১৯. আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও তার শাসনামলের প্রভাব

১৯. আওরঙ্গজেবের চরিত্র ও তার শাসনামলের প্রভাব

১৯.১ শান্তিই ভারতের উন্নতির মূল

বাইরের পর্যবেক্ষকদের মনে হবে, আওরঙ্গজেবের সিংহাসনারোহণের সময় মোগল সাম্রাজ্য তার জাঁকজমক আর শক্তির শিখরে উঠেছে। তার মতো শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন প্রশাসক আর অভিজ্ঞ সেনাপতির হাতে যখন পড়ল সম্পদশালী এই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার, যিনি কিনা ব্যক্তিগত জীবনেও নিতান্ত সরল আর সম্পূর্ণ সৎ, সব মানুষ আশা করল যে মোগল সাম্রাজ্যকে তিনি পৌঁছে দেবেন। যশের অকল্পনীয় উচ্চতায়। অথচ আওরঙ্গজেবের দীর্ঘ আর শ্রমসাধ্য শাসনামল পর্যবসিত হলো ব্যর্থতা আর দুর্দশায়। কেন ঘটল এমন অদ্ভুত ঘটনা-তা তদন্ত করা ঐতিহাসিকগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

ভারতের মতো একটা গরম আর উর্বরা দেশে-যেখানে অকৃপণ প্রকৃতি দ্রুত সারিয়ে দেয় হিংস্র মানুষ আর হিংস্র পশুর ধ্বংসলীলার ক্ষত-অন্যান্য দেশের তুলনায় শৃঙ্খলাই হলো জীবনের মূল সুর। শান্তি পেলে ভারতের মানুষ তাদের সম্পদ, শক্তি আর সভ্যতা এত দ্রুত বৃদ্ধি করতে পারে যে তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে কেবল প্রথম মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পর এখানকার গাছপালার বৃদ্ধি। সম্রাট আকবর আর তাঁর পুত্র এবং নাতির এক শতাব্দীর শক্তিশালী আর বিজ্ঞ শাসন ভারতীয়দের ঠিক এই শান্তিই দিয়েছিল। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পরের একশো বিজয় ভারতীয়দের বিশ্বাস করিয়েছিল যে মোগল সেনাবাহিনী অপরাজেয় আর মোগল ভূখণ্ড অলঙ্ঘনীয়। শিবাজী ভেঙে দেয় এই সম্মোহন। মোগল শান্তি মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র ন্যায্যতা-ভারত থেকে অন্তর্হিত হয় আওরঙ্গজেবের মৃত্যুতে।

ভারতের মতো সেরা একটা কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকেরাই জাতীয় সম্পদের একমাত্র উৎস। এমনকি শিল্পী আর কারিগরেরাও তাদের পণ্য বিক্রির জন্য কৃষকের ওপর নির্ভর করে; কৃষক যদি উদ্বৃত্ত খাদ্য না ফলায়, তাহলে ক্রয়ের ক্ষমতা ক্রেতার থাকে না। অতএব ভারতে কৃষক শ্রেণীর ধ্বংসের অর্থ হলো অ কৃষক শ্রেণীরও ধ্বংস। শান্তি আর সম্পদের নিরাপত্তা কেবল কৃষক আর শিল্পীদের জন্যই নয়, ব্যবসায়ীদের জন্যও দরকার । অশান্তি এই দেশে জাতীয় মূলধন বৃদ্ধি থামিয়ে দেয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করে। ভারতে বিশৃঙ্খলা আর নিরাপত্তাহীনতায় অশান্তির রয়েছে এমনই এক সর্বজনীন আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। এবং আওরঙ্গজেবের শাসনামল এই সত্যের জলজ্যান্ত উদাহরণ।

১৯.২ আওরঙ্গজেবের অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহের ফলে অর্থনৈতিক ভাঙন

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের সিকি শতাব্দীর যুদ্ধবিগ্রহের ফলে যে অর্থনৈতিক ভাঙন হয়েছিল, তা আকারে ভয়ংকর আর প্রভাবে অতি দূর প্রসারিত আর দীর্ঘস্থায়ী । সম্রাট-বাহিনীর আক্রমণ, বিশেষ করে তাদের অসংখ্য অবরোধ, বন আর ঘাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল। সরকারি হিসাবে মোগলদের ১,৭০,০০০ সেনার বিশাল বাহিনী আর সম্ভবত তার দশ গুণ অসামরিক লোক, যেখানেই গেছে সেখানে সবুজ বলতে আর কিছু রাখেনি। পাশাপাশি, লুটের যে মালই নিয়ে যেতে পারেনি, ধ্বংস করে দিয়েছে মারাঠিরা, তাদের ঘোড়াগুলোকে খাইয়েছে দণ্ডায়মান শস্য, বহন করা সম্ভব নয় বলে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে বাড়ি । অতএব, অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ১৭০৫ সালে সর্বশেষ অভিযান সেরে আওরঙ্গজেব যখন অবসর নিলেন, দেশ হয়ে গিয়েছিল ধ্বংসের প্রতিমূর্তি। বনশূন্যতা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল কৃষির ওপর । অন্তহীন যুদ্ধ সরকার আর সাধারণ মানুষ উভয়কে এত গরিব করে ফেলেছিল যে নষ্ট হয়ে যাওয়া দালান আর রাস্তা মেরামত করার ক্ষমতাও তাদের ছিল না।

জনসাধারণ কেবল বন্দিত্ব, অনিচ্ছাকৃত শ্রম দেওয়া আর অনাহারেই ভোগেনি, এসবের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে মহামারী। দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে বার্ষিক লোকক্ষয় হয়েছে এক লাখ এবং ঘোড়া, বলদ, উট আর হাতি তিন লাখ। গোলকুণ্ডা অবরোধের সময় (১৬৮৭) এল এক দুর্ভিক্ষ। হায়দরাবাদ শহরে বাড়ি, নদী আর সমভূমি ভরে গেল লাশে। ক্রোশের পর ক্রোশ চোখে পড়ল কেবল লাশের স্তূপ। অবিরাম বৃষ্টিপাতে খুলে গেল সেগুলোর মাংস আর চামড়া। কয়েক মাস পর বৃষ্টি থামতে দূর থেকে সাদা হাড়গুলোকে মনে হলো বরফের পাহাড়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে রোগের পাশাপাশি দাক্ষিণাত্যে দেখা দিল বন্যা, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অসময়ের বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রায় একপুরুষ ব্যাপী যুদ্ধবিগ্রহ নিঃশেষ করে ফেলেছে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়, ফলে যখন দুর্ভিক্ষ আর অনাবৃষ্টি এসেছে, কৃষক আর ভূমিহীন শ্রমিকেরা অসহায়ভাবে মরেছে কীটপতঙ্গের মতো। জিনিসের অভাব লেগেই থেকেছে সম্রাট-শিবিরে, দুর্ভিক্ষে তা আরও বেড়েছে। অতীতের অতি সস্তা শস্যের গল্প ভারতের অনেক জায়গায় বর্তমানে পরিণত হয়েছে বিস্মৃত প্রবাদে।

১৯.৩ যুদ্ধ সৃষ্ট বাণিজ্য এবং শিল্পের ক্ষতি, বিশৃঙ্খলা, আর কর্মচারীদের আদায়

দেশের নানা জায়গায় শান্তি আর নিরাপত্তা না থাকায় বাঁচার তাগিদে কৃষকেরা হলো রাহাজান। দাক্ষিণাত্যে তারা অস্ত্র জোগাড় করে যোগ দিল মারাঠিদের আক্রমণে, আর এভাবে তাদের বেকারত্ব ঘোচাল। অশান্তির এই সিকি শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যে বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। শক্ত পাহারা ছাড়া নর্মদার দক্ষিণে কাফেলা চলাচল করতে পারল না। মারাঠি বিশৃঙ্খলায় এমনকি সম্রাটের চিঠি আটকে থাকল মাসের পর মাস।

যেখানে যুদ্ধ হলো না (যেমন বাংলায়), সেখানেও কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক সরকারেরা সম্রাটের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে মেতে উঠল বেআইনি আদায়ে। নিরাপত্তার অভাবে দেয়ালঘেরা শহর ছাড়া বন্ধ হয়ে গেল শিল্পের অনুশীলন। পল্লিশিল্প আর শিল্পপণ্যোৎপাদী শ্রেণী প্রায় খতম হয়ে গেল।

আগুয়ান মোগল সেনাদের পায়ের নিচে পড়ে ধ্বংস হয়ে গেল শস্য। সম্রাট যদিও বিশেষ কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন কৃষকদের ক্ষতিপূরণের জন্য (পয়মালি ই-জারাইত), তার অর্থনৈতিক অসুবিধা মানবিক এই আইন অবহেলায় বাধ্য করাল। কৃষকদের সবচেয়ে বড় অত্যাচারী ছিল সেনাবাহিনীর পেছনভাগ। বিপুলসংখ্যক ভৃত্য, দিন মজুর, দরবেশ আর অন্যান্য ভবঘুরের দল আওরঙ্গজেবের ‘চলমান উঁবুর শহর’ অনুসরণ করত কিছু উচ্ছিষ্ট পাওয়ার আশায়। সেনাবাহিনী আর চাকরির সন্ধানে ঘোরা আফগানদের উট ভাড়া দেওয়া বেলুচ মালিকরা গ্রামবাসীদের করত লুটপাত আর নির্মম প্রহার। বানজারা বা শস্য সরবরাহকারী উপজাতিগুলো চলাচল করত বড় বড় দল বেঁধে, পথের পাশে লুটপাট চালাত, আর তাদের গবাদিপশুকে খাওয়াত কৃষকের শস্য। এমনকি সরকারি চিঠিপত্র, গুপ্তচরদের রিপোর্ট, আর উপহার হিসেবে সম্রাটের জন্য ফলবোঝাই ঝুড়ি বহনকারী সাম্রাজ্যিক দূতেরাও লুটপাট চালাত পথে-পড়া গ্রামে। মারাঠি সেনাদের পেছনভাগে থাকত বেরাদ আর পিণ্ডারিরা-যারা জন্মগতভাবেই রাহাজান।

এসব ছাড়াও ছিল যাতায়াত করা প্রতিদ্বন্দ্বী জায়গিরদারদের দেওয়ান। কোনো জায়গিরদার একটা জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কৃষকদের যথাসাধ্য নিংড়ে নিত তার দেওয়ান, আবার নতুন যে জায়গিরদার আসত সেখানে, তার দেওয়ান প্রবল উদ্যমে আধমরা কৃষকদের ঢোকাত টাকা আদায়ের জাতাকলে ।

১৯.৪ মোগল সরকারের দেউলিয়া অবস্থা

ইংরেজদের ভারত জয়ের পর তাদের শাসকদের চরিত্র ছিল যেন একে অন্যের পরিপূরক। উদাহরণস্বরূপ, ক্লাইভের যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক শূন্যতা পূরণ করেছিল হেস্টিংস। আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে ঘটনা তেমন ছিল না। ১৬৭৯ সালের পর তাঁর শাসনামল ভরা কেবল যুদ্ধবিগ্রহে। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, ভবিষ্যৎ যুদ্ধের সঞ্চয় বা প্রজাদের দম ফেলার জন্যও যে বিরতি দরকার তা তিনি উপলব্ধি করেননি। অবিরাম যুদ্ধ নিঃশেষ করে ফেলেছে তাঁর হাল রাজস্ব, ১৬৭৯ সালে হিন্দুদের ওপর আরোপিত নতুন কর (জিজিয়া), এমনকি আগ্রা আর দিল্লি দুর্গের ভল্টে রক্ষিত তাঁর পূর্বপুরুষদের ধনের সঞ্চয়।

সাম্রাজ্য দেউলিয়া হলে জনসাধারণের দেউলিয়া অবস্থা অবশ্যম্ভাবী । তিন বছর বেতন না পেয়ে সেনারা শুরু করল সেনাপতির অর্থ ব্যবস্থাপককে অকথ্য গালাগাল বা প্রহার। যে দুর্গই আত্মসমর্পণ করল, মোগল সরকার সেটার কিলাদারের কাছ থেকে নিল বিশাল অঙ্কের টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি, অনেক সময়েই যে প্রতিশ্রুতি পালন করা ছিল অসম্ভব। জায়গিরদারদের জন্য জমি বন্দোবস্তের যে আদেশ দেওয়া হতো, সেই আদেশ থেকে যেত কেবল কাগজেই; শ্লেষাত্মকভাবে বলা হতো, আদেশ জারির পর জমির দখল পেতে যে সময় লাগত, তা একজন বালকের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অনেক সময় দুর্গের দখল নেওয়া হতো ঘুষ দিয়ে । এভাবে ছোট একটা মারাঠি পাহাড়ে-দুর্গের দখল নিতেও লাগত ৪৫,০০০ টাকা। তার পরও জেদির মতো তিনি একের পর এক দুর্গ দখল করছিলেন হয় মোটা ঘুষ দিয়ে, নয়ত অবরোধ করে। অবশ্য অবরোধ করলে খরচ হতো দশ গুণ।

শেষমেশ দাক্ষিণাত্যে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ল মোগল সেনাদের মনোবল । কিন্তু আওরঙ্গজেব কোনো প্রতিবাদ বা বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ শুনতে রাজি নন। এমনকি যখন তার প্রধান উজির আসাদ খান বিজাপুর আর গোলকুণ্ডা জয়ের পর তাঁকে পরামর্শ দিলেন যে করার মতো কোনো কাজই আর সম্রাটের বাকি নেই, সুতরাং এবার দিল্লি ফেরা যেতে পারে, তাকে কঠোর তিরস্কার করলেন আওরঙ্গজেব, ‘আপনার মতো একজন বিজ্ঞ কর্মচারী এমন কথা বলেন কী করে ভেবে পাই না …যতক্ষণ এই দেহে একটা দম অবশিষ্ট আছে, কাজ থেকে কোনো ছুটি নেই।

মোগল অনুসারীদের একটা পুরুষ বেড়ে উঠেছিল দাক্ষিণাত্যে, তারা কখনো প্রবেশ করেনি কোনো শহরে, দেখেনি কোনো ইট বা পাথরের বাড়ি, পুরো জীবন তাদের কেটে গেছে তাঁবুতে, এক শিবির থেকে আরেক শিবিরে কুচকাওয়াজ করতে করতে। রাজপুত সেনারা অভিযোগ করেছে যে তাদের আগামী পুরুষ আর মোগল সাম্রাজ্যের সেবা করতে পারবে না, কারণ, দাক্ষিণাত্যের অভিযানেই অতিবাহিত হয়ে চলেছে তাদের জীবন, এমনকি বাড়ি ফিরে সন্তান উৎপাদনের ফুরসতও তাদের নেই। দাক্ষিণাত্যের এক গৃহ-কাতর অমাত্য কেবল দিল্লিতে বদলির জন্য সম্রাটকে দিতে চেয়েছিল এক লাখ টাকা ঘুষ ।

উল্লেখ্য, সম্রাট যে সেনাদের হতাশা বুঝতেন না, এমনটা বোধ হয় না। একবার শাহজাদা মুয়াজ্জমকে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন, এভাবে মরুভূমি আর বন পেরিয়ে অবিরাম এগিয়ে চলার জন্য আমার সেনা অফিসারেরা আমার মৃত্যু কামনা করবে।

১৯.৫ প্রশাসনিক পতন আর জনসাধারণের অশান্তি

দাক্ষিণাত্যের স্ফীত ব্যয় আর অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহ উত্তর ভারতে ফেলল এক প্রতিকূল প্রভাব। নিঃশেষ হয়ে গেল পুরনো, শান্তিপূর্ণ আর উন্নতিশীল প্রদেশগুলোর মানুষ, সম্পদ আর প্রতিভা। তাদের সেরা সেনা, সর্বোচ্চ অফিসার, আর যাবতীয় রাজস্ব পাঠিয়ে দেওয়া হতে লাগল দাক্ষিণাত্যে, ওদিকে হিন্দুস্তানের অন্যান্য সুবাগুলো শাসিত হতে লাগল নিমপদস্থ অফিসারদের হাতে। মাথাচাড়া দিল বিরোধীরা, আর অত্যাচার শুরু করল তাদের দুর্বল প্রতিবেশীর ওপর। সর্বজনীন এক অশান্তিতে কমে গেল কৃষকদের খাজনা আদায় ।

রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় জায়গিরদের কাছ থেকে আসা টাকার পরিমাণ কমে গেল ক্রমেই; এই আয় কমার ফলে কমল সেনাদের বেতন; আর সেনাদের শক্তি কমার ফলে বাড়ল অপরাধ ।

যুদ্ধই রাজপুতদের একমাত্র পেশা, ক্ষত্রিয় গোত্রভুক্ত সমস্ত হিন্দুরও। সাম্রাজ্যিক পতাকার তলে রাজপুতেরা যুদ্ধ করেছে মধ্য এশিয়া আর কান্দাহারে। কিন্তু আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সামরিক কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ থেকেছে সীমান্তের ভেতরে, যদিও কাবুল আজও সাম্রাজ্যের একটা অংশ। দাক্ষিণাত্যের অবশিষ্ট ছোট রাজ্যগুলোও সংযুক্ত করায় রাজপুতেরা বেকার হলো দুভাবে-প্রথমত, আওরঙ্গজেবকে নিয়োগ দিতে হলো রাজাহীন রাজ্যগুলোর সেনাকে, এবং দ্বিতীয়ত, জয় করার মতো রাজ্য তার এক রকম অবশিষ্ট আর নেই বলে। এই পরিস্থিতিতে রাজপুতদের সামনে ভোলা থাকল কেবল জ্ঞাতিদের সঙ্গে যুদ্ধ করা, ডাকাতিকে পেশা হিসেবে নেওয়া, বা আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে তালুক পাওয়ার খাতিরে ধর্মান্তরিত হওয়া।

১৯.৬ আওরঙ্গজেবের অধীনে ভারতীয় সভ্যতার পতন, তার কারণ আর চিহ্ন

আকবর আর শাহজাহান যে শৈল্পিক মানুষকে লালন করেছেন, তাদের ছিল বহুমুখী প্রতিভা, কিন্তু আওরঙ্গজেবের সময়ে তারা প্রায় উবে গেল, শিবির আর দরবারে তাদের জায়গা নিল প্রতিভাহীন মানুষ, যারা ধীরে ধীরে গ্রহণ করল মোসাহেবের ভূমিকা। আওরঙ্গজেবের সুদীর্ঘ জীবনে ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়েছে অভিজ্ঞতা আর তথ্যের ভাণ্ডার, মেধাবিচারে তরুণ প্রজন্ম ছিল তার তুলনায় বামন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে তার স্বয়ংসম্পূর্ণতা আর একগুঁয়েমি; শেষমেশ কেউ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সাহস পায়নি, কেউ দিতে পারেনি সৎ পরামর্শ বা জানাতে পারেনি অপ্রিয় সত্য । অবিরাম যুদ্ধবিগ্রহের ফলে অবসরের অভাবে পতন হয়েছে অভিজাতদের সংস্কৃতির, সেই সঙ্গে পিছিয়ে গেছে ভারতের সমস্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী।

প্রাচ্যের মানুষের অভ্যাস হলো, অতীতের একটা স্বর্ণযুগের কথা ভেবে বর্তমান প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে হা-হুঁতাশ করা যে তারা তাদের মহিমান্বিত পূর্বপুরুষদের মতো হতে পারেনি। ঐতিহাসিক ভীমসেন আর খাফি খানও তেমনই বর্তমান ভারতের দিকে তাকিয়ে হা-হুঁতাশ করেছেন আকবর আর শাহজাহানের যুগের মহিমার কথা ভেবে বৃদ্ধ আওরঙ্গজেবও শোকাতুর ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে তাঁর মৃত্যুর পর আসবে একটা মহাপ্লাবন। হতাশাপীড়িত একজন মানুষকে সাদুল্লাহ যথার্থ জবাব দিয়েছেন, কোনো যুগই সামর্থ্যহীন মানুষে পূর্ণ নয়। দরকার কেবল একজন বিজ্ঞ প্রভুর যে খুঁজে বের করবে সেসব যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ, তাদের লালন করবে, নিজের কাজ করিয়ে নেবে তাদের দিয়ে, আর শুনবে না তাদের বিপক্ষে স্বার্থপরের কানাঘুষা।’ কিন্তু আওরঙ্গজেব তার শাসনামলের পরের দিকে এই বিজ্ঞ নীতি মানেননি, আর তার উত্তরসূরিরা এটাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। আওরঙ্গজেবের অধীনে গোঁড়ামি আর দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং পরবর্তী মোগলদের কলুষতা আর আলসেমি ধ্বংস করে দিয়েছে সাম্রাজ্যের প্রশাসন আর পতনোন্মুখ সাম্রাজ্যের সঙ্গেই টেনে নিচে নামিয়েছে ভারতবাসীকে।

১৯.৭ অভিজাত মোগলদের নৈতিক অধঃপতন

অভিজাতদের নৈতিক পতন ডেকে এনেছে সবচেয়ে অমঙ্গল। মোগল বংশের নৈতিক অধঃপতনের একটা উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আছে। প্রধানমন্ত্রীর নাতি মীর্জা তাফাখখুর তার দিল্লির প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে, গুন্ডাদের নিয়ে লুটপাট করত দোকান, সবার চোখের সামনে উঠিয়ে নিয়ে যেত হিন্দু মেয়েদের; তবু ছিল না তাকে শাস্তি দেওয়ার মতো কোনো বিচারক, তার অপরাধে বাধা দেওয়ার মতো কোনো পুলিশ। প্রত্যেকবার এ রকম ঘটনার অভিযোগ যেত সম্রাটের কাছে, সম্রাট সেটা পাঠিয়ে দিতেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে।

মোগল অভিজাতরা যে বিলাসিতা করত, তা পারস্য মধ্য এশিয়ার রাজারাও কল্পনা করেনি। তাদের হেরেমে থাকত নানা জাতির অসংখ্য মেয়ে, ফলে চলত সেখানে অবাধ যৌনতা, আর কুৎসিত সেই পরিবেশেই বেড়ে উঠত তাদের সন্তান। আইনজাত সন্তানের পাশাপাশি রক্ষিতাদের অনেক সন্তানও জন্ম নিত সেখানে।

মোগল অভিজাত শ্রেণীর সন্তানদের না ছিল কোনো ভালো শিক্ষা, না কোনো বাস্তব প্রশিক্ষণ । লালিতপালিত হতো তারা খোঁজা আর মহিলা-ভৃত্যের কাছে। তাদের গৃহশিক্ষকেরা ছিল এক অসুখী শ্রেণী, চলতে হতো তাদের ছাত্রের ইচ্ছেয়, হজম করতে হতো হারেমের খোঁজা আর মেয়েদের চোখরাঙানি, মানতে হতো দরবারের কেতা, নয়ত ছেড়ে দিতে হতো চাকরি। এমনকি স্বয়ং আওরঙ্গজেবের সন্তান, শাহ আলম আর কাম বখশকেও সংশোধন করা যায়নি। তাদের উপদেশ দিতে দিতে ক্লান্ত আওরঙ্গজেব হতাশায় চিৎকার দিয়ে উঠেছিলেন, কথা বলতে বলতে আমি হয়ে গেছি বকবক করা এক মানুষ; কিন্তু তোমরা কেউই আমার কথায় কান দাওনি।

লাগামহীন যৌনসংসর্গ আর গোপন মদ্যপান ও জুয়োখেলার পাশাপাশি অনেক অভিজাতের ছিল সমকামের জঘন্য অভ্যাস, কলঙ্কজনক যে অভ্যাস থেকে তথাকথিত অনেক সাধুও মুক্ত নয়। আওরঙ্গজেবের যাবতীয় নিষেধাজ্ঞাও মোগল অভিজাতদের মদ্যপানে বিরত করতে পারেনি।

১৯.৮ প্রচলিত কুসংস্কার

সব শ্রেণীর মানুষের ছিল নানা রকম কুসংস্কার। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বিশ্বাস করত জ্যোতিষশাস্ত্র । হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে করত স্মৃতিচিহ্নের পূজা। তবে জনসাধারণের পক্ষে সবচেয়ে অবমাননাকর ছিল মানব-পূজা। গুরু আর মহন্তদের পূজা করত হিন্দু আর শিখো, ওদিকে মুসলমানেরা করত সাধু আর ধার্মিক ভিখারিদের পূজা এবং আশা করত যে তারা ঘটাবে অলৌকিক ঘটনা, তাদের দেবে কবচ, মন্ত্র বা বিস্ময়কর ওষুধ। রমরমা ব্যবসা করত ভণ্ড জাদুকরেরা, বিশ্বাসে গদগদ মানুষকে তারা দিতে চাইত পরশপাথর।

কুসংস্কারের রয়েছে গভীর অন্ধকার দিক, যা মোটেই অভিপ্রেত নয়; শোনা গেছে সোনা বা অমর জীবন লাভের আশায় নরবলি দেওয়ার কথা, যদিও আইনত এটা দণ্ডনীয় অপরাধ, আর এই অপরাধে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে দেওয়া হয়েছে কঠোর শাস্তি। কোনো কোনো মুসলমান ডাক্তার তাদের রোগীকে সুস্থ করে তোলার জন্য ব্যবহার করত মানুষের চর্বি। হিন্দুরা লম্বা বাহুযুক্ত মানুষের পূজা করত তাদের বানর-দেবতা হনুমানের অবতার ভেবে।

অজ্ঞতা আর গর্বের স্বাভাবিক পরিণতিতে, সব শ্রেণীর মানুষ বিদেশিদের ঘৃণা করত। সত্য যে ইয়োরোপিয়ান কামান-ঢালাইকারী, গোলন্দাজ আর কিছু ডাক্তারের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ধনীরা, কারণ, চোখের সামনে তারা দেখেছে তাদের অধিকতর যোগ্যতার প্রমাণ, তা ছাড়া তারা খুবই পছন্দ করত ইয়োরোপিয়ান বিলাসদ্রব্য। কিন্তু ভারতীয় কোনো অমাত্য বা পণ্ডিত কখনোই শিখতে চায়নি ইয়োরোপিয়ান ভাষা, শিল্পকলা কিংবা সামরিক পদ্ধতি।

উল্লেখ্য যে মোগল দরবারে আসা ইয়োরোপিয়ান অতিথিদের দোভাষীর কাজ করত আর্মেনিয়ান বা ফারসি জানা ইয়োরোপিয়ানরা। আওরঙ্গজেবের একটা চিঠি পড়ে জানা যায়, মুতামাদ খান নামক একমাত্র মুসলমান ইংরেজি ভাষা জানত। গোঁয়ার কিছু সেনভী ব্রাহ্মণ পর্তুগিজ ভাষা জানত, যারা বোম্বের ইংরেজদের সুবিধার্থে মারাঠি দলিলপত্র অনুবাদ করেছে পর্তুগিজে। মাদ্রাজে ইংরেজ আর ফরাসিদের কারখানায় নিয়োগ দেওয়া হতো ব্রাহ্মণ দোভাষীদের, যারা ইংরেজি আর ফরাসি ভাষা ছাড়াও জানত ‘মুর’ (অর্থাৎ, ফারসি)।

১৯.৯ আমলাতান্ত্রিক ঘুষ; আমলাদের জীবন ও চরিত্র

হাতেগোনা কিছু ডাক্তার আর যাজক পরিবার বাদ দিলে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রায় সবাই ছিল আমলা। ব্যবসায়ী আর ছোট ভূস্বামীদের মধ্যে অনেকে সম্পদের বিচারে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সমান হলেও শিক্ষায় বা চর্চিত সাহিত্যে ছিল না। মোগল প্রশাসন, বেসামরিক আর সামরিক উভয়ই, চালাত কেরানি আর হিসেবরক্ষকদের বিরাট দল। তাদের বেতন ছিল খুবই কম।

সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম শ্রেণীর অনেক আমলা ঘুষ খেত, আর তার বিনিময়ে মক্কেলকে দিত অন্যায় সুবিধা বা বিচার পরিচালিত করত ভিন্ন পথে। অবশ্য আমলাদের এই দুর্নীতি সমাজে নিন্দিত ছিল, তাই সেটা করা হতো গোপনে।

সম্রাটকে ঘিরে থাকা মন্ত্রী বা প্রভাবশালী সভাসদদের অনেকে প্রচুর আয় করত কোনো আমলাকে ভালো জায়গায় বদলি করার বিনিময়ে। আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত সঙ্গী কাবিল খান এভাবে মাত্র ২.৫ বছরে পেয়েছিল নগদ ১২ লাখ টাকা, মূল্যবান জিনিসপত্র আর একটা নতুন বাড়ি।

কায়স্থ আর খতরি, উভয় জাতের কেরানিদের মধ্যে ছিল ব্যাপক মদ্যপানের অভ্যাস, আর ছিল রাজপুত সেনাদের মধ্যে। কুরআনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মুসলমান অমাত্য আর আমলাদের অনেকেই ছিল মদ্যপানে আসক্ত। আর এই বিষয়ে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল তুর্কিরা। বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে কাজ করতে হতো বলে পাতি আমলারা পুষত স্থানীয় রক্ষিতাদের ছোটখাটো হেরেম।

১৯.১০ সাধারণ জনজীবনের অনাবিলতা আর আনন্দ

মোগল ভারতের সমাজ জীবনের এ যাবৎ যে চিত্র আঁকা হলো, তা যেন গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা, তাই তার সঙ্গে আরও কিছু দৃশ্য যোগ করা দরকার, তা ছাড়া চিত্র অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা স্বীকার করতে বাধ্য যে কোটি কোটি ভারতীয় মানুষের পারিবারিক জীবনে ছড়িয়ে আছে অনাবিলতা আর আনন্দ। আমাদের আছে অনেক প্রচলিত গান, গাথা আর গল্প, যা অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করে, শেখায় বীরোচিত ধৈর্য, আর সবচেয়ে অশিক্ষিত মনেও জাগায় কোমলতা। আজও বার্ষিকভাবে জনসমক্ষে অভিনীত হয় তুলসী দাসের মহাকাব্য, আবৃত্ত হয় হিন্দিভাষী মানুষের ঘরে ঘরে, আমাদের কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ভরিয়ে তোলে কর্তব্যের প্রতি ভালোবাসায়, পুরুষোচিত আচরণে, আর আত্মত্যাগের তেজে, শিক্ষা দেয় তাদের প্রকাশ্য এবং ব্যক্তিগত জীবনের জ্ঞান।

বাংলা, বিহুত, উড়িষ্যা, আসাম এবং অন্যান্য কিছু স্থানে শঙ্করদেব আর চৈতন্যের শিক্ষা দেওয়া বৈষ্ণবধর্ম সূচিত করেছে অনভ্যস্ত এক ভদ্রতা, রুক্ষকে করেছে মার্জিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তাদের নিজস্ব লোকগীতি, যেমন, পাঞ্জাবে রয়েছে হীর আর রনঝার গাথা। এবং ভারত জুড়েই জনপ্রিয় হলো কীর্তন-ধর্মোপদেশ, বক্তৃতা আর সাহিত্যের বিকল্প হিসেবে।

হিন্দিভাষীরা ছাড়া সেই আমলের মুসলমানদের ছিল না স্বদেশীয় ভাষার কোনো ধর্মীয় কবিতা। কিন্তু তাদের ছিল বিভিন্ন সাধুর সমাধিতে গিয়ে বার্ষিক উরস উদযাপন। দূরদূরান্ত থেকে সেসব উরসে যেত হাজার হাজার মানুষ। সব ধর্মের নারী-পুরুষ আকৃষ্ট হতো সেখানকার মেলায় । আজমীর, কুলবর্গা, নিজাম উদ-দীন আউলিয়া আর বুরহানপুরের মতো মুসলমানদের তীর্থস্থান এবং মথুরা, এলাহাবাদ, বেনারস, নাসিক, মাদুরা আর তাঞ্জোরের মতো হিন্দুদের তীর্থস্থান, ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিত সংস্কৃতি, ভেঙে ফেলত প্রাদেশিক বিচ্ছিন্নতা, আর দূর করত মনোদিগন্তের সংকীর্ণতা।

১৯.১১ আওরঙ্গজেবের চরিত্র

মধ্যযুগীয় পৃথিবীতে আর অন্য সব দেশের চেয়ে বিশেষ করে ভারতে যুক্তিসম্পন্নভাবেই মনে করা হতো যে প্রজাদের সুখ-শান্তি রক্ষা করা রাজার দায়িত্ব। সে হলো ঈশ্বরের প্রতিনিধি, যাকে দেওয়া হয়েছে পুরো ভূখণ্ড এবং সীমাহীন আর প্রশ্নাতীত ক্ষমতা। তাই, আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষের দিকে যখন সবকিছুতেই শুরু হলো ভ্রান্তি, তখন সাম্রাজ্যের ধ্বংসসাধন আর জনসাধারণের শান্তি বিনষ্টের কারণ খোঁজার তাগিদে সমসাময়িক ঐতিহাসিকগণ বিচার করতে বসলেন আওরঙ্গজেবের চরিত্র।

আওরঙ্গজেব ছিলেন অস্বাভাবিক ধরনের সাহসী। তৈমুর লংয়ের বংশধরদের সবাই ব্যক্তিগতভাবে সাহসী, যত দিন না এসেছিল তার অযোগ্য নাতির পুত্রদের আমল; কিন্তু তার এই গুণটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঠান্ডা মেজাজ আর বিবেচক মন, যা কিনা আমরা উত্তর ইয়োরোপীয় জাতিগুলোর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে জানি। ব্যক্তিগত সাহসের তিনি দিয়েছেন ভূরি ভূরি প্রমাণ; চৌদ্দ বছর বয়েসে যেমন হয়েছেন তিনি ক্রুদ্ধ হাতির মুখোমুখি, তেমনই ৮৭ বছর বয়েসে যুদ্ধ করেছেন ওয়াজিনজেরার পরিখায়। তাঁর স্থৈর্য, ঘোর বিপদেও অন্যকে সাহস জোগানোর অসাধারণ ক্ষমতা এবং ধর্মাত আর খাজওয়ায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া পরিণত হয়েছে ভারতীয় ইতিহাসের বিখ্যাত অধ্যায়ে।

প্রকৃতিগত সাহস আর মানসিক স্থিরতার পাশাপাশি যৌবনের শুরুতেই বেছে নিয়েছেন তিনি কষ্টকর আর বিপদসংকুল জীবন এবং আত্মনিবেদন, আত্মদর্শন আর আত্মসংযমের মাধ্যমে নিজেকে করে তুলেছেন সম্রাটের আসনের উপযুক্ত। অন্যান্য শাসকের পুত্রদের থেকে পৃথক, আওরঙ্গজেব ছিলেন ব্যাপক পড়াশোনা করা একজন নিখুঁত পণ্ডিত, মুমূর্ষ সময় পর্যন্ত বইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অটুট। অসংখ্য কুরআন নিজ হাতে নকল করেছেন তিনি একজন পরমোৎসাহী মানুষের যান্ত্রিক পরিশ্রমে, আর অত্যন্ত ব্যস্ত একজন শাসকের বিরল অবসরের ফাঁকেও পড়েছেন আরবি ভাষায় লিখিত ব্যবহারশাস্ত্র (Jurisprudence) আর ধর্মতত্ত্বের বই, সেই সঙ্গে খুঁজে ফিরেছেন নেহাইয়া’, ‘আহিয়া-উল-উলুম’, “দিওয়ান-ই-সাইব’ জাতীয় বইয়ের দুর্লভ পাণ্ডুলিপি। তাঁর ব্যাপক চিঠিপত্র ফারসি কবিতা আর আরবি সাহিত্যে তার সুগভীর জ্ঞানের পরিচয় বহন করে, যেগুলোর প্রায় প্রত্যেকটাকেই অলংকৃত করেছেন তিনি যথাযথ উদ্ধৃতি দিয়ে । আরবি আর ফারসি ছাড়াও অনর্গল তিনি বলতে পারতেন তুর্কি আর হিন্দি। ভারতে মুসলমান আইনের সারসংগ্রহের ব্যাপারে আমরা আজও তার উদ্যম আর পৃষ্ঠপোষকতার কাছে ঋণী, যেখানে সংগতভাবেই যুক্ত রয়েছে তার নাম- ফতোয়া-ই-আলমগিরি, যা ভারতে ইসলামি বিচারের সংজ্ঞা নিরূপণ এবং তাকে সহজতর করেছে।

বই পড়ার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন কুশলী ও দক্ষ। শাহজাদা হিসেবে তার কুশলতা, বিচক্ষণতা আর তা তার পিতার দরবারের সর্বোচ্চ পদের অমাত্যকেও তার বন্ধুতে পরিণত করেছে; আর সম্রাট হওয়ার পরও গুণগুলো তাকে ছেড়ে যায়নি। ফলে অবাক হওয়ার এতে কিছু নেই যে সমসাময়িক মানুষজন তাঁকে ডাকত ‘স্রাটের লেবাসে দরবেশ’ বলে।

তাঁর ব্যক্তিগত জীবন-পোশাক, খাবার আর বিনোদন-সবই ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু সুবিন্যস্ত। তিনি ছিলেন লালসা আর লাম্পট্য থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত, এমনকি অলস ধনীদের অপেক্ষাকৃত নিরীহ আমোদ-প্রমোদেও তাঁর রুচি ছিল না। কুরআনে মুসলমানদের যে চার স্ত্রী রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাঁর স্ত্রীসংখ্যা ছিল তার চেয়েও কম, আর বিবাহিত জীবনের ভালোবাসার প্রতি তিনি ছিলেন পুরোপুরি বিশ্বস্ত। দিলরাস বানু মারা গিয়েছেন ১৬৫৭ সালে; নওয়াব বাই দিল্লিতে গিয়ে এক রকম অবসর জীবনযাপন শুরু করেছেন ১৬৬০ সালে; আওরঙ্গাবাদি মহল তাঁর নিজ মৃত্যু পর্যন্ত সম্রাটের সঙ্গে থেকেছেন ১৬৮৫ সাল অবধি; সুতরাং মৃত্যুকালে উদিপুরী মহলই ছিলেন তাঁর একমাত্র সঙ্গিনী । তৃপ্তি নিয়ে তিনি খেতেন কেবল-পাঠক জেনে হাসবেন-টক ফল করমচা, আর ‘খালি’ নামের এক ধরনের চুইংগাম। প্রতিদিন দরবার (কখনো কখনো দিনে দুবার) আর বুধবারের বিচারে উপস্থিত হওয়া ছাড়াও চিঠি আর আবেদনপত্রের ওপর তিনি আদেশ লিখতেন স্বহস্তে, এমনকি সরকারি চিঠিপত্রের জবাব কেমন ভাষায় লিখিত হবে, তা-ও বলে দিতেন স্বয়ং। সুতরাং প্রশাসনে তার শ্রম ছিল অতুলনীয়। ইতালির চিকিৎসক জেমেলি কারেরি সম্রাটকে স্বচক্ষে দেখার পর (২১ মার্চ, ১৬৯৫) বর্ণনা দিয়েছেন : তার শারীরিক উচ্চতা বেশি নয়, লম্বা আর পাতলা নাক বয়সের ভারে হেলে গেছে। চামড়া জলপাই-রঙা হওয়ার কারণে গোল ছটের দাড়ির শুভ্রতা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে বেশি…এই বয়সেও চশমা ছাড়াই প্রত্যেকটা আবেদনপত্রে নিজ হাতে আদেশ লিখছেন দেখে অভিভূত না হয়ে পারলাম না, আর সম্রাটের হাসি-হাসি চেহারা বলে দিচ্ছে যে কাজ তার কাছে আনন্দের বস্তু।

মুসলমান ঐতিহাসিকগণ লক্ষ করেছেন যে ৯০তম বছরে মৃত্যু হওয়া সত্ত্বেও তার শারীরিক প্রায় সমস্ত সক্ষমতাই বজায় ছিল। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ ‘একবার কাউকে দেখলে সেই চেহারা কিংবা একবার শুনলে সেই কথা তিনি কোনো দিনই ভুলতেন না। একদম শেষ বয়সে তিনি কানে একটু কম শুনতেন, আর ডান পা-টা সামান্য টেনে টেনে হাঁটতেন, তবে পায়ের এই ব্যাপারটা হয়েছিল একটা হাড় সরে যাওয়ার পর ডাক্তারের অদক্ষ চিকিৎসার ফলে।

১৯.১২ তাঁর অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণের প্রলুব্ধকারী পাপ: প্রশাসনের ওপর সেটার সর্বনাশা প্রভাব

কিন্তু এসব দীর্ঘ প্রস্তুতি আর চমৎকার প্রাণশক্তি ছিল তার সর্বনাশের কারণ, এসব তার ভেতরে জন্ম দিয়েছিল আত্মবিশ্বাস আর অন্যের প্রতি অবিশ্বাস, নিজের পরিকল্পনা অনুসারে সবকিছু নিখুঁত করতে চাওয়া-এ জন্যই প্রশাসন আর যুদ্ধবিগ্রহের পুঙ্খানুপুঙ্খ তিনি তত্ত্বাবধান করতে চেয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে। রাষ্ট্রের প্রধানের এভাবে প্রত্যেকটা কাজে হস্তক্ষেপের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে সুবাদার আর সেনাপতিদের দায়িত্ববোধ, উদ্যম, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে দ্রুত নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা; পরিণত হয়েছে তারা প্রাণহীন পুতুলে, প্রভু যাদের সুতো ধরে নাচায় রাজধানীতে বসে। উচ্চ কর্মদক্ষতাসম্পন্ন, তৎপর অফিসারেরা হয়ে পড়েছে নিষ্ক্রিয়। শাসনামলের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব সহ্য করতে পারেননি কোনো প্রতিবাদ, শুনতে চাননি কোনো বিস্বাদ সত্য, ঘিরে রেখেছে তাকে মিষ্টভাষী মোসাহেবের দল। সম্রাটের মন্ত্রিবর্গ পরিণত হয়েছে প্রায় কেরানিতে, পরোক্ষভাবে যারা লিপিবদ্ধ করেছে কেবল তার অনুশাসন।

এমন একজন সম্রাটকে রাজনীতিক বলা যেতে পারে না, এমনকি একজন প্রতিভাধর প্রশাসকও নয়। তাঁর ছিল কেবল সততা আর পরিশ্রমের ক্ষমতা। তিনি হতে পারতেন একজন চমৎকার বিভাগীয় প্রধান, কূটনীতিজ্ঞ নন, যিনি দূরদর্শী হয়ে আগেই করে রাখবেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এগিয়ে চলার কাজ। মূর্খ আর প্রায়শ বদমেজাজি হলেও মোগলদের মধ্যে একমাত্র আকবরের ছিল এই প্রতিভা।

মুসলমানদের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ একজন চরিত্র। তারা তাকে মনে করত অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সাধু (জিন্দা পীর)। তাই, রাজনৈতিক বিচারে আওরঙ্গজেব তার সমস্ত গুণ নিয়েও সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কিন্তু তাঁর শাসনকালের এই ব্যর্থতার কারণ তার চরিত্রের চেয়েও অনেক গভীর। যদিও এটা সত্য নয় যে মোগল সাম্রাজ্যের পতন তিনি একাই ডেকে এনেছেন, তবু পতন প্রতিরোধের জন্য তিনি কিছু করেনওনি, বরং সেই পতন তরান্বিত করতে স্বেচ্ছাকৃতভাবে কঠোর দিব্যতান্ত্রিক সরকারের আদলে হাজির করেছেন কিছু ধ্বংসাত্মক শক্তি, কারণ, সহজাত প্রবৃত্তিবশেই তিনি ছিলেন প্রতিক্রিয়াশীল, সংস্কারসাধক কোনো কূটনীতিজ্ঞ নন। এবং সেই শক্তিগুলোকেই আমি এখন তদন্ত করে দেখব।

১৯.১৩ মোগল সরকারের খাঁটি চরিত্র ও উদ্দেশ্য

মোগলেরা নানাভাবে ভারতের জন্য অনেক কিছু করেছে। কিন্তু তারা ভারতের মানুষকে একটা জাতিতে পরিণত করতে বা এটাকে একটা শক্তিশালী আর দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।

তাজমহল বা ময়ূর সিংহাসনের সোনা আর রত্নরাজির ঝলসানিতে আমাদের চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়া উচিত নয়, কারণ, মোগল ভারতের মানুষ ছিল একেবারেই হীনাবস্থায় বেশির ভাগেরই ছিল না কোনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা; অত্যাচারী অমাত্য বা বড় আমলা কিংবা ভূস্বামীর সামনে তাদের ছিল না কোনো সুবিচার অথবা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা; রাজনৈতিক অধিকার ছিল কল্পনাতীত। অমাত্যদের অবস্থানও খুব উঁচুতে ছিল না। সব নির্ভর করত সিংহাসনে বসা স্বৈরতন্ত্রীর মর্জির ওপর। সরকার বাস করত বিপ্লবের আতঙ্কে। একটা দেশের পুরো শক্তি আর যাবতীয় উৎস মিলে তৈরি করত একটা দরবার, এবং সেই দরবারের মধ্যমণি থাকতেন শাহজাদা।

অন্যান্য সব রাজতন্ত্রের মতো মোগল ভারতেও সেরা সম্রাটের অধীনেও প্রচলিত সুখ ছিল অস্থিতিশীল, কারণ, সেটা নির্ভর করত একটামাত্র মানুষের চরিত্রের ওপর। ‘মোগলদের শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ-পদ্ধতি একজন সম্ভাবনাময় উত্তরাধিকারী সৃষ্টি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রানিদের ঈর্ষা শাহজাদাদের রাজধানীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিতে দেয়নি…যে শাহজাদাই উপযুক্ত দায়িত্ব নিতে গেছেন তাঁকে সন্দেহ করা হয়েছে সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী বলে।’ ‘ব্যস্ত থাকতে বাধ্য হয়েছেন সম্রাট তাঁর দরবারে ভিড় করা জনতাকে নিয়ে…যাদের ভূমিকা ছিল গঠনমূলক কোনো কাজের চেয়ে প্রভুর মনোরঞ্জন করা।’ (ক্রুক)।

তত্ত্বগতভাবে ইসলামি সরকার হলো সামরিক শাসন-জনসাধারণ ইসলামের বিশ্বস্ত সেনা, আর সম্রাট (খলিফা) তাদের সেনাপতি। এই খলিফা-সম্রাট হলেন আল্লাহর ছায়া (জিল-সুবহানি), এবং আল্লাহর দরবার যেখানে কেন বা কীভাবে’র কোনো স্থান নেই। পাদিশাহর প্রশাসনেও এসবের স্থান নেই, যেহেতু এটা আল্লাহর দরবারেরই নমুনা (নমুনা-ই-দরবার-ই-ইলাহি)। ইসলামি সরকারের মৌলিক নিয়মানুসারে হিন্দু ও অন্যান্য অবিশ্বাসীরা থাকবে জাতির চৌহদ্দির বাইরে। কিন্তু, এমনকি কর্তৃত্বপূর্ণ সম্প্রদায়, মুসলমানেরাও একটা জাতি গঠন করতে পারেনি; তারা স্থাপন করেছে একটা সামরিক ভ্রাতৃত্ব, সেনাদের একটা চিরস্থায়ী শিবির।

১৯.১৪ জীবনযাত্রা আর আদর্শের পার্থক্য হিন্দু আর মুসলমানের মিলন অসম্ভব করে তুলেছে

মুসলমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার মূলনীতি অনুসারে, সংখ্যালঘুর কোনো রাজনৈতিক অধিকার থাকতে পারে না, তাদের জাতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিরোধী ধর্মবিশ্বাসকে গুঁড়িয়ে দিয়ে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী এই দুই শ্রেণীর কোনো মিলন হতে পারেনি, কারণ, জীবনযাত্রা আর আদর্শে তাদের রয়েছে দুই মেরুর পার্থক্য। হিন্দু নির্জনবাসী, অক্রিয়, পারলৌকিক; তার সর্বোচ্চ লক্ষ্য আত্মোপলব্ধি, একার চেষ্টায় ব্যক্তিগত মোক্ষ লাভ করা, ব্যক্তিগত নিবেদন, আর একান্ত আত্মসংযম। অপর পক্ষে, মুসলমান শেখে যে ধর্মের সেনা না হওয়া পর্যন্ত তার কোনো মূল্যই নেই; তাকে অবশ্যই প্রার্থনা করতে হবে সমাবেশের সঙ্গে বিশ্বাসের আন্তরিকতা অবশ্যই তাকে প্রমাণ করতে হবে জেহাদের মাধ্যমে, আর তাকে ভেঙে দিতে হবে অন্যের অবিশ্বাস।

বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি আর সামাজিক সংহতির ফলে মুসলমানেরা শিল্পকলা আর সভ্যতার (সাহিত্য ছাড়া) উন্নতি করতে পেরেছে হিন্দুদের চেয়ে বেশি; তাদের আমোদ-প্রমোেদ অনেক বিচিত্র আর অভিজাত, যেখানে মোগল আমলে হিন্দু আভিজাত্য ছিল মুসলমানদের আনাড়ি অনুকরণ মাত্র। গড়পড়তা মুসলমানেরা (ভিক্ষুক আর নিম্নশ্রেণীর মজুর ছাড়া) সাধারণত মার্জিত আর ব্যয়বহুল জীবনযাত্রা পছন্দ করে, আর হিন্দুরা ধনী হলেও থাকে অপরিষ্কার আর কম মার্জিত। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা স্পষ্টতই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর নিয়শ্রেণীর মুসলমানের চেয়ে বুদ্ধিমান।

১৯.১৫ আওরঙ্গজেবের অধীনে হিন্দুদের রাজনৈতিক হীনতা

খাদ্যসংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় মতবাদ আর আচারগত পার্থক্য, পারস্পরিক বিবাহবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও হিন্দু আর মুসলমানের মিলন অসম্ভব করে তুলেছে জীবন সম্বন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য। এসবের পাশাপাশি গোড়া মুসলমানের শাসনাধীন কুরআনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অতিষ্ঠ করে ফেলেছে হিন্দুদের জীবন। আওরঙ্গজেব ভেঙে দিয়েছেন হিন্দুদের শিক্ষালয়, ধ্বংস করেছেন হিন্দুদের উপাসনালয়, নিষিদ্ধ করেছেন হিন্দুদের মেলা, হিন্দু জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন অর্থনৈতিক বোঝা, হিন্দুদের জন্য বন্ধ করেছেন রাষ্ট্রীয় চাকরির দুয়ার।

তাই আওরঙ্গজেবের শাসনামলে হিন্দুরা কেবল অবিরাম বিপ্লব আর বিশৃঙ্খলাই ঘটায়নি, অবনতি ঘটিয়েছে তাদের মেধার, সংগঠনের আর অর্থনৈতিক উৎসের, ফলে তারা দুর্বল করে ফেলেছে রাষ্ট্র যার জনশক্তির তারা নিজেই কিনা দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

১৯.১৬ ভারতীয় মুসলমানদের পতন : তার কারণ

এ রকম প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে মুসলমানেরাও উন্নতি করতে পারেনি, যদিও ভিন্ন কারণে। তুর্কিরা সেনা ছাড়া আর কিছুই নয়, যুদ্ধই তাদের একমাত্র পেশা। একটা স্থায়ী সেনাবাহিনী একটানা তার পারিবারিক জীবন লালন করতে পারে না। তথাকথিত মোগলদের শাসক শ্রেণী আসলে ছিল তুর্কিরা। অতএব মোগলদের সময়ে মুসলমান সমাজ প্রায়শ প্রদর্শন করেছে গ্যারিসনমাফিক আচরণ।

মুসলমানদের মেধার পতন দ্রুত হয়েছে তাদের আজব অবস্থানের কারণে। তারা ভারতকে করেছে তাদের স্থায়ী আবাস; জাতিগতভাবেও তাদের অনেকে ভারতীয়; তারা ভারতীয় তাদের চেহারায়, চিন্তায়, চলনে-বলনে। কিন্তু তাদের ধর্ম শিক্ষকেরা তাদের তাকাতে বলেছে সুদূর অতীতের আরবের দিকে। তাদের ধর্মীয় ভাষা অবশ্যই আরবি, যা ভারতীয় মুসলমানদের একসোজনের একজনেও পুরোপুরি বোঝে না; তাদের সাংস্কৃতিক ভাষা হলো ফারসি, যা তারা আরবির চেয়ে বেশি জানলেও সুদ্ধভাবে বলতে পারে না। ভারতীয় মুসলমানেরা সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ফারসি ব্যবহার করাকে মর্যাদাহানিকর ভাবে। ফলে সংখ্যাগুরু এই সম্প্রদায়ের নিজস্ব কোনো সাহিত্য নেই।

সুতরাং গোঁড়া মুসলমানেরা সব সময় অনুভব করে যে ভারতে বসবাস করলেও তারা আসলে ভারতের নয়। এখানকার ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি তাদের মনে-প্রাণে গ্রহণ করা চলবে না; সেসব অবশ্যই আমদানি করতে হবে পারস্য আর আরব থেকে।

এমন একটা দেশে তারা আরবের আচরণ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে, যার কোনো কিছুই আরবীয় নয়। এবং এসবই ছিল ভারতীয় মুসলমানদের উন্নতির ক্ষেত্রে অলক্ষনীয় বাধা।

১৯.১৭ হিন্দু সমাজের অবনতি আর সহজাত দুর্বলতা

মধ্যযুগীয় ভারতের হিন্দুদেরও ছিল একই রকম অসুখী দৃশ্য। অসংখ্য সামাজিক বিভাজনের ফলে সম্ভবত তারাও কোনো জাতি গঠন করতে পারত না। পাশাপাশি তাদের ছিল অস্পৃশ্য সমস্যা, দক্ষিণ ভারতে সান্নিধ্যে যাওয়ার সমস্যা। মুসলমান শাসনকালে এই দুর্বল হিন্দু সমাজ হয়েছে দুর্বলতর।

হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য শিক্ষিত বা দেশপ্রেমিক কোনো পুরোহিত সম্প্রদায়ের দেখা পাওয়া যায়নি। ধর্মের মতো তাদের সমাজেও আছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা। তাদের রয়েছে প্রগাঢ় গুরু-ভক্তি বা প্রকারান্তরে মানব পূজা, রয়েছে দেবদাসী বা মুরলীর আকারে মন্দির-অনুমোদিত লাম্পট্য।

তাদের সংস্কারসাধনের দরকার ছিল, আর সেটা সম্ভব ছিল কেবল প্রচলিত মন্দিরের বাইরে, সেখানকার সাধারণ মানুষ ছিল সবকিছু ত্যাগ করে সত্যের অনুসরণে প্রস্তুত; অবশ্য সেই সংস্কারসাধনও করা যেত কেবল প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মকে, তারপর তারাও তলিয়ে যেত অরুচিকর গুরু-পুজোয়।

১৯.১৮ ভারত হিন্দু আর মুসলমানের একত্রে বসবাস: সাময়িক ঐক্য, প্রচ্ছন্ন বিপদ বা লড়াই

এ যাবৎ যতকিছুই বলা হোক, হিন্দু আর মুসলমানের কোথায় যেন একটা সাদৃশ্যও আছে। খাঁটি আদর্শগতভাবে তারা উভয়েই মহানতম একজনের পূজা করে । সাধারণ মানুষ বা গোঁড়ারা ভাবনার উচ্চস্তরে উঠতে পারে না । অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শনের যোগ্যতাসম্পন্ন মুসলমান সাধুদের পূজা করেছে হিন্দু যুবরাজ আর সাধারণ মানুষ। সুফিরা দুই সম্প্রদায়ের মিলন ঘটিয়েছে।

সাধারণ মানুষ অতীন্দ্রিয় সর্বেশ্বরবাদ (Pantheism) বা সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মতো অত বড় চিন্তা করতে পারে না। হিন্দু আর মুসলমান বা শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে কিছু লড়াই হওয়ার পর শান্ত হয়েছে তাদের নিম্নশ্রেণীরা। বন্ধুত্বপূর্ণভাবে বসবাস করেছে তারা তাদের সংকীর্ণ গণ্ডিতে। কিন্তু ধর্মীয় এই কলহশান্তি তত দিনই বজায় থেকেছে, যত দিন স্থানীয় সমাজ থেকেছে স্থির। দুই সম্প্রদায়ের শক্তির সামান্য তারতম্য বা বহিরাগত কোনো গোড়া ধর্মপ্রচারকের উসকানিতে জনতা আবার ফুঁসে উঠেছে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৬৮৫ সালে শ্রীনগরে শিয়াদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, বা আওরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংস, অথবা মালওয়ায় রাজপুতদের জিজিয়া-আদায়কারীর দাড়ি টেনে ছেঁড়া, কিংবা রাঠোর আর মারাঠি রাজপুত্রদের মসজিদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার কথা। সুতরাং আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মিশ্র ধর্মের ভারতীয় সমাজ থেকেছে অস্থির এক ভারসাম্যের মধ্যে।

১৯.১৯ ভারতীয় জনসাধারণের প্রগতিশীল মেজাজের অভাব; অতএব তাদের পতন

শেষমেশ মোগল আমলের ভারতীয় জনসাধারণ হিন্দু আর মুসলমান উভয়েই ছিল অপরিবর্তনীয়। বর্তমান যুগকে নিকৃষ্ট ভেবে তারা তাকাত কেবল অতীতের দিকে, কখনোই সামনের দিকে নয়। ভারতের প্রগতিশীল মেজাজের মৃত্যু ঘটেছিল আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই। তারপর এসেছিল একটা অপরিবর্তনীয় সভ্যতা, আর এ রকম সভ্যতায় উন্নতি অসম্ভব বলে তার পতন হতে বাধ্য।

‘ইসলামের দৃঢ়তা তার অনুসারীদের একটা নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত উন্নত হতে দেয়নি। জগতে প্রগতিই যেখানে জীবনের ধর্ম, তারা সেখানে থেমে গেছে। যখন ইয়োরোপ দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সামনে, অপরিবর্তনীয় প্রাচ্য পড়ে থাকছে পেছনে, আর প্রত্যেক বছর ইয়োরোপের সঙ্গে এশিয়ার ব্যবধান বাড়ছে জ্ঞানে, সংগঠনে, বর্ধিত সম্পদে, আর অর্জিত যোগ্যতায়, ফলে এশিয়াবাসীদের পক্ষে ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে ইয়োরোপিয়ানদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা।’ [আমার ‘মোগল প্রশাসন’ থেকে।]

১৯.২০ আওরঙ্গজেবের শাসনামলের মর্ম : কীভাবে ভারতীয় জাতীয়তা গঠন করা যাবে

 পঞ্চাশ বছরের এই দীর্ঘ আর কঠোর শাসনামলের বিস্তারিত গবেষণা আমাদের মনে একটা সত্য উপস্থিত করে। ভারতকে যদি কখনো একটা জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে হয়, যেটা বজায় রাখতে পারে শান্তি, রক্ষা করতে পারে সীমান্ত, বাড়াতে পারে দেশের অর্থনৈতিক উৎস, উন্নীত করতে পারে শিল্পকলা আর বিজ্ঞান, তাহলে অবশ্যই হিন্দুত্ব আর ইসলামকে মরে আবার জন্ম নিতে হবে নতুন করে । দুই সম্প্রদায়কেই যুক্তি আর বিজ্ঞানের আলোকে অবশ্যই করতে হবে কঠোর পর্যবেক্ষণ আর প্রায়শ্চিত্ত, হতে হবে বিশুদ্ধ আর পুনর্নব। ইসলামের এমন একটা পুনর্জন্ম যে অসম্ভব নয়, তা আমরা নিজেদের যুগেই দেখেছি। গাজী মোস্তফা কামাল পাশা প্রমাণ করেছেন যে বৃহত্তম মুসলমান রাষ্ট্রও ধর্মনিরপেক্ষ করতে পারে তার সংবিধান, বাতিল করতে পারে বহুবিবাহ, দূর করতে পারে নারীদের হীনাবস্থা, প্রদান করতে পারে সমস্ত সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সাম্য এবং তার পরও থেকে যেতে পারে একটা ইসলামি দেশ হিসেবে।

কিন্তু আওরঙ্গজেব এমন একটা আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা করেননি, যদিও সমগ্র ভারত লুটিয়ে পড়েছিল তার পায়ের কাছে, ইয়োরোপিয়ান কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁর সাম্রাজ্য দখলের মানসে হানেনি লোলুপ দৃষ্টি।

ইতিহাস যথার্থভাবে পড়লে হয় দূরদর্শিতার ন্যায্যতা, মহান একটা উদ্দেশ্য যথাসময়ে সম্পূর্ণ করার রহসোঘাটন। সিংহাসনারোহণের সময়েই যাবতীয় সুবিধা লাভ করা আর অতি উচ্চমানের নৈতিক চরিত্র এবং প্রশিক্ষণ থাকা সত্ত্বেও, আওরঙ্গজেবের মতো একজন আদর্শ মুসলমান সম্রাটের ব্যর্থতা তাই এই চিরন্তন সত্যের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর স্পষ্টতম প্রমাণ যে মহান আর স্থায়ী কোনো সাম্রাজ্য থাকতে পারে না, যদি না থাকে তার মহান জনসাধারণ, অর্থাৎ, কোনো জনসাধারণ মহান হতে পারে না, যদি না তারা শেখে এমন দৃঢ় একটা জাতি গঠন করতে, যেখানে থাকবে সবার সমান অধিকার আর সুযোগ-একটা জাতি, যেটা জীবন আর ভাবনার যাবতীয় দরকারী বিষয়ে সম্মত হয়, সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে উপলব্ধি করে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা-একটা জাতি, যার প্রশাসন কেবল জাতীয় স্বার্থ দেখে আর অনুদার বা সাম্প্রদায়িক স্বার্থের বিরোধিতা করে-এবং গড়ে তোলে একটা সমাজ, যেটা করে জ্ঞানের অকুতোভয়, অবিরাম, অসীম অনুসরণ । শুভ আর সত্যের এই পবিত্র আলোকেই কেবল ভারতীয় একটা জাতীয়তা গড়ে উঠতে পারে তার পূর্ণ উচ্চতা নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *