১৭. উত্তর ভারতের ঘটনাবলি

১৭. উত্তর ভারতের ঘটনাবলি

১৭.১ মারওয়ারের ত্রিশ বছরের যুদ্ধবিগ্রহ

সম্রাট যখন মহারানার সঙ্গে একটি শান্তি স্থাপন করে (জুন, ১৬৮১) দাক্ষিণাত্যে ফিরে গেলেন, রাজপুতদের মেবারের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, কিন্তু মারওয়ারের নয় । সম্রাটের বাহিনী রাঠোরদের দেশের প্রধান প্রধান শহর আর কৌশলগত স্থানগুলো অধিকারে রাখলেও তাদের দেশপ্রেমিকেরা রইল একটা যুদ্ধাবস্থায়। তারা দখল করে রইল পাহাড় আর মরুভূমি আর মাঝেসাঝেই বাজপাখির মতো সমভূমিতে নেমে এসে আক্রমণ চালাল মোগলদের কনভয়, কাফেলা আর দুর্বল আউটপোস্টের ওপর। প্রায়ই দুর্ভিক্ষ হানা দিল মারওয়ারে।

বিরামহীন সংঘর্ষ, দখল আর পুনর্দখলে কেটে গেল মারওয়ারের একটা পুরুষ। কিন্তু মরুভূমির ছোট একটা প্রদেশের তুলনায় সম্রাটের সম্পদ অনেক বেশি। অবিরাম শক্তিক্ষয়ের ফলে হয়তো দুর্বল হতে হতে শেষ হয়ে যেত রাঠোরদের বিরোধিতা, যদি না দাক্ষিণাত্যের অধিকতর মারাত্মক এক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে শেষ হয়ে যেত সম্রাটের সম্পদ।

মারওয়ারের এই সাতাশ বছরের (১৬৮১-১৭০৭) ইতিহাসকে ভাগ করা যায় সুনির্দিষ্ট তিনটে পর্বে। ১৬৮১ থেকে ১৬৮৭ সাল পর্যন্ত এটা ছিল জনসাধারণের যুদ্ধ, যেহেতু তাদের রাজা ছিল একজন শিশু আর তাদের জাতীয় নেতা দুর্গাদাস অনুপস্থিত ছিল দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার কারণে। বিভিন্ন নেতার অধীনে দলে দলে বিভক্ত হয়ে রাঠোরেরা যুদ্ধ করেছে মোগলদের বিপক্ষে। তবে এসবে রাঠোরদের বীরত্বের অনেক ঘটনা থাকলেও সেগুলো মোগল সেনাদের একটা সার্বক্ষণিক সতর্কাবস্থায় রাখা ছাড়া আর কোনো সামরিক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অবশ্য নির্দিষ্ট নেতা না থাকায় রাঠোরদের ভালোই হয়েছে, রণক্ষেত্রের যুদ্ধ সংঘটিত হলে তাদের হয়তো এমন পরাজয় বরণ করতে হতো যে এক পুরুষেও তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। গেরিলা কৌশল অবলম্বন করায় মোগলদের তারা কেবল ক্লান্তই করেনি, সংখ্যা এবং যুদ্ধোপকরণে অনেক কম থাকা সত্ত্বেও সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছে তাদের ক্ষয়ক্ষতি।

যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলো ১৬৮৭ সালে, যখন দুর্গাদাস ফিরল দাক্ষিণাত্য থেকে আর অজিত সিংহ ত্যাগ করল আর আত্মগোপনাবস্থা। প্রথমে রাঠোরেরা লাভ করল চোখধাঁধানো সাফল্য। বুন্দির হাদাদের দ্বারা শক্তি বৃদ্ধি করে তারা মুক্ত করল মারওয়ারের সমভূমি আর আপন দেশের সীমা ছাড়িয়ে আক্রমণ চালাল মালপুরা আর পুর-মণ্ডলে (১৬৮৭), এমনকি পরাজিত করল আজমীরের সুবাদারকে (১৬৯০), তারপর ধ্বংসলীলা চালাল মেওয়াট আর দিল্লির পশ্চিমে। কিন্তু স্বদেশ উদ্ধার তারা করতে পারল না। অজিত সিংহ আর দুর্গাদাস এসে উপস্থিত হওয়ার বছরই (১৬৮৭) সম্রাটের পক্ষে যোধপুরের শাসক হয়ে এল সুজায়েত খান নামক অসাধারণ যোগ্যতাসম্পন্ন আর তৎপর একজন অফিসার। মারওয়ারে ১৪ বছর বজায় রাখল সে মোগল অধিকার।

মারওয়ারের ফৌজদারির পাশাপাশি সুজায়েত খান ধরে রাখল গুজরাটের সুবাদারি । প্রত্যেক বছর ছয় মাস (কখনো কখনো আট) থাকল সে মারওয়ারে আর ছয় মাস গুজরাটে। এভাবে সে প্রতিরোধ করল রাঠোরদের যুদ্ধ। তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায়ও এল সে (১৬৮৮), যে যাবতীয় পণ্য নিরাপদে যেতে দেওয়ার বিনিময়ে রাঠোরেরা পাবে সম্রাটের ধার্য শুল্কের এক-চতুর্থাংশ। এটাও ছিল চৌথের আরেকটা ধরন।

কিন্তু ১৭০১ সালের ৯ জুলাই মারা গেল সুজায়েত খান, মারওয়ারের শাসক হয়ে এলেন শাহজাদা আজম, আবার সংঘর্ষ শুরু করলেন অজিত সিংহের সঙ্গে, আর শুরু হলো রাজপুতদের স্বাধীনতা যুদ্ধের তৃতীয় পর্ব । প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর দুই পক্ষের নানা উত্থান-পতনের পর শেষমেশ মারওয়ার মুক্ত হলো (১৭০৭)।

১৭.২ আবার মারওয়ারে দুর্গাদাস, ১৬৮৭-১৬৯৮

১৬৮৭ সালে মহারাষ্ট্র থেকে দুর্গাদাসের প্রত্যাবর্তন রাঠোরদের উজ্জীবিত করল। বুন্দির অন্যতম সামন্ত দুর্জন শাল হাদা তার সর্দার অনুরুধ সিংহের (আওরঙ্গজেবের একজন বিশ্বস্ত সামন্ত এবং সেনাপতি) কাছে অপমানিত হয়ে জ্ঞাতি আর পোষ্যদের অস্ত্রে সজ্জিত করে আচমকা এক আক্রমণে দখল করে নিল বুন্দি দুর্গ । তারপর মারওয়ারে এসে বিয়ে করল সে রাঠোর নেতা মুকুন্দ সিংহ চম্পাবতের এক বোনকে, আর হাদা গোত্রের হাজার অশ্বারোহী নিয়ে শক্তিশালী করল রাঠোর জাতীয় সেনাবাহিনীকে।

রাঠোর আর হাদারা সম্মিলিতভাবে দুঃসাহসিক আক্রমণ চালাতে লাগল মোগলদের উত্তর ভূখণ্ডে, এমনকি রাজধানী দিল্লির পক্ষে হয়ে দাঁড়াল হুমকিস্বরূপ। তার প্রত্যাবর্তনের পর দুর্জন শাল নিহত হলো মান্দালের নিকটবর্তী এক যুদ্ধে।

১৬৯০ সালে দুর্গাদাস অর্জন করল বিশিষ্ট একটা সাফল্য; আজমীরের সুবাদার শফি খানকে সে তাড়িয়ে দিল তার প্রদেশ থেকে। আবার ডেকে পাঠানো হলো সুজায়েত খানকে, সে রাজপুত মোড়লদের বোঝাতে পারল সম্রাটের উদ্দেশ্য।

শাহজাদা আকবরের কন্যা সাফিয়াত-উন-নিসাকে ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন আওরঙ্গজেব, ১৬৮১ সালে তার বাবা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে তিনি রাঠোরদের সঙ্গেই ছিলেন। এই ব্যাপারে একটা মধ্যস্থতা ব্যর্থ হয়েছিল ১৬৯২ সালে, নতুন করে ১৬৯৪ সালে আবার সেই কাজের ভার পড়ল যোগ্য এবং বিজ্ঞ সুজায়েত খানের ওপর এবং সুজায়েত এবার মধ্যস্থতার ভার দিল পাটনার এক নাগর ব্রাহ্মণ যোধপুরের ভূতপূর্ব রাজস্ব আদায়কারী, ঐতিহাসিক ঈশ্বরদাসের ওপর।

বারবার ঈশ্বরদাসের অনুরোধে শেষমেশ আকবরের কন্যাকে সম্রাটের হাতে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলো দুর্গাদাস…তখন ঈশ্বরদাস শাহজাদিকে পৌঁছে দিল

সম্রাটের দরবারে। দীর্ঘকাল বর্বর হিন্দুদের রাষ্ট্রে থেকে তার নাতনি নিশ্চয়ই ধর্মগ্রন্থ পাঠ করতে ভুলে গেছে ভেবে তক্ষুনি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার আলোচনা শুরু করলেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু শাহজাদি তাকে জানালেন যে দুর্গাদাস তার। জন্য মুসলমান শিক্ষিকা এনেছিলেন আজমীর থেকে, আর তার কাছে তিনি কুরআন পাঠ শিখেছেন।

দুর্গাদাসের মহানুভবতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তার অতীত সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন আওরঙ্গজেব।

এবার রাঠোরদের কাছ থেকে শাহজাদা আকবরের পুত্র বুলন্দ আখতারকে। ফিরিয়ে আনার পালা। কিন্তু এই কাজে প্রায় দুই বছর দেরি হয়ে গেল, প্রধানত এই কারণে যে দুর্গাদাস দাবি করল যোধপুর অজিত সিংহকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক, ওদিকে আওরঙ্গজেব চাইলেন যশোবন্ত সিংহের উত্তরাধিকারীকে মারওয়ারের ছোট একটা অংশ দিয়ে সন্তুষ্ট করতে।

ওদিকে অজিত সিংহ ভুগছিল হতাশায়, মোগলদের তাড়া খেয়ে বনজঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে সে ক্লান্ত। তাই ১৬৯৮ সালে দুর্গাদাস কমিয়ে ফেলল তার চাহিদা। অজিতকে ক্ষমা করে সম্রাট তাকে দিলেন সম্রাট-বাহিনীর একটা মনসব, সেই সঙ্গে জায়গির হিসেবে ঝালোর, শচদ আর শিওয়ানার পরগনা ।

বুলন্দ আখতারকে সম্রাটের দরবারে পৌঁছে দিল দুর্গাদাস, তারপর ইসলামপুরীতে (১৬৯৮)। রাজকীয় এই বেচারি মানুষটি জন্মের পর থেকেই বেড়ে উঠেছেন রুক্ষ রাজপুত চাষিদের মধ্যে, চোখেও দেখেননি কোনো শহর বা দরবার। এমনকি মার্জিত হিন্দুস্তানি ভাষাও তিনি জানেন না। আওরঙ্গজেব আহত হলেন আর দরবারের সবাই মজা পেল যে একজন সম্রাটের নাতি কথা বলতে পারে কেবল রাজপুত আঞ্চলিক ভাষায় (রাজস্থানি বোলি)! তা ছাড়া রাঠোরেরা তাকে সারা জীবন শিখিয়েছে যে আওরঙ্গজেব হলেন দানবের মতো, যিনি তাঁর বাবা আর পরিবারের একজন অদম্য শত্রু; অথচ রক্ষাকারীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে এখন তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে কিনা সেই আওরঙ্গজেবেরই হাতে! যা-ই হোক, ধীরে ধীরে শিক্ষিত হয়ে মার্জিত হলেন তিনি। দুর্গাদাসকে পুরস্কৃত করা হলো ৩-হাজারি মনসবদারি দান করে।

১৭.৩ অজিত ও দুর্গাদাস, ১৭০১-৭

আবার বন্ধুত্ব স্থাপনের এই ঘটনাটা ঘটেছিল ১৬৯৮ সালের মে মাসে, কিন্তু ১৭০১-২ সালে দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ করল দুর্গাদাস। সত্যি বলতে কি, সে আর অজিত সিংহ কখনোই মোগল সরকারকে বিশ্বাস করতে পারেনি, তাই দরবার থেকে নিজেদের রেখেছিল একটা সন্দেহপ্রবণ দূরত্বে। গুজরাটের নতুন সুবাদার, শাহজাদা মুহম্মদ আজম শাহকে সম্রাট আদেশ দিলেন যে পারলে তিনি যেন দুর্গাদাসকে সম্রাট-শিবিরে পাঠান, নয়ত তাকে সেখানেই হত্যা করেন, যেন দুর্গাদাস আর কখনোই অজিত সিংহ বা অন্যান্য রাঠোরদের মন্দ কাজে প্ররোচিত করতে না পারে।

মুহম্মদ আজম দুর্গাদাসকে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বললেন আহমেদাবাদে। কিন্তু রাজপুতের মনে জাগল সন্দেহ। সুতরাং তাঁবু আর মালপত্র আগুনে জ্বালিয়ে দিয়ে সমস্ত অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দুর্গাদাস রওনা দিল মারওয়ার অভিমুখে।

দুর্গাদাস আবার মারওয়ারে ফিরে আসতে অজিত সিংহ তার সঙ্গে যোগ দিয়ে (১৭০২) কয়েকটা আক্রমণ চালাল মোগলদের ওপর। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলো না। মারওয়ারের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল ওদিকে সিকি শতাব্দীর গেরিলা যুদ্ধ করতে করতে রাঠোর যোদ্ধারাও ক্লান্ত। এই সময় অবস্থা আরও খারাপ হলো অজিত সিংহ আর দুর্গাদাসের মতবিরোধে। আর এই অসুবিধার সুযোগ নিতে দেরি করলেন না সম্রাট। অজিত ছিল উদ্ধত আর দুর্গাদাসের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত। সবকিছুই যখন যাচ্ছিল আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তখন অভ্যন্তরীণ এই বিরোধ তাঁর উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়তা করল, আর তার ফলেই অজিত সিংহকে আরও পাঁচ বছর থাকতে হলো তার রাজ্যের বাইরে।

১৭০৪ সালে আওরঙ্গজেব একরকমের শান্তি স্থাপন করলেন অজিত সিংহের সঙ্গে তাকে মাইরতার জায়গির দিয়ে। ১৭০৫ সালের নভেম্বরে দুর্গাদাসও সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করল শাহজাদা আজমের মাধ্যমে, আর তাকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হলো মনসবদারি আর গুজরাটের পদ।

পরবর্তী বছর অর্থাৎ, আওরঙ্গজেবের শাসনের সর্বশেষ বছরে মারাঠিরা প্রবেশ করল গুজরাটে আর তার পরপরই মোগল সেনাবাহিনী নিদারুণ এক পরাজয় বরণ করল রতনপুরে। তৃতীয়বার অজিত সিংহ মাথা চাড়া দিল বিদ্রোহ করতে। দুর্গাদাসও পালাল মোগল শিবির থেকে, আর কাজ করতে লাগল অজিত সিংহের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। কিন্তু তখন গুজরাটের দায়িত্বে থাকা শাহজাদা বিদার বখত একটা বাহিনী পাঠালেন দুর্গাদাসের বিরুদ্ধে, আর পালিয়ে সে চলে গেল সুরাটের দক্ষিণের বিচ্ছিন্ন কোলি দেশে। অজিত সিংহ কিছুদিন খোলাখুলি বিদ্রোহ করল। দ্রুনেরাতে সম্রাটের পক্ষের মুহাকম সিংহকে পরাজিত করে শক্তি আর সম্মানও খানিকটা বাড়ল তার। এই ঘটনার পর আহমদনগরে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সংবাদ আসতে ১৭০৭ সালের ৭ মার্চ অজিত ঘোড়া ছোটাল যোধপুরের উদ্দেশে, আর শহরটার সহকারী ফৌজদার জাফর কুলিকে সেখান থেকে বহিষ্কার করে, অধিকার করল তার বাবার রাজধানী। আহত হয়ে মাইর খালি করে দিয়ে মুহাম সিংহ পালিয়ে গেল নাগরে। সোজাত আর পালি পুনরুদ্ধার করা হলো। যোধপুর দুর্গ পবিত্র করা হলো গঙ্গাজল আর তুলসিপাতা দিয়ে। এভাবে দুর্গাদাসের জীবনের কাজগুলো হলো পুরোপুরি সাফল্যমণ্ডিত।

১৭.৪ আগ্রার কাছে জাঠ বিক্ষোভ

১৬৭৯ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে অন্তহীন যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়েন আওরঙ্গজেব, শিগগিরই তার একটা প্রতিক্রিয়া হয় উত্তর ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। বছরের পর বছর সম্রাট রাজধানীতে ফেরেন না, অনুপস্থিত থাকেন শাহজাদাগণও। নর্মদার উত্তরের সাম্রাজ্যের সম্পদশালী প্রদেশগুলো থাকে দ্বিতীয় শ্ৰেণীর অমাত্যদের দায়িত্বে। পণ্যদ্রব্য, রাষ্ট্রীয় রাজস্ব, সেনাবাহিনীর রসদ, সম্পদসহ অমাত্যদের পরিবার নিয়ে দূর দক্ষিণের পথে চলে লম্বা লম্বা কাফেলা, কিন্তু সেগুলো রক্ষার দায়িত্বে থাকে ছোটখাটো বাহিনী, ফলে প্রলুব্ধ হয় ডাকাত উপজাতিরা। দিল্লি থেকে আগ্রা, খোলপুর আর মালওয়া হয়ে দাক্ষিণাত্যগামী বিরাট রাজপথ চলে গেছে জাঠ দেশের বুক চিরে। সাহসী, শক্তিশালী আর কষ্টসহিষ্ণু এই জাতির শিকারি প্রবৃত্তি সংযত হয়ে থাকে কেবল অধিকতর কোনো শক্তির আতঙ্কে।

১৬৮৫ সালে সম্রাটের দাক্ষিণাত্য আক্রমণের সুযোগে মাথা চাড়া দেয় নতুন দুই জাঠ নেতা, সিনসানি আর সোগারের ছোট দুই জমিদার, রাজারাম আর রামচেহেরা। তারাই প্রথম উপজাতির মানুষকে দেয় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। আক্রমণ। পরিচালনার কেন্দ্র, পরাজিত প্রধানের আশ্রয়, লুটের মাল রাখার জায়গা হিসেবে তারা নির্মাণ করে ছোট ছোট দুর্গ (গড়হি) । তারপর আক্রমণ চালাতে থাকে তারা রাজপথে আর তাদের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেয় আগ্রার উপকণ্ঠ পর্যন্ত।

রাজারামের বেআইনি কার্যকলাপকে আগ্রার শাসক শফি খান দমাতে পারল না। এমনকি তুরানি বিখ্যাত যোদ্ধা আগহার খান যখন কাবুল থেকে যাচ্ছিল বিজাপুরের সম্রাট-শিবিরে, রাজারাম তাকে হত্যা করল ধোলপুরের কাছে। ১৬৮৭ সালের ডিসেম্বরে শাহজাদা বিদার বখতকে পাঠানো হলো জাঠ যুদ্ধের প্রধান হিসেবে।

কিন্তু শাহজাদা আসার আগেই ১৬৮৮ সালের শুরুতে জাঠ নেতা আক্রমণ করল হায়দরাবাদের মীর ইব্রাহিমকে (মহব্বত খান)। এবং তার পরপরই সেকেন্দ্রায় আকবরের সমাধি লুট করে সে নিয়ে গেল কার্পেট, সোনা আর রুপার পাত্র, প্রদীপ, সেই সঙ্গে দালানেরও ক্ষতিসাধন করল।

ঈশ্বরদাস আর মানুচি বর্ণনা দিয়েছেন: ধ্বংসলীলার শুরুতে ভাঙল তারা ব্রোঞ্জের বড় বড় দরজাগুলো, লুট করল মূল্যবান রত্ন আর সোনা ও রুপার থালা, আর যেসব জিনিস নিয়ে যেতে পারল না সেগুলো ধ্বংস করল । সমাধি থেকে আকবরের হাড়গোড় টেনে বের করে রেগেমেগে তারা ছুঁড়ে মারল আগুনে আর পুড়িয়ে ফেলল।

বিদার বখত এসে উপস্থিত হতে জোরদার হলো মোগল আক্রমণ। রাজপুতদের দুই গোত্রের মারাত্মক যুদ্ধে এক পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে রাজারাম মারা গেল গুলি খেয়ে (৪ জুলাই, ১৬৮৮)।

অম্বরের (জয়পুর) নতুন রাজা বিশুন সিংহ কাছওয়াকে সম্রাট নিয়োগ দিলেন মথুরার ফৌজদার হিসেবে এবং তার ওপর চাপালেন জাঠদের উৎখাত আর সিনসানিকে নিজের জায়গির হিসেবে দখল করার ভার । বিশুন সিংহের সহায়তায় সিনসানি অবরোধ করলেন বিদার বখত। খাবার আর পানির ভীষণ কষ্টে ভুগল

অবরোধকারীরা, কিন্তু হাল ছেড়ে দিল না। ১৬৯০ সালের জানুয়ারির শেষে সফল। এক মাইন বিস্ফোরণে ভেঙে গেল দেয়াল, আর সেদিক দিয়ে ঢুকে তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর দুর্গ দখল করে নিল মোগলরা। মারা গেল ১,৫০০ জাঠ, আর সম্রাট বাহিনীর ২০০ মোগল, সেই সঙ্গে হতাহত হলো ৭০০ রাজপুত। পরবর্তী বছর (২১ মে, ১৬৯১) জাঠদের সোগার দুর্গ দখল করল রাজা বিশুন সিংহ।

কয়েক বছর শান্তি বিরাজ করার পর মাথা চাড়া দিল নতুন জাঠ নেতা চুরামন। এই চুরামন ছিল রাজারামের এক ভাই ভাজ্জার ছেলে। চুরামনের শক্তি অবশ্য পূর্ণ প্রকাশিত হয় আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর। ১৭০৪ সালের দিকে সিনসানি উদ্ধার করেছিল সে মোগলদের হাত থেকে। ১৭০৫ সালের ৯ অক্টোবর জাঠদের কাছ থেকে সেটা দ্বিতীয়বার দখল করেছিল আগ্রার সুবাদার মুখতার খান।

১৭.৫ পাহাড় সিংহ গৌড় আর তার ছেলেদের হাতে মালওয়ার অশান্তি

পশ্চিম বুন্দেলখণ্ডের ইন্দ্রাখির রাজপুত জমিদার, পাহাড় সিংহ গৌড় ছিল সম্রাটের মালওয়ার শাহাবাদ ধামধেরার ফৌজদার। বুন্দির রাজা অনুরুধ সিংহ হাদাকে পরাজিত করল সে লাল সিংহ খিচির (চৌহান) পক্ষ নিয়ে, তারপর লুট করল বুন্দি রাজার পুরো শিবির, মালপত্র আর লাখ লাখ টাকা (১৬৮৫ সালের শুরুতে)। এই ঘটনার পর খোলাখুলিই সম্পর্ক ছিন্ন করল সে সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সঙ্গে, আর লুটপাট করতে লাগল মালওয়ার গ্রামে। সে সময় শাহজাদা মুহম্মদ আজমের অনুপস্থিতিতে প্রদেশটা শাসন করছিল তার দেওয়ানের সহকারী (পেশদস্ত ) রাই মুলুক চাঁদ। ১৬৮৫ সালের ডিসেম্বরে আক্রমণ চালিয়ে সে হত্যা করল বিদ্রোহীকে। কিন্তু বিদ্রোহ অব্যাহত রইল পাহাড় সিংহের পুত্র ভগবন্তের নেতৃত্বে, হিংস্র কৃষকদের বড় একটা দল গঠন করে সে আক্রমণ চালাতে লাগল গোয়ালিয়রের আশপাশে। মুলুক চাঁদ এগিয়ে গেল তার বাহিনী নিয়ে। অন্ত্রির কাছে সামনাসামনি এক যুদ্ধে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাল সম্রাট-বাহিনী; গৌড় সেনারা লুট করল তাদের মালপত্র আর ঘোড়া, কিন্তু আক্রমণ পরিচালনার কেন্দ্রে ফিরে গৌড়েরা যখন লুটের মাল ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত, ভগবন্ত সিংহ পেছনে পড়ে গেল একা, আর সেই সুযোগে তাকে হত্যা করল কয়েকজন মোগল অফিসার (মার্চ, ১৬৮৬)।

কিন্তু এখানেই ঝামেলার শেষ হলো না। এবার পাহাড় সিংহের আরেক পুত্র দেবী সিংহ যোগ দিল ছত্র শাল বুন্দেলার সঙ্গে, আর লুটপাট করতে লাগল মোগলদের ভূখণ্ডে, সেই সঙ্গে হামলা চালাল বুন্দেলখণ্ডের অধিবাসীদের ওপর। ১৬৯০ সালে পাহাড় সিংহের নাতি, গোপাল সিংহ বড় একটা সেনাবাহিনী গঠন করে দখল করে নিল ইন্দ্রাখি দুর্গ। গোয়ালিয়রের ফৌজদার সফদার খান নিহত হলো এই বিদ্রোহীদের আক্রমণেই (মে, ১৬৯০)।

কিন্তু দুই বছর পর সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করল গৌড় বিদ্রোহীরা, পরে তাদের মোগল সেনাবাহিনীর সেবা করতে দেখা গেল।

১৭.৬ বিহারে গঙ্গারামের বিদ্রোহ; মালওয়ায় গোপাল সিংহের

গুজরাটের এক গরিব ব্রাক্ষণ, গঙ্গারাম ছিল খান-ই-জাহান বাহাদুরের দেওয়ান । প্রভুর সঙ্গে মনোমালিন্যের ফলে বিদ্রোহী হলো সে, হাজার চারেক সেনা সংগ্রহ করে লুটপাট চালাল বিহার শহরে আর অবরোধ করল পাটনা। জাল একজন শাহজাদা আকবর খাড়া করে সে জনসাধারণকে দাঁড়াতে বলল তার পাশে (মার্চ, ১৬৮১)। কিন্তু দেয়ালঘেরা একটা শহর দখল করার মতো দক্ষতা তার ছিল না। শাসক বেশ কিছুদিন দুর্গের ভেতরে হাত গুটিয়ে বসে থাকার পর সাহায্য এসে পৌঁছাল ঢাকা আর বেনারস থেকে, আর উঠে গেল পাটনার অবরোধ। কিছুদিন পর গঙ্গারাম মালওয়ায় গিয়ে রাজপুতদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লুটপাট চালাল শিরোঞ্জে (অক্টোবর, ১৬৮৪)। এই ঘটনার পরপরই সে মারা গেল উজ্জয়িনীতে।

মালওয়ার রামপুরার জমিদার রাও গোপাল সিংহ চন্দ্রবত ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে যোগ দিয়েছিল দাক্ষিণাত্যের সম্রাট-বাহিনীতে। সম্রাট রামপুরার নাম পরিবর্তন করে ইসলামপুরা রাখায় বিদ্রোহ করে রামপুরা উদ্ধার করতে গেল সে ১৭০০ সালের জুনে, কিন্তু মালওয়ার শাসকের কাছে পরাজিত হয়ে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করল। তাকে নিয়োগ করা হলো কৌলাসের (হায়দরাবাদের অন্তর্গত) ফৌজদার । কিন্তু ১৭০৬ সালের শুরুতে ফৌজদারি কেড়ে নিলে ভয়াবহ দারিদ্র্যের মুখোমুখি হলো সে, তাই বাঁচার তাগিদে মারাঠিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে, বরোদা ধ্বংসে অংশ নিল সেই বছরের মার্চে ।

১৭.৭ বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য

ইংরেজ জাতি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সুরাটে তাদের প্রথম কারখানা প্রতিষ্ঠিত করেছিল ১৬১২ সালে। সেখান থেকে তারা স্থলপথে খাদ্যবিনিময় করত আগ্রা আর দিল্লিতে। গোলকুপ্তা রাজ্যের মসুলিপট্টম বন্দরেও তাদের একটা এজেন্সি ছিল ।

১৬৩৩ সালে একটা ইংরেজ কারখানা খোলা হলো বালাসোরে আরেকটা কটকের ২৫ মাইল দক্ষিণ-পুবের হরিহরপুরে। ১৬৪০ সালে বিজয়নগর বংশের এক হিন্দু রাজার কাছ থেকে কেনা জমির ওপর তারা সেইন্ট জর্জ দুর্গ নির্মাণ করতে লাগল মাদ্রাজে, এটাই ছিল ভারতে ইংরেজদের সর্বপ্রথম স্বাধীন দপ্তর। অবশ্য এটা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের বাইরে। ১৬৫১ সালে ইংরেজরা বাংলায় তাদের প্রথম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলল কলকাতার ২৪ মাইল উত্তরের হুগলিতে। তাদের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য ছিল শশারা (নৌকায় করে বয়ে আনা হতে পাটনার উত্তরের সিংহিয়া বা লালগঞ্জ থেকে), রেশম আর চিনি। বাংলার তদানীন্তন সুবাদার শাহজাদা সুজা বাংলায় ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিলেন যাবতীয় শুল্কের পরিবর্তে বার্ষিক ৩,০০০ টাকা প্রদানের বিনিময়ে (১৬৫১)। অনেক বছর যাবৎ বাংলার পণ্যদ্রব্য নিয়ে ইয়োরোপগামী জাহাজের মাল বোঝাই এবং মাল খালাস করত তারা বালাসোরে।

১৬৫৮ সালের দিকে বাংলায় বাণিজ্য ছিল খুব লাভজনক। কাঁচা রেশম ছিল পর্যাপ্ত ছিল নানা রকমের সুন্দর সুন্দর টাফেটা; সেরা জাতের শোরা ছিল একদম সস্তা; ইংল্যান্ড থেকে আসা সোনা আর রুপা লুফে নিত ভারতীয়রা।

১৬৬৮ সালে কোম্পানি প্রদেশ থেকে মাল রপ্তানি করল ৩৪,০০০ পাউন্ডের, ১৬৭৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াল ৮৫,০০০ পাউন্ডে, ১৬৭৭ সালে ১,০০,০০০ পাউন্ডে আর ১৬৮০ সালে ১,৫০,০০০ পাউন্ডে। ১৬৬৮ সালে অধীনস্ত কোম্পানি খোলা হলো ঢাকায় আর মালদায় ১৬৭৬ সালে। স্থানীয়ভাবে নির্মিত দ্রব্য কেনার পাশাপাশি ইংরেজরা ইয়োরোপিয়ান ডাইয়ার পাঠাল বাংলায় রেশমের রং উন্নত করতে। হুগলি থেকে সাগর পর্যন্ত প্রথম বেঙ্গল পাইলট সার্ভিসও চালু করল তারা (১৬৬৮)। বঙ্গোপসাগর থেকে গঙ্গার ওপর দিয়ে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ জাহাজ চলাচল করল ১৬৭৯ সালে।

১৭.৮ বাংলায় ইংরেজ ব্যবসায়ী আর মোগল কর্মচারীদের বিরোধ

ইতিমধ্যে বেআইনি আদায় নিয়ে ইংরেজ ব্যবসায়ী আর মোগল স্থানীয় কর্মচারীদের লাগল এক বিরোধ। হুগলির স্থানীয় কর্মচারীরা কোম্পানির নৌকা ধরে আটক করতে লাগল তাদের মাল। কোম্পানির প্রতিনিধি হেজেস আমদানি রপ্তানি শুল্ক মওকুফ করার বিনিময়ে শায়েস্তা খানকে দিতে চাইল মোটা অঙ্কের টাকা, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। শেষমেশ ধৈর্য হারিয়ে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভারতীয় শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, উপকূলের নিরাপদ কোনো স্থানে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এই যুদ্ধ আসলে শুরু হলো ১৬৮৬ সালে।

শাহজাদা সুজা ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন একজন প্রাদেশিক শাসকমাত্র। স্বভাবতই সম্রাটের হিসেব ছিল তার থেকে অনেক আলাদা।

সত্যি বলতে কি, সৎ প্রশাসনের জন্য চাই সবার সহযোগিতা। যে সমাজের মানুষ শক্তিমানের কাছে মাথা নত করে অভ্যস্ত, সেখানে প্রশাসনিক সততা বজায় রাখা সম্ভব নয়। সম্রাট সবদিকে নজর দিতে পারতেন না; সর্বত্র উপস্থিত হওয়াও ছিল তার পক্ষে অসম্ভব; তাকে কাজ করতে হতো প্রতিনিধিদের মাধ্যমে, এবং এই সব প্রতিনিধি প্রজাদের ব্যাপারে মোটেই সৎ আর মনোযোগী ছিল না।

১৭.৯ বাংলায় আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ, ১৬৮৬-৮৯

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাশিমবাজারস্থ ভারতীয় ব্যবসায়ী আর দালালেরা বিরাট এক দাবি করে বসল সেখানকার কারখানা-প্রধান জোব চার্নক আর তার সহকর্মীদের বিপক্ষে। ভারতীয় বিচারক ইংরেজদের বিপক্ষে দিল ৪৩,০০০ টাকার এক ডিক্রি (১৬৮৪-৮৫), যেহেতু চার্নক এই আদেশ মানতে অস্বীকার করল, মোগল সেনারা আক্রমণ করল তার কারখানা (অগাস্ট, ১৬৮৫)। কিন্তু পরবর্তী বছর হুগলিতে পালিয়ে গিয়ে সে নিল ইংরেজদের কার্যকলাপ পরিচালনার প্রধান ভার। যুদ্ধ শুরু হলো ছয় মাসের মধ্যে।

১৬৮৬ সালের অক্টোবরে তিনজন ইংরেজ স্থানীয় ফৌজদারের আদেশ অগ্রাহ্য করে ঢোকার চেষ্টা করল মোগল শহর হুগলির বাজারে, আর তাদের ধরে জখম করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো ফৌজদারের কাছে। গোলঘাটের কাছের ইংরেজ কারখানা থেকে তাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে গেল ক্যাপ্টেন লেসলি, আর ফিরে এল পিটুনি খেয়ে, জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ইংরেজ কারখানার চারপাশের খড়ের কুটির। কিন্তু শিগগিরই নদীপথে সাহায্য এসে পৌঁছাল ইংরেজ শিবিরে, জ্বালিয়ে দিল তারা ফৌজদারের বাড়ি আর তার ওপাশের শহর। সন্ধেয় হুগলিতে ইংরেজদের জাহাজ এসে দখল করল মোগলদের একটা জাহাজ, আর সারা রাত ও পরদিন ধরে চালাল গুলি আর লুটপাট । ফৌজদার পালিয়ে গেল ছদ্মবেশে; ভারতীয় পক্ষে মারা গেল ষাটজন সেনা, সেই সঙ্গে পুড়ে ছাই হলো চার বা পাঁচশো বাড়ি এবং অনেক বার্জ আর নৌকা।

শায়েস্তা খান ইংরেজদের হাতে হুগলি ধ্বংস হওয়ার কথা শুনে তাদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অশ্বারোহী বিরাট বিরাট দল গেল হুগলিতে, দেওয়া হলো পাটনার ইংরেজ কারখানা দখল করার আদেশ। ২০ ডিসেম্বর ইংরেজরা তাদের সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে হুগলি থেকে নদীপথে গিয়ে থামল ২৪ মাইল ভাটির সুতানটিতে (আধুনিক কলকাতা)।

যুদ্ধ আবার শুরু হলো ১৬৮৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ইংরেজরা পুড়িয়ে দিল মোগলদের মেটিয়াবুরুজের লবণ কারখানা, আর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নিল থানা দুর্গ। তারপর নদীপথে গিয়ে দখল করে নিল তারা মেদিনীপুর জেলার পুব উপকূলের হিজলি দ্বীপ-মারাত্মক ম্যালেরিয়ায় ভরা একটা জলাভূমি, কিন্তু প্রচুর পরিমাণে আছে সেখানে ফল, শস্য আর শিকার, আছে সাগরের পানি শুকিয়ে লবণ গড়ার কারিগর। পরবর্তী মার্চে ১৭০ জন ইংরেজ সেনা আর নাবিকের একটা দল নামল বালাসোরে, দখল করল মোগল দুর্গ, আর দুই দিন। লুটপাট চালানোর পর পুড়িয়ে দিল নতুন আর পুরাতন বালাসোর নামক দুটো। শহর। পুড়িয়ে দেওয়া হলো ডকে থাকা ভারতীয় জাহাজ এবং শাহজাদা আজম আর শায়েস্তা খানের দুটো জাহাজ নিয়ে যাওয়া হলো পুরস্কার হিসেবে।

১৬৮৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি আবদুস সামাদ নামক শায়েস্তা খানের। একজন লেফটেন্যান্ট ১২,০০০ সেনার একটা দল নিয়ে হিজলিতে এল ইংরেজদের তাড়িয়ে দিতে। ১১ জুন পতাকা উড়িয়ে আর ঢাক বাজাতে বাজাতে সমস্ত গোলাবারুদ নিয়ে হিজলি দুর্গ ত্যাগ করল ইংরেজরা। শায়েস্তা খান একটা চিঠিতে সাম্প্রতিক হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য ভসনা করলেন ইংরেজদের, কিন্তু একটা দুর্গ নির্মাণের অনুমতি দিলেন কলকাতার বিশ মাইল দক্ষিণের উলুবেড়িয়ায়, সেই সঙ্গে হুগলিতে বাণিজ্য। সুতরাং জাহাজ নিয়ে চার্নক এল সুতানটিতে (সেপ্টেম্বর, ১৬৮৭)।

পরবর্তী বছর ইংল্যান্ড থেকে ক্যাপটেন হিথ এল চার্নকের বদলে বাংলার প্রতিনিধি হয়ে। নতুন এই প্রধান বাংলা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬৮৮ সালের ৮ নভেম্বর কোম্পানির সমস্ত মানুষ আর সম্পদ জাহাজে তুলে ত্যাগ করল সুতানটি। ৩০০ সেনাসহ বালাসোরে গিয়ে ২৯ নভেম্বর ক্যাপ্টেন হিথ দখল করল পুরাতন বালাসোরের সর্ব পুবের মোগল দুর্গ। পরদিন নতুন বালাসোর দখল করে চরম দুর্ব্যবহার করল সে খ্রিষ্টান অ-খ্রিষ্টান নারী-পুরুষনির্বিশেষে । ১৬৮৯ সালের ১৮ জানুয়ারি চাটগায়ে পৌঁছে সেই দুর্গও সে ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করল মোগলদের হাত থেকে। যুদ্ধের একটা পরিষদ তাকে ত্যাগ করতে বলল উন্মাদ এই পরিকল্পনা, আর চুড়ান্ত বিরক্ত হিথ বাংলার যাবতীয় ভাবনা পেছনে ফেলে রেখে জাহাজ ভাসাল মাদ্রাজের উদ্দেশে (১৭ ফেব্রুয়ারি)।

এই সংবাদ শুনে সম্রাট আদেশ দিলেন সব ইংরেজকে গ্রেপ্তার করতে, তাদের কারখানাগুলো দখল করতে, আর বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে। কিন্তু সাগরে ইংরেজরা প্রচণ্ড শক্তিশালী, বন্ধ করে দিল তারা হজপালনের উদ্দেশ্যে মক্কাগামী জাহাজগুলো। এদিকে তাদের ব্যবসা বন্ধ থাকার ফলে রাজস্বও কমে গেল অনেক। সুতরাং একটা রফা করতে চাইলেন সম্রাট। ১৬৮৯ সালের মে মাসে বাংলার সুবাদার হয়ে আসা ইব্রাহিম খান ছিল একজন নম্র আর ন্যায়পরায়ণ মানুষ, ইংরেজদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। অবশেষে ১৬৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শান্তি স্থাপিত হলো মোগল সরকার আর পশ্চিম উপকূলের ইংরেজদের মধ্যে। ১৬৯০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আওরঙ্গজেব লিখেছেন, ইংরেজরা (সুরাটের] বশ্যতা স্বীকার করেছে…আর তারা এ রকম লজ্জাকর আচরণ করবে না…জরিমানা হিসেবে তারা সম্রাটকে দেবে ১,৫০,০০০ টাকা…সম্রাট তাদের ক্ষমা করে সম্মত হয়েছেন…যে আবার তারা বাণিজ্য করবে অতীত দিনের মতোই। এই রফার পর সম্রাট ২৩ এপ্রিল ইব্রাহিম খানকেও চিঠি দিয়েছেন যেন ইংরেজরা অবাধে বাংলায়ও বাণিজ্য করতে পারে।

আবার প্রতিনিধি হয়ে ২৪ আগস্ট মাদ্রাজ থেকে জোব চার্নক এল সুতানটি। এটাই ছিল কলকাতার, সেই সঙ্গে উত্তর ভারতে ব্রিটিশ শক্তির প্রতিষ্ঠা। ১৬৯১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধান উজির মারফত বাংলার দেওয়ানের কাছে সম্রাটের আদেশ (হসব-উল-হুঁকুম) এল, যেন ইংরেজরা এই প্রদেশে অবাধে বাণিজ্য করতে পারে যাবতীয় শুল্কের পরিবর্তে বার্ষিক ৩,০০০ টাকা প্রদানের বিনিময়ে।

১৭.১০ ইংরেজ আর মোগলদের পশ্চিম উপকূলের যুদ্ধ

বাংলার মতোই ভারতের পশ্চিম উপকূলেও ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ভুগছিল মোগল সরকারের স্থানীয় অফিসারদের কারণে। বিরোধ চলতেই থাকল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় প্রতিনিধিরা এটার কোনো সমাধান খুঁজে পেল না।

অবশেষে ১৬৮৮ সালের ৯ অক্টোবর ভারতে কোম্পানির সমস্ত কারখানার প্রধান পরিচালক স্যার জন চাইল্ড একটা নৌবহর নিয়ে এল সোয়ালিতে, আর ক্ষতিপূরণ চাইল সুরাটের শাসকের কাছ থেকে। শাসক খোলাখুলি উগ্রতা প্রদর্শন করে বন্দী করল কয়েকজন ইংরেজ আর তাদের ভারতীয় দালালকে, তারপর সোয়ালিতে একটা বাহিনী পাঠাল চাইল্ডকে পাকড়াও করতে। চাইল্ড পালাল এবং প্রতিশোধ নিতে সুরাটের নিচের নদীমুখ বন্ধ করে দিয়ে উপকূলের দিকে গিয়ে ভারতীয় যে জাহাজ পেল, সেটাকেই দখল করল।

মোগল সরকার বন্দী ইংরেজদের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে রাখল ১৬ মাস (ডিসেম্বর ১৬৮৮- এপ্রিল ১৬৯০)। একই সময় মোগল নৌসেনাপতি হিসেবে জানজিরার সিদ্দি বোম্বেতে একটা আক্রমণ চালিয়ে (মে, ১৬৮৯) দখল করে নিল দ্বীপটার বাইরের অংশ। সুতরাং চাইল্ড একদম নত হয়ে ক্ষমা চেয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে একটা মিশন পাঠাল (১০ ডিসেম্বর, ১৬৮৯) জি. ওয়েলডন। আর আব্রাহাম নাভারোর অধীনে। সম্রাট একটা আদেশের মাধ্যমে তাদের ক্ষমা করলেন ১৬৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ইংরেজরা আগের মতোই ভারতে তাদের বাণিজ্যের অধিকার ফিরে পেল দেড় লাখ টাকা জরিমানা প্রদান করে।

১৭.১১ ভারত মহাসাগরে ইয়োররাপিয়ান জলদস্যু, সপ্তদশ শতাব্দী

ভারত মহাসাগরে ইয়োররাপিয়ান জলদস্যুতার সূত্রপাত হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষে ভাস্কো ডা গামার আগমনের মাধ্যমে। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে বৃদ্ধি পেল ভারতীয় বাণিজ্য আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেল বিভিন্ন জাতির জলদস্যুতা।

১৬৩৫ সালে ইংল্যান্ডের ১ম চার্লসের ছাড়পত্র নিয়ে এসে লোহিত সাগরের মুখে দুটো মোগল জাহাজে লুটপাট চালাল কব নামক এক জাহাজের ক্যাপ্টেন। ১৬৩৮ সালে একই রাজার অনুমতি নিয়ে এসে চারটে জাহাজ পাঠাল স্যার উইলিয়াম কুর্টেন, এবং সেগুলো অত্যাচার চালাল ভারতীয় জাহাজ আর নাবিকদের ওপর। স্বদেশিদের এসব দুষ্কর্মের জন্য সুরাটের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিরীহ কর্মচারীদের বন্দী করে রাখা হলো দুই মাস, আর মুক্তি দেওয়া হলো ১,৭০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের পর।

সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জলদস্যুতা আরও বাড়ল। এসব জলদস্যুর। বেশির ভাগই ছিল ইংরেজ, এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল টিচ, ইভরি, কিড, রবার্টস, ইংল্যান্ড আর টিউ…তিন বছরে রবার্টস একাই ধ্বংস করেছিল ৪০০ বাণিজ্য জাহাজ। উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা জলদস্যুদের এসব অপকর্ম দেখেও না দেখার ভান করত, তারা পেত লুটের ভাগ। অন্যান্য জাতির জলদস্যুরাও লুটপাট চালাত ইংরেজদের ছদ্মবেশে। দেশীয় কর্মচারীরা সৎ ব্যবসায়ী আর দস্যুদের আলাদা করে চিনতে না পেরে দুষ্কর্মের দায় চাপাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের ওপর।

সবচেয়ে কুখ্যাত জলদস্যু ছিল হেনরি ব্রিজম্যান, যে ছদ্মনাম নিয়েছিল ইভরি। ১৬৯৪ সালে ৩০ মে স্প্যানিশ সরকারের ভাড়া করা ইংরেজ একটা জাহাজে মেট থাকার সময় অফিসারদের পরাজিত করে জাহাজটার নতুন নাম সে দেয় ফ্যান্সি, এবং ৪৬টা বন্দুক আর ১৫০ জন যোদ্ধাসহ বেছে নেয় জলদস্যুর। জীবন। তার সবচেয়ে বড় অর্জন গঞ্জ-ই-সওয়াই দখল, মোগল সম্রাটের এই জাহাজটা ছিল সুরাট বন্দরের সবচেয়ে বড় জাহাজ।

সুরাটের রাজ্যপাল ইতিমাদ খান ছিল ইংরেজদের বন্ধু, একজন অতুলনীয় সৎ মানুষ, অনেক নিরীহ মানুষকে সে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছে। বোম্বের রাজ্যপাল স্যার জন গেয়ার বারবার সম্রাট আর ইতিমাদ খানকে লিখে জানিয়েছে, ‘আমরা ব্যবসায়ী, জলদস্যু নই।’

১৭.১২ ইয়োররাপিয়ান ব্যবসায়ীদের জন্য আওরঙ্গজেবের কর্মপন্থা

আওরঙ্গজেব সবই লক্ষ করলেন কিন্তু তিনি অনেক জ্ঞানী মানুষ, আবেগতাড়িত হয়ে চট করে কোনো কাজ করে ফেলার মতো নন। প্রথমে তিনি চাইলেন যেসব জাহাজে করে মানুষ মক্কায় হজ করতে যায়, সেগুলোতে পাহারা বসানো হোক।

ওলন্দাজেরা প্রস্তাব দিল যে মোগল সাম্রাজ্যে যদি তাদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য করতে দেওয়া হয়, আরবগামী তীর্থযাত্রীদের জাহাজ তারা জলদস্যু মুক্ত রাখবে। সম্রাট তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। সুরাটের ইংরেজ পরিষদের সভাপতি অ্যানেসলি আরব সাগরে ভারতীয় জাহাজের নিরাপত্তার ভার নিতে চাইল ইংরেজদের বার্ষিক চার লাখ টাকা প্রদানের বিনিময়ে। সম্রাট দর-কষাকষি করে তা নামিয়ে আনলেন অর্ধেকে, কিন্তু এই শর্তে যে তীর্থযাত্রীদের যাতায়াত, অর্থাৎ, উভয় দিকের যাত্রার নিরাপত্তা দেখতে হবে। অবশেষে একটা মুচলেকায় স্বাক্ষর করল অ্যানেসলি, ইংরেজ বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হলো ১৬৯৬ সালের ২৭ জুন।

ইতিমাদ খান মারা গেল ১৬৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে, আর তার স্থলাভিষিক্ত হলো আমানত খান নামক বিচারহীন আর অত্যাচারী এক মানুষ। ১৬৯৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সুরাটের কারখানা ঘেরাও করে অ্যানেসলিকে সে বলল সম্রাটের দাবি মেনে নিতে বা দশ দিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যেতে। ওলন্দাজ আর ফরাসিদের সঙ্গেও সে একই রকম দুর্ব্যবহার করল । ইতিমধ্যে কারখানাগুলোকে পৃথক করে ফেলা হলো, যেসব ভারতীয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল তাদের বেঁধে চাবকানো হলো শাসকের আদেশে। ১৬৯৮ সালের আগস্টে এই মর্মে সম্রাটের একটা আদেশ এল যে সাগরে হওয়া যাবতীয় ক্ষতির জন্য ইংরেজ, ফরাসি আর ওলন্দাজদের দায়ী হতে হবে, এবং সে জন্য এই তিন জাতিকে প্রদান করতে হবে মোট ১৪ লাখ টাকার একটা খেসারত।

শেষমেশ ইংরেজ, ফরাসি আর ওলন্দাজেরা মিলিতভাবে জলদস্যু দমন করতে সম্মত হয়ে একটা মুচলেকায় স্বাক্ষর করল, আর আওরঙ্গজেব তখন সুরাটের শাসককে লিখলেন বিষয়টি তার নিজের মতো করে নিস্পত্তি করতে। চুক্তির শর্তানুসারে, মক্কার তীর্থযাত্রীদের পাহারা আর লোহিত সাগরে টহল দেওয়ার পাশাপাশি ওলন্দাজেরা সুরাটের শাসককে প্রদান করবে ৭০,০০০ টাকা; ইংরেজরা ৩০,০০০ টাকা প্রদানের পাশাপাশি টহল দেবে দক্ষিণ ভারতীয় সাগরে; ফরাসিরাও পাহারা দেবে পারস্য উপসাগরে ইংরেজদের সমপরিমাণ টাকা প্রদানের পাশাপাশি’ (মার্চ, ১৬৯৯)।

১৭০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্যার জন গেয়ারকে বন্দী করল আমানত খান। ১৭০২ সালে জানুয়ারির এক হিসাবে দেখা গেল, সুরাটে বন্দীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৯ জন, যাদের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ২১ জন ইংরেজ কর্মচারী আর ১৫ জন নাবিক।

১৭০৩ সালের ২৮ আগস্ট আবদুল গফুর আর কাশিম ভাইয়ের দুটো জাহাজ দখল করল জলদস্যুরা। সংবাদ পেয়ে শাসক ইতিবার খান ইংরেজ কোম্পানির সব ভারতীয় দালালকে আটক করে পুরনো ইংরেজ কোম্পানির দালাল বিট্টাল আর কেশব পারেখের কাছ থেকে আদায় করল তিন লাখ টাকা এবং আরও তিন লাখ টাকা আদায় করল ওলন্দাজদের দালালের কাছ থেকে। এসবই ইতিবার খান করল তার পূর্ববর্তী শাসক আমানত খানের ১৬৯৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজদের থেকে নেওয়া খেসারতের মুচলেকার বলে। সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব বিরত করলেন ইতিবার খানকে, সেই সঙ্গে অগ্রাহ্য করলেন ১৬৯৯ সালের বলপূর্বক নেওয়া মুচলেকা।

কিন্তু সত্যি বলতে কি, ইয়োরোপিয়ানদের শান্তি বলে কিছু ছিল না। অবশেষে আওরঙ্গজেব উপলব্ধি করতে পারলেন যে সাগরে ঘটা কার্যকলাপের প্রশ্নে তিনি নিতান্তই অসহায়, তাঁর প্রজাদের নিরাপদে হজব্রত পালন করতে দেওয়ার খাতিরে ইয়োরোপিয়ানদের কাছে তাঁর অবশ্যই করতে হবে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। সেই ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশই দিলেন তিনি নেজাবত খানকে, সব বন্দীকে মুক্ত করে দেওয়ার পর, সেই সঙ্গে নিষেধ করলেন যেন ভবিষ্যতে ইয়োরোপীয়দের কাছ থেকে কোনো খেসারতের মুচলেকা আদায় করা না হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *