৯. রাজপুতানায় যুদ্ধ : আকবরের বিদ্রোহ
৯.১ আওরঙ্গজেবের মারওয়ার আক্রমণ ১৬৭৯
মারওয়ার একটা মরুভূমি অঞ্চল, কিন্তু মোগল আমলে জায়গাটার কৌশলগত গুরুত্ব ছিল এই যে মোগল রাজধানী থেকে সমৃদ্ধ শিল্পনগর আহমেদাবাদ আর ব্যস্ত বন্দর ক্যাম্বে যাওয়ার ওটাই ছিল সহজতম বাণিজ্যিক পথ। মারওয়ারের গোত্রপ্রধান ছিলেন যশোবন্ত সিংহ, যিনি ভোগ করেছেন একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন মহারাজার পদ।
১৬৭৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মহারাজা যশোবন্ত সিংহ মারা গেলেন জামরুদে। যশোবন্তের মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্র আওরঙ্গজেব তাঁর রাজ্যটাকে প্রত্যক্ষ মোগল শাসনাধীনে আনার পদক্ষেপ নিলেন। ১৬৭৯ সালের ৯ জানুয়ারি সম্রাট স্বয়ং অগ্রসর হলেন আজমীর অভিমুখে, যোধপুরের একদম কাছে গিয়ে তিনি শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে চান।
যশোবস্তের মৃত্যু রাঠোরদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা আর আতঙ্কের জন্ম দিয়েছিল। রাজ্য হয়ে পড়েছিল শাসকহারা, যশোবন্তের বড় বড় সব অফিসার আর সেনাবাহিনীর সেরা অংশ ছিল আফগানিস্তানে। ফলে বিশাল মোগল সেনাবাহিনীর সামনে তারা কোনো রকম প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারল না।
আওরঙ্গজেব জানতে পেরেছিলেন (২৬ ফেব্রুয়ারি) যে লাহোরে যশোবস্তের দুই বিধবা মহারাজার মৃত্যুর পর দুই পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু বৈধ উত্তরাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে, সম্রাট মারওয়ারকে সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুত হলেন না। আজমীর থেকে তিনি ফিরে এলেন দিল্লিতে (২ এপ্রিল)। ওই দিনই হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর পুনরায় আরোপ করা হলো এক শতাব্দী পর ।
নাগরের সর্দার আর যশোবন্তের ভাইয়ের নাতি, ইন্দ্র সিংহ রাঠোরকে ৩৬ লাখ টাকা উত্তরাধিকার ফির বিনিময়ে (২৬ মে), যোধপুরের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো মারওয়ারে। কিন্তু দখলদার বাহিনীর সঙ্গে আসা মোগল প্রশাসক আর সেনাপতিরা দেশের ভেতরে থেকেই গেল, ক্ষমতা গ্রহণে নতুন রাজাকে সহায়তা করার জন্য।
৯.২ দুর্গাদাস কীভাবে অজিত সিংহকে রক্ষা করল
লাহোর পৌঁছার পর যশোবন্তের দুই বিধবা রানি দুই পুত্রের জন্ম দিল (ফেব্রুয়ারি, ১৬৭৯), যার একটা মারা গেল কয়েক সপ্তাহ পরই, কিন্তু অন্যটা, অজিত সিংহ বেঁচে রইল অনেক ঘটনাবহুল সময় পেরিয়ে যোধপুরের সিংহাসনে আরোহণের জন্য। জুনের শেষে মহারাজার পরিবার গেল দিল্লিতে; আর অজিতের অধিকারের জন্য আবার অনুরোধ করা হলো আওরঙ্গজেবের কাছে; কিন্তু তিনি শিশুটিকে তার। হেরেমে লালনপালন করতে বললেন, আর কথা দিলেন যে সে বড় হলে তাকে রাজা হিসেবে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হবে।
বিশ্বস্ত রাঠোরেরা আতঙ্কিত হলো আওরঙ্গজেবের এই প্রস্তাবে। তারা শপথ করল যে সর্দারের উত্তরাধিকারীকে রক্ষা করতে প্রয়োজনে তারা প্রাণ দেবে। তাদের নেতা ছিল দুর্গাদাস, রাঠোর বীরধর্মের সেরা উদাহরণ, যশোবন্তের মন্ত্রী আসকরণের পুত্র, দ্রুনেরার জমিদার । দুর্গাদাসের পঁচিশ বছরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর বিচক্ষণ কৌশল ছাড়া অজিত সিংহ তার পিতার সিংহাসনে বসতে পারত না। শত প্রতিকূলতার বিপক্ষে লড়াই করেও সে তার সর্দারের উদ্দেশ্যকে সমুন্নত রেখেছে। মোগল সেনা তাকে ভ্রষ্ট করতে পারেনি, মোগল সেনা প্রকম্পিত করতে পারেনি ওই অকুতোভয় হৃদয়। রাঠোরদের মধ্যে একমাত্র সে-ই প্রদর্শন করেছে একজন রাজপুত সেনার তেজ আর বেপরোয়া শৌর্যের সঙ্গে একজন মোগল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশলতা, কূটনীতি আর সাংগঠনিক ক্ষমতার এক বিরল সমন্বয়।
১৫ জুলাই দিল্লি শহরের সামরিক পুলিশপ্রধান আর সম্রাটের রক্ষীদের সেনাপতির অধীনে আওরঙ্গজেব শক্তিশালী একটা দল পাঠালেন দুই রানি আর অজিতকে গ্রেপ্তার করে নূরগড় দুর্গের কারাগারে নিক্ষেপের জন্য। ওদিকে রাঠোরেরা পরিকল্পনা করল নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে হলেও অজিতের পালানোর ব্যবস্থা করে দেবে। যোধপুরের অমাত্য রঘুনাথের অধীন একশো নিবেদিতপ্রাণ সেনা এক ঝটিকা আক্রমণ চালাল প্রাসাদের একপাশ থেকে। আকস্মিক এই আক্রমণে সামান্য পিছু হটল সম্রাট-বাহিনী, আর মুহূর্তের সেই সুযোগে অজিত আর পুরুষের পোশাক পরা দুই রানিকে নিয়ে দুর্গাদাস সোজা ঘোড়া ছোটাল মারওয়ার অভিমুখে। দেড় ঘণ্টা ধরে দিল্লির রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করার পর প্রাণ বিসর্জন দিল রহণনাথ। এবার তাড়া করল মোগলেরা, কিন্তু দুর্গাদাস ততক্ষণে নয় মাইল এগিয়ে গেছে। শত্রুর মুখোমুখি হলো এবার রণছোড়দাস যোবা, আর নষ্ট করে দিল তাদের মূল্যবান বেশ কিছু সময়। তিনবার এ রকম সংঘর্ষের মুখোমুখি হওয়ার পর সন্ধেয় অনুসরণ ত্যাগ করল রণক্লান্ত মোগলেরা, আর অজিত নিরাপদে পৌঁছে গেল মারওয়ারে (২৩ জুলাই)। মনে হলো, আওরঙ্গজেবের পরিকল্পনা এখানে মার খেয়ে গেল। কিন্তু দুর্গাদাসের পরিকল্পনা বানচাল করার উদ্দেশ্যে তিনি এক কৌশলের আশ্রয় নিলেন : এক গোয়ালার শিশুপুত্রকে হেরেমে লালনপালন শুরু করলেন তিনি খাঁটি অজিত সিংহের পরিচয়ে, আর দাবি করলেন যে দুর্গাদাসের অভিভাবকত্বাধীন শিশুটি হলো এক নকল যুবরাজ। ওই একই সময়ে মারওয়ারের দুই মাসের রাজা ইন্দ্র সিংহকে সিংহাসনচ্যুত করলেন তিনি তার প্রমাণিত অযোগ্য শাসনের দায়ে ।
মারওয়ার পুনর্দখলের জন্য পাঠানো হলো শক্তিশালী এক মোগল বাহিনী। অরাজকতা আর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড নেমে এল অভিশপ্ত রাজ্যটির ভাগ্যে ।
১৬৭৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সম্রাট স্বয়ং গেলেন তাঁর আজমীরের সদর দপ্তরে; সেনাবাহিনী অগ্রসর হলো তাঁর পুত্র মুহম্মদ আকবরের অধীনে। মোগল বাহিনীর সর্বাগ্রভাগের নেতৃত্বে রইল আজমীরের ফৌজদার তাহায়ূর খান। রাজ সিংহের অধীন রাঠোরেরা তার পথরোধ করে দাঁড়াল পবিত্র পুষ্কর দিঘির কাছের বোয়ার মন্দিরের সামনে, আর তিন দিনের অবিরাম যুদ্ধ শেষ হলো কেবল অগণিত বীর রক্ষকের প্রাণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে। তারপর রাজপুতেরা তাদের গেরিলা যুদ্ধ চালাতে লাগল পাহাড় আর মরুভূমির লুকানো ঘাঁটি থেকে। সম্রাট মারওয়ার রাজ্যকে জেলায় বিভক্ত করে, প্রত্যেক জেলার দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন একজন করে ফৌজদারের হাতে (অক্টোবরের শেষাশেষি)। যোধপুর এবং সমভূমির অন্য বড় বড় সব শহরের পতন হলো আর চলল সেখানে অবাধ লুটতরাজ; মন্দিরগুলো খুঁড়িয়ে দিয়ে তার ওপরে নির্মিত হলো মসজিদ।
৯.৩ উদয়পুরের মহারানার সঙ্গে মোগলদের যুদ্ধ
মারওয়ারের সংযোজন ছিল সহজে মেবার দখলের ভূমিকা মাত্র। জিজিয়া কর। পুনরায় আরোপের আইন রাষ্ট্রময় কায়েম করার দাবি জানানো হলো মহারানার কাছে। এখন শিশোদিয়ারা যদি রাঠোরদের পাশে না দাঁড়ায়, দুটো গোত্রই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে অত্যাচারী শাসকের পদতলে। এ রকমই ভাবলেন মহারানা রাজ সিংহ আর তাঁর গোত্রের সবাই । অজিত সিংহের মাতা মেবারের একজন রাজকন্যা, আর রাজ সিংহ তাই একজন আত্মীয় কিংবা ক্ষাত্রধর্মের পালক হিসেবে, বিধবা রানির পিতৃহীন পুত্রের অধিকার রক্ষার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলেন না।
যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করলেন রাজ সিংহ। স্বভাবসিদ্ধ তৎপরতায় প্রথম আঘাত হানলেন আওরঙ্গজেব। মূল মোগল সেনাকে পথ করে দেওয়ার জন্য সাত হাজার বাছাই সেনার এক বাহিনী নিয়ে পুর থেকে হাসান আলী খান অগ্রসর হলো মহারানার ভূখণ্ড বিধ্বস্ত করতে করতে। ইয়োরোপিয়ান গানার সমৃদ্ধ মোগল গোলন্দাজ বাহিনীর সামনে রাজপুতেরা দাঁড়াতেই পারল না। মহারানা স্থির করলেন, তিনি এই আক্রমণের জবাব দেবেন নিমাঞ্চল ত্যাগ করে, সমস্ত প্রজাসহ পাহাড়শ্রেণীতে অবস্থান নিয়ে, যেখানে ঢোকার সাহস পাবে না মোগলেরা। এমনকি রাজধানী উদয়পুরও শূন্য করা হলো। মোগলেরা সেটা দখল করে ধ্বংস করল সেখানকার বড় মন্দির, উদয়-সাগর দিঘির ওপরের তিনটে মন্দিরও তাদের হাত থেকে রেহাই পেল না।
হাসান আলী খান উদয়পুরের উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণীতে প্রবেশ করে মহারানাকে একটা পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করাল (২২ জানুয়ারি), তাঁর শিবির আর ধনসম্পদ দখলে নিয়ে, আর উদয়পুরের চারপাশের ১৭৩টা মন্দির ধ্বংস করে। চিতোর ইতিমধ্যেই মোগলদের অধিকারে এসেছে, আর সেখানেও ধ্বংস করা হয়েছে ৬৩টা মন্দির। উদয়পুর ত্যাগ করে সম্রাট ফিরে এলেন আজমীর (২২ মার্চ), আর শাহজাদা আকবরের অধীন শক্তিশালী একটা বাহিনী ঘাঁটি গাড়ল চিতোর জেলায়। কিন্তু মোগল আউটপোস্টগুলো বেশ বিক্ষিপ্ত, এদিকে পুরো রাজপুত দেশটাই রাগে ফুঁসছে। মেবার আর মারওয়ারের মোগল অবস্থান বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আরাবল্লী পর্বতমালা দিয়ে; মহারানা ওটার চুড়ো দখল করে থাকায়। যখন-তখন নেমে এসে তার পক্ষে ডানে-বামে ইচ্ছে মতো প্রচণ্ড আঘাত হানা সম্ভব, কিন্তু মোগল সেনাদের চিতোর থেকে দক্ষিণ মারওয়ারে যাওয়ার প্রয়োজন। হলে যেতে হবে বেদনুর, বিওয়ার আর সোজাত জেলার এক সুদীর্ঘ পথ বেড় দিয়ে ।
মেবারের পাহাড়শ্রেণী দিয়ে নির্মিত রুক্ষ এই প্রাকৃতিক বৃত্ত এমনভাবে উদয়পুর থেকে এগিয়ে গেছে পশ্চিমের কমলমীর, আর রাজসমুদ্র থেকে দক্ষিণের সালুব্রার দিকে, ঠিক যেন এটা একটা অভেদ্য দুর্গ, যার তিনটে দরজা মেলে আছে পুব, উত্তর আর পশ্চিমে, অর্থাৎ দেওবাড়ী, রাজসমুদ্র আর দেওসুরী অভিমুখে, যার যেকোনো একটা দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মোগলদের যেকোনো বিচ্ছিন্ন আউটপোস্ট গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। পক্ষান্তরে, শক্তিবৃদ্ধির প্রয়োজনে মোগল সেনাকে অবশ্যই লম্বা এক বেড় দিয়ে। যেতে হবে মহারানার স্বল্পকালীন ঘাঁটির পাশ বরাবর।
চিতোরে অবস্থান নেওয়া শাহজাদা আকবরের অধীনে রয়েছে আরাবল্লীর পুবের আর আজমীরের দক্ষিণের সমস্ত মোগল আউটপোস্ট। কিন্তু এত বিশাল একটা অঞ্চলের পক্ষে তাঁর এই বাহিনী একেবারেই ছোট। তা ছাড়া মোগলদের কাছে এই অঞ্চল অপরিচিত, যেখানে রাজপুতেরা এখানকার প্রতিটা ইঞ্চি চেনে ।
সম্রাট আজমীরে ফিরে যাওয়ার (মার্চ) পরপরই রাজপুত আক্রমণের মাত্রা ক্রমে ক্রমে এত বেড়ে গেল যে প্রত্যেকটা মোগল আউটপোস্টই হয়ে উঠল ঝুঁকিপূর্ণ। আউটপোস্টে সেনা কর্মকর্তারা পর্যন্ত সময় কাটাতে লাগল চূড়ান্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে, সেনারা ঘাঁটি ছেড়ে মাত্র কয়েক ধাপ বাড়ানোর পরই আর অগ্রসর হতে রাজি হলো না।
মে মাসের মাঝামাঝি চিতোরের কাছে আকবরের শিবিরে রাতের বেলা হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন সেনাকে হত্যা করে গেল রাজপুতেরা। মাসের শেষাশেষি মহারানার আরেক আক্রমণে আকবরের খুবই ক্ষয়ক্ষতি হলো। কয়েক দিন পরই রাজপুতেরা ১০,০০০ বলদ ধরে নিয়ে গেল, যেগুলো শাহজাদার সেনাদের জন্য শস্য নিয়ে আসছিল মালওয়া থেকে। মহারানার পুত্র ভীম সিংহের অধীন একটা সেনাবাহিনী সারা দেশ ঘুরে ঘুরে দুর্বল জায়গা দেখলেই সেখানে চালাতে লাগল অতর্কিত আক্রমণ। আতঙ্কে আমাদের সেনারা অসাড় হয়ে গেছে, এমনটাই অভিযোগ করেছেন আকবর।
আকবরের ব্যর্থতায় ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন মারওয়ারে, আর চিতোরের দায়িত্ব ন্যস্ত করলেন তাঁর আরেক পুত্র শাহজাদা আজমের হাতে (২৬ জুন)।
মেবার পাহাড়শ্রেণী ভেদ করার পরিকল্পনা আঁটলেন সম্রাট তিন দিক থেকে চিতোর বা পুব থেকে শাহজাদা আজম অগ্রসর হবেন দেওবাড়ী গিরিপথ আর উদয়পুর হয়ে, উত্তর থেকে শাহজাদা মুয়াজ্জম রাজসমুদ্র দিঘি হয়ে, আর পশ্চিম থেকে শাহজাদা আকবর দেওসুরী গিরিপথের ভেতর দিয়ে। প্রথম দুজন তাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলেন।
৯.৪ শাহজাদা আকবরের মারওয়ার অভিযান
চিতোর থেকে বদলি হয়ে মারওয়ারের সোজাতে এলেন শাহজাদা আকবর ১৬৮০ সালের ১৮ জুলাই। কিন্তু মারওয়ারেও মেবারের চেয়ে বেশি কোনো সাফল্য পেলেন না তিনি। রাঠোরেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দেশজুড়েই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে চলেছে। আকবরের ওপর নির্দেশ ছিল সোজাতের অবস্থান সুদৃঢ় করে গোদোয়ার জেলার প্রধান শহর নাদোল দখল করা, আর নতুন এই ঘাঁটি থেকে। সর্বাগ্রভাগের সেনা নিয়ে নারলাই শহর হয়ে তাহায়ুর খান অগ্রসর হবে পুবের মেবারে, তারপর দেওসুরী গিরিপথ ধরে গিয়ে আক্রমণ করবে কমলমীর অঞ্চল, যেখানে পরাজিত রাঠোরদের নিয়ে ঘাঁটি গড়েছেন মহারানা। কিন্তু মৃত্যুপ্রিয় রাজপুতেরা এমনই আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে যে হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে রইল তাহায়ূরের সেনাবাহিনী।
২১ সেপ্টেম্বর সোজাত ত্যাগ করে নাদোলে পৌঁছালেন আকবর মাসের শেষাশেষি। কিন্তু তাহায়ূর খান পাহাড়শ্রেণীতে প্রবেশ করতে রাজি না হলে আকবর বাধ্যতা আরোপ করলেন তাঁর ভীতু সেনাপতির ওপর। ২৭ সেপ্টেম্বর খান অগ্রসর হলো গিরিপথের মুখের দিকে। কখন সে বিশ্বাসঘাতকতা করে রাজপুতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল আমরা বলতে পারব না, কিন্তু ১৬৮০ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই তার কাজকর্মে একটা ঢিলে ভাব পরিলক্ষিত হয়।
সম্রাটের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এক মুহূর্তও আর দেরি না করে আকবরকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দিলেন তিনি। সুতরাং নাদোল থেকে অগ্রসর হয়ে আকবর পৌঁছালেন দেওসুরীতে (১৯ নভেম্বর), আর সেখান থেকে তাহায়ূরকে পাঠালেন ঝিলওয়ারা গিরিপথ অভিমুখে; যুদ্ধ করতে করতে মোগলেরা পৌঁছাল ঝিলওয়ারাতে, আর সেখান থেকে খান লুটতরাজ চালাতে লাগল আশপাশের গ্রামগুলোতে।
মোগলেরা ঝিলওয়ারা এসেছিল ২২ নভেম্বর। পরবর্তী পদক্ষেপ ৮ মাইল দক্ষিণের মহারানার সর্বশেষ আশ্রয় কমলমীর আক্রমণ। কিন্তু পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহে আবার পরিলক্ষিত হলো তাহায়ুর খানের সেই সন্দেহজনক ঢিলে ভাব। সত্যি বলতে কি, এই সময়টাতেই শাহজাদা তার বিশ্বাসঘাতকতার ডিমটিতে পুরোপুরি তা দিয়েছিলেন। ১৬৮১ সালের ১ জানুয়ারি রাজপুত বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করার এক লিখিত ঘোষণা দিয়ে নিজেকে তিনি ঘোষণা করলেন সম্রাট হিসেবে; আর পরদিনই মোগল মুকুট আওরঙ্গজেবের মাথা থেকে কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন আজমীরের উদ্দেশে।
৯.৫ শাহজাদা আকবরের নিজেকে সম্রাট ঘোষণা, ১৬৮১
আওরঙ্গজেবের চতুর্থ পুত্র সুলতান মুহম্মদ আকবরের বয়েস ছিল তখন মোটেই ২৩ বছর। মেবার অভিযানের ব্যর্থতার কারণে সম্রাট তাঁকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন। মারওয়ারেও না পেরেছেন তিনি রাঠোরদের পরাজিত করতে, না পেরেছেন পিতার পরিকল্পনা অনুসারে দেওসুরী গিরিপথ দিয়ে মেবারে ঢুকতে । বারংবার এই ব্যর্থতার জ্বালায় পিতার সিংহাসন দখলের জন্য রাজপুতদের সহায়তার প্রস্তাব পেতে তিনি এক রকম কান পেতেই অপেক্ষা করছিলেন।
রাষ্ট্রদ্রোহমূলক এসব যোগাযোগের প্রধান হোতা ছিল তাঁর সেনাপতি তাহায়ুর খান। মহারানা রাজ সিংহ আর দুর্গাদাস আকবরকে বলেছিল যে রাজপুত ধ্বংসের তাঁর পিতার গোঁড়ামিপ্রসূত পরিকল্পনা মোগল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ, সুতরাং মোগল ঐতিহ্য রক্ষা করতে হলে তার উচিত পিতার সিংহাসন দখল করে তার পূর্বপুরুষদের বিচক্ষণ পদ্ধতিগুলো ফিরিয়ে আনা। সিংহাসন দখলের ব্যাপারে রাজপুতদের সেরা দুই গোত্র, শিশোদিয়া আর রাঠোর, তাঁকে সশস্ত্র সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
আওরঙ্গজেবের বিপক্ষে রওনা দেওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, হঠাৎ করেই মারা গেলেন মহারানা (২২ অক্টোবর, ১৬৮০)। শোকপালনের জন্য স্বাভাবিকভাবেই মাস খানেক নিষ্ক্রিয় রইল তার উত্তরাধিকারী জয় সিংহ। তারপর তাহায়ূর খানের মধ্যস্থতায় নতুন করে আবার শুরু হলো আলোচনা। পদাতিক আর অশ্বারোহী সেনার অর্ধেক কর দিতে রাজি হলো জয় সিংহ। মোগল সিংহাসন দখলের লক্ষ্যে আকবরের আজমীর রওনা দেওয়ার চূড়ান্ত তারিখ ধার্য হলো ১৬৮১ সালের ২ জানুয়ারি।
এই তারিখের দুই দিন আগে পিতার সন্দেহ দূর করার উদ্দেশ্যে আকবর তাকে লিখেছিলেন একটা মিথ্যে চিঠি: ‘তাহায়ুর খানের নেতৃত্বে নতুন রানার ভাই আর পুত্র পাহাড় থেকে নেমে এসেছে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। রাঠোর নেতারাও আমাদের সঙ্গে শান্তিস্থাপন করতে চায়। তারা অনুরোধ করছে যে আমি যেন নিজে তাদের মহামান্য সম্রাটের সামনে নিয়ে গিয়ে তাদের হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। সুতরাং আমি (তাদের নিয়ে রওনা দিচ্ছি সম্রাট সকাশে।
তারপর আকবর তাঁর মুখোশ খুলে ফেললেন। তাঁর বেতনভোগী চার ঈশ্বরতাত্ত্বিক একটা অনুশাসন জারি করল যে ইসলামি আইন লঙ্ঘনের দায়ে সিংহাসনের ওপর আওরঙ্গজেবের আর কোনো অধিকার নেই। অতএব আকবর নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করলেন (১ জানুয়ারি), আর তাহায়ূর খানকে নিযুক্ত করলেন তার প্রধান অমাত্য।
আজমীরে জটিল হয়ে পড়ল সম্রাটের পরিস্থিতি। তাঁর মূল সেনাবাহিনীর বড় যে দুটো দলে আজ পর্যন্ত বিদ্রোহের কলঙ্ক লাগেনি, দুটোই এখন বহু দূরে। এই মুহূর্তে তার দল বলতে রয়েছে কেবল অকেজো কিছু সেনা, ব্যক্তিগত অনুচর, কেরানি আর খোঁজা, যেখানে গুজব ভাসছে বাতাসে যে বিদ্রোহীরা সংখ্যায় ৭০,০০০, তার সঙ্গে রয়েছে আবার রাজপুতানার সেরা যোদ্ধারা।
সবাই ধরে নিল যে দ্রুত এসে পৌঁছাবে আকবরের সেনাবাহিনী, পতন হবে সম্রাটের গুটিকয় রক্ষীর, আর পরিবর্তন হবে শাসকের। কিন্তু আকবরের দিনরাত্রি কাটতে লাগল অলসতা আর আমোদ-প্রমোদের মধ্যে। পিতার কাছ থেকে তার যে ১২০ মাইলের দূরত্ব, সেটা অতিক্রম করতে তিনি লাগিয়ে দিলেন এক পক্ষ (২-১৫ জানুয়ারি), যখন প্রত্যেকটা ঘণ্টার দেরি চলে যাচ্ছিল আওরঙ্গজেবের অনুকূলে।
ইতিমধ্যে চারদিকে ছুটে চলেছে সম্রাটের দূতেরা, যেন যেখানে যেসব বিক্ষিপ্ত মোগল বাহিনী আছে, এই মুহূর্তে গিয়ে উপস্থিত হয় সম্রাটের পাশে। দিন আর রাত সমান তালে হেঁটে চারপাশ থেকে সম্রাটের সহায়তায় ছুটে আসতে লাগল বিশ্বস্ত সব সেনাপতি । শিরোহি থেকে ১২০ মাইল পথ মাত্র দুদিনে অতিক্রম করে আজমীর এসে পৌঁছাল প্রথম নিজামের পিতা শিহাব-উদ-দীন-খান (৯ জানুয়ারি)। অন্যান্য সেনাপতিরাও এসে গেল প্রায় একই রকম দ্রুততায়। ফলে কেটে গেল মহাসংকট। ১৪ জানুয়ারি সম্রাট অগ্রসর হয়ে শিবির পাতলেন আজমীরের ৬ মাইল দক্ষিণের ঐতিহাসিক দেওরাইয়ে । কিন্তু আকবরের শিবিরে নেমে এল হতাশা। যতই তিনি এগিয়ে এলেন, মোগল সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে ত্যাগ করে গিয়ে যোগ দিতে লাগল সম্রাটের দলে। অটল রইল কেবল ৩০ হাজার রাজপুত।
১৫ জানুয়ারি সম্রাট আরও ৪ মাইল দক্ষিণে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন দো-রাহায়।
সন্ধেয়, মধ্যশীতের বৃষ্টি, বাতাস আর কনকনে ঠান্ডা উপেক্ষা করে শাহজাদা মুয়াজ্জম এসে যাওয়ায়, দ্বিগুণ হয়ে গেল সম্রাটের শক্তি। পক্ষান্তরে, আকবর এসে পৌঁছালেন তাঁর পিতার শিবিরের ৩ মাইল দূরে, আর প্রস্তুত হলেন পরবর্তী সকালের চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য ।
৯.৬ তাহায়ূর খানের হত্যা, আকবরের ব্যর্থতা
কিন্তু রাতটা কেটে যাওয়ার আগেই আওরঙ্গজেবের এক ধূর্ত কূটনীতি তাঁকে বিনা যুদ্ধে জয়ী করাল। আকবরের ডান হাত তাহায়ূর খান বিয়ে করেছিল সম্রাট শিবিরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, ইনায়েত খানের এক কন্যাকে। আওরঙ্গজেব ইনায়েত খানকে দিয়ে তাহায়ূরকে একটা চিঠি লিখালেন যে সে যদি সম্রাটের কাছে আসে, তাহলে তার অতীত অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, আর না এলে ‘প্রকাশ্যে’ বলাৎকার করা হবে তার পরিবারের মহিলাদের, আর ক্রীতদাস হিসেবে তার পুত্রদের বিক্রি করে দেওয়া হবে কুকুরের দামে।
চিঠি পেয়ে পাগল হয়ে গেল তাহায়ুর খান। ষড়যন্ত্র হতে পারে, এমন একটা সন্দেহও হলো তার। তাই আকবর আর দুর্গাদাসকে না জানিয়ে পোশাকের নিচে ছোট একটা বর্ম পরে সম্রাটের শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলো সে মাঝরাতের সামান্য আগে। রক্ষীরা সম্রাটের কাছে তাকে নিয়ে যাবে নিরস্ত্র করে, কিন্তু সে ও রকম মর্যাদাহানিকর অবস্থায় যাবে না, আর এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল হইচই। রক্ষীরা তাকে মারতে লাগল লাঠি দিয়ে, কিন্তু পোশাকের নিচের ছোট বর্ম তাহায়ূরকে কিছুক্ষণ রক্ষা করল, তারপর গোলমালের মধ্যেই কে যেন তার গলা দুই ফাঁক করে ফেলে ‘বন্ধ করে দিল তার চিৎকার।’
ইতিমধ্যে আওরঙ্গজেব একটা মিথ্যে চিঠি লিখেছেন আকবরকে। সেই চিঠিতে রাজপুতদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে আনার জন্য শাহজাদার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি, আর সেই সঙ্গে নির্দেশ দিয়েছেন আগামীকাল সকালের যুদ্ধে অবশ্যই যেন রাজপুত সেনাদের রাখা হয় বাহিনীর সর্বাগ্রভাগে, কারণ ওই অবস্থায় সামনে থেকে আওরঙ্গজেব আর পেছন থেকে আকবরের দ্বারা আক্রান্ত। হলে রাজপুতদের আর দেখতে হবে না। আওরঙ্গজেবের ষড়যন্ত্র অনুসারে চিঠিটা গিয়ে পড়ল দুর্গাদাসের হাতে, আর সে ওটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গে আকবরের শিবিরে গেল একটা ব্যাখ্যা চাইতে। কিন্তু শাহজাদা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর খোঁজাদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে যে কিছুতেই তাঁকে জাগানো যাবে না। এবার দুর্গাদাস লোক পাঠাল তাহায়ুর খানের তাঁবুতে, কিন্তু তাকেও অনুপস্থিত দেখে ঘনীভূত হলো রাজপুতদের সন্দেহ। ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পেতে হলে তাদের এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে। হাতের কাছে আকবরের যে সম্পদই পেল, সব লুটে নিয়ে দিনের প্রথম আলো ফোঁটার তিন ঘন্টা আগে রাজপুতেরা সোজা ঘোড়া ছোটাল মারওয়ার অভিমুখে। এই সুযোগে আকবরের বিশ্বস্ত সেনা কর্মকর্তারাও লুকিয়ে গিয়ে যোগ দিল আওরঙ্গজেবের সঙ্গে। তাহায়ূর খান ছিল রাজপুত আর আকবরের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র; সে ছিল নতুন সম্রাটের যুগপৎ প্রধান সেনাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী, আর তাই তার মৃত্যুতে মিত্রসংঘ ভেঙে গেল।
সকালে জেগে আকবর দেখলেন যে সবাই তাকে পরিত্যাগ করেছে। তার বিশাল সেনাবাহিনী যেন জাদুবিদ্যায় অদৃশ্য হয়ে গেছে একটামাত্র রাতের মধ্যে, এখন অবশিষ্ট বলতে তার রয়েছে কেবল পুরনো কজন বিশ্বস্ত অনুচর আর ৩৫০টা ঘোড়া। মহিলাদের ঘোড়ার পিঠে তুলে দিয়ে আর যথাসম্ভব ধনসম্পদে উটের পিঠ বোঝাই করে রাজপুতদের পালিয়ে-যাওয়া পথেই ছুটলেন তিনি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে।
তাঁর এক স্ত্রী, দুই পুত্র, আর তিন কন্যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো সম্রাটের শিবিরে। কঠিন শাস্তি জুটল তাঁর অনুসারীদের ভাগ্যে। আকবরের সঙ্গে শাহজাদি জেব-উন-নিসার গোপন যোগাযোগের তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় শাহজাদির চার লাখ টাকার ভাতা আর জমিজমা থেকে বঞ্চিত করে বন্দী করা হলো তাকে সেলিমগড় দুর্গে।
শাহজাদা মুয়াজ্জমের অধীনে মারওয়ারে একটা সেনাবাহিনী পাঠানো হলো আকবরকে গ্রেপ্তার করার জন্য। ইতিমধ্যে আওরঙ্গজেবের ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারায়। আকবরকে আশ্রয় দিল দুর্গাদাস। মোগল বাহিনীর তাড়ায় মারওয়ার জুড়ে পালিয়ে বেড়ালেন আকবর, কোনো জায়গাতেই অবস্থান করলেন না চব্বিশ ঘণ্টার বেশি। শেষমেশ বীরধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে আকবরকে মারাঠা দরবারে পৌঁছে দেওয়ার এক কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করল দুর্গাদাস। প্রত্যেকটা নদীপথ সম্রাটের বাহিনী পাহারা দিয়ে থাকা সত্ত্বেও তাদের সবার চোখে ধুলো দিয়ে আকবরপুরের কাছ দিয়ে নর্মদা অতিক্রম করে (৯ মে), দুর্গাদাস গিয়ে উঠল তপতীর ওপরের বুরহানপুরে (১৫ মে)। কিন্তু সেখানেও সম্রাটের বাহিনী পথরোধ করে আছে দেখে পশ্চিম বরাবর এগিয়ে আন্দেশ আর বাগোনর ভেতর দিয়ে, অবশেষে পৌঁছে। গেল সে শম্ভুজীর কঙ্কানের নিরাপত্তায় (১ জুন)।
৯.৭ রাজস্থানের আংশিক শান্তি
আকবরের বিদ্রোহ মোগলদের যুদ্ধ-পরিকল্পনাকে এমন একটা সময়ে ব্যাহত করেছিল, যখন তাদের ক্রমশ গুটিয়ে আনা জালে মেবার প্রায় আটকা পড়ার মুখে, ফলে আপনা থেকেই দেশটা ফেলতে পেরেছিল একটা স্বস্তির নিশ্বাস। সম্ভবত এই সময়েই প্রতিশোধ নেওয়ার একটা সুযোগ গ্রহণ করেছিল শিশোদিয়ারা, এবং যুবরাজ ভীম সিংহ আর মহারানার অর্থমন্ত্রী দয়ালদাসের সাহসী নেতৃত্বে ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল গুজরাট আর মালওয়ায়।
খাঁটি যুদ্ধকে বিবেচনায় আনলে রাজপুত যুদ্ধ ছিল একটা অমীমাংসিত খেলা, কিন্তু মহারানার প্রজাদের ওপর সেটার বাস্তব পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ; সমভূমিতে তাদের সমস্ত শস্যক্ষেত ধ্বংস করে দিয়েছিল শত্রুরা; পরাজয় ঠেকাতে পারলেও তারা অনাহার ঠেকাতে পারেনি। সুতরাং উভয় পক্ষই শান্তি কামনা করেছিল। ১৬৮১ সালের ১৪ জুন মহারানা জয় সিংহ ব্যক্তিগতভাবে গিয়ে সাক্ষাৎ করল শাহজাদা মুহম্মদ আজমের সঙ্গে, আর সাম্রাজ্যের সঙ্গে শান্তিস্থাপন করল নিম্নলিখিত শর্তাবলিতে :
১. রাজ্যের কাছে যে জিজিয়া কর দাবি করা হয়েছিল, তার পরিবর্তে মহারানা সাম্রাজ্যের হাতে তুলে দেবে মান্দাল, পুর আর বেদনুর পরগনা।
২. মেবার জয় সিংহকে ফিরিয়ে দিয়ে এখান থেকে চলে যাবে মোগলেরা, তার সঙ্গে ফিরিয়ে দেবে মহারানা উপাধি আর পাঁচ হাজারি মনসবদারি।
এভাবে মেবার ফিরে পেল শান্তি আর স্বাধীনতা । কিন্তু মারওয়ার নয়। অসুখী ওই যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ বিরতিহীন সংঘর্ষে পরিণত হলো একটা বিরাণ ভূমিতে। শম্ভুজীর সঙ্গে আকবরের সংযোগ সাম্রাজ্যের জন্য এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠল যে আওরঙ্গজেবকে সমস্ত শক্তি দাক্ষিণাত্যে কেবল কেন্দ্রীভূতই করতে হলো না, সেখানে গিয়ে থাকতে হলো স্বয়ং। মারওয়ারের ওপর মোগলদের নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে গেল। রক্ষা পেল রাঠোরেরা।
মোগলদের সঙ্গে রাঠোরদের বিরামহীন যুদ্ধ চলল ৩০ বছর, অবশেষে ১৭০৯ সালের আগস্টে অজিত সিংহ বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করল যোধপুরে, আর দিল্লির সম্রাট মেনে নিল তার মারওয়ারের উত্তরাধিকার ।
আওরঙ্গজেবের চূড়ান্ত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রাজপুতানায় কেবল বিদ্রোহই চাড়িয়ে তুলেছে, যখন সীমান্তে আফগানরাও মোটেই শান্ত ছিল না। রাজপুতদের সবচেয়ে বড় দুটো গোত্র মারমুখী হয়ে ওঠায় তার বাহিনী হারিয়েছে বিশ্বস্ততম সেনার সেবা। গোলযোগও কেবল মারওয়ার আর মেবারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে তা হাদা আর গৌড় গোত্রেও। অরাজকতার ঢেউ উপচে গিয়ে আঘাত হেনেছে মালওয়ায়, আর বিপজ্জনক করে তুলেছে মোগলদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মালওয়া থেকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার পথ ।