০২. দাক্ষিণাত্যের দ্বিতীয় সুবাদারি : ১৬৫২-৫৮

২. দাক্ষিণাত্যের দ্বিতীয় সুবাদারি : ১৬৫২-৫৮

২.১ মোগল দাক্ষিণাত্যের ক্ষয় আর দুর্দশা: অর্থনৈতিক অসুবিধা

কান্দাহার থেকে কাবুলে ফেরার পর আওরঙ্গজেবকে দ্বিতীয়বারের মতো দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করা হলো (১৬৫২)। পথিমধ্যে বুরহানপুরে নয় মাস দেরি করার পর তিনি রাজধানী আওরঙ্গাবাদে এসে পৌঁছলেন ১৬৫৩ সালের নভেম্বরে, চার বছর সেখানে অবস্থান করার পর বেরোলেন গোলকুণ্ডা আর বিজাপুর অবরোধের উদ্দেশ্যে, এবং ১৬৫৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেষবারের মতো। দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করলেন দিল্লির সিংহাসন দখল করার অভিপ্রায়ে ।

১৬৪৪ সালের মে মাসে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি ত্যাগ করার পর মোগল প্রশাসন সেখানে মোটেই উন্নতি লাভ করতে পারেনি। এ কথা সত্য যে দেশ উপভোগ করেছিল এক অনভ্যস্ত বিশ্রাম, কিন্তু অনেক আবাদি জমি পরিণত হয়েছিল জঙ্গলে, কৃষক আর সম্পদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল, দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছিল রাজস্ব আদায় । এই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল স্বল্পমেয়াদি সুবাদারি আর অযোগ্য সুবাদারদের জন্য।

দাক্ষিণাত্য দীর্ঘ দিন ধরেই রাজকোষের মাথাব্যথার কারণ হয়েছিল। প্রদেশটা ছিল বিরাট, ভাঙা ভাঙা, জঙ্গলে পরিপূর্ণ, ত্রুটিযুক্তভাবে সংগঠিত, আর তার সীমান্ত ঘেঁষে ছিল দুটো শক্তিশালী রাষ্ট্র। ফলে সব সময়ই সেখানে রাখতে হতো সেনাবাহিনীর বড় একটা অংশ। কিন্তু জমি অনুর্বর হওয়ার কারণে ভালো ফসল সেখানে প্রায়ই ফলত না আর আদর্শ মানের একটা রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হতো না কখনোই। তখন মোগল দাক্ষিণাত্য গড়ে উঠেছিল যে চারটে প্রদেশের সমন্বয়ে তার বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৬২ লাখ টাকা; কিন্তু ১৬৫২ সালে রাজস্ব আদায় হয়েছিল মাত্র এক কোটি, অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশেরও কম। সুতরাং দাক্ষিণাত্যের সাধারণ আয় ছিল তার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন, আর তাই ঘাটতি পূরণ করে দক্ষিণের প্রশাসন যথাযথ চালু রাখার খাতিরে টাকা পাঠাতে হতো সম্পদশালী আর পুরনো প্রদেশগুলো থেকে।

দাক্ষিণাত্যে পা দিয়েই আওরঙ্গজেব এক কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। জায়গিরদের কাছে পাওয়া যেত তাদের নামেমাত্র রাজস্বের ক্ষুদ্র একটা অংশ। কেবল জায়গিরদের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হলে দাক্ষিণাত্যে চাকরি করা মোগল অফিসারদের অনাহারে থাকতে হতো। আওরঙ্গজেব প্রদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকতে দেখলেন তাঁর পূর্বসূরিদের অপশাসনের চিহ্ন। কখনো কখনো রাজস্ব আদায় হয়েছে এমনকি মোটে এক-দশমাংশ। এই আয় অনুসারে কোনো মতে ব্যয় নির্বাহ করাও অসম্ভব বলে মনে হলো নতুন সুবাদারের কাছে। সেই সময় জায়গিরদের কাছ থেকে বেতন নেওয়া অফিসারদের হিসেবের বাইরে কেবল সামরিক আর বেসামরিক ঘাটতিই ছিল বাৎসরিক ২০,৩৬,০০০ টাকা, যা পূরণ করতে হতো দাক্ষিণাত্যের সংরক্ষিত তহবিল থেকে।

সেনাবাহিনীর বেতন শোধ করার ব্যাপারে জায়গিরদারদের যে ঝামেলা ছিল, তার অনেকটাই আওরঙ্গজেব তুলে নিলেন নিজের কাঁধে । পিতা আর পুত্রের মধ্যের এই অর্থনৈতিক কলহ চলতে থাকল বছরের পর বছর। শাহজাহান চাইলেন দাক্ষিণাত্যের ঘাটতির জন্য আর যেন টাকা ঢালতে না হয়, ওদিকে জায়গিরদের পরিবর্তে আওরঙ্গজেব টাকা চেয়ে পাঠাতে লাগলেন অন্যান্য প্রদেশ থেকে!

দাক্ষিণাত্যে দ্বিতীয়বার সুবাদার নিযুক্ত করার সময় শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে বলেছিলেন, তিনি যেন চাষি সম্প্রদায়ের উন্নতি আর চাষবাসের সম্প্রসারণের প্রতি বিশেষ নজর দেন। আওরঙ্গজেবও পিতাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি এসব ব্যাপারে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তিনি কেবল অনুরোধ করেছিলেন যে তাঁকে যেন সুবাদার হিসেবে একটা লম্বা সময় এবং এই কাজের জন্য যথেষ্ট লোক আর টাকা সরবরাহ করা হয়, কারণ এক পুরুষব্যাপী যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মানুষের ঘাটতি আর বিশৃঙ্খলা আর তার পরবর্তী দশ বছরের অপশাসন দুই কিংবা তিন বছরে দূর করা সম্ভব নয়। শিগগিরই দাক্ষিণাত্যের জমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে তার সুবাদারি ইতিহাসে অক্ষয় হওয়ার পথে পা বাড়াবে।

২.২ মুর্শিদ কুলি খান : তাঁর চরিত্র এবং রাজস্ব পদ্ধতি

মুর্শিদ কুলি খান ছিলেন খোরাসানের অধিবাসী, তিনি ভারতে এসেছিলেন কান্দাহারের পলাতক শাসক আলী মর্দান খানের অনুচরদের সঙ্গে। তার ভেতরে ছিল ‘একজন সৈনিকের শৌর্যের পাশাপাশি একজন বেসামরিক কর্মকর্তার প্রশাসনিক দক্ষতা। দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের দেওয়ান হিসেবে মুর্শিদ কুলি রাজস্ব পদ্ধতির সংস্কার সাধন করেন এবং সাফল্যের মুখ দেখেন।

দাক্ষিণাত্যে এত দিন রাজস্ব পদ্ধতি বলতে কিছু ছিল না। জমির সীমানা চিহ্নিতকরণ, শিকল টেনে জরিপ, বিঘাপিছু রাজস্ব নির্ধারণ, কিংবা জমির উৎপাদনের কতখানি করে অংশ রাষ্ট্র, জমিদার আর চাষি পাবে তার সবই ছিল অজানা। দাক্ষিণাত্যের চাষিরা একটা লাঙল আর একজোড়া বলদের সাহায্যে যত বেশি সম্ভব জমিতে তার ইচ্ছে মতো যেকোনো ধরনের ফসল ফলাত, আর লাঙলপিছু রাষ্ট্রকে দিত খুব সামান্যই, একেক এলাকায় একেক রাজস্বের হার নির্ধারিত করা হয়েছিল খেয়ালখুশি মাফিক। ফলে চাষি সম্প্রদায় হয়ে পড়েছিল খামখেয়ালির শিকার। সেই সঙ্গে মোগলদের দীর্ঘ সব লড়াই আর বছরের পর বছরের শাসনহীনতা তাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ধ্বংসের মুখোমুখি। নিষ্পেষিত চাষিরা পালিয়ে গিয়েছিল তাদের বাড়ি ছেড়ে, পরিত্যক্ত জমি ঢেকে গিয়েছিল জঙ্গলে; একদা-সমৃদ্ধ অনেক গ্রাম পরিণত হয়েছিল বিরাণ ভূমিতে।

নতুন দেওয়ানের সংস্কার ছিল দাক্ষিণাত্যে টোডরমলের পদ্ধতির সম্প্রসারণ। প্রথমত, বিক্ষিপ্ত চাষিদের তিনি ফিরিয়ে আনলেন গ্রামের স্বাভাবিক জীবনে, আর নিয়োগ করলেন উপযুক্ত অফিসার। সব জায়গায় অভিজ্ঞ আমিন আর সৎ জরিপকারীরা জমির মাপ করে সেগুলোর রেকর্ড করল, সেই সঙ্গে পাথুরে মাটি আর নদীনালা থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করল চাষযোগ্য জমি। যেসব গ্রামের মোড়ল (মুকাদ্দাম) ছিল না, সেখানে অবশিষ্ট গ্রামবাসীদের মধ্য থেকে এমন কাউকে মোড়ল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো, যে চাষিদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং চাষাবাদের উন্নতিকল্পে প্রস্তুত। গবাদিপশু, বীজ এবং চাষাবাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি কেনার জন্য গরিব চাষিদের ঋণ (তাকাভি) দেওয়া হলো সরকারি তহবিল থেকে, আর অগ্রিম সেই ঋণ কিস্তিতে কিস্তিতে তাদের কাছ থেকে আদায় করা হলো ফসল কাটার পর।

স্থানীয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে পদ্ধতি পরিবর্তন করার উপযুক্ত জ্ঞান তার ছিল। যেখানে চাষাবাদ অনুন্নত আর জনসংখ্যা কম, কিংবা যেসব গ্রাম দুর্গম স্থানে অবস্থিত, সেখানে লাঙলপিছু রাজস্ব আদায়ের পুরনো ধারাটাকেই তিনি অপরিবর্তিত রাখলেন। কিন্তু অন্যান্য অনেক জায়গায় তিনি প্রবর্তন করলেন মূল উৎপাদনের অংশ ভাগের পদ্ধতি।

উত্তর ভারতের পদ্ধতি অনুসারে তার তৃতীয় ধারাটা ছিল বেশ জটিল। এখানে সরকারের সর্বোচ্চ ধার্য ছিল মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ, তা শস্য, ফল বা বীজ যা-ই চাষ করা হোক না কেন। এখানে বিঘাপিছু রাজস্ব আদায় করা হলো জমির পরিমাণ আর মান নিরূপণ করার পর, পাশাপাশি খতিয়ে দেখা হলো চাষের আওতায় আনা জমির পরিমাণ আর চাষকৃত ফসলের বাজারদর। এই পদ্ধতি মোগল দাক্ষিণাত্যে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করল আর শতাব্দী জুড়ে পরিচিত হলো ‘মুর্শিদ কুলি খানের ধারা’ নামে। চমৎকার এই পদ্ধতি, তাঁর অবিরাম ব্যক্তিগত যত্নের ফলে কয়েক বছরের মধ্যেই চাষাবাদে উন্নতি ঘটিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করল ।

২.৩ আওরঙ্গজেবের হাতে দাক্ষিণাত্য প্রশাসনের উন্নতি

সুবাদারি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আওরঙ্গজেব নজর দিলেন প্রশাসন দক্ষ করে ভোলার দিকে। বুড়ো এবং অযোগ্য মানুষদের হয় চাকরিচ্যুত করা হলো কিংবা সরিয়ে দেওয়া হলো নিমপদস্থ কোনো কাজে; পরীক্ষিত যোগ্যতার একদল অফিসার বেছে নিয়ে তাদের হাতে শাহজাদা ছেড়ে দিলেন যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতির ভার। সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধি করায় আগ্রহী আওরঙ্গজেব প্রথমেই নিশ্চিত করলেন অর্থনৈতিক সহযোগিতা, যা ছাড়া সেনাবাহিনীর মান বজায় রাখা কোনো মতেই সম্ভব নয়।

গোলন্দাজ বাহিনীর অত্যন্ত যোগ্য আর কর্মচঞ্চল একজন ইন্সপেক্টর জেনারেল শিগগিরই যাবতীয় পুরনো অপশাসন ঝেটিয়ে বিদায় করলেন। তিনি প্রতিটা দুর্গ পরিদর্শন করলেন, সেটা বড় কিংবা ছোট যেমনই হোক না কেন, আর সবগুলোকে সরবরাহ করলেন আবশ্যকীয় খাবার আর যুদ্ধোপকরণ। বুড়ো এবং অথর্ব মানুষদের নেওয়া হলো মাস্কেট চালানোর এক পরীক্ষা। যারা একবারও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না, তাদের চাকরিচ্যুত করা হলো। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া সেনাদের পেনশন দেওয়া হলো তাদের অতীত অবদান বিচার করে। এভাবে সেই ইন্সপেক্টর-জেনারেল বার্ষিক ৫০,০০০ টাকা বাঁচাতে সক্ষম হলেন।

২.৪ আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সম্রাটের মতভেদের কারণ

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের দ্বিতীয় সুবাদারি পিতার সঙ্গে তাঁর বেশকিছু বিবাদ দ্বারা চিহ্নিত । তখন আওরঙ্গজেবের শত্রুরা হয় তার বিরুদ্ধে সম্রাটের কান ভারী করেছে, নয়ত সম্রাটই দাক্ষিণাত্যে শাহজাদাকে যেসব ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেগুলো বুঝে উঠতে পারেননি। সুবাদারির শুরু থেকেই আওরঙ্গজেবকে ভুল বোঝা হয়েছে, সন্দেহ করা হয়েছে, তিনি হয়েছেন অন্যায্য তিরস্কারের শিকার। আর, অনুভবের এই তিক্ততাই ছিল সিংহাসন দখলের লড়াইয়ের নির্মমতা আর বিবেকহীনতার অন্যতম কারণ।

দাক্ষিণাত্যে তাকে সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার একদম প্রথমেই আওরঙ্গজেব সেখানকার জায়গিরদের সিন্ধের চেয়ে ১৭ লাখ টাকা কম দিতে চাওয়ার বিষয়ে আপত্তি করেছিলেন।

সেখানকার জায়গিরদের পরিবর্তে অধিকতর উৎপাদনক্ষম জায়গির চাইলেন আওরঙ্গজেব, আর তাঁর এই প্রস্তাবই হয়ে দাঁড়াল পিতা-পুত্রের এক দীর্ঘকালীন বাদানুবাদের কারণ।

কখনো কখনো কারও নিয়োগ বা অধস্তন কোনো কর্মচারীর পদোন্নতি প্রসঙ্গে সুবাদারের সুপারিশ সম্রাট কর্তৃক অগ্রাহ্য হয়েছে, আর শাহজাদা রেগেমেগে তার পিতাকে চিঠি লিখেছেন, ১৮ বছর বয়েস থেকে আমি সুবাদারের দায়িত্ব পালন করছি, আর পদের যোগ্য নয়, এমন কারও জন্য আমি কোনো দিনই সুপারিশ করিনি।’ এ ছাড়া আরও অনেক ব্যাপারেই পিতা আর পুত্রের মধ্যে মতভেদ ছিল।

তাঁদের মতভেদ ছিল বিজাপুর আর গোলকুপ্তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের দায়িত্ব নিয়েও। আওরঙ্গজেবের যুক্তি যথার্থই ছিল যে এই দুই দরবারের মোগল কূটনীতিকদের দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের আদেশ পালন করা উচিত এবং তাদের সঙ্গের রাজকীয় চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হওয়া উচিত তার মারফত। কিন্তু এই ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয় তাঁর প্রশাসনকালের শেষের দিকে, এমনকি তখনো পুরোপুরি নয়।

সম্রাট কর্তৃক অবিরাম ভুল-বোঝাবুঝি, তিরস্কার, আর বাধার সম্মুখীন হয়ে আওরঙ্গজেব একবার এতই বিরক্ত হন যে নিজের করা উচিত ছিল, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ না করে তিনি তিক্ত মন্তব্যসহ চিঠি লিখেন, এই পদক্ষেপটা নিয়ে আমি মোটেই অবাক হওয়ার মতো কিছু করিনি, যেহেতু আমাকে এমন সব কাজের ভার দেওয়া হয়েছে, যেগুলোতে আমি কখনোই অভ্যস্ত ছিলাম না। আগের চেয়ে এখন আমি হয়েছি অনেক বেশি সাবধানি!

২.৫ অপ্রধান কিছু অভিযান

যোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে আজকের মধ্যপ্রদেশের বেশির ভাগ স্থানই ছিল আদিম গোন্দ দলপতিদের নিয়ন্ত্রণে আর তখন সেটা পরিচিত ছিল গন্দোয়ানা নামে। বিখ্যাত গোন্দ রাজ্য গড়-মান্দলার ক্ষতিসাধিত হয়েছিল মোগল এক আক্রমণে আর রাজধানী ধ্বংস হয়েছিল আকবরের রাজত্বকালে, পরে উত্তর থেকে এখানে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করেছিল বুন্দেলা । কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি আরেকটা গোন্দ রাজ্য, যার রাজধানী ছিল দেওগড়ে, মাথা চাড়া দেয় এবং বেতুল, চিন্দোয়ারা আর নাগপুর জেলা, আর শিয়োনি, ভান্ডারা আর বালাঘাটের কিছু কিছু অংশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করে। গন্দোয়ানার দক্ষিণাংশে অবস্থিত চান্দা শহর, যেখানে ছিল দেওগড়ের রাজার বংশানুক্রমিক শত্রু তার আর প্রতিদ্বন্দ্বী তৃতীয় গোল বংশধরদের আবাস।

১৬৩৭ সালে খান-ই-দৌরান দেওগড়ে আক্রমণ চালিয়ে সম্রাটকে বার্ষিক ১ লাখ টাকা কর প্রদানের ব্যাপারে রাজাকে শপথ করায় । কিন্তু সেই কর বাকি পড়ে আর তা চেয়ে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো লাভ হয় না। সুতরাং, ১৬৫৫ সালে, শাহজাহান দেশটাকে আক্রমণের আদেশ দেন। গোন্দ রাজা, কেশরী সিং তৎক্ষণাৎ বশ্যতা মেনে নিয়ে বাকি শোধের শপথ করে ।

কঙ্কানের উত্তর আর বাগলানার দক্ষিণ-পশ্চিমের এক মালভূমির ওপর অবস্থিত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র জওহরে ছোট এক রাজা দিল্লির কর্তৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। আওরঙ্গজেবের পরামর্শে শাহজাহান দেশটাতে আক্রমণ চালানোর ব্যাপারে অনুমোদন প্রদান করেন, আর রাজা তখন আতঙ্কিত হয়ে বশ্যতা মেনে নেয় এবং বার্ষিক একটা কর প্রদানে শপথ করে (জানুয়ারি, ১৬৫৬)।

২.৬ গোলকুণ্ডা

গোলকুপ্তা একটা অত্যন্ত উর্বরা আর যত্নের সঙ্গে চাষাবাদকৃত দেশ, যার ছিল বিশাল এক পরিশ্রমী জনসংখ্যা। রাজধানী হায়দরাবাদ, তখন কেবল এশিয়ারই নয়, ছিল সারা পৃথিবীর হীরক ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। বিদেশি অনেক ব্যবসায়ী এখানে সম্মিলিত হয়ে ব্যবসা করত । রাজ্যটা ছিল অনেক শিল্পের জন্য বিখ্যাত, এ ছাড়া মসুলিপট্টমে ছিল বঙ্গোপসাগরের সেরা নোঙর ফেলার স্থান। রাজ্যের বনে ছিল উন্নত জাতের হাতির বড় বড় পাল, যেগুলো রাজার ঐশ্বর্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলতে সহায়তা করত। পর্যাপ্ত তামাক আর তাল ফলত এখানে, এবং অনেক রাজস্ব আদায় হতো তামাক আর তাড়ির শুল্ক থেকে।

আওরঙ্গজেব মাঝেমধ্যেই গোলকুণ্ডার রাজার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। বার্ষিক করের দুই লাখ হুন সব সময়ই বাকি পড়ে থাকত, আর মোগল সুবাদারের বারবার তাগাদার জবাবে রাজার তরফ থেকে আসত কেবল নানা অজুহাত আর সময় বাড়ানোর আবেদন।

১৬৩৬ সালে হুনের বিনিময় মূল্য ৪ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৪ টাকায় আর ১৬৫৪ সালে শেষমেশ হলো ৫ টাকা। কুতব শাহ পুরনো হারেই বার্ষিক কর দিচ্ছিল আট লাখ টাকা করে। বিনিময় মূল্য বৃদ্ধির কারণে মোগলেরা অতীত বছরগুলোর কর চেয়ে বসল একবারে, ফলে তার কাঁধে গিয়ে পড়ল ২০ লাখ টাকার নতুন করের বোঝা।

তারপর কর্ণাটক দখলের আগে সম্রাটের অনুমোদন না নেওয়ায় তার ভাগ্যে জুটল তিরস্কার। শেষমেশ ঘটল মীর জুমলার ঘটনা, যা যুদ্ধ ত্বরান্বিত করল।

২.৭ মীর জুমলা : তার ইতিহাস ও অবস্থান

১৬৩৬ সালের চুক্তি মোগল সাম্রাজ্য আর দাক্ষিণাত্যের দুই রাজ্যকে পরিষ্কারভাবেই বিভক্ত করেছিল। উত্তরে মোগলদের শক্তিশালী বাহুর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই দুই রাজ্য তাদের নিজস্ব সেনাদল গড়ে তুলেছিল, যারা নিজ উচ্চাশা অনুযায়ী দখল শুরু করেছিল অন্যান্য দিকে। পুরো কর্ণাটক, কৃষ্ণা নদী থেকে তাঞ্জোর পেরিয়ে কাবেরী পর্যন্ত ছিল ছোট্ট ছোট্ট হিন্দু রাজ্য, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের এবড়োখেবড়ো ধ্বংসাবশেষ। এগুলো শিগগিরই হয়ে দাঁড়াল মুসলমানদের শিকার। গোলকুণ্ডার সেনাবাহিনীর বিজয়রথ এগিয়ে এল বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত, দখল করল তারা চিল্কা হ্রদ থেকে পেনার নদী পর্যন্ত ।

বিজাপুরের বিজয়রথ এগোল দক্ষিণে, তারপর পূর্বে ঘুরে দখল করল তারা জিনজি আর তাঞ্জোরের মধ্যবর্তী উপকূল । উত্তর আর দক্ষিণে দুই সুলতানের জয় করা দেশগুলোর মধ্যে, ঠিক যেন কোনো দানবের দুই চোয়ালের মাঝখানে অবস্থিত চন্দ্রগিরি রাজ্য, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শেষ টুকরো, যার ভূখণ্ড ছিল পূর্বে নেলোর থেকে পণ্ডিচেরী অঞ্চল আর পশ্চিমের মহীশূর সীমান্ত পর্যন্ত। এই রাজ্য দখলের প্রতিযোগিতায় নামল গোলকুণ্ডা আর বিজাপুরের রাজা; উত্তর আর দক্ষিণ থেকে চোয়াল দুটো দ্রুত গিলে ফেলতে উদ্যত হলো অভিশপ্ত কর্ণাটককে। আর দখলের এই প্রতিযোগিতায় বিশিষ্টতম ভূমিকা রাখলেন গোলকুণ্ডার উজির মীর জুমলা।

মুহম্মদ সাঈদ, ইতিহাসে যিনি মীর জুমলা নামে বিখ্যাত, ছিলেন পারস্যের আর্দিস্তানের একজন সাঈদ, ইস্পাহানের ধনী একজন তৈল ব্যবসায়ীর পুত্র। অন্যান্য শিয়া অভিযানকারীদের মতো যৌবনেই স্বদেশ ত্যাগ করে ভাগ্যের অম্বেষণে তিনি এসেছিলেন দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের দরবারে (১৬৩০), যারা ছিল তারই গোত্রের। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর ব্যবসায়িক সামর্থ্যের কারণে একজন হীরক ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি হয়েছিলেন প্রভূত সম্পদের অধিকারী। অসামান্য প্রতিভার বলেই আবদুল্লাহ কুতব শাহের সুনজরে পড়ে তিনি হলেন তার প্রধানমন্ত্রী। মীর জুমলার পরিশ্রম, দ্রুত ব্যবসায়িক সম্পাদন, প্রশাসনিক দক্ষতা, সামরিক সহজাত প্রতিভা আর জন্মগত নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁকে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করিয়েছিল। সামরিক এবং বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রে সমদক্ষতার ফলে শিগগির তিনিই একপ্রকার হয়ে দাঁড়ালেন গোলকুপ্তার শাসক: তাঁর অনুমোদন ছাড়া কিছুই সুলতানের কাছে যেত না। প্রভু কর্তৃক কর্ণাটকে প্রেরিত হয়ে শিগগিরই তিনি সেখানকার আমূল রূপান্তর ঘটালেন। মীর জুমলা নিজের শক্তি বৃদ্ধি করলেন ইয়োরোপিয়ান গানার আর কামান-ঢালাইকারীদের সহায়তায়, সেনাবাহিনীকে তুলে আনলেন শৃঙ্খলা এবং দক্ষতার চুড়ায়, আর শিগগিরই দখল করলেন কুড্ডাঙ্গা জেলা। তাঁর সেরা অর্জন পাহাড়ে দুর্গ গাণ্ডিকোটা দখল, যেটা ছিল সবার দৃষ্টিতে অজেয়। কুচ্ছাপ্পার পুবের সিধুটও দখল করা হলো, তার সেনাপতিরা এগিয়ে গেল চন্দ্রগিরি আর উত্তর আট জেলার তিরুপতি পর্যন্ত। দক্ষিণের সম্পদশালী প্রাচীন মন্দিরগুলো লুট আর গুপ্তধন খুঁড়ে তুলে মীর জুমলা হলেন বিশাল ভাগ্যের অধিকারী, একসময় পরিচিত হলেন তিনি দক্ষিণের শ্রেষ্ঠ ধনী মানুষ আর বিশ মণ হীরের মালিক হিসেবে। এসব জয়ের ফলে তাঁর কর্ণাটকের জায়গির পরিণত হলো ৩০০ মাইল দীর্ঘ আর ৫০ মাইল প্রশস্ত এক রাজ্যে, যার বার্ষিক কর ৪০ লাখ টাকা, আর যার অন্তর্গত বেশ কয়েকটা হীরের খনি। এভাবে প্রভুর কর্তৃত্ব থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে তিনিই পরিণত হলেন কর্ণাটকের রাজায়। ঈর্ষান্বিত সভাসদেরা এই বলে গোলকুণ্ডার সুলতানের কান ভারী করতে চাইল না যে উজিরের অস্ত্রশক্তি এখন তারই নিরাপত্তার পক্ষে হুমকি, আর ভৃত্যের সম্পদের কাছে হার মেনেছে প্রভুর দরবারের জাকজমক। স্বাভাবিকভাবে, কুতব শাইও কর্ণাটক থেকে পাওয়া তার উজিরের সম্পদের একটা অংশ লাভের আশা করেছিল। পক্ষান্তরে, মীর জুমলা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর প্রভুর দুর্বলতা আর অক্ষমতা, ফলে জয়গুলোকে তিনি ধরে নিয়েছিলেন তার আপন কৃতিত্ব হিসেবে এবং সভাসদের জীবনে তিনি আর ফিরে যেতে চাননি। শেষমেশ কুতব শাহ খোলাখুলিই তার অবিশ্বস্ত ভৃত্যকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার ভার নিয়েছিল।

২.৮ মোগলদের সঙ্গে কুতব শাহের বিচ্ছেদ ১৬৫৫

মীর জুমলা একজন রক্ষাকারী খুঁজতে লাগলেন। বিজাপুরে কাজ করবেন, এই প্রস্তাব দেওয়ার পাশাপাশি গোপনে তিনি যোগাযোগ শুরু করলেন মোগল শক্তির সঙ্গে। সম্পদশালী গোলকুণ্ডা রাজ্য দখলের একটা আশা লালন করতেন আওরঙ্গজেব, ফলে সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর মতো এমনই একজন সাহায্যকারী আর পরামর্শদাতা পাওয়ার ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী। গোলকুণ্ডার মোগল দূত মারফত তিনি একটা গোপন যোগাযোগ করতে লাগলেন মীর জুমলার সঙ্গে, তাঁকে কথা দিলেন যে তিনি যদি মোগলদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাহলে তিনি তাকে সম্রাটের সীমাহীন অনুগ্রহ পাইয়ে দেবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব গ্রহণের ব্যাপারে মীর জুমলার কোনো তাড়া ছিল না; তিনি এক বছর সময় চাইলেন, আর তার এই কপটতায় খুবই বিরক্তবোধ করলেন আওরঙ্গজেব ।

কুতব শাহ মীর জুমলাকে শাস্তি দেওয়ার মতো সেনা কিংবা সাহস সমাবেশ করার আগেই ঝামেলা পাকলি উজিরের পুত্র মুহম্মদ আমিনের আচরণ। উদ্ধত এবং অস্থিরচিত্ত এই যুবক তার পিতার সহকারী হিসেবে কাজ করত গোলকুণ্ডার দরবারে, আর সেখানে খোলাখুলিই সুলতানকে কিছুটা অসম্মান করত । অবশেষে একদিন মাতাল হয়ে দরবারে এল মুহম্মদ আমিন টলতে টলতে, আর সুলতানের নিজস্ব কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ে ঘুমের ঘোরে বমি করে আশপাশ ভাসিয়ে দিল। দীর্ঘ দিন ধরে চেপে রাখা সুলতানের রাগের আগুনে যেন ঘি পড়ল, সে মুহম্মদ আমিনসহ তার পরিবারকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার সম্পত্তি ক্রোক করল (২১ নভেম্বর, ১৬৫৫)। এবং দীর্ঘ দিন যাবৎ আওরঙ্গজেব ছিলেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায়।

১৮ ডিসেম্বর মীর জুমলা আর তার সন্তানকে মোগল বাহিনীতে নিয়োগ করা সংক্রান্ত সম্রাটের চিঠি পেলেন আওরঙ্গজেব, আর কুতব শাহকে নির্দেশ দিলেন যে সে যেন তাদের রাজদরবারে আসার ব্যাপারে বাধার সৃষ্টি না করে কিংবা তাদের সম্পত্তি আটকে না রাখে । তিনি সম্রাটের আদেশ অমান্য কিংবা তা পালনে বিলম্ব করলে কুতব শাহকে যুদ্ধের হুমকিও দিলেন। ইতিমধ্যে গোলকুণ্ডা সীমান্তে সেনা সমাবেশও করলেন আওরঙ্গজেব কিন্তু আসন্ন এই ঝড় দেখেও যেন অন্ধ হয়ে রইল কুতব শাহ, মোগল আদেশের কোনো তোয়াক্কাই সে করল না।

মুহম্মদ আমিনের বন্দী হওয়ার কথা শুনে (২৪ ডিসেম্বর) শাহজাহান একটা চিঠিতে কুতব শাহকে নির্দেশ দিলেন যে সে যেন মীর জুমলার পরিবারকে মুক্ত করে দেয়। কাজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এই চিঠিই যথেষ্ট সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন সম্রাট। কিন্তু আওরঙ্গজেবকে খুশি করার জন্য তিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও, মুহম্মদ আমিনকে আটকে রাখলে গোলকুণ্ডা আক্রমণের অনুমোদন দিলেন (২৯ ডিসেম্বর)। উভয় চিঠিই আওরঙ্গজেবের হাতে পৌঁছাল ১৬৫৬ সালের ৭ জানুয়ারি। তিনি তখন গোলকুণ্ডা আক্রমণের জন্য চাতুরির আশ্রয় নিলেন। শাহজাহানের ২৪ ডিসেম্বরের চিঠি পেয়ে সেই মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুযোগই তিনি দিলেন না কুতব শাহকে, বরং এই ঘোষণা করলেন যে সম্রাটের ৩ ডিসেম্বরের চিঠি পাওয়ার পরও বন্দীদের মুক্ত করার ব্যাপারে তার অস্বীকৃতিতে সম্রাটের আদেশ লঙ্ঘিত হয়েছে, আর খোলাখুলি এই অবাধ্যতার ফলে এখন গোলকুণ্ডা আক্রমণ করা দরকার।

২.৯ আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা রাজ্য আক্রমণ ১৬৫৬

আওরঙ্গজেবের আদেশে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মুহম্মদ সুলতান অতিক্রম করলেন নান্দার সীমান্ত (১০ জানুয়ারি, ১৬৫৬), আর অশ্বারোহী সেনাসহ তীরবেগে গিয়ে পৌঁছালেন হায়দরাবাদে। মাসের বিশ তারিখে পুত্রের সঙ্গে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে আওরঙ্গজেব স্বয়ং ছুটলেন আওরঙ্গাবাদ থেকে।

ইতিমধ্যে মুহম্মদ সুলতান তার ভূখণ্ডে প্রবেশ করার পর শাহজাহানের ২৪ ডিসেম্বরের কড়া নির্দেশসংবলিত চিঠি পৌঁছাল আবদুল্লাহর হাতে, আর সে তৎক্ষণাৎ পরিবারসহ মুহম্মদ আমিন আর তার ভৃত্যদের মুক্ত করে পাঠিয়ে দিল শাহজাদার কাছে, সঙ্গে সম্রাটের বশ্যতা স্বীকারের একখানা বিনয়ী চিঠি। কিন্তু আওরঙ্গজেব এমনভাবেই ফন্দি এঁটেছিলেন যে বশ্যতা স্বীকারের এই বিলম্বের ফলে কুতব শাহ যেন রক্ষা না পায়। মুহম্মদ আমিন শাহজাদার অপেক্ষায় রইল হায়দরাবাদের ২৪ মাইল দূরে (সম্ভবত ২১ জানুয়ারি), কিন্তু শাহজাদা তার লড়াই থামাতে রাজি তো হলেনই না, বরং এই ছলে ছুটে চললেন রাজধানী অভিমুখে যে আবদুল্লাহ এখনো বন্দীদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়নি। কুতব শাহের শেষ ভরসাও উবে গেল; মোগল অশ্বারোহী বাহিনীর অতি দ্রুত আগমন তাকে অবাক করে দিল। সমূলে বিনাশ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ২২ জানুয়ারি রাতে রাজধানী ত্যাগ করে পালিয়ে গেল সে গোলকুণ্ডা দুর্গে।

এই পলায়ন তার জীবন রক্ষা করল, কারণ মুহম্মদ সুলতানের প্রতি আওরঙ্গজেবের গোপন নির্দেশটা ছিল ভয়ংকর :

কুতব-উল-মুলক একজন কাপুরুষ, ফলে সে সম্ভবত কোনো রকম প্রতিরোধ করতেই যাবে না। সংবাদটা পৌঁছে দেওয়ার পরপরই তাকে আক্রমণ করবে প্রচণ্ডভাবে আর সম্ভব হলে লক্ষ রেখো, তার ঘাড়কে যেন আর তার মাথার ভার বহন করতে না হয়। এই পরিকল্পনা সফল করার সেরা উপায় হলো বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা, তৎপরতা, আর হাতের ক্ষিপ্রতা।

২৩ জানুয়ারি আক্রমণকারীরা এসে পৌঁছাল হায়দরাবাদের দুই মাইল উত্তরের হুসাইন সাগর দিঘির পাশে। পরদিন তরুণ শাহজাদা হায়দরাবাদে প্রবেশ করলেন। লুটপাট আর হিংস্রতা প্রতিরোধ করার জন্য শহরে শক্ত একটা দল রাখা হলো মুহম্মদ বেগের অধীনে। হায়দরাবাদ ছিল ভারতের ধনী শহরগুলোর অন্যতম। তখন মোগল সেনাবাহিনী কর্তৃক হায়দরাবাদের এই লুণ্ঠন ছিল পুরো ভারতের আলোচনার বিষয়বস্তু। আওরঙ্গজেবের অশ্বপাল, আকিল খান রাজি, তার ইতিহাসে লিখেছে, কুতব- উল-মুলকের বেশির ভাগ সংগৃহীত বস্তু আর সম্পত্তি, যেমন অসংখ্য মূল্যবান বই আর অন্যান্য মূল্যবান বস্তু লুষ্ঠিত হয়েছে শাহজাদা মুহম্মদ সুলতানের হাতে… কুতব-উল-মুলকের অনেক দুর্লভ সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করেছেন আওরঙ্গজেব।

সেনাবাহিনীসহ আওরঙ্গজেব দৃশ্যপটে এসে পৌঁছালেন ৬ ফেব্রুয়ারি। চিরাচরিত কর্মচাঞ্চল্য আর তৎপরতার সঙ্গে পরীক্ষা করলেন তিনি গোলকুণ্ডা দুর্গ আর তার আশপাশের এলাকা।

পরদিন থেকে শুরু হলো গোলকুণ্ডা অবরোধ। দুর্গের পশ্চিম পাশটা ছিল মুক্ত, তা ছাড়া বাকি তিনটে পাশই পরিখা খুঁড়ে ঘিরে রাখল মোগল বাহিনী। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ ব্যাপী এই অবরোধ পরিচালিত হলো খুবই ঢিলেঢালাভাবে, কারণ, তার অধীনে যেসব অস্ত্রশস্ত্র মজুত ছিল, তা দিয়ে এমন একটা অজেয় দুর্গের ক্ষতিসাধন অসম্ভব। গোলকুণ্ডার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত হতে লাগল খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। এসবের ফাঁকে ফাঁকে প্রায় প্রতিদিনই আসতে লাগল নানা রকম উপঢৌকন আর শান্তি প্রস্তাব। কিন্তু আওরঙ্গজেব এসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। ছোটখাটো উপঢৌকনে তার মন ভরবে না, তিনি চান পুরো রাজ্য। গোলকুপ্তাকে মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার অনুমতি প্রদানের জন্য পিতার সামনে তিনি উপস্থিত করতে লাগলেন যাবতীয় ধরনের যুক্তি । কিন্তু স্রেফ অবিশ্বস্ত একজন উজিরকে শৃঙ্খলার আওতায় আনার চেষ্টা করার অপরাধে শাহজাহান একজন ভাতৃসম সুলতানকে ধ্বংস করতে চাননি। দারা দিল্লি গোলকুপ্তার কূটনীতিকের ঘুষ খেয়ে আর আওরঙ্গজেবের ভীষণ ঘৃণা আর ক্রোধ উৎপাদন করে কুতব-উল-মুলকের পক্ষে কঠোর ওকালতি শুরু করলেন, এবং ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে নিশ্চিত করালেন তার নিরাপত্তা। এ বিষয়ে সম্রাটের অনুমোদনসংবলিত চিঠি আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছাল ২৪ ফেব্রুয়ারি। সম্রাটের লেখা কুতব-উল-মুলককে ক্ষমা করে দেওয়ার এই চিঠি (৮ ফেব্রুয়ারি) আওরঙ্গজেব গোপন করে রাখলেন, পাছে সে আবার সাহস সঞ্চয় করে চুক্তি ভঙ্গে উৎসাহিত হয়ে ওঠে।

ইতিমধ্যে দিল্লি দরবারে নিযুক্ত আবদুল্লাহর প্রতিনিধি দারা শুকো আর শাহজাদি জাহানারাকে দিয়ে মধ্যস্থতার ব্যবস্থা করাল। তাঁদের মাধ্যমে সে সম্রাটের সামনে ফাস করল আওরঙ্গজেবের কূটকৌশলের সত্য ঘটনা–কীভাবে আবদুল্লাহর বিপক্ষে ফন্দি এঁটে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে তাকে করা হয়েছিল প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি, কীভাবে তাকে দেওয়া হয়নি সম্রাটের আদেশ মান্য করার সুযোগ, কীভাবে তার কাছ থেকে গোপন করা হয়েছে সম্রাটের ফরমান, কীভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে দীন একজন শাসকের প্রতি শাহজাহানের সহানুভূতি। সব শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন শাহজাহান। কড়া একটা তিরস্কারের চিঠি লিখলেন তিনি আওরঙ্গজেবকে, সঙ্গে এই মুহূর্তে অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে গোলকুপ্তার ভূখণ্ড ত্যাগের নির্দেশ।

সুতরাং, ৩০ মার্চ, সম্রাটের চরম নির্দেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে গোলকুণ্ডার অবরোধ উঠিয়ে ফিরে এলেন আওরঙ্গজেব। চার দিন পর আবদুল্লাহ কুতব শাহের, দ্বিতীয় কন্যার সঙ্গে মুহম্মদ সুলতানের বিয়ে হলো। গোলকুপ্তার সুলতানকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ আর এক কোটি টাকার বকেয়া কর দেওয়ার পাশাপাশি ছেড়ে দিতে হলো রামগির শহর (বর্তমানের মানিকদ্রগ আর চিনুর)। মোগল সেনাবাহিনী ফিরতি পথ ধরল ২১ এপ্রিল।

মীর জুমলা ২০ মার্চ আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডার শিবিরে এলেন যতটা না সভাসদ তার চেয়ে বেশি একজন শাহজাদার বেশে। ছয় হাজার অশ্বারোহী, ১৫,০০০ পদাতিক, ১৫০টা হাতি, আর তার সঙ্গে চমৎকার একটা গোলন্দাজ বাহিনী। সম্রাটের দরবারের ডাক পেয়ে দিল্লি এলেন তিনি ৭ জুলাই, সম্রাটকে উপহার দিলেন ১৫ লাখ টাকার সামগ্রী, আর ২১৬ রতির বিশাল এক হীরে। তৎক্ষণাৎ তাঁকে দেওয়া হলো ছয় হাজার সেনার সেনাপতির পদ, আর প্রধানমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত করা হলো সাদুল্লাহ খানের মৃত্যুর পর।

২.১০ গোলকুণ্ডার লুটের মাল নিয়ে শাহজাহানের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের বিবাদ

এই অভিযানের ফলে সম্রাটের সঙ্গে আবার আওরঙ্গজেবের বিবাদ শুরু হলো। হায়দরাবাদের লুটের মালের বিবরণ দিল্লিতে এসেছিল অতিরঞ্জিত হয়ে। সম্ভবত গোলকুণ্ডার সেই কূটনীতিকই এই ব্যাপারেও শাহজাহানের কান ভারী করেছিল যে আওরঙ্গজেব আর তাঁর পুত্রগণ কোনো রকম উল্লেখ না করেই কুতব শাহের কাছ থেকে নিয়েছেন বহু মূল্য সব উপহার, কিংবা সেসবের মূল্যের বিনিময়ে বকেয়া করে কোনো ছাড় দেননি। পক্ষান্তরে, আওরঙ্গজেব অভিযোগ করেছেন যে কথা মতো গোলকুণ্ডার ক্ষতিপূরণের কোনো অংশ শাহজাহান তাঁকে দেননি; ‘গোলকুপ্তার ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণটা সম্রাট নিয়ে জমা দিয়েছেন দৌলতাবাদের কোষাগারে। তাহলে কীভাবে আমি যুদ্ধের ঋণ আর সৈন্যদের বকেয়া প্রায় ২০ লাখ টাকা পরিশোধ করব?’ তিনি বলেছেন, গোলকুণ্ডায় প্রাপ্ত উপহারসামগ্রী অতিরঞ্জিত হয়ে ‘সিন্দুক-ভর্তি রত্নে’ পরিণত হয়েছে সম্রাটের বিদ্বেষপরায়ণ মানুষের বিবরণে।

গোলকুণ্ডায় শান্তি স্থাপিত হলেও একটা বিরোধ থেকেই গেল। কুতব শাহ কর্ণাটক রেখে দিতে চাইল, আর তা ন্যায্যভাবেই: তার ভৃত্য দখল করায় এটা হয়ে গেছে তার রাজ্যেরই অংশ। কিন্তু আপত্তি জানিয়ে আওরঙ্গজেব বললেন যে এটা মীর জুমলার ব্যক্তিগত জায়গির আর বিষয়টা নিস্পত্তির ভার ছেড়ে দিলেন সম্রাটের হাতে, এবং তিনি মীর জুমলার জায়গির হিসেবে কর্ণাটক নিজ দখলে রেখে কুতব শাহকে সেখান থেকে তার অফিসারদের সরিয়ে নেওয়ার আদেশ দিলেন। কিন্তু গোলকুণ্ডার অফিসারেরা সম্পদশালী এই স্থান ছেড়ে সহজে যেতে চাইল না। যথাসম্ভব কাঁটা বিছাল তারা মোগলদের সেখানে গিয়ে স্থায়ী হওয়ার পথে।

২.১১ আওরঙ্গজেবের বিজাপুর আক্রমণ ১৬৫৭

মুহম্মদ আদিল শাহের রাজত্বকালে (১৬২৬-৫৬) বিজাপুর রাজ্য উঠে গিয়েছিল বিস্তৃতি, ক্ষমতা আর চমৎকারিত্বের শীর্ষে। তার আধিপত্য বিস্তার লাভ করেছিল আরব সাগর থেকে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারতীয় উপদ্বীপজুড়ে। ১৬৩৬ সালের পর থেকে বেশ শান্তি বিরাজ করছিল মুহম্মদ আদিল শাহ আর দিল্লির সম্রাটের মধ্যে, দুই দরবারে আদান-প্রদান হতো বন্ধুত্বপূর্ণ উপহার । ধর্মানুরাগে সুলতানের সুনাম, ন্যায়বিচারের প্রতি ভালোবাসা, আর প্রজাদের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি পৃথিবী সম্বন্ধে তার জ্ঞান আর অজ্ঞতার বিশেষ একটা সরলতায় খুব সন্তুষ্ট ছিলেন শাহজাহান। কিন্তু দিল্লিতে মীর জুমলার আগমন (৭ জুলাই, ১৬৫৬) আওরঙ্গজেবের আগ্রাসনপন্থার বিজয় নিশ্চিত করল। সম্রাটের পরামর্শদাতাদের মধ্যে মীর জুমলার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় আওরঙ্গজেব গোপনে বিজাপুর আক্রমণের পরিকল্পনা করলেন রাজ্যটির শাসকের সম্ভাব্য মৃত্যুর দিনে।

১৬৫৬ সালের ৪ নভেম্বর বিজাপুর রাজকীয় সারির সপ্তম ব্যক্তি মুহম্মদ আদিল শাহ মৃত্যুবরণ করল। তার মুখ্যমন্ত্রী খান মুহম্মদ আর রানি বারী সাহিবার প্রচেষ্টায় মুকুট উঠল প্রয়াত সুলতানের একমাত্র পুত্র, ১৮ বছরের তরুণ, দ্বিতীয় আলী আদিল শাহের মাথায়। শিগগিরই আক্রমণের অনুমতি চেয়ে শাহজাহানের কাছে আওরঙ্গজেব চিঠি লিখলেন এই ওজরে যে আলী আসলে প্রয়াত সুলতানের পুত্র নয়, সে মুহম্মদ আদিল শাহের তত্ত্বাবধানে হেরেমে বেড়ে ওঠা এক পিতৃপরিচয়হীন বালক। মুহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর পর কর্ণাটকে বিশৃঙ্খলা দেখা দিল; জমিদারেরা দখল করে নিল তাদের আগের জমিজমা। রাজধানীর অবস্থা হলো আরও খারাপ। বিজাপুরের সভাসদেরা নিজেদের মধ্যে এবং প্রধানমন্ত্রী খান মুহম্মদের সঙ্গে কলহ শুরু করে দিল ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে। অশুভ এই পরিস্থিতি উসকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রে যোগ দিলেন আওরঙ্গজেব, দরবারের নেতৃস্থানীয় কয়েকজনের চরিত্র কলুষিত করায় সফল হলেন তিনি। তারা তার আনুগত্য স্বীকার করে নিজ নিজ সেনাবাহিনীসহ স্বদেশ ত্যাগ করে মোগলদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিল। আওরঙ্গজেব আশা করলেন, মীর জুমলার সহায়তায় তিনি বাকিদেরও চরিত্র কলুষিত করতে সমর্থ হবেন।

২৬ নভেম্বর আক্রমণের অনুমতি দিলেন শাহজাহান, সেই সঙ্গে আওরঙ্গজেবকে পূর্ণ স্বাধীনতা যে বিজাপুরের ব্যাপারে তিনি যা ভালো বোঝেন, তা-ই করবেন। আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীকে জোরদার করার জন্য কিছুটা দরবার কিছুটা জায়গির থেকে নেওয়া ২০,০০০ সেনার একটা দল, অফিসারদের একটা বিশাল বহর, আর স্বয়ং মীর জুমলা যোগ দিলেন। অনুমতি পেলেও এটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যায় এক যুদ্ধ। বিজাপুর সামন্ত রাজ্য নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বাধীন, ফলে সেখানে হস্তক্ষেপের কোনো বৈধ অধিকার মোগল সম্রাটের ছিল না। মীর জুমলা আওরঙ্গাবাদে পৌঁছালেন ১৮ জানুয়ারি আর সেই একই দিনে, জ্যোতিষীদের নির্ধারিত শুভ সময়ে, শাহজাদা অগ্রসর হলেন বিজাপুর আক্রমণের উদ্দেশ্যে। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পৌঁছালেন বিদারের পাশে, আর দুর্গ অবরোধ করলেন ২ মার্চ। বেশ একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলল সিদ্দি মার্জান, কিন্তু শেষমেশ সুবিধা করতে পারল না বিশাল মোগল বাহিনীর বিপক্ষে, আর মীর জুমলার চমৎকার গোলন্দাজ বাহিনী দুর্গপ্রাকারের খুবই ক্ষতি করল; ধ্বংস হয়ে গেল দুটো টাওয়ার আর সবচেয়ে নিচের দেয়ালের ব্যাটলমেন্টের পাশাপাশি বাইরের দিকের দেয়াল মাটির সঙ্গে মিশে গেল।

আক্রমণ চালানো হলো ২৯ মার্চ। মোগলদের ছোঁড়া গোলা থেকে একটা ফুলিঙ্গ গিয়ে পড়ল টাওয়ারের পেছনে রক্ষিত বারুদ আর গ্রেনেডের মধ্যে। ঘটল প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ। দুই পুত্র আর বহু অনুসারীসহ মারাত্মকভাবে আহত হলো মার্জান। ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে প্রতিরোধকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মোগলেরা। মৃত্যুশয্যা থেকে সিদ্দি মার্জান দুর্গের চাবি দিয়ে তার সাত পুত্রকে পাঠাল আওরঙ্গজেবের কাছে। এভাবে, অবরোধের মাত্র ২৭ দিন পর, বিদার দুর্গের পতন হলো। জয়ের লুটের মালের মধ্যে পাওয়া গেল ১২ লাখ টাকা, ৮ লাখ টাকা মূল্যের বারুদ, গুলি, শস্য, আর তার সঙ্গে ২৩০টা কামান।

তারপর সম্মিলিত শত্রু সেনাবাহিনীকে পরাস্ত আর বিজাপুর ভূখণ্ডের পশ্চিমের কালিয়ানি আর দক্ষিণের কুলবর্গা পর্যন্ত ধ্বংস করার জন্য সুশিক্ষিত অশ্বারোহীদের ১৫,০০০-এর একটা বাহিনী পাঠালেন আওরঙ্গজেব মহব্বত খানের অধীনে। মোগল সেনারা শত্রুর মুখোমুখি হলো ১২ এপ্রিল । বিখ্যাত সেনাপতি খান মুহম্মদ, আফজাল খান এবং রণদৌলা আর রায়হানের পুত্রদের অধীনে আক্রমণ শুরু করল প্রায় ২০০০০ বিজাপুরী । চমৎকার একজন সেনাপতির মতোই শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও নিজ সেনাদের ছত্রভঙ্গ হতে দিল না মহব্বত খান; অবশেষে আক্রমণ চালাল সে আর বিজাপুরীরা পালিয়ে গেল।

বিদারের ৪০ মাইল পশ্চিমে, তুলজাপুরের পবিত্র তীর্থ থেকে গোলকুণ্ডা যাওয়ার পুরনো রাস্তার ওপর, কালিয়ানি শহর–চালুক্য রাজা আর কানারিদের দেশের প্রাচীন রাজধানী। ২৭ এপ্রিল হালকা সাজসরঞ্জাম নিয়ে রওনা দিয়ে আওরঙ্গজেব কালিয়ানির পাশে পৌঁছালেন সপ্তাহ খানেকের মধ্যে। শিগগিরই জায়গাটা অবরোধ করা হলো। দুর্গকার থেকে চলল অবিরাম গুলিবর্ষণ; মীর জুমলার ট্রেঞ্চের ওপরও তারা চালাল ভয়াবহ আক্রমণ, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। একবার কালিয়ানির ১০ মাইল উত্তর-পুবে মহব্বত খান পড়ে গেল শত্রু ঘেরাওয়ের মধ্যে। সংঘটিত হলো দীর্ঘ আর ভয়ংকর এক যুদ্ধ। আক্রমণের আসল ধাক্কা গেল রাজপুতদের ওপর দিয়ে। খান মুহম্মদের অশ্বারোহীরা রাও ছত্র শাল আর তার হাদা জ্ঞাতিদের ওপর চালাল ব্যর্থ এক আক্রমণ। বিজাপুরের বাহলুল খানের পুত্রদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ঘোড় থেকে পড়ে গেল রাজা রাই সিংহ শিশোদিয়া। ঠিক তখনই এসে পৌঁছাল সাহায্য: মহব্বত খানের আক্রমণে শত্রুরা পালাল ছত্রভঙ্গ হয়ে।

আওরঙ্গজেব যখন অবরোধ আরও কঠিন করে তোলায় মনোনিবেশ করেছেন, ৩০,০০০ বিজাপুরী সেনার একটা শক্তিশালী বাহিনী জমায়েত হলো তাঁর তাঁবু থেকে মাত্র চার মাইল দূরে। ২৮ মে সেনাবাহিনীর মূল অংশ সঙ্গে নিয়ে শাহজাদা এগোলেন শক্ত অবস্থানের দিকে। তুমুল এক যুদ্ধ হলো ছয় ঘণ্টা ধরে। চারবার শত্রুসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, আবার একত্র হয়ে তারা রুখে দাঁড়াতে লাগল মোগলদের সামনে। কিন্তু শেষমেশ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত উত্তরে অশ্বারোহীদের বারবার আক্রমণের মুখে তারা আর টিকতে পারল না। বাম আর ডান পাশ থেকে মোগল সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর, আর তাড়া করে গিয়ে উপস্থিত হলো তাদের তাঁবুতে। সবকিছুই পাওয়া গেল বিজাপুরী তাঁবুতে–অস্ত্রশস্ত্র, ক্রীতদাসী, ঘোড়া, মালবাহী গবাদিপশু, আর নানা জাতের সামগ্রী-সমস্ত লুষ্ঠিত হলো । অবরোধ আরও কঠিন করা হলো দারুণ তেজের সঙ্গে, প্রতিরোধও ছিল একই রকম বীরত্বপূর্ণ। মোগলদের বিপক্ষে লড়ার জন্য বিজাপুরীরা আবার সংগঠিত হতে লাগল। সুতরাং, ২২ জুলাই, তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য আওরঙ্গজেব বিশাল এক বাহিনী পাঠালেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আর মীর জুমলার অধীনে। ৪৮ মাইল এগোনোর পর আক্রমণ চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল মোগল সেনারা, আর তাড়িয়ে নিয়ে গেল চার মাইল । বিজাপুরী গ্রামগুলোকে তছনছ করে জয়ীরা এগোল কুলবর্গা পর্যন্ত।

২৯ জুলাই সম্রাট-বাহিনী আক্রমণ চালাল কালিয়ানি পরিখার উল্টো পাশের দুর্গে। ভীষণ যুদ্ধই হলো, তবু শেষমেশ তারা দুর্গের ভেতরে ঢুকে পড়ল ঝাঁকে ঝাকে। ১ আগস্ট তাদের হাতে দুর্গের চাবি তুলে দিল আবিসিনীয় দিলওয়ার, যাকে সসম্মানে দেওয়া হলো বিজাপুরে চলে যাওয়ার অনুমতি।

কালিয়ানির পতনের পর বিজাপুরের রাজা যযাগাযোগ শুরু করল শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে। বিজাপুরী প্রতিনিধিরা দিল্লিতে ষড়যন্ত্র করে দারার মধ্যস্থতায় দেখা করল সম্রাটের সঙ্গে। স্থির হলো, আদিল শাহ বিদার, কালিয়ানি আর পারেন্দার দুর্গ মোগলদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি এক কোটি টাকা দেবে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। এসব শর্তে শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে শান্তিস্থাপন করে বিদারে ফিরে আসার আদেশ দিলেন, সেই সঙ্গে শক্তি বৃদ্ধির জন্য মালওয়া আর উত্তর ভারত থেকে পাঠানো সেনাদেরও ফিরে যেতে বলা হলো তাদের নিজ নিজ এলাকায়। এভাবে বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করে থামিয়ে দেওয়া হলো আওরঙ্গজেবকে; বিশাল বিজাপুর রাজ্যের উত্তর সীমানা দখল সম্পূর্ণ হতেই তার পিতা তাঁকে থামার আদেশ দিলেন। এতে লাভবান হলো বিজাপুরীরা আর। শেষমেশ পারেন্দা দুর্গ সমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানাল।

দাক্ষিণাত্যে মোগলদের দুর্ভাগ্য আরও বাড়িয়ে তুলতে ৬ সেপ্টেম্বর অসুস্থ হয়ে পড়লেন শাহজাহান আর সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল তার মৃত্যুর গুজব। উদ্বিগ্ন আওরঙ্গজেব কালিয়ানি থেকে ফিরতি পথ ধরলেন ১৬৫৭ সালের ৪ অক্টোবর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *