১০. মারাঠা শক্তির উত্থান

১০. মারাঠা শক্তির উত্থান

১০.১ সপ্তদশ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসের মর্ম

চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাহমানি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ ভারতে মুসলমান শক্তির জন্য একটা স্বাধীন কেন্দ্রের সৃষ্টি করল। ভারতে ইসলাম ধর্ম তার বিস্তৃতির পাশাপাশি শুরু করল দাক্ষিণাত্যের স্বাধীন হিন্দু রাজ্যগুলোর ধ্বংস সাধন। পঞ্চদশ শতাব্দী জুড়েই চলল এই প্রণালি । পরবর্তী শতাব্দীর প্রথম পাদের শেষে, বাহমানি বংশের পতন হতে, তার উত্তরাধিকার গিয়ে পড়ল নিজাম শাহ আর আদিল শাহের যোগ্য হাতে। আহমদনগর আর বিজাপুর পরিণত হলো ইসলামি সংস্কৃতির দুই কেন্দ্রে। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদে নিজাম শাহি বংশ লোপ পেল। আহমদনগরের নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে দ্রুত এগিয়ে এল বিজাপুর।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে দক্ষিণের রণক্ষেত্রে প্রবেশ করল নতুন এক প্রতিদ্বন্দ্বী। মোগল সম্রাটের দাক্ষিণাত্য জয়ে আর কোনো বাধা রইল না। বিজাপুরের শাসক আদিল শাহ দেখল যে দাক্ষিণাত্যের নেতৃত্বের স্বপ্ন তাকে ত্যাগ করতেই হবে, আর উচ্চাশা পূরণের জন্য খুঁজে নিতে হবে কেবল পুব আর দক্ষিণের কোনো পথ, যেন তাকে না মাড়াতে হয় উত্তরের ভয়ংকর মোগলদের পথ । ১৬৩৬ সালের বিভাজন-চুক্তির ফলে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হলো মোগলদের দক্ষিণ প্রান্তসীমা, আর পরবর্তী বিশ বছরে ভারতীয় উপদ্বীপের এক সাগর থেকে আরেক সাগর পর্যন্ত সীমানা বিস্তৃত করে বিজাপুর পৌঁছে গেল উন্নতির চরম শিখরে, তার রাজধানী হয়ে দাঁড়াল শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর ধর্মীয় শিক্ষার পীঠস্থান। কিন্তু পূর্ববর্তী অপেক্ষাকৃত কম ঐশ্বর্যবান যোদ্ধা-রাজাদের যেসব উত্তরাধিকারী এল, তারা খোলা মাঠের শিবির আর ঘোড়ার পিঠের চেয়ে দরবারের আরাম আর হেরেমে মজে থাকতেই পছন্দ করল বেশি। আদিল শাহি শক্তিরও দ্রুত পতন আর বিভাজন শুরু হলো।

সামন্ত রাষ্ট্র অলস রাজা বা কোনো নিয়মতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সফলভাবে শাসিত হতে পারে না। কারণ, রাজা যখন আর বীর থাকে না, তখন তাকে আর মান্য করতে চায় না সামরিক রাজ্যপালেরা। অতএব, ১৬৫৬ সালের নভেম্বরে আদিল শাহের মৃত্যুর পর অবশিষ্ট মুসলমান রাজ্যগুলোর ভাঙন আর সেগুলোর দ্রুত মোগলদের হাতে চলে যাওয়াটা ছিল এক রকম অবশ্যম্ভাবী বা বলা যায় প্রকৃতির নীরব কর্ম সম্পাদন। তবে এ সময়েই দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলো নতুন এক উপাদান।

সেই উপাদানটাই হলো মারাঠা। দাক্ষিণাত্যের ইতিহাসে তারা দেড়শো বছর ধরে আধিপত্য বিস্তার করেছে। মারাঠি জনসাধারণ এখানে বসবাস করত প্রায় অনাদিকাল থেকে, কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে এবং আপন ভূখণ্ডে অন্যের প্রজা হয়ে । জন্মভূমিতেই তাদের ছিল না কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা সামাজিক পদমর্যাদা। তাদের প্রয়োজন ছিল সহজাত দক্ষতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তির, যে মারাঠি বিক্ষিপ্ত জনগণকে একত্র করে তাদের একটা পূর্ণাঙ্গ জাতিতে রূপ দিতে পারে। আর সেই ব্যক্তিটিই ছিল শিবাজী, আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক এবং তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী।

বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার শাসকেরা কখনোই ভুলতে পারেনি যে আওরঙ্গজেবের একমাত্র নিঘুম উদ্দেশ্য হলো, তাদের বিলুপ্তি আর সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের ভূখণ্ডের সংযুক্তি। তাই চুড়ান্ত বিপদের ক্ষণে শিবাজীর সহজাত দক্ষতা আর শম্ভুজীর বেপরোয়া ধৃষ্টতার মধ্যেই তারা খুঁজে পেয়েছে তাদের একমাত্র রক্ষাকারী বর্ম। মারাঠিদের বিপক্ষে বিজাপুর কিংবা গোলকুপ্তার মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিল হওয়া ছিল মনস্তাত্ত্বিকভাবেই অসম্ভাব্য।

মোগল আগ্রাসনের আতঙ্কেই গোলকুপ্তা আর বিজাপুরের সুলতান ধরা দিয়েছিল শিবাজীর বাহুপাশে। দাক্ষিণাত্যের উল্লেখযোগ্য তিন ক্ষমতার মধ্যে কুতব শাহকে আমরা হিসেব থেকে বাদ দিতে পারি, যেহেতু এই সময়ে সে মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তার সম্পর্কে কোনো ফাটল ধরাতে চায়নি। ১৬৬৬ সালের পর শুরু হলো বিজাপুর সরকারের অসহায় পতন, যখন দ্বিতীয় আলী আদিল শাহ ডুবে গেল মদে, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী অমাত্যরা প্রধানমন্ত্রিত্ব আর দুর্বল রাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে। ঘটনা হলো আরও খারাপ, ১৬৭২ সালে যখন সিংহাসনে বসল বালক-রাজা সিকান্দার। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলতায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো প্রশাসন। আর এটাই সম্ভব করে দিল স্বাধীন একটা ক্ষমতা হিসেবে শিবাজীর উত্থান।

দিল্লি সরকারের শান্ত চেহারায় শিবাজীর বিশ্বাস ছিল না; তাদের কোনো চুক্তির বিষয়েও সে মুহূর্তের জন্য নিশ্চিত হতে পারেনি। তাই দাক্ষিণাত্যের মোগল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালানোর বিন্দুমাত্র সুযোগও সে জাপটে ধরেছে দুই হাতে । তবে বিজাপুরের সঙ্গে তার ছিল অন্য ধরনের সম্পর্ক। বিজাপুরে সে চলাফেরা করতে পারত নির্দ্বিধায়, এমনকি তাদেরই মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বাড়িয়ে নিতে পারত নিজ ভূখণ্ড। কিন্তু ১৬৬২ সালের দিকে আদিল শাহি মন্ত্রীদের সঙ্গে তার একটা সমঝোতা কার্যকর হওয়ার পর বিজাপুর রাজ্যের কেন্দ্রে সে আর কোনো রকম ঝামেলা সৃষ্টি করেনি। তার ভূখণ্ড বিস্তৃতির স্বাভাবিক পথের (অর্থাৎ, কোলাপুর, কানারা আর কোপাল) পাশেই ছড়িয়ে ছিল বিজাপুরী অমাত্যদের জায়গির, ফলে শান্তিতে থাকা ছিল তার পক্ষে অসম্ভব, যদিও বিজাপুরের কেন্দ্রীয় সরকারকে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান জানাতে চায়নি।

১০.২ দাক্ষিণাত্যে মোগল দুর্বলতার কারণসমূহ

১৬৫৮ সালের জানুয়ারিতে পিতার সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার লক্ষ্যে দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করেছেন আওরঙ্গজেব, আর জীবনের শেষ সিকি শতাব্দী অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে কাটানোর জন্য ১৬৮২ সালের মার্চে আবার ফিরে এসেছেন দক্ষিণে, ইতিমধ্যে ২৪টা বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে, যে সময়ে দাক্ষিণাত্য প্রদেশের সুবাদারি করেছে পাঁচজন, যাদের মধ্যে এগারো বছরের জন্য শাহজাদা শাহ আলম, ছয় বছরের জন্য বাহাদুর খান, শায়েস্তা খান চার বছর, জয় সিংহ প্রায় দুই আর দিলির খান এক বছর। এই চব্বিশ বছরে মোগলেরা বিজাপুরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার এক সবল পদ্ধতি অনুসরণ করেছে কেবল জয় সিংহ (১৬৬৬), বাহাদুর খান (১৬৭৬-৭৭), আর দিলির খানের (১৬৭৯-৮০) অধীনে। মারাঠিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় সামরিক অভিযান চালিয়েছেন শায়েস্তা খান (১৬৬০-৬২), জয় সিংহ (১৬৬৫), মহব্বত খান (১৬৭১-৭২), বাহাদুর খান (১৬৭৩-৭৫), আর ১৬৭৮-৭৯ সালে স্বল্প সময়ের জন্য দিলির খান। এর চেয়েও অনেক দীর্ঘ কাল যাবৎ শিবাজী আর মোগলদের মধ্যে একটা যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল, যে কালের বেশির ভাগ জুড়ে, তাদের দূরবর্তী প্রভুকে প্রতারণা করার জন্যই যেন, সম্রাট-বাহিনীর সেনাপতিরা থেকেছে ঢিলেঢালা, আর গোপনে একটা সমঝোতা রক্ষা করেছে শিবাজীর (পরে শম্ভুজীর সঙ্গে সঙ্গে, আর তার কাছ থেকে নিয়েছে ঘুষ।

এই ২৪ বছরে মোগল সেনারা দাক্ষিণাত্যে কয়েকটা সফলতা লাভ করলেও কোনো চূড়ান্ত ফল অর্জন করতে পারেনি। এই ব্যর্থতার কারণ ছিল আংশিক ব্যক্তিগত আর আংশিক রাজনীতিক। শাহ আলম ছিলেন একজন ভীরু, উদ্যমহীন শাহজাদা, প্রকৃতিগতভাবেই প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তি বজায় রাখায় আগ্রহী এবং আগ্রহী হেরেমের উপভোগ আর শিকারে। পাশাপাশি প্রধান সেনাপতি দিলির খানের সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্য বিবাদ দাক্ষিণাত্যকে প্রায়ই করে তুলেছে গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশের মতো ক্ষমতাহীন। যেকোনো কাজে শাহ আলম ডানে গেলে দিলির খান গেছে বামে, আর এভাবে দাক্ষিণাত্যে নিশ্চিত করেছে মোগল ব্যর্থতা।

দ্বিতীয়ত, সম্রাট-বাহিনীর সেনাপতিরা সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল শিবাজীর সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধে। মোগলদের হিন্দু সেনা কর্মকর্তারা সৌভাতৃত্ব প্রদর্শনের খাতিরে লুকিয়ে লুকিয়ে শিবাজীকে টাকা দিয়েছে, ওদিকে মুসলমান অনেক সেনাপতি তাকে খুশি মনে ঘুষ দিয়েছে কেবল একটু শান্তিতে থাকার আশায়। সর্বোপরি দাক্ষিণাত্যের সমস্ত সরকারকে যে পরিমাণ মানুষ আর অর্থ সরবরাহ করা হয়েছে, তা বিজাপুর আর মারাঠিদের পরাজিত করার দুরূহ কাজটার পক্ষে অর্ধেক যথেষ্টও নয়।

শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহ আর শম্ভুজীর কাছে তাঁর পলায়ন (১৬৮১) দিল্লির সিংহাসনকে এতটাই বিপন্ন করে তুলেছে, যার প্রতিকার হতে পারে কেবল আওরঙ্গজেব স্বয়ং দক্ষিণে এলে। মোট কথা, এই অঞ্চলের জন্য আমূল পরিবর্তন করতে হলো সম্রাটের পরিকল্পনা। এখন আওরঙ্গজেবের প্রথম কাজ হলো, শম্ভুজীর শক্তি গুঁড়িয়ে দিয়ে আকবরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা।

১০.৩ মহারাষ্ট্র: দেশ এবং এটার জনসাধারণ

মারাঠিদের দেশ স্পষ্টভাবে সীমানাচিহ্নিত তিনটে অঞ্চলে বিভক্ত। পশ্চিম ঘাট আর ভারত মহাসাগরের মাঝখানে রয়েছে লম্বা সরু একটা ভূখণ্ড, যার নাম কঙ্কান (বোম্বে আর গোয়র মাঝখানে), আর কানারা (গোঁয়ার দক্ষিণে)। এখানে ভারী বৃষ্টিপাত হয়, বছরে ১০০ থেকে ১২০ ইঞ্চি, ধান এখানকার প্রধান শস্য, আর রয়েছে আমের ঘন কুঞ্জ, কলার বাগান, আর নারিকেল । ঘাট পেরিয়ে পুব দিকে। রয়েছে ২০ মাইল চওড়া আরেকটা ভূখণ্ড, নাম মাবল। আরও পুবে এগোলে নদী উপত্যকাগুলো ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে গঠন করেছে দেশ’ বা মধ্য দাক্ষিণাত্যের বিশাল কালো মাটির সমভূমি।

শুধু পুব দিকে খোলা পাহাড়ে প্রায় বন্দী এই দেশটাই হলো মারাঠা রাজ্য। ঘাটের পুব দিকের অঞ্চলে অত বৃষ্টিপাত হয় না।

এ রকম একটা দেশে কোনো বিলাস থাকতে পারে না, কোনো অবসর (পুরোহিতদের মধ্যে ছাড়া), সৌন্দর্যের কোনো পিপাসা, এমনকি কোনো মার্জিত আচরণ। তবে এই দেশ আর জলবায়ু আবার পুষিয়ে দিয়েছে অন্য দিকে । এখানকার মানুষের রয়েছে আত্মবিশ্বাস, সাহস, অধ্যবসায়, এক অনমনীয় সরলতা, এক অমার্জিত স্পষ্টভাষিতা, সামাজিক সমকক্ষতার একটা বোধ, আর এ সবকিছুর পরিণতিতে মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার একটা গর্ব। সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক ইউয়ান চোয়াং মারাঠিদের সম্বন্ধে লিখেছেন, “তেজ-গর্বী আর যুদ্ধপ্রিয়, অনুগ্রহের প্রতি কৃতজ্ঞ, আর অন্যায়ের প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ। পরবর্তী দশ শতাব্দীতে তাদের ধূর্ততা বেড়েছে আর বীরধর্ম কমেছে; তবে চরিত্রের মৌলিকত্ব রয়ে গেছে প্রায় একই রকম-কর্মচাঞ্চল্য, আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান, আর মানুষের সমকক্ষতার প্রতি ভালোবাসা।

তাদের ধর্মও মানুষের এই সমকক্ষতাকে লালন করেছে। পঞ্চদশ আর মোড়শ শতাব্দীর জনপ্রিয় সাধুরা তাদের শিক্ষা দিয়েছে যে কেবল জন্মের পবিত্রতা থাকলেই চলবে না, থাকতে হবে আচরণের পবিত্রতা, আর খাঁটি সমস্ত ধর্মবিশ্বাসী ঈশ্বরের দৃষ্টিতে সমান।

অনেক পাহাড়ই তাদের জন্য তৈরি করেছে প্রাকৃতিক দুর্গ, প্রয়োজনে যেগুলোতে তারা আশ্রয় নিতে পারে আর গড়ে তুলতে পারে দৃঢ় প্রতিরোধ; এ রকম অনেক দুর্গের ভেতরেই রয়েছে সুমিষ্ট পানির ঝরনা।

বলা যেতে পারে, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস আর জীবনযাত্রার বিচারে সপ্তদশ শতাব্দীর মহারাষ্ট্র পেয়েছিল একটা উল্লেখযোগ্য সম্প্রদায়, এমনকি শিবাজী সেখানে রাজনৈতিক একতা সৃষ্টি করার আগেই।

১০.৪ শাহজী ভোঁসলে : তার জীবনধারা

ভোঁসলে উপাধিযুক্ত একটা পরিবার দুই গ্রামের মোড়ল (পাতিল) হিসেবে বাস করত পুনা জেলার পাতাস মহকুমায়। তারা চাষবাস করত আর সচ্চরিত্র আর ধর্মীয় দানশীলতার কারণে স্থানীয়ভাবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। তারা পেয়েছিল তাদের জমিতে পোঁতা কিছু গুপ্তধন, ফলে কিনতে পেরেছিল অস্ত্রশস্ত্র আর ঘোড়া আর ষোড়শ শতাব্দীর শেষাশেষি হয়েছিল নিজাম শাহি বংশের ভাড়াটে সেনাদের ক্যাপটেন। মালোজীর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহজীর জীবনও ছিল অনেকটা এ রকম। তার জন্ম হয়েছিল ১৫৯৪ সালে, আর শিশু থাকতেই বিয়ে হয়েছিল জীজা বাইয়ের সঙ্গে। জীজা বাই ছিল আহমদনগরের অন্যতম সেরা হিন্দু অমাত্য, সিন্ধখেদের জমিদার অভিজাত-বংশীয় লখজী যাদব রাওয়ের কন্যা। শাহজী সম্ভবত সেনাবাহিনীতে ঢুকেছিল মালিক অম্বরের শাসনকালে। ১৬২৬ সালের মে মাসে মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর শুরু হলো রাষ্ট্রের পতন; দরবারে সংঘটিত হলো একের পর এক হত্যাকাণ্ড। সংকটময় এই সময়ে শাহজী প্রথমে হলো নিজাম শাহি সরকারের অনুসারী, তারপর যোগ দিল মোগলদের পক্ষে, তাদের ছাড়ল, পরে আবার তাদের পক্ষে গিয়ে যুদ্ধ করল বিজাপুরীদের বিপক্ষে, আর শেষমেশ একটা পুতুল নিজাম শাহ প্রতিষ্ঠা করল (১৬৩৩) শাহজাদ্রি পাহাড়শ্রেণীর এক পাহাড়ে-দুর্গে। দখল করল সে নিজাম শাহি রাজ্যের এক সিকি, পুনা আর চাকন থেকে বালাঘাট, আর জুন্নার, আহমদনগর, সংগামনার, জিম্বক আর নাসিকের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল, আর তিন বছর সরকার চালাল (১৬৩৩ ৩৬) এই সুলতানের নামে। জুন্নারকে সে করল তার রাজধানী। কিন্তু ১৬৩৬ সালে বিশাল এক সম্রাট-বাহিনী এল শাহজীর বিরুদ্ধে, আর সে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে তার আটটা দুর্গ ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো, যোগ দিল বিজাপুর সেনাবাহিনীতে এবং ত্যাগ করল মহারাষ্ট্র।

১০.৫ শিবাজীর শৈশব, শিক্ষা ও চরিত্র

১৬২৭ সালের ১০ এপ্রিল শাহজী আর জীজা বাইয়ের দ্বিতীয় পুত্র শিবাজী জন্মগ্রহণ করল পাহাড়ে-দুর্গ শিবনারে, যেখান থেকে জুন্নার শহরটা দেখা যায়। ১৬৩৬ সালের শেষের দিকে বিজাপুর সেনাবাহিনীতে যোগদান করার পর, নতুন প্রভুর জন্য নতুন ভূখণ্ড আর নিজের জন্য জায়গির দখল করতে শাহজীকে প্রথমে পাঠানো হলো তুঙ্গভদ্রা অঞ্চল আর মহীশূর মালভূমিতে এবং পরে মাদ্রাজ উপকূলে। কিন্তু এখানে সঙ্গে রয়েছে তার প্রিয় স্ত্রী টুকা বাই আর টুকার পুত্র ভ্যাঙ্কোজী, ওদিকে জীজা বাই আর শিবাজীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পুনরায়, তার জমির দেওয়ান দাদাজী কোন্দ-দেবের তত্ত্বাবধানে।

এমনিতেই জীজা বাই ছিল ধর্মপরায়ণ মহিলা, স্বামীর অবহেলা ধর্মের প্রতি টান আরও বাড়াল, আর পুত্রকেও সে দিতে লাগল ধর্মশিক্ষা। শিবাজী বড় হতে লাগল একাকিত্বের মধ্যে, সঙ্গীহীন একটা শিশু, যার ভাই, বোন, পিতা কেউ নেই। ভীষণ এই একাকিত্ব মা আর পুত্রকে করল খুবই অন্তরঙ্গ, মার প্রতি শিবাজীর ভালোবাসা বাড়তে বাড়তে চলে গেল প্রায় দেবীর পর্যায়ে। একদম কম বয়েস থেকে নিজের কাজ নিজেই করতে শিখল শিবাজী। তার হলে কঠোর বাস্তবের শিক্ষা; লড়াই করা, ঘোড়ায় চড়া এবং অন্যান্য পুরুষালি কাজে সে হয়ে উঠল দক্ষ; গভীর ভালোবাসা জন্মাল তার হিন্দু মহাকাব্যের প্রতি, আবৃত্তি আর গল্প শুনতে শুনতে সেগুলো আত্মস্থ করে ফেলল সে। ধর্মীয় বই পড়তে আর গান (কীর্তন) শুনতে পছন্দ করত শিবাজী, আর পছন্দ করত সাধুসঙ্গ; কোথাও হিন্দু কিংবা মুসলমান সাধু আসার কথা শুনলেই তৎক্ষণাৎ সে ছুটে যেত তাদের পাশে।

পুনা জেলার পশ্চিমে যে পাশটা চলে গেছে শাহজাদ্রি পাহাড়শ্রেণীর পাদদেশ দিয়ে, সেখানে বাস করে মাবল নামের শক্ত-সমর্থ, স্বাস্থ্যবান আর দুঃসাহসী চাষিদের একটা বংশ। প্রথম দিকে তাদের ভেতর থেকেই শিবাজী বেছে নিল তার সঙ্গী, নিবেদিত অনুসারী, আর সেরা সেনা। নিজ বয়সী মাবল সর্দারদের সঙ্গে শাহজাদ্রি পাহাড়শ্রেণীর বনে-জঙ্গলে আর জটপাকানো নদী উপত্যকা বরাবর ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে শিবাজী হয়ে উঠল ভীষণ কষ্টসহিষ্ণু। ভালোবাসা জন্মাল তার স্বাধীনতার প্রতি, আর কোনো মুসলমান রাজার বেতনভোগী ক্রীতদাসসুলভ বিলাসী জীবনের প্রতি ঘৃণা ।

১৬৪৭ সালের ৭ মার্চ মারা গেল দাদাজী কোন্দ-দেব, ফলে মাত্র বিশ বছর বয়েসেই শিবাজী হলো স্বাবলম্বী।

১০.৬ শিবাজীর প্রথম দিকের বিজয়

১৬৪৬ সালে বিজাপুরের রাজা অসুস্থ হয়ে পড়ল। এই অসুস্থতা স্থায়ী হলো দশ বছর, যে সময়ে রাজা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজই করতে পারল না। আর এটাই শিবাজীর জন্য বয়ে আনল সুযোগ। তোরনা দুর্গ দখল করে নিল সে সেটার বিজাপুরী সেনাপতির সঙ্গে প্রতারণা করে। এখানকার সরকারি কোষ ভেঙে পেল সে ২ লাখ হুন। তোরনা থেকে ৫ মাইল পুবে একই পাহাড়শ্রেণীর চুড়ায় শিবাজী তৈরি করল রাজগড় নামের নতুন আরেকটা দুর্গ। তারপর বিজাপুরের এক প্রতিনিধির কাছ থেকে সে দখল করল কোন্দানা (সিংহ-গড়)।

১৬৪৮ সালের ২৫ জুলাই, শাহজীকে গ্রেপ্তার করে তার যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল বিজাপুরী প্রধান সেনাপতি মুস্তফা খান।

হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে শাহজীকে আনা হলো বিজাপুরে, আর সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার না করা পর্যন্ত তাকে রাখা হলো কড়া পাহারায়।

শিবাজী পড়ে গেল এক ভীষণ দোটানায়: দাক্ষিণাত্যের তদানীন্তন সুবাদার শাহজাদা মুরাদ বখশকে সে অনুরোধ করল যেন তিনি সম্রাটকে বলে শাহজীর অতীত অপরাধ ক্ষমা করিয়ে নেন আর তার এবং তার পুত্রদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, তাহলে বিনিময়ে সে নিজে মোগল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। শাহজাহান অবশ্য শাহজীর মুক্তির ব্যাপারে আদিল শাহের ওপরে কোনো চাপ প্রয়োগ করলেন না। বিজাপুরী অমাত্য আহমেদ খানের মধ্যস্থতায় সুলতানকে তিনটে দুর্গ (বাঙ্গালোর, কোন্দানা আর কপি) সমর্পণের বিনিময়ে মুক্তি পেল শাহজী (১৬৪৯ সালের মে)। ১৬৪৯ থেকে ১৬৫৫ সাল পর্যন্ত এই ছয়টা বছর শিবাজী এক রকম শান্তই রইল, বিজাপুর সরকারের সঙ্গে তেমন কোনো ঝামেলা পাকাল না। এই সময় সে কেবল দখল করল পাহাড়ে-দুর্গ পুরন্দর।

সাতারা জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে জাবলি গ্রাম, যেটার মালিক মোরে নামের এক মারাঠি পরিবার, যার পরিবারপ্রধানের বংশগত উপাধি হলো চন্দ্র রাও। এই পরিবারটার রয়েছে ১২,০০০ পদাতিক সেনা, যাদের বেশির ভাগই মাবলদের মতো শক্ত-সমর্থ পাহাড়ি মানুষ।

শিবাজী দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পশ্চিমে তার যে উচ্চাশা পূরণ করতে চায়, অবস্থানগত কারণে জাবলি সেই পথের এক প্রধান বাধা। তাই সে তার প্রতিনিধি রঘুনাথ বল্লাল কোর্দেকে পাঠাল চন্দ্র রায়ের কাছে, মৃত চন্দ্র রাওয়ের মেয়ের সঙ্গে শিবাজীর বিয়ের প্রস্তাবের ভান করতে করতে চন্দ্র রাওকে হত্যা করার জন্য। হত্যার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়ে শিবাজী আক্রমণ চালাল জাবলির ওপর (১৫ জানুয়ারি, ১৬৫৬)। নেতৃত্বহীন গ্যারিসন ছয় ঘণ্টা প্রতিরোধ করার পর হাল ছেড়ে দিল। ফলে পুরো জাবলিই চলে গেল শিবাজীর অধিকারে। জাবলির ২ মাইল পশ্চিমে সে তৈরি করল প্রতাপগড় নামের নতুন এক দুর্গ, আর সেখানে প্রতিষ্ঠা করল তার কুলদেবী ভবানীর প্রতিমা। এপ্রিলে মোরেদের কাছ থেকে সে দখল করল রাইগড়– তার ভবিষ্যতের রাজধানী।

১০.৭ মোগলদের সঙ্গে শিবাজীর প্রথম যুদ্ধ, ১৬৫৭

মুহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর (৪ নভেম্বর, ১৬৫৬) পর আওরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণের তোড়জোড় শুরু করলেন। শিবাজীর কূটনীতিক সোনাজী, বিদারের সামনে ফেলা শাহজাদার তাঁবুতে গেলে (মার্চ, ১৬৫৭), তাকে নিশ্চিত করা হলো যে মোগল সরকার মারাঠা সর্দারের সমস্ত দাবি মেনে নেবে। কিন্তু শিবাজী ততক্ষণে নিয়ে ফেলেছে অন্য সিদ্ধান্ত। তার মনে হয়েছে যে এর চেয়ে মোগল দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণ-পশ্চিমে হামলা চালানোটাই হবে বেশি লাভজনক।

মারাঠি দুই ক্যাপটেন, মিনাজী ভোঁসলে আর কাশী, ৩,০০০ অশ্বারোহী সেনা নিয়ে গিয়ে ভীমা পেরিয়ে লুটপাট করল চামরগন্ধা আর রাইজিন মহকুমার মোগল গ্রামগুলো। শিবাজী তখন উত্তরের জুন্নার মহকুমা লুটপাটে ব্যস্ত। ৩০ এপ্রিল রাতের গভীর অন্ধকারে দড়ির মই বেয়ে টপকাল সে জুন্নার শহরের দেয়াল, আর রক্ষীদের হত্যা করে নিয়ে চলে গেল নগদ ৩০০,০০০ হুন, ২০০টা ঘোড়া এবং দামি পোশাক আর সোনাদানা। আওরঙ্গজেব এসব ঝামেলার কথা শুনে শক্তিবৃদ্ধির লক্ষ্যে নাসিরি খান, ইরাজ খান এবং আরও কিছু সেনা কর্মকর্তার অধীনে ৩,০০০ অশ্বারোহী পাঠালেন আহমদনগর জেলায়। ইতিমধ্যে মুলতাফত খান আহমদনগর দুর্গ থেকে গিয়ে চামরগন্ধার অবরুদ্ধ আউটপোস্ট মুক্ত করল মিনাজীকে পরাজিত করে (২৮ এপ্রিল)।

কিন্তু মোগল চাপ যখন খুব বেড়ে গেল উত্তর পুনা অঞ্চলে, শিবাজী লুটপাট শুরু করল আহমদনগর জেলায়। এই সময় (মে মাসের শেষে) এসে পৌঁছাল নাসিরি খান আর শিবাজীকে অবাক করে দিয়ে আচমকা প্রায় ঘিরে ফেলল তার সেনাবাহিনীকে। অনেক মারাঠি নিহত হলো, আহতও হলো অনেক, অবশিষ্টরা পালিয়ে গেল (৪ জুন)। আওরঙ্গজেব তার অফিসারদের প্রতিশোধ নেওয়ার আদেশ দিলেন যে তারা যেন শিবাজীর ভূখণ্ডে চারপাশ থেকে প্রবেশ করে, ‘গ্রামগুলো ধ্বংস করে দেয়, নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড চালায়, আর লুটপাটের চূড়ান্ত করে। কিন্তু মৌসুমী বায়ুর কারণে ঠিক তখনই নামল ঘোর বর্ষা, ফলে জুন, জুলাই আর আগস্টে অভিযান মুলতবি রাখতে হলো।

সেপ্টেম্বরে যখন শিবাজীর সামন্ত-প্রভু, বিজাপুরের রাজা, শান্তি স্থাপন করল, তখন সে বুঝতে পারল যে এখন মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্গে একাকী যুদ্ধ চালিয়ে গেলে তার ধ্বংস অনিবার্য। তাই তার কূটনীতিক রঘুনাথ পন্তকে পাঠাল আওরঙ্গজেবের কাছে। উত্তর ভারতে রওনা দেওয়ার মুখোমুখি শাহজাদা জবাব দিলেন, তোমার অপরাধ যদিও ক্ষমার অযোগ্য, আমি তোমাকে ক্ষমা করছি তুমি অনুতপ্ত হয়েছ বলে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মন শান্ত হলো না; তিনি বুঝতে পারলেন, তরুণ এই মারাঠি সর্দারের দুঃসাহস তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সমকক্ষ।

১৬৫৭ সালের শেষ তিন মাসে দিল্লির সিংহাসন নিয়ে লড়াইয়ের ফলে সৃষ্ট একটা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় শাহজাদা আওঙ্গজেবের উত্তরে চলে যাওয়া, আর বিজাপুরী অমাত্যদের আত্মকলহ শিবাজীর উচ্চাশার পথ আবার উন্মুক্ত করে। দিল। পশ্চিম ঘাট পেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে কানের ওপর, আর সাইজেই দখল করে নিল দেয়ালবিহীন দুই সম্পদশালী শহর, কালিয়ান আর ভিবন্দী (২৪ অক্টোবর, ১৬৫৭)। তারপর তার করতলগত হলো একদা শাহজীর শেষদিকের আশ্রয় মহুলি দুর্গ (৮ জানুয়ারি, ১৬৫৮)। শিবাজী শিগগিরই কালিয়ান আর ভিবন্দীকে রূপান্তরিত করল নৌ-দপ্তর আর ডকে।

১৬৫৯ সালে শিবাজীর রাজ্যের বিস্তৃতি গিয়ে দাঁড়াল দক্ষিণের সাতারা জেলা আর উত্তরের মহুলি থেকে মাহাদের কাছের উত্তর কঙ্কান পর্যন্ত।

১০.৮ শিবাজী কর্তৃক বিজাপুরের আফজাল খান হত্যা, ১৬৫৯

১৬৫৯ সালে শিবাজীর বিপক্ষে অভিযানের দায়িত্ব পড়ল প্রথম শ্রেণীর একজন অমাত্য, আবদুল্লাহ ভাটারি ওরফে আফজাল খানের ওপর। কিন্তু আফজালের অধীনে দেওয়ার মতো আছে কেবল ১০,০০০ অশ্বারোহী সেনা, অথচ সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে যে শিবাজীর রয়েছে ৬০,০০০ মাবল পদাতিক। বিজাপুরের বিধবা। রানি আফজাল খানকে নির্দেশ দিল, সে যেন বন্ধুত্বের ভান করে শিবাজীকে গ্রেপ্তার কিংবা হত্যা করে। ওয়াইয়ের নিজের শিবির থেকে আফজাল তার জমিজমার দেওয়ান কৃষ্ণজী ভাস্করকে দিয়ে শিবাজীকে প্রলুব্ধ করার মতো একটা সংবাদ পাঠাল: ‘অনেক দিন যাবৎ তোমার পিতা ছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, অতএব তুমি আমার অপরিচিত কেউ নও। এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করো, আমি আমার প্রভাব খাঁটিয়ে আদিল শাহকে দিয়ে তোমার কঙ্কান এবং দখলে থাকা দুর্গগুলোতে তোমার অধিকার নিশ্চিত করাব।

শিবাজী আফজালের দূত কৃষ্ণজী ভাস্করকে খুবই সম্মান প্রদর্শন করল, আর রাতের বেলা গোপনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে চাইল আফজাল খানের সত্যিকার মনোভাব। আফজাল খানের এই ঘটনা সবাই জানে যে শেরা দুর্গ অবরোধের সময় সেই অঞ্চলের রাজা কস্তুরী রাঙ্গা আত্মসমর্পণ করার জন্য তার শিবিরে এলে রাজাকে সে হত্যা করেছে। কৃষ্ণজী স্বীকার করল যে আফজাল খানের মনে সম্ভবত কোনো অভিসন্ধি আছে। শিবাজী তখন সেই দূতের সঙ্গে পাঠাল পান্তজী গোপীনাথ নামক তার নিজের এক প্রতিনিধিকে। পান্তজী প্রচুর ঘুষ দিয়ে আফজালের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পারল যে ‘খান সাক্ষাঙ্কারের আয়োজন করেছে শিবাজীকে গ্রেপ্তার করার জন্য, যেহেতু তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণে খোলাখুলি যুদ্ধে তাকে কিছুতেই ধরা সম্ভব হচ্ছে না।’

সাক্ষাৎকারের স্থান নির্দিষ্ট হলো প্রতাপগড় দুর্গের পেছনের এক পাহাড়চুড়োয়। দুই পক্ষেই থাকল চারজন করে লোক-প্রধান, সশস্ত্র দুই অনুচর আর একজন দূত। আপাতদৃষ্টিতে শিবাজীকে নিরস্ত্র মনে হলো, যেন এক বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করতে এসেছে, যখন খানের পাশে ঝুলছে একটা তরবারি । কিন্তু শিবাজীর বাম হাতে লুকানো রয়েছে ইস্পাতের একটা থাবা (বাঘনখ), আর ডান হাতার ওপরে লুকানো সরু তীক্ষ্ণধার একটা ছুরি (বিছুয়া)।

আফজালের সামনে গিয়ে মাথা হেলিয়ে সম্ভাষণ জানাল শিবাজী। সামনে এগিয়ে এল খান বাহু দুই দিকে মেলে, হালকা-পাতলা মারাঠির উচ্চতা বড়জোর তার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাঁধ সমান । হঠাৎ খান তার বাম বাহুর বজ বাঁধনে আঁকড়ে ধরল শিবাজীর ঘাড়, আর ডান বাহু তরবারি চালিয়ে দিল শিবাজীর পাঁজর বরাবর। মারাঠির পোশাকের নিচে লুকানো বর্ম রক্ষা করল তাকে। গুঙিয়ে উঠল সে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভান করে, কিন্তু পরমুহূর্তেই তার বাম হাতে লুকানো বাঘনখের আঘাতে বেরিয়ে পড়ল খানের নাড়িভূঁড়ি, আর ডান হাতের বিছুয়া বিদ্ধ হলো তার পাঁজরে। বাঁধন শিথিল হয়ে গেল খানের, শিবাজী নিজেকে মুক্ত করে ছুটে গেল তার সঙ্গীদের কাছে।

খান চিৎকার ছাড়ল, ‘বিশ্বাসঘাতকতা! খুন! বাঁচাও! বাঁচাও!’ সাঈদ বান্দা নামক এক ওস্তাদ তরবারিবাজ ছুটে এল শিবাজীর মুখোমুখি, আর তরবারির এক কোপে দুই টুকরো করে ফেলল তার পাগড়ি, এবারেও পাগড়ির নিচের ইস্পাতের ক্যাপ রক্ষা করল মারাঠি সর্দারকে। তারপর জিব মহালা এক কোপে কেটে ফেলল সাঈদের ডান বাহু, তারপর তাকে খতম করে ফেলল। শম্ভুজী কবজী আফজালের মাথা কেটে নিয়ে এল শিবাজীর কাছে। ( বিপদমুক্ত হয়ে দুই সঙ্গীসহ প্রতাপগড়ের চুড়োয় গিয়ে কামানের একটা গোলাবর্ষণ করল শিবাজী। এই সংকেতেরই অপেক্ষায় ছিল নিচের উপত্যকায় জড়ো হওয়া তার সেনাবাহিনী। মোয়রা জিম্বক এবং নেতাজী পালকরের অধীন বাহিনী আর হাজার হাজার মাবল সেনা মুহূর্তে চারপাশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিজাপুরী শিবিরের ওপর। আফজালের কর্মকর্তা আর সেনারা আতঙ্কিত হয়েছিল তাদের সেনাপতির মৃত্যুসংবাদে, এবার শত্রুপক্ষের আক্রমণে তারা একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ল। অবর্ণনীয় ক্ষতি হলো বিজাপুরী বাহিনীর।

কামান, গাড়ি, গোলাবারুদ, তাঁবু, সাজসরঞ্জাম, মালবাহী গবাদিপশুসহ একটা পুরো সেনাবাহিনীর প্রায় সবকিছুই পেয়ে গেল বিজয়ীরা, যার মধ্যে ছিল ৬৫টা হাতি, ৪০০০ ঘোড়া, ১,২০০ উট, ২,০০০ কাপড়ের বান্ডিল আর ১০ লাখ টাকার নগদ আর সোনাদানা।

আফজাল খানের সেনাবাহিনী ধ্বংসের পর (১০ নভেম্বর, ১৬৫৯), দক্ষিণ কঙ্কান আর কোলাপুর জেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে, আরেক বিজাপুরী বাহিনীকে পরাজিত করে মারাঠিরা দখল করে নিল পানহালা দুর্গ, আর তার পরও অর্জন করল আরও বড় বড় কয়েকটা বিজয় (১৬৫৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৬৬০ সালের ফেব্রুয়ারি)।

১০.৯ পানহালা দুর্গে শিবাজীর অবরোধ

১৬৬০ সালের প্রথম দিকে ২য় আলী আদিল শাহ একটা সেনাবাহিনীসহ তার আবিসিনীয় ক্রীতদাস সিদ্দি জওহরকে পাঠাল শিবাজীকে দমন করতে। জওহর শিবাজীকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল পানহালা দুর্গের ভেতরে (২ মার্চ, ১৬৬০)। কিন্তু জওহরকে ঘুষ দিয়ে হাত করে ফেলল শিবাজী, ফলে লোক-দেখানো এক অবরোধ করে বসে রইল সে। নিহত আফজাল খানের পুত্র ফজল খান অবশ্য। মারাঠিদের সঙ্গে বীরদর্পে যুদ্ধ করে দখল করে নিল পাশের একটা টিলা। পানহালার পতন হতে পারে দেখে গভীর এক রাতে (১৫ জুলাই) নিজের অর্ধেক সেনাসহ দুর্গ থেকে বেরিয়ে গেল শিবাজী, আর বিজাপুরী সেনাবাহিনীর তাড়া খাওয়া সত্ত্বেও পালিয়ে যেতে পারল ২৭ মাইল পশ্চিমের বিশালগড়ে। বাজী প্রভুর অধীন সেনাদের গজপুর গিরিপথের দুঃসাহসিক যুদ্ধের ফলেই গড়ে উঠল এই প্রতিরোধ। অনেক সেনাসহ নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বাজী প্রভু সম্ভব করল শিবাজীর পলায়ন। পানহালাতে রেখে যাওয়া শিবাজীর বাদবাকি সেনারা দুর্গ সমর্পণ করল ২২ সেপ্টেম্বর।

১০.১০ শায়েস্তা খানের পুনা ও চাকন দখল

১৬৬০ সালের শুরু থেকেই দাক্ষিণাত্যের নতুন মোগল সুবাদার শায়েস্তা খান শিবাজীর বিরুদ্ধে তার অভিযান শুরু করলেন উত্তর থেকে। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশাল এক সেনাবাহিনীসহ আহমদনগর ত্যাগ করে খান এগোতে লাগলেন পুনা জেলার দিকে। পুরন্দরে আসার আগ পর্যন্ত মারাঠিরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করারই সাহস পেল না। মোগলেরা পুরন্দর যুদ্ধে জয়ী হলো আর শায়েস্তা খান পুনায় প্রবেশ করলেন। ৯ মে।

১৯ জুন পুনা ত্যাগ করে ২১ জুন খান এসে পৌঁছালেন ১৮ মাইল উত্তরের চাকনে, আর পরিখা খুঁড়লেন দুর্গের দেয়ালের পাশে। ৫৪ দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর উত্তর-পুব কোনার বুরুজের নিচে বসানো হলো একটা মাইন, আর সেটা বিস্ফোরিত হলো ১৬৬০ সালের ১৪ আগস্ট বেলা তিনটেয়। উড়ে গেল বুরুজসহ সেখানকার সব প্রহরী; সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোগলেরা। পরদিন দুর্গার পতন হলো, কিন্তু সম্রাট-বাহিনীর অনেক ক্ষতির বিনিময়ে। তাদের ২৬৮ জন নিহত হলো আর আহত ৬০০। চাকন দখল করার পর শায়েস্তা খান ফিরলেন পুনায় (আগস্টের শেষাশেষি, ১৬৬০), আর বর্ষাকালে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হলেন।

পরবর্তী বছরের (১৬৬১) শুরুতে শায়েস্তা খান নজর দিলেন কালিয়ান জেলা বা উত্তর কঙ্কানের দিকে। এখানে ইসমাইলের অধীনে ৩,০০০ মোগল সেনার ছোট একটা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে গত এপ্রিল থেকে। তারা জেলার কিছু অংশ দখল করলেও গুরুত্বপূর্ণ শহর আর বন্দরগুলো তখনো ছিল অজেয়। ১৬৬১ সালের জানুয়ারিতে পুনা থেকে শক্তিশালী একটা মোগল বাহিনী কঙ্কান অভিমুখে রওনা দিল কর তলব খানের অধীনে। উম্বরখিন্দের কাছে আসতে গোপনে দ্রুত এগিয়ে এসে তাদের যাতায়াত বিচ্ছিন্ন করে দিল শিবাজী। পানির অভাবে পিপাসায় মরার জোগাড় হলো কর তলবের সেনাদের। হতাশায় ভেঙে পড়ে শিবিরের সমস্ত সম্পত্তি আর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ শিবাজীর হাতে তুলে দিয়ে ফিরে এল সে বাহিনী নিয়ে (৩ ফেব্রুয়ারি)। কালিয়ান জেলাকে নতুন শত্রুদের কাছ থেকে মুক্ত করার পর দক্ষিণে অগ্রসর হয়ে অনায়াসে শিবাজী দখল করে চলল শহরের পর শহর, যতক্ষণ না উপকূলীয় দান্দা-রাজপুরী থেকে খারেপতনের পুরোটাই চলে এল তার অধীনে। কিন্তু এত জয়ের পর এল বিরাট এক পরাজয়। ১৬৬১ সালের মে মাসে মোগলেরা মারাঠিদের হাত থেকে কালিয়ান কেড়ে নিল আর সেটা নয় বছর রেখে দিল নিজেদের দখলে। দুই বছর ধরে এই যুদ্ধের ফলাফল দাঁড়াল, মোগলেরা দখল বজায় রাখল কঙ্কানের উত্তরে, আর দক্ষিণ থেকে গেল শিবাজীর অধীনে। ১৬৬৩ সালের মার্চে মোগলেরা তাড়া করল শিবাজীর অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি নেতাজীকে। পালাতে পারল নেতাজী, তবে ৩০০ ঘোড়া হারানো আর নিজে আহত হওয়ার পর।

১০.১১ শায়েস্তা খানের ওপর শিবাজীর নৈশ-আক্রমণ

কিন্তু মাস খানেকের মধ্যেই শিবাজী মোগলদের দিল একটা ওস্তাদের মার। দাক্ষিণাত্যের মোগল সুবাদারকে আক্রমণ করল তার খাস-শয়নকক্ষে।

শায়েস্তা খান পুনাতে থাকতেন লাল মহলে, অর্থাৎ শিবাজীর শৈশবের বাড়িতে। সঙ্গে ছিল তাঁর হেরেম, চারপাশে ছড়ানো প্রহরী আর অনুচরদের শিবির, জলসাঘর আর অফিস। খানিকটা সরে দক্ষিণে সিংহ-গড়ে যাওয়ার পথের ওপর তার সেনাপতি মহারাজা যশোবন্ত সিংহ আর তার ১০,০০০ সেনার শিবির। এ রকম একটা জায়গায় অভিযান চালানোর জন্য কেবল সাহসই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে চাই ক্ষিপ্রতা। নেতাজী পালকর আর মোয়রা পন্তের অধীন এক হাজার সেনার একটা করে বাহিনীকে শিবাজী নির্দেশ দিল বিশাল মোগল শিবিরের এক মাইল বাইরে অবস্থান নিতে। ১৬৬৩ সালের ৫ এপ্রিল, রোববার, রাত নামার পর ৪০০ বাছাই সঙ্গীসহ শিবাজী এসে উপস্থিত হলো পুনার উপকণ্ঠে, তারপর কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নেওয়ার পর চুপিসারে খানের শিবিরের কাছে এসে পৌঁছাল মাঝরাতে। এই বাড়িতেই শৈশব আর যৌবন কেটেছে বলে এখানকার প্রত্যেকটা ইঞ্চি শিবাজীর চেনা।

সেদিন ছিল রমজান মাসের ষষ্ঠ দিন। সারা দিনের অনাহারের পর রাতের ভারী খাবার পেটে যাওয়ায় নবাবের প্রায় সব ভৃত্যই ঢলে পড়েছিল ঘুমের কোলে। দু-চারজন ভৃত্য সেহরির আয়োজন করছিল, তাদের সহজেই খতম করে দিল মারাঠিরা। তারপর হেরেমের ইট-কাদার দেয়াল ভেঙে ২০০ লোকসহ শিবাজী প্রবেশ করল ভেতরে। তারা শয়নকক্ষে এসে পৌঁছাতেই চিৎকার শুরু করে দিল সেখানকার আতঙ্কিত মহিলারা, কিন্তু নবাব উঠে অস্ত্র ব্যবহার করার আগেই। শিবাজীর তরবারির এক কোপে কাটা পড়ল তার বুড়ো আঙুল । ঠিক এই সময়ে বুদ্ধিমতী কোনো মহিলা নিভিয়ে দিল ঘরের বাতি। গাঢ় অন্ধকারে শুরু হলো দারুণ এক বিশৃঙ্খলা, আর সেই সুযোগে শায়েস্তা খানের ক্রীতদাসী-বালিকারা সরিয়ে নিয়ে গেল তাঁকে নিরাপদ স্থানে।

ইতিমধ্যে শিবাজীর বাকি ২০০ জন লোক হেরেমে প্রবেশ করে প্রথমে হত্যা করল কয়েকজন প্রহরীকে, তারপর জলসাঘরে গিয়ে যন্ত্রীদের হাতের কাছে যা আছে, তা-ই বাজানোর আদেশ দিল। নাকাড়ার প্রচণ্ড শব্দ আর বাইরের চেঁচামেচিতে নরক গুলজার হয়ে উঠল।

শায়েস্তা খানের এক পুত্র, আবুল ফতহ, সর্বপ্রথম ছুটে এল পিতার সাহায্যে, কিন্তু দু-তিনজন মারাঠিকে আঘাত করতেই নিহত হলো সেই সাহসী যুবক।

শত্রুপক্ষ পুরোপুরি জেগে গেছে দেখে, হেরেম ত্যাগ করে সোজা ফিরতি পথ ধরল শিবাজী। এই নৈশ-আক্রমণে মারাঠিদের মাত্র ছয়জন নিহত হলো আর চল্লিশজন আহত, পক্ষান্তরে তাদের হাতে মারা পড়ল শায়েস্তা খানের এক পুত্র আর এক ক্যাপ্টেন, চল্লিশজন অনুচর, তার ছয় স্ত্রী আর ক্রীতদাসী-বালিকা, পাশাপাশি আহত হলে তাঁর অন্য দুই পুত্র, অন্য আটজন মহিলা আর শায়েস্তা খান স্বয়ং। দাক্ষিণাত্যের সমস্ত জনসাধারণ বলাবলি করতে লাগল যে শিবাজীর এই কৃতিত্বের মূলে রয়েছে যশোবন্ত সিংহের ষড়যন্ত্র।

অসাধারণ সাহস প্রদর্শনের ফলে বেড়ে গেল শিবাজীর সম্মান। সবাই তাকে মনে করল সাক্ষাৎ শয়তান, কোনো স্থানই যার কাছে অগম্য নয়। ঘটনার কথা শুনে সম্রাট এটাকে ধরে নিলেন তাঁর সুবাদারের অবহেলা এবং অযোগ্যতা। শায়েস্তা খানকে তিনি স্থানান্তরিত করলেন বাংলার রাজ্যপাল হিসেবে (১ ডিসেম্বর, ১৬৬৩), তখন যে প্রদেশে পাঠানোটাকে মনে করা হতো শাস্তিমূলক। ১৬৬৪ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি দাক্ষিণাত্য ত্যাগ করলেন শায়েস্তা খান, আর তার স্থলাভিষিক্ত হলেন শাহজাদা মুয়াজ্জম।

১০.১২ শিবাজীর হাতে সুরাটের প্রথম ধ্বংস

আওরঙ্গাবাদে যখন সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে, শিবাজী ঘটাল এমন এক কাণ্ড, যেমনটা সে এর আগে কখনো ঘটায়নি। ৬ থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সে লুট করল সুরাট শহর, মোগল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সম্পদশালী বন্দর। তখন শহরটার কোনো প্রতিরক্ষাকারী দেয়াল ছিল না। আর ওটার সম্পদ ছিল সীমাহীন। কেবল আমদানি-রপ্তানি শুল্ক থেকেই সম্রাটের আয় হতো বার্ষিক ১২ লাখ টাকা।

সুরাট শহরের আয়তন ছিল প্রায় সাত বর্গমাইল, জনসংখ্যা দুই লাখ। রাস্তাগুলো সরু সরু, বাড়ির বেশির ভাগেরই কাঠের খুঁটি, বাঁশের দেয়াল আর মাটির মেঝে। ইটের পাকা বাড়ি ছিল মোটেই দু-তিনটে।

১৬৬৪ সালের ৫ জানুয়ারি, মঙ্গলবার খুব সকালে একটা সংবাদ পেয়ে সুরাট শঙ্কিত হয়ে উঠল যে একটা সেনাবাহিনী নিয়ে শিবাজী এসে উপস্থিত হয়েছে ২৮ মাইল দক্ষিণের গাবীতে, আর অগ্রসর হচ্ছে শহরটা লুট করার জন্য । অধিবাসীদের বেশির ভাগই স্ত্রী আর সন্তানসহ পালিয়ে গেল নদী পেরিয়ে। ধনীরা সেনাপতিকে ঘুষ দিয়ে আশ্রয় নিল দুর্গে। শহরের প্রশাসক ইনায়েত খান দুর্গে পালিয়ে গেল, শহরটাকে শত্রুর মর্জির ওপর ছেড়ে দিয়ে। সে রাজকোষ থেকে ৫০০ সেনার বেতন নিত, কিন্তু কখনোই একটা নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলতে পারেনি। তার কাপুরুষতা তাকে একটা প্রতিরোধ সংগঠিত করা, এমনকি কর্তব্যপালন করার সময় একটা গৌরবের মৃত্যু থেকেও বঞ্চিত করেছে। ইংরেজ আর ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা যেকোনো মূল্যে তাদের কারখানাগুলোকে রক্ষা করবে বলে স্থির করল।

১৬৬৪ সালের ৬ জানুয়ারি, বুধবার বেলা ১১টায় মারাঠি অশ্বারোহীরা ঢুকে পড়ল প্রতিরোধহীন, প্রায় পরিত্যক্ত শহরটায়, আর লুটপাট চালানোর পর আগুন ধরিয়ে দিল বাড়িগুলোয়। বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার যাবৎ চলল এই ধ্বংসলীলা, হাজার হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেল, ধ্বংস হয়ে গেল শহরের দুই-তৃতীয়াংশ। ওলন্দাজ কারখানার পাশেই বাহারজী বোরার প্রাসাদোপম বাসস্থান। বাহারজীকে তখন বলা হতো পৃথিবীর সেরা ধনী ব্যবসায়ী, তার ধনসম্পদের মূল্য ছিল ৮০ লাখ টাকা। শুক্রবার সন্ধে পর্যন্ত সেখানে দিন-রাত লুটতরাজ চালাল মারাঠিরা, তারপর আগুন লাগিয়ে দিল। ইংরেজদের কারখানার পাশে আরেক খুবই ধনী ব্যবসায়ী হাজি সাঈদ বেগের প্রকাণ্ড বাসস্থান আর বিরাট বিরাট গুদাম। সব অরক্ষিত রেখে সাঈদ বেগ পালিয়ে গিয়েছিল দুর্গে, আর সেখানেও বুধবার বিকেল থেকে সারা রাত আর বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত লুটতরাজ চালাল মারাঠিরা। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে ইংরেজরা এক ঝটিকা আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে শুনে দস্যুরা পালিয়ে গেল তড়িঘড়ি। পরদিন নিজেদের দায়িত্বে প্রহরী নিযুক্ত করল ইংরেজ ব্যবসায়ীরা, ফলে আরও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেল সাঈদ বেগ। সুরাট লুট করে মারাঠিরা পেল এক কোটি টাকারও বেশি।

রোববার বেলা ১০টায় একটা মোগল সেনাবাহিনী আসছে শুনে দলবল নিয়ে সুরাট ত্যাগ করল শিবাজী। সম্রাট শহরের উৎপীড়িত নাগরিকদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে সুরাটের সমস্ত ব্যবসায়ীর এক বছরের আমদানি-রপ্তানি শুল্ক মওকুফ করলেন, আর ইংরেজ এবং ওলন্দাজ ব্যবসায়ীদের সাহসিকতার পুরস্কার দিলেন ভবিষ্যতে তাদের আমদানি শুল্ক বর্তমানের চেয়ে শতকরা এক ভাগ হ্রাস করে।

১৬৬৪ সালে শায়েস্তা খানের চলে যাওয়া থেকে জয় সিংহের আসার মধ্যবর্তী সময়টুকু মোগলেরা কোনো সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না। ওদিকে আওরঙ্গাবাদে বসবাসরত নতুন সুবাদার শাহজাদা মুয়াজ্জম মেতে রইলেন আমোদ-প্রমোদ আর শিকারে।

১০.১৩ শিবাজীর বিপক্ষে জয় সিংহ : পুরন্দর দখল

শায়েস্তা খানের পরাজয় আর সুরাট ধ্বংস আওরঙ্গজেব আর তাঁর দরবারের মানসিক যন্ত্রণার কারণ হলো, তাই সম্রাট মনস্থির করলেন যে এবার তিনি তার সেরা হিন্দু আর মুসলমান সেনাপতি, জয় সিংহ আর দিলির খানকে পাঠাবেন শিবাজীকে দমন করতে।

সম্রাট-বাহিনীর পতাকাতলে জয় সিংহ যুদ্ধ করেছে সাম্রাজ্যের সর্বত্র-মধ্য এশিয়ার বলখ থেকে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর, পশ্চিমের কান্দাহার থেকে পুবের মুঙ্গের। শাহজাহানের দীর্ঘ শাসনকালে এমন একটা বছরও বোধ হয় যায়নি, যখন রাজপুত এই সর্দার কোথাও না কোথাও যুদ্ধ করেনি, বা পদোন্নতি পায়নি যোগ্যতার বলে। কূটনীতিতে তার সাফল্য তার বিজয়ের চেয়েও বড়। যেখানেই কোনো কঠিন বা নাজুক কাজ করার প্রয়োজন পড়েছে, সম্রাট ভেবেছেন জয় সিংহের কথা। অসীম কৌশল আর ধৈর্যের এই মানুষটি যেমন ছিল মুসলমানদের আদব-কায়দায় দক্ষ, তেমনই তুর্কি, ফারসি আর উর্দু ভাষায় দক্ষ, যেমন দূরদর্শী আর রাজনীতিজ্ঞ, তেমনই বীরধর্মী আর বেপরোয়া।

জয় সিংহ সম্রাটকে বলল যে যুদ্ধে থাকা উচিত মূল একটামাত্র মাথা, তা ছাড়া যুদ্ধ খারাপ হতে বাধ্য। সম্রাট তার যুক্তিতে সায় দিলেন, ফলে সামরিক আর বেসামরিক সব কর্তৃত্বই এল জয় সিংহের হাতের মুঠোয়।

খাঁটি একজন সেনাপতির মতো জয় সিংহ তার সদর দপ্তর স্থাপন করল সস্বাদে। পর্যবেক্ষণের জন্য লোহগড়ের উল্টো পাশে বসানো হলো একটা আউটপোস্ট।

৩১ মার্চ জয় সিংহ স্থায়ীভাবে তার সদর দপ্তর স্থাপন করল সস্বাদ আর পুরন্দরের মাঝখানে।

সস্বাদের ছয় মাইল দক্ষিণে খাড়া মাথা উঁচু করে আছে পুরন্দর, যার সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৫৬৪ ফুট। এটা আসলে একটা জোড়া দুর্গ, অপেক্ষাকৃত নিচু দুৰ্গটার নাম বজগড়। জয় সিংহ প্রথমে বজ্রগড়ে আক্রমণ চালাবে বলে স্থির করল।

অবিরাম গোলাবর্ষণ করতে লাগল মোগলেরা, আর সেই গোলায় ধসে পড়ল বজ্রগড়ের সামনের বুরুজ। ১৩ এপ্রিল মাঝরাতে দিলির খানের বাহিনী শত্রুদের তাড়িয়ে নিয়ে গেল একটা ঘেরাওয়ের পেছনে। পরদিন আরও ভেতরে প্রবেশ করল মোগল বাহিনী, দুর্গ আত্মসমর্পণ করল সন্ধেবেলা (১৪ এপ্রিল)।

বজগড় অধিকারে আসায় পুরন্দর দখলের দিকে মোগলেরা এগিয়ে গেল এক ধাপ। দিলির খান এবার নজর দিল পুরন্দরের দিকে, আর জয় সিংহ ধ্বংসলীলা চালাতে লাগল আশপাশের গ্রামে, যেন শিবাজী বুঝতে পারে যে মোগল বাহিনী এতই বড়, যেকোনো সময় দু-একটা দলকে এদিক-সেদিক পাঠানোর ক্ষমতা তারা রাখে। অবশ্য জয় সিংহের সরে যাওয়ার পেছনে গোপন আরেকটা কারণ ছিল। বেশ কজন বিশ্বাসঘাতক অফিসার ছিল তার, যাদের এখানে রাখলে অনেক অপকার হতো। দাউদ খান কোরেশীর ওপর ছিল দুর্গের পেছনের দরজা পাহারা দেওয়ার ভার; কিন্তু কদিন পর জানা গেল যে ওই দরজা দিয়ে একদল মারাঠি প্রবেশ করেছে দুর্গের ভেতরে, অথচ সে কোনো রকম বাধা দেয়নি। শুভ-কর্ন বুন্দেলা সবার আগে লক্ষ রেখেছে শিবাজীর স্বার্থের দিকে!

দিলির খান পরিখা খুঁড়তে খুঁড়তে অগ্রসর হলো পুরন্দরের উত্তর-পুব কোণ অভিমুখে।

মোগলেরা দুর্গের নিচে এসে পৌঁছাতে মারাঠিরা ওপর থেকে ফেলতে লাগল ন্যাপথা তেল, চামড়ার ব্যাগ ভর্তি বারুদ, বোমা আর ভারী ভারী পাথর। ৩০ মে দিলির খানের অজান্তে কিছু রুহেলা সেনা বিদ্যুৎগতিতে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নিল দুর্গের একটা বুরুজ। সামনাসামনি শুরু হলো প্রচণ্ড লড়াই, তবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির পর মারাঠিরা পিছু হটতে বাধ্য হলো। দুদিন পর মোগলদের অধিকারে এসে গেল পাঁচটা বুরুজ। পুরন্দর দুর্গের পতন হয়ে দাঁড়াল স্রেফ সময়ের ব্যাপার।

অবরোধের প্রথমদিকে ৫,০০০ আফগান সেনা এবং অন্যান্য গোত্রের কয়েকটা দল নিয়ে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছিল দিলির খান, এমন সময় সাতশো বাছাই সেনা নিয়ে একটা ঝটিকা আক্রমণ চালাল দুঃসাহসী কিলাদার মুরার বাজী প্রভু। তার মাবলদের হাতে মারা পড়ল ৫০০ পাঠান আর অনেক বালিয়া পদাতিক, আর ষাটজন বেপরোয়া সঙ্গীসহ দিলির খানের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল মুরার বাজী । অতুলনীয় এই সাহস দেখে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলল খান, কথা দিল যে তার জীবন রক্ষা করা হবে, সেই সঙ্গে দেওয়া হবে উচ্চ একটা পদ। ঘৃণাভরে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিলিরকে আঘাত হানতে গেল মুরার, কিন্তু তার আগেই ধরাশায়ী হলো খানের তীরে। তিনশো মাবল নিহত হলো তার সঙ্গে, আর বাকিরা পিছু হটে প্রবেশ করল দুর্গে।

২ জুন জয়লাভ করল মোগলেরা, আর তাদের জয়লাভের অর্থ হলো, পুরন্দরে আশ্রয় নেওয়া মারাঠি সেনা অফিসারদের পরিবারগুলোর বন্দিত্ব আর চূড়ান্ত অসম্মান। তাই জয় সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মোগল বাহিনীর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে চাইল শিবাজী।

১০.১৪ পুরন্দরের চুক্তি, ১৬৬৫

১১ জুন সকাল নয়টায় জয় সিংহ যখন তার তাঁবুতে দরবার নিয়ে বসেছিল পুরন্দরের পাদদেশে, তখন শিবাজী সেখানে এসে উপস্থিত হলে তাকে প্রদর্শন করা হলো যথাযোগ্য সম্মান।

মাঝরাত পর্যন্ত শর্ত নিয়ে চলল দুই পক্ষের দর-কষাকষি। অনেক আলোচনার পর শেষমেশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো তারা যে : (১) ২৩টা যেসব দুর্গ থেকে ৪ লাখ হুন করে আদায় হয় বার্ষিক রাজস্ব হিসেবে, তার সবই সংযুক্ত হবে সাম্রাজ্যের সঙ্গে; এবং (২) রাজগড়সহ যে ১২টা দুর্গ থেকে ১ লাখ হুন করে আদায় হয় বার্ষিক রাজস্ব হিসেবে, ছেড়ে দেওয়া হবে শিবাজীকে এই শর্তে যে সে সম্রাটের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে আর প্রয়োজনে সাম্রাজ্যের সেবা করবে। শিবাজী অবশ্য অনুরোধ করল যে অন্যান্য রাজা আর অমাত্যদের মতো দুরবারে যোগ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না, সে বরং সম্রাটের কিংবা দাক্ষিণাত্যের মোগল সরকারের নিয়মিত সেবায় তার পুত্রকে পাঠাবে ৫,০০০ অশ্বারোহী সেনাসহ।

উপরোল্লিখিত ছাড়াও মোগলদের সঙ্গে শিবাজীর আরেকটা শর্তসাপেক্ষ চুক্তি হলো যে: কঙ্কানের যেসব নিম্নভূমি অঞ্চল থেকে বার্ষিক ৪ লাখ হুন আদায় হয়, আর যেসব উচ্চভূমি অঞ্চল (বালাঘাট বিজাপুরী) থেকে বার্ষিক ৫ লাখ হুন, সেসব যদি মোগলদের প্রত্যাশিত বিজাপুর বিজয়ের পর সম্রাটের ফরমানের বলে তাকে মঞ্জুরি দেওয়া হয়, তাহলে সে ১৩টা বার্ষিক কিস্তিতে সম্রাটকে ৪০ লাখ হুন দিতে রাজি আছে। বলা বাহুল্য, বিজাপুরীদের কাছ থেকে অঞ্চলগুলো দখল করতে চেয়েছে শিবাজী নিজের সেনা দিয়ে। এখানে আমরা জয় সিংহের একটা তীক্ষ্ণধার বুদ্ধির পরিচয় পাই যে এটার ফলে শিবাজী আর বিজাপুরীদের মধ্যে সে জিইয়ে রাখল এক চিরকালীন শক্রতা। পরদিন (১২জুন), চুক্তি অনুসারে ৭,০০০ পুরুষ আর মহিলা পুরন্দর ত্যাগ করল, আর মোগলেরা নিল দুর্গের অধিকার; ভেতরে যেসব মজুত, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ আর অন্যান্য সম্পত্তি পাওয়া গেল, তার সমস্তই ক্রোক করল সরকার। শিবাজীর লোকজনের সঙ্গে মোগল অফিসারেরা গেল মারাঠিদের সমর্পণ করা অন্য পাঁচটা দুর্গের দখল বুঝে নিতে।

১০.১৫ আগ্রায় আওরঙ্গজেবের সঙ্গে শিবাজীর সাক্ষাৎ

বিজাপুরের অভিযান শেষ হওয়ার পর জয় সিংহ অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শিবাজীকে আগ্রায় আসার ব্যাপারে সম্মত করাল। জয় সিংহ শপথ করে বলল যে সেখানে তার কোনো ক্ষতি হবে না। সুতরাং ১৬৬৬ সালের ৫ মার্চ, জ্যেষ্ঠ পুত্র শম্ভুজী, সাতজন বিশ্বস্ত উচচপদস্থ কর্মকর্তা, আর ২৫০ জন সেনা নিয়ে শিবাজী রওনা দিল উত্তর ভারত অভিমুখে । ১১ মে সে এসে পৌঁছাল আগ্রার উপকণ্ঠে ।

দেওয়ান-ই-খাসে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হয়ে উপহার (নজর) হিসেবে শিবাজী সিংহাসনের সামনে রাখল ১,০০০ সোনার মোহর আর ২,০০০ টাকা, আর প্রায়শ্চিত্তমূলক উপঢৌকন (নিসার) ৫,০০০ টাকা। কিন্তু সম্রাট তার সঙ্গে একটা কথাও বললেন না। খানিক পর শিবাজীকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো পাঁচ হাজারি মনসবদারি বা তৃতীয় শ্রেণীর অমাত্যদের সারিতে; যথারীতি এগিয়ে চলল দরবারের কার্যক্রম, শিবাজীর উপস্থিতি যেন ভুলে গেল সবাই ।

এ রকম অভ্যর্থনার কথা শিবাজী কখনোই কল্পনা করেনি।

শহরের বাইরের বড় একটা বাড়িতে শিবাজীকে রাখা হলো রাম সিংহের দায়িত্বে। শিবাজী বুঝতে পারল যে তাকে বন্দী করা হয়েছে। সম্রাটের আদেশে আগ্রার পুলিশপ্রধান ফুলাদ খান, তার বাড়ির চারপাশ ঘিরে বসাল গোলন্দাজ বাহিনীসহ বড়সড় একটা পাহারা । জয় সিংহের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ সভাসদেরা, সম্রাটের হেরেমে বসবাসকারী শায়েস্তা খানের আত্মীয়স্বজন আর যশোবন্ত সিংহের অনুগামীরা একযোগে সম্রাটের কাছে আবেদন জানাল শিবাজীকে হত্যা বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বয়ং জয় সিংহ শিবাজীকে অভয় দেওয়ায় সম্রাট খোলাখুলি কোনো সহিংসতা প্রদর্শনের মতো ভুল করলেন না।

এ রকম ঘটনায় জয় সিংহ পড়ল মহাজ্বালায়। সে বারবার তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রাম সিংহকে চিঠি লিখে সাবধান করে দিল যে কিছুতেই যেন শিবাজীর প্রাণহানি না ঘটে, তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার রাজপুত পিতা-পুত্রের পবিত্র শপথ যেন লঙ্ঘিত না হয়।

১০.১৬ আগ্রা থেকে শিবাজীর পলায়ন

শিবাজী খুঁজতে লাগল মুক্তির পথ । অসুখের ভান করে প্রতিদিন বিকেলে সে মিষ্টি পাঠাতে লাগল ব্রাহ্মণ, ধার্মিক ভিক্ষু আর সভাসদদের জন্য। বড় বড় ঝুড়িতে করে এসব মিষ্টি বহন করত দুজন করে লোক। প্রহরীরা প্রথম কদিন ঝুড়িগুলো পরীক্ষা করল, তারপর আর প্রয়োজন বোধ করল না। ১৯ আগস্ট বিকেলে বাড়ির পাহারাদারদের শিবাজী বলে পাঠাল যে সে খুবই অসুস্থ, কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। তার সত্তাই হীরাজী ফরজন্দ, যে দেখতে অনেকটা তারই মতো, সারা শরীর লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে রইল তার খাটে, কেবল ডান হাতটা বাইরে রইল, যে হাতে রয়েছে শিবাজীর সোনার ব্রেসলেট-ওদিকে শিবাজী আর তার পুত্র মিষ্টির দুটো ঝুড়িতে উবু হয়ে বসে আরও সব আসল মিষ্টির ঝুড়ির সঙ্গে প্রহরীর সারির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল বাইরে।

আগ্রা থেকে ছয় মাইল দূরে ঘোড়াসহ অপেক্ষা করছিল নিরজী রাজী (প্রধান বিচারপতি)। জঙ্গলের ভেতরে সংক্ষিপ্ত একটা আলাপ সেরেই ঘোড়ায় চাপল শিবাজী আর তার পুত্র।

ইতিমধ্যে আগ্রায় হীরাজী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় পড়ে থাকা সত্ত্বেও তার হাতে শিবাজীর সোনার ব্রেসলেট দেখে সন্দেহ জাগল না পাহারাদারের মনে। তারপর সন্দেহ জাগল যখন, পাখি ততক্ষণে উড়ে গেছে বহু দূরে! ফুলাদ খান এই সংবাদ পেয়ে সম্রাটকে বলল যে শিবাজী পালিয়ে গেছে ডাকিনীবিদ্যার বলে । ফুলাদ খান সম্রাটের রোষ থেকে গা বাঁচালেও তাঁর সন্দেহ হলো যে শিবাজীর পালানোর পেছনে কাজ করেছে রাম সিংহের ষড়যন্ত্র। শাস্তি হিসেবে প্রথমে রাজপুত যুবরাজের নিষিদ্ধ হলো দরবারে অংশগ্রহণ, তারপর তাকে বঞ্চিত করা হলো পদ আর মাসোহারা থেকে।

নিখুঁত ধূর্ততায় শিবাজী ধুলো দিল তার অনুসরণকারীদের চোখে। মহারাষ্ট্রে যাওয়ার স্বাভাবিক পথ আগ্রা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের মালওয়া আর খান্দেশ হয়ে না গিয়ে সে গেল পুবের মথুরা আর বুন্দেলখণ্ড হয়ে আর তারপর দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে গন্দোয়ানা আর গোলকুণ্ডার ভেতর দিয়ে রাজগড় পৌঁছাল ১৬৬৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর।

আগ্রা থেকে বাড়ি ফিরে শিবাজী দেখল, দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। বয়স, পরিশ্রম, বিজাপুর আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে প্রভুর চোখে কলঙ্কিত হওয়ার হতাশা, সব মিলিয়ে যেন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে মীরজা রাজা জয় সিংহ। ১৬৬৭ সালের মে মাসে জয় সিংহের হাত থেকে সুবাদারি গেল শাহজাদা মুয়াজ্জমের হাতে, আর রাজপুত সর্দার বুরহানপুরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করল ২৮ আগস্ট।

দুর্বল আর অলস মুয়াজ্জম আর বন্ধুভাবাপন্ন যশোবন্ত দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতায় আসায় মোগলদের কোনো ভয়ই আর শিবাজীর রইল না। ১৬৬৭ সালের অক্টোবরে দিলির খান এসে শাহজাদা মুয়াজ্জমের সঙ্গে যোগদান করল বটে, কিন্তু বিখ্যাত এই যোদ্ধার আগমনে মোগলদের কোনো শক্তিবৃদ্ধি হলো না। পিতার দরবারে দিলিরের প্রভাব আর সম্মানকে শাহজাদা কেবল ঈর্ষার চোখেই দেখতেন না, তাকে মনে করতেন তার পিতার একজন গুপ্তচর। পক্ষান্তরে, গর্বিত রুহেলা সেনাপতি প্রকাশ্যেই অবজ্ঞা করত শাহজাদার ডান হাত আর অন্তরঙ্গ মহারাজা যশোবন্ত সিংহকে। এই সংঘাত নিয়ে মোগল শিবিরে একটা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও গেছে, আর শিবাজীর বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি।

মারাঠি সর্দার অবশ্য সম্রাট-বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করায় আগ্রহী ছিল না। আগ্রা থেকে বাড়ি ফেরার পর তিন বছর সে শান্তই রইল। সম্রাটের সঙ্গে শান্তিস্থাপনের জন্য যশোবন্ত সিংহকে সে মধ্যস্থতাকারী হওয়ার একান্ত অনুরোধ জানাল। সে মহারাজাকে চিঠি লিখল, আমার রক্ষক, মীরজা রাজা, মারা গেছেন। আপনার মধ্যস্থতায় আমাকে যদি ক্ষমা করা হয়, তাহলে আমার অনুসারীদের প্রধান করে শঙ্কুকে আমি মনসবদার হিসেবে পাঠাব। সে শাহজাদার হুকুম তামিলের অপেক্ষায় থাকবে, আর প্রয়োজনে যেকোনো স্থানে যাবে সেবা দিতে।

যশোবন্ত সিংহ আর শাহজাদা মুয়াজ্জম এই প্রস্তাব লুফে নিলেন, আর শিবাজীর বিষয়ে আওরঙ্গজেবের কাছে সুপারিশ করলে তিনিও গ্রহণ করলেন প্রস্তাবটা। সম্রাট শিবাজীকে ভূষিত করলেন রাজা’ পদবিতে (১৬৬৮ সালের প্রথমে), কিন্তু চাকন ছাড়া তার আর কোনো দুর্গ ফিরিয়ে দিলেন না। এই শান্তি স্থায়ী হলো দুই বছর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *