০৩. শাহজাহানের অসুস্থতা এবং তার পুত্রদের বিদ্রোহ

৩. শাহজাহানের অসুস্থতা এবং তার পুত্রদের বিদ্রোহ

৩.১ শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শুকো

১৬৫৭ সালের ৭ মার্চ শাহজাহান তাঁর তিন দশকের শাসনকাল পূর্ণ করে একত্রিশতম বছর শুরু করলেন। এই শাসনকাল ছিল যেমন দীর্ঘ তেমনই সফল। মহান এই মোগলের অধীনে ভারতের ঐশ্বর্য বিদেশি পর্যটকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে, আর আনন্দোৎসবের দিনগুলোতে বুখারা, পারস্য, তুরস্ক, আর আরবের রাজদূত, সেই সঙ্গে ফ্রান্স আর ইতালির পর্যটকেরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকিয়ে থেকেছে ময়ূর সিংহাসন, কোহিনুর এবং অন্যান্য রত্নরাজির দিকে। তার ভালোবাসার অট্টালিকাগুলোতে ব্যবহৃত শ্বেতপাথর যেমন দামি, তেমনই বিশুদ্ধ তাদের ডিজাইন। জাঁকজমক আর ঐশ্বর্যে সাম্রাজ্যের সভাসদদের কাছেই হার মেনেছে অন্যান্য রাজ্যের রাজারা। সাম্রাজ্যজুড়ে বিরাজ করেছে গভীর শান্তি। যত্নের সঙ্গে লালিত হয়েছে চাষাবাদ; প্রজাদের অভিযোগে অনেকবার পদচ্যুত করা হয়েছে রূঢ় আর জুলুমকারী শাসককে। সবখানে বয়ে গেছে ঐশ্বর্য আর উন্নতির জোয়ার। দয়ালু অথচ জ্ঞানী একজন প্রভু হিসেবে শাহজাহান নিয়োগ দিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষ কর্মচারীদের, তাঁর দরবার পরিণত হয়েছে দেশের বুদ্ধি আর জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু দেশের উন্নতিতে অতুলনীয় অবদান রাখা সেই সব মহান মন্ত্রী আর সেনাপতিদের একের পর এক নিয়ে চলে গেছে মৃত্যুর নির্মম হাত। নতুনদের মধ্যে প্রাচীন মহারথীদের মতো যোগ্য আর কাউকে খুঁজে পাননি সম্রাট। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে তার জীবনের ৬৭টি চান্দ্র বছর (২৪ জানুয়ারি, ১৬৫৭)। তিনি গত হওয়ার পর কী হবে?

শাহজাহানের চার পুত্র। সবারই যৌবন পেরিয়ে গেছে আর তাঁদের সবাই অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন প্রদেশের শাসক আর সেনাবাহিনীর অধিপতি হিসেবে। কিন্তু তাদের মধ্যে ভাতৃসুলভ কোনো ভালোবাসা নেই। বিশেষ করে, দারা আর আওরঙ্গজেবের মধ্যে রয়েছে তিক্ত এক বিদ্বেষ, যা বছরের পর বছর ধরে হয়েছে তিক্ততর, আর পুরো সাম্রাজ্যের আলোচনার বিষয়বস্তু, তাঁদের দুজনের শান্তি রক্ষা করতে হয়েছে কেবল বড় ভাই আর দরবারের কাছ থেকে আওরঙ্গজেবকে দূরে সরিয়ে দিয়ে। শাহজাহান পরিষ্কারভাবেই ইঙ্গিত দিয়েছেন যে রাজমুকুট তিনি তুলে দিয়ে যেতে চান দারার মাথায়, একই মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া চার পুত্রের জ্যেষ্ঠটিকে। প্রশাসনে দক্ষ করে তোলা আর শান্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের খাতিরে সম্রাট বছরের পর বছর দারাকে রেখেছেন তার পাশাপাশি, এমনকি জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সুবাদারি চালানোর অনুমতি দিয়েছেন সহকারী দ্বারা। একই সঙ্গে সম্রাট তাঁকে প্রদান করেছেন এমন সব পদমর্যাদা আর সুযোগ-সুবিধা যা তাকে উন্নীত করেছে প্রায় রাজকীয় অবস্থানে। সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হলে সবারই দারার মধ্যস্থতা ক্রয় বা প্রার্থনা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

দারা সবে ৪২ বছরে পা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার দাদা আকবরের মতো। সর্বেশ্বরবাদী দর্শনের প্রতি গভীর তৃষ্ণা থাকার ফলে পড়াশোনা করেছেন তিনি তালমুদ, নিউ টেস্টামেন্ট, মুসলমান সুফিদের রচনা আর হিন্দু বেদান্ত নিয়ে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু আর ইসলাম ধর্মের একটা মিলনস্থল খুঁজে বের করা, আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন তিনি সেই সমস্ত সর্বজনীন সত্য, যেগুলো সব ধর্মেরই মূল ভিত্তি, অথচ বিশ্বাসের বহিরঙ্গ আঁকড়ে থাকা ধর্মোন্মাদদের অবহেলার বস্তু । হিন্দু যোগী লাল-দাস আর মুসলমান ফকির সারমাদের মতোই শুষে নিয়েছিলেন তিনি ধর্ম-দর্শনের সার। কিন্তু কোনোভাবেই তিনি ছিলেন না ধর্মত্যাগী মুসলমান। ইসলাম ধর্মের সাধুদের একটা জীবনী সংকলন করেছিলেন তিনি, আর মুসলমান সাধু মিয়া মীরের শিষ্যত্ব গ্রহণে ব্রতী হয়েছিলেন, যা একজন কাফের কখনোই করতে পারে না। সাধ্বীসুলভ জাহানারাও দারাকে উল্লেখ করেছেন তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু বলে। তার ঈশ্বরতত্ত্বসংক্রান্ত রচনাগুলো পরিষ্কারভাবেই প্রমাণ করে যে তিনি কখনোই ইসলামের মূল মতবাদগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেননি; তিনি কেবল সুফিদের দর্শন-সার প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। যা-ই হোক, হিন্দু দর্শনের প্রতি দারার ভালোবাসার ভান তাঁকে গোঁড়া কিংবা একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি, এমনকি সম্ভবত তিনি চাইলেও বিধর্মীদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য মুসলমানেরা তার পতাকাতলে সমবেত হতো না।

পিতার মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা তার দারুণ একটা ক্ষতি করেছিল। তিনি সব সময় দরবারে থাকতেন, আর কান্দাহারের তৃতীয় অবরোধের সময় ছাড়া কখনোই কোনো প্রদেশ শাসন কিংবা সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে যাননি। ফলে যুদ্ধ বা প্রশাসনের কৌশলগুলো তিনি কখনোই আয়ত্ত করতে পারেননি; কখনোই মানুষকে বিচার করতে শেখেননি বিপদ আর বাধার কঠিন পরীক্ষায় ফেলে; সেই সঙ্গে তিনি সক্রিয় সেনাদের যোগাযোগ হারিয়েছিলেন। এ জন্যই, উত্তরাধিকারের লড়াইয়ে মোগলদের টিকে থাকার যে বাস্তব পরীক্ষা হয়েছিল, সেখানে তিনি ছিলেন অযোগ্য। তার অতুলনীয় ঐশ্বর্য আর প্রভাব তাঁকে আত্মসংযমী আর দূরদর্শী হওয়ার শিক্ষা দেয়নি, বরং সবার কাছ থেকে পাওয়া চাটুকারিতার আতিশয্য অবশ্যই তার অহংকার আর ঔদ্ধত্য বাড়িয়ে দিয়েছে। চরিত্র বিচার তিনি করতে পারতেন না। এ রকম একজন ব্যর্থ আর অবিবেচক প্রভুর কাছ থেকে সমর্থ আর আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মানুষের অবশ্যই দূরে থাকা উচিত। দারা ছিলেন একজন প্রেমময় স্বামী, হেময় পিতা, আর নিবেদিত পুত্র; কিন্তু বিপদকালীন একজন শাসক হিসেবে তিনি ব্যর্থ হতে বাধ্য। অবিরাম উন্নতি তাঁর চরিত্রকে দুর্বল করে দিয়েছিল; জ্ঞানসমৃদ্ধ পরিকল্পনা, দুঃসাহসিকতাপূর্ণ কর্মদক্ষতা আর পরিশ্রমী অর্জনে তিনি ছিলেন ব্যর্থ, কিংবা প্রয়োজনে, পরাজয়ের মুখ থেকে তিনি জয় ছিনিয়ে আনতে পারতেন না মরিয়া প্রচেষ্টা বা বীরসুলভ সহিষ্ণুতায়। সামরিক সংগঠন আর কুশলী আক্রমণের সমন্বয়সাধন ছিল তার ক্ষমতার বাইরে। অনুশীলনের মাধ্যমে খাঁটি একজন সেনাপতির মতো যুদ্ধের বিরুদ্ধ স্রোতকে নিয়ন্ত্রণ করতেও তিনি কখনোই শেখেননি। অথচ যুদ্ধবিদ্যায় এমন একজন শিক্ষানবিশের নিয়তি সিংহাসন লাভের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁকে দাঁড় করিয়ে দেবে ভয়ংকর একজন যুদ্ধবিশারদের সামনে।

৩.২ শাহজাহানের অসুস্থতা, ১৬৫৭, আর তার পরিণতিতে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা

৬ সেপ্টেম্বর শাহজাহান হঠাৎ দিল্লিতে মূত্রকৃচ্ছু (Strangury) আর কোষ্ঠকাঠিন্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এক সপ্তাহ ধরে রাজকীয় চিকিৎসকেরা বৃথাই গলদঘর্ম হলো। রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে চলল। প্রতিদিনের দরবার বন্ধ হয়ে গেল; ঝুলবারান্দা থেকেও সম্রাট আর জনসাধারণকে দেখা দিলেন না। আরও এক সপ্তাহ পর চিকিৎসকেরা রোগ নিয়ন্ত্রণে সমর্থ হলো। কিন্তু উন্নতি এত ধীর যে সম্রাট আগ্রা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেখানে প্রিয়তমা স্ত্রীর স্মৃতিতে নির্মিত সৌধের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করতে চান পরম শান্তিতে। আগ্রা শহরে প্রবেশ করলেন তিনি ২৬ অক্টোবর।

শাহজাহানের অসুস্থতার সময় দারা বসে রইলেন শয্যাপাশে, আর তার সেবা করতে লাগলেন পরম যত্নে, সিংহাসন নিশ্চিত করার কোনো অশোভন তাড়া তাঁর মধ্যে দেখা গেল না। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিকে শাহজাহান সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে হতাশ হয়ে পরবর্তী পৃথিবীতে পদার্পণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। আর তাই একান্ত ব্যক্তিগত কয়েকজন সভাসদ আর প্রধান অফিসারকে ডেকে পাঠিয়ে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শেষ ইচ্ছে, আদেশ করেছিলেন তারা যেন দারাকে মান্য করে চলে পরবর্তী সম্রাট হিসেবে। দারা অবশ্য আপন অবস্থান সুদৃঢ় করায় মনোযোগী হলেও সিংহাসনে না বসে পিতার নামেই আদেশ জারি করে চললেন। তিনি আওরঙ্গজেবের অন্তরঙ্গ আর অনুগামী মীর জুমলাকে সরিয়ে দিলেন উজির পদ থেকে (সেপ্টেম্বরের শেষে), সেই সঙ্গে মীর জুমলা, মহব্বত খান এবং অন্যান্য রাজকীয় অফিসারকে আদেশ পাঠালেন যেন তারা দাক্ষিণাত্য থেকে নিজ নিজ সেনাদলসহ ফিরে দরবারে যোগদান করে।

নভেম্বরের মাঝামাঝি শাহজাহান আবার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর মতো যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠলেন। ব্যাপারগুলোর একটা হলো, সুজা নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে বাংলা থেকে অগ্রসর হচ্ছেন। শাহজাহানের সম্মতিতে সুজার বিরুদ্ধে ২২,০০০ সেনার শক্তিশালী একটা দল পাঠানো হলো (৩০ নভেম্বর) সুলাইমান শুকো (দারার জ্যেষ্ঠ পুত্র) আর মীর্জা রাজা জয় সিংহের অধীনে। এর পরপরই আরেক বিপজ্জনক সংবাদ এল গুজরাট থেকে। সেখানে মুরাদ ৫ ডিসেম্বর নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। সুতরাং এই মাসের শেষাশেষি আগ্রা থেকে মালওয়া গেল সম্রাটের দুটো সেনাদল, একটা দক্ষিণ থেকে অগ্রসরমাণ আওরঙ্গজেবকে বাধা দিতে, আরেকটা গুজরাটে গিয়ে প্রদেশ থেকে মুরাদকে বিতাড়িত করতে। প্রথম সেনাদল রাখা হলো মারওয়ারের মহারাজা যশোবন্ত সিংহের অধীনে, তাঁকে মালওয়ার সুবাদার নিযুক্ত করা হয়েছিল শায়েস্তা খানকে দরবারে ডেকে পাঠিয়ে, আর দ্বিতীয় সেনাদলের নেতৃত্ব গ্রহণে। কাশিম খানকে রাজি করানো হয়েছিল তাকে গুজরাটের সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। শাহজাহান দুই সেনাপতির কাছে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রদ্বয়ের প্রাণ রক্ষার্থে মিনতি করেছিলেন, বলেছিলেন যে সম্ভব হলে মিষ্টি কথায় তাঁদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে যেন ফেরত পাঠানো হয় নিজ নিজ প্রদেশে, তা না হলে শক্তি প্রদর্শন, আর তা-ও না হলে নিতান্ত বাধ্য হয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ।

শাহজাহানের অসুস্থতার সময় দারা প্রথম দিকে তাঁর বিশেষ আস্থাভাজন দু একজন মন্ত্রী ছাড়া আর কাউকেই সম্রাটের কাছে যেতে দিতেন না, লক্ষ রাখতেন, কোনো চিঠি বা দূত যেন বাংলা, গুজরাট আর দাক্ষিণাত্যে তাঁর ভাইদের কাছে যেতে না পারে, দরবারে তাঁদের প্রতিনিধির ওপরও কড়া নজর রাখা হতো, পাছে তারা আবার লুকিয়ে প্রভুদের কাছে গোপন কোনো সংবাদ পাচার করে দেয়। কিন্তু এই সাবধানতা আরও বেশি ক্ষতি ডেকে আনল। কোনো সংবাদ না পেয়ে তিন শাহজাদার সঙ্গে সঙ্গে দূর প্রদেশের অধিবাসীরাও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে শাহজাহান মারা গেছেন, আর তার ফলে শুরু হয়ে গেল যাবতীয় গোলযোগ আর বিশৃঙ্খলা । চাষিরা রাজস্ব দিতে অস্বীকার করল, জমিদারেরা পরাজিত করার চেষ্টায় মাতল নিজ নিজ প্রতিদ্বন্দ্বীকে, লন করা হলো সীমান্ত। ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তায় স্থবির হয়ে গেল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, অনেক জায়গায় আইনকানুন বলতে আর কিছু রইল না।

শাহজাহানের আরোগ্যের নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে তাঁর সহস্ত লিখিত চিঠি আর সিলমোহর শাহজাদাদের কাছে পৌঁছেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা ধরে নিয়েছিলেন যে চিঠিগুলো আসলে শাহজাহানের হস্তাক্ষর নকলে ওস্তাদ দারার লেখা, সুতরাং মৃত সম্রাটের সিলমোহর এখন এক অনধিকারীর হাতে। ছোট তিন ভাই চিঠি লিখে পাঠালেন, সম্রাটের মৃত্যুর গুজবে তাদের মন খুবই অশান্ত হয়েছে, আর তাই তাঁরা আগ্রা অভিমুখে রওনা দিচ্ছেন স্বচক্ষে পিতার অবস্থা দেখে সন্দেহ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে।

৩.৩ গুজরাটে মুরাদ বখশের নিজেকে সম্রাট ঘোষণা

মুহম্মদ মুরাদ বখশ, শাহজাহানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র, ছিলেন সম্রাট পরিবারের কুলাঙ্গার। তাঁকে বলখ, দাক্ষিণাত্য আর গুজরাটে রেখে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সব জায়গাতেই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। বোকা, আমোদ-প্রমোদপ্রিয় আর প্রচণ্ড এই শাহজাদার চরিত্র বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠেনি; না শিখেছেন তিনি পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে মেলে ধরতে, না শিখেছেন আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে। আরও খারাপ হলো, উপযুক্ত প্রতিনিধি বাছাই করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। কিন্তু মুরাদের ছিল সেনাসুলভ বেপরোয়া সাহস। তাঁকে কেবল ছেড়ে দিন যুদ্ধের একটা মাঠে, মুহূর্তে তাঁর শিরায় টগবগিয়ে উঠবে তৈমুরের রক্ত, অদম্য দৃঢ়তায় ভেদ করবেন তিনি শক্রর ব্যুহ, চারপাশ থেকে ভেসে আসা কোলাহলকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে মনে তার জেগে রইবে কেবল হত্যার উল্লাস। কিন্তু ব্যক্তিগত এই বেপরোয়া সাহস তাঁর সেনাপতিত্বের ঘাটতি পূরণের উপযুক্ত নয়।

শাহজাদার অক্ষমতা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল শাহজাহান তার রাজস্ব মন্ত্রী হিসেবে পাঠালেন আলী নকী নামক অত্যন্ত সৎ আর যোগ্য একজন মানুষকে। আলী নকীর নিখুঁত আর সতর্ক প্রশাসন শাহজাদার চাটুকার আর প্রমোদ-সঙ্গীদের মধ্যে জন্ম দিল একদল শত্রু। শিগগিরই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করল মুরাদের প্রিয় এক খোঁজা। আলী নকীর হস্তাক্ষর আর সিলমোহর জাল করে দারার আনুগত্য স্বীকার করা একটা চিঠি পাঠানো হলো বাহক মারফত, যে বাহক পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ধরা পড়ল মুরাদের প্রহরীর হাতে, কিন্তু চিঠিটার প্রকৃত মালিকের নাম প্রকাশ করল না। ভোরের কিছু আগে সেই চিঠি পৌঁছাল বাগানবাড়িতে প্রমোদে মত্ত মুরাদের হাতে। রাতভর লাম্পট্যে ক্লান্ত শাহজাদা ফেটে পড়লেন রাগে, আর সেই মুহূর্তে আলী নকীকে হাজির করতে বললেন তার সামনে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে আলী নকীকে বারবার বর্শাবিদ্ধ করে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, শয়তান! তোকে আমি এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও তুই কিনা হলি এমন বেইমান!

সেনাসংখ্যা অনেক বৃদ্ধি করায় মুরাদ পড়লেন টাকার টানে। তাই ৬,০০০ সেনা আর যুদ্ধসামগ্রীসহ শাহবাজ খান নামক এক খোঁজাকে কর সংগ্রহ করতে পাঠালেন তিনি সম্পদশালী সুরাট বন্দরে। দেয়ালহীন শহরটা সহজেই অধিকৃত আর লুণ্ঠিত হলো । ওলন্দাজ নির্মাতাদের নেতৃত্বে শাহবাজ খান মাইন পাতল সুরাট দুর্গপ্রাকারের নিচে, আর সেগুলোর একটার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করাল (২০ ডিসেম্বর)। এভাবে সুরাটের সমস্ত কামান আর সঞ্চিত সম্পদ লুট করলেন মুরাদ, সেই সঙ্গে সবচেয়ে ধনী দুজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করলেন পাঁচ লাখ টাকার ঋণ।

ইতিমধ্যে, শাহজাহানের অসুস্থতার সংবাদ পাওয়ার পরপরই বিশ্বাসী দূত মারফত মুরাদ আর আওরঙ্গজেব শুরু করলেন এক গোপন যোগাযোগ। দারার বিপক্ষে সুজার সহায়তা চেয়েও চিঠি পাঠালেন তারা, কিন্তু অত্যধিক দূরত্বের কারণে তাঁর কোনো নিশ্চিত সমর্থন পাওয়া গেল না। তবে শিগগিরই একটা পরিকল্পনা আঁটলেন মুরাদ আর আওরঙ্গজেব। প্রথম থেকে মুরাদ চলতেন আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচণ্ড স্বভাবের, কোনো কিছুতেই তর সইত না। সুরাটে সাফল্য পাওয়ার পর মুরাদ খোলাখুলিই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন মারুয়াজ-উদ-দীন নাম নিয়ে (৫ ডিসেম্বর)। চিঠির পর চিঠিতে প্রকাশিত হলো মুরাদের ক্রোধ আর তাড়াহুড়ো, অথচ আওরঙ্গজেব রইলেন শান্ত আর দ্বিধান্বিত।

মুরাদ প্রস্তাব দিলেন যে সেনা অফিসারদের বশে এনে দারা তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় করার আগেই ভাইয়েরা তার ওপর আক্রমণ চালাক দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে। কিন্তু আওরঙ্গজেব তাঁকে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিলেন, বললেন যে তিনি যেন কোনো সমঝোতার পদক্ষেপ না নেন কিংবা খোলাখুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করে না বসেন, বরং তারা শাহজাহানের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন। দারাকে লিখে চলেন নিছক বন্ধুত্বপূর্ণ সব চিঠি। আওরঙ্গজেব মুরাদকে আরও পরামর্শ দিলেন যে দারার মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার জন্য পারসি আর উজবেকদের আফগানিস্তান আক্রমণে প্ররোচিত করা উচিত। তখন আফগানিস্তান ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। মুরাদ পারস্যের রাজাকে শাহজাহানের মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে চিঠি লিখে তাঁর কাছে সশস্ত্র সহায়তা প্রার্থনা করলেন। পারস্যের শাহ অপেক্ষা করে সংবাদটার সত্যতা যাচাই করতে চাইলেন।

সাম্রাজ্য ভাগাভাগিসংক্রান্ত একটা চুক্তিনামা সম্পাদন করে কুরআনের শপথ নিয়ে আওরঙ্গজেব সেটা পাঠালেন মুরাদের কাছে :

(১) মুরাদ তাঁর ভাগে পাবেন পাঞ্জাব, আফগানিস্তান, কাশ্মির, আর সিন্ধু এবং সেসব স্থান শাসন করবেন একজন স্বাধীন সম্রাটের মতো। মোগল সাম্রাজ্যের বাদবাকি ভাগ পাবেন আওরঙ্গজেব।

(২) যুদ্ধ থেকে প্রাপ্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পাবেন মুরাদ আর আওরঙ্গজেব পাবেন দুই-তৃতীয়াংশ।

প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর আহমেদাবাদ থেকে মুরাদ অগ্রসর হলেন ১৬৫৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, আর ১৪ এপ্রিল আওরঙ্গজেবের সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হলেন মালওয়ার দিপালপুরে।

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। উপরোল্লিখিত শর্তগুলোর কথা পরিষ্কার লেখা আছে আওরঙ্গজেবের নিজস্ব চিঠিতে (আদ-ই-আলমগিরি, পৃষ্ঠা.৭৮), তার কর্মচারী আকিল খান রাজির ইতিহাসে (পৃষ্ঠা.২৫), আর তাজকিরাত-উস-সালাতিন-উস-চাঘতাইয়ায়, সুতরাং বার্নিয়ারের এই বিবরণ আসলে সম্পূর্ণ বানোয়াট যে নাস্তিক দারাকে সিংহাসনচ্যুত করার পর সাম্রাজ্যের পুরোটা মুরাদের হাতে তুলে দিয়ে আওরঙ্গজেব দরবেশ সেজে মক্কা চলে যাবেন বলে শপথ করেছিলেন।

৩.৪ উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের প্রাক্কালে আওরঙ্গজেবের উদ্বেগ ও কূটনীতি

১৬৫৭ সালের ৪ অক্টোবর, বিজাপুরের যুদ্ধ থেকে ফেরার পর ১৬৫৮ সালের ২৫ জানুয়ারি সিংহাসনের দাবিতে হিন্দুস্থান অভিমুখে রওনা দেওয়ার মাঝামাঝি সময়টুকু আওরঙ্গজেব কাটিয়েছেন দারুণ এক উদ্বেগ আর জটিলতায়। দ্রুত ঘটে চলছিল এমন সব ঘটনা যে তার সংশয় হলো, পরিস্থিতি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন কি না।

তার বর্তমান অবস্থান প্রতিদিনই হয়ে উঠছে সমর্থনের আরও অযোগ্য, ওদিকে সামনে ঝুলছে অশুভ ভবিষ্যৎ। এই সময়ের বিশাল আর জটিল বাধাগুলোকে আওরঙ্গজেব এমনভাবে সামাল দিয়েছেন যে তাঁর স্থিরতা, বিচক্ষণতা, মানুষকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আর কূটনৈতিক দক্ষতা উপলব্ধি করে আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার পালা একদম চূড়ায় গিয়ে ঠেকে।

সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে যে সম্রাট শান্তি স্থাপনের আদেশ দিয়ে দাক্ষিণাত্যে পাঠানো সেনাদলকে ফিরে আসতে বলেছেন। তার অর্থ হলো, দীর্ঘ আর ব্যয় বহুল বিজাপুরের যুদ্ধের ফল ভোগ করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আওরঙ্গজেব তা থেকে বঞ্চিত হবেন। সুতরাং তিনি একটা সাহসের খেলা খেলবেন বলে মনস্থ করলেন; সাম্রাজ্যের দুর্বলতা আর বিশৃঙ্খল অবস্থা বিজাপুরীরা সম্পূর্ণ বুঝে ওঠা কিংবা সাম্প্রতিক পরাজয়ের ধাক্কা সামলে স্থির হওয়ার আগেই তিনি তাদের শর্ত পালনে বাধ্য করাবেন।

কিন্তু তার এই পরিকল্পনার একটা অসুবিধাও আছে। সিংহাসনের প্রতিযোগিতায় নামতে তিনি যত দেরি করবেন, ততই দারা নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করে তার পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেওয়ার সুযোগ পাবেন। পক্ষান্তরে, খোলাখুলি সিংহাসন দাবি করে তিনি যদি সেনাদলসহ অগ্রসর হন উত্তরে, তাহলে নিঃসন্দেহে দারাকে সময় মতো থামিয়ে লাভ করতে পারবেন আরও সব উচ্চাভিলাষী অভিযানকারীদের আনুগত্য। কিন্তু ততক্ষণে পারো দুর্গ আর প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ পাওয়ার সব আশা নিভে যাবে, এই সুযোগে মাথা চাড়া দেবে দক্ষিণের অন্যান্য শক্ররা; গত দুই বছরের যুদ্ধের ফল ভোগ করার বিন্দুমাত্র সুযোগও তাঁর আর থাকবে না।

আদব-ই-আলমগিরিতে সংরক্ষিত আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্রে স্পষ্ট বর্ণিত আছে, কীভাবে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে বিজাপুরীদের সঙ্গে একটা দ্রুত ফয়সালা হওয়ার আশা, কীভাবে প্রতিশ্রুত ভূখণ্ড আর অর্থ পাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি করে চলেছেন বিকল্প সব চেষ্টা, একদম না পাওয়ার চেয়ে কিছু পাওয়ার আশায় কীভাবে একের পর এক ছাড় দিচ্ছেন বিজাপুরীদের, এবং শেষমেশ ভেঙে পড়ছেন হতাশায়। অবশ্য বিজাপুর থেকে খালি হাতে ফেরার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার ফলে তাঁর দ্বিধা দূর হয়ে গেল, এবার পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন আওরঙ্গজেব তার উত্তর ভারতের পরিকল্পনা সফল করার দিকে।

১৬৫৭ সালের ৪ অক্টোবর কালিয়ানি ত্যাগ করে পাঁচ দিন পর আওরঙ্গজেব পৌঁছালেন বিদারে । এই দুৰ্গটা ভালোভাবে মেরামত করে সেখানে সেনা আর রসদ সরবরাহ করা হয়েছে। মাসের ১৮ তারিখে আবার ফিরতি পথ ধরে আওরঙ্গাবাদে উপস্থিত হলেন তিনি ১১ নভেম্বর। বিদার ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে শুরু হয়ে গেল আনন্দোৎসব, মোগলেরা ফেলে যাচ্ছে তাদের মুখের গ্রাস! পারেন্দা দুর্গ আর চুক্তি অনুসারে অন্যান্য ক্ষতিপূরণ বুঝে নেওয়ার জন্য আওরঙ্গজেব পাঠিয়েছিলেন মীর জুমলাকে (২৮ সেপ্টেম্বর), কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ১৬৫৮ সালের ১ জানুয়ারি আওরঙ্গাবাদে ফিরে এসেছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় সেনাপতি।

২৮ অক্টোবরেই আওরঙ্গজেব অবলম্বন করলেন প্রয়োজনীয় একটা সাবধানতা, নর্মদা নদীর সমস্ত খেয়ানৌকা আটক করে বন্ধ করে দিলেন দারা আর দাক্ষিণাত্যের সম্রাটের কর্মচারীদের যোগাযোগ। কিন্তু এখন তিনি কী করবেন? অনুসারীরা রয়েছে তার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়, অথচ এই পরিস্থিতিতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেমন কঠিন, তেমনই বিপজ্জনক। দরবার থেকে আসা সংবাদগুলো পরস্পরবিরোধী, কোনোভাবেই শাহজাহানের সঠিক অবস্থা জানা যাচ্ছে না। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে আওরঙ্গজেব কোনো কর্তব্য স্থির করে উঠতে পারলেন না; হাত গুটিয়ে বসে রইল তাঁর অনুসারীরাও।

আওরঙ্গজেব একদম প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, শাহজাহানের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করবেন না। কিন্তু ঘটনার দ্রুত প্রবাহ তাঁকে বাধ্য করাল। দাক্ষিণাত্য নিয়ে দারার পরিকল্পনা এখন পরিষ্কার টের পাওয়া যাচ্ছে। অসহায় শাহজাহানকে তিনি প্ররোচিত করেছেন গুজরাটের সুবাদারি থেকে মুরাদকে সরিয়ে দিতে, আর আওরঙ্গজেবের বেরার সুবা হস্তান্তর করতে মুরাদকে, যেন দুই ভাই কলহে লিপ্ত হয়। তা ছাড়া দারা দুটো সেনাবাহিনী পাঠিয়েছেন তাদের দুই ভাইয়ের বিপক্ষে (ডিসেম্বরের শেষাশেষি), ওদিকে শায়েস্তা খানকে (আওরঙ্গজেবের দৃঢ় সমর্থক) তাঁর নিজ প্রদেশ মালওয়া থেকে ডেকে নিয়ে গেছেন দরবারে, আবার মীর জুমলাকেও আওরঙ্গজেবের পাশ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছে সম্রাটের চিঠি, যা তাঁকে খোলাখুলি অপমান করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই ধরনের চিঠি আওরঙ্গজেবের অন্যান্য অনেক কর্মচারীও পেয়েছিল।

৩.৫ সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওরঙ্গজেবের প্রস্তুতি

অবশেষে এসে উপস্থিত হলো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা যে আওরঙ্গজেব সম্রাট হতে কিংবা অন্ততপক্ষে স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চান কি না। মনস্থির করে ফেলেছিলেন ১৬৫৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথমেই, ফলে গ্রহণ করলেন তিনি কয়েকটা দ্রুত আর চূড়ান্ত পদক্ষেপ। প্রথমত, মীর জুমলার সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্র অনুসারে তাঁকে দৌলতাবাদ দুর্গের কারাগারে নিক্ষেপের ভান করে রাষ্ট্রের নামে আওরঙ্গজেব বাজেয়াপ্ত করলেন তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি আর চমৎকার গোলন্দাজ বাহিনী। এই গ্রেপ্তারের লোক-দেখানো কারণ হিসেবে আওরঙ্গজেব প্রচার করে দিলেন যে মীর জুমলা দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতানের সঙ্গে সম্রাটের বিপক্ষে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তারপর শাহজাহান আর নতুন উজির জাফর খানকে তিনি চিঠি লিখলেন যে সম্রাটের রোগসংক্রান্ত গুজবে তিনি মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন, সুতরাং আগ্রায় গিয়ে তিনি স্বচক্ষে অসুস্থ পিতাকে দেখতে চান কর্তব্যপরায়ণ একজন পুত্রের মতো, সেই সঙ্গে উদ্ধার করতে চান তাঁকে দারার কবল থেকে, যেন মোগল সাম্রাজ্য রক্ষা পায় আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর গোলযোগের অভিশাপ হতে।

চিঠি লিখলেন তিনি কুতব শাহকে যুদ্ধ ক্ষতিপূরণের বকেয়া টাকার চাপ দিয়ে, আর গোলকুণ্ডা দরবারের মোগল কূটনীতিককে, যেন সে সুলতানের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করে আর তাকে বোঝায় দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের অনুপস্থিতিতে মোগল স্বার্থের পরিপন্থী কিছু না করার জন্য। রানিমাতা বারী সাহিবাকেও পাঠালেন তিনি সদ্ভাবের চিঠি আর উপহার, সেই সঙ্গে অনুরোধ জানালেন যে তার অনুপস্থিতিতে তিনি যেন বিজাপুরীদের শান্ত রাখেন আর পরিশোধ করেন প্রতিশ্রুত টাকা। বন্ধুত্বের বিনিময়ে আদিল শাহকে আওরঙ্গজেব দিলেন দারুণ এক প্রলোভন: বিশ্বস্ত থাকুন আর আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করুন…আমি অঙ্গীকার করছি যে পারো দুর্গ, কঙ্কান, ওয়াঙ্গির মহল–যেসব সংযুক্ত করা হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে–আপনাকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া হবে, তার সঙ্গে আপনার পিতা মরহুম আদিল শাহকে প্রতিশ্রুত কর্ণাটকের অংশ…আর আপনার প্রতিশ্রুত যুদ্ধ ক্ষতিপূরণের এক কোটি টাকা থেকে ৩০ লাখ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। এই দেশকে রক্ষা করুন; এটার প্রশাসনের উন্নতি সাধন করুন। শিবাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করুন, সে গোপনে কয়েকটা দুর্গের দখল নিয়েছে। আপনি কি আমাকে দিতে পারেন অন্তত ১০,০০০ অশ্বারোহী সেনা? আমি আপনাকে দেব ওয়ানগঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড।

পুরো সময় জুড়েই আওরঙ্গজেব ষড়যন্ত্র করে চললেন রাজধানীর সভাসদ আর প্রদেশের (বিশেষ করে মালওয়ার) উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে, তবে ভীষণ গোপনে। শাহজাহানের চার পুত্রের মধ্যে তাঁরই ছিল দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার সেরা সুখ্যাতি। সব সভাসদ আর কর্মচারী তাকে ধরে নিয়েছিল পরবর্তী সম্রাট হিসেবে, ফলে নিজ নিজ আখের গোছানোর খাতিরে বন্ধুত্ব প্রকাশে কিংবা তার প্রতি সমর্থনের অন্তত গোপন নিশ্চয়তা জানিয়ে দিতে তাদের কারোরই বিলম্ব হলো না।

এসবের পাশাপাশি এগিয়ে চলল সেনাসংখ্যা বাড়ানোর কাজ। যুদ্ধোপকরণ তৈরির জন্য কেনা হলো প্রচুর পরিমাণে শশারা, গন্ধক আর সিসা। বারুদ আর ফিউজ নেওয়া হলো দাক্ষিণাত্যের দুর্গগুলো থেকে। শেষমেশ আওরঙ্গজেবের বাহিনী গড়ে উঠল ৩০,০০০ বাছাই সেনায়, পাশাপাশি রইল ইংরেজ আর ফরাসি গানারসমৃদ্ধ মীর জুমলার অসাধারণ গোলন্দাজ বাহিনী।

আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য শাসনকালে তাকে ঘিরেছিল অত্যন্ত দক্ষ একদল কর্মচারী, যাদের সবাই তার সঙ্গে যুক্ত ছিল কৃতজ্ঞতা কিংবা ব্যক্তিগত ভালোবাসার সূত্রে; দেওয়ান মুর্শিদ কুলি খান, যোদ্ধা আর একান্ত পরামর্শদাতা শেখ মীর, অশ্বপাল আর ব্যক্তিগত সহকারী আকিল খান রাজি, বিশ্বস্ত সেক্রেটারি কাবিল খান, গোলন্দাজ বাহিনী পরিদর্শক খান-ই-জামান, অভিজ্ঞ প্রবীণ সেনাপতি মুহম্মদ তাহির, বিশ্বস্ত কূটনীতিক ঈশা বেগ, উচ্চবংশীয় এবং অভিজ্ঞ সামস-উদ দীন-মুখতার খান, আর সর্বোপরি কর্মচারীদের রত্ন মীর জুমলা, মহান যোদ্ধা, ততোধিক মহান উপদেষ্টা। তার নিবেদিত হিন্দু অনুসারীদের মধ্যে সেরা ছিল বিকানিরের রাও করন, দাতিয়ার শুভ-করন বুন্দেলা, ধামধেরার রাজা ইন্দ্রমণি প্রমুখ ।

দাক্ষিণাত্য ত্যাগের আগে তাঁর অনুপস্থিতিতে যেন কোনো অসুবিধা না হয়, সেই পদক্ষেপও নিলেন আওরঙ্গজেব। শাসন অব্যাহত রাখার জন্য উচ্চপদস্থ দুজন অফিসার আর শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনী নিয়ে আওরঙ্গাবাদে রয়ে গেলেন শাহজাদা মুয়াজ্জম, আর আওরঙ্গজেবের হেরেমকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো পার্শ্ববর্তী দৌলতাবাদ দুর্গে ।

অবশেষে, ১৬৫৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, আওরঙ্গাবাদ থেকে আওরঙ্গজেব অগ্রসর হলেন সিংহাসন দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় । বুরহানপুরে পৌঁছালেন তিনি ১৮ তারিখে, আর সেখানে এক মাস অবস্থান করলেন সামরিক সংগঠন এবং অন্যান্য প্রস্তুতি শেষ করার জন্য। ২০ মার্চ বুরহানপুর ত্যাগ করে তার শ্বশুর শাহ নওয়াজ খানকে বন্দী করলেন তিনি (২৬ মার্চ), কারণ, বুড়ো ছিলেন শাহজাহানের একগুঁয়ে সমর্থক। প্রায় বাধাহীনভাবেই আকবরপুরের কাছে তারা অতিক্রম করলেন নর্মদা (৩ এপ্রিল), আর উত্তরে উজ্জয়িনীর দিকে অগ্রসর হতে হতে ১৩ তারিখে দিপালপুরের (উজ্জয়িনীর প্রায় ২৬ মাইল দক্ষিণে) কাছে গিয়ে জানতে পারলেন যে মুরাদ এসে পৌঁছেছেন তাঁর কয়েক মাইল পশ্চিমে। পরদিন দুই ভাইয়ের সেনাবাহিনী মিলিত হলো দিপালপুর দিঘির পাশে। যশোবন্ত সিংহ রয়েছেন তাদের সামনে, মাত্র একদিনের পথ-দূরত্বে। সন্ধেয় দুই শাহজাদা তাঁবু গাড়লেন ধর্মাত গ্রামে (উজ্জয়িনীর ১৪ মাইল দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে), চম্বল নদীর একটা শাখা, গম্ভীরার পশ্চিম তীরে। পরদিন শুরু হলো মোগল উত্তরাধিকারের ভয়াবহ লড়াই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *