কলস। কিন্তু শিগগিরই ডান বাহুতে একটা তীর বিদ্ধ হওয়ায় সে আর যুদ্ধ করতে পারল না। মারাঠি সেনারা সমবেত হয়েছিল দ্রুতই, কিন্তু নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ায় পালিয়ে গেল তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে। শম্ভুজী আর তার মন্ত্রী তখন লুকাল মন্ত্রীর বাড়ির মেঝের একটা গর্তে, তবে রেহাই পেল না। মোগল সেনারা তাদের লম্বা চুল ধরে টেনে বের করে নিয়ে এল বাইরে হাতির পিঠে অপেক্ষমাণ সেনাপতির সামনে। বন্দী হলো এখানে স্ত্রী-কন্যাসহ শম্ভুজীর প্রধান পঁচিশজন অনুসারী (১ ফেব্রুয়ারি, ১৬৮৯)।
শিগগিরই বন্দী করার এই সংবাদ পৌঁছে গেল আকলুজের সম্রাট-শিবিরে, আর আনন্দোৎসব শুরু হলো পুরো সাম্রাজ্যে।
১৫ ফেব্রুয়ারি সম্রাটের শিবির পৌঁছাল বাহাদুরগড়ে, আর বন্দীদের উপস্থিত করা হলো সেখানে। সম্রাটের আদেশে দাক্ষিণাত্যের এই অত্যাচারীকে পরিণত করা হলো জনসাধারণের হাসির খোরাকে। শিবিরের চার মাইল বাইরে শম্ভুজী আর কবি-কলসকে পরিয়ে দেওয়া হলো ভাঁড়ের পোশাক, মাথায় লম্বা, ঘণ্টি বাঁধা বিচিত্র আকারের গাধার টুপি, তারপর তাদের উটের পিঠে বসিয়ে বাহাদুরগড়ে আনা হলো ঢাক, ঢোল আর ভেরী বাজাতে বাজাতে। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো লক্ষ লক্ষ মানুষ এমনভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল শম্ভুজীকে, যেন সে একটা আজব জানোয়ার কিংবা দানব। এভাবে শোচনীয় অপমানের মাঝ দিয়ে বন্দীদের উপস্থিত করা হলো পুরো দরবার নিয়ে অপেক্ষমাণ সম্রাটের সামনে। বন্দীদের দেখামাত্র সিংহাসন থেকে নেমে এলেন আওরঙ্গজেব, আর বিশাল এই বিজয়ের জন্য কার্পেটের ওপর সেজদা করে কৃতজ্ঞতা জানালেন আল্লাহকে। সম্রাটের সভাসদেরা ছিল শম্ভুজীর জীবন ভিক্ষা দেওয়ার পক্ষে, যেন মারাঠি রাজার আদেশে তার অফিসারেরা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্ত দুর্গ সমর্পণ করে। শম্ভুজী তার ধনসম্পদ কোথায় লুকিয়ে রেখেছে তা জানতে আওরঙ্গজেব পাঠালেন রুহুল্লাহ খানকে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণব্যাপী প্রকাশ্য অপমানের জ্বালা আর তার পরিণতিতে হতাশায়। নিমজ্জিত শম্ভুজী প্রত্যাখ্যান করল এই অপূর্ব সুযোগ, গালাগালি করল সম্রাট আর তার মহানবীকে, সেই সঙ্গে অমার্জিত রসিকতায় বলল যে আওরঙ্গজেবের উচিত বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ তার একটি কন্যাকে তার হাতে তুলে দেওয়া।
এমন পাপ করে বসল মারাঠি রাজা, যার আর কোনো ক্ষমা হতে পারে না। সেই রাতেই অন্ধ করে দেওয়া হলো তার দুই চোখ, আর পরদিন কেটে নেওয়া হলো কবি-কলসের জিভ। মুসলমান ধর্মগুরুরা ঘোষণা করল যে মুসলমান হত্যা, বন্দী, অবমাননা, আর শহর লুটতরাজের দায়ে শম্ভুজীর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। সম্রাট সম্মতি জ্ঞাপন করলেন। এক পক্ষকাল অত্যাচার চালানোর পর সম্রাট শিবিরের সঙ্গে বন্দীদের নিয়ে যাওয়া হলো ভীমার কোরগাঁয়ে (৩ মার্চ), আর তার কদিন পর তাদের ওপর নেমে এল এক অতি যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু (১১ মার্চ); একের পর এক কুপিয়ে কাটা হলো দুজনের প্রত্যেকটা অঙ্গ, আর মাংস খাওয়ানো হলো কুকুর দিয়ে। তারপর তাদের বিচ্ছিন্ন মাথার ভেতরে খড় গুঁজে দাক্ষিণাত্যের সমস্ত বড় বড় শহরে প্রদর্শন করা হলো ঢাক, ঢোল আর ভেরীর বাদ্য সহযোগে।
১৪.১৮ রাইগড় এবং শম্ভুজী পরিবারের বন্দিত্ব, ১৬৮৯
শম্ভুজীর পতনের পর রাইগড়ের মারাঠি মন্ত্রীরা তার ছোট ভাই রাজারামকে কারাগার থেকে বের করে রাজা হিসেবে বরণ করে নিল, যেহেতু শম্ভুজীর পুত্র শাহু তখনো রাজ্য পরিচালনা আর আওরঙ্গজেবের মতো একজন ভয়ংকর শত্রুর মোকাবিলা করার পক্ষে নিতান্তই ছোট। শিগগিরই ইতিকাদ খানের অধীন সম্রাটের একটা বাহিনী মারাঠি রাজধানী অবরোধ করল, কিন্তু রাজারাম সেখান থেকে পালাল (৫ এপ্রিল) একজন যোগীর ছদ্মবেশে। বিজাপুরের নতুন সুবাদার বরহার সাঈদ আবদুল্লাহ খান পলাতকদের পিছু নিয়ে তিন দিনের মধ্যে চলে গেল তুঙ্গভদ্রা তীরের সুবহানগড় আর জারা দুর্গের কাছে। মারাঠিরা আশ্রয় নিয়েছিল একটা দ্বীপে, রাতের বেলা আক্রমণ চালিয়ে তাদের একশোজন সর্দারকে বন্দী করা হলো। কিন্তু সঙ্গীরা যখন যুদ্ধে ব্যস্ত, তার এক ফাঁকে রাজারাম পালিয়ে যেতে পারল ।
কিছুদিন সে লুকিয়ে রইল বেদনুরের রানির ভূখণ্ডে (বর্তমানে মহীশূর জেলার সিমোগা)। তারপর রানির সহায়তায় জিনজিতে পালিয়ে গেল সে ১ নভেম্বর, আর সম্রাটের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করল ছোট একটা জরিমানার বিনিময়ে। দ্বীপে বন্দী করা মারাঠিদের রাখা হয়েছিল বিজাপুরের নগরদুর্গে, কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেখান থেকে পালাল হিন্দু রাও, বাহারজী এবং আরও জনা বিশেক সর্দার-যে কাজটা ছিল দুর্গের প্রহরীদের সহায়তা ছাড়া অসম্ভব। পালিয়ে যাওয়ার এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে বাকি ৮০ জন বন্দীকেই সম্রাট দান করলেন মৃত্যুদণ্ড।
ইতিকাদ খান (পরে জুলফিকার খান উপাধিপ্রাপ্ত) দীর্ঘ এক সংঘর্ষের পর রাইগড় দুর্গ দখল করল ১৬৮৯ সালের ১৯ অক্টোবর, আর শিবাজীর বিধবা, শম্ভুজীর আর রাজারামের স্ত্রী, কন্যা, পুত্রদের সঙ্গে বন্দী করল শাহু নামক সাত বছরের এক ছেলেকে। মহিলাদের পৃথক তাঁবুতে রাখা হলো যথাযোগ্য সম্মান আর গোপনীয়তা বজায় রেখে । শাহুকে দান করা হলো ৭-হাজারি মনসবদারির পদ আর রাজা উপাধি, কিন্তু বন্দী করে রাখা হলো সম্রাট-শিবিরের পাশেই।
সুতরাং, ১৬৮৯ সালের শেষাশেষি আওরঙ্গজেবই হলেন উত্তর ভারত আর দাক্ষিণাত্যের একচ্ছত্র অধিপতি। একে একে পতন হলো আদিল শাহ, কুতব শাহ, রাজা শম্ভুজীর, আর তাদের সবার রাজ্য সংযুক্ত হলো মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে।
‘এখন মনে হলো, সবকিছুই লাভ করলেন আওরঙ্গজেব; কিন্তু আসলে তিনি সবকিছুই হারালেন। এখান থেকেই হলো তাঁর শেষের শুরু। মোগল সাম্রাজ্য হয়ে গেল এত বিশাল, যা একজন মানুষ কিংবা একটা কেন্দ্র থেকে শাসিত হওয়ার অসাধ্য…চারপাশ থেকে মাথা তুলে দাঁড়াল তার শত্রুরা; তাদের তিনি পরাজিত করতে পারলেও চিরতরে দমন করতে পারলেন না। উত্তর আর মধ্য ভারতের অনেক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল অরাজকতা। প্রশাসন হয়ে পড়ল শিথিল আর কলুষিত। দাক্ষিণাত্যের অন্তহীন যুদ্ধ শূন্য করে ফেলল সম্রাটের কোষ । প্রথম নেপোলিয়ন বলতেন, ‘স্পেনের আলসারই (Ulcer) আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’ আওরঙ্গজেবকে ধ্বংস করে দিয়েছিল দাক্ষিণাত্যের আলসার।’ (আমার ‘স্টাডিজ ইন আওরঙ্গজেব’স রেইন’ থেকে।)