১২. বিজাপুরের ক্ষয় ও পতন

১২. বিজাপুরের ক্ষয় ও পতন

১২.১ জয় সিংহের বিজাপুর আক্রমণ, ১৬৬৫-১৬৬৬

আওরঙ্গজেব বিজাপুরের সুলতানের ওপর সংগত কারণেই অসম্ভষ্ট হয়েছিলেন। মোগলদের উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের সুযোগ নিয়ে আদিল শাহ ১৬৫৭ সালের আগস্ট মাসের চুক্তিতে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো এড়িয়ে গিয়েছিল। জয় সিংহের শিবাজীর বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালীনও বিজাপুরী সরকার একটা গোপন মৈত্রী স্থাপন করল মারাঠি সর্দারের সঙ্গে আর তাকে সহায়তা করল ভুমি, টাকা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস দিয়ে। সর্বোপরি ১৬৬৫ সালের জুনে শিবাজীর সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দাক্ষিণাত্যে জয় সিংহের অধীন বিশাল সেনাবাহিনী হাত গুটিয়ে বসেছিল, যাদের আশু প্রয়োজন একটা লাভজনক কাজ। তাই বিজাপুর আক্রমণই মনে হলো সেরা উপায়।

১৬৬৫ সালের ১৯ নভেম্বর জয় সিংহ রওনা দিল পুরন্দর দুর্গের পাদদেশ থেকে, সঙ্গে তার সম্রাট-বাহিনীর ৪০,০০০ সেনা, পাশাপাশি ২,০০০ মারাঠি অশ্বারোহী আর নেতাজি পালকরের অধীন ৭,০০০ পদাতিক। প্রথম মাসে বাধাহীনভাবে এগিয়ে চলল জয় সিংহ একের পর এক ফল্টন, থার্থবাদা, খাতব, মঙ্গলবাইদ ইত্যাদি বিজাপুরী দুর্গ দখল করতে করতে। শত্রুপক্ষের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হলো ২৫ ডিসেম্বর। ওই দিন দিলির খান আর শিবাজীর অধীন একটা বাহিনী মুখোমুখি হলো বিখ্যাত দুই সেনাপতি শারজা খান আর খাবাস খান এবং তাদের মারাঠি মৈত্রী কালিয়ানির যাদব রাও আর শিবাজীর সৎ ভাই ভ্যাঙ্কোজীর। দীর্ঘ এক যুদ্ধের পর দিলির খানের অক্লান্ত বারংবার আক্রমণ শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। কিন্তু বিজয়ীরা ফিরতি পথ ধরতেই শত্রুরা আবার দুই পাশ আর পেছন থেকে আক্রমণ চালিয়ে তাদের খুবই ক্ষতি করল।

দুই দিন পর ২৮ ডিসেম্বর শত্রুপক্ষের আবার যুদ্ধ হলো জয় সিংহের বাহিনীর সঙ্গে। মোগল আক্রমণের মুখে এখানেও শেষমেশ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল তারা। পরদিন ২৯ ডিসেম্বর জয় সিংহ গিয়ে পৌঁছাল বিজাপুরের ১২ মাইলের মধ্যে। কিন্তু ইতিমধ্যে আলী আদিল শাহের যুদ্ধের সম্পূর্ণ প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। তার নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ৩০,০০০ কর্ণাটকি পদাতিক, তা ছাড়া চারপাশের ছয় মাইল জুড়ে বিপুল ক্ষতিসাধন করা হয়েছে শত্রুসেনা প্রতিহত করার লক্ষ্যে; নৌরসপুর আর শাহপুরের বিরাট দুই দিঘির পানি শুকিয়ে ফেলা হয়েছে; আশপাশের সমস্ত কুয়ো ভরাট করা হয়েছে মাটি দিয়ে প্রত্যেকটা দালান মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে মাটির সঙ্গে, আর কেটে ফেলা হয়েছে সমস্ত গাছ, যেন শত্রুরা কোনো রকম ছায়া কিংবা আড়াল না পায়।

বিজাপুর জয়ের সুবর্ণ সুযোগের হাতছানিতে দ্রুতবেগে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে জয় সিংহ, কিন্তু এখন তার অবস্থা হয়ে গেল জটিল। দ্বিতীয় আলী আদিল শাহের সাহায্যে গোলকুণ্ডা থেকে ছুটে আসছে বিশাল এক সেনাবাহিনী, এদিকে তার সেনারা অনাহারের সম্মুখীন।

১২.২ বিজাপুর থেকে জয় সিংহের বাধ্যতামূলক পশ্চাদপসরণ, ১৬৬৬

১৬৬৬ সালের ৫ জানুয়ারি, বাধ্য হয়ে পিছু হটতে লাগল মোগল সেনাপতি। ২৭ তারিখে পৌঁছাল সে পারোর ১৬ মাইল দক্ষিণের সুলতানপুরে আর থাকল সেখানে ২৪ দিন।

এই জানুয়ারি মাসে মোগলেরা হলো চারটে বড় বড় দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন। প্রথমত, মাসের ১২ তারিখের দিকে সিকান্দার নামক এক সাহসী আফগান ক্যাপ্টেন জয় সিংহের সেনাবাহিনীর জন্য রসদ, সাজ-সরঞ্জাম আর যুদ্ধোপকরণ নিয়ে আসার সময় শারজা খানের সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলো পারোর আট মাইল দক্ষিণে; সিকান্দার নিহত হলো, আর তার সমস্ত জিনিস লুট করে নিয়ে গেল শত্রুরা।

তারপর ১৬ তারিখে পানহালা দুর্গ আক্রমণ করতে গিয়ে শোচনীয় পরিস্থিতি হলো শিবাজীর, নিহত হলে তার এক হাজার সেনা। ২০ তারিখের দিকে এসে পৌঁছাল আরেক দুঃসংবাদ, পানহালা আক্রমণে অবাধ্যতা আর অবহেলার জন্য শিবাজী তার প্রধান সেনাপতি নেতাজিকে এমন তিরস্কার করেছে যে সে চার লাখ হুন ঘুষের বিনিময়ে গিয়ে যোগ দিয়েছে বিজাপুরীদের সঙ্গে। চিঠির পর চিঠি লিখে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আর সব চাহিদা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনল (২০ মার্চ) জয় সিংহ। আর চতুর্থ দুর্ভাগ্য হলো, আদিল শাহের সহায়তায় গোলকুণ্ডার সুলতান পাঠিয়েছে ১২,০০০ অশ্বারোহী আর ৪০,০০০ পদাতিক বাহিনী।

তারপর আরও দুটো বড় যুদ্ধ করতে হলো জয় সিংহকে, কিছুদিন পর আরও চারটে, কিন্তু সব যুদ্ধই হলো নিষ্ফলা। শত্রুসেনা প্রথমে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু পরে আবারও একত্র হয়ে চালাল অতর্কিত সব আক্রমণ।

জয় সিংহ উত্তর দিকে ফিরতে লাগল ৩১ মে। ভূম পৌঁছে (১০ জুনের দিকে) থাকল সে ৩.৫ মাস, তারপর ২৮ সেপ্টেম্বর ভূমের ৩৭ মাইল উত্তরের বীরের উদ্দেশে যাত্রা করে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে থেকে শেষমেশ আওরঙ্গাবাদ ফিরে এল সে ২৬ নভেম্বর। যুযুধান দুই পক্ষই ক্লান্ত হয়ে আকুল হয়ে উঠেছিল শান্তির জন্য; তাই আবার শুরু হলো সমঝোতার যোগাযোগ।

১২.৩ জয় সিংহের ব্যর্থতা ও মৃত্যু

জয় সিংহের বিজাপুর আক্রমণ ছিল একটা সামরিক ব্যর্থতা। এর ফলে লাভ করা যায়নি এক ইঞ্চি ভূখণ্ড, একটা দুর্গ বা কোনো রকম যুদ্ধ ক্ষতিপূরণ । অর্থনৈতিক বিচারে এই আক্রমণ ছিল আরও শোচনীয়। সম্রাটের তহবিলের ৩০ লাখ টাকা ছাড়াও জয় সিংহের নিজের পকেট থেকেই গিয়েছিল এক কোটি টাকার বেশি। একদম ছোট ছোট মুসলমান ক্যাপ্টেনও বিজাপুরের পক্ষ ত্যাগ করে আসতে চাইলে, জয় সিংহ তাকে যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা দেওয়ার পরও মোগল সেনাবাহিনীতে উচ্চ পদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সামরিক এই ব্যর্থতা আর অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণে জয় সিংহের ওপর খুবই বিরক্ত হলেন সম্রাট। অসুখী সেনাপতি পেল আওরঙ্গাবাদে ফেরার নির্দেশ (অক্টোবর ১৬৬৬) এবং দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি তুলে দেওয়া হলো শাহজাদা মুয়াজ্জমের হাতে। একশো যুদ্ধের অভিজ্ঞ এই রাজপুত সেনাপতি শাহজাদার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নিদারুণ হতাশায় ফিরে গেল উত্তর ভারতে। বিজাপুরে তার খরচ হওয়া এক কোটি টাকার একটা পয়সাও ফেরত দিলেন না সম্রাট। অপমানে আর হতাশায় ভেঙে পড়ে এবং বৃদ্ধ বয়সের রোগে ভুগে ১৬৬৭ সালের ১৮ আগস্ট বুরহানপুরে হাতির পিঠ থেকে পড়ে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল মীরজা রাজা জয় সিংহ।

কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের কোনো সুযোগ রাজার ছিল না। এত বড় একটা রাজ্য জয়ের পক্ষে তার সেনাবাহিনী ছিল খুবই ছোট; তার যুদ্ধাপকরণ আর খাদ্যের সরবরাহ ছিল এক মাস বা বড়জোর দুই মাসের জন্য যথেষ্ট, আর তার ছিল না ভারী কোনো কামান। জয় সিংহের অধীনস্তরাও যথাযথ দায়িত্ব পালন করেনি; অনেকেই ছিল অবিশ্বাসী, কেউ কেউ তার আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, কিংবা মানলেও মেনেছে তা অনেক দেরিতে। সদর দপ্তরে থাকা সম্রাটের অফিসারেরা নিয়মিতভাবে সেনাবাহিনীকে শস্য সরবরাহ করেনি। এ রকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধে সাফল্য লাভ করা কোনো মানুষের পক্ষে অসম্ভব ।

১২.৪ সামরিক অভিজাত কর্তৃক শাসিত বিজাপুর : তাদের চরিত্র

সামরিক বিদ্রোহ ছিল বিজাপুর সুলতানাতের অভিশাপ। সরকার একটা খাঁটি সামরিক পেশা, যার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভাড়াটে সেনাপতিরা। সামরিক এসব অভিজাতদের প্রধান ছিল আফগান, আবিসিনীয়, সাঈদ, আর আরব মোল্লারা। এখানে হিন্দুরা ছিল নিম শ্ৰেণী। বিদেশি অভিজাতরা কখনোই নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে করেনি, ফলে তারা স্থানীয় অধিবাসীর অঙ্গীভূত হতে পারেনি। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নজর ছিল কেবল ব্যক্তিগত লাভের দিকে। যতক্ষণ তাদের পাওনা ঠিক থেকেছে, রাষ্ট্রের শাসক কে থাকল না থাকল, তা নিয়ে তারা মাথা ঘামায়নি। দেশপ্রেম বলতে তাদের কিছু ছিল না, যেহেতু তারা এই দেশেরই কেউ নয়; তারা হলো খাঁটি রাজনৈতিক বেদুইন।

এ রকম মানুষের বিশ্বস্ততার ওপর রাষ্ট্রের ভিত্তি রাখা আর বালি দিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করা একই কথা। বিদেশি হস্তক্ষেপের ফলে সূচিত রাজনৈতিক পরিবর্তন এদের জীবনযাত্রার এতটুকু হেরফের ঘটায়নি। আর এভাবে শাসিত হওয়াটাই ছিল আদিল শাহি শাসনের পতনের মূল কারণ।

১২.৫ আদিল শাহি শাসনের ক্ষয় : অন্তর্বর্তীকালীন শাসক হওয়ার দ্বন্দ্ব

মুহম্মদ আদিল শাহের অধীনের বিজাপুর রাজ্যই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃতি লাভ করেছিল। তার রাজ্য রাজস্ব আদায় করত বার্ষিক ৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, পাশাপাশি রাজা আর জমিদারদের কর বাবদ আরও ৫ কোটি। তার সেনাবাহিনীতে ছিল ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ২,৫০,০০০ পদাতিক আর ৫৩০টা যুদ্ধের হাতি।

১৬৫৭ সালের মোগল আক্রমণের পর বিজাপুরের যে শক্তি ক্ষয় হয়েছিল, দ্বিতীয় আলী আদিল শাহের হাতে আবার তার গঠন-প্রক্রিয়া শুরু হলো ১৬৬৬ সালে। সে শিবাজীর উত্থানের রাশ টেনে ধরল, কারনুলের আবিসিনীয়দের বশ মানাল, মাথা নোয়াতে বাধ্য করাল বেদনুরের রাজাকে, আর শেষমেশ প্রতিহত করল জয় সিংহের অধীন মোগল আক্রমণ। তারপর বাদবাকি জীবনের জন্য সুলতান গা ভাসিয়ে দিল মদের স্রোত আর হেরেমের আমোদে; কিন্তু তার যোগ্য উজির আবদুল মুহম্মদ প্রশাসন চালাতে লাগল চমৎকার সাফল্যের সঙ্গে। ১৬৭২ সালের ২৪ নভেম্বর দ্বিতীয় আলী আদিল শাহ মৃত্যুবরণ করার পর বিজাপুরের গৌরব অন্তর্হিত হলো। তার ছেলে চার বছরের সিকান্দারকে অধিষ্ঠিত করা হলো সিংহাসনে, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো অন্তর্বর্তীকালীন শাসকদের শাসনকাল, যা রাজ্যকে টেনে নিয়ে গেল ধ্বংসের পথে।

১৬৭২ সাল থেকে ১৬৬৮ সালে রাজ্যের পতন পর্যন্ত বিজাপুরের ইতিহাস আসলে তার উজিরদের ইতিহাস। এই সময়ে ঘটল দলাদলি-প্রবণ অমাত্যদের মধ্যে ঘন ঘন গৃহযুদ্ধ, প্রাদেশিক রাজ্যপালদের স্বাধীনতা, খোদ রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শাসনের অসাড়তা, মাঝেসাঝে মোগল আক্রমণ, আর বাইরে শত্রুতার ভান করে ভেতরে ভেতরে মারাঠি শক্তির সঙ্গে মৈত্রী।

দ্বিতীয় শাহ আলী আদিল শাহের মৃত্যুর পরপরই দাক্ষিণাত্যের মুসলমান দলের আবিসিনীয় নেতা খাবাস খান চূড়ান্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সিংহাসনে বসাল আদিল শাহের শেষ বংশধর সিকান্দারকে। নতুন প্রধানমন্ত্রী অঙ্গীকার ভঙ্গ করে প্রতিশ্রুত দুর্গগুলো অমাত্যদের দিল না। রাগে-ক্ষোভে দরবার ত্যাগ করল প্রাক্তন দক্ষ উজির আবদুল মুহম্মদ। রাজার শৈশবাবস্থা আর অক্ষমতার ফলে। রাজ্যজুড়ে নেমে এল বিশৃঙ্খলা।

‘বিজাপুর আক্রমণের জন্য সম্রাট বারবার বাহাদুর খানকে আদেশ পাঠাতে লাগলেন।’ কিন্তু একজন প্রাদেশিক সরকারের সামান্য সেনাবাহিনী নিয়ে এই কাজ করা ছিল বাহাদুর খানের পক্ষে অসম্ভব। খান গিয়ে উপস্থিত হলো পেডগাঁয়ে। তার উদ্দেশ্য হলো, মূল সেনাবাহিনী শিবাজীর বিপক্ষে পাঠিয়ে দিয়ে এদিকে অমাত্যদের মোটা ঘুষের লোভ দেখিয়ে আর আক্রমণ না করে আক্রমণের ভয় দেখিয়ে বিজাপুরী ভূখণ্ড দখল।

বিজাপুরী সেনাবাহিনীর অর্ধেকেরও বেশি হলে আফগান, আর তাদের নেতা হলো আবদুল করিম ওরফে বাহলুল খান। তার জায়গির বাঙ্কাপুরে। গোপনে মোগল সুবাদারের সহায়তা চাইল খাবাস খান ‘আফগানদের শান্ত বা তাদের একদম ধ্বংস করে ফেলতে, কারণ, তাদের পাওনা শশাধের কড়া তাগাদা আর প্রায় খোলাখুলি বিরোধিতা খাবাসের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। সুতরাং বাহাদুর খান ভীমা নদীর তীরে গিয়ে মিলিত হলো খাবাসের সঙ্গে (১৯ অক্টোবর), আর । দুজনে শর্তালোচনা করতে বসল বিজাপুরের আফগান চক্রান্ত দমন আর শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষ্যে।

১২.৬ বাহলুল খানের অন্তর্বর্তীকালীন শাসন, ১৬৭৫-১৬৭৭

মোগল সহায়তার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে খাবাস খান তার সেনাপতিকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা আঁটল। কিন্তু বাহলুল ষড়যন্ত্রটা আঁচ করে আঘাত হানল আগেই। খাবাসকে একটা ভোজের দাওয়াত দিল আফগান সর্দার, তারপর মদে ভরপুর অবস্থায় তাকে বন্দী করে (১১ নভেম্বর) পাঠিয়ে দিল বাঙ্কাপুরে। তারপর বিজাপুরের নগরদুর্গে প্রবেশ করে উজির হয়ে বসল সে কোনো রকম রক্তপাত ছাড়াই। তিন বছর প্রধানমন্ত্রী তথা রাজা ছিল খাবাস খান, আর তার অলসতা ও অযোগ্যতার ফলে রাজ্যের পরিস্থিতি হয়েছিল খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ। কিন্তু আবিসিনীয় সেই শাসকের শাসন যতটা খারাপ ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ হলো বাহলুল খানের শাসন। ক্ষমতা হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অফিস থেকে দাক্ষিণাত্যের লোকজনদের একে একে সরিয়ে দিয়ে সেখানে সে বসাতে লাগল তার অনুসারী আর আত্মীয়দের। দাক্ষিণাত্যের অনেককে এমনকি শহর থেকেও বহিষ্কার করল সে। ফলে রাজ্যজুড়েই শুরু হলো দারুণ এক বিশৃঙ্খলা । দাক্ষিণাত্যের দল তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করল।

বাহলুল খানের শাসন পুরোপুরি নির্ভরশীল তার প্রধান মন্ত্রণাদাতা খিজির খান পানির সামর্থ্য আর কর্মদক্ষতার ওপর। ১৬৭৬ সালের ১২ জানুয়ারি দাক্ষিণাত্যের এক অধিবাসীর হাতে নিহত হলো সে ছুরিকাঘাতে। বাহলুল তৎক্ষণাৎ হত্যা করল তার অসহায় বন্দী খাবাস খানকে (১৮ জানুয়ারি), আর তারপর দাক্ষিণাত্যকে শায়েস্তা করার জন্য অগ্রসর হলো বিজাপুর থেকে। ২১ মার্চ মোকাহর কাছে তার বাহিনীর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হলো শারজা খানের বাহিনীর বিপক্ষে। যুদ্ধে আফগানরা জয়ী হলো, আর শারজা খান শোলাপুরে গিয়ে আশ্রয় নিল বাহাদুর খানের কাছে। দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে ভীমা পেরোল বাহাদুর খান (৩১ মে), আর তার অশ্বারোহীরা ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করল বিজাপুর শহরের আশপাশে। ১৩ জুন বাহলুল খানের সঙ্গে যুদ্ধ হলো তার বিজাপুরের ৩০ মাইল উত্তর-পুবের আলিয়াবাদ আর ইন্দির মধ্যের এক সমভূমিতে। দাক্ষিণাত্যের আক্রমণের মূল ঝড়টা গেল ইসলাম খানের (মালওয়ার সুবাদার) অধীন মোগল ডান অংশের ওপর। দিয়ে। তার হাতি বারুদের এক বিস্ফোরণে ভড়কে গিয়ে ঢুকে পড়ল শত্রুর মধ্যে, এবং নিহত হলো ইসলাম খান আর তার পুত্র । ভীমার অপর তীরের মোগল শিবির লুট করল আফগানেরা আর রক্ষীদের সবাইকে হত্যা করল। খরস্রোতা নদী পেরিয়ে সহায়তাও করতে পারল না বাহাদুর খান।

এই সময় প্রধানমন্ত্রী মদনা পণ্ডিতের অধীনে বিশাল এক গোলকুণ্ডা বাহিনী এসে উপস্থিত হওয়ায় আরও সংকটাপন্ন হলো বাহাদুর খানের অবস্থা। তবে ঘুষ। দিয়ে নবাগতদের বশ করতে পারল মোগল সেনাপতি, ফলে কিছু না করেই ফিরে গেল তারা। এবার বাহাদুর খান হালসাঙ্গিতে অগ্রসর হয়ে গড়ে তুলল বিশাল এক সেনাবাহিনী। ভয় পেয়ে গেল বাহলুল খান, আর নিজের নিরাপত্তার বিনিময়ে বিজাপুরী নির্দিষ্ট কয়েকটা জেলা দখলের ক্ষেত্রে মোগলদের বাধা দেবে না বলে অঙ্গীকার করল। বাহাদুর খান ঘুষ দিয়ে সহজেই দখল করল নলদুর্গ (১৪ মে, ১৬৭৭), আর কুলবর্গা (৭ জুলাই)। কিন্তু গোল বাধল দিলির খানকে নিয়ে (এসেছিল ১৬৭৬ সালের জুনে), নিজে আফগান হওয়ায় সে হয়ে গিয়েছিল বাহলুল খানের অন্তরঙ্গ বন্ধু আর বিজাপুরের আফগান চক্রান্তের পৃষ্ঠপোষক । দিলির আর বাহলুল চিঠি লিখে সম্রাটের কাছে অভিযোগ করল যে বাহাদুর খান গোপনে দাক্ষিণাত্যের তিন শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এবং এই অঞ্চলে সম্রাট বাহিনীর সাফল্যের ঘোর বিরোধী।

১২.৭ দিলির খান আর বাহলুলের গোলকুপ্তা আক্রমণ, ১৬৭৭

আওরঙ্গজেব বাহাদুরকে ডেকে নিলে সে প্রদেশ ত্যাগ করল ১৬৭৭ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথমে, আর দিলির দাক্ষিণাত্যের সুবাদার রয়ে গেল ১৬৭৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম বিশ বছরে দাক্ষিণাত্যে মোগলদের লাভের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে ১৬৫৭ সালে তিনি কালিয়ানি আর বিদারকে সংযুক্ত করেন বিজাপুর রাজ্যের উত্তর-পূর্ব কোণে; সবচেয়ে উত্তরের পারো দুর্গ আর জেলা ঘুষ দিয়ে পেয়ে যান তিনি ১৬৬০ সালের নভেম্বরে; চুক্তির মাধ্যমে শোলাপুর অর্জিত হয় ১৬৬৮ সালের জুলাইয়ে; আর এখন সংযুক্ত হলো নলদুর্গ আর কুলবর্গা। এভাবে বিশাল এক ভূখণ্ড চলে গেছে মোগলদের হাতে, যার পুব দিক ঘিরে রেখেছে ভীমা আর মঞ্জিরা নদী, আর সেখান থেকে কাল্পনিক একটা রেখা গিয়ে মিশেছে কুলবর্গা হয়ে বিদারের সঙ্গে (৭৭° পূর্ব দ্রাঘিমাংশ)। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমানা গিয়ে পৌঁছেছে হালসাঙ্গির উল্টো পাশের ভীমার উত্তর তীরে, আর দক্ষিণ-পুবে সেটা ছুঁয়েছে গোলকুণ্ডা রাজ্যের পশ্চিম সীমান্তের মালখেদ দুর্গ ।

বিজাপুরের এই কোণটা দখল সম্পূর্ণ করে মোগলেরা এবার নজর দিল গোলকুণ্ডার দিকে। তারা কুতব শাহকে আক্রমণের হুমকি দিল (আগস্টের মাঝামাঝি), যদি না সে তাদের হাতে তুলে দেয় শিবাজী আর শেখ মিনহাজকে-যে মোগলদের পক্ষে যোগ দেবে বলে সুবাদারের কাছ থেকে অনেক টাকা নেওয়া সত্ত্বেও শেষমেশ যোগ দিয়েছে গোলকুণ্ডার সঙ্গে। দিলির আর বাহলুল গোলকুণ্ডা আক্রমণ করল সেপ্টেম্বরে। সর্বশেষ মোগল আউটপোস্ট কুলবর্গা থেকে অগ্রসর হয়ে তারা পৌঁছাল ২৪ মাইল পুবের গোলকুপ্তা সীমান্তের প্রথম দুর্গ মালখেদে, আর সেটা দখল করে নিল একদিনেই। কিন্তু কুতব শাহি সেনার প্রতিরোধের মুখে পড়ল তারা মঙ্গলিগিতে। দুই মাস ধরে চলল অবিরাম। যুদ্ধ। কুতব শাহিরা বিজাপুরের মোগল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে বিচ্ছিন্ন করে দিল তাদের শস্যের সরবরাহ। চারপাশে শত্রুপক্ষ নিয়ে অতিবর্ষণ আর খাদ্যের অভাবে। অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করল আফগান আর রাজপুতেরা। বাহলুল খান শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল মরণাপন্ন এক অসুখে, আর তার অনুচরেরা ভেগে গেল অনাহার থেকে নিজেদের রক্ষা করার তাগিদে। শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে দিলির কোনো রকমে ফিরে এল কুলবর্গায়; শত্রুসেনার হাতে লুট হয়ে গেল তার মালপত্র, আর খিদেয় মৃতপ্রায় সম্রাট-বাহিনীর সেনারা খেতে বাধ্য হলো তালের আঁটি আর খেজুরের বিচি।

কুলবর্গায় দিলির খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মোগলদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন। করল মাসাউদ: সে বিজাপুরের উজির পদে অধিষ্ঠিত হবে, কিন্তু আওরঙ্গজেবের আদেশ পালনে বাধ্য থাকবে; শিবাজীর সঙ্গে কোনো রকম মৈত্রী স্থাপন করবে না, আর মারাঠা সর্দারের বলপূর্বক দখলকৃত ভূখণ্ডগুলো কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারে সব সময় মোগলদের সহায়তা করতে প্রস্তুত থাকবে; আদিল শাহের বোন সাহার বানু বেগমকে (পাদিশাহ বিবি নামে সুপরিচিত) মোগল দরবারে পাঠাবে সম্রাটের এক পুত্রকে বিয়ে করতে। শান্তিস্থাপন সেরে দিলির খান চলে গেল উত্তরে ।

১২.৮ অন্তর্বর্তীকালীন শাসক হিসেবে মাসাউদ; আফগান সেনা বিদ্রোহ; বিজাপুরে বিদ্রোহ

বাহলুল খান শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ১৬৭৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর। মাসাউদ হলো পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন শাসক (ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৮)। কিন্তু রাজকোষ শূন্য। আফগান ভাড়াটে সেনাদের বেতন দিতে পারল না সে, ফলে আফগানরা একেবারে ফেটে পড়ল। তারা বাহলুল খানের এতিম, বিধবা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘেরাও করে বকেয়া পাওনা আদায়ের লক্ষ্যে তাদের প্রকাশ্যে অপমান করতে লাগল। ধনী নাগরিকদের কেউই তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেল না। চিন্টু চিমনা নামক এক ডাকাত অত্যাচার চালাতে লাগল শহরবাসীদের ওপর, ওদিকে দুর্গপ্রাকারের বাইরের অধিবাসীদের ওপর চড়াও হলো আফগানেরা…। অসহায় মাসাউদ হাত-পা গুটিয়ে নিজের বাড়িতে বসে রইল দরজা-জানালা বন্ধ করে…। অনেক মানুষ আতঙ্কে পালিয়ে গেল কর্ণাটকে।

মাসাউদ তার দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলল, নিজের শক্তি বাড়াবার উদ্দেশ্যে গোপনে শিবাজীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মোগলদের ক্রুদ্ধ করে। মাসাউদের এই বিশ্বাস ভঙ্গের ফলে কুলবর্গার চুক্তি মানার ব্যাপারে দিলির খানের আর কোনো দায় রইল না। বর্ষা ঋতুর শেষে (অক্টোবর, ১৬৭৮), পেডগা থেকে অগ্রসর হয়ে দিলির খান এসে থামল আকলুজে।

ইতিমধ্যে চুক্তি অনুসারে মাসাউদের সহায়তায় শিবাজী পাঠিয়ে দিল ইস্পাতের বর্ম পরিহিত ছয় হাজার সেনা । কিন্তু এই দুই পক্ষের মধ্যে আন্তরিকভাবে মৈত্রী স্থাপন ছিল অসম্ভব। বিশ্বাসঘাতকতা করে বিজাপুর দুর্গ দখলের চেষ্টা করল শিবাজী। তাদের দিনে দিনে বেড়ে চলা বিদ্বেষ শেষমেশ রূপ নিল প্রকাশ্য কলহে। তখন শিবাজী আবার লুটপাট শুরু করল বিজাপুরী ভূখণ্ডে। মারাঠি সেনা এগিয়ে এসে লুটতরাজ করল দৌলতপুরের শহরতলি, খুসরৌপুর, আর জুহরাপুরে। প্রকাশ্য শত্রুর চেয়েও ভণ্ড মিত্রকে মাসাউদ ভয় পেল বেশি, আর আবার দিলির খানের কাছে নিরাপত্তার অনুরোধ জানিয়ে বিজাপুরে স্বাগতম জানাল একটা মোগল সেনাবাহিনীকে।

১৬৭৯ সালের ২ এপ্রিল দিলির খান ধ্বংস করে দিল শিবাজীর ভূপালগড় দুর্গ, আর ১৬,০০০ মারাঠি সেনার অসংখ্য হত্যা করল। কিন্তু আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মাসাউদের দ্বৈত চরিত্র, আর তাই ধূলখেদের কাছে ভীমা পেরিয়ে চলে গেল সে বিজাপুরের মাত্র ৩৫ মাইল দূরের হালসাঙ্গিতে। ভেঙে পড়ল আদিল শাহি সরকার এবং মাসাউদ আর শারজা খানের শক্রতার ফলে দেশে নেমে এল চূড়ান্ত অরাজকতা। যুযুধান চক্রান্তকারীদের মধ্যে দাক্ষিণাত্যের মোগল সুবাদারই হয়ে দাঁড়াল এক এবং অদ্বিতীয় শালিস। মুসলমান, আফগান আর মারাঠিদের সমন্বয়ে গঠিত ১,০০০ সেনার একটা দল মোগল বাহিনীতে যোগ দিয়ে গিয়ে দাঁড়াল দিলিরের পাশে, ওদিকে মাসাউদকে ঘিরে থাকল মাত্র তিন বা চার হাজার অনাহারি সেনার একটা দল, আর তারাও লালায়িত হয়ে রইল মোগল টাকার আশায়।

আওরঙ্গজেব সুলতানের বোন সাহার বানু ওরফে পাদিশাহ বিবিকে মোগল হেরেমে পাঠানোর দাবি জানালেন। এই রাজকুমারী ছিল রাজপরিবার আর নাগরিকদের অত্যন্ত প্রিয়। ১৬৭৯ সালের ১ জুলাই নিজের জন্মশহর ত্যাগ করে, দরবার আর জনসাধারণের সবাইকে কাঁদিয়ে শাহজাদা আজমের স্ত্রী হিসেবে সারা জীবনের জন্য সে গিয়ে প্রবেশ করল এক গোঁড়া সুন্নির বাড়িতে।

১২.৯ দিলির খানের বিজাপুর আক্রমণ; আদিল শাহকে শিবাজীর সহায়তা, ১৬৭৯

কিন্তু রাজকুমারীর আত্মত্যাগেও অভিশপ্ত বংশের কোনো উপকার হলো না। মোগলদের লোভ অসীম; এবার দিলির খান দাবি জানাল যে মাসাউদ তার শাসন ছেড়ে চলে যাক নিজের জায়গিরে, আর বিজাপুরের সরকার তোক মোগলদের কেউ। বুদ্ধিমানের মতো মাসাউদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। প্রকাশ্য এই বিরোধিতায় তৎক্ষণাৎ বিজাপুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল মোগল সেনাপতি। কিন্তু তার নিজের অবস্থানই তখন দুর্বল; তহবিল শূন্য, সেনাদের বেতন বাকি পড়ে আছে। দ্বিতীয়ত, দাক্ষিণাত্যের নতুন সুবাদার শাহজাদা শাহ আলম এক রকম তার প্রকাশ্য শত্ৰু, তিনি চান দিলিরের যেকোনো কাজ পণ্ড করে তার মাথায় অযোগ্যতার বোঝা চাপিয়ে দিতে। টাকার জন্য শাহজাদার কাছে বারবার অনুরোধ করতে লাগল দিলির খান। দেরির এই সুযোগে আদিল শাহকে সহায়তা করার। জন্য শিবাজীর কাছে দূত পাঠাল মাসাউদ। তৎক্ষণাৎ সাড়া দিল শিবাজী। মাসাউদকে সহায়তা করল সে ১০,০০০ মারাঠি অশ্বারোহী আর ২,০০০ বলদবোঝাই রসদ দিয়ে ।

১৬৭৯ সালের সেপ্টেম্বরে মঙ্গলবাইদ অধিকার করল মোগলরা। দিলির খান বারাগি পৌঁছাল ৭ অক্টোবর। ১০,০০০ সেনার নতুন একটা বাহিনী নিয়ে শিবাজী এসে পৌঁছাল সেলগুড়ে। তারপর ভীমা থেকে নর্মদা পর্যন্ত মোগল ভূখণ্ডে সে চালাতে লাগল লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ আর হত্যার মহোৎসব।

১২.১০ দিলির কর্তৃক বিজাপুরের আশপাশের গ্রাম ধ্বংস

১৪ নভেম্বর মিরাজ-পানহালা অঞ্চলে আক্রমণ চালাবার লক্ষ্যে মোগল সেনাপতি এগোল পশ্চিমে। তার প্রথম কাজ হলো কাণ্ডজ্ঞানহীন নিষ্ঠুরতায় বিজাপুরী ভূখণ্ডের ধ্বংসসাধন। পথিমধ্যে যে গ্রামই পড়ল, আক্ষরিক অর্থেই ধ্বংস করে দিল সে; সেগুলোর সমস্ত অধিবাসী, হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে বন্দী করা হলো ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য; মহিলারা তাদের শিশুসহ কুয়োয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল । ২০ নভেম্বর দিলিরের শিবির থেকে পালিয়ে গেল শম্ভুজী ।

শাহ আলম আর দিলির খানের কলহ দিনে দিনে তিক্ত থেকে তিক্ততর হলো। ৫৬ দিন বিজাপুর অবরোধ করে থেকেও কোনো লাভ না হওয়ায় শিবির ভেঙে ফিরতি পথ ধরল দিলির খান ১৬৭৯ সালের ২৯ জানুয়ারি। তারপর সে আক্রমণ করল বেরাদ। ১৬৮০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সে পৌঁছাল গোগিতে। কিন্তু গোগির আট মাইল দক্ষিণের রোদের রাজধানী সাগর আক্রমণ করতে গিয়ে ভয়াবহ এক পরাজয় বরণ করতে হলো মোগল সেনাপতিকে। বেরাদের পদাতিক বাহিনী দুর্গের প্যারাপেট, টিলা, ঢিবি এমনকি পাথরখণ্ডের পেছন থেকেও নিখুঁত নিশানায় গাদা বন্দুকের গুলিবর্ষণ করল মোগল সেনার ওপর।

সম্রাট-বাহিনীর অশ্বারোহীরা দয়া করার জন্য করুণ আবেদন জানাতে জানাতে ছুটল দিগ্বিদিকহারা হয়ে। একদিনেই নিহত হলো ১,৭০০ মানুষ। মোগল সেনাদের মনোবল এতটাই ভেঙে গেল যে মাথা পিছু ৫,০০০ টাকার লোভ দেখিয়েও তাদের আর শত্রুর মুখোমুখি করা গেল না।

১২.১১ দিলির খানের অপমান ও পদচ্যুতি, ১৬৮০

সম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পর দিলির খান উত্তরে ফিরতে লাগল ২৩ ফেব্রুয়ারি। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিল সে, লোকজনকে বন্দী করল মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে। দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল ১৬৭৮ সালের অক্টোবরে, যখন আওরঙ্গাবাদ থেকে শাহ আলম এসেছিলেন চতুর্থবারের মতো সুবাদার হতে । শাহজাদা এই পদে থাকলেন ১৬৮০ সালের মে পর্যন্ত। তাঁর অলস প্রশাসন কোনো সাফল্য বয়ে আনল না। অসন্তুষ্ট হয়ে শাহ আলম আর দিলির উভয়কেই ডেকে নিলেন সম্রাট এবং খান-ই-জাহানকে (বাহাদুর খান) দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করলেন দ্বিতীয়বারের মতো। ১৬৮০ সালের মে মাসে আওরঙ্গাবাদে এই সেনাপতি শাসনভার বুঝে নিল শাহ আলমের কাছ থেকে।

১২.১২ বিজাপুর বিষয়ে আওরঙ্গজেবের কর্মপন্থা, ১৬৮০ থেকে ১৬৮৪

দিলির খানের ব্যর্থতার পর চার বছর ধরে মোগলেরা বিজাপুরে চূড়ান্ত কোনো সাফল্য অর্জন করতে পারল না, শম্ভুজীর ফলপ্রসূ ধৃষ্টতায় তারা এক রকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল । ১৬৮১ সালের ১৩ জুলাই আওরঙ্গজেব বিজাপুরের প্রধান সেনাপতি শারজা খানের কাছে একটা বন্ধুসুলভ চিঠি লিখলেন, যেন শম্ভুজীকে দমন করতে সে মোগল সেনাপতিদের সহায়তা করে; শাহজাদা আজমের সঙ্গে সম্প্রতি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ বিজাপুরী রাজকুমারী সাহার বানুও একই মর্মে ব্যক্তিগত একটা আবেদন জানাল (১৮ জুলাই) শারজার কাছে। কিন্তু কোনো আদিল শাহি অফিসারের তরফ থেকেই সম্রাটের চিঠির জবাব এল না । এদিকে সম্রাট বিজাপুরী সরকারের তরফ থেকে মারাঠিদের সহায়তা করার স্পষ্ট প্রমাণ পেতে লাগলেন। তাই শম্ভুজীর ওপর চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ১৬৮২ সালের এপ্রিলে আওরঙ্গজেব বিজাপুরে একটা বিরাট সেনাবাহিনী পাঠালেন শাহজাদা আজমের অধীনে। তিনি দখল করলেন বিজাপুরের ১৪০ মাইল উত্তরের ধরুর দুর্গ। অনেক মাস ধরে চলল ঢিলেঢালা অভিযান, কিন্তু শাহজাদা নীরা নদীর পর দক্ষিণে আর অগ্রসর হতে না পারায় তাকে ফিরিয়ে নেওয়া হলো দরবারে।

বিজাপুরের পরিস্থিতি হয়ে পড়ল অসহায়। পাঁচ বছর যাবৎ ক্ষয়িষ্ণু আদিল শাহি দরবারে উজির পদে অধিষ্ঠিত থেকে বিরক্তির চুড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গেল সিদ্দি মাসাউদ। প্রশাসনে কোনো রকম উন্নতি করতে না পারায় কাজে ইস্তফা দিয়ে দরবার ত্যাগ করল সে ১৬৮৩ সালের ২১ নভেম্বর। তারপর ১৬৮৪ সালের ১৯ মার্চ উজির হলো আকা খুসরে, কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই মারা গেল সে (১১ অক্টোবর)। এই সময় সিকান্দার রাজ্যের নিরাপত্তার ভার তুলে দিল তার সবচেয়ে সাহসী সেনাপতি সাঈদ মখদুম ওরফে শারজা খানের হাতে (৩ মার্চ, ১৬৮৪)।

৩০ মার্চ আওরঙ্গজেবের একটা চিঠি এল আদিল শাহের নামে, যেখানে তিনি রসদ সরবরাহ করতে বললেন সম্রাট-বাহিনীকে, তার ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে মোগল সেনা যাওয়ার একটা পথ করে দিতে বললেন, মারাঠিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য চাইলেন ৫ বা ৬ হাজার অশ্বারোহীর একটা বাহিনী, নিষেধ করলেন শম্ভুজীকে কোনো রকম সহায়তা করতে, আর বললেন শারজা খানকে দেশ থেকে বের করে দিতে! মে মাসের শেষে মঙ্গলবাইদ আর সাঙ্গোলা দখল করে নিল খান-ই জাহান। এই সময়ে সিকান্দার খুব তেজের সঙ্গে আওরঙ্গজেবকে একটা জবাব দিল যে ইতিপূর্বে বলপূর্বক দখলকৃত বিজাপুরী ভূখণ্ড আর আদায়কৃত কর তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত মোগলদের, তার রাজ্য থেকে সরিয়ে নেওয়া উচিত মোগল আউটপোস্টগুলো, আর শম্ভুজীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলে তারা যেন যাতায়াত করেন তাঁদের নিজ ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে।

১৬৮৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিজাপুরে এসে পৌঁছাল শম্ভুজীর দেওয়ান মেলগিরি পণ্ডিতের অধীন একটা মারাঠি বাহিনী। ওদিকে গোলকুণ্ডার সহায়তার আশ্বাস পাওয়া গেছে আগেই। মোগলদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই, ফলে উভয় পক্ষই এবার আশ্রয় নিল তরবারির আইনের কাছে।

১২.১৩ বিজাপুর অবরোধের শুরু

বিজাপুর শহরের দেয়াল একটা উপবৃত্তের আকারে তাকে ঘিরে আছে আড়াই বর্গমাইল জুড়ে। ৪০ থেকে ৫০ ফুট চওড়া গভীর একটা পরিখা পেরোনোর পর পাওয়া যাবে বিশাল আর শক্ত সেই দেয়াল, যার উচ্চতা ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট, আর গড়পড়তা ২০ ফুট পুরু। দেয়ালের শক্তিবৃদ্ধির জন্য রয়েছে ৯৬টা বুরুজ।

মোগলরা অবরোধ শুরু করল ১৬৮৫ সালের ১ এপ্রিল। রুহুল্লাহ খান আর কাশেম খান পরিখা খুঁড়ল শাহপুর অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিকে, খান-ই-জাহান অগ্রসর হয়ে এসে থামল জুহরাপুরের কাছে। ১৪ জুন, বিরাট এক সেনাবাহিনী নিয়ে শাহজাদা আজম এলেন বেগম হউজে।

অবরোধে দেরি করার ব্যাপারে মোগলরা বরাবরই কুখ্যাত । তার পাশাপাশি বিজাপুরের মাটি আবার খুবই শক্ত, মাটির মাত্র এক বা দুই ফুট নিচ থেকেই নিরেট পাথর। তাই মোগলদের অগ্রগতি হলো অত্যন্ত ধীর আর কষ্টকর।

আদিল শাহের এই দুঃসময়ে মিত্ররা এগিয়ে এল একে একে । ১০ জুন এল সিদ্দি মাসাউদের সেনাবাহিনী, তারপর ১৪ আগস্টে এল একটা গোলকুণ্ডা বাহিনী, আর সবশেষে ১০ ডিসেম্বর এল শম্ভুজীর দ্বিতীয় একটা সেনাবাহিনী হাম্বির রাওয়ের অধীনে।

১২.১৪ শাহজাদা আজমের বিপদ, ফিরুজ জং কর্তৃক উদ্ধার

১৬৮৫ সালের ১৯ জুন শাহজাদা আজম এলেন বিজাপুর দুর্গের কাছে, কিন্তু এক মাসেরও কম সময়ে তাকে হতে হলো শক্ত তিনটে যুদ্ধের মুখোমুখি। ১ জুলাই তার পরিখায় আক্রমণ চালাল আবদুর রউফ আর শারজা খান এবং বেশকিছু মোগল অফিসার হতাহত হলো। পরদিনই তারা বিচ্ছিন্ন করে দিল মোগলদের খাদ্যের সরবরাহ।

শাহজাদার শিবিরে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ; বিজাপুরে খাদ্য পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, উত্তর দিকের রাস্তাগুলো মারাঠিদের কার্যকলাপের ফলে বন্ধ, ওদিকে বর্ষা ঋতুর কারণে ভরে উঠেছে নদীনালা। শস্য পাওয়া কঠিন হয়ে গেল, যেটুকু মিলল, তা-ও বিক্রি হলো ১৫ টাকা সের দরে।

আওরঙ্গজেব দেখলেন, সেনাবাহিনীসহ বিজাপুর থেকে ফিরে আসতে বলা ছাড়া তার পুত্রকে রক্ষার আর কোনো উপায় নেই। শাহজাদা যুদ্ধ বিষয়ে একটা বৈঠক করলেন; সবাই ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত দিল। কিন্তু জেগে উঠল শাহজাদার তেজ; তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শাহ আলমের পর্যায়ে নামতে রাজি নন। সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে আজম বললেন, ‘তোমাদের সবার কথা শুনলাম। এবার আমার কথা শোনো। দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত মুহম্মদ আজম তার দুই পুত্র আর বেগমকে নিয়ে এখান থেকে যাবে না। মারা যাওয়ার পর সম্রাট এসে হয়তো আমার লাশটা কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। তোমরা আমার অনুসারী, আমার সঙ্গে থাকবে, নাকি চলে যাবে, সেটা তোমাদের ইচ্ছে।’ তখন সবাই সমস্বরে বলল, ‘শাহজাদার ইচ্ছেই আমাদের ইচ্ছে!’

সংবাদটা পাওয়ামাত্র ৫,০০০ বলদভর্তি খাদ্য আর প্রচুর যুদ্ধোপকরণ পাঠালেন আওরঙ্গজেব, গাজি-উদ-দীন খান বাহাদুর ফিরুজ জংয়ের অধীনে। ১৬৮৫ সালের ৪ অক্টোবর রওনা দিয়ে ইন্দির কাছে শারজা খানকে বিতাড়িত করে ফিরুজ জং পৌঁছাল শাহজাদার শিবিরে। নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল অনাহারি মোগল সেনারা। কুতব শাহি রাষ্ট্রে মোগল নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত হলো ১৬৮৬ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী মদনা পণ্ডিত নিহত হওয়ার পর।

১২.১৫ বিজাপুর অবরোধে মোগলদের কষ্ট ও দুর্ভোগ

১৬৮৬ সালের জুনের দিকে বিজাপুরের অবরোধ ১৫ মাস হয়ে গেল, তবু এল না কোনো চূড়ান্ত ফল ।

মোগল সেনাপতিদের মধ্যে দেখা দিল মতভেদ আর বিদ্বেষ। সম্রাট বুঝতে পারলেন যে নেতৃত্ব নিজ হাতে না নিলে দুর্গের পতন হবে না । ১৬৮৬ সালের ১৪ জুন তিনি শোলাপুর ত্যাগ করলেন আর রসুলপুরে পৌঁছালেন ৩ জুলাই। শাহজাদা শাহ আলম এসে যোগ দিলেন তাঁর পিতার সঙ্গে। তিনি গোপনে সিকান্দার আদিল শাহ আর তার অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, যেন তারা শান্তি পূর্ণভাবে দুৰ্গটা সমর্পণ করে, কারণ, শাহজাদা আজম তাহলে দুর্গ জয়ের গৌরব থেকে বঞ্চিত হবেন। কিন্তু কথাটা গিয়ে পৌঁছাল মুহম্মদ আজম শাহ আর সম্রাটের কানে। শাহ আলম তিরস্কৃত হলেন; অভিযুক্ত কয়েকজন অফিসারকে বন্দী করা হলো, অন্যান্যদের বহিষ্কার করা হলো শিবির থেকে। কিন্তু এই দুর্ভোগ শেষ হতে না হতেই দেখা দিল আরেক দুর্ভোগ। অনাবৃষ্টির কারণে দাক্ষিণাত্যে শুরু হলো খাদ্যের অভাব। তবে মোগলদের চেয়েও অবরুদ্ধ বিজাপুরীদের দুর্ভোগ হলো দশ গুণ বেশি। দুর্গের ভেতরেই মারা গেল অসংখ্য মানুষ আর ঘোড়া। অবরোধের চূড়ান্ত পর্বে ঈশ্বরতাত্ত্বিকদের একটা দল আওরঙ্গজেবের শিবিরে এসে তাকে বলল, ‘আপনি একজন গোড়া বিশ্বাসী, ইসলামি আইন আপনার নখদর্পণে এবং কুরআনের নির্দেশের বাইরে আপনি কিছু করেন না। এবার বলুন, ভাতৃপ্রতিম মুসলমানদের বিপক্ষে অপবিত্র এই যুদ্ধে আপনি কোন ন্যায্যতা খুঁজে পেলেন।’ আওরঙ্গজেব তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন: আপনাদের বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। আপনাদের এই রাজ্যের লোভ আমার নেই। কিন্তু নারকীয় বিধর্মীর এক বিধর্মী পুত্রকে (অর্থাৎ, শম্ভুজী) আপনারা আশ্রয় দিয়েছেন। এখান থেকে দিল্লি পর্যন্ত সে মুসলমানদের ঝামেলা সৃষ্টি করছে, আর তারা আমার কাছে নালিশ করছে দিন রাত। আপনারা সেই বিধর্মীকে আমার হাতে তুলে দিন, পরমুহূর্তেই আমি অবরোধ তুলে নেব। ঈশ্বরতাত্ত্বিকদের কারও মুখে আর কথা জোগাল না।

১২.১৬ বিজাপুরের সর্বশেষ সুলতানের পতন

সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বিজাপুরের পতন হলো, কিন্তু সংঘর্ষের মাধ্যমে নয়। দুর্গের সবাই মনোবল হারিয়ে ফেলল। কমতে কমতে সেখানে ছিল আর মাত্র ২,০০০ মানুষ। ৯ সেপ্টেম্বর রাতে বিজাপুরী দুই নেতা নওয়াব আবদুর রউফ আর শারজা খানের সচিব আত্মসমর্পণের ব্যাপারে ফিরুজ জংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করল।

১৬৮৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রোববার বিজাপুরী শাসনের অবসান হলো। প্রজাদের কান্না আর বিলাপের মধ্যে দুপুর একটায় পূর্বপুরুষের সিংহাসন ত্যাগ করে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এল সর্বশেষ আদিল শাহি সুলতান, সিকান্দার, আর রাও দলপত বুন্দেলার তত্ত্বাবধানে গেল আওরঙ্গজেবের রসুলপুর শিবিরে।

ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক এই ঘটনা উপলক্ষে আওরঙ্গজেবের শিবির সজ্জিত করা হয়েছিল জাকজমকপূর্ণভাবে। সিকান্দার এসে উপস্থিত হতেই উচচপদস্থ কয়েকজন অফিসার তাকে সসম্মানে নিয়ে গেল সম্রাট সকাশে। তার অপূর্ব সুন্দর চেহারা আর রাজকীয় আচরণে সবার সঙ্গে সঙ্গে আওরঙ্গজেবও মুগ্ধ হলেন। তিনি তার সঙ্গে স্ত্র স্বরে কথা বললেন, তাকে ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত করলেন, আর তার বার্ষিক বৃত্তি স্থির করলেন এক লাখ টাকা। ১৯ সেপ্টেম্বর বিজয়ী সম্রাট বহনযোগ্য একটা সিংহাসনে বসে গেলেন দুর্গ অভিমুখে, আর শহরের রাস্তা অতিক্রম করার সময় ডানে-বামে ছড়ালেন মুঠো মুঠো স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা। দুর্গ পরিদর্শন শেষে জামে মসজিদে গিয়ে তাঁর প্রতি আল্লাহর কৃপার জন্য নামাজ আদায় করলেন। সিকান্দারের প্রাসাদে তিনি বিশ্রাম নিলেন দু-এক ঘণ্টা আর গ্রহণ করলেন তার সভাসদদের অভিনন্দনমূলক উপহার। জীবিত বস্তুর ছবি আঁকা কুরআনের পরিপন্থী, কারণ, এটা সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার শামিল; তাই প্রাসাদের দেয়ালে আঁকা সমস্ত ছবি মুছে ফেলার আদেশ দিলেন তিনি, আর তার বিজয়সংবলিত একটা খোদাই করা হলো বিখ্যাত কামান ‘মালিক-ই-ময়দান’-এর ওপর।

সর্বশেষ আদিল শাহি সুলতান কিছুদিন বন্দী থাকল দৌলতাবাদের রাষ্ট্রীয় কারাগারে। ১৭০০ সালের ৩ এপ্রিল যখন শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল সে সাতারা দুর্গের বাইরে, তখনো তার বয়স ৩২ পুরো হয়নি। শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার লাশ নিয়ে যাওয়া হলো বিজাপুরে, আর ছাদবিহীন একটা ঘেরাওয়ে সমাহিত করা হলো, তার আধ্যাত্মিক গুরু শেখ ফাহিমুল্লাহর মাজারের পাদদেশে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *