৫. উত্তরাধিকারের লড়াই : দারা ও সুজার মৃত্যু
৫.১ শামুগড়ের যুদ্ধের পর দারার অনুসরণ
১৬৫৮ সালের ৫ জুন দারা দিল্লি পৌঁছালেন আর রাজধানীর সরকারি সম্পত্তি দখল করে নতুন একটা সেনাবাহিনী গঠনের চেষ্টা করলেন। কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর আগ্রা দুর্গের পতনের সংবাদ পেয়ে দিল্লি ছেড়ে তিনি গেলেন লাহোরে। দীর্ঘ দিন তাঁর সুবাদারির অধীনে থাকায় পাঞ্জাব ছিল দারার খুবই অনুগত, আর এখন প্রদেশটা রয়েছে তার বিশ্বস্ত সহকারী সাঈদ ঘইরাত খানের অধীনে। দিল্লি থেকে ১০,০০০ মানুষের একটা দল নিয়ে লাহোর পৌঁছালেন দারা ৩ জুলাই। যুদ্ধের প্রস্তুতির লক্ষ্যে সেখানে থাকলেন তিনি দেড় মাস, সম্রাটের সেখানকার সম্পদ দখল করে গড়লেন ২০,০০০ সেনার একটা বাহিনী, আর শক্ত পাহারা বসালেন তালওয়ান আর রূপারের কাছের শদ্ৰ নদীর নৌকা পারাপারের ওপর।
ইতিমধ্যে দারার লোকজনের কাছ থেকে এলাহাবাদ দখলের ভার দিলেন আওরঙ্গজেব খান-ই-দৌরানকে, বাহাদুর খানকে পাঠালেন দারার অনুসরণে, আর নিজে দিল্লি গেলেন ৬ জুলাই। রাজধানীতে অবস্থান করলেন তিনি তিন সপ্তাহ, পুরাতন প্রশাসনের অবসান ঘটিয়ে গঠন করলেন নতুন প্রশাসন, আর শেষমেশ ২১ জুলাই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন ‘আলমগির গাজি’ উপাধি নিয়ে। খলিলুল্লাহ খানকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠানো হলো তাকে দারার অনুসরণ জোরদার করার জন্য।
৫ আগস্ট রাতে রূপারের কাছে শ অতিক্রম করল বাহাদুর খান, আর দারার সেনাপতিরা পিছিয়ে গেল গোবিন্দোয়ালে। কিন্তু দিল্লি থেকে যখন আওরঙ্গজেব গেলেন শতদ্রর তীরে, পরিবার আর ধনসম্পদসহ নৌকাযোগে দারা পালিয়ে গেলেন লাহোর থেকে মুলতানে (১৮ আগস্ট)। আরেকবার দারার বুদ্ধির কাছে হার মানলেন আওরঙ্গজেব। তার সেনারা ভেঙে পড়ল হতাশায়।
৩০ আগস্ট লাহোর থেকে আবার দারার অনুসরণ শুরু করল আওরঙ্গজেবের সেনারা, আর সম্রাট স্বয়ং সেই অনুসরণে যোগ দিলেন ১৭ সেপ্টেম্বর। কিন্তু মুলতান থেকে আবার পালিয়ে (১৩ সেপ্টেম্বর) দারা গেলেন শরে (১৩ অক্টোবর)। মুলতানের কাছ থেকে আওরঙ্গজেব দিল্লি ফিরলেন (৩০ সেপ্টেম্বর) সুজার আক্রমণ মোকাবিলা করতে, কিন্তু ১৫,০০০ সেনা নিয়ে সিন্ধুর দুই তীর জুড়ে দারার অনুসরণ অব্যাহত রইল শাফ শিকন খান এবং শেখ মীরের নেতৃত্বে।
শক্করে সম্রাট-বাহিনী জানতে পারল (২৩ অক্টোবর) যে ভর দুর্গে বেশির ভাগ সম্পদ আর বড় কামানগুলো খোঁজা বসন্তের অধীনে, আর ইয়োরোপীয় অনেক গানার নিকোলাস মানুচির তত্ত্বাবধানে রেখে, ৩,০০০ মাত্র সেনা নিয়ে দারা পালিয়ে গেছেন শেহওয়ানের দিকে। বাদবাকি সেনা এমনকি বিশ্বস্ত দাউদ খানও শেষমেশ তাদের অন্যায্য সন্দেহপ্রবণ প্রভুকে ত্যাগ করেছে। দারাকে বন্দী করার আশায় সম্রাট-বাহিনী দ্রুত শেহওয়ানে গিয়ে অবস্থান নিল সিন্ধুর উভয় তীরে (৩১ অক্টোবর)। কিন্তু তাদের নৌশক্তি বলতে প্রায় কিছুই ছিল না, ফলে প্রশস্ত নদীটিতে দ্রুত নৌকা বেয়ে (২ নভেম্বর) নিরাপদেই দারা গিয়ে পৌঁছালেন টাট্টাতে (১৩ নভেম্বর)। সম্রাট-বাহিনীও টাট্টাতে গেল গন্ধ এঁকে এঁকে (১৮ নভেম্বর), কিন্তু জানতে পারল যে দারা চলে গেছে বাদিনের অনেক দক্ষিণে (২৪ নভেম্বর), আর কচ্ছ পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গুজরাট অভিমুখে।
এবার অনুসরণকারীদের দরবারে ডেকে পাঠানো হলো। দারা লাহোর ত্যাগ করার পর তিন মাস ধরে অনুসরণ চালিয়ে গেছে তারা অদম্য এক তেজ আর বিস্ময়কর সহিষ্ণুতায়, কিন্তু সাফল্য একেবারে ধরা দেওয়ার মুহূর্তে ব্যর্থ হলো কেবল নৌশক্তির অভাবে।
৫.২ রাজপুতানায় দারা : দেওরাইয়ের যুদ্ধ
টাট্টার ৫৫ মাইল পুবের বাদিন ত্যাগ করে পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে, কচ্ছের রান পেরোলেন দারা (নভেম্বরের শেষাশেষি)। রাজধানী ভুজে তাঁকে স্বাগত জানিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য করল রাজা, কাথিয়াবাড়েও সহায়তার হাত বাড়াল নওয়ানগরের জাম। ৩০০০ সঙ্গীসহ দারা পৌঁছালেন আহমেদাবাদে। প্রদেশটার নতুন শাসক শাহ নওয়াজ খান তার সঙ্গে যোগদান করে খুলে দিলেন রাজকীয় কোষাগার (৯ জানুয়ারি, ১৬৫৯)। বাহিনী ২২,০০০ সেনাতে উন্নীত করার পর দারা জানতে পারলেন, এলাহাবাদ ছেড়ে আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে গেছেন সুজা। তৎক্ষণাৎ ছুটলেন তিনি আগ্রা অভিমুখে। পথিমধ্যে আজমীরে তাঁকে আমন্ত্রণ করে যশোবন্ত সিংহ জানালেন, রাঠোর এবং অন্যান্য রাজপুতদের নিয়ে তিনি যোগ দেবেন তার সঙ্গে।
কিন্তু, ইতিমধ্যে, খাজওয়াতে সুজাকে বিধ্বস্ত করে (৫ জানুয়ারি, মীরজা রাজা জয় সিংহের সহায়তায় আক্রমণের হুমকি আর পদোন্নতির প্রলোভন দেখিয়ে যশোবন্তকে বশে এনে ফেললেন আওরঙ্গজেব। কোনো সহায়তার সম্ভাবনা না থাকলেও যুদ্ধ ছাড়া দারার আর উপায় রইল না, আওরঙ্গজেব তার একেবারে কাছে এসে পড়েছেন। তবে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তিনি বুদ্ধিমানের পরিচয় দিলেন। খোলা মাঠে সামনাসামনি যুদ্ধ না করে দারা সিদ্ধান্ত নিলেন, অবস্থান নেবেন তিনি আজমীরের চার মাইল দক্ষিণের দেওরাই গিরিপথে, যেখানে অপ্রশস্ত তার সুবিধা নিয়ে কম শক্তিধর একটা সেনাদলের পক্ষেও বড় একটা বাহিনীকে ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব। তার দুই পাশ প্রতিরোধ করবে বিথলি আর গোকলা পাহাড়, পেছনেই সম্পদশালী আজমীর শহর, যেখান থেকে তিনি আনতে পারবেন অফুরন্ত সরবরাহ।
আওরঙ্গজেব এগিয়ে এলেন এখানে, আর ১৬৫৯ সালের ১২ মার্চ সূর্যাস্ত থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ করলেন তেরো তারিখ রাত পর্যন্ত। উচ্চ আর সুরক্ষিত অবস্থানের কারণে দারার গোলন্দাজ বাহিনী আর মাস্কেটধারীরা আওরঙ্গজেবের অরক্ষিত গানার আর পদাতিক বাহিনীর অনেককে হতাহত করল। শত্রুদের ট্রেগুলো ছিল ভীষণ দুর্গম, তাই আওরঙ্গজেবের গানাররা সুবিধা করতে পারল না। সুতরাং, পরদিন, ১৪ তারিখে যুদ্ধের পরিকল্পনাসংক্রান্ত একটা বৈঠক ডাকলেন আওরঙ্গজেব। বৈঠকে স্থির হলো, শাহ নওয়াজ খানের নেতৃত্বে যুদ্ধরত শত্রুর বাম পাশে চালানো হবে প্রচণ্ড এক আক্রমণ, ডান পাশের সঙ্গে যথারীতি যুদ্ধ চলবে সম্রাট-বাহিনীর; কিন্তু সম্মুখ এই আক্রমণের ওপর সাফল্য নির্ভর করবে না। আর সেই লক্ষ্যে শক্রর বাম পাশের পেছন, অর্থাৎ গোকলা পাহাড়ের দিক থেকে এক গোপন আক্রমণ চালাবে জম্মু পাহাড়ের রাজা রাজরূপের পর্বতারোহণে দক্ষ গোত্র, যারা আবিষ্কার করেছে চূড়ায় ওঠার একটা পথ।
চৌদ্দ তারিখ বিকেল থেকে সম্রাট-বাহিনীর কামানগুলো বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে লাগল শাহ নওয়াজ খানের ট্রেঞ্চের ওপর। ভয়াবহ যুদ্ধের পর খানিকটা পিছু হটতে বাধ্য হলো দারার বাহিনী।
এদিকে শত্রুরা যখন তাদের সামনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে ব্যস্ত, গোকলা পাহাড়ের দিক থেকে পেছনে গিয়ে উপস্থিত হলো রাজরূপের গোত্র। তাদের রণহুঙ্কার কানে যেতে হতাশা নেমে এল দারার বাহিনীতে, এভাবে পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার কথা তারা কল্পনাও করেনি। সব শেষ হয়ে গেছে জেনেও নিজের সেনাদের সাহস জোগাতে লাগল শাহ নওয়াজ খান, এবং শেষমেশ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল কামানের এক গোলার আঘাতে। ছত্রভঙ্গ হয়ে দারার বাহিনী পালিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।
সত্য যে একটামাত্র ট্রেঞ্চের পতন ঘটেছিল; কিন্তু সেটাই ছিল যথেষ্ট: গোকলা পাহাড়ের পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দারার বাহিনীর প্রতিরোধের আর কোনো ক্ষমতা ছিল না। পুত্র শিপির শুকো আর মাত্র বারোজন অনুসারীসহ দারা নিজে পালালেন গুজরাটের দিকে। আজমীর ঘিরে শুরু হলো বন্য এক লুণ্ঠন; যশোবন্তের আহ্বানে হাজার হাজার রাজপুত এসে উপস্থিত হলো ভাগাড় ঘিরে থাকা শকুনের পালের মতো। পরাজিত বাহিনীর সম্পত্তি আর মালবাহী পশু নিয়ে চালাল তারা এক অবাধ লুটপাট।
৫.৩ দারার পলায়ন এবং গ্রেপ্তার
দেওরাইয়ের যুদ্ধ চলার সময় দারার হেরেম আর ধনসম্পদ হাতি, উট ও খচ্চর বোঝাই করে আজমীরের আনাসাগর দিঘির বাম তীরে রাখা ছিল তাঁর বিশ্বস্ত খোঁজা খাজা মকবুল আর এক সেনার তত্ত্বাবধানে। তারা চৌদ্দ তারিখ রাতে ওখান থেকে পালিয়ে পনেরোর বিকেলে দারার সঙ্গে মিলিত হলো মাইর্তার কাছে। কিন্তু আওরঙ্গজেব ইতিমধ্যেই দারার অনুসরণে পাঠিয়ে দিয়েছেন জয় সিংহ আর বাহাদুর খানের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী একটা সেনাদল, তাই বিশ্রাম আর তার ভাগ্যে জুটল না। মাইর্তা ত্যাগ করলেন দারা ২,০০০ সেনাসহ আর প্রতিদিন গড়ে ত্রিশ মাইল বা তারও বেশি পথ অতিক্রম করে এগিয়ে চললেন গুজরাটের দিকে। গরম আর ধুলোয় এবং তাঁবু আর মালবাহী পশুর অভাবে তাদের অবস্থা হলো শোচনীয়। তাদের ঘোড়া আর উট মারা গেল মাত্রাতিরিক্ত গরম আর পরিশ্রমের চাপে।
কোথাও শান্তি পেলেন না দারা; যেখানেই যেতে চাইলেন, দেখলেন, তার আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য সেখানে পৌঁছে গেছে আওরঙ্গজেবের চিঠি। আহমেদাবাদ থেকেও যখন তার দূত ফিরল একই দুঃখজনক সংবাদ নিয়ে, তিনি একেবারে মুষড়ে পড়লেন। সেই সময় দারার অসুস্থ স্ত্রীর সেবায় নিয়োজিত ডা. বার্নিয়ার দিয়েছেন দুর্দশা আর ভোগান্তির এক হৃদয়বিদারক বর্ণনা, ‘শেষ আশ্রয়ও হারিয়ে যাওয়ার সংবাদে তারা একদম ভেঙে পড়লেন…মহিলাদের বিলাপ পানি আনল সবার চোখে…তাঁদের পোশাক-আশাক তখন শোচনীয়…মহিলাদের বহনের জন্য অবশিষ্ট রয়েছে কেবল একটা ঘোড়া, একটা গরুর গাড়ি আর পাঁচটা উট, এ ছাড়া মালবাহী কয়েকটা উট, আর তার কজন মাত্র অনুচর। এশিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী সিংহাসনের মনোনীত উত্তরাধিকারী আরেকবার ভয়াবহ রান পেরিয়ে পৌঁছালেন সিন্ধুর দক্ষিণ উপকূলে (মের শুরুতে)।
সিন্ধুর নিমাঞ্চলের পথও ইতিমধ্যে বন্ধ করে দিয়েছেন দূরদর্শী আওরঙ্গজেব, লাহোর থেকে খলিলুল্লাহ খান এসেছে ভরে। আওরঙ্গজেবের স্থানীয় অফিসার আর জয় সিংহের দল ওত পেতে আছে উত্তর, পুব আর দক্ষিণ-পুবে। পালাবার রয়েছে আর একটাই মাত্র পথ: উত্তর-পশ্চিমে ঘুরে, সিন্ধু নদ পেরিয়ে, দারা প্রবেশ করলেন শিবিস্তানে, ইচ্ছে কান্দাহার হয়ে যাবেন পারস্যে।
ইতিমধ্যে পানি আর পশুখাদ্যের অভাব সত্ত্বেও আজমীর থেকে দারার পিছু নিয়ে, রান পেরিয়ে এসেছে জয় সিংহ। পথে বারবার হয়েছে সে মারাত্মক অসুবিধার মুখোমুখিঃ ‘কোথাও কোথাও এক সের শস্যের দাম এক টাকা, আবার কোথাও টাকা দিয়েও খাবার পাওয়ার উপায় নেই। একগুঁয়ের মতো তাড়া করে ১১ জুন, ১৬৫৯, এল সে শিবিস্তানের সীমান্তে, কিন্তু দারা মোগল ভারতের বাইরে চলে গেছে শুনে ধরল সে ফিরতি পথ ।
কিন্তু পারস্যে যেতে কিছুতেই রাজি হলো না দারার পরিবার। তা ছাড়া, তার প্রিয়তমা স্ত্রী, নাদিরা বানু এখন খুবই অসুস্থ, বোলান গিরিপথ পার হওয়ার মতো ধকল হয়তো তার শরীর সইতে পারবে না। সুতরাং মত পরিবর্তন করে একজন। গোত্রপ্রধানের খোঁজ করতে লাগলেন দারা, যে তাঁকে দেবে আশ্রয় আর সহায়তা। খোঁজাখুঁজির পর খুশি হলেন তিনি দাদারের জমিদার মালিক জিহনকে পেয়ে। কয়েক বছর আগে আফগান এই গোত্রপ্রধানকে হাতির পায়ের নিচে ফেলে পিষে মারার আদেশ দিয়েছিলেন শাহজাহান। তখন দারা মিনতি করে তার প্রাণ রক্ষা করেছিলেন। জিহন সসম্মানে দারাকে তার বাড়ি নিয়ে গেল (সম্ভবত ৬ জুন)।
দাদার যেতেই পথকষ্ট আর ওষুধের অভাবে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন নাদিরা বানু। জীবনসঙ্গিনীকে হারানোর শোকে হতবাক হয়ে গেলেন দারা। স্ত্রীকে মিয়া মীরের (দারার আধ্যাত্মিক গুরু) মাজার প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করার জন্য তাঁর মৃতদেহ লাহোরে পাঠিয়ে দিলেন দারা, সঙ্গে গেল তাঁর অবশিষ্ট ৭০ সেনা আর সবচেয়ে নিবেদিত অফিসার গুল মুহম্মদ। সর্বশেষ সময়ের অনুসারীদের স্বাধীনতা দিয়ে দারা বললেন, তারা ইচ্ছে করলে পারস্যের পথে তাঁর সাথি হতে পারে কিংবা ফিরে যেতে পারে নিজ নিজ বাড়িতে। সুতরাং দারার সঙ্গে আর কোনো অনুসারীই রইল না, সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন তিনি তাঁর নতুন আশ্রয়দাতার বিশ্বস্ততার ওপর।
কিন্তু টাকার লোভে বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলল আফগান । অকৃতজ্ঞ জিহন কনিষ্ঠ পুত্র আর দুই কন্যাসহ দারাকে গ্রেপ্তার করে (৯ জুন), তুলে দিল বাহাদুর খানের হাতে।
৫.৪ দারার অবমাননা ও মৃত্যু
বন্দীদের দিল্লি আনার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হলো সদর রাস্তা দিয়ে (২৯ আগস্ট)। একটা মাদি হাতির অনাবৃত হাওদায় বসে রইলেন ধূলি-ধূসরিত দারা। পাশে তার দ্বিতীয় পুত্র, চৌদ্দ বছরের শিপির শুকো; তাঁদের পেছনে খোলা তরবারি হাতে হিংস্র কারাপাল, ক্রীতদাস নজর বেগ । সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর পরনে এখন সস্তা পোশাক, আর মাথায় গাঢ় রঙের জীর্ণ পাগড়ি, কোনো নেকলেস বা রত্নের বালাই নেই। তার হাত মুক্ত থাকলেও পা শেকল দিয়ে বাঁধা। যেখানে একদিন কাটিয়েছেন তিনি জাঁকজমক আর গৌরবের জীবন, সেই রাজধানীরই পথ ধরে এই বেশে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে আগস্টের গনগনে সূর্যের নিচ দিয়ে । অবমাননার বেদনায় মাথা পর্যন্ত তুললেন না দারা বা তাকালেন না এদিক-সেদিক, বরং চুপচাপ বসে রইলেন ‘ভাঙা একটা ডালের মতো।
নাগরিকেরাও যেন বেদনায় নুয়ে পড়ল। অসংখ্য মানুষ জড় হলো পথের দুই পাশে। বার্নিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন যে সর্বত্রই তারা কাঁদছিল আর বিলাপ করেছিল দারার নিয়তির কথা ভেবে।
সেই সন্ধেতেই দারার নিয়তিবিষয়ক একটা সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রীদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে বসলেন আওরঙ্গজেব। দানিশমন্দ খান (ডা. বার্নিয়ারের নিয়োগকর্তা) তাঁর জীবন ভিক্ষা চাইলেন, কিন্তু শায়েস্তা খান, মুহম্মদ আমিন খান, বাহাদুর খান এবং হেরেম থেকে শাহজাদি রওশনারা ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের খাতিরে দারার মৃত্যুদণ্ড দাবি করলেন। সম্রাটের বেতনভোগী নীতিনির্ধারকেরা এই মর্মে একটা হুকুমনামায় স্বাক্ষর দিলেন যে ইসলাম থেকে ভ্রষ্ট হওয়ার দায়ে দারার মৃত্যুদণ্ডই কাম্য।
৩০ তারিখে আদালতে যাওয়ার সময় বিশ্বাসঘাতক মালিক জিহনের বিপক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল দিল্লির নাগরিকেরা। ওই রাতেই আরও কয়েকজন ক্রীতদাসসহ নজর বেগ গেল দারার খাবাসপুরার কারাগারে, তারপর পিতার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ শিপির শুকোকে ছিনিয়ে নিয়ে দারাকে কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল। আওরঙ্গজেবের আদেশে লাশটা হাতির পিঠে করে ঘোরানো হলো দিল্লির সদর রাস্তা ধরে, আর তারপর সেটাকে সমাহিত করা হলো হুমায়ুনের সমাধির গম্বুজের নিচের একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষে।
৫.৫ সুলাইমান শুকোর মৃত্যু
এবার আমরা আলোচনা করব দারার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলাইমান শুকোর নিয়তি সম্বন্ধে। বেনারসের কাছে সুজার সঙ্গে জয়ী হওয়ার পর পরাজিত চাচার পিছু নিয়ে বিহার হয়ে মুঙ্গেরে পৌঁছাতে ১৬৫৮ সালের মে মাসের প্রথম দিকে পিতার তরফ থেকে সুলাইমান একটা বার্তা পেলেন যে আওরঙ্গজেব ধর্মাতে জয়ী হওয়ার ফলে এই মুহূর্তে তাঁকে ফিরে যেতে হবে। সুতরাং তড়িঘড়ি সুজার সঙ্গে একটা শান্তি স্থাপন করে ফিরতে লাগলেন সুলাইমান । ২ জুন, এলাহাবাদের ১০৫ মাইল পশ্চিমে আসতে তিনি সংবাদ পেলেন যে শামুগড়ে তার পিতা আবার পরাজিত হয়েছেন। তাঁর সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে তার সবচেয়ে বড় দুই সেনাপতি জয় সিংহ আর দিলির খান এবং অন্য সব রাজকীয় অফিসারেরা তাকে ত্যাগ করে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এলাহাবাদে সুলাইমানের সঙ্গে এসেছিল মাত্র ৬,০০০ সেনা, তাঁর মূল বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশেরও কম, আর সেখানে তিনি কাটিয়ে দিলেন অতি মূল্যবান একটা সপ্তাহ কেবল এই চিন্তায় যে তার কিম্ভূত আর ব্যয়বহুল আসবাব, থালাবাসন আর বিশাল হেরেম নিয়ে এখন তিনি কী করবেন। অবশেষে তাঁর প্রধান অনুসারী, বরহার সাইদদের পরামর্শে সুলাইমান সিদ্ধান্ত নিলেন, দিল্লির চারপাশে বিশাল এক বৃত্তাকারে ঘুরে, তাদের মধ্য দোয়াবের বাড়ি হয়ে, পাহাড়ের পাদদেশের নদী অতিক্রম করে, যাবেন তিনি পিতার কাছে পাঞ্জাবে, যেন পথিমধ্যে তাঁর বন্দী হওয়ার কোনো রকম ভয় না থাকে।
নাগিনা আর চান্দি হয়ে, সুলাইমান দ্রুত পৌঁছালেন হরিদ্বারের উল্টো পাশের গঙ্গার তীরে। প্রতিদিন হ্রাস পেল তার সেনাসংখ্যা, পক্ষান্তরে দিল্লির শক্তিশালী সেনাবাহিনী ক্রমেই তার পথ বন্ধ করতে লাগল দক্ষিণ, পুব আর পশ্চিমে। সুতরাং আশ্রয়ের সন্ধানে সুলাইমান পালালেন শ্রীনগর পাহাড়শ্রেণীর দিকে, বরহার সাঈদ অনুসারীরা তার সঙ্গে সেখানে যেতে অস্বীকার করল । শ্রীনগরের রাজা পৃথ্বী সিং তাঁকে এই শর্তে আশ্রয় দিলেন যে তিনি সঙ্গে কেবল পরিবার আর সতেরোজন ভৃত্য রাখতে পারবেন, কোনো সেনা নয়। রাজা তার দুর্দশাগ্রস্ত মানী অতিথির বেশ সমাদর করলেন, ফলে এক বছর সুলাইমান সেখানে যথেষ্ট শান্তিতেই কাটালেন ।
কিন্তু সব ভাইকে পরাজিত করার পর আওরঙ্গজেব এবার মনোযোগ দিলেন সুলাইমানের দিকে। ১৬৫৯ সালের ২৭ জুলাই তিনি রাজা রাজারূপকে পাঠালেন শ্রীনগরের রাজার মাধ্যমে সুলাইমানকে আত্মসমর্পণ করানোর জন্য, কিন্তু দেড় বছর তাঁর এই প্রচেষ্টা সফল হলো না। তারপর আওরঙ্গজেব এই কাজের ভার দিলেন জয় সিংহের ওপর, যে পৃথ্বী সিংকে চিঠি লিখে হুমকি দিল, সম্রাটের আদেশ অমান্য করে তিনি যেন নিজের রাজ্যের ধ্বংস ডেকে না আনেন। কিন্তু বৃদ্ধ রাজা অতিথিকে শত্রুর হাতে তুলে দেওয়ার মতো পাপ এবং লজ্জাজনক কাজ করতে সম্মত হলেন না। তবে তার পুত্র আর উত্তরাধিকারী মেদিনী সিং ছিল অনেক বৈষয়িক ধ্যান-ধারণার মানুষ; সে দিল্লির পুরস্কারের লোভ সংবরণ করতে পারল না। পাশাপাশি তার রাজ্য হারানোরও ভয় ছিল। প্রতিবেশী অন্যান্য পাহাড়ি রাজাকে শ্রীনগর আক্রমণে প্ররোচিত করছিলেন আওরঙ্গজেব। মেদিনী সিংয়ের মনোভাব জানতে পেরে লাদাখের দিকে পালাবার চেষ্টা করলেন সুলাইমান, কিন্তু পিছু নিয়ে, আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে তাকে তুলে দেওয়া হলো আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধির হাতে। ১৬৬১ সালের ২ জানুয়ারি সুলাইমানকে আনা হলো দিল্লিতে।
৫ জানুয়ারি বন্দীর সাক্ষাৎ হলো তার ভয়ংকর চাচার সঙ্গে। সুলাইমানের তারুণ্য, অপূর্ব সুন্দর চেহারা, সামরিক খ্যাতি, আর বর্তমান দুর্দশা সভাসদদের পাশাপাশি সম্রাটের হেরেমের মহিলাদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করল । দয়ালু স্বরে আওরঙ্গজেব তার ভাতিজাকে অভয় দিয়ে বললেন, শান্ত হও; তোমার কোনো ক্ষতি করবে না কেউ। সালাম জানালেন শাহজাদা…তারপর সম্রাটকে প্রশান্তভাবে বললেন যে তাঁকে যদি পুস্তা’ পান করানোর কথা ভাবা হয়ে থাকে, তাহলে যেন এই মুহূর্তে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আওরঙ্গজেব জোর গলায় কথা দিলেন যে এই পানীয় তাঁকে অবশ্যই পান করানো হবে না।
উল্লেখ্য, পুস্তা পানীয় তৈরি করা হতো আফিমদানার খোসা পিষে এক রাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে। এই পানীয় পান করানো হতো গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী সেই সব শাহজাদাকে, যাদের গর্দান সম্রাট নিতেন না লোকলজ্জার ভয়ে। বড় এক পেয়ালা পানীয় তাদের সামনে রাখা হতো সকালে আর তা পান না করা পর্যন্ত কোনো খাবার দেওয়া হতো না। এই পানীয় পান করে রোগা হয়ে যেতেন বন্দীগণ, ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলতেন তাদের শক্তি আর মেধা, শরীরজুড়ে নেমে আসত বোধশক্তিহীন আর অসাড় একটা অবস্থা, অবশেষে মৃত্যু।
বন্দীকে পাঠানো হলো গোয়ালিয়রে, আর রাষ্ট্ৰীয় সেই নির্জন কারাগারেই সুলাইমান শুকোর মৃত্যু নিশ্চিত করা হলো (মে, ১৬৬২) মাত্রাতিরিক্ত আফিম খাইয়ে।
৫.৬ বাহাদুরপুরের যুদ্ধ
শাহজাদা মুহম্মদ সুজা, শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র এবং বাংলার সুবাদার, ছিলেন। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অভিজাত, রুচিবান আর অমায়িক একজন মানুষ। কিন্তু আমোদ-প্রমোদের প্রতি বিরামহীন টান, আর বাংলার মতো সহজ প্রশাসনের দেশে ১৭ বছর বসবাস তাকে দুর্বল মানুষে রূপান্তরিত করেছিল। তিনি হয়ে পড়েছিলেন পরিশ্রমবিমুখ, অমনোযোগী আর অসতর্ক। তিনি তাঁর প্রশাসনকে হতে দিয়েছিলেন অলস, সেনাবাহিনীকে অযোগ্য, তাঁর প্রতিটি বিভাগ যেন ভেসে গিয়েছিল একটা নিদ্রাজনিত অবসন্নতায়। তার মানসিক শক্তি আগের মতোই ছিল, কিন্তু নেহাত প্রয়োজন ছাড়া তা প্রকাশ পেত না; পরিশ্রমী কাজ করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল, তবে নিতান্তই মাঝেসাঝে।
শাহজাহানের অসুস্থতার অতিরঞ্জিত গল্প বাংলার তদানীন্তন রাজধানী রাজমহলে সুজার কানেও পৌঁছাল, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তিনি সম্রাট ঘোষণা করলেন আবুল ফউজ নাসির-উদ-দীন মুহম্মদ, তৃতীয় তৈমুর, দ্বিতীয় আলেকজান্ডার, শাহ সুজা গাজি উপাধি নিয়ে।
বিশাল এক সেনাবাহিনী, চমৎকার এক গোলন্দাজ বাহিনী, আর বাংলার অত্যন্ত কার্যকরী যুদ্ধ-নৌকা (নওয়ারা) নিয়ে বেনারস পৌঁছালেন তিনি ১৬৫৮ সালের ২৪ জানুয়ারির দিকে। ইতিমধ্যে দারা ২২০০০ সেনার একটা বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলাইমান শুকোর নেতৃত্বে, যাকে সহায়তা দান করবে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ মীরজা রাজা জয় সিংহ আর দিলির খান রুহেলা।
১৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে সুলাইমান অতর্কিত আক্রমণ চালালেন বেনারসের ৫ মাইল উত্তর-পুবের বাহাদুরপুরের সুজার তাঁবুতে। যুদ্ধ তো দূরের কথা যুদ্ধসাজ পরারও সময় পেল না বাংলার সেনারা, পালাল তারা সব ফেলে। অতি কষ্টে সুজা একটা হাতিতে চেপে, শত্রু-বেষ্টনীর ভেতর থেকে বেরিয়ে, উঠে পড়লেন যুদ্ধ নৌকায়, যেগুলোর গোলাবর্ষণে শত্রু নদীতীরে যেতে পারল না। তার পঞ্চাশ লাখ টাকা সমমূল্যের তাঁবু ও অন্যান্য সমস্ত সম্পত্তি লুট করল বিজয়ীরা।
আতঙ্কিত বাংলার সেনারা স্থলপথে সাসারাম হয়ে পালাল পাটনার দিকে, আর পদে পদে লুষ্ঠিত হলো গ্রামবাসীদের হাতে। কিন্তু স্লাট-বাহিনী পিছু পিছু তেড়ে আসছে শুনে, সুজা পালালেন মুঙ্গেরে, আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন পরিখা আর গোলন্দাজ বাহিনী দিয়ে । ফলে সুলাইমানকে থামতে হলো মুঙ্গেরের। ১৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমের সুরজগড়ে। মূল্যবান মাস পেরিয়ে গেল, তিনি আর এগোতে পারলেন না। কিন্তু ধর্মাত যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে তড়িঘড়ি একটা শান্তি স্থাপন করলেন তিনি সুজার সঙ্গে বাংলা, পূর্ব বিহার আর উড়িষ্যা শাহজাদাকে ছেড়ে দিয়ে (৭ মে) ধরলেন আগ্রার ফিরতি পথ ।
আওরঙ্গজেব দিল্লির সিংহাসনে বসার (২১ জুলাই) পর, বন্ধুভাবাপন্ন একটা চিঠি লিখে পুরো বিহারই সুজার সুবাদারিতে ছেড়ে দিলেন এবং তাকে আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন।
কিন্তু দারাকে অনুসরণ করে আওরঙ্গজেবের সুদূর পাঞ্জাবে যাওয়ার সংবাদে সুজার উচ্চাভিলাষী মন জেগে উঠল। আওরঙ্গজেবের অনুপস্থিতিতে অরক্ষিত আগ্রা দখল করে শাহজাহানকে মুক্ত করার এই তো সুযোগ! সুতরাং ১৬৫৮ সালের অক্টোবরের শেষে ২৫০০০ অশ্বারোহী, গোলন্দাজ বাহিনী আর নৌকাসহ পাটনা থেকে অগ্রসর হয়ে ৩০ ডিসেম্বর সুজা পৌঁছালেন এলাহাবাদের ওপারের খাজওয়াতে। কিন্তু মুহম্মদ সুলতান তার পথ রোধ করে আছেন। ইতিমধ্যে দারার অনুসরণ ত্যাগ করে (৩০ সেপ্টেম্বর), মুলতান থেকে আওরঙ্গজেব দ্রুত ফিরে এলেন দিল্লি (২০ নভেম্বর), এবং এলাহাবাদের কাছে অবস্থানরত তার বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করলেন মানুষ আর টাকা দিয়ে। আগ্রা যাওয়ার খোলা পথ সুজার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। ১৬৫৯ সালের ২ জানুয়ারি সম্রাট স্বয়ং গিয়ে তাঁর পুত্রের সঙ্গে যোগ দিলেন সুজার অবস্থানের আট মাইল পশ্চিমের কোরাতে। একই দিনে দাক্ষিণাত্য থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন মীর জুমলা।
৫.৭ খাজওয়া : যশোবন্তের বিশ্বাসঘাতকতা
৪ জানুয়ারি আওরঙ্গজেব তাঁর বাহিনীকে সুসংগঠিতভাবে নিয়ে গেলেন শক্রশিবিরের এক মাইল সামনে। নিখুঁত অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র অবস্থাতেই সেনারা ঘুমাল মাটিতে শুয়ে, মাথার কাছে প্রস্তুত রইল জিন-পরানো ঘোড়া। সেই রাতেই জন্মগত একজন সেনাপতির মতো দুই বাহিনীর মাঝখানের একটা ঢিবি দখল করে সেটার মাথায় ৪০টা কামান স্থাপন করলেন মীর জুমলা। সারা রাত সেখানে রইল সতর্ক প্রহরা।
৫ জানুয়ারি, যুদ্ধের নির্ধারিত দিনে ভোর হওয়ার আগেই একটা হইচই শুরু হলো আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সর্বাগ্রভাগে; দেখতে দেখতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে গেল শিবিরজুড়ে। আক্রমণকারীদের চিৎকার, পলাতকদের হইচই, আর ঘোড়ার খুরের শব্দে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। অন্ধকার বিশৃঙ্খলা বাড়িয়ে দিল। আর, এ সবকিছুর মূলেই ছিলেন মহারাজা যশোবন্ত সিংহ, সম্রাট-বাহিনীর ডান পাশের সেনাপতি। কথিত আছে, একটা প্রতিশোেধ চরিতার্থ করার গোপন ইচ্ছেয় যশোবন্ত নাকি সুজাকে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন যে তিনি সম্রাট শিবিরে অতর্কিত আক্রমণ চালাবেন রাতের আঁধারে, আর তাকে সামলাতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়বেন সম্রাট, সুজা প্রতিদ্বন্দ্বী দুই বাহিনীর মাঝখানে ঢুকে পড়ে বিশৃঙ্খল সেনাদের ধ্বংস করে দেবেন। সুতরাং মাঝরাতের পরপরই ১৪০০০ রাজপুত নিয়ে শাহজাদা মুহম্মদ সুলতানের শিবিরে হামলে পড়লেন যশোবন্ত, হাতের কাছে যা পেল, লুট করল রাজপুতেরা। সম্রাটের শিবিরের অনেকটা অংশও আক্রান্ত হলো একইভাবে । রাজপুতেরা চলে গেল আগ্রার দিকে, কিন্তু আঁধারে কিছুই পরিষ্কার বুঝতে না পারায় হইচইটা ছড়িয়ে পড়ল বাহিনীর সর্বাগ্রভাগে।
কিন্তু ভীষণ আশঙ্কাজনক এই পরিস্থিতি রক্ষা পেল আওরঙ্গজেবের অতুলনীয় স্থিরতা আর সুজার দ্বিধায়। পূর্ব পরিকল্পনামাফিক হুলস্থলের শব্দ ঠিকই পেলেন সুজা, কিন্তু রাতের বেলা শিবির থেকে বের হলেন না এই সন্দেহে যে এটা তাঁকে ধ্বংস করার জন্য আওরঙ্গজেব আর যশোবন্তের একটা মিলিত চক্রান্তও হতে পারে!
যশোবন্তের আক্রমণের সংবাদ যখন সম্রাটের কানে পৌঁছাল, তখন নিজের তাঁবুতে তিনি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছিলেন। কোনো শব্দ উচ্চারণ না করে, স্রেফ হাত নেড়ে তিনি যেন বললেন, যদি সে আমার পক্ষ ত্যাগ করে চলে যায়, তাকে যেতে দাও!’ একদম শান্তভাবে নামাজ শেষ করে একটা তখত-ই-রওয়ানে (বহনসাধ্য চেয়ার) বসে, সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন এই ঘটনা আল্লাহর পরম মেহেরবানি । সে যদি যুদ্ধ চলার সময় বিশ্বাসঘাতকতা করত, হয়তো আমরা পরাজিত হতাম। সে পালিয়ে যাওয়ায় আমাদের উপকারই হয়েছে।
এভাবে আপন অবস্থান বজায় রেখে আওরঙ্গজেব বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে দিলেন না। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া সেনারা আবার সমবেত হলো। সুজার ২৩,০০০ সেনার বিপক্ষে সম্রাটের সেনাসংখ্যা ৫০,০০০ এরও বেশি।
৫.৮ খাজওয়ার যুদ্ধ
সুজা বুঝতে পারলেন যে প্রথাগত পদ্ধতিতে এই যুদ্ধ জেতা যাবে না, যেহেতু সম্রাটের বাহিনীর তুলনায় তার সেনাসংখ্যা কিছুই নয় । দারুণ এক বিচক্ষণতায় তার সব সেনাকে লম্বা একটামাত্র লাইনে দাঁড় করালেন সুজা, গোলন্দাজ বাহিনীর পেছনে।
সকাল আটটায় যুদ্ধ শুরু হলো কামানের তুমুল গোলা আর মাস্কেটের গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে। সুজার ডান পাশের নেতৃত্বে থাকা সাঈদ আলম আক্রমণ করল সম্রাট-বাহিনীর বাম পাশকে, তার সামনে তিনটে হাতি ছুটল গুঁড়ে দুই মণ। ওজনের একটা করে লোহার শেকল দোলাতে দোলাতে । ভয়াবহ ভঙ্গিতে তেড়ে আসা ওই তিন হাতির সামনে মানুষ তো দূরের কথা পশুরও টেকা দায়। সম্রাট বাহিনীর বাম পাশের নেতৃত্বে বড় কোনো সেনাপতি বা শাহজাদা না থাকায় তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাতে শুরু করল। এই আতঙ্ক এমনকি ছড়িয়ে পড়ল কেন্দ্রভাগেও; সেনারা এদিক-সেদিক দৌড়াতে লাগল কিছুই না বুঝে। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি হলো আরও খারাপ যখন গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে সম্রাট নিহত হয়েছেন। অনেক সেনা পালিয়ে গেল। বাম পাশকে ছত্রভঙ্গ করে, শত্রুরা এবার এগোতে লাগল কেন্দ্রের দিকে, যেখানে সম্রাটের পাহারায় রয়েছে এখন মাত্র ২০০০ সেনা । কিন্তু তার সংরক্ষিত দুই সেনাদল শত্রুর পথরোধ করে দাঁড়াল। বাম পাশকে সহায়তা দেওয়ার জন্য কেন্দ্রভাগের সেনাসহ সম্রাট ঘুরিয়ে নিলেন তাঁর হাতি। প্রতিহত হয়ে যে পথে এগিয়েছিল সেই পথেই পালিয়ে এল সাঈদ আলম।
কিন্তু তিনটে তিরই বুনো গতি রইল অব্যাহত, বরং আহত হয়ে সেগুলো আরও হিংস্র মূর্তি ধারণ করল। হঠাৎ একটা হাতি সরাসরি তেড়ে এল আওরঙ্গজেবের হাতির দিকে। যুদ্ধের জটিল এক মুহূর্ত। এখন সম্রাট যদি পিছু হটেন কিংবা ঘুরে দাঁড়ান, সঙ্গে সঙ্গে তার বাহিনী পালাতে শুরু করবে । আওরঙ্গজেব অটল রইলেন পাহাড়ের মতো, পাশাপাশি তাঁর হাতি যেন পালাতে না পারে, তাই শেকল দিয়ে বাঁধলেন জানোয়ারটার দুই পা। সম্রাটের আদেশে তার গাদাবন্দুকধারীদের একজন, জালাল খান, গুলি করে মারল আক্রমণোদ্যত হাতিটার মাহুতকে, আর তার বাহিনীর সাহসী এক মাহুত হাতিটার পিঠে চেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনল। দম ফেলার ফুরসত পেলেন আওরঙ্গজেব। এবার ঘুরলেন তিনি ডান পাশকে সহায়তা দিতে, যেখানে শত্রু ঘোর যুদ্ধ চালাচ্ছে তাদের বাম পাশ আর সর্বাগ্রভাগের নেতৃত্বে থাকা শাহজাদা বুলন্দ আখতারের কুশলতায়। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আওরঙ্গজেব দেখতে পেলেন, ডান পাশের তিনটে জায়গায় সেনারা পালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভয়ংকর এই বিপদের মুখেও সম্রাটের স্থিরতা আর উপস্থিত বুদ্ধি তাকে ছেড়ে গেল না। তার মাথায় চিন্তা দোলা দিল যে তার নিজ সম্মুখভাগের সেনারা যেহেতু এখন বাম পাশে ঘুরছে, এ অবস্থায় তিনি নিজে ডান পাশে ঘুরলে সেটাকে সেপাইরা পালিয়ে যাওয়ার চিহ্ন হিসেবে ধরে নিতে পারে। সুতরাং তৎক্ষণাৎ আর্দালি পাঠিয়ে সেনাপতিদের তাঁর আসল উদ্দেশ্য জানিয়ে দিলেন সম্রাট, আর সেই সঙ্গে বললেন যে তারা যেন সম্পূর্ণ নির্ভয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
তারপর সম্রাট ঘুরলেন ডান পাশের সহায়তায়। এটাই ছিল যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্ত। সম্রাটের ডান পাশের বাহিনী নতুন বলে বলীয়ান হয়ে শুরু করল তুমুল যুদ্ধ, পিছু হটতে বাধ্য হলো শত্রুপক্ষ।
ইতিমধ্যে জুলফিকার খান আর মুহম্মদ সুলতানের অধীন সম্রাট-বাহিনীর সর্বাগ্রভাগও বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রুর সম্মুখভাগের ওপর। প্রচণ্ড সেই গোলা আর গুলিবর্ষণের মুখে কোনো মানুষের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব নয়। সম্রাটের বাহিনী এবার ধেয়ে আসতে লাগল ডান, কেন্দ্র, বাম-সব দিক থেকে। কালো মেঘরাশির মতো তারা ছেয়ে ফেলল সুজার নিজ বাহিনী (কেন্দ্র), তার দুপাশের বাহিনী ইতিমধ্যেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। স স করে তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কামানের গোলায় নিহত হলো শাহজাদার অনেক ব্যক্তিগত পরিচারক। সুতরাং হাতির পিঠের বিপজ্জনক স্থান ত্যাগ করে সুজা এবার চাপলেন ঘোড়ায়।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, কারণ, সেনারা ভাবল যে তাদের প্রভু নিহত হয়েছেন। বাংলার অবশিষ্ট সেনারাও পালিয়ে গেল। পুত্র, সেনাপতি সাঈদ আলম আর ঘোঁট একটা সেনাদলসহ পালালেন সুজা। তার পুরো তাঁবু আর মালপত্র লুট করল সম্রাট-বাহিনী। যুদ্ধজয়ের পুরস্কারস্বরূপ বিজয়ীরা পেল ১১৪টা কামান আর বাংলার বিখ্যাত ১১টা হাতি।
উল্লেখ্য, বার্নিয়ারের এই বিবৃতি যে জয়লাভের পূর্ব মুহূর্তে হাতি থেকে নামার ফলেই সুজা পরাজিত হয়েছিলেন, একটা বাজারে গুজব ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে ইতিমধ্যেই যুদ্ধটার ভাগ্যে নেমে এসেছিল পরাজয়, সুজা ঘোড়ার পিঠে না উঠলে তাঁর ছিল বন্দী হওয়ার ঝুঁকি।
৫.৯ সুজার অনুসরণ এবং বিহারের যুদ্ধ
খাজওয়াতে জয়লাভের দিন বিকেলেই সুজার অনুসরণে আওরঙ্গজেব একটা সেনাবাহিনী পাঠালেন মুহম্মদ সুলতানের অধীনে। মীর জুমলার তত্ত্বাবধানে শিগগিরই সেই বাহিনী উন্নীত হলো ৩০,০০০ সেনাতে। বেনারস আর পাটনা হয়ে পালিয়ে মুঙ্গেরে এসে সুজা অবস্থান করলেন এক পক্ষ (১৯ ফেব্রুয়ারি-৬ মার্চ)। গঙ্গা নদী আর খড়গপুর পাহাড়শ্রেণীর মধ্যে মাত্র আড়াই মাইল প্রশস্ত একটা সমভূমির ওপর মুঙ্গের শহর অবস্থিত। এই সমভূমি বরাবরই রয়েছে বাংলা যাওয়ার সবচেয়ে সুবিধাজনক পথ। সেই পথে নদী থেকে পাহাড় পর্যন্ত নালা কেটে, ত্রিশ গজ অন্তর অন্তর বুরুজ নির্মাণ করে এবং বড় কামান আর সেনা। মোতায়েন করে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন সুজা।
মার্চের শুরুতেই মীর জুমলা এসে পৌঁছালেন মুঙ্গেরের সামনে, কিন্তু প্রধান সড়কে প্রতিবন্ধকতা দেখে তিনি ঘুষ দিলেন রাজা বিরোজকে আর তার নির্দেশিত পথে সম্রাট-বাহিনীকে নিয়ে অগ্রসর হলেন মুঙ্গের দুর্গের দক্ষিণ-পুবের পাহাড় আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। ফলে মুঙ্গের থেকে সুজা পালালেন সাহেবগঞ্জে। এবার বীরভূম আর চাটনগরের জমিদার খাজা কামাল আফগানকে হাত করে তার সাহায্য আর পথনির্দেশ নিয়ে ২৮ মার্চ মীর জুমলা এসে পৌঁছালেন মুঙ্গের জেলার দক্ষিণ-পুবের সুরিতে।
কিন্তু একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে দারা আজমীরে জয়লাভ করে রাজপুতদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছেন, আর তাই মীর জুমলার অধীন (বিশেষ করে জয় সিংহের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম সিংহের অধীন) রাজপুতেরা বাহিনী ত্যাগ করে ফিরে গেল বাড়িতে। এতে অনুসরণকারী দলে সেনাসংখ্যা কমে গেল ৪,০০০, কিন্তু তার পরও তা রইল সুজার বাহিনীর দ্বিগুণ শক্তিশালী।
ইতিমধ্যে সাহেবগঞ্জ থেকে সুজা পালিয়ে গেছেন রাজমহলে (২৭ মার্চ); আর সেখানেও নিরাপত্তার অভাব দেখে রাজমহল থেকে আবার মালদা জেলায় (৪ এপ্রিল)। সুজার প্রধান সভাসদ আলাবর্দি খানের আরও সব কর্মচারীসহ মীর জুমলার সঙ্গে যোগ দেওয়ার চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তার গর্দান নেওয়া হয়েছে (২ এপ্রিল)। সম্রাট-বাহিনী রাজমহল দখল করল ১৩ এপ্রিল, ফলে গঙ্গার পশ্চিমের পুরো অঞ্চল সুজার হাত থেকে বেরিয়ে গেল।
তারপর দুই বাহিনীর মধ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হলো তাকে বলা যেতে পারে বাঘ আর কুমিরের লড়াই। সুজার নিয়মিত বাহিনীর সেনা কমতে কমতে এখন। এসে ঠেকেছে পাঁচ হাজারে, মীর জুমলার বাহিনীর এক-পঞ্চমাংশে। সুতরাং স্থলপথে সুজা অসহায়। কিন্তু মীর জুমলার বাহিনী হলো খাঁটি স্থলবাহিনী। তার নৌবাহিনী বলতে কিছু নেই, কামানও সংখ্যায় কম আর ছোট ছোট। পক্ষান্তরে, সুজার রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী নৌবাহিনী, আর বড় বড় কামান যেগুলো দক্ষতার সঙ্গে চালায় ইয়োরোপীয় আর দো-আঁশলা গানার। জলপথে সেনা পরিবহন আর নদীতীরের সম্রাট-বাহিনীর ওপর যখন খুশি গোলাবর্ষণ করতে পারেন সুজা । ফলে অনেক ছোট বাহিনী সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন সমানে সমানে।
গৌড় দুর্গের চার মাইল পশ্চিমের তান্দা হলো সুজার সদর দপ্তর, আর মীর জুমলার নদী অতিক্রমে বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যে অনেক ট্রেঞ্চ খুঁড়লেন তিনি গঙ্গার পুব তীর বরাবর । কিন্তু তার এই সুবিধা বেশি দিন রইল না। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নৌকা জোগাড় করে ফেললেন মীর জুমলা, আর যুদ্ধবিদ্যায় প্রখর বিদ্বান আওরঙ্গজেব আরেকটা সেনাবাহিনী পাঠালেন পাটনার রাজ্যপালের অধীনে।
রাজমহলের ১৩ মাইল দক্ষিণের নিজ সদর দপ্তর দোগাছি থেকে দুটো সার্থক আঘাত হানলেন মীর জুমলা। চকিত আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নিলেন তিনি দোগাছির অপর পাশের একটা দ্বীপ, বারবার চেষ্টা করেও সুজা আর সেটা ফিরে পেলেন না। পরে ধ্বংস করে দিলেন তিনি সুতির দিকে মুখ করে পুব তীরে বসানো শত্রুর আটটা কামান।
পুরো পশ্চিম তীরে সম্রাট-বাহিনীকে ছড়িয়ে রাখা হলো। সর্ব উত্তরের রাজমহলে অবস্থানরত বাহিনীর নেতৃত্বে রইল মুহম্মদ মুরাদ বেগ; অধিকাংশ সেনা নিয়ে জুলফিকার খান আর ইসলাম খানসহ ১৩ মাইল দক্ষিণের দোগাছিতে রইলেন শাহজাদা; আরও প্রায় আট মাইল দক্ষিণের দুনাপুরে রইলেন আলী কুলি খান; আর ছয়-সাত হাজার সেনাসহ স্বয়ং মীর জুমলা রইলেন মোগল বাহিনীর সর্ব দক্ষিণের সুতির নেতৃত্বে।
তৃতীয় আরেকটা অতর্কিত আক্রমণ চালাতে গিয়ে দারুণ ক্ষতির শিকার হলেন মীর জুমলা। কারণ এবার সুজা প্রস্তুত ছিলেন। ব্যর্থ এই আক্রমণে সম্রাট বাহিনী হারাল চারজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কয়েক শত সেনা, সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষ ৫০০ জনকে নিয়ে গেল বন্দী করে। পশ্চিম তীর থেকে কোনো রকম সহায়তা পাঠাতে পারলেন না মীর জুমলা। তাঁর হাতে তখন নৌকা থাকলেও তা বাংলার নৌবহরের মুখোমুখি হওয়ার সমকক্ষ ছিল না।
৮ জুন গভীর রাতে দোগাছি থেকে পালিয়ে সুজার কাছে চলে গেলেন শাহজাদা মুহম্মদ সুলতান। অনেক দিন থেকেই মীর জুমলার অধীনতা তার আর ভালো লাগছিল না, তাই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার একটা ইচ্ছে পোষণ করছিলেন মনে মনে! গোপনে মুহম্মদের সঙ্গে নিজ কন্যা গুলরুখ বানুর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সুজা, এটাও বলেছিলেন যে সিংহাসন দখলে তাকে তিনি সহায়তা করবেন, আর এভাবেই সুজা হাতে এনেছিলেন নির্বোধ শাহজাদাকে। এই সংবাদ পেয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করলেন মীর জুমলা। সব সেনাপতিই তাঁকে প্রধান হিসেবে মেনে নিতে রাজি হলো।
শিগগিরই বাংলার মুষলধারে বৃষ্টি সমস্ত সামরিক অভিযান অচল করে ফেলল । প্রায় ১৫,০০০ সেনাসহ মীর জুমলা অবস্থান নিলেন মাসুমা-বাজারে, বাদবাকি সম্রাট-বাহিনী রাজমহলে রইল জুলফিকার খানের অধীনে, আর দুটো দল বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল ৬০ মাইল কর্দমাক্ত পথের এক অতি দুর্গম ব্যবধানে।
অবিরাম বৃষ্টিতে রাজমহল আর তার আশপাশের অঞ্চল যেন পরিণত হলো প্রকাণ্ড এক জলাভূমিতে। মালওয়া থেকে আসা শহরের খাদ্য সরবরাহ সুজা বন্ধ করে দিলেন রাজাকে ঘুষ খাইয়ে; ওদিকে সমস্ত নদীপথে টহল দিতে লাগল বাংলার নৌবাহিনী; খাবারের অভাব মোগল বাহিনীকে অস্থির করে তুলল এবং এই পরিস্থিতিতে, ২২ আগস্ট নৌবাহিনীর এক ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে যাবতীয় মোগল সম্পত্তিসহ শহরটা দখল করে নিলেন সুজা ।
৫.১০ বাংলার যুদ্ধ
১৬৫৯ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে ৮,০০০ সেনাসহ রাজমহল থেকে সুজা অগ্রসর হলেন মুর্শিদাবাদ জেলার উল্টো পাশের জঙ্গিপুরের ৪২ মাইল দক্ষিণে বেলেঘাটার কাছে অবস্থান নেওয়া মীর জুমলার বিপক্ষে। এখানে দুইবার আক্রমণ চালিয়ে সুজা সম্ৰাট-বাহিনীর এতই ক্ষতিসাধন করলেন যে পিছু হটে মুর্শিদাবাদে আসতে বাধ্য হলেন মীর জুমলা। তাঁর সমান্তরালে এগিয়ে সুজাও উপস্থিত হলেন নশিপুরে। ইতিমধ্যে বিহারের রাজ্যপাল দাউদ খান দ্বিতীয় একটা সেনাবাহিনী নিয়ে কুশি নদী পেরিয়ে সোজা অগ্রসর হলো তান্দা অভিমুখে। এই সংবাদ শুনে নশিপুর ত্যাগ করে (২৬ ডিসেম্বর), সুতি হয়ে সুজা ছুটলেন তান্দার দিকে। তৎক্ষণাৎ তার পিছু নিলেন মীর জুমলা, রাজমহলের কাছে গঙ্গা পার হলেন সুজা, আর সম্রাট-বাহিনী শহরটা পুনর্দখল করল ১৬৬০ সালের ১১ জানুয়ারি। গঙ্গার পুরো পশ্চিমাঞ্চল সুজার হাতছাড়া হয়ে গেল চিরদিনের মতো।
এই বছর মীর জুমলার সামরিক অভিযান পরিকল্পনা ছিল অভিনব: শত্রুকে তিনি আক্রমণ করবেন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত উত্তর-পুব থেকে। সুজার অবস্থান এখন বিস্তৃত রাজমহলের উল্টো পাশের সামদা দ্বীপ থেকে তান্দা পর্যন্ত উত্তর পশ্চিম আর দক্ষিণ-পুবে, আর তাঁর সদর দপ্তর এখন মাঝখানের চৌকি মিরদাদপুরে। মীর জুমলার পরিকল্পনা হলো, এই অবস্থানের উত্তরে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে রাজমহল, আকবরপুর আর মালদা হয়ে হঠাৎ তিনি ঘুরবেন দক্ষিণে, আর পুব থেকে তান্দার ওপর নেমে আসবেন বাজপাখির মতো। পাটনা থেকে আনা ১৬০টা নৌকাযোগে, গঙ্গার ওপর দিয়ে সেনা বহন করে গিয়ে দাউদ খানের সঙ্গে যোগ দিলেন মীর জুমলা।
প্রথম থেকেই সুজার সেনাসংখ্যা ছিল কম, আর এখন (ফেব্রুয়ারি, ১৬৬০) তার দক্ষিণে ফেরার একমাত্র পথও প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। এই সময় শাহজাদা মুহম্মদ সুলতান তাঁকে ত্যাগ করে ফিরে এলেন দোগাছির মোগল শিবিরে (৮ ফেব্রুয়ারি)। বাকি জীবনটা অভিশপ্ত এই শাহজাদাকে কারাগারেই কাটাতে হয়েছে।
৬ মার্চ মালদা পৌঁছে সুজাকে মারণাঘাত হানার জন্য এক মাস ধরে প্রস্তুতি নিলেন মীর জুমলা। তারপর ৫ এপ্রিল অগ্রসর হলেন তিনি মাহমুদাবাদের সদর দপ্তর থেকে। হঠাৎ তাদের দেখে চমকে উঠল মহানন্দা নদীতে টহলরত ছোট শত্রুদলটা। কালবিলম্ব না করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সম্রাট-বাহিনী। দিলির খানের এক পুত্রসহ ডুবে মারা গেল এক হাজারের বেশি শক্রসেনা।
সুজার সবকিছু শেষ হয়ে গেল। এখন শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তাঁকে এই মুহূর্তে পালাতে হবে ঢাকায়। ৬ এপ্রিল ভোরে তান্দায় গিয়ে তিনি তাঁর। বেগমদের তৈরি হয়ে নিতে বললেন। তাঁর ধনরত্ন এবং অন্যান্য সম্পদ বড় চারটে নৌকায় ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ভাটির দিকে। বিকেলে রওনা দিলেন সুজা স্বয়ং, সঙ্গে কনিষ্ঠ দুই পুত্র, বুলন্দ আখতার আর জইন-উল-আবিদিন, তাঁর সেনাপতিবর্গ, মীর্জা জান, বরহার সাঈদ আলম, সাঈদ কুলি উজবক, মীর্জা বেগ, কয়েকজন সেনা, ভৃত্য আর খোঁজা-৬০টা নৌকায় সবসুদ্ধ ৩০০ জন মানুষ। যে সভায় বসে জাঁকজমকের সঙ্গে তিনি শাসন করেছেন তিনটে প্রদেশ, আর তাঁর বিশাল যে সেনাবাহিনী দুবার নেমেছে দিল্লির সিংহাসন দখলের যুদ্ধে, সেসবের এটুকুই ছিল অবশিষ্ট!
তান্দা ত্যাগ করায় সুজার সেখানকার অরক্ষিত সমস্ত সম্পদ লুট হয়ে গেল। পরদিন (৭ এপ্রিল) মীর জুমলা শহরটা দখল করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। সরকারের পক্ষে লুট হয়ে যাওয়া সম্পত্তি যথাসম্ভব উদ্ধার করলেন তিনি, আর সুজার ফেলে যাওয়া মেয়েদের দিলেন যথাযথ নিরাপত্তা। তর্তিপুরে আটক করা। হলো সুজার নৌবাহিনীর ৪০০ নৌকা। তার সেনাবাহিনী যোগ দিল মীর জুমলার সঙ্গে (৯ এপ্রিল)। তারপর সেনাপতি মীর জুমলা তান্দা থেকে রওনা দিলেন (১৯ এপ্রিল) ঢাকার উদ্দেশে।
৫.১১ সুজার বাংলা ত্যাগ; তার পরিণতি
১২ এপ্রিল, সুনাম আর ভাগ্য দুদিক থেকেই দেউলিয়া হয়ে, সুজা পৌঁছালেন বাংলার দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকাতে। কিন্তু সেখানেও কোনো আশ্রয় মিলল না। জমিদারদের সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, আর এখন তার না আছে তাদের দমন করার শক্তি, না আছে পিছু ছুটে আসা মীর জুমলার মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা। সুতরাং ৬ মে ঢাকা ত্যাগ করে নদীপথে এগোতে লাগলেন তিনি সাগরের দিকে। পদে পদে কমতে লাগল সেনা আর মাঝির সংখ্যা। ইতিমধ্যেই তিনি আরাকানের রাজার সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, আর ঢাকা ত্যাগের দুদিন পর রাজার চাটগাঁর শাসক তার জন্য পাঠিয়ে দিল ৫১টা জাহাজ। বাংলার কর্তৃত্বের সব আশা ত্যাগ করে, হিংস্র মগদের দেশে নিজেকে নির্বাসন দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন সুজা।
এই সংবাদ তাঁর পরিবার আর অনুসারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করল। আরাকানের জলদস্যুদের কথা বাংলার সবাই জানে। নোয়াখালী আর বাকেরগঞ্জ জেলার মানুষজনকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাদের অত্যাচারে । আরাকানের অধিবাসীর দুঃসাহসী আক্রমণ, ভয়াবহ হিংস্রতা, বুনো চেহারা, বর্বরসুলভ আচরণ, ধর্ম বা গোত্রের বালাই না থাকা, আর পালক-চামড়াসমেত পশুপাখি খাবার জঘন্য অভ্যাসের কারণে পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমান উভয়ে তাদের আতঙ্ক আর ঘৃণার চোখে দেখে।
কিন্তু আওরঙ্গজেবের হাতে দারা শুকো আর মুরাদ বখশের পরিণতি বরণ করতে না চাইলে সেই দেশে যাওয়া ছাড়া সুজার আর কোনো উপায় নেই। সুতরাং ১৬৬০ সালের ১২ মে পূর্বপুরুষের বাসস্থান আর বিশ বছরের শাসন করা। প্রদেশ ত্যাগ করে পরিবার আর ৪০ জনের কম অনুসারী নিয়ে পাড়ি জমালেন তিনি আরাকানের উদ্দেশে; অনুসারীদের দশজনই ছিল বরহার সাঈদ, শৌর্য আর প্রভুর প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য যারা ভারত জুড়ে বিখ্যাত।
নতুন বাসস্থানে সুজা শাস্তি পেলেন না। তাঁর অস্থির উচ্চাভিলাষ ডেকে আনল করুণ পরিণতি। আরাকানে বসবাসকারী অনেক মোগল আর পাঠান তাঁর প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করল। তাই তাদের সঙ্গে নিয়ে রাজাকে হত্যার একটা পরিকল্পনা আঁটলেন সুজা; এখানকার কাজ সারার পর আবার ভাগ্যপরীক্ষার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি বাংলা অভিমুখে। কিন্তু আরাকানরাজ এই পরিকল্পনার কথা জেনে ফেলায় আঁটল শাহ সুজাকে হত্যার পরিকল্পনা। কয়েকজন মানুষসহ শাহ সুজা পালিয়ে গেলেন জঙ্গলে। মগেরা গেল হতভাগ্য শাহজাদার পিছু পিছু…আর তাঁকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল।’ (ওলন্দাজ রিপোর্ট, ফেব্রুয়ারি, ১৬৬১)।