০৮. আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় পদ্ধতি

৮. আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় পদ্ধতি

৮.১ মুসলমান রাষ্ট্র : তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য

উৎপত্তিগত তত্ত্বের বিচারে মুসলমান রাষ্ট্র দিব্যতান্ত্রিক। এটার প্রকৃত রাজা হলো আল্লাহ, পার্থিব শাসকেরা তার প্রতিনিধিমাত্র, যারা তার আইন সবার ওপর চাপিয়ে দিতে বাধ্য। বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাজ মূলত খাঁটি বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়া এবং তা প্রতিষ্ঠা করা। এ রকম কোনো রাষ্ট্রে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতা রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। কারণ, অবিশ্বাসী প্রকৃত রাজার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বী, নকল দেব-দেবীকে আনুগত্য জানায়। সুতরাং গোঁড়া ইসলামের বাইরের কোনো কিছুকে সহ্য করা আর পাপ করা সমান কথা। এবং এই পাপের নিকৃষ্ট রূপ হলো একাধিক দেব-দেবীতে বিশ্বাস। তাই ইসলামি ঈশ্বরতন্তু তার খাঁটি বিশ্বাসীকে বলছে যে তার সর্বপ্রধান কর্তব্য হলো, অবিশ্বাসীদের দেশের (দার-উল-হার্ব) বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া (জিহাদ)’, যতক্ষণ না সেই দেশ ইসলামি রাজ্যের (দার-উল-ইসলাম) একটা অংশ হয়ে পড়ে আর তাদের সব অধিবাসী খাঁটি বিশ্বাসীতে রূপান্তরিত হয়। তত্ত্বগতভাবে, যুদ্ধ জয়ের পর অবিশ্বাসীদের পুরো জনসংখ্যাই বিজয়ী সেনাবাহিনীর ক্রীতদাসে পরিণত হয়।

অধিবাসীদের সবাইকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা আর যেকোনো ধরনের ভিন্নমতের বিলোপ সাধনই মুসলমান রাষ্ট্রের আদর্শ। সম্প্রদায়ে যদি কোনো অবিশ্বাসীর অস্তিত্ব থাকে, থাকবে তা শুধু পরিবৃত্তিকালের জন্য। অবশ্যই তার ওপর আরোপ করতে হবে রাজনৈতিক আর সামাজিক অযোগ্যতা, আর তাকে দিতে হবে সরকারি তহবিলের ঘুষের প্রস্তাব, যেন সে যথা শিগগির আত্মিকভাবে আলোকপ্রাপ্ত হয়ে তার নাম খাঁটি বিশ্বাসীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।

৮.২ অমুসলমানদের রাজনৈতিক অযোগ্যতা

অতএব একজন অমুসলমান এই রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না; সে অন্ত্যজ শ্রেণীর একজন সদস্য; পদমর্যাদার বিচারে সে ক্রীতদাসের নামান্তর। সে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটা চুক্তির (জিম্মা) আওতায় বসবাস করে : যেহেতু বিশ্বাসীদের সেনাপতি কর্তৃক তার জীবন এবং সম্পত্তিকে প্রদান করা হয়েছে এক অনিচ্ছুক নিরাপত্তা, তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে রাজনৈতিক আর সামাজিক অযোগ্যতা এবং দিতে হবে একটা বিনিময়কর (জিজিয়া)।

তাকে তার জমিজমার জন্য কর (খেরাজ) দিতে হবে, যে কর থেকে তার পূর্ববর্তী মুসলমানদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে; সেনাবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও কর দিতে হবে তাকে, যে করের পরিবর্তে সে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না; পোশাক-পরিচ্ছদ আর আচরণে তাকে অবশ্যই এমন একটা হীনভাব প্রদর্শন করতে হবে যেন তাকে অন্ত্যজ শ্রেণীর বলে চেনা যায়। কোনো অমুসলমানই সুন্দর পোশাক পরতে পারবে না, ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারবে না, কিংবা বহন করতে পারবে না অস্ত্র; শাসক সম্প্রদায়ের সবার সঙ্গে অবশ্যই আচরণ করবে সে শ্রদ্ধাভরে এবং বাধ্যগতভাবে।

জ্ঞানী কাজি মুঘিস-উদ-দীন আইনের বই থেকে (Canon Law) আলা উদ-দীন খলজিকে পাঠ করে শুনিয়েছিল : ‘এসব হীন আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে মুসলমানের চূড়ান্ত বশ্যতা, ইসলামের খাঁটি বিশ্বাসের মহিমা, আর নকল বিশ্বাসের দীনতা। মহানবী আমাদের আদেশ দিয়েছেন তাদের হত্যা, লুণ্ঠন আর বন্দী করার জন্য…আমরা যার অনুসারী, সেই মহান ইমাম (হানিফা) ছাড়া আর কোনো ধর্মীয় কর্তৃপক্ষই হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর আরোপের অনুমতি দেয়নি। বাকি সব ঈশ্বরতাত্ত্বিকদের মতে হিন্দু-সম্বন্ধীয় আইন হলো ‘হয় ইসলাম গ্রহণ, নয়ত মৃত্যু।

অমুসলমানকে (জিম্মি) আদালতে সাক্ষ্য প্রদান, অপরাধ আইনের আওতায় প্রতিরক্ষা, এবং বিবাহ-সংক্রান্ত কিছু আইনি অযোগ্যতাও ভোগ করতে হবে। চুক্তির অপর পক্ষ হিসেবে, রাষ্ট্র তাকে দেবে জীবন আর সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, আর তার নিজ ধর্মপালনের একটা পরিমিত প্রতিরক্ষা; সে নির্মাণ করতে পারবে না কোনো নতুন মন্দির, আর তাকে এড়িয়ে চলতে হবে তার বিশ্বাসের যেকোনো উগ্র প্রচার।

পূর্ববতী আরব বিজেতারা, বিশেষ করে সিন্ধুতে, অনুসরণ করেছে এক বিচক্ষণ এবং লাভজনক পদ্ধতি; তারা অমুসলমানদের তীর্থ আর ধর্মপালনে কোনো রকম বাধার সৃষ্টি করেনি। প্রথমে কোনো উজ্জ্বলতা বা প্রতিমা ভাঙার ঘটনা ছিল না। কিন্তু মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর দীর্ঘ দিনের তর্কাতীত ক্ষমতা ভোগ করতে করতে তাদের মধ্যে দেখা দিল পরমত-অসহিষ্ণুতা আর নির্যাতনের মনোভাব। জিজিয়া কর, পোশাক আর আচরণের ওপর হীনতা আরোপের পর অমুসলমানেরা হলো নানা রকম আশা এবং আতঙ্কের শিকার। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো, যারা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করবে, তাদের দেওয়া হবে নগদ টাকা, নয়ত চাকরি। ধীরে ধীরে দমানো হলো হিন্দুদের ধর্মীয় আর সামাজিক নেতাদের ধর্মীয় জমায়েত আর শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করা হলো, যেন তাদের মধ্যে সংহতি কিংবা সাম্প্রদায়িক শক্তি সঞ্চয়ের বোধ গড়ে না ওঠে। নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ বা পুরনোগুলোকে সংস্কার করার অনুমতি দেওয়া হলো না, যেন সারা দেশে পূজার বিলুপ্তি স্রেফ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইসলামের অনেক পরমোৎসাহী শক্তির এই তরটুকু সইল না, ধ্বংসের ব্যাপারটা সময়ের হাতে ছেড়ে না দিয়ে মন্দির ধ্বংস করল তারা নিজ হাতে।

পরবর্তীকালে, বিশেষ করে তুর্কিরা, তাদের পূর্ববর্তী আরব বিজেতারা অমুসলমানদের প্রতি যে সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছে, সেগুলোকে মনে করল পাপকাজের শামিল। ফলে যেকোনো যুদ্ধের পর মন্দির ধ্বংস আর নির্বিচার হিন্দু হত্যাকে তারা আর দূষণীয় বলে গণ্য করল না। এবং এভাবেই মুসলমান সম্প্রদায়ের মানসিক গঠন একসময় এমন হয়ে উঠল যে লুণ্ঠন আর হত্যা কোনো অমানবিক কাজ নয়, আল্লাহর পথে জিহাদ মাত্র । অমুসলমান হত্যা (কাফির কুশি) একজন মুসলমানের যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হলো। তাদের আর আবেগকে বশ মানানোর কোনো প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন নেই কৃচ্ছসাধনের, এমনকি আধ্যাত্মিক উন্নতিও এখন তার কাছে অপ্রয়োজনীয় একটা ব্যাপার। তাকে কেবল হত্যা করতে হবে নির্দিষ্ট একটা শ্রেণীর মানুষ কিংবা লুট করতে হবে তাদের ধনসম্পদ, তাহলেই এই কাজের পুরস্কারস্বরূপ তার আত্মা আরোহণ করবে স্বর্গে ।

যে ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীরা লুটপাট আর হত্যাকে তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করে, তারা কেবল মানবতার অগ্রগতি কিংবা বিশ্বশান্তির পক্ষেই বেমানান নয়, তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের খাঁটি অনুসারীদের জন্যও অপকারী।

৮.৩ মুসলমান জনসংখ্যা এবং অমুসলমান ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপারে কুরআনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রভাব

মুসলমান রাজনৈতিক সংগঠন বিশ্বাস’ সুগঠিত করার প্রক্রিয়া হিসেবে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। যত দিন পর্যন্ত নতুন একটা দেশ জয় করার সুযোগ আছে। কিংবা ধনী কোনো কাফেরের ধনসম্পদ লুটপাট করার সম্ভাবনা, রাষ্ট্রের সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই চলে । শাসক সম্প্রদায় উঠে যায় উন্নতির সোপান বেয়ে; এমনকি নির্দিষ্ট ধরনের কয়েকটা শিল্পকলা, সাহিত্য, চিত্রকলারও লালন করে। কিন্তু মুসলমান রাজ্যের বিস্তৃতি সর্বোচ্চ সীমা স্পর্শ করার পর যখন বাধাপ্রাপ্ত হয় আসামের পাহাড়শ্রেণীতে, চাটগায়, কিংবা উষর মহারাষ্ট্রে, তাদের দ্রুত পতন রোধ করার আর কোনো উপায় থাকে না। এই রাষ্ট্রের নেই কোনো অর্থনৈতিক ভিত্তি কিংবা শান্তিতে সময় কাটানোর মতো সহ্যগুণ। সরকারের নিষ্ঠুর সদাশয়তা শাসক সম্প্রদায়কে শান্তিতে বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলেছে। যুদ্ধই এখন তাদের একমাত্র প্রবণতা, শান্তি বলতে তারা বোঝে-বেকারত্ব, দোষ আর অধঃপতন।

ইসলামের এসব অটল নীতি মুসলমানকে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণীতে পরিণত করেছে, যারা যুদ্ধ ছাড়া আর সব সময়ই অলস, ফলে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর অযোগ্য। তাদের সরকারও এই অলসতার জন্য কম দায়ী নয়। নিঃস্বদের ঘরবাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের পেছনে রাষ্ট্র যে বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করে, বা রমজানের মাসে কিংবা অন্যান্য পবিত্র দিন আর আনন্দোৎসবে যত ভিক্ষা দেয়, তা অলসতার একটা প্রত্যক্ষ পারিতোষিক। এভাবে সাম্রাজ্যজুড়ে গড়ে উঠেছে অতিরিক্ত প্রশ্রয়প্রাপ্ত একটা অলস শ্ৰেণী, যারা সাম্রাজ্যের উন্নয়ন ব্যাহত হলে সর্বপ্রথমেই ভুগতে বাধ্য। ঐশ্বর্য আনে পরিশ্রমবিমুখতা আর আরামের প্রতি ভালোবাসা; এই দুটো মিলে আনে চরিত্ৰদূষণ; আর চরিত্ৰদূষণ শেষমেশ বয়ে আনে দারিদ্র্য আর ধ্বংস।

একই সময়ে অমুসলমানদের প্রতি আচরণ রাষ্ট্রের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। যখন মানুষের কোনো একটা শ্ৰেণী আইনের কাছে আশ্রয় পাওয়ার পরিবর্তে প্রকাশ্যে লাঞ্ছিত হয়, তখন সে দিনের পর দিন একটা পশুতুল্য জীবন যাপন করেই কোনো রকমে তৃপ্ত থাকে। তখনকার হিন্দুদের কাছ থেকে তাদের পুরো সামর্থ্য উজাড় করে নেওয়ার প্রত্যাশা করা যায় না; তাদের বেশির ভাগই তখন নিজ নিজ প্রভুর জন্য বন থেকে কাঠ কেটে আনত কিংবা বয়ে আনত পানি; পরিশ্রমের ফল পাওয়ার একমাত্র উপায় হিসেবে শিখেছিল তারা একটা নিম মানের চালাকি আর চাটুকারিতা। এ রকম সামাজিক অবস্থায় মানুষ তার সেরা অবদান রাখতে পারে না, করতে পারে না তার মানসিকতাকে উন্নত। হিন্দুদের বোধশূন্যতা আর হিন্দু উচ্চ শ্রেণীর মানসিক নীচতাই ছিল ভারতে মুসলমান শাসনের সবচেয়ে বড় দোষ। ফল ফলানোর বিচারে, ইসলামি রাজনৈতিক বৃক্ষটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

পৃথিবী চষে বেড়ানো আর গভীর জ্ঞানের অধিকারী একজন আধুনিক দার্শনিক লিখেছেন, ইসলাম ঈশ্বরের বাধ্যতা মেনে তার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়ার ধর্ম-কিন্তু সে ঈশ্বর হলো যুদ্ধের ঈশ্বর…এই ধর্মবিশ্বাসের আচার পালনই তার শৃঙ্খলার স্পষ্ট ধারণা দেয়…ইসলামের এই সামরিক ভিত্তিই মুসলমানের প্রয়োজনীয় গুণাবলির ব্যাখ্যা উপস্থিত করে। এটা তার মৌলিক খুঁতগুলোরও ব্যাখ্যা দেয়–তার প্রগতিবিরোধিতা, অভিযোজনের অযোগ্যতা, উদ্যম আর উদ্ভাবনীশক্তির অভাব। সেনার কাজ কেবল আদেশ পালন করা। বাদবাকি সমস্ত কাজের ভার আল্লাহর। (এইচ. কেসারলিং)

যোগ্যতার পরিবর্তে যখন ধর্মবিশ্বাসকেই বড় করে দেখা হলো, তখন অমুসলমানেরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হলো যে তারা এ রকম একটা রাষ্ট্রের অংশ হতে পারে না। এ রকম একটা রাষ্ট্রের অবলম্বন তার অধিবাসীর ভালোবাসা আর ভক্তি নয়, সুতরাং এটাকে সর্বসাধারণের রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা চলে না।

৮.৪ ইসলামে পরমতসহিষ্ণুতার স্থান শূন্য

গোঁড়া ইসলামের ধারণায় এটাই আদর্শ রাষ্ট্র। সন্দেহ নেই, প্রায়শ যুক্তিকে ছাপিয়ে উঠেছে কাণ্ডজ্ঞান, আর কূটনীতির কাছে হার মেনেছে ঈশ্বরতত্ত্ব, তা ছাড়া পরমত অসহিষ্ণুতা ছড়িয়ে পড়ত সারা দেশে। মুসলমান শাসনের অধীনেও তাই হিন্দুরা ভোগ করেছে তাদের ধর্ম আর সম্পদের নিরাপত্তা, আবার কখনো উদার দু একজন রাজা তাদের উৎসাহিত করেছে সাহিত্য, শিল্পকলা কিংবা দেশসেবায় ।

কিন্তু এ রকম একটা রাষ্ট্রের মূল প্রকৃতি অনুসারেই অবিশ্বাসীদের এই প্রশ্রয় অনিশ্চিত এবং ব্যতিক্রমী। মুসলমান জগৎ এটাকে মনে করে গোঁড়া আদর্শ থেকে একটা শোচনীয় পতন, আর রাজকীয় কর্তব্যের একটা ক্ষতিকর অবহেলা। মুসলমান সৈনিকবৃত্তি, যাদের তরবারির ওপর রাজার ক্ষমতা নির্ভরশীল, এ রকম উদারমনা সুলতানকে স্বধর্মত্যাগী হিসেবে বিবেচনা করে, যার শাসন করার কোনো যোগ্যতা নেই।

অতএব, অমুসলমানদের জনসংখ্যা আর অগ্রগতি যেমন পর্যায়েই থাকুক না কেন, তা একটা মুসলমান রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে বেমানান। ফলে এখানে শাসক আর শাসিতের মধ্যে স্থাপিত হয় একটা দীর্ঘস্থায়ী শক্রতা, যা শেষমেশ ভেঙে দেয় প্রত্যেকটা ইসলামি রাষ্ট্র। এবং আওরঙ্গজেবের শাসনকালই এই সত্যের উদাহরণ।

৮.৫ আওরঙ্গজেবের গোঁড়ামি এবং মন্দির ধ্বংস

আওরঙ্গজেব হিন্দুধর্মের ওপর তার আক্রমণ শুরু করলেন একটা ছলনার পথ ধরে। শাসনকালের প্রথম বছরেই তিনি বেনারসের এক পুরোহিতকে জানালেন যে তার ধর্ম তাকে নতুন কোনো মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয় না, তবে পুরনো মন্দির ধ্বংস করায় কোনো নিষেধ নেই। গুজরাটের সুবাদার থাকার সময় ১৬৪৪ সালে আহমেদাবাদের সাম্প্রতিক নির্মিত একটা মন্দিরকে তিনি অপবিত্র করলেন সেটার ভেতরে গরু জবাই করে, আর তারপর সেটাকে রূপান্তরিত করলেন একটা মসজিদে। সেই সময় প্রদেশের আরও অনেক মন্দির তিনি ধ্বংস করেছেন। তার শাসনকালের প্রথম দিকে জারি করা একটা আদেশের বলে স্থানীয় অফিসারেরা উড়িষ্যা থেকে কটক পর্যন্ত শহর আর গ্রামের অসংখ্য মন্দির ভাঙচুর করেছে, কিন্তু নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ করার অনুমতি দেয়নি।

১৬৬৯ সালের ৯ এপ্রিল অবিশ্বাসীদের সমস্ত বিদ্যালয় আর মন্দির ধ্বংসের একটা সাধারণ আদেশ জারি করলেন আওরঙ্গজেব। তারপর তাঁর বিধ্বংসী হাত অগ্রসর হলো বিখ্যাত তীর্থগুলোর দিকে যা ভারতের সমস্ত হিন্দু শ্রদ্ধার চোখে দেখে–যেমন, সোমনাথের দ্বিতীয় মন্দির, বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির, আর মথুরার কেশব রাই মন্দির।

পবিত্র শহর মথুরা সব সময়ই ছিল মুসলমানদের গোঁড়ামির বিশেষ শিকার। শহরটার অবস্থান আগ্রা আর দিল্লির মাঝখানে। আওরঙ্গজেব মথুরার ফৌজদার হিসেবে আবদুন নবী নামক একজন ধার্মিক মানুষকে নিয়োগ দিলেন, হিন্দুদের দমন করতে।

১৬৬৬ সালের ১৪ অক্টোবর দারা শুকো কেশব রাই মন্দিরকে একটা পাথরের রেলিং উপহার দিয়েছেন জানতে পেরে আওরঙ্গজেব সেটাকে সরিয়ে ফেলার আদেশ দিলেন। শেষমেশ ১৬৭০ সালে মন্দিরটাকে ধ্বংস করার আদেশ দিলেন তিনি, আর শহটার নাম পরিবর্তন করে রাখতে বললেন ইসলামাবাদ। সাম্রাজ্যের সমস্ত শহর আর মহকুমায় যেসব মুহতাসিব অর্থাৎ নৈতিক চরিত্র সংশোধক নিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য ছিল হিন্দুদের উপাসনার জায়গাগুলো ধ্বংস করা। ১৬৮০ সালের জুনে বিশ্বস্ত রাজ্য জয়পুরের রাজধানী অম্বরের মন্দিরগুলোও ভেঙে ফেলা হলো।

১৬৭৪ সালে গুজরাটের হিন্দুদের সমস্ত জমি আওরঙ্গজেব বাজেয়াপ্ত করলেন ধর্মীয় অনুদান (ওয়াজিফা) হিসেবে।

৮.৬ অমুসলমানদের জিজিয়া কর বা মাথট

ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসের অনুমতি পাওয়ার জন্য অবিশ্বাসীকে দিতে হয় জিজিয়া নামক একটা কর, যার অর্থ, বিনিময়-কর, মানে, প্রশ্রয়-মূল্য। প্রথম এই কর আরোপ করেছিলেন মুহম্মদ, যে তাঁর অনুসারীদের আদেশ করেছিলেন তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো যারা খাঁটি বিশ্বাসের কথা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে না, যতক্ষণ না তারা জিজিয়া পরিশোধ করে হীন হাত দিয়ে’ (কুরআন)। তাঁর আদেশের শেষাংশটুকু নিয়ে মুসলমান ভাষ্যকারেরা অর্থ করে যে এই কর পরিশোধ করতে হবে হীন আচরণের মাধ্যমে : করদাতাকে অবশ্যই খালি পায়ে এসে কর পরিশোধ করতে হবে দাঁড়িয়ে, আর করগ্রহীতা থাকবে বসে। মহিলা, চৌদ্দ বছরের কমবয়স্ক শিশু, আর ক্রীতদাসেরা এই কর থেকে অব্যাহতি পাবে; অন্ধ মানুষ, পঙ্গু আর পাগলদের এই কর দিতে হবে কেবল যখন তারা ধনী হবে; পুরোহিতেরা এই কর থেকে মুক্ত, যদি তারা গরিব হয়, কিন্তু যদি তারা থাকে ধনী মঠের আওতায়, সে ক্ষেত্রে কর দিতে হবে মঠাধ্যক্ষকে। এই কর একজন মানুষের প্রকৃত আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, কিন্তু করদাতাদের মোটামুটিভাবে তিনটে শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে : আয় ২০০ দিরহামের বেশি নয় (গরিব), ২০০ থেকে ১০ হাজার দিরহামের মাঝামাঝি (মধ্যবিত্ত), আর ১০ হাজার দিরহামের বেশি (ধনী)। পোদ্দার, কাপড়ের দোকানদার, জমিদার আর ডাক্তার সর্বোচ্চ শ্রেণীভুক্ত; দরজি, কাপড় রঞ্জনকারী, ধোপা আর মুচি হলো গরিব। এই সর্বশেষ শ্রেণীটা কেবল তখনই কর দেবে, যখন তাদের আয় তাদের পরিবার রক্ষণাবেক্ষণের পরও উদ্বৃত্ত থাকবে । ভিক্ষুক আর নিঃস্বরা এই কর থেকে অব্যাহতি পাবে।

তিনটে শ্রেণীর জন্য যথাক্রমে কর নির্ধারিত হলো বার্ষিক –১২, ২৪ আর ৪৮ দিরহাম বা ৩.৩৩, ৬.৬৬, আর ১৩.৩৩ টাকা। অতএব গরিবদের ওপর এই করের পরিমাণ হলো তাদের মোট আয়ের অন্তত শতকরা ৬ ভাগ; মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর শতকরা ৬ থেকে ১/৪ ভাগ আর ধনীদের ওপর এমনকি ২.৫ সহস্রাংশেরও কম। জিজিয়া গরিবদেরই আঘাত হানল সবচেয়ে বেশি, ধর্মীয় প্রশ্রয়ের বিনিময়ে বার্ষিক এই কর তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল এক বছরের খাবারের সমান মূল্য। আকবর এই কর বাতিল করেছিলেন (১৫৬৪)। আওরঙ্গজেব সেটাকে ফিরিয়ে আনলেন।

সম্রাটের আদেশক্রমে ‘অবিশ্বাসীদের ওপর জিজিয়া পুনরায় আরোপ হলো ১৬৭৯ সালের ২ এপ্রিল। দিল্লি আর তার আশপাশের হিন্দুরা একত্র হয়ে এই কর প্রত্যাহারের জন্য করুণভাবে ফরিয়াদ জানাল। কিন্তু সম্রাট তাতে কর্ণপাত করলেন না। পরবর্তী শুক্রবার দুর্গের দরজা থেকে জামে মসজিদ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ভরে গেল হিন্দু ফরিয়াদিতে। সাবধান করা সত্ত্বেও তাদের কেউই সামনে থেকে সরল না । সম্রাট নামাজের জন্য এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অপেক্ষমাণ জনতার ওপর দিয়ে হাতি তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিলেন। শিবাজী একটা চিঠি লিখে এই কর বাতিলের জন্য আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ জানাল; সে আওরঙ্গজেবকে ভেবে দেখতে বলল যে ঈশ্বরের দৃষ্টিতে খাঁটি সমস্ত বিশ্বাসই সমান। কোনো লাভ হলো না।

এই কর আরোপের ফলে আদায় হলো প্রচুর টাকা। উদাহরণস্বরূপ এক গুজরাট প্রদেশেই আদায় হলো বার্ষিক পাঁচ লাখ।

সরকারিভাবে বলা হয়েছে যে জিজিয়া কর পুনরায় আরোপের উদ্দেশ্য হলো, হিন্দুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা। সমসাময়িক মানুচি লিখেছেন, অনেক হিন্দু কর পরিশোধ করতে না পেরে মুসলমান হয়ে গেছে, কর সংগ্রাহকদের হাতে প্রকাশ্যে অপমান হওয়ার জ্বালা থেকে বাঁচতে…আওরঙ্গজেব খুশি হয়েছেন।

৮.৭ হিন্দুদের বিরুদ্ধে দমননীতি

১৬৬৫ সালের ১০ এপ্রিল একটা অধ্যাদেশ জারি করা হলো যে এখন থেকে সমস্ত পণ্যদ্রব্যের বিক্রির জন্য মুসলমানদের কর দিতে হবে বিক্রয়মূল্যের শতকরা ২/ ভাগ, আর হিন্দু বিক্রেতাদের শতকরা ৫ ভাগ।

১৬৬৭ সালের ৯ মে সম্রাট মুসলমান ব্যবসায়ীদের আমদানি-রপ্তানি শুল্ক সম্পূর্ণ বাতিল করলেন, কিন্তু হিন্দু ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তা বহাল রাখলেন আগের মতোই। এতে রাষ্ট্রের ক্ষতি হলে বেশি, কারণ, হিন্দু ব্যবসায়ীরা মুসলমানদের সঙ্গে যোগসাজশে তাদের নিজের মালই চালাতে লাগল মুসলমানের মাল বলে।

অবিশ্বাসীদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের লক্ষ্য হিসেবে প্রস্তাব রাখা। হলো যে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হলে পাওয়া যাবে পুরস্কার, সরকারি চাকরি, কারাগার থেকে মুক্তি আর বিতর্কিত জমির উত্তরাধিকার।

১৬৭১ সালে একটা অধ্যাদেশ জারি করা হলো যে এখন থেকে সাম্রাজ্যের সমস্ত জমির খাজনা আদায়কারীরা অবশ্যই হবে মুসলমান, আর সমস্ত সুবাদার আর তালুকদারদের আদেশ করা হলো যে তারা যেন এক্ষুনি তাদের হিন্দুপ্রধান কেরানি (পেশকার) আর হিসাবরক্ষকদের (দেওয়ানিয়ান) বরখাস্ত করে, তাদের পদে মুসলমান নিয়োগ দেয়। কিন্তু হিন্দু পেশকারদের বরখাস্ত করার পর প্রশাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ল। তাই পরে সম্রাট আবার আদেশ জারি করলেন যে পেশকারদের অর্ধেক হবে হিন্দু আর অর্ধেক মুসলমান।

ধর্মান্তরিত মুসলমানদের কাউকে কাউকে সম্রাটের আদেশে হাতির পিঠে বসিয়ে বাদ্য সহকারে আর পতাকা উড়িয়ে শোভাযাত্রা বের করা হলো শহরের রাস্তায় । অন্যেরা পেল প্রতিদিন সর্বনিম চার আনা করে বৃত্তি।

১৬৯৫ সালের মার্চে রাজপুত ছাড়া বাকি সব হিন্দুদের পালকি, হাতি আর ঘোড়ায় চড়া এবং অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হলো।

বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিনে হিন্দুরা তাদের পবিত্র স্থানগুলোর পাশে মেলা বসাত ভারত জুড়ে । বিপুলসংখ্যক পুরুষ, নারী আর শিশু যেত সেসব মেলায়। গ্রামের মহিলারা মেলা উপভোগের পাশাপাশি মিলিত হতো তাদের দূরের বন্ধুবান্ধব আর জ্ঞাতিদের সঙ্গে। ১৬৬৮ সালে এই ধরনের সমস্ত মেলা নিষিদ্ধ করলেন আওরঙ্গজেব।

আদেশ দেওয়া হলো, হিন্দুরা যেন তাদের প্রদীপ উৎসব (দীপাবলি) এবং বসন্ত উৎসব (হোলি) করে কেবল বাজার এলাকার বাইরে আর খানিকটা সংযতভাবে।

৮.৮ মথুরা জেলার অত্যাচারিত হিন্দু : কৃষ বিদ্রোহ

হিন্দুধর্মের ওপর সরকারি সমস্ত বিভাগের খোলাখুলি আক্রমণে হিন্দুরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সম্রাটের প্রাণনাশের কয়েকটা প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। ১৬৬৯ সালের প্রথম দিকে মথুরা জেলায় সংঘটিত হলো একটা বিদ্রোহ।

১৬৬০ সালের আগস্ট থেকে ১৬৬৯ সালের মে পর্যন্ত মথুরার ফৌজদার পদে নিযুক্ত আবদুন নবী খান খুশি মনেই নামল তার প্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণে। পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই মথুরার কেন্দ্রস্থলে সে একটা জামে মসজিদ নির্মাণ করল (১৬৬১-৬২) একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর। ১৬৬৬ সালে কেশব রাই মন্দির থেকে সে সরিয়ে দিল দারা শুকোর উপহার দেওয়া একটা পাথরের রেলিং। ১৬৬৯ সালে তিলপতের জমিদার গোকলার নেতৃত্বে জাঠ কৃষকগোষ্ঠী বিদ্রোহ করলে আবদুন নবী গিয়ে তাদের আক্রমণ করল বসরা গ্রামে, কিন্তু সংঘর্ষের একপর্যায়ে নিহত হলো বন্দুকের গুলিতে (১০ মে-র কাছাকাছি)। বিজয়ের আনন্দে গোকলা লুট করল সদাবাদ পরগনা, আর বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল পার্শ্ববর্তী আগ্রা জেলায়।

বিদ্রোহ দমন করার জন্য শক্তিশালী একটা বাহিনী পাঠালেন আওরঙ্গজেব। ১৬৬৯ সাল জুড়েই অরাজকতা বিরাজ করল মথুরা জেলায়। ৪ ডিসেম্বর হাসান আলী খান আক্রমণ করল বিদ্রোহী কিছু গ্রামবাসীকে। দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধ চালানোর পর আর প্রতিহত করতে না পেরে তাদের অনেকে হত্যা করল তাদের মেয়েদের, তারপর নিজেরাও আত্মাহুতি দিল মোগল তরবারির নিচে।

পরবর্তী মাসে হাসান আলী খান পরাজিত করল গোকলাকে। বেশির ভাগই জাঠকে নিয়ে গঠিত ২০,০০০ বিদ্রোহীর সঙ্গে সম্রাট-বাহিনীর যুদ্ধ হলো তিলপতের ২০ মাইল দূরে। কিন্তু দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মোগলদের সুশৃঙ্খলতা আর গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে হার মেনে তারা পালিয়ে এল তিলপতে। তিন দিন গ্রামটা অবরোধ করে রাখার পর সেখানে চালানো হলো হত্যাযজ্ঞ । বিজয়ীদের পক্ষের ৪,০০০ মানুষ নিহত হলো, বিদ্রোহীদের ৫,০০০ আর গোকলা আর তার পরিবারসহ ৭,০০০ জন হলো বন্দী। আগ্রা পুলিশ অফিসের প্ল্যাটফরমের ওপর জাঠ নেতার অঙ্গ একটা একটা করে কুপিয়ে বিচ্ছিন্ন করা হলো, আর তার পরিবারের সবাইকে বাধ্য করা হলো ইসলাম ধর্ম গ্রহণে।

হাসান আলীর কঠোর পদক্ষেপে শিগগিরই শান্তি ফিরে এল জেলায়, তবে খুব বেশি দিনের জন্য নয়। ১৬৮৬ সালে দ্বিতীয় জাঠ বিদ্রোহ হলো রাজারামের নেতৃত্বে, যার বর্ণনা আরও পরে দেওয়া হবে।

৮.৯ সাতনামি সম্প্রদায় : তাদের ১৬৭২ সালের বিদ্রোহ

আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সাতনামিরা আসলে ছিল সাধু, সাতনামি নামটা চালু করেছিল তারা নিজেই। ১৫৪৩ সালে একেশ্বরবাদী এই সম্প্রদায়টাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিজেশ্বরের বীরভান । মাথার সমস্ত চুল এমনকি ভ্রু পর্যন্ত কামিয়ে ফেলার জন্য লোক তাদের উপনাম দিয়েছিল মুণ্ডিয়া। সপ্তদশ শতাব্দীতে তাদের দুর্গ ছিল দিল্লির ৭৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের নারনল শহরে।

ফকিরের মতো পোশাক পরে থাকলেও তাদের বেশির ভাগই করত চাষবাস কিংবা অল্প পুঁজির ব্যবসা। তারা বসবাস করত তাদের আপন ধর্মবিশ্বাস নিয়ে কখনোই টাকা উপার্জন করত না কোনো অসৎ বা বেআইনি উপায়ে ।

গোলমালের সূত্রপাত সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে। একদিন সাতনামি এক চাষির তুমুল ঝগড়া হলো এক পেয়াদার সঙ্গে। একসময় পেয়াদা হাতের মোটা লাঠি দিয়ে চাষিটার মাথা ফাটিয়ে দিল। তখন একদল সাতনামি মিলে পিটিয়ে আধমরা করল পেয়াদাকে। এই সংবাদ শুনে শিকদার (নিমপদস্থ রাজস্ব সংগ্রাহক) একদল পেয়াদা পাঠাল লোকটাকে গ্রেপ্তার করার জন্য; কিন্তু সাতনামিরা একজোট হয়ে সব পেয়াদাকেই মারল, কয়েকজনকে আহত করল, তারপর কেড়ে নিল তাদের অস্ত্রশস্ত্র ।

দেখতে দেখতে এই গোলমালের গায়ে লাগল রাজনৈতিক রং যে স্বাধীনতাকামী একদল হিন্দু স্বয়ং আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করতে আসছে। ইতিমধ্যে এক বুড়ি সাতনামিদের মধ্যে উপস্থিত হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করল যে সে এমন জাদু করবে যে সম্রাটের সেনার অস্ত্রে সাতনামিদের মৃত্যু হবে না, যদি বা কোনো সাতনামি মরে, সেখান থেকে জন্ম নেবে আশিটা সাতনামি। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো, শিগগিরই পাঁচ হাজার সশস্ত্র সাতনামি একত্র হলো। বিপদটার গুরুত্ব না দিয়ে স্থানীয় অফিসারেরা পাঠাল ছোট ছোট সেনাবাহিনী, যারা পরাজিত হলো বারবার। নারনলের ফৌজদারকে পরাজিত করে শহরটা দখল করে নিল বিদ্রোহীরা, সেখানে লুটপাট চালাল, মসজিদগুলো ধ্বংস করে ফেলল; আউটপোস্ট বসিয়ে আর চাষিদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে। শহরটায় প্রতিষ্ঠিত করল নিজেদের প্রশাসন। বিদ্রোহের সংবাদ গিয়ে পৌঁছাল দিল্লিতে। সাতনামিদের জাদুশক্তির কুসংস্কারাচ্ছন্ন গল্পে মনোবল হারিয়ে ফেলল সম্রাটের সেনাবাহিনী।

আওরঙ্গজেবের ততক্ষণে টনক নড়েছে। ১৫ মার্চ ১০,০০০ সেনা আর গোলন্দাজ বাহিনী পাঠালেন তিনি রাদান্দাজ খানের অধীনে। আওরঙ্গজেব নিজেও জীবিত সাধু (জিন্দা পীর) হিসেবে বিখ্যাত, তাই সাতনামিদের জাদু নষ্ট করার জন্য কাগজে তিনি লিখে দিলেন নানা রকম কুরআনের আয়াত, আর কাগজগুলো সেনাবাহিনীর পতাকার সঙ্গে সেলাই করে শত্রুদের দেখানোর আদেশ দিলেন। সংঘর্ষটা হলো ভয়াবহ। প্রবল যুদ্ধের পর নিহত হলো দুই হাজার সাতনামি, পালাতে গিয়েও মারা পড়ল অনেকে। তাদের খুব অল্পই প্রাণে বাঁচল; আর দেশের এই অঞ্চল অবিশ্বাসী মুক্ত হলো।

৮.১০ শিখ ধর্মের পরিবর্তনসমূহ

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষাশেষি পাঞ্জাবে হিন্দু একজন সংস্কারক সুপরিচিত হয়ে উঠল, যার নাম বাবা নানক। সে সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে তার ধর্মবিশ্বাসের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাল।

১৪৫৯ সালে নানকের জন্ম লাহোরের ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের তালবন্দিতে (বর্তমানে নানকানা)। তার ধর্মবিশ্বাসের সার হলো জীবিত একজন ঈশ্বরে বিশ্বাস, আর প্রত্যেকটা মানুষের আচরণ এমনভাবে গঠন করা যেন তার ভেতর দিয়ে সেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায়।

কবিরের মতোই সে-ও বলত, ঈশ্বরকে পাওয়া যায় তা আর প্রার্থনা, আত্মসংযম, আত্মানুসন্ধান, আর অপলকে তার দিকে তাকিয়ে থাকার মাধ্যমে। নানক (জীবিত ছিল ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত) তার চারপাশে গড়ে তুলেছিল একদল। ভক্ত, যারা কালক্রমে একটা সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।

ষোড়শ শতাব্দী জুড়ে শিখ গুরুরা নানক থেকে পঞ্চম গুরু অর্জুন পর্যন্ত, তাদের সাধকসুলভ আচরণের ফলে মোগল সম্রাটগণের শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছে, কখনোই তাদের কোনো কলহ হয়নি ইসলাম বা রাষ্ট্রের সঙ্গে।

আওরঙ্গজেবের শাসনকালের আগে শিখদের কখনোই ধর্মীয় কারণে শাস্তি পেতে হয়নি কিংবা তাদের কোনো সংঘর্ষ হয়নি মোগল সরকারের সঙ্গে। জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তাদের যে সংঘর্ষ, তা হয়েছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ কারণে, গুরুদের চরিত্রের পরিবর্তনই ছিল সে জন্য পুরোপুরি দায়ী।

পঞ্চম গুরু অর্জুনের (১৫৮১-১৬০৬) অধীনে শিখ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা খুবই বৃদ্ধি পেল, আর তাদের সঙ্গে গুরুর সম্পদ। কাবুল থেকে ঢাকা পর্যন্ত প্রত্যেকটা শহরে তারা দান গ্রহণ করত, যা প্রতিনিধিদের তছরুপ এড়িয়ে যেটুকু থাকত, তার সবই জমা পড়ত অমৃতসরের কেন্দ্রীয় কোষাগারে। গুরুকে মনে করা হতো। পার্থিব রাজা, আর তাকে ঘিরে থাকত একদল সভাসদ আর মন্ত্রী, যাদের বলা হতো মসন্দ (হিন্দি মসন্দ-ই-আলা’ উপাধির বিকৃতি)। কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে অর্জুন আশীর্বাদ করল খুসরৌকে, যে মোগল সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে জাহাঙ্গীরের প্রতিদ্বন্দ্বী, এমনকি শাহজাদাকে অর্থনৈতিক সহায়তাও দিল । সিংহাসনের দাবিদারের পরাজয়ের পর অবিশ্বস্ততার দায়ে গুরুর দুই লাখ টাকা জরিমানা করলেন জাহাঙ্গীর। জরিমানা দিতে অস্বীকার করল গুরু, আর নির্বিকারভাবে বরণ করল বন্দিত্ব আর অত্যাচার। লাহোরের বালির ওপর জোরপূর্বক বসিয়ে রাখলে আগুনের মতো সেই গরম সইতে না পেরে গুরু শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ১৬০৬ সালের জুন মাসে।

তার ছেলে হর গোবিন্দের (১৬০৬-৪৫) সঙ্গে একটা নতুন যুগের সূচনা। হলো । পিতার মতো না হয়ে হর গোবিন্দ শুরু করল সামরিক অনুশীলন আর তারপর আকর্ষিত হয়ে পড়ল শিকারে। ৫২ জন দেহরক্ষীকে বাড়াতে বাড়াতে সে গঠন করে ফেলল খুদে একটা সেনাবাহিনী। শাহজাহান তাঁর সিংহাসনারোহণের পরপরই একদিন শিকারে এলেন অমৃতসর, আর সেদিন গুরুও শিকার করতে এল ওই একই অঞ্চলে। একটা পাখিকে কেন্দ্র করে গোলযোগের সূত্রপাত হলো তার শিখ আর সম্রাটের ভৃত্যদের মধ্যে। শেষমেশ তারা মেরে সম্রাটের ভৃত্যদের তাড়িয়ে দিল। উদ্ধত বিদ্রোহীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাঠানো হলো একটা সেনাবাহিনী, কিন্তু অমৃতসরের কাছের সংগ্রানায় সেটা ভীষণভাবে পরাজিত হলো ১৬২৮ সালে। গুরুর বীরত্বের কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। দলে দলে মানুষ এসে নাম লেখাল গুরুর দলে। তারা বলল যে সম্রাটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা আর কারোরই নেই। কিন্তু লাহোরের এত কাছে খোলাখুলি এই বিদ্রোহ সম্রাট সহ্য করলেন না। বড় বড় সব সেনাবাহিনী আসতে লাগল গুরুর বিপক্ষে আর প্রথমটায় কিছু সফলতা পেলেও, শেষমেশ অমৃতসরে তার বাড়ি আর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হলো। বাধ্য হয়ে গুরু আশ্রয় নিল কাশ্মির পাহাড়শ্রেণীর কিরাতপুরে, মোগল অস্ত্রের নাগালের বাইরে। আর সেখানেই সে মারা গেল। ১৬৪৫ সালে।

১৬৬৪ সালে গুরু হর কিষণের মৃত্যুর পর শিখদের মধ্যে দেখা দিল এক বিশৃঙ্খলা আর লোলুপতা। ২২ জন শিখ সবাই গুরু হতে চায়। এই স্বঘোষিত গুরুরা আবার শিখদের কাছ থেকে জোরপূর্বক দান গ্রহণ করতে লাগল। কিছুদিন পর বেশির ভাগ শিখই গুরু বলে মেনে নিল হর গোবিন্দের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র তেগ বাহাদুরকে।

আনন্দপুরে বাস করার সময় নিজের ধর্মবিশ্বাসের ওপর খোলাখুলি আক্রমণ আর পবিত্র স্থানগুলোকে অপবিত্র করতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল তেগ বাহাদুর। কাশ্মিরে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানো হিন্দুদের উৎসাহ দিল সে, আর প্রকাশ্যেই সম্রাটের বিরুদ্ধাচরণ করল। দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে তাকে নিক্ষেপ করা হলো কারাগারে আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হলো, কিন্তু সে অস্বীকার করায় পাঁচ দিন অত্যাচার চালানোর পর তার মস্তক দ্বিখণ্ডিত করা হলো সম্রাটের এক পরওয়ানায় (ডিসেম্বর, ১৬৭৫)।

অবশেষে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল শিখ আর মুসলমানদের মধ্যে। শিগগিরই শিখদের মধ্যে দেখা দিল এমন এক নেতা যে তার সম্প্রদায়কে পরিণত করল সুসংগঠিত এক সেনাবাহিনীতে। গোবিন্দ রাই (১৬৭৬-১৭০৮), দশম এবং সর্বশেষ গুরু আর তেগ বাহাদুরের এই একমাত্র পুত্রটি এমন একজন মানুষ, যার জন্মের আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল শিয়ালকে সে রূপান্তরিত করবে বাঘ আর চড়ুইকে বাজপাখিতে।

এখানে সামান্য থেমে আমরা বিবেচনা করতে পারি যে কেন গুরু গোবিন্দ অতটা সফল হয়েছিল। প্রথমত, শ্রদ্ধার আসনে বসে ওপরে উঠতে উঠতে শুরু পৌঁছে গিয়েছিল এক অতিমানবিক অবস্থানে। শিখেরা তাদের গুরুকে মান্য করতে শিখেছিল বিনা বাক্যব্যয়ে। দ্বিতীয়ত, সপ্তদশ শতাব্দীর শিখেরা ছিল তাদের ভাতৃত্ববোধ আর পারস্পরিক ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত। ভাই গুরুদাস বলেছেন, “যেখানে দুজন শিখ আছে, সেখানে আছে সাধুসঙ্গ; আর যেখানে আছে পাঁচজন শিখ, সেখানে আছে ঈশ্বর! শিখদের একতা আরও সুদৃঢ় হয়েছিল গোবিন্দের আদেশে তাদের জাতভেদের বালাই দূর হয়ে যাওয়ায়। আর খাবার এবং পান করার বিধিনিষেধ নিয়ে হিন্দু সমাজের যেসব মাতামাতি, শিখেরা ইতিমধ্যেই তা প্রত্যাখ্যান করেছিল অপ্রয়োজনীয় ভেবে।

৮.১১ গুরু গোবিন্দ : তার আদর্শ ও জীবন

অনুসারীদের নিয়ে সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধাচরণের একটা পথ অবলম্বন করল গোবিন্দ। হিন্দুদের সে রুখে দাঁড়াতে বলল মুসলমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে, আর তার অনুসারীদের ওপর ১২৫ টাকার একটা জরিমানা আরোপ করল যেকোনো মুসলমান সাধুর সমাধিকে সালাম করার অপরাধে।

গোবিন্দের জীবনের বেশির ভাগই কেটেছে উত্তর পাঞ্জাবের পাহাড়ে পাহাড়ে, আর জম্মু থেকে শ্রীনগরের পাহাড়ি রাজাদের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধ করে। শরহিন্দ থেকে সম্রাটের বড় বড় বাহিনী গেছে গুরুকে দমন করতে, কিন্তু সচরাচর সেগুলোর অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। দলে দলে মানুষ তার অনুসারী হয়েছে, এমনকি মুসলমানেরাও। আনন্দপুর অবরোধ করা হয়েছে পাঁচবার। সর্বশেষ আক্রমণের পর পালিয়েছে গুরু তার দুর্গ পরিত্যাগ করে, পেছনে পেছনে মোগলেরা ছুটেছে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে । তার চার পুত্র মারা গেছে। তারপর বিশ্বস্ত কয়েকজন অনুচরসহ গুরু চলে গেছে দক্ষিণ ভারতে।

১৭০৭ সালে নতুন সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহ তাকে তার সঙ্গে যেতে বললেন রাজপুতানা আর দাক্ষিণাত্য অভিযানে। ১৭০৭ সালের আগস্টে, কিছু পদাতিক আর দুই থেকে তিনশো অশ্বারোহী সেনাসহ গুরু পৌঁছাল হায়দরাবাদের ১৫০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের গোদাবরির ওপরের নান্দারে, আর সেখানে এক বছরের বেশি অবস্থান করার পর নিহত হলো এক আফগানের ছুরিকাঘাতে (১৭০৮)। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেল গুরু পরম্পরা।

তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আওরঙ্গজেবের অধীন মোগল সরকার গুরুদের ক্ষমতা ভেঙে ফেলতে সমর্থ হয়েছিল। শিখরা বঞ্চিত হয়েছিল সর্বসাধারণের গ্রহণযোগ্য কোনো নেতৃত্ব। তারপর শিখরা জনসাধারণের শাস্তি বিনষ্ট করেছে, কিন্তু কখনোই দলবদ্ধভাবে নয়। তখন তারা আর নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একজন সেনাপতির অধীন সেনাবাহিনী ছিল না, তারা হয়ে পড়েছিল ভ্রাম্যমাণ রাহাজান-অকুতোভয়, কৌতূহলী আর কষ্টসহিষ্ণু, কিন্তু দেশে সংগঠিত কোনো সরকার প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণাহীন দস্যুমাত্র। রণজিৎ সিংয়ের উত্থান না হলে শিখদের শাসনাধীন বড় আর সংযুক্ত কোনো রাজ্য থাকত না, পাঞ্জাবের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য তখন কোনো শিখ সেনার নেতৃত্বে প্রত্যেক বছর যেত কেবল লুণ্ঠন চালিয়ে দেশের বারোটা বাজাতে।

যা-ই হোক, আওরঙ্গজেবের গোঁড়ামির নিকৃষ্টতম পরিণতি ছিল বৃহত্তম দুই রাজপুত গোত্রের মধ্যে তাঁর উসকে দেওয়া যুদ্ধ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *