১৬. আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ পর্ব

১৬. আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ পর্ব

১৬.১ মারাঠি সরকারের কূটনীতি, ১৬৮৯-৯৯

নতুন মারাঠি রাজা, রাজারাম মাদ্রাজ উপকূলে পালিয়ে যাওয়ার পর (জুলাই, ১৬৮৯), মহারাষ্ট্রের যাবতীয় কাজকর্মের ভার পড়ল মন্ত্রীদের হাতে। উল্লেখ্যযোগ্য জ্ঞান আর তৎপরতার সঙ্গে দেশ চালাতে লাগল পশ্চিমের প্রতিনিধি রামচন্দ্র নীলকান্ত।

লাম্পট্যে গা ভাসিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রাজারাম ছিল মানসিকভাবে দুর্বল। তার অবস্থান তাকে ক্ষমতাহীন করে ফেলেছিল। সমস্ত মারাঠি সর্দার যেত তাদের রাজার কাছে, রাজা তাদের ভূষিত করত বিভিন্ন উপাধিতে, দিত সেনা পরিচালনার ভার, লুট করার সুবিধা, চৌথ আরোপ করার অধিকার । অহংকারী আর স্বার্থপর প্রধানদের অখুশি করার ক্ষমতা তার ছিল না। তার এগারো বছরের স্বল্প রাজত্বকালে সেনাপতিদের পদ বদল হয়েছে পাঁচবার, এমনকি একই সঙ্গে পাঁচজন ভোগ করেছে সেনাপতির সমান অধিকার।

কিন্তু কর্তৃত্বের এই বিকেন্দ্রীকরণ খাপ খেয়ে গেছে মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতির সঙ্গে। গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে মারাঠি ক্যাপ্টেনেরা সমূহ ক্ষতিসাধন করেছে মোগল ভূখণ্ডে। সাম্রাজ্যবাদীরা কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি যে মারাত্মক ক্ষতি করতে গেলে শত্রুদের ঠিক কোন অবস্থানে আঘাত হানতে হবে । মারাঠি ভ্রাম্যমাণ দলগুলো চালাত অপ্রত্যাশিত আক্রমণ, আর এ রকম ভ্রাম্যমাণ দল ছিল তাদের অসংখ্য। তাদের আক্রমণে সর্বজনীন এক অস্থিরতা বিরাজ করত দাক্ষিণাত্য জুড়ে।

মহারাষ্ট্র আর জিনজির দরবারের মন্ত্রীদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক ঈর্ষা। পরশুরাম ত্রিম্বক এক দলাদলির সৃষ্টি করে পক্ষে টেনেছিল সান্তাজী ঘোড়পারেকে। এবং সেটার স্বাভাবিক পরিণতিতে ধানা সিংহ যাদবের পক্ষ নিয়েছিল রামচন্দ্র। সান্তা ঘোড়পারে আর ধানা সিংহ যাদবের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ১৬৯৬ সালে ত্বরান্বিত করেছিল একটা গৃহযুদ্ধ, তাদের মধ্যে তিনটে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু মারাঠিদের অভ্যন্তরীণ এই কলহ মোগলদের খুব বেশিদিন স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি।

রামচন্দ্র বুদ্ধিমানের মতো মারাঠি প্রতিদ্বন্দ্বীদের আশ্রয় দিয়েছিল দক্ষিণ কঙ্কান আর পর্তুগিজ ভূখণ্ড দমনে, যেখানে আজও যায়নি মোগল সেনাবাহিনী, এ ছাড়া আশ্রয় দিয়েছিল বেরাদদের দেশে আর মহীশূরের উত্তর-পশ্চিম কোণে, যেখানে আক্রমণ করার ফুরসত সম্রাটের আজও হয়নি।

১৬.২ রানি-মাতা হিসেবে তারা বাইয়ের শাসন; মারাঠা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ

১৭০০ সালের ২ মার্চ রাজারাম আর তারপর তিন সপ্তাহ শাসন করে তার জারজ পুত্র কর্ণ মারা যাওয়ার পর তারা বাই তার দশ বছরেরও কমবয়সী পুত্র শিবাজীকে সিংহাসনে বসিয়ে শাসন করতে লাগল পরশুরাম ব্রিম্বকের সহায়তায়। ফলে কোনো মন্ত্রী নয়, মহারাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরিচালিকা শক্তি হলো স্বামীর সম্পত্তি ভোগকারিণী বিধবা রানি তারা বাই মোহিতে। তার প্রশাসনিক তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর। চারিত্রিক দৃঢ়তা জাতিকে রক্ষা করল এই সংকট থেকে।

প্রতিকূল মনোভাবাপন্ন মুসলমান ঐতিহাসিক খাফি খান বলতে বাধ্য হয়েছেন। যে সে ছিল জ্ঞানী, উদ্যমী, প্রশাসনে দক্ষ এবং সেনাবাহিনীতে জনপ্রিয়। তারা বাইয়ের পরিচালনায় প্রতিদিন বেড়ে চলল মারাঠি কার্যকলাপ । নিজের হাতে নিল সে বেশ কিছু কাজ-সেনাপতিদের নিয়োগ ও পরিবর্তন, দেশের কৃষি, মোগল ভূখণ্ডে আক্রমণের পরিকল্পনা।

রাজারামের মৃত্যুর পরপরই সাতারার অন্য মন্ত্রীদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে নিজ দুর্গ পার্লি থেকে বেরিয়ে পরশুরাম জিম্বক যোগ দিতে চেয়েছিল মোগলদের সঙ্গে। কিন্তু তারা বাই অত্যন্ত যোগ্য এই অফিসারকে পক্ষে আনে। তাকে প্রতিনিধির পদ দিয়ে। অবশ্য তারা বাই তার সর্বময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল বেশ ঝামেলার পর । সেনাপতিদের কেউ কেউ তাকে মেনেছে, আবার। কেউ কেউ মানেনি । রাজারামের ছোট স্ত্রী রজস বাই তার ছেলে ২য় শম্ভুজীকে সিংহাসনে বসানোর স্বার্থে কলহ করেছে তারা বাইয়ের সঙ্গে। মারাঠি নেতাদের তৃতীয় একটা দল শাহুকে সিংহাসনে বসাতে চেয়েছে শিবাজীর উত্তরাধিকারীদের জ্যেষ্ঠ শাখার প্রতিনিধি হিসেবে। বংশগত এই কলহ জটিলতর হয়েছে মারাঠি। সেনাপতিদের মতানৈক্য, বিশেষ করে ধানা সিংহ যাদব আর সান্তা ঘোড়পারের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

১৬.৩ শাহুর বন্দিজীবন, ১৬৮৯-১৭০৭; মোগলদের মারাঠি অনুসারী

১৬৮৯ সালের অক্টোবরে যখন রাইগড় আত্মসমর্পণ করল, শম্ভুজীর বড় ছেলে সাত বছরের শাহু বন্দী হলো মোগলদের হাতে। কড়া নজরে রাখা হলেও তার সঙ্গে করা হলো সহানুভূতিশীল আচরণ, সঙ্গে রইল মা যেসু বাই আর তার দুই সৎ ভাই মদন সিংহ আর মধু সিংহ।

১৭০০ সালে শাহু আক্রান্ত হলো মারাত্মক এক রোগে, তা থেকে জীবনটা বাঁচলেও শারীরিক আর মানসিকভাবে সে কখনোই পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি। দরবারের হস্তলিখিত বিবরণীতে বলা হয়েছে-২৬ আগস্ট শাহু সর্বসমক্ষে আসার পর সম্রাট তাকে দেখে মন্তব্য করলেন যে তার শরীরের রং পুরোপুরি হলুদ হয়ে গেছে, আর জানতে চাইলেন এ রকম হওয়ার কারণ। হাফেজ অম্বর (খোঁজা) জবাব দিল যে রাজা রান্না করা কোনো ডাল, রুটি বা ভাত খায় না, সে খায় কেবল মিষ্টি (পাকোয়ান), কারণ, বন্দী অবস্থায় হিন্দুদের একেবারেই রান্না করা খাবার খাওয়া উচিত নয় এবং রাজা নিজেকে একজন বন্দীই মনে করে।

যখন মনে হলো যে দাক্ষিণাত্যের জট আর কিছুতেই খুলবে না, আওরঙ্গজেব শাহুর মাধ্যমে সেই জট খোলার একটা চেষ্টা করলেন। প্রথমে ১৭০৩ সালের ৯ মে তিনি হামিদ-উদ-দীন খানকে পাঠালেন শাহুকে মুসলমান হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে । কিন্তু শাহু স্বধর্ম ত্যাগ করতে রাজি হলো না। তারপর সম্রাট মারাঠিদের মধ্যে একটা বিভক্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলেন শাহুকে মুক্তি দিয়ে। কথা হলো, মারাঠি সেনাপতিদের সঙ্গে একটা সন্ধি করার চেষ্টা চালাবেন শাহজাদা কাম বখশ। কিন্তু এই পদক্ষেপও ব্যর্থ হলো। ভীমসেন লিখেছেন- শাহজাদা বারবার লোক পাঠালেন ধানার কাছে। কিন্তু যেহেতু মারাঠিরা পরাজিত হয়নি, পুরো দাক্ষিণাত্য প্রায় এসে গেছে তাদের হাতের মুঠোয়, তারা সন্ধি করতে যাবে কোন দুঃখে?…হতাশ হয়ে ফিরে এল শাহজাদার কূটনীতিকেরা, আর রাজা শাহুকে আবার বন্দী করা হলো।’

অসহায় বোধ করলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর জীবনের শেষ বছরে (১৭০৭) মারাঠিদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের আরেকটা চেষ্টা করলেন তিনি, শাহুকে মুক্তি দিয়ে নিজের তাঁবু থেকে নসরত জংয়ের তাঁবুতে স্থানান্তর করে (২৫ জানুয়ারি)। নসরত জং চিঠি পাঠিয়ে মারাঠি সেনাপতিদের রাজা শাহুর সঙ্গে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। কোনো কাজ হলো না।

এই কথা সত্য নয় যে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় মারাঠিদের নেতৃস্থানীয় পরিবারগুলোর সব জাতির পক্ষে ছিল । শিবাজীর মা যে বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিল, সিন্ধখেদের সেই যাদব রাওদের পরিবারের সবাই মোগল সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল শাহজাহানের রাজত্বকালে (১৬৩০); কঙ্গোজী শার্কি আর নাগোজী মানে ছিল মোগলদের অনুসারী; মারাঠিদের আরও তিনজন-অবজী আধাল (খানাপুরের থানাদার), রামচন্দ্র (খাটাউয়ের থানাদার), আর বাহারজী পান্ধেরে (কখনো কখনো কাশীগার থানাদার), ছিল মোগলদের নিবেদিত কর্মচারী।

তবে মারাঠিদের এসব মোগল অনুসারী সম্রাট-বাহিনীর তেমন সহায়তায় আসেনি। তাদের সাধারণত সেনাবাহিনীতে নেওয়া হতো দুষ্কর্ম থেকে বিরত রাখার খাতিরে।

১৬.৪ আওরঙ্গজেবের সাতারা অবরোধ

১৬৯৯ সালের ১৯ অক্টোবর ইসলামপুরী থেকে আওরঙ্গজেব রওনা দিলেন মারাঠিদের দুর্গ দখল অভিযানে। ইসলামপুরীতে আওরঙ্গজেব রেখে গেলেন স্ত্রী উদিপুরী, পুত্র কাম বখশ, কন্যা জিনাত-উন-নিসা, অতিরিক্ত মালপত্র, অপ্রয়োজনীয় কর্মচারী এবং সেনা আর পরিচারকদের পরিবার। তাদের দায়িত্বে থাকল উজির আসাদ খান। ইসলামপুরীর আশপাশের ভ্রাম্যমাণ মারাঠি বাহিনীর মোকাবিলায় রইল জুলফিকার ওরফে নসরত জং।

ইসলামপুরী থেকে রওনা দিয়ে ২১ নভেম্বর সম্রাট পৌঁছালেন সাতারার ২১ মাইল দক্ষিণের মসুরে। আতঙ্কিত হয়ে মসুরের ৬ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের ছোট একটা দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেল সেখানকার গ্যারিসন, বসন্তগড় নামক সেই দুর্গে সম্রাট-বাহিনী প্রবেশ করল ২৫ নভেম্বর আর সেটার নাম রাখল ‘সাফল্যের চাবি’।

সাম্রাজ্যবাদীরা সাতারা পৌঁছাল ৮ ডিসেম্বর। আওরঙ্গজেব শিবির পাতলেন দুর্গপ্রাকারের দেড় মাইল উত্তরের করনজা গ্রামে। মোগল সেনাবাহিনী আর মালবাহী পশুগুলোকে রাখা হলো এক জায়গায়, আর মারাঠিরা যেন আক্রমণ করতে না পারে সে জন্য জায়গাটার চারপাশে তোলা হলো দেয়াল। অবরোধ শুরু হলো ৯ ডিসেম্বর।

অনেক ছোটখাটো আক্রমণ পাল্টা আক্রমণের পর ১৩ এপ্রিল বিস্ফোরিত হলো তরবিয়াত খানের বসানো দুটো মাইন। প্রথমটা খতম করে দিল গ্যারিসনের অনেককে, দেয়ালের ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে জীবিত টেনে বের করা হলো হাওলাদার প্রাগজী প্রভুকে। দ্বিতীয়টা ধ্বংস করল একটা টাওয়ার, মারা পড়ল দেয়ালের কাছে গাদাগাদি করে থাকা মোগল সেনার প্রায় দুশোজন। এই বিস্ফোরণে উড়ে গেল দেয়ালের বিশ গজ চওড়া একটা জায়গা।

ইতিমধ্যে রাজারাম মারা গেছে (মার্চ), তাই বশ্যতার প্রস্তাব দিল মন্ত্রী পরশুরাম। তরবিয়াত খান ধ্বংস করে দিয়েছিল দুর্গপ্রাকারের ৭০ গজ, মাইন বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল গ্যারিসনের ৪০০ জন। এতে ভেঙে পড়ল সাতারার কিলাদার শুভানজী, আর সম্রাটের সঙ্গে আত্মসমর্পণের শর্ত স্থির করল শাহজাদা আজমের মধ্যস্থতায়। ২১ এপ্রিল তার দুর্গের মাথায় সে তুলে দিল সাম্রাজ্যিক পতাকা, আর গ্যারিসনসহ দুর্গ ত্যাগ করল পরদিন। শাহজাদা মুহম্মদ আজমের সম্মানার্থে দুৰ্গটার নতুন নাম রাখা হলো আজমতারা। ১৬.৫ পার্লি দুর্গ দখল এই ঘটনার পরপরই মোগলরা অবরোধের জন্য ট্রেঞ্চ খুঁড়তে লাগল সাতারার ৬ মাইল পশ্চিমের পার্লি দুর্গের সামনে। মারাঠি সরকারের প্রধান রাজস্ব অফিসার পরশুরাম রাজারামের মৃত্যু আর সাতারার পতনের পর হতাশ হয়ে পালিয়ে গেল পার্লি থেকে, তবু দুর্গের প্রতিরক্ষা চালিয়ে গেল অধীনস্তরা।

তুমুল বৃষ্টি আর শস্য ও পশুখাদ্যের অভাবে চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হলো অবরোধকারীরা। কিন্তু আওরঙ্গজেব অটল। অবশেষে আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে বসতে হলো পার্লির কিলাদারকে, আর দুর্গ খালি করে দিল সে (৯ জুন) ঘুষের বিনিময়ে।

এই দুই অবরোধের ফলে সম্রাট-বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলো, হারাল তারা অনেক মানুষ, ঘোড়া আর মালবাহী পশু। মে মাসের শুরুতে ভারী আর নজিরহীন এক বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে চলল জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত। ২১ জুন শুরু হলো ফিরতি যাত্রা, সেনাদের অবস্থা এবার শোচনীয় হয়ে পড়ল। বেশির ভাগ মালবাহী পশুই মারা গিয়েছিল অবরোধের সময়, টিকে থাকা গুটিকয় গাড়ি টানা বলদ আর হাতির হাড় এবং চামড়া ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। উচ্চবংশজাত অনেক মানুষকে কাদার ভেতর দিয়ে হেঁটে চলতে হলো মাইলের পর মাইল। এক দিনে তারা এগোতে পারল মাত্র ৩ মাইল করে। ২৫ জুলাই পৌঁছাল তারা ভূষণগড় । তারপর ১৭০০ সালের ৩০ অগাস্ট সম্রাট শিবির স্থানান্তরিত হলো ৩৬ মাইল দূরবর্তী খাবাসপুরের মান নদীর কাছে। সেনারা তাঁবু পাতল দুই তীর, এমনকি নদীর শুকনো বুকে। ১ অক্টোবর রাতে সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন, পাহাড়ে অসময়ের ভারী বৃষ্টিতে ঢল নামল নদীতে। মারা গেল অনেক মানুষ আর পশু।

মধ্যরাতের সামান্য আগে ঢলের প্রথম পানি শিবিরে আঘাত হানতে ভীষণ এক হইচই শুরু হলো সেনাদের মধ্যে। মারাঠিরা শিবির আক্রমণ করেছে ভেবে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে সরে গেল সম্রাটের ডান হাঁটুর হাড়। ডাক্তাররা সেটাকে আর ভালোভাবে যথাস্থানে বসাতে পারেনি, ফলে জীবনের বাকি কয়েকটা বছর তাঁকে হাঁটতে হয়েছে সামান্য খুঁড়িয়ে। দরবারের চাটুকারেরা সম্রাটকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছে যে এটা তাঁর পূর্বপুরুষ বিশ্ব বিজয়ী তৈমুর লংয়ের ঐতিহ্য!

১৬.৬ পানহালা অবরোধ, ১৭০১

আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্যস্থল হলো পানহালা। সম্রাট সেখানে পৌঁছালেন ১৭০১ সালের ৯ মার্চ, আর ঘিরে ধরলেন পানহালা আর সেটার সঙ্গের দুর্গ পবনগড়। এই সময় সম্রাটের সর্বোচ্চ দুই সেনাপতি নসরত জং এবং ফিরুজ জংয়ের কুখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে যোগ হলো তরবিয়াত খান এবং ফতুল্লাহ খানের বিশ্রী এক ঈর্ষা। ফলে অযথা অবরোধ দীর্ঘ করল তারা দুই মাস। বর্ষার আগেই পানহালা পাওয়ার জন্য মোটা ঘুষ দেওয়া হলো কিলাদার ম্বিককে, আর দুর্গ হস্তান্তর করা হলো ১৭০১ সালের ২৮ মে।

পানহালার পতনের পর আওরঙ্গজেব ফিরতি পথ ধরে (২৯ মে, ১৭০১) শিবির ফেললেন সাতারার ২৫ মাইল পুবের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আর উর্বরা অঞ্চল খাটাউতে।

ফতুল্লাহ খানকে অনেক উচ্চস্তরের বাহাদুর’ খেতাবে ভূষিত করে পাঠানো হলো খাটাউয়ের ৮ মাইল উত্তর-পশ্চিমের ওয়ার্ধনগড় এবং আশপাশের অন্য তিনটে দুর্গ-চন্দন, নন্দগির আর ওয়ান দখল করতে।

১৬.৭ খেলনা অবরোধ

তারপর সম্রাট রওনা দিলেন খেলনা (বা বিশালগড়) জয় করতে। দুৰ্গটা পানহালার ৩০ মাইল পশ্চিমে, শাহজাদ্রি পাহাড়ের চূড়ায় সাগর থেকে ৩,৩৫০ ফুট উঁচুতে, পশ্চিমে দেখা যায় কঙ্কানের সমভূমি। সপ্তদশ শতাব্দীতে পাহাড়গুলো ছিল ঘন গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ে আবৃত। দুৰ্গটায় যাওয়ার সহজতম পথ ছিল ৫ মাইল উত্তরের অম্বা গিরিপথ ধরে। কিন্তু সেই পথ ছিল এতই উঁচু-নিচু আর সরু যে সেদিক দিয়ে ঘোড়াও সহজে যাতায়াত করতে পারত না।

২৬ ডিসেম্বর অবরোধ শুরু করল আসাদ খান। ১৭০২ সালের ১৬ জানুয়ারি সম্রাটের শিবির পড়ল খেলনার ১ মাইল দূরে। অবরোধ চলল পাঁচ মাস (জানুয়ারি-জুন, ১৭০২)। এই বছর বেরার আর তেলেঙ্গানায় নসরত জং তাড়িয়ে বেড়াল মারাঠিদের, করল ১৯টা বড় বড় যুদ্ধ আর অসংখ্য ছোটখাটো লড়াই। শাহজাদা বিদার বখতের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের ঘুষ নিয়ে ৪ জন দুর্গে সাম্রাজ্যিক পতাকা ওড়াল কিলাদার পরশুরাম, আর সেখানকার গ্যারিসন দুর্গ খালি করে দিল ৭ জুন রাতে।

ফিরতি পথে সম্রাট-বাহিনীর দুর্দশার সীমা রইল না। অনেক ক্ষয়ক্ষতির পর ফিরল তারা পানহালার কাছে (১৭ জুলাই, ১৭০২)।

শেষমেশ ১৭০২ সালের ১৩ নভেম্বর মোগলেরা পৌঁছাল ভীমার উত্তর তীরের বাহাদুরগড় বা পেডগায়ে।

১৬.৮ কোন্দানা (সিংহ-গড়), রাজগড় ও তোরনা অবরোধ

মাত্র ১৮ দিন অবস্থান করার পর ২ ডিসেম্বর সম্রাট বেরিয়ে পড়লেন কোন্দানা (সিংহগড়) দখল করতে আর সেখানে পৌঁছালেন ২৭ ডিসেম্বর। সম্রাটের পরিবার, দপ্তর, ভারী মালপত্র ইসলামপুরী থেকে স্থানান্তরিত করা হলো বাহাদুরগড়ে, আর ইসলামপুরীকে করা হলো নসরত জংয়ের সেনানিবাস। শাহজাদা বিদার বখতকে পাঠানো হলো আওরঙ্গাবাদের শাসক করে, আর পরে (ফেব্রুয়ারি, ১৭০৩) তাকে দেওয়া হলো খান্দেশের সুবাদারি। অবরোধ শুরু হলো, কিন্তু অবরোধকারীদের কাজে কোনো প্রাণ না থাকায় কেটে গেল তিনটে মাস। এগিয়ে আসছে ভয়াবহ বর্ষাকাল। সুতরাং সম্রাটের কর্মচারীরা কিলাদারকে বিপুল ঘুষ দিয়ে, দুর্গ হস্তগত করল ১৭০৩ সালের ৮ এপ্রিল।

কোন্দানা থেকে সেনাবাহিনী এক সপ্তাহের মধ্যে পিছিয়ে গেল পুনায়, আর তার আশপাশে থাকল প্রায় সাত মাস। ১৭০২ সালের মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পর ১৭০৩-৪ সালে হলো একটা দুর্ভিক্ষ, আর সেটার হাত ধরাধরি করে এল মহামারী। অসংখ্য গরিব মানুষ মারা গেল, মানুচির মতে বিশ লাখ ।

পুনা থেকে মোগল সেনাবাহিনী রাজগড়ে পৌঁছাল ১৮ দিনে, তাদের অবরোধ শুরু হলো ১৭০৩ সালের ২ ডিসেম্বর। গ্যারিসনের দুই প্রধান ফিরংজী আর হামিনজী ভেতরের দুর্গে গিয়ে প্রতিরোধ চালাল আরও দশ দিন। অবশেষে কিলাদার আত্মসমর্পণের শর্ত স্থির করে তার টাওয়ারের ওপর সাম্রাজ্যিক পতাকা তুলে পালিয়ে গেল রাতে (১৬ ফেব্রুয়ারি)।

এবার আওরঙ্গজেব ২৩ ফেব্রুয়ারি অবরোধ করলেন রাজগড়ের ৮ মাইল দূরের তোরনা। ১০ মার্চ রাতে আমানুল্লাহ খান মাত্র ২৩ জন মাবল পদাতিকসহ দড়ির মই বেয়ে নিঃশব্দে দুর্গপ্রাকার পেরিয়ে ভেরী বাজিয়ে আক্রমণ করল শত্রুকে। যারা প্রতিরোধ করতে এল, মারা পড়ল তাদের সবাই। গ্যারিসনের বাকিরা ভেতরের দুর্গে পালিয়ে গিয়ে দয়া ভিক্ষা করতে লাগল । এই একটামাত্র মারাঠি দুর্গই কেবল আওরঙ্গজেব ঘুষের বদলে জয় করলেন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে।

তোরনা থেকে সম্রাট-শিবির চাকনের ৭ মাইল উত্তরের খেদে এসে অবস্থান করল ছয় মাস, ১৭০৪ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ২১ অক্টোবর। এখান থেকে ২২ অক্টোবর সম্রাট রওনা দিলেন বেরাদের রাজধানী ওয়াজিনজেরার উদ্দেশে, আর ধীরে ধীরে এগিয়ে সাড়ে তিন মাস পর সেখানে পৌঁছালেন ১৭০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি । এটাই ছিল আওরঙ্গজেবের সর্বশেষ অভিযান।

১৬.৯ বেরাদের মানুষ আর তাদের দেশ আর সর্দার

বিজাপুর শহরের পুবে বিস্তৃত, ভীমা আর কৃষ্ণ নদী ঘেরা যে দেশ, সেটাই বেরাদদের বাসস্থান। আদিম এই কানারিদের বেদ বলেও ডাকা হয়, আর মনে করা হয় হিন্দুদের সর্বনিম একটা জাত। তারা পৌরুষপূর্ণ আর কষ্টসহিষ্ণু, হিংস্র মানুষের চেয়ে খুব বেশি উন্নত নয়। তারা খায় খাসির মাংস, গরুর মাংস, শুয়োরের মাংস, গৃহপালিত মুরগি আর বিপুল পরিমাণ মদ। মাঝারি উচ্চতার শরীর তাদের গাঢ়-রঙা, পেশিবহুল, গোল মুখ, চ্যাপটা চোয়াল, পাতলা ঠোঁট আর ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল। তাদের পরিবারের শৃঙ্খলা আর ঐক্য বজায় রাখে মোড়ল। সপ্তদশ আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে বেরাদরাই সরবরাহ করত দক্ষিণ ভারতের নির্ভুল নিশানার মাস্কেটিয়ার। যুদ্ধবিগ্রহের শৌর্যে তারা তাদের নৈশ আক্রমণের মতোই বিশিষ্ট। সমসাময়িক পারসি ঐতিহাসিকেরা তাদের নাম সামান্য অদল-বদল করে বলত বে-ডর (নিভীক)।

বেরাদদের আদিভূমি হলো মহীশূর, সেখান থেকে এগিয়েছে তারা রাইচুর দোয়াবে, তারপর কৃষ্ণ আর ভীমা পেরিয়ে আরও উত্তরের দেশে। বেরাদ নায়ক বা সর্দারদের আদি রাজধানী ছিল বিজাপুর শহরের ৭২ মাইল পুবের সাগর। যখন মোগলেরা সাগর দখল করে নিল (১৬৮৭), সর্দার তার নতুন রাজধানী তৈরি করল সাগরের ১২ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের ওয়াজিনজেরায়। ১৬৮৭ সালে মোগলদের কাছে রাজত্ব হারিয়ে ফেলার পর বিদ্রোহ, পাহাড়ের মধ্যে নতুন দুর্গ নির্মাণ, আর মারাঠিদের অনুকরণে মোগল ভূখণ্ডে লুটপাট চালানো ছাড়া সর্দারদের আর করার কিছু রইল না। সাগরের পতনের পর প্রায়ই ঝামেলা সৃষ্টি করত তারা কুলবর্গা জেলায়, বেরাদ অশ্বারোহীদের ভয়ে অনেক বছর এদিকের রাস্তায় কাফেলা চলাচল করত না।

পাম নায়কের (রাজত্বকাল ১৬৮৭-৮৮) পোয্য উত্তরাধিকারী পেচ্ছা পিডিয়া নায়ক ১৬৮৩ সালের দিকেই আওরঙ্গজেবের হুকুম তামিল করার পর একটা পদ পেয়েছিল সম্রাট-বাহিনীতে। মোগলদের সাগর জয়ের পর সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওয়াজিনজেরায় দুর্গ আর একটা সেনাবাহিনী তৈরিতে। উপজাতিদের ভেতর থেকে বেছে নিল সে বারো হাজার চমৎকার মাস্কেটিয়ার আর দ্রুত বাড়াল তার গোলন্দাজ বাহিনী এবং যুদ্ধের অন্য সব উপকরণ।

কুলবর্গা জেলায় পিডিয়ার ডাকাতি মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে অবশেষে ১৬৯১ সালের ২৭ মে সম্রাট বিজাপুর থেকে তাঁর ছেলে কাম বখশকে পাঠালেন ওয়াজিনজেরা আক্রমণ করতে। ২০ জুলাই শাহজাদাকে মাদ্রাজ কর্ণাটকে পাঠিয়ে দেওয়ার পর বেরাদদের ব্যবস্থা নেওয়ার ভার পড়ল রুহুল্লাহ খানের ওপর। কিন্তু সে তার কাজে সফল হলো না; দুবার বেরাদরা ধ্বংস করে দিল তার ট্রেঞ্চ বিখ্যাত রণমস্ত খানসহ অনেকে নিহত হলো মোগলদের পক্ষে। এবার রুহুল্লাহ খানের পরিবর্তে পাঠানো হলো শাহজাদা আজমকে (১৮ ডিসেম্বর, ১৬৯১)। এক বছর সেখানে থেকে বেরাদদের কার্যকলাপ বন্ধ করে দিলেন শাহজাদা। তখন পিডিয়া বশ্যতা মেনে শাহজাদাকে উপহার দিল দুই লাখ টাকা, আর সম্রাটের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করল সাত লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে। কিন্তু ১৬৯২ সালের ডিসেম্বরে সম্রাট সাগর থেকে শাহজাদা আজমকে সরিয়ে নিতেই পিডিয়া আবার শুরু করল লুটপাট। তারপর ১৬৯৬ সালের এপ্রিলে তার বিরুদ্ধে ফিরুজ জংকে পাঠাতে সেই একই রকম ‘শেয়ালের কৌশল অবলম্বন করে নিজের ধ্বংস এড়িয়ে গেল সে কর হিসেবে নয় লাখ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে । ১৬.১০ আওরঙ্গজেবের ওয়াজিনজেরা দখল, ১৭০৫। ১৭০৪ সালের শেষে মারাঠি সমস্ত বড় বড় দুর্গ দখল সমাপ্ত হওয়ার পর সম্রাট ওয়াজিনজেরার অবরোধ শুরু করলেন ১৭০৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ।

দুর্গের দরজার দক্ষিণের সমভূমিতে রয়েছে কাদার দেয়াল ঘেরা তলোয়ারজেরা নামক একটা গ্রাম, যার বাজার থেকে যায় দুর্গের নানা রকম সরবরাহ। পাশেই রয়েছে ধেদপুরা নামক ক্ষুদ্র একটা পল্লি, যার বেরাদ অধিবাসীরা চাষবাস করে চারপাশের জমিগুলোতে। এই অঞ্চলে এই তিনটেই মাত্র বসবাসের স্থান; কিন্তু দুর্গের উত্তর আর পুবে রয়েছে বেশ কয়েকটা টিলা, যেগুলো অবরোধকারীদের অত্যন্ত সাহায্যে আসে। এই টিলাগুলোরই একটার নাম লাল তিকরি, সেটার লাল ধুলোর কারণে। বেরাদেরা এখানে পাহারা বসাবার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি।

ওয়ানজিনজেরার শক্তি তার প্রাকৃতিক অবস্থানের চেয়ে বেরাদদের মাস্কেটের নিখুঁত নিশানার ওপরই বেশি নির্ভরশীল।

অবরোধের অনেক সপ্তাহ কেটে যাওয়ার পরও মোগলেরা কিছুই করতে পারল না। প্রত্যেক দিন তারা হতে লাগল ছোটখাটো আক্রমণের শিকার, পাশাপাশি দুর্গকার থেকে বিরামহীন গোলাবর্ষণ তাদের অগ্রগতি অসম্ভব করে তুলল।

এক সকালে দুর্বল জায়গা খুঁজতে খুঁজতে মোগল সেনাপতিরা উঠে পড়ল লাল তিকরির ওপর । শিগগিরই বেরাদে পাঠাল তিনটে বড় বড় পদাতিক বাহিনী, যারা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল অসংখ্য পিঁপড়ে আর পঙ্গপালের মতো’, তারপর নিখুঁত নিশানায় সম্রাট-বাহিনীর ওপরে ছুড়ল মাস্কেটের গুলি আর পাখরখণ্ড।

অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে তাদের নেমে আসতে হলো লাল তিকরি থেকে।

মোগল পরিখাগুলো শুরু হয়েছে লাল তিকরি আর তলোয়ারজেরার উল্টো পাশের একটা টিলার মাঝখান থেকে আর পাহাড় থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে লাল তিকরি আর পরিখাগুলোর মধ্যে একটা আউটপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে মুহম্মদ আমিন খানের অধীনে। তলোয়ারজেরার দিকে মুখ করে থাকা টিলাটা দখল করেছে কাম বখশের সেনারা, আরেকটা টিলার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বকর খান।

কিন্তু ২৬ মার্চ ধানা যাদব আর হিন্দু রাওয়ের অধীন পাঁচ-ছয় হাজার মারাঠি অশ্বারোহীর একটা বাহিনী দুর্গের কাছে এসে পৌঁছাল তাদের বেরাদ মিত্রদের সহায়তায়, কারণ, মারাঠি সেনাপতিদের অনেক পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল সেখানে। সুতরাং মারাঠিদের প্রথম কাজ হলো, দুর্গ থেকে পরিবারগুলোকে নিরাপদে বাইরে নিয়ে যাওয়া। মারাঠি বাহিনীর মূল অংশ ব্যস্ত রাখল মোগলদের, ওদিকে বাছাই ২,০০০ মারাঠি মহিলা আর শিশুদের নিয়ে ওয়ানজিনজেরার পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে উঠে পড়ল দ্রুতগামী অশ্বের পিঠে।

পেড়া পিডিয়া নায়ক মারাঠিদের কথা দিয়েছিল, যত দিন তারা রাজধানী রক্ষায় সহায়তা করবে, তত দিন সে তাদের বৃত্তি দেবে রোজ কয়েক হাজার করে টাকা। মারাঠিরা মাঝেসাঝেই আক্রমণ চালাতে লাগল মোগলদের ওপর। ফলে মোগল বাহিনীই এক রকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। তাদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেল, শিবিরে শস্য আর পশুখাদ্যের অভাব প্রকট হয়ে উঠল। সম্রাট তাঁর সেনাপতিদের তিরস্কার করলেন, কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

পিডিয়া এবার বশ্যতার প্রস্তাব পাঠাতে লাগল সম্রাটের কাছে, কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য হলো এভাবে সময় কাটিয়ে দিয়ে দূর আর কাছ থেকে সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করা।

আবদুল গনি নামক চূড়ান্ত মিথ্যুক এক কাশ্মিরি ফেরিওয়ালা একদিন এল সম্রাটের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান হেদায়েত-কেশের কাছে, পিডিয়ার শান্তি প্রস্তাবসংবলিত একখানা চিঠি নিয়ে। আওরঙ্গজেব সেই চিঠির একটা অনুকূল জবাব দিলেন । তারপর পিডিয়া তার ভাই সোম সিংকে মোগল শিবিরে পাঠাল দুর্গ সমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে, যার পরিবর্তে তার ভাইকে যেন মঞ্জুর করা হয় জমিদারি, গোত্রপ্রধানের পদ, আর একটা মনসব । সোম সিং শিবিরে এই গল্প ছড়িয়ে দিল যে পিডিয়া পাগল হয়ে মারাঠিদের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। তারপর সেই কাশ্মিরি একই গল্প নিয়ে উপস্থিত হলো বেরাদপ্রধানের মায়ের তরফ থেকে, আর সেই সঙ্গে সোম সিংকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানাল, যেহেতু সাত দিনের মধ্যেই দুর্গ খালি করে দেওয়া হবে। সম্রাট সম্মত হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দিলেন।

এবং তারপরেই ফাঁস হয়ে গেল আসল কথা। পুরো ঘটনাটাই একটা সাজানো নাটক । পাগল-টাগল কিছুই হয়নি, বহাল তবিয়তে পিডিয়া দুর্গের ভেতরেই আছে; সে এখন আর দুর্গ সমর্পণ করতে রাজি নয়। ক্রোধে আর লজ্জায় সম্রাট প্রায় পাগল হয়ে গেলেন।

ইতিমধ্যে তিনি তাঁর সেরা সেনাপতিদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ২৭ মার্চ এসে পৌঁছাল নসরত জং, আর পরদিনই লাল তিকরির মাথায় উঠে তাড়িয়ে দিল শক্রদের। পালিয়ে গেল তারা তলোয়ারজেরায়, আর মাস্কেট ছুঁড়তে লাগল কাদার দেয়ালের পেছন থেকে। লাল তিকরিতে আর গ্রামের বাইরে অনেক রাজপুত নিহত হলো। এবার নসরত জং পাশের একটা টিলায় পাঠাল দলপত বুলোকে। সেখান থেকেও বেরাদরা পালিয়ে চলে গেল ধেদপুরা গ্রামে। সেদিন দলপত রাওয়ের হাতিকে আঘাত হানল একুশটা বুলেট, আর নসরত জংয়ের দুজন মাহুত আহত হলো আর মারা গেল একজন। মোগল সেনাপতির কেন্দ্র আর পশ্চাৎভাগের অনেক সেনা হতাহত হলো, কিন্তু নসরত জং তার অবস্থান ছেড়ে হটল না। কয়েক দিন পর বেরাদদের কয়েকটা কুয়ো দখল করে নিল খান। ২৭ এপ্রিল সে আক্রমণ চালাল তলোয়ারজেরায়। রুখে দাঁড়ানো সমস্ত বেরাদ নিহত হলো সম্রাট-বাহিনীর হাতে, অন্যেরা পালিয়ে গেল।

তারা বুঝতে পারল যে আর যুদ্ধ করে লাভ হবে না। মারাঠি সঙ্গীদের নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল পিডিয়া । রাত নামার পর যখন থেমে গেল মাস্কেটের শব্দ, কয়েকজন মোগল সেনা ভেতরে ঢুকে দেখল দুর্গ একদম শূন্য। তারপর শুরু হলো এক বন্য লুণ্ঠন আর অগ্নিসংযোগ। দুর্গ শূন্য, এই সংবাদ পাওয়ামাত্র সরকারি প্রতিনিধি আসার আগেই যা পাওয়া যায় হাতিয়ে নেওয়ার আশায় ছুটে এল সেনাদলের পরিচারক আর সেপাইরা । ছাদের আগুন বারুদের গুদামে গিয়ে পড়ায়, ভয়াবহ এক বিস্ফোরণে অনেক মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। দু-তিন দিন পর হলো আরেক বিস্ফোরণ । ওয়াজিনজেরা দখলকৃত হলো, কিন্তু ভবিষ্যতে আরও ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য ততক্ষণে পালিয়ে গেছে তার প্রধান। আওরঙ্গজেবের তিন মাসের পরিশ্রম নিষ্ফলা হয়ে গেল।

১৬.১১ আওরঙ্গজেবের যুদ্ধবিগ্রহের ফলে দেশের শোচনীয় অবস্থা; সর্বজনীন বিশৃঙ্খলা

 সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে আকবর যে সাম্রাজ্যকে করেছিলেন বিখ্যাত, শাহজাহান জাকজমকে যেটাকে করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত, আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সেই সাম্রাজ্যেরই শুরু হয়েছিল যেন এক অসহায় ক্ষয়; প্রশাসন, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক জীবন, সামরিক শক্তি আর সামাজিক সংগঠন-সবই যেন দ্রুত ধাবিত হচ্ছিল এক চূড়ান্ত ধ্বংস অভিমুখে। সিকি শতাব্দীর যুদ্ধবিগ্রহে সাম্রাজ্যের বস্তুগত ধ্বংস হয়েছিল রীতি মতো ভয়ংকর। সম্পূর্ণ হয়েছিল দাক্ষিণাত্যের ধ্বংস।

ওয়াজিনজেরা থেকে উত্তর দিকে ফেরা শুরু করতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার মারাঠির বিশাল এক দল অনুসরণ করল সম্রাট-বাহিনীকে, বিচ্ছিন্ন করে দিল তাদের শস্যের সরবরাহ, খতম করল দলভ্রষ্টকে, এমনকি হামলা করতে চাইল সম্রাটের শিবিরে।

প্রত্যক্ষদর্শী ভীমসেন লিখেছেন, মারাঠিরা প্রভুত্ব কায়েম করেছিল পুরো রাজ্যে। ডাকাতি করে দারিদ্রকে এড়িয়ে তারা হয়েছিল সম্পদশালী ।… প্রশাসন বলতে কিছু ছিল না, ভেঙে পড়েছিল চাষাবাদ। কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা উধাও হয়ে গিয়েছিল মারাঠি সরকারের, ফলে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করছিল লুটতরাজের মাধ্যমে আর তার সামান্য একটা অংশ রাজাকে দিয়ে। …তারা এমনকি আক্রমণ চালিয়েছিল হায়দরাবাদ, বিজাপুর, আওরঙ্গাবাদ আর বুরহানপুরের মতো দেয়ালঘেরা শহরগুলোতেও।

প্রশাসন ভেঙে পড়া আর জনগণের শান্তি বিনষ্ট হওয়াতে যে কত অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল, সে সম্বন্ধে ভীমসেন পরিষ্কার নির্দেশ করেছেন: মনসবদারের অধীনে ছোট বাহিনী থাকায় জায়গির হিসেবে পাওয়া ভূখণ্ডের ওপর তাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। স্থানীয় জমিদারেরা মারাঠিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে রাজ্যময় ছড়িয়ে দিয়েছিল তাদের অত্যাচারী হাত… মোগলদের মতো মারাঠিরাও ভূখণ্ডের বন্দোবস্ত করেছিল তাদের সেনাপতিদের জন্য, ফলে একই রাজ্যের ছিল দুই দল জায়গিরদার!…কৃষকেরা এই দ্বিমুখী আদায় সহ্য করতে না পেরে অস্ত্র আর ঘোড়া জুটিয়ে যোগ দিয়েছিল মারাঠিদের সঙ্গে। অনেক মোগল মনসবদার দারিদ্রের জ্বালা সইতে না পেরে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে লুটপাট চালাতে শুরু করেছিল নিরীহ আর বিশ্বস্ত কৃষকদের ওপর, অনেকে ভাগ বসিয়েছিল মারাঠি আক্রমণকারীদের পাওয়া জিনিসে।

১৬.১২ লুণ্ঠন আর যুদ্ধের মারাঠি পদ্ধতি

মারাঠিরা লুণ্ঠনকে নিয়ে এসেছিল একটা পদ্ধতির আওতায়। খাফি খান লিখেছেন, ‘এসব আক্রমণকারী যেখানেই যেত, সেখানে একটা রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করে স্ত্রী আর সন্তানসন্ততি নিয়ে বসবাস করত মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর। তারা পরগনা ভাগ করে নিয়েছিল নিজেদের মধ্যে, আর মোগল সরকারের অনুকরণে নিয়োগ দিয়েছিল তাদের আপন সুবাদার, কমাবিশ-দার (রাজস্ব আদায়কারী), আর রাহদার (পথ প্রহরী)। তাদের সুবাদার ছিল একটা বাহিনীর নেতা: কোথাও বড়সড় কাফেলা আসার সংবাদ পেলেই হাজার সাতেক অশ্বারোহী নিয়ে গিয়ে লুটপাট করত সে। প্রত্যেকটা জায়গায় কমাবিশ-দারদের বসানো হয়েছিল চৌথ আদায়ের জন্য। কোথাও শক্তিশালী জমিদার বা মোগল ফৌজদারের বিরোধিতায় কোনো কমাবিশ-দার আদায় করতে না পারলে মারাঠি সুবাদার এগিয়ে যেত তার সহায়তায় । রাহদারেরা একটা কর আদায় করে (মোগলদের তিন বা চার গুণ) ব্যবসায়ীদের মাল নিয়ে যেতে দিত নিরাপদে। প্রত্যেক সুবায় মারাঠিরা নির্মাণ করেছিল একটা বা দুটো ছোট দুর্গ (গড়হি), সেগুলোতে তারা থাকত আর সেখান থেকেই দেশের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত লুটতরাজ চালাতে।

১৭০৩ সালের পর মারাঠিরা প্রভুত্ব কায়েম করল পুরো দাক্ষিণাত্য, এমনকি উত্তর ভারতের কিছু অংশে। শিবাজী বা শম্ভুজীর শাসনামলের তুলনায় মারাঠিদের কৌশলে এসেছিল অনেক পরিবর্তন। তারা আর তখনকার মতো চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে মোগল সেনাবাহিনীর আসার সংবাদ পাওয়ামাত্র কেটে পড়ত না। বরং ১৭০৪ সালে মানুচি লক্ষ করেছেন, এখন দল নিয়ে মারাঠি নেতারা চলাচল করে অনেক নির্ভয়ে, কারণ, মোগল সেনাপতিদের বুকে তারা করতে পেরেছে ভয়ের সঞ্চার। বর্তমানে গোলন্দাজ বাহিনী, মাস্কেটিয়ার, ধনুক আর তীরের পাশাপাশি মালপত্র আর তাঁবু বহনের জন্য তাদের আছে হাতি আর উট। সংক্ষেপে, বর্তমানে সজ্জিত হয়ে চলাফেরা করে তারা মোগল সেনাবাহিনীর মতোই।

আওরঙ্গজেব সরকারের শাসন একেবারেই ভেঙে পড়েছিল। কর্মচারীরা হয়ে পড়েছিল সংশোধনাতীত কলুষিত আর অযোগ্য, তার আদেশের তোয়াক্কা না করে স্থানীয় সরকাররা মেতে উঠেছিল যাবতীয় নিষিদ্ধ কর আদায়ে; বৃদ্ধ সম্রাটকে অমান্য করেছে দূরবর্তী কর্মচারীরা, প্রশাসন হারিয়েছে তার দক্ষতা।

১৬.১৩ আওরঙ্গজেবের আহমদনগর প্রত্যাবর্তন, ১৭০৫

ওয়াজিনজেরা দখলের পরপরই (২৭ এপ্রিল, ১৭০৫), সম্রাট তাঁর শিবির স্থানান্তরিত করলেন দেবাপুরে, দুর্গের ৮ মাইল দক্ষিণে, কৃষ্ণর কাছের নীরব সবুজ একটা গ্রামে। এখানে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি বয়স (নব্বই চান্দ্র বছর) আর অবিরাম পরিশ্রমের ফলে।

তাঁর শিবিরের সবাই হতাশ হয়ে পড়ল। প্রথমে সাহসের সঙ্গে তিনি লড়াই চালিয়ে গেলেন অসুস্থতার বিপক্ষে, করলেন স্বাভাবিক কাজকর্ম, এমনকি জীবিত যে আছেন, তা নিশ্চিত করানোর জন্য শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন জনসাধারণের উদ্দেশে। কিন্তু জোর করে এই কাজ করতে গিয়ে তার অসুস্থতা আরও বৃদ্ধি পেল, তীব্র এক ব্যথায় তিনি মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগলেন। বাতাসে ভাসতে লাগল তার মৃত্যু আর তার পুত্রদের লড়াইয়ের গুজব।

এই অবস্থাতেই শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন তিনি দশ বা বারো দিন, তারপর সেরে উঠতে লাগলেন খুব ধীরে ধীরে, শরীর তখনো ভীষণই দুর্বল। এ রকম সময়েই একদিন গভীর মানসিক কষ্টে তিনি আবৃত্তি করলেন শেখ গাঞ্জার কবিতা :

‘বয়স যখন যায় আশিতে
কিংবা ঘরে নব্বই-এর,
সইতে হয় কঠিন আঘাত
নিষ্ঠুর ওই সময়ের;
তার পরও যাও যদি যাও
একশতেরই সীমানায়,
মৃত্যু নিজের করাল পোশাক
পরিয়ে দেবে তোমার গায়।’

রোগশয্যার পাশে বসে থাকা আমির খান সম্রাটকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, জাহাঁপনা, দয়া করে শান্ত হন। শেখ গাঞ্জার কবিতায় এ রকমও আছে :

‘মন খুশিতে ভরিয়ে রাখো
সব ভালো ওই খুশিতেই,
খুশির ফাঁকে দেয় যে উঁকি
আল্লাহ তার বান্দাকেই!’’

১৭০৫ সালের ২৩ অক্টোবর আওরঙ্গজেব তার দেবাপুরের শিবির ভেঙে একটা পাল্কিতে করে রওনা দিলেন উত্তরে। একদিন যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর দাক্ষিণাত্য বিজয়, ২৩ বছর পর আবার সেই আহমদনগরে ফিরে এলেন তিনি ১৭০৬ সালের ২০ জানুয়ারি। এই স্থানটিকেই তিনি ঘোষণা করলেন তার ‘যাত্রার শেষ।

১৬.১৪ আওরঙ্গজেবের শেষ জীবনের দুঃখ ও হতাশা

আওরঙ্গজেবের শেষ জীবন ছিল অনির্বচনীয় বিষণ্ণ। রাজনৈতিক মণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছেন যে শক্তভাবে আর ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ভারত শাসন করার তাঁর জীবনভর প্রবল প্রচেষ্টা পর্যবসিত হয়েছে সাম্রাজ্য জুড়ে অরাজকতা আর ঐক্যনাশে। শেষ বয়সে আওরঙ্গজেবকে তাড়া করে ফিরেছে অবর্ণনীয় এক একাকিত্বের অনুভব। একের পর মৃত্যুবরণ করেছে বয়োজ্যেষ্ঠ সব অমাত্য, নিজ বয়সের বলতে এখনো রয়ে গেছে কেবল উজির আসাদ খান। দরবারের চারপাশে তাকিয়ে বৃদ্ধ সম্রাট এখন দেখতে পান শুধু কমবয়সী মানুষ, ভীতু সব মোসাহেব, যারা ভয় পায় দায়িত্ব নিতে, ভয় পায় সত্য বলতে, আর ব্যক্তিগত লোভের বশবর্তী হয়ে করে চলে অন্তহীন ষড়যন্ত্র। তার গোড়া আত্মসংযম সব সময় মানুষকে তার কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারে আতঙ্কিত করেছে। মানুষ কুঁকড়ে দূরে সরে গেছে এমন একজনের কাছ থেকে, যিনি আনন্দ, বেদনা, দুর্বলতা আর করুণার উর্ধ্বে, যার ভেতরে সাধারণ মানুষের প্রায় কোনো স্বভাবের প্রকাশ নেই, যিনি এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেও যেন অপার্থিব কিছু। সদাব্যস্ত সাম্রাজ্য পরিচালনার অবসরে বর্তমানে তার সঙ্গী বলতে রয়েছে কেবল ইতিমধ্যে বৃদ্ধার খাতায় নাম লেখানো কন্যা জিনাত-উন-নিসা, আর তার শেষ স্ত্রী উদিপুরী, যার পুত্র কাম বখশের আচরণ সম্রাটকে অত্যন্ত কষ্ট দিয়েছে।

তাঁর পারিবারিক জীবন শোকে নিমজ্জিত। সবচেয়ে প্রিয় পুত্রবধূ জাহানজেব বানু মারা গেছেন গুজরাটে, ১৭০৫ সালের মার্চে। ১৭০৪ সালে নির্বাসনে বিদেশের মাটিতে মারা গেছেন তার বিদ্রোহী পুত্র আকবর। আরও আগে তাঁর প্রতিভাময়ী কন্যা কবি জেব-উন-নিসা শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন দিল্লির কারাগারে (১৭০২)। তাঁর অসংখ্য ভাই আর বোনের সর্বশেষ গওহর-আরা বেগম, এই তো মারা গেলেন ১৭০৬ সালে, যাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সবার সামনেই করুণ স্বরে তিনি বলে উঠেছিলেন, হায়, শাহজাহানের সন্তানদের মধ্যে সে আর আমিই শুধু ছিলাম এই পৃথিবীতে। ১৭০৬ সালের মে মাসে তাঁর কন্যা মিহর উন-নিসা আর তার স্বামী ইজিদ বখশ (মুরাদের পুত্র) উভয়েই মারা গেছেন দিল্লিতে, আর তাঁদের পরের মাসেই বিদায় নিয়েছেন আকবরের পুত্র বুলন্দ আখতার। তাঁর নিজের মৃত্যুর (১৭০৭) সামান্য আগে মারা গিয়েছেন তার দুই নাতি-নাতনি, কিন্তু সেই সংবাদ দিয়ে মন্ত্রীরা এই জীবনপ্রান্তে উপস্থিত মানুষটির মন আরও ভারাক্রান্ত করে তুলতে চায়নি।

১৬.১৫ সাম্রাজ্যিক ভূখণ্ডে মারাঠি হয়রানি, ১৭০৬-১৭০৭

আহমদনগরে রওনা দেওয়ার সময় আওরঙ্গজেব পেছনে ফেলে এসেছিলেন নির্জনতা আর অরাজকতা। কিন্তু তার এই শহরে প্রত্যাবর্তনও আনতে পারল না সেনাবাহিনীর বিশ্রাম কিংবা সাম্রাজ্যের শান্তি। ১৭০৬ সালের এপ্রিল বা মে মাসে মারাঠিদের বিশাল এক বাহিনী এসে উপস্থিত হলো সম্রাট-শিবিরের ৪ মাইল দূরে। আওরঙ্গজেব পাঠালেন খান-ই-আলম এবং অন্যান্য অফিসারকে, দীর্ঘ এক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পর তারা মারাঠিদের তাড়িয়ে দিতে পারল।

গুজরাটে সাম্রাজ্যবাদীদের ঘটল দারুণ এক দুর্ঘটনা। ইনু মন্দ নামক খান্দেশের ভূতপূর্ব এক মদ চোলাইকারী, ডাকাতি ধরে যোগ দিয়েছিল মারাঠি সেনাপতিদের সঙ্গে। ধানা যাদব আর তার সেনাবাহিনীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে সে ধ্বংস করাল সম্পদশালী বিরাট বাণিজ্যকেন্দ্র বরোদা (মার্চ, ১৭০৬)। সেখানকার ফৌজদার নজর আলী পরাজিত হয়ে মারাঠিদের হাতে বন্দী হলো তার লোকজনসুদ্ধ।

একইভাবে আওরঙ্গাবাদ প্রদেশেও ঘন ঘন হামলা চালাতে লাগল ধানা যাদবের দল এবং অন্য নেতারা।

জুলাইয়ে ওয়াজিনজেরার কাছে মারাঠি কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে তরবিয়াত খানকে পাঠাতে বাধ্য হলেন সম্রাট তাদের শায়েস্তা করতে। পিডিয়া বেরাদ গোপনে হিন্দু রাওয়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে বেতন না পেয়ে অনাহারে থাকা মোগল কিলাদারকে ঘুষ খাইয়ে হস্তগত করেছিল পেনু-কোন্দা। অবশ্য কর্ণাটকের ফৌজদার দাউদ খান পরে পেনু-কোন্দা উদ্ধার করেছিল। সিয়াদত খান নামক দরবারের একজন অফিসারকে শত্রুরা বন্দী করেছিল মুক্তিপণ আদায়ের জন্য, তার দুই চোখই জখম হয়েছিল মাস্কেটের গুলিতে । এই সময়ে তারা বসন্তগড়ও উদ্ধার করেছিল সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে।

যখন বর্ষাকাল শেষ হলো (সেপ্টেম্বর, ১৭০৬), আবার মারাঠিদের আক্রমণ শুরু হলো দশ গুণ প্রচণ্ডতায়। ধানা যাদব আক্রমণ করল বেরার আর খান্দেশ, কিন্তু নসরত জং মিরাজের শিবির থেকে বেরিয়ে এসে, তাকে তাড়িয়ে দিল বিজাপুর হয়ে কৃষ্ণ নদীর ওপারে । আওরঙ্গাবাদ থেকে লম্বা একটা কাফেলা আসছিল সম্রাট-শিবিরের উদ্দেশে, সেটার সবকিছু লুট করা হলো আহমদনগরের ২৪ মাইল দূরবর্তী চান্দার কাছে।

১৬.১৬ আওরঙ্গজেবের শেষ দিনগুলো

একদিকে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীকে ঘিরে ধরছে বিপদ, আরেক দিকে শিবিরের অভ্যন্তরীণ ঝামেলা ধারণ করছে অশুভ রূপ। মুহম্মদ আজমের অবাধ অহংকার আর উচ্চাশার চাহিদা হলো, সিংহাসন লাভের ব্যাপারে সম্রাট তাঁর পথের সমস্ত কাঁটা দূর করে দেবেন। সম্রাটের কান ভারী করলেন তিনি শাহ আলমের যোগ্য তৃতীয় পুত্র আজিম-উস-শানের বিপক্ষে, আর তাকে ফেরত আনালেন পাটনার রাজ্যপালের পদ থেকে। প্রধানমন্ত্রী আসাদ খান এবং আরও কয়েকজন অমাত্যকে তিনি ডেকে নিলেন তার পাশে। তারপর তিনি রইলেন এমন এক সুযোগের অপেক্ষায়, যেন অতর্কিত আক্রমণে খতম করে দেওয়া যায় কাম বখশকে। দিনে দিনে কাম বখশের বিরুদ্ধে আজমের হিংস্রতা এতই স্পষ্ট হয়ে উঠল যে সম্রাট কাম বখশের সেনাবাহিনীর অত্যন্ত সাহসী আর বিশ্বস্ত বখশি সুলতান হোসেনের ওপর অর্পণ করলেন শাহজাদার নিরাপত্তার দায়িত্ব।

১৭০৭ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে আওরঙ্গজেবকে আবার পেয়ে বসল সেই অবসন্নতা। তবে আবারও সেরে উঠে অংশগ্রহণ করতে লাগলেন তিনি দরবারে আর সাম্রাজ্য পরিচালনার কাজে। কিন্তু এবার সম্রাট পরিস্কার অনুভব করতে পারলেন যে অবশ্যম্ভাবী সেই ঘটনাটি ঘটতে আর বেশি দেরি নেই, এদিকে আজমের ক্রমবর্ধমান অধীরতা আর উগ্র উচ্চাশা যেকোনো মুহূর্তে শিবিরের সবাইকে ঠেলে দিতে পারে হুমকির মুখে। তাই, ৯ ফেব্রুয়ারি কাম বখশকে বিজাপুরের সুবাদার নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনীসহ । চার দিন পর (১৩ ফেব্রুয়ারি), মুহম্মদ আজমকে পাঠালেন তিনি মালওয়ার রাজ্যপাল হিসেবে; কিন্তু ধূর্ত শাহজাদা, তার পিতার মৃত্যু সন্নিকটে জেনে এগোতে লাগলেন অত্যন্ত ধীরে ধীরে, মাত্র কয়েক মাইল পরপরই থামলেন একবার করে।

শেষ পুত্রকে পাশ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চার দিন পর বৃদ্ধ সম্রাট আক্রান্ত হলেন মারাত্মক এক জ্বরে; কিন্তু তিন দিন তবু তিনি উপস্থিত হলেন দরবারে, আর যথারীতি পড়ে চললেন পাঁচ ওয়াক্ত করে নামাজ। এই তিন দিন বিড়বিড় করে আবৃত্তি করলেন তিনি কবিতার এই চরণগুলো–

‘এই দুনিয়া শ্বাসের ফাঁকে
তারার ঝিলিক মেঘ-আড়ে,
সবকিছুরই বদল আঁকে
এক লহমার ফুঙ্কারে।’

শেষ এই সময়ে তার দুই পুত্র আজম আর কাম বখশকে তিনি লিখলেন করুণ দুটো চিঠি (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য), তাঁদের অনুরোধ করলেন ভাতৃসুলভ ভালোবাসা, শান্তি আর আত্মসংযম বজায় রাখতে, এবং বর্ণিত হলো সেখানে পার্থিব অসারতা।

১৭০৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভোরে শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আদায় করলেন আওরঙ্গজেব ফজরের নামাজ, তারপর তসবি টিপে টিপে জপতে লাগলেন ইসলামি বিশ্বাসের এই স্বীকারোক্তি যে আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয় আর মুহম্মদ তার প্রেরিত নবী। ধীরে ধীরে প্রবেশ করলেন তিনি একটা সংজ্ঞাহীন স্তরে; কিন্তু স্বাভাবিক শারীরিক দুর্বলতাকে ছাপিয়ে অমিত তেজোময় সেই পুরুষ তখনো ঘুরিয়ে চললেন তসবির দানা আর ফিসফিসিয়ে জপে চললেন কলেমা, আর তারপর সকাল আটটার দিকে সব শেষ হয়ে গেল। আওরঙ্গজেব সারা জীবন চাইতেন যে তাঁর মৃত্যু যেন হয় শুক্রবার জুমার দিনে, আর আল্লাহ তাঁর অন্যতম খাঁটি এই সেবকের প্রার্থনায় সাড়া দিলেন।

মুহম্মদ আজম শিবিরে পৌঁছালেন ২২ তারিখে এবং পিতার মৃত্যুর শোকপালন আর বোন জিনাত-উন-নিসা বেগমকে সান্ত্বনা দেওয়ার পর মরদেহ নিয়ে গেলেন দৌলতাবাদের কাছের খুলদাবাদে, আর সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করা হলো সাধু শেখ জইন-উদ-দীনের মাজার প্রাঙ্গণে।

অত্যন্ত সাধারণ এক কবর, যেখানে নেই কোনো শ্বেতপাথর, ওপরের স্ল্যাবে কেবল ভরে দেওয়া হলো মাটি যেন জন্মাতে পারে সেখানে সবুজ লতাপাতা (তাঁর বোন জাহানারার দিল্লির বাইরে অবস্থিত কবরের অনুকরণে),-আর সেখানেই শেষ শয্যা পাতলেন মহান মোগলগণের মহানতম সম্রাট, অবশ্য একজন বাদে।

পরিশিষ্ট

শাহজাদা আজমকে লিখিত আওরঙ্গজেবের শেষ চিঠি

‘আসোলামু আলাইকুম!

‘বৃদ্ধ বয়স এসে গেছে আর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে দুর্বলতার স্তূপ; শক্তি আমার শরীর থেকে অন্তর্হিত হয়েছে। একা আমি এসেছিলাম এই পৃথিবীতে আর চলেও যাচ্ছি একদম একা। এখন নিজের কাছেই যেন অপরিচিত এক মানুষ আমি, আর জানিও না কী করছি কখন। কঠোর আত্মসংযমের দিনগুলো ছাড়া রয়ে গেছে কেবলই অনুতাপ । সাম্রাজ্যের কোথাও খাঁটি শাসন চালাতে পারিনি আমি, কিংবা লালন করতে পারিনি চাষিদের।

‘জীবন, এত অমূল্য এক বস্তু, অথচ কেটে গেল তা অর্থহীনভাবে। প্রভু আমার বাড়িতেই ছিলেন, কিন্তু আমার পাপী চোখে তার দীপ্তি ধরা পড়েনি। জীবন স্থায়ী নয়; কাটিয়ে আসা দিনগুলো হারিয়ে গেছে চিরতরে; আর ভবিষ্যতের মধ্যেও নেই কোনো আশা ।

‘আমার জ্বর সেরে গেছে, কেবল রয়ে গেছে তার সামান্য রেশ। বিজাপুরে চলে যাওয়া আমার পুত্র কাম বখশ, আমার কাছেই আছে। আর তুমি রয়েছ তার চেয়েও কাছে। সবার চেয়ে দূরে রয়েছে প্রিয় শাহ আলম। নাতি মুহম্মদ আজিম, আল্লাহর রহমতে, বাংলাদেশ থেকে এসে পৌঁছেছে হিন্দুস্তানের কাছে।

‘সব সেনারা এখন আমার মতোই অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় আর অস্থির। তারা ভাবেওনি যে আল্লাহ সব সময় আমাদের সঙ্গেই আছে। এই পৃথিবীতে আমি এসেছিলাম শূন্য হাতে, আর মুঠো ভরে নিয়ে যাচ্ছি আমার পাপের ফল । জানি না কোন শাস্তি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। যদিও আল্লাহর কৃপা আর অনুগ্রহ লাস্ত্রে ব্যাপারে আমার রয়েছে গভীর বিশ্বাস, তবু কৃতকর্মের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা আমার পিছু ছাড়ছে না। নিজের ভেতরে যখন নিজেই রইব না, কে আর রইবে আমার পাশে?

আকাশ ঘিরে এলেও আঁধার
ধরব কষে ধরব হাল,
সোজাই যাওয়ার আশা আমার
হোক না নৌকা টালমাটাল।

‘প্রভু যদিও তার বান্দাদের রক্ষা করে থাকে, তবু আমার পুত্রদের লক্ষ রাখা কর্তব্য যে মুসলমান কিংবা প্রভুর সৃষ্ট কোনো জীবই যেন প্রাণ না হারায় অন্যায়ভাবে।

নাতি বাহাদুরকে (বিদার বখত জানিয়ে দিয়ে আমার বিদায়বেলার শুভেচ্ছা । যাওয়ার সময় তার সঙ্গে দেখা হলো না; সাক্ষাতের আশা অপূর্ণই থেকে গেল। বেগম আমার শোকে আচ্ছন্ন, আল্লাহই কেবল পারেন শোক নিবারণ করতে। অদূরদর্শিতা। কেবল বয়ে আনে হতাশা।

‘বিদায়! বিদায়! বিদায়!’

শাহজাদা কাম বখশকে লিখিত আওরঙ্গজেবের শেষ চিঠি

‘আমার বেটা, [আমার বুকের ধন] আমার কলিজা! যদিও আমার পূর্ণ ক্ষমতার সেই দিনগুলোতে, সবাইকে আমি উপদেশ দিয়েছি আল্লাহর ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করতে আর এই ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছি সম্ভাবনার সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে,-তবু আল্লাহ অন্য রকম চেয়েছেন বলে কেউ আমার কথা শোনেনি। এখন যেহেতু আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে, ওসব উপদেশ সম্পূর্ণ নিষ্ফল। এখন বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে সারা জীবনের শাস্তি আর পাপের বোঝা। সঙ্গীহীন আমি পা রেখেছিলাম এই পৃথিবীতে, অথচ যাওয়ার সময় নিয়ে যাচ্ছি কী বিশাল এক কাফেলা! শেষ দিনগুলোতে খুব ভুগেছি সেনা আর শিবির-পরিচারকদের কথা ভেবে ভেবে । যদিও আল্লাহই নেবেন তাঁর বান্দাদের রক্ষার দায়িত্ব, এটা মুসলমান এবং আমার পুত্রদেরও অবশ্য পালনীয় এক কর্তব্য। শরীরে যখন ছিল শক্তির পূর্ণ তেজ, তখন আমি তাদের। মোটেই রক্ষা করতে পারিনি; আর এখন তো আমি নিজেকে রক্ষা করতেই অসমর্থ! এ রকম দুর্বল শরীর নিয়ে প্রার্থনা ছাড়া আমি আর কী করতে পারি? তোমার মাতা। উদিপুরী বেগম রোগের সময় আমার পাশে থেকেছে; আরেক পৃথিবীতেও সে থাকতে চায় আমার পাশে। তোমাকে আর তোমার পুত্রদের আল্লাহর হাতে সঁপে দিলাম । প্রত্যেকটা অঙ্গে আমার ভর করেছে কম্পন । অতএব বিদায়…পার্থিব চিন্তায় নিমগ্ন মানুষ হলো প্রতারক, তারা নমুনা হিসেবে গম দেখিয়ে বিক্রির সময় দেয় যব; তাদের ওপর ভরসা কোরো না। দারা শুকো যখন তার অনুচরদের মাসোহারা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন তারা কাজ করেছে আগের চেয়েও কম। কাজ কোরো ক্ষমতা বুঝে, কখনো তার বাইরে গিয়ে নয়।

‘যা বলার বললাম আমি আর এবার বিদায় নেওয়ার পালা। চাষি আর প্রজাদের দিকে লক্ষ রেখো, যেন তাদের ওপর কোনো অন্যায় না হয়…আর অযথা যেন প্রাণ না হারায় মুসলমান, তাহলে আরও বাড়বে আমার শাস্তি।’

আওরঙ্গজেবের শেষ উইল

এই উইল সম্রাটের স্বহস্তলিখিত আর পাওয়া গেছে তার মৃত্যুশয্যার বালিশের নিচে।

জীবনে আমি ছিলাম অসহায় আর বিদায় নিচ্ছি অসহায়ভাবে। আমার পুত্রদের মধ্যে যারই থাক সিংহাসন লাভের সৌভাগ্য, তার উচিত হবে না কাম বখশকে অত্যাচার করা, অবশ্য সে যদি বিজাপুর আর হায়দরাবাদ এই প্রদেশ দুটো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। আসাদ খানের চেয়ে ভালো উজির আর কেউ হবে না। দাক্ষিণাত্যের দেওয়ান দিয়ানাত খান সাম্রাজ্যের অন্যান্য কর্মচারীদের চেয়ে ভালো। মুহম্মদ আজম শাহকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে হবে-যদি সে সাম্রাজ্য ভাগ করতে রাজি হয়, তাহলে আর সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ হবে না, মানুষ রক্ষা পাবে রক্তক্ষয়ের হাত থেকে। আমাদের পুরনো কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত বা তাদের ওপর অত্যাচার কোরো না। সিংহাসনের অধিকারী পাবে আগ্রা আর দিল্লির যেকোনো একটা সুবা। যে আগ্রা নিতে রাজি হবে, সে পাবে পুরনো রাজ্যের চারটে সুবা-আগ্রা, মালওয়া, গুজরাট আর আজমীর এবং সেগুলোর ওপর নির্ভরশীল সমস্ত চাকলা, সেই সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের চারটে সুবা-খান্দেশ, বেরার, আওরঙ্গাবাদ, বিদার এবং সেগুলোর বন্দর। আর যে দিল্লি নিতে রাজি হবে, সে পাবে পুরনো রাজ্যের এগারোটা সুবা-দিল্লি, পাঞ্জাব, কাবুল, মুলতান, টাট্টা, কাশ্মির, বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার, এলাহাবাদ আর অযোধ্যা।

আওরঙ্গজেবের আরেকটা উইল পাওয়া গেছে ‘আহকাম-ই-আলমগিরি’তে। উইলটা নিম্নরূপ :

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর আর শান্তি বর্ষিত হোক তার সেই সেবকদের ওপর, যারা নিজেদের পাপমুক্ত এবং তাকে সন্তুষ্ট করেছে।

‘আমার শেষ ইচ্ছের বিষয়ে কিছু নির্দেশ দেওয়ার আছে:

প্রথম-অপরাধে নিমজ্জিত এই পাপীর মৃত্যুর পর তাঁর তরফ থেকে একটা চাদর বিছিয়ে দিয়ো হাসান (রা.)-এর মাজারের ওপর, কারণ, যারা পাপের মহাসাগরে তলিয়ে গেছে, তাদের কৃপা আর অনুগ্রহের ওই দরজার কাছে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মহাশুভ এই কর্মসম্পাদনের জন্য সহায়তা নিয়ে আমার পুত্র শাহজাদা আলীজার (আজম)।

দ্বিতীয়-আমার টুপি সেলাইয়ের মজুরির চার টাকা দুই আনা গচ্ছিত আছে মহলদার আইয়া বেগের কাছে। ওটা দিয়ে ক্রয় করো অসহায় এই জীবের কাফনের কাপড়। কুরআন নকলের তিনশো পাঁচ টাকা রাখা আছে আমার থলিতে। আমার মৃত্যুর দিন ওটা বিতরণ কোরো ফকিরদের মধ্যে। যেহেতু কুরআন নকলের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা শিয়ারা সুনজরে দেখে না, ওটা যেন ব্যয় কোরো না আমার কাফনের কাপড় কেনা কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে।

তৃতীয়-বাদবাকি প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে শাহজাদা আলীজার প্রতিনিধির কাছ থেকে, যেহেতু আমার পুত্রদের মধ্যে সে-ই নিকটতম উত্তরাধিকারী, আর তার ওপরই রয়েছে আমার ধর্মসম্মত কিংবা ধর্মবিরোধী জানাজা করার দায়; এই অসহায় মানুষকে সে জন্য জবাবদিহি করতে হবে না, কারণ, মৃতেরা জীবিতদের দয়ার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।

চতুর্থ-এই ভবঘুরেকে কবর দিয়ে সত্যপথ থেকে বিচ্যুতদের উপত্যকায় এবং নগ্ন মাথায়, কারণ, যে পাপীকেই আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে নগ্ন মাথায়, তার থাকবে অনুগ্রহ লাভের এক নিশ্চিত সম্ভাবনা।

পঞ্চম-আমার শব্যানের ওপর কফিনের মাথার দিকটা ঢেকো অমসৃণ, মোটা ‘গজি’ নামের সাদা কাপড়ে। ওপরে যেন টাঙিও না শামিয়ানা, আর বাতিল করো গায়কদের শোভাযাত্রা আর মিলাদ শরিফ।

ষষ্ঠ-সাম্রাজ্যের শাসকের (অর্থাৎ, আমার উত্তরাধিকারী) উচিত তার অসহায় কর্মচারীদের প্রতি সদয় হওয়া, যারা নির্লজ্জ এই জীবের সঙ্গে ছুটে বেরিয়েছে দাক্ষিণাত্যের মরুভূমি আর বনেবাদাড়ে। তারা যদি স্পষ্ট কোনো ভুলও করে, তবু তা এড়িয়ে গিয়ে তাদের ক্ষমা করে দাও।

সপ্তম-কেরানি (মুৎসদ্দি) হিসেবে পারসিরা সব জাতের সেরা। যুদ্ধের মাঠেও, সম্রাট হুমায়ূনের আমল থেকে এখন পর্যন্ত, তাদের তুলনা খুব কম। তারা কখনো যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালায়নি, কখনোই আতঙ্কে কাঁপেনি তাদের পা। আর কোনো দিনই তাদের কাউকে অভিযুক্ত করা যায়নি তাদের প্রভুকে অমান্য করা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে । কিন্তু তারা সব সময়ই খুব বড় মর্যাদা দাবি করে বলে একত্রে তাল মিলিয়ে তাদের সঙ্গে কাজ করা কঠিন। তাদের মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখবে, প্রয়োজনে অবলম্বন করবে এড়ানোর কৌশল।

অষ্টম-তুরানিরা বরাবরই সেনা ছিল। শত্রুর ওপর প্রবল দুঃসাহসে ঝাঁপিয়ে পড়া, বাইরে থেকে আকস্মিক চড়াও হওয়া, নৈশ-আক্রমণ, আর বন্দী করায় তারা অত্যন্ত দক্ষ। যুদ্ধ চলাকালীন পশ্চাদপসরণ করতে বললে তারা কোনো রকম সন্দেহ, হতাশা বা লজ্জা অনুভব করে না, যে আদেশ মানার ব্যাপারে হিন্দুস্তানিরা কিনা ডাহা মূর্খ, যারা কিছুতেই অবস্থান ছেড়ে হটবে না, মাঝখান থেকে নিজের কল্লাটাই হারাবে। তুরানিদের দেবে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা, কারণ, অনেক পরিস্থিতিতেই

তারা এমন সেবা দেবে, যা আর কোনো জাতির পক্ষেই অসম্ভব।

নবম-কখনোই মর্যাদা কিংবা অনুগ্রহ প্রদানে অবহেলা করবে না বরহার সাঈদদের, ঠিক যেমন কুরআনে বর্ণিত আছে, তার নিকট আত্মীয়দের (মহানবীর) দাও তাদের ন্যায্য পাওনা। সেই যে পবিত্র ছত্রে বর্ণিত আছে, তোমার কাছে আমার আত্মীয়দের জন্য আমি কেবল ভালোবাসা চাই, কোনো ক্ষতিপূরণ নয়, এই পরিবারটিকে ভালোবাসার অর্থ নবুয়তের (মুহম্মদের) মজুরি দেওয়া, তাদের প্রতি শ্রদ্ধার কোনো রকম কার্পণ্য কোরো না, এটা তোমাকে এই পৃথিবীতে এবং পরকালে ফল লাভে সহায়তা করবে। কিন্তু বরহার সাঈদদের সঙ্গে কাজ কোরো অত্যন্ত সাবধানে। তাদের জন্য হৃদয়ে ভালোবাসার অভাব রেখো না, কিন্তু তাঁদের দিয়ো না উচ্চ কোনো পদ, কারণ, সম্রাটের শক্তিশালী সহকর্মী শিগগির নিজেই সম্রাট হতে চায়। তাদের হাতে যদি লাগাম তুলে দাও, পরিণতিতে তোমার হবে মর্যাদাহানি।

দশম-রাজ্যের একজন শাসকের উচিত যত বেশি সম্ভব এক স্থান থেকে আরেক স্থানে বিচরণ করা; তার একটা স্থানে দীর্ঘ দিন অবস্থান করা উচিত নয়, কারণ, এটা তাকে বিশ্রাম দিলেও বয়ে আনে হাজারটা ঝামেলা আর দুর্ভোগ।

একাদশ-তোমার পুত্রদের অন্ধের মতো বিশ্বাস কোরো না, লালন কোরো না তাদের অতিরিক্ত আদরে, কারণ, সম্রাট শাহজাহান যদি দারা শুকোকে মাত্রাতিরিক্ত আদর না দিতেন, তাহলে শোচনীয় ওই পরিণতি তাকে বরণ করতে হতো না। সব সময় মনে রেখো, ‘রাজার বাণী হলো নিষ্ফলা এবং নিষ্প্রভ।

দ্বাদশ-সরকারি শক্তির প্রধান স্তম্ভ হলো, রাজ্যের ঘটনাবলি সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল থাকা। এক মুহূর্তের অবহেলা পরিণত হয় দীর্ঘ বছরের অপমানে। শয়তান শিবা পালাতে পেরেছিল আমারই অবহেলায়, আর তার ফলে মারাঠিদের নিয়ে আমাকে ভুগতে হয়েছে আজীবন।

সংখ্যার মধ্যে বারো হলো শুভ। তাই আমার নির্দেশ শেষ করলাম বারোটাতেই।

শিক্ষা যদি নিতে পারো
তোমার জ্ঞানে রইল চুম,
অবহেলায় যদি হারা
ভাঙবে না হয় তোমার ঘুম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *