০৪. উত্তরাধিকারের লড়াই : আওরঙ্গজেবের জয়

৪. উত্তরাধিকারের লড়াই : আওরঙ্গজেবের জয়

৪.১ ধর্মাতে যশোবন্ত

১৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারির শেষে যশোবন্ত উজ্জয়িনী এসেছেন তার সেনাবাহিনী নিয়ে, কিন্তু আওরঙ্গজেবের কার্যকলাপ আর মনোভাবের কোনো সংবাদই তিনি পাননি। প্রথম এই সংবাদ তার কাছে পৌঁছাল যে শাহজাদা ইতিমধ্যেই মালওয়া পৌঁছে গেছেন আর ধেয়ে আসছেন উজ্জয়িনীর দিকে।

হতভম্ব যশোবন্ত অগ্রসর হলেন উজ্জয়িনীর ১৪ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, আর দক্ষিণ থেকে আগুয়ান শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্য তাঁবু গাড়লেন ধর্মাতের উল্টো পাশে। আরেকটা চমকদার সংবাদ পৌঁছাল তাঁর কাছে: মুরাদ মিলিত হয়েছেন। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে (১৪ এপ্রিল), আর দুজনে এখন রয়েছেন মাত্র একদিনের পথ-দূরত্বে।

যশোবন্ত মালওয়ায় এসেছেন এই আশা নিয়ে যে সম্রাট পরিবারসুলভ সম্মানের কথা ভেবেই বিদ্রোহী দুই শাহজাদা ফিরে যাবেন নিজ নিজ প্রদেশে, আর এ জন্য তাঁকে কেবল শক্তি প্রদর্শন করলেই চলবে। কিন্তু বড় দেরিতে তিনি এখন বুঝতে পারছেন, তাঁর শত্রু যুদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর।

এদিকে শাহজাহানের নির্দেশ তাঁকে দারুণ অসুবিধার মুখোমুখি করে দিয়েছে যে যথাসম্ভব কম ক্ষতি করে শাহজাদাদের নিজ নিজ প্রদেশে ফেরত পাঠাতে হবে, কোনো উপায় না দেখলেই কেবল যুদ্ধ। যশোবন্ত দুলতে লাগলেন কঠিন এক দ্বিধায় তিনি আগ্রার নির্দেশ মেনে চলবেন, নাকি ব্যবস্থা নেবেন পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে।

তাঁর সেনাবাহিনীর অবস্থাও সুবিধার নয়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন গোত্রের রাজপুত, যারা প্রায়ই নিজেদের মধ্যেই বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া হিন্দু আর মুসলমানদের দূরত্ব তো আছেই। এত জাতের মানুষকে এক সেনাপতির অধীনে ভালোভাবে যুদ্ধ করানো প্রায় অসম্ভব। সম্মিলিত সম্রাট-বাহিনীর নেতৃত্বেরও কোনো ঠিকঠিকানা নেই। কাশিম খানকে বলা হয়েছে যশোবন্তকে সহায়তা করতে, কিন্তু সে তাঁর অধীন নয়। ওদিকে মুসলমান অফিসারদের অনেকেই গোপনে আওরঙ্গজেবের অনুগত। আসন্ন যুদ্ধে আমরা দেখতে পাব, সম্রাটের পক্ষে মারা গেছে চব্বিশজন রাজপুত গোত্রপ্রধান, অথচ মুসলমান সেনাপতি মাত্র একজন। নিজ সেনাদল নিয়ে কাশিম খান থেকেছে নিরাপদ স্থানে, আর যুদ্ধের মূল ঝড়টা গেছে রাজপুতদের ওপর দিয়ে।

অবশ্য সেনাপতি হিসেবে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যশোবন্তের কোনো তুলনাই চলে না। তার যুদ্ধ পরিচালনায় ভুল, সেনাদের অবস্থান নির্ধারণে ভুল, অশ্বারোহী নিয়ন্ত্রণে ভুল; সব মিলিয়ে তার আচরণ ছোটখাটো সেনাপতির মতো, একজন প্রধান সেনাপতির মতো নয়। সবচেয়ে বড় ভুল তিনি করলেন গোলন্দাজ বাহিনীকে অবজ্ঞা করে।

স্পষ্টতই যশোবন্তের পরিকল্পনা ছিল, পরস্পরবিরুদ্ধ দুটো দল একে অপরের দিকে ছোটা শুরু করতেই, শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলা উপেক্ষা করে নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের একেবারে কাছে চলে যাওয়া। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতেই রাজপুতেরা পড়ে গেল দুই পাশের নালা আর ট্রেঞ্চের মাঝখানে, আর আক্রমণে পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই ভয়াবহ গোলাবর্ষণের মুখোমুখি হলো। দ্বিতীয়ত, শত্রুর গোলন্দাজ বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে তারা আওরঙ্গজেবের মূল সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধের উপক্রম করতেই শাহজাদার ফরাসি আর ইংরেজ গানারদের কামান ঘুরে গেল তাদের নতুন অবস্থানের দিকে আর শুইয়ে দিতে লাগল রাজপুত সেনাদের । আসলে এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো তলোয়ার আর গোলার, যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অশ্বারোহী বাহিনীর বিপক্ষে জয়লাভ করল গোলন্দাজ বাহিনী।

৪.২ ধৰ্মাতের যুদ্ধ

দুই বাহিনীতেই সেনার সংখ্যা প্রায় সমান, ৩৫,০০০-এর কিছু বেশি, তবু সুসংগতি আর গোলন্দাজ বাহিনীর কারণে আওরঙ্গজেবেরটা অনেক এগিয়ে।

১৫ এপ্রিল সূর্যোদয়ের দুই ঘণ্টা পর দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। আওরঙ্গজেবের বাহিনী ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে গাদাগাদি করে থাকা রাজপুতদের গুলি ছুঁড়ে ধরাশায়ী করতে লাগল। প্রতি মিনিটে বেড়ে চলল রাজপুতদের ক্ষয়ক্ষতি । তারপর সম্রাট-বাহিনীর সর্বাগ্রভাগের মুকুন্দ সিংহ হাদা, রতন সিংহ রাঠোর, দয়াল সিংহ ঝালা, অর্জুন সিংহ গৌড়, সুজন সিংহ শিশোদিয়াসহ তাদের নেতৃত্বাধীন সেনারা ছুটে এল সামনে। রাম! রাম! বলে রণহুঙ্কার ছেড়ে শত্রর ওপরে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঘের মতো। রাজপুতদের প্রথম আক্রমণটা আছড়ে পড়ল আওরঙ্গজেবের গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর। কামান আর মাস্কেট ছোঁড়া হলো প্রায় গায়ে ঠেকিয়ে, ভীষণভাবে হতাহত হলো রাজপুতেরা, তবু তারা এতটুকু দমল না । বীরত্বপূর্ণ এক প্রতিরোধের পর নিহত হলেন গোলন্দাজ বাহিনী প্রধান মুর্শিদ কুলি খান, দারুণ নাড়া খেল তার বাহিনী; কিন্তু কামানগুলো নষ্ট হলো না। গোলন্দাজেরা সম্ভবত পালিয়ে গিয়েছিল আক্রমণের তোড়ে, পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হতেই তারা আবার ফিরে এল। গোলন্দাজদের পর আক্রমণকারীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল আওরঙ্গজেবের সর্বাগ্র বাহিনীর ওপর। এখানে চলল হাতাহাতি এক যুদ্ধ। এটাই ছিল দিনের জটিলতম মুহূর্ত তখন রাজপুত আক্রমণ প্রতিহত না হলে আওরঙ্গজেব আর মাথা তুলতে পারতেন না।

শাহজাদার বাহিনীর সর্বাগ্রে ছিল সেরা বাছাইকৃত ৮,০০০ সেনা, আর তাদের নির্ভরযোগ্য সেনাপতিরা ছিল হাতির পিঠে। চারপাশে বারবার আছড়ে পড়ল রাজপুত আক্রমণের ঢেউ, কিন্তু আপন অবস্থান আঁকড়ে তারা রইল পাহাড়ের মতো অটল । দিনের সবচেয়ে কঠিন আর চূড়ান্ত লড়াই সংঘটিত হলো এখানেই, আর মাটি রক্তে লাল হয়ে গেল টিউলিপের বাগানের মতো। দুর্বল আর বিভক্ত হয়ে গেল রাজপুত আক্রমণ।

যশোবন্তের বাহিনীর কেন্দ্র থেকে খুব কম সেনাই এগিয়ে এল রাজপুতদের সাহায্যে; কাশিম খানের অধীন মোগল বাহিনী কোনো রকম সহায়তা করল না। ওদিকে আক্রমণের তোড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া আওরঙ্গজেবের বাহিনী পেছনে আবার একত্র হয়ে তাদের ফেরার পথ বন্ধ করে দিল। এই সময় আওরঙ্গজেবের সতর্ক চোখ বুঝে ফেলল পরিস্থিতি। তাঁর সংরক্ষিত অগ্রভাগের সেনা এগিয়ে এল সর্বাগ্র বাহিনীর সাহায্যে, আর তাদের অতিরিক্ত সহায়তা আর আশ্রয় দিতে কেন্দ্রভাগ থেকে দেয়ালের মতো এগিয়ে এলেন আওরঙ্গজেব স্বয়ং। এ ছাড়া, কেন্দ্রভাগের বাম আর ডান পাশ থেকে রাজপুতদের ওপর আক্রমণ চালাল শেখ মীর আর শাফ শিকন খান। একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল সর্বাগ্রভাগের নেতৃত্বে থাকা ছয় রাজপুত গোত্রপ্রধান। এভাবে, অসামান্য বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করা সত্ত্বেও চারপাশ থেকে আক্রান্ত হয়ে অসহায়ের মতো মারা পড়ল অনেক রাজপুত।

আক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠতেই আওরঙ্গজেবের কাছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। তাঁর গানাররা এবার ঢিবির ওপর থেকে কামান দাগতে লাগল কেন্দ্রভাগে খোদ যশোবন্তের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর মাঝখানে।

দুই পাশে পেরিয়ে যাওয়ার অসাধ্য নালা, খাল আর জলাভূমি থাকায় সম্রাট বাহিনীর সেনারা মরতে লাগল ‘আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া পতঙ্গের মতো। দুঃসাহসী সর্বাগ্রভাগের নির্মম মৃত্যু আর অগ্রসরমাণ স্বয়ং আওরঙ্গজেবকে দেখে নিজ নিজ গোত্রের সেনাসহ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে গেল রাই সিংহ শিশোদিয়া, সুজন সিংহ বুন্দেলা আর অমর সিংহ চন্দ্রবত।

ইতিমধ্যে আপন সেনাদলসহ মুরাদ বখশ ঝাঁপিয়ে পড়লেন যশোবন্ত শিবিরের পাশে; আত্মসমর্পণ করালেন তিনি দেবী সিংহ বুন্দেলাকে আর বাদবাকিদের তাড়িয়ে নিয়ে গেলেন। তারপর আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসে মুরাদ আক্রমণ চালালেন স্মাট-বাহিনীর বাম পাশে, সেনাপতি ইফতিখার খান নিহত হওয়ার পর তাদের আর কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না।

৪.৩ যশোবন্ত ও তাঁর বাহিনীর পলায়ন

রাই সিংহের পলায়ন ইতিমধ্যেই যশোবন্তের ডান পাশ উন্মুক্ত করে দিয়েছে; ইফতিখার খানের মৃত্যু উন্মুক্ত করল বাম পাশ। সর্বাগ্রভাগ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে; আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে পলায়নের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে কাশিম খানের অধীন মুসলমানেরা। এখন সামনে থেকে আওরঙ্গজেব, বাম থেকে মুরাদ, আর ডান থেকে শাফ শিকন খানের বাহিনী বিশাল এক বন্যার মতো তলিয়ে দিতে চাইছে যশোবন্তের অবশিষ্ট সেনাদলকে। দুবার জখম হওয়া মহারাজা শত্রুসেনার দিকে ঘোড়া ছোটাতে গিয়ে নিহত হলেন। কিন্তু তার সেনাপতি আর মন্ত্রীরা ঘোড়াটাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে ধরল যোধপুরের পথ । পরাজয় ইতিমধ্যেই নেমে এসেছিল, রাঠোরদের পলায়নের পর রইল কেবল কোলাহল । জয়ী শাহজাদা পেলেন সম্রাট-বাহিনীর দুই সেনাপতির শিবিরের সমস্ত গোলাবারুদ, হাতি আর সম্পদ, সেপাইরা লুট করল পরাজিত সেনাদের মালপত্র আর সাজসজ্জা ।

কিন্তু এসব বাস্তব লাভের চেয়ে এখানে আওরঙ্গজেবের নৈতিক সম্মান নিশ্চিত হওয়াটাই ছিল অনেক বড় ব্যাপার। তার ভবিষ্যৎ সাফল্যের পক্ষে ধর্মাত হয়ে উঠেছিল অশুভ। এখন একটামাত্র আঘাতে উচ্চাসন থেকে দারাকে তিনি নামিয়ে আনলেন তার সমান উচ্চতায়, কিংবা আরও নিচে। যারা সন্দেহে দুলছিল, তারাও এবার নিশ্চিত হয়ে গেল যে চার ভাইয়ের মধ্যে কার দিকে মুখ তুলে চেয়েছে ভাগ্য।

যশোবন্ত সিংহ আর কাশিম খান পলায়ন করতেই আওরঙ্গজেব হলেন পূর্ণ বিজয়ী: আর সে জন্য যুদ্ধক্ষেত্রেই হাঁটু মুড়ে বসে, হাত ভাঁজ করে, আওরঙ্গজেব ধন্যবাদ জানালেন সৃষ্টিকর্তাকে।

যুদ্ধে সম্রাট-বাহিনী হারিয়েছে প্রায় ছয় হাজার সেনা, আর মূল ক্ষতিটা হয়েছে রাজপুতদের। রাজস্থানের প্রত্যেকটা গোত্র সেই সব বীরদের প্রতি অবদান রেখেছে, যারা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছে প্রভুর সেবায় (স্বামী ধর্ম)। যেখানে দাহ করা হয়েছে রতন সিংহ রাঠোরের (রাটলাম, শৈলানা আর সীতামাউ বংশের আদিপুরুষ) মৃতদেহ, সেখানে তার বংশধরেরা নির্মাণ করেছে পাথরের বিশাল এক স্মৃতিস্তম্ভ।

৪.৪ আওরঙ্গজেবের আগ্রা অভিমুখে যাত্রা

বিজয়ের পরদিন দুই শাহজাদা গেলেন উজ্জয়িনী আর গোয়ালিয়রে ২১ মে। এখানে জানা গেল যে বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে দারা এসেছেন ঢোলপুরে, আর চম্বল নদীর ওপর সুপরিচিত সমস্ত অগভীর নদীপথ বন্ধ করে দিয়েছেন। পার হওয়ার প্রত্যেকটা মুখে তার পরিখা; উল্টো তীরে গোলন্দাজ বাহিনী; সব জায়গায় শক্তিশালী সেনাদল সতর্ক হয়ে রয়েছে শত্রুর অপেক্ষায়। এই অবস্থায় নদী পেরোতে গেলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সুতরাং স্থানীয় এক জমিদারের সহায়তা চাইলেন আওরঙ্গজেব আর জানতে পারলেন, ঢোলপুরের ৪০ মাইল পুবের ভাদৌলিতে রয়েছে হাঁটু-গভীর পানির একটা নদীপথ, যেখানে দারা পাহারা বসাননি।

নষ্ট করার মতো কোন সময় নেই। যেদিন তারা গোয়ালিয়রে পৌঁছেছেন, সেই রাতেই আবার রওনা দিল তিন সেনাপতির অধীন শক্তিশালী একটা বাহিনী, কিছু গোলাবারুদ নিয়ে, আর পরদিন সকালে সেই নদীপথ পেরিয়ে নির্বিঘ্নেই গিয়ে উঠল অপর তীরে। সেদিন বাদবাকি সেনাবাহিনী নিয়ে রওনা দিলেন স্বয়ং আওরঙ্গজেব, নিরাপদে পেরোলেন ওই একই নদীপথ (২৩ মে)। পথ ছিল জঘন্য। নদীপথটার কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেনাদের অবর্ণনীয় কষ্ট হলো; প্রায় ৫,০০০ মানুষ মারা গেল পিপাসায়। তবে এতে করে আওরঙ্গজেব পেলেন অসামান্য এক সামরিক সুবিধা, দারার পরিখা আর গোলন্দাজ বাহিনী সম্পূর্ণ নিষ্ফল হয়ে গেল। আওরঙ্গজেবের সামনে এখন আগ্রার উন্মুক্ত পথ। আর দারারই এবার চম্বল ত্যাগ করে রাজধানীতে ফেরার পালা। অনেক কামান ফেলে আসতে হলো তাঁকে নদীতীরে, ফলে পরবর্তী যুদ্ধে দুর্বল হয়ে গেল তার গোলন্দাজ বাহিনী। চম্বল থেকে বিজয়ীরা অগ্রসর হলো উত্তরে, আর তিন দিনের মাথায় শত্রুর মুখোমুখি হলো, আগ্রার প্রায় দশ মাইল পুবের শামুগড়ে।

৪.৫ ধৰ্মাত যুদ্ধের পর দারার গতিবিধি

যুদ্ধ শেষ হওয়ার দশ দিন পর ধর্মাতের পরাজয়ের সংবাদ গিয়ে পৌঁছাল সম্রাটের দরবারে, তারপর বালুচপুরে। তাড়াহুড়ো করে নতুন একটা সেনাবাহিনী গঠন করলেন দারা। ৬০,০০০ সেনাসংখ্যার সেই বাহিনীর চেহারা আপাতদৃষ্টিতে ভয়ংকর হলেও সেখানে ছিল নানা জায়গার নানা শ্রেণীর মিশ্রণ। তা ছাড়া সেনাপতিদের অনেকেই সম্রাটের দরবারের বসে থাকা সেনা, তাদের না ছিল সাহস কিংবা একজন দাক্ষিণাত্যের সেনাপতির অভিজ্ঞতা। দারা মারাত্মক ভুল করেছিলেন তাঁর সবচেয়ে বিশ্বাসী আর যোগ্য সেনাপতিদের সুলাইমান শুকোর অধীনে সুজার বিরুদ্ধে পাঠিয়ে । দরবারের বিদেশি মুসলমানেরা দারার রাজপুত প্রীতিতে বিরক্ত হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিল নিয়তির হাতে। শাহজাহানও তাঁর অনেক অসুবিধা সৃষ্টি করেছেন। সম্রাট এখনো তাকে যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে বলছেন এই আশায় যে তার পুত্রদের কলহ কূটনীতির মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যাবে।

১৮ মে, আগ্রা দুর্গের দিওয়ান-ই-আমে বৃদ্ধ পিতার কাছ থেকে সকরুণ এক বিদায় নিয়ে এলেন তিনি চম্বলে। মাসের ২২ তারিখে ঢলপুর পৌঁছে বন্ধ করে দিলেন তিনি আশপাশের সমস্ত অগভীর নদীপথ। তার লক্ষ্য ছিল আওরঙ্গজেবের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করে সুলাইমান শুকোর সেনাবাহিনীর আগমনের অপেক্ষায় থাকা। কিন্তু তিনি জেনে মহাবিরক্ত হলেন যে ২৩ তারিখে আওরঙ্গজেব নদী পেরিয়ে গেছেন ঢোলপুরের ৪০ মাইল পুব দিয়ে। সুতরাং আগ্রার দিকে ফিরে দারা তাঁবু ফেললেন শামুগড়ের কাছে, যেখানে আওরঙ্গজেব এসে পৌঁছালেন ২৮ তারিখে।

সেদিন দারা এমনভাবে তেড়ে গেলেন যেন যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু শত্রুসেনা চোখে পড়তে তিনি লক্ষ করতে লাগলেন তাদের গতিবিধি। সূর্য ঢলে পড়তে দারা তাঁবুতে ফিরলেন। তার এই পদক্ষেপ ছিল মহাভুল; আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনী কেবল সংখ্যাতেই কম ছিল না, পানিবিহীন আর বালুকাময় একটা সমভূমির ওপর দিয়ে দশ মাইল আসার ফলে তারা ছিল ভীষণ ক্লান্ত, পক্ষান্তরে দারার সেনাবাহিনী ছিল সতেজ। সারাদিন কিছু না করে প্রচণ্ড গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অযথাই ক্লান্ত হলো দারার সেনা, ঘোড়া আর হাতি, ওদিকে আগামী সকালের যুদ্ধের জন্য দূরদর্শী আওরঙ্গজেব তার সেনাদের দিলেন সারা রাতের বিশ্রাম।

৪.৬ শামুগড়ের যুদ্ধ, ২৯ মে, ১৬৫৮

পরদিন সকালে দারা তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন তাঁবুর দুই মাইল সামনের এক বিস্তৃত সমভূমিতে। ৫০,০০০ সেনার বিশাল একটা বাহিনী। এখানে রয়েছে রাজপুত আর দারার অসংখ্য অনুগত সেনা । কিন্তু বাহিনীর প্রায় অর্ধেকই সম্রাটের সেনা, যাদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না; তাদের অনেক সেনাপতি, বিশেষ করে খলিলুল্লাহ খানকে আওরঙ্গজেব কলুষিত করেছেন। দারার সম্মুখ জুড়ে এক সারিতে দাঁড়াল গোলন্দাজ বাহিনী; তার পেছনে পদাতিক মাস্কেটধারীরা, তারপর হাতি, আর সবার পেছনে গাদাগাদি করে থাকা অশ্বারোহী। আওরঙ্গজেবের তুলনায় দারার গোলন্দাজ বাহিনী ছিল কম ভ্রাম্যমাণ; ঘোড়া আর মালবাহী পশুগুলোও অনুপযুক্ত।

পক্ষান্তরে আওরঙ্গজেবের ছিল অভিজ্ঞ সেনা, যুদ্ধের উপযুক্ত ঘোড়া, আর ইয়োরাপিয়ান গানারসমৃদ্ধ মীর জুমলার অতুলনীয় গোলন্দাজ বাহিনী। সেনাপতিদের মধ্যে ছিল দারুণ একতা, প্রভুর আদেশ মানতে তারা বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি।

যুদ্ধ শুরু হলো দুপুরবেলা। একযোগে গর্জে উঠল দারার সমস্ত কামান, যুদ্ধক্ষেত্র যেন কেঁপে উঠল, কিন্তু দূরপাল্লার কারণে শত্রুর তেমন ক্ষতি হলো না; আওরঙ্গজেব বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর বারুদ আর গোলা সংরক্ষণ করলেন।

এক ঘণ্টা কেটে গেল গোলাবর্ষণের মাধ্যমে, তারপর আক্রমণের আদেশ দিলেন দারা। তাঁর বাম পাশের নেতৃত্বে ছিল রুস্তম খান। খোলা তরবারি হাতে রণহুঙ্কার ছেড়ে দারার সেনারা আক্রমণ চালাল বিপক্ষ গোলন্দাজ বাহিনীর ওপর। আওরঙ্গজেবের গোলন্দাজ বাহিনীর সেনাপতি শাফ শিকন খান আর মাস্কেটধারীরা এতে একটুও দমে না গিয়ে আক্রমণের জবাব দিল গোলা, বুলেট, তীর, আর বর্শা ছুঁড়ে। দারার সেনাদের গতি ব্যাহত হলো কামানের গোলার আঘাতে। সুতরাং রুস্তম খান ডান পাশে ঘুরে ধুলো উড়িয়ে ছুটল আওরঙ্গজেবের সর্বাগ্রভাগের দিকে। কিন্তু ডান পাশ থেকে দ্রুত উঠে এসে রুস্তম খানের পথ রোধ করে দাঁড়াল বাহাদুর খান। শুরু হলো হাতাহাতি যুদ্ধ; বাহাদুর খান আহত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে, আর যখন তার দলকে মনে হলো পরাজয়ের সম্মুখীন, সহায়তার জন্য এগিয়ে এল ইসলাম খান আর শেখ মীর। এবার রুস্তম খানের বিপদের পালা। বাহুতে মারাত্মক জখম নিয়ে গোটা ১২ বেপরোয়া সেনাসহ এগোবার একটা শেষ চেষ্টা করল রুস্তম খান, তারপর লুটিয়ে পড়ল স্তূপীকৃত লাশের মধ্যে। দারার বাম পাশের অতি অল্পসংখ্যক অবশিষ্ট সেনা পালিয়ে ফিরে এল শিপির শুকোর নেতৃত্বে।

একই সময়ে আওরঙ্গজেবের বাম পাশে সংঘটিত হলো আরও ভয়ংকর এক যুদ্ধ। জুলফিকারের গোলন্দাজ বাহিনী আর মুরাদের বাহিনীর ফাঁক গলে ছত্র শাল হাদার অধীন রাজকীয় সর্বাগ্রভাগের রাজপুতেরা গিয়ে পড়ল শাহজাদার ওপর। ফলে আওরঙ্গজেবের বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন মুরাদ। পাগড়িতে অমূল্য এক ছড়া মুক্তো জড়ানো, হলুদ আলখাল্লা পরা, রাজা রাম সিংহ রাঠোর হামলে পড়ল মুরাদের হাতির ওপর, উপহাসের চিৎকার ছেড়ে বলল, তুমি দারার কাছ থেকে সিংহাসন কেড়ে নিতে চাও!’ লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো মুরাদকে ছোঁড়া রাজার বর্শা, পরক্ষণেই শাহজাদার তীরে রাজা খতম হয়ে গেল । রাজপুত অশ্বারোহীরা মুরাদের বিশাল হাতির বিপক্ষে সুবিধা করতে পারল না; কিন্তু তিনটে জখম হলো মুরাদের মুখে; মাহুত মারা পড়ল, তীর বিঁধে বিধে হাওদার চেহারা হলো শজারুর পিঠের মতো; শাহজাদা খানিকটা পিছু হটলেন।

এবার রাজপুতেরা গিয়ে পড়ল মুরাদের সহায়তায় এগিয়ে আসা আওরঙ্গজেবের ওপর। শুরু হলো শক্তিশালী দুই বাহিনীর মরণপণ যুদ্ধ। রাজপুতেরা আওরঙ্গজেবের একদম কাছে যাবে, কিন্তু শাহজাদার প্রহরীরা কিছুতেই তাদের যেতে দেবে না। মুরাদের সঙ্গে যুদ্ধে রাজপুতদের সংখ্যা কমে গিয়েছিল, তাই শেষমেশ তারা পেরে উঠল না শাহজাদার বাহিনীর বিপক্ষে। তবু যুদ্ধ করল তারা শত বিপদ উপেক্ষা করে। একের পর এক পতন হলো তাদের সব নেতার ছত্র শাল হাদা, রাম সিংহ রাঠোর, ভীম সিংহ গৌড় আর শিবরাম গৌড় । অবশিষ্ট রাজপুতেরা যুদ্ধ করল-ইয়োরোপিয়ান এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায়, ‘বুভুক্ষু কুকুরের মতো। ঘোড়র পিঠ থেকে লাফিয়ে নামল রাজা রূপ সিংহ রাঠোর, খোলা তরবারি হাতে আওরঙ্গজেবের হাতের কাছে ছুটে গিয়ে কেটে দেওয়ার চেষ্টা করল হাওদার রশি, যেন শাহজাদা মাটিতে পড়ে যান। হাতির পায়ে তরবারির কোপ মারল সে, কিন্তু দেহরক্ষী তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলল। এভাবেই ধ্বংস হয়ে গেল দারার বাম আর ডান পাশের সেনারা।

৪.৭ শামুগড়ে দারার নিজ গতিবিধি; যুদ্ধের শেষ

যুদ্ধের শুরুতেই রুস্তম খান আর ছত্র শাল আক্রমণে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারা কেন্দ্রভাগে তার নিজ অবস্থান ত্যাগ করে গোলন্দাজ বাহিনীর মাঝখান দিয়ে আওরঙ্গজেবের ডান পাশে ছুটলেন রুস্তম খানকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে। এটার চেয়ে মারাত্মক ভুল আর কিছুই হতে পারে না। দারার পক্ষে পুরো যুদ্ধক্ষেত্র ঘুরে ঘুরে প্রধান সেনাপতির মতো সেনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব ছিল না; ফলে তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গিয়েছিল বিশৃঙ্খলা । দ্বিতীয়ত, গোলন্দাজ বাহিনীর সামনে দিয়ে ছোটায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের কামান। অথচ আওরঙ্গজেবের গোলা তার সেনাদের শুইয়ে দিচ্ছিল বিরামহীনভাবে। বিশেষ করে, এই ভুলটা দারার যুদ্ধ খতম করে দিয়েছিল। শত্রুসেনার গোলার হাত থেকে রক্ষা পেতে দারা এবার ঘুরলেন ডানে, আর সোজা গিয়ে পড়লেন শেখ মীরের অধীন সেনাদলের মুখোমুখি।

ঠিক সেই সময় আওরঙ্গজেবের কোনো প্রহরী ছিল না। দারা যদি তখন পথ করে প্রতিদ্বন্দ্বীর পাশে গিয়ে উপস্থিত হতে পারতেন, তাহলে জয় হয়তো তারই হতো। কিন্তু তিনি তখন দেরি করেছিলেন কিছুক্ষণের জন্য, যুদ্ধক্ষেত্রের জটিলতা আর হঠাৎ পেয়ে বসা তার অবসাদের কারণে। আর, সামান্য এই দেরির ফলেই সুবর্ণ সুযোগ তার হারিয়ে গেল চিরতরে। কারণ, আওরঙ্গজেব ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন। ভয়াবহ গরম দারার সেনা আর ঘোড়াকে কাহিল করে ফেলল, আর তার মধ্যেই তার বাম পাশের সেনাদের ওপর একের পর এক আছড়ে পড়তে লাগল শত্রুপক্ষের গোলা। দমবন্ধ করা ধুলোর মধ্যে, আগুনের মতো গরম বালির ওপর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েছিল তার লোকজন, সূর্যের গনগনে তাপে বর্ম ফোঁসকা ফেলে দিয়েছিল তাদের গায়ে, পিপাসা মেটানোর জন্য এক ফোঁটা পানিও ছিল না।

আওরঙ্গজেবের সর্বাগ্রভাগের সেনারা তাদের অবস্থান ছেড়ে নড়ল না। ওদিকে দারার বাহিনীর দুরবস্থা আর বিশৃঙ্খলা দেখে পিতার সর্বাগ্রভাগে নিযুক্ত শাহজাদা মুহম্মদ সুলতান ছুটে গেলেন দারাকে আক্রমণ করতে। একই সময়ে আওরঙ্গজেবের ডান পাশের সেনারাও ঘুরল দারার বাহিনীর দিকে। আসলে তখনই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে দারা জেনে গেছেন তাঁর সেরা সেনাপতিদের মৃত্যুসংবাদ, আর এখন আওরঙ্গজেবের বাহিনী, সাগরের ঢেউয়ের মতো তার দিকে এগিয়ে আসছে অসংখ্য বন্দুক উঁচিয়ে। তাদের নির্ভুল নিশানায় প্রতি মিনিটে ধরাশায়ী হচ্ছে তার চারপাশের সেনা। দারার নিজস্ব হাতিও পরিণত হলো শত্রুদের গোলার লক্ষ্যবস্তুতে। হতভাগ্য শাহজাদার এখন এই হাতি থেকে নেমে একটা ঘোড়া নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এতেই পূর্ণ হলো সর্বনাশের ষোলোকলা। চারপাশ থেকে সেনারা দারার হাতির হাওদা শূন্য দেখে নিশ্চিত হলো যে তাদের প্রভু মারা গেছে। মাত্রাতিরিক্ত গরমে পুঁকতে ধুঁকতে এমনিতেই তারা খুঁজছিল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানোর একটা সম্মানজনক অজুহাত, ফলে এই সুযোগ তারা আর হাতছাড়া করল না। মুহূর্তে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল চরম বিশৃঙ্খলা, যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। কয়েকজন মাত্র বংশগত অনুসারী ছাড়া দারা দাঁড়িয়ে রইলেন প্রায় একা। তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাকে বের করে নিয়ে চলে গেল আগ্রা।

প্রতিরোধের সর্বশেষ আশাটুকুও উবে গেল; তবে কেউ এল না তাড়া করে। তাড়ার প্রয়োজনই বা কী, এটার চেয়ে সম্পূর্ণ বিজয় তো আর হতে পারে না। পরাজিত দল হারাল দশ হাজার মানুষ, তার সঙ্গে অসংখ্য ঘোড়া আর মালবাহী পশু। সম্রাট-বাহিনীর নিহত উচ্চপদস্থ সেনার মধ্যে রয়েছে নয়জন রাজপুত আর উনিশজন মুসলমান।

সাহসীদের মধ্যেও সেরা সাহসী মানুষ ছিল বুন্দি গোত্রপ্রধান আর বাহান্ন। যুদ্ধের বীর রাও ছত্র শাল হাদা। এই যুদ্ধেও যথারীতি চিৎকার ছেড়ে আর নিজে উদাহরণ সৃষ্টি করার মাধ্যমে গোত্রের সেনাদের উৎসাহ জোগাচ্ছিল, এমন সময় কামানের একটা গোলা তার হাতিকে আঘাত হানলে জানোয়ারটা ভয় পেয়ে পালাতে লাগল। তখন ছত্র শাল সেই হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে একটা ঘোড়া চেয়ে চিৎকার করে বলল, আমার হাতি শত্রুকে দেখে পালিয়ে যেতে পারে, কিন্তু তার প্রভু কখনোই পালাবে না।’ ঘোড়ায় চেপে গোত্রের সেনাদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে শাহজাদা মুরাদের দলের ওপর, আর যখন সে বর্শা দিয়ে শাহজাদাকে বিদ্ধ করতে উদ্যত, একটা বুলেট তার কপাল ভেদ করল। ধর্মাত আর শামুগড়ের দুই যুদ্ধে বারোজন যুবরাজসহ নিহত হলো প্রত্যেকটা হাদা গোত্রের প্রধান।

তবে এই যুদ্ধের নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল উজবেক আর পারসি যুদ্ধের বীর রুস্তম খান ওরফে ফিরুজ জং।

আওরঙ্গজেবের বাহিনী হারিয়েছিল মাত্র একজন সেনাপতি, আজম খান, মারা গিয়েছিল সে অত্যধিক গরমে।

উল্লেখ্য, জয়ের সমস্ত আশা হারিয়ে দারার হাতি থেকে নেমে আসার বর্ণনা দিয়েছেন আকিল, মাসুম আর কামু। এই সমসাময়িকগণের নির্ভরযোগ্য তথ্য মানুচি আর বার্নিয়ারের বাজার-চলতি এই গুজবকে খণ্ডন করেছে যে দারা তার হাতি বদল করে ঘোড়ার পিঠে উঠেছিলেন খলিলুল্লাহ খানের বিশ্বাসঘাতী পরামর্শে ।

৪.৮ আগ্রার ঘটনা আর শাহজাহানের বন্দিত্ব, জুন ১৬৫৮

শামুগড় থেকে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে দারা আগ্রা পৌঁছালেন রাত নয়টায়, আর নিজ বাড়িতে ঢুকে বন্ধ করে দিলেন ঘরের দরজা। শহরজুড়ে বিরাজ করছিল আতঙ্ক, এবার রাজকীয় পরিবারে উঠল কান্নার রোল। শাহজাহান সংবাদ পাঠালেন, দুর্গে গিয়ে দারা যেন তার সঙ্গে দেখা করেন; কিন্তু শারীরিক এবং মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত দারা পিতার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বললেন, এই মুখ আমি আর মহামান্য সম্রাটকে দেখাতে চাই না। এখন সামনে আমার এক সুদীর্ঘ যাত্রা, বরং সেই পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে দিন বিদায়ী আশীর্বাদ।

হতভাগ্য শাহজাদা, তাঁর স্ত্রী, সন্তান আর জনা বারো ভূত্যসহ আগ্রা ত্যাগ করে দিল্লির পথে রওনা দিলেন রাত তিনটেয়। শাহজাহানের আদেশে প্রাসাদের কোষ থেকে তাঁকে দেওয়া হলো কয়েকটা খচ্চরভর্তি স্বর্ণমুদ্রা, আর তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি নিলেন নিজেদের বহনসাধ্য-পরিমাণ গহনা আর নগদ টাকা । পরবর্তী দুই দিন পথিমধ্যেই তাঁর সঙ্গে যোগ দিল অনুসারীদের ছোট ছোট দল। সবসুদ্ধ তার দলে ৫,০০০ মানুষ হলো দিল্লি পৌঁছাতে পৌঁছাতে।

শামুগড়ের যুদ্ধের পর মুরাদকে অভিনন্দন জানিয়ে আওরঙ্গজেব বললেন, ছোট ভাইয়ের বীরত্বের জন্য তিনি বিজয়ী হতে পেরেছেন, সুতরাং এই মুহূর্ত থেকেই শুরু হবে মুরাদের রাজত্ব। এমনকি আহত মুরাদের সেবাও করলেন তিনি যত্নের সঙ্গে।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিজয়ীরা এলেন আগ্রার বাইরের নূর মঞ্জিল বা ধারার বাগানে (১ জুন)। এখানে তারা অবস্থান করলেন দশ দিন। প্রতিদিন দলে দলে সভাসদ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আর অফিসারেরা সম্রাটের পক্ষ ত্যাগ করে এসে যোগ দিতে লাগল তাদের সঙ্গে, এবং দারার পক্ষের অফিসারেরাও বাদ গেল না।

শামুগড়ের যুদ্ধের পরদিন আওরঙ্গজেব সরাসরি শাহজাহানকে লিখেছিলেন যে শত্রুদের কার্যকলাপে বাধ্য হয়েই তাঁকে এই যুদ্ধ করতে হয়েছে। নূর মঞ্জিলে এসে তিনি শাহজাহানের স্বহস্ত লিখিত জবাব পেলেন, সম্রাট তাঁকে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খানিক দ্বিধার পর তার কয়েকজন বন্ধুর পরামর্শে (বিশেষ করে শায়েস্তা খান আর খলিলুল্লাহ) আওরঙ্গজেব আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। বন্ধুরা জানিয়েছিল যে শাহজাহান তাঁর বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পনা এঁটেছেন; আগ্রা দুর্গে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সম্রাটের তাতারি রক্ষিণীরা আওরঙ্গজেবকে হত্যা করবে।

অবশেষে মুখোশ খুলে পড়ল, জুনের পাঁচ তারিখে শাহজাদা আগ্রা দুর্গের অবরোধ শুরু করলেন। ইতিমধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র মুহম্মদ সুলতানকে পাঠিয়েছিলেন আগ্রা শহর দখল করে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য (৩ জুন)। অবরোধের জবাবে শাহজাহান বন্ধ করে দিলেন দুর্গের দরজা। সেই যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী দুর্গগুলোর মধ্যে এটা ছিল অন্যতম, আওরঙ্গজেবের গোলন্দাজ বাহিনীও এখানে সম্পূর্ণ অসহায় । সুতাং তাদের দুই ভাইকে এই অবরোধ চালিয়ে যেতে হতে পারে মাসের পর মাস, এমনকি বছর ধরে, যা দারাকে দেবে একটা নতুন সেনাবাহিনী গড়ে তোলার পর্যাপ্ত সময়।

তাই এক ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে আওরঙ্গজেব দখল করে নিলেন দুর্গের জল-কপাট (খিজিরি)। ফলে বন্ধ হয়ে গেল পানির সরবরাহ, গ্রীষ্মের এই মাঝামাঝি, যা রীতি মতো ভয়ংকর এক ব্যাপার। দুর্গের ভেতরে কিছু কুয়ো আছে বটে, তবে দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় সেগুলোর পানি হয়ে গেছে পান করার অযোগ্য। সম্রাটের বহু অফিসার চুপি চুপি পালিয়ে গেল দুর্গ থেকে।

মারাত্মক এই পরিস্থিতি শাহজাহান সহ্য করলেন তিন দিন। আওরঙ্গজেবের কাছে এক চিঠিতে সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে কাতর মিনতি করলেন যে তিনি যেন জীবিত একজন পিতাকে পিপাসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব জবাব দিলেন, এটা আপনারই কর্মের ফল। অবশেষে বুক ফাটা পিপাসায়, চারপাশে কেবল হতাশা আর বিশ্বাসঘাতকতা দেখতে দেখতে হার মানলেন বৃদ্ধ সম্রাট। ৮ জুন খুলে দিলেন তিনি দুর্গের সমস্ত দরজা, আর বন্দিত্ব বরণ করলেন প্রাসাদের হেরেমে। তার ক্ষমতা সম্পূর্ণ কেড়ে নেওয়া হলো, উদ্ধারের যেকোনো প্রচেষ্টা বানচাল করার লক্ষ্যে দুর্গের ভেতরে এবং চারপাশে মোতায়েন করা হলো শক্তিশালী বাহিনী, এমনকি সম্রাটের খোঁজাদেরও রাখা হলো চোখে চোখে, পাছে তারা তাঁর কোনো চিঠি নিয়ে যায় দুর্গের বাইরে। আগ্রা দুর্গের বিশাল ধনরাশি ভারতের তিন পুরুষের সফল শাসকদের সঞ্চয় চলে গেল আওরঙ্গজেবের অধিকারে।

১০ জুন শাহজাদি জাহানারা এলেন বোনের দাবি নিয়ে। শাহজাহানের নামে চার ভাইয়ের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগাভাগির প্রস্তাব দিলেন তিনি। আওরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন।

৪.৯ মুরাদ বখশের বন্দিত্ব ও মৃত্যু

১৩ জুন আওরঙ্গজেব আগ্রা শহর থেকে দিল্লি অভিমুখে রওনা দিলেন দারার সন্ধানে। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে থামতে হলো মথুরায়, কারণ, মুরাদের ঈর্ষা আর স্বেচ্ছাচারের ফলে এক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শাহজাদার সভাসদেরা তার কান ভারী করেছে যে প্রতিদিন তার হাত গলে একটু একটু করে বেরিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতা আর আওরঙ্গজেব হয়ে উঠছেন সর্বেসর্বা। রাজা হয়ে শাসন করার সম্ভাবনা তার ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তিনি যদি আওরঙ্গজেবের দাবার খুঁটি হয়ে শেষমেশ সব হারাতে না চান, তাহলে আর দেরি না করে তাকে রাজত্ব দাবি করতে হবে।

সভাসদদের কথা শুনে মুরাদ খোলাখুলিভাবেই আওরঙ্গজেবের বিরোধিতা শুরু করেছেন। তিনি সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন, আওরঙ্গজেবের বাহিনীতে সম্প্রতি যোগদান করা অনেক সেনাকে নিজ দলে টেনে নিয়ে গেছেন উচ্চতর পদ, মাসোহারা, আর অধিকতর স্বাধীনতার প্রলোভন দেখিয়ে। এমনকি বর্তমানে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে সাক্ষাকে তিনি আত্ম-অবমাননাকর হিসেবে বিবেচনা করেন।

পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। কিন্তু পরিকল্পনা আঁটতে আওরঙ্গজেবের মোটেই দেরি হলো না। প্রথমত, মুরাদের সন্দেহ তিনি সম্পূর্ণ দূর করে দিলেন উপহার হিসেবে ২০ লাখ টাকা আর ২৩৩টা ঘোড়া পাঠিয়ে দ্বিতীয়ত, মুরাদের জখমমুক্তি উদযাপন উপলক্ষে তিনি তাকে একটা ভোজে আমন্ত্রণ জানালেন, যেখানে দুই ভাই পলাতক দারাকে খুঁজে পাওয়ার উদ্দেশ্যে করবেন একান্ত পরামর্শ; শেষত, প্রচুর ঘুষ দিয়ে আওরঙ্গজেব নিজের দলে ভিড়ালেন মুরাদের প্রিয় খানসামা নূর উদ-দীন-খাবাসকে, যে ভাইয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণের ব্যাপারে মুরাদকে রাজি করিয়ে একটা মৃগয়া থেকে ফেরার পথে তাঁকে নিয়ে এল আওরঙ্গজেবের তাঁবুতে (২৫ জুন)।

মুরাদকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন আওরঙ্গজেব, আর প্রচুর ভোজ আর ওয়াইনে ভরপুর শাহজাদা ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার পর বন্দী করলেন তাঁকে নিরস্ত্র অবস্থায়। মধ্যরাতে মহিলাদের একটা আবৃত হাওদায় শক্তিশালী একটা অশ্বারোহী বাহিনীর অধীনে বন্দীকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলো সেলিমগড়, তারপর গোয়ালিয়রের রাষ্ট্রীয় কারাগারে। শত্রুর চোখে ধূলো দেওয়ার এই অসাধারণ কৌশল’ এতই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হলো যে মুরাদের অনুসারীরা যখন ঘটনা জানতে পারল, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরদিন মুরাদের নেতৃত্বহীন সেনাদের নেওয়া হলো আওরঙ্গজেবের অধীনে, এমনকি তাঁর নিবেদিত অফিসারদেরও নতুন প্রভুর বশ্যতা স্বীকার করা ছাড়া আর কোনো পথ রইল না। এভাবে, মুরাদের যাবতীয় সম্পত্তি চলে গেল আওরঙ্গজেবের অধিকারে।

তিন বছর মুরাদ থাকলেন গোয়ালিয়র দুর্গে, কিন্তু তাঁকে উদ্ধারের লক্ষ্যে বন্ধুবান্ধবদের একটা পরিকল্পনা অল্পের জন্য ভেস্তে গেল তাঁর নিজের বোকামিতে, আর এই ঘটনার পর আওরঙ্গজেব তাঁর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সম্রাটের প্ররোচনায় আলী নকীর দ্বিতীয় পুত্র মুরাদ কর্তৃক ১৬৫৭ সালে তার পিতৃহত্যার বিচার চাইল। ইসলামি আইন অনুসারে, কাজির কিছু করার ছিল না। ফলে, ১৬৬১ সালের ৪ ডিসেম্বর, গোয়ালিয়র কারাগারের নিভৃত কক্ষে দিল্লির সিংহাসনের জন্য উচ্চাভিলাষী, ভাগ্যবিড়ম্বিত এই শাহজাদার মস্তক ছিন্ন করল দুই ক্রীতদাস, আর তাকে সমাহিত করা হলো দুর্গের অভ্যন্তরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *