হর্ষবর্ধনের ‘দ্বিরাগমন’

হর্ষবর্ধনের ‘দ্বিরাগমন’

চেহারা খারাপ শুনলে হর্ষবর্ধন আর খাড়া থাকতে পারেন না। অমনি উনি শুয়ে পড়েন—যদি বিছানার কাছে থাকেন। চেয়ারের কাছাকাছি থাকলে তাঁকে যেন বসিয়ে দেয়।

যেদিন বিকেলে তিনি রাস্তায় ছিলেন, তা লোকটা যেন তাঁকে পথেই বসিয়ে গেল…

আনকোরা অচেনা মানুষ, কখনো তাকে দেখেননি এর আগে, মাটি ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এল অকস্মাৎ।

এগিয়ে এসে, চোখের উপর স্নিগ্ধ দৃষ্টি রেখে (আর কাঁধে এক হাত) শুধালেন তিনি হর্ষবর্ধনকে ‘শরীরটা কি খারাপ বোধ হচ্ছে আপনার?’

প্রতিবাদের ছলে মৃদুকন্ঠে হয়তো তিনি কিছু কইতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক—‘বলতে হবে না, আমি বুঝতে পেরেছি। বুকের ভেতর কেমন যেন গুড়গুড় করছে আপনার।’

সত্যি বলতে বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড়ুনি তিনি অনুভব করছিলেন কিছুক্ষণ থেকেই। কিন্তু সেটা শীতের জন্যেই তিনি ভেবেছিলেন। ভদ্রলোক কিন্তু তাঁর সে-ধারণা টলিয়ে দিলেন তক্ষুনি—এক লগুড়ের ঘায়।

বুকের ভেতরকার গুরুত্ব তিনি অনুভব করলেন।

‘হার্ট ফেল করার আগে অমনটা হয়।’—জানালেন ভদ্রলোক।

শুনে হর্ষবর্ধনের যেন খিল লাগল বুকে। গুড়গুড়ুনিও বন্ধ হওয়ার দাখিল হল যেন। ফ্যালফ্যাল করে তিনি তাকিয়ে রইলেন।

‘আপনার এটা কি অনেককালের বুকের ব্যামো নাকি?’

‘অ্যাঁ’।

‘আগেও কি এমন বুক ধড়ফড় করত আপনার?’

‘কই, মনে পড়ছে না তো,’ তিনি কন।

‘করত নিশ্চয়ই। ধরতে পারেননি। জানতে পারেননি কখনো। কিংবা টের পেয়েও হয়তো চেপে গেছেন। উচিত হয়নি সেটা। বুকের দোষ এমন করে পুষে রাখলে শেষটায় আফশোস করতে হয়। বুক কি কখনো কারও পোষ মানে মশাই’?

ভদ্রলোকের কথাটা খাঁটি বলেই তাঁর মনে হয়। বুকে একটা কুপোষ্যই বটে। বুক কিংবা ওই হৃদয় যা-ই বলা যাক, নিজের বা পরের যারই হোক-না, কিছুতেই কখনো পোষ মানানো যায় না। বুকের এই জান্তব প্রকৃতি তিনি জানতেন যেন।

সহজেই তিনি সায় দেন তাঁর কথায়—‘যা বলেছেন! হাঁ মশাই।’

‘এই পোষা রোগ কিছুতেই আপোশ করতে চায় না—বুঝেছেন? করোনারি থ্রমবোসিস হয় তা থেকেই।’

‘কী বললেন? কীসের সিস অ্যাঁ?’ হর্ষবর্ধনের বুকটা থমথম করে।

‘থ্রমবোসিস।’ মুখ ভার করে কন ভদ্রলোক— ‘করোনারি।’

‘থাইসিস বুঝি?’

‘তার চেয়েও খারাপ। থাইসিস তো দেখতে-শুনতে দেয়। চিকিৎসা রয়েছে তার। ভালো ওষুধপথ্যে সেরেও যায় অনেকের। কিন্তু এই থ্রমবোসিস হঠাৎ এসে পাকড়ায়— চোখে কানে দেখতে দেয় না একেবারে।’

‘অ্যাঁ?’ অ্যাঁ-করাটা তাঁর আর্তনাদের মতোই শোনায়। আহত হৃদয়ের থেকে চোঁয়া ঢেঁকুরের মতোই ডুকরে ওঠে যেন।

‘আর থাইসিস তো হয় যত গরিবগুরবোর—ভালো করে খেতে পরতে পায় না যারা। তাতে মারা পড়ে যায় বাজে পুঁচকেরা।’

‘আর আপনার এই সিসটায়?’

‘থ্রমবোসিসে? যত আমির ওমরাহরা—বড়োলোক যতসব এতেই যায় তো।’

হর্ষবর্ধন খতিয়ে দেখেন তখন। না, তিনি গরিব নন। টাকার গণিতে বড়োলোক বলেই তিনি গণনীয়। আর পুঁচকে তাঁকে বলা যায় না কিছুতেই। ভুঁড়ির বিপুল পরিধি নিয়ে এমন কলেবরে তিনি কি পুঁচকে? না, কখনোই নন। অতএব, থাইসিস নয়, হয় যদি তো থ্রমবোসিসই তাঁর হবে। নির্ঘাত।

‘কতদিনে হার্ট ফেল করে—ওই রোগটায়? ওই রোগে ধরলে—’

‘কতদিনে? বলুন, কতক্ষণে। হার্ট ফেল করতে সময় লাগে না মশাই। ট্রেন ফেল করার মতোই—এক মিনিটের এদিক-ওদিকেই হয়ে যায়। থাইসিসেই বরং ধীরে ধীরে তিলে তিলে শুকিয়ে শুকিয়ে—’

‘অ্যাঁ?’

‘কাশতে কাশতে—সুদীর্ঘকাল ওই কাশীবাসের পরেই কাঁসি বাজায় মানুষ। কিংবা ওই পটল তোলে—যা-ই বলুন।’

‘কিন্তু থাইসিস তো আর হয়নি আমার—’ দীর্ঘনিশ্বাস পাড়েন হর্ষবর্ধন।

‘দেখি তো আপনার হাতটা।’—ভদ্রলোক হাত বাড়ান। —‘না না, হাতের চেটো নয়। আয়ুরেখাটা দেখতে বলছেন? ও দেখে কী করব? ওসব কি আর মেলে মশাই আজকাল? আপনার নাড়িটা দেখতে চাইছি। হুম, ধরেছি ঠিক। পালস প্রেশার ভীষণ। প্যালপিটেশনটা ওই জন্যই। দাঁড়ান, একটা ট্যাক্সি ডাকি। আর হাঁটাচলা নয়। বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ুন চট করে। বিশ্রাম করুন। খাওয়াদাওয়া বন্ধ আজ। সাবু, বার্লি, বেদানার রস আর কমপ্লিট রেস্ট। হার্টের একজন ভালো ডাক্তার আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি এক্ষুনি—ঠিকানাটা বলুন তো আপনার?’

দুরুদুরু বক্ষে হর্ষবর্ধন ট্যাক্সিতে গিয়ে বসেন ভদ্রলোককে নিয়ে। বসাটাও যেন তাঁর কাছে দুরূহ ঠেকে। এলিয়ে পড়তে পারলে বঁাচেন যেন। ক্ষীণ কন্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করেন—‘আমি কি এখুনি, এই ট্যাক্সিতেই মারা যেতে পারি।’

‘না মরতেও পারেন যদি রোগটা আপনার গা-সওয়া হয়ে গিয়ে থাকে।’ ভদ্রলোক জানান—‘রোগটা আপনার ক্রনিক কি? এই বুক ধড়ফড় করা?’

হর্ষবর্ধন গোঁ গোঁ করেন, কিছুই ব্যক্ত করতে পারেন না।

‘ক্রনিক হলে তেমন ভয় নেই, ভয়ের কারণ নেই কোনো। মানে, এখনই কোনো আশঙ্কা নেই হার্ট ফেলের। তবে এ রকমের ধাক্কা আরও গোটা কয়েক এলে আর আপনাকে দেখতে হবে না। আজকের তালটা হয়তো আপনি সামলাতে পারবেন— যথাসময়ে যথাস্থানে পেয়েছিলেন আমায় ভাগ্যিস। অসময়ে বন্ধু মেলা ভাগ্যের কথা মশাই।’

‘আপনি বুঝি ডাক্তার?’

‘না, ডাক্তার নই। তবে ডাক্তারি বই ঘাঁটা আছে বিস্তর, হাজার রকমের রোগ আমার নখে।’

হর্ষবর্ধন তাঁর নখটা দেখার জন্য ঝোঁকেন।

‘না না, এই নখে নয়। নখের কোনো ব্যায়রাম নেই আমার। এই নখদর্পণে— সেই কথাই বলছিলাম। রোগী দেখলেই চিনতে পারি। তাই, রোগ ধরতে আমার দেরি হয় না। ওষুধের ক্যাটালগ দেখে দাবাইও বাতলে দিতে পারি মশাই। কিন্তু তার দরকার হবে না। রীতিমতো স্পেশালিস্ট ডাক্তারই চিকিচ্ছে করবেন আপনার— পাঠিয়ে দিচ্ছি তাঁকে এক্ষুনি। আমাদের পাড়াতেই থাকেন এক নামজাদা হার্ট স্পেশালিস্ট। কল দিলেই চট করে এসে পড়বেন তিনি এক্ষুনি। কিছু ভাবতে হবে না। ওই যা! আমার একটা জরুরি কল ছিল যে এক জায়গায়। যদি কিছু না মনে করেন, আপনার বাড়ির পথে দয়া করে যদি নামিয়ে দিয়ে যান আমায়।’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়। নামিয়ে দেব বই কী।’ হর্ষবর্ধন কৃতজ্ঞতায় গদগদ।

‘যেখানে নামব সেখান থেকে ফোন করে ডাক্তারকে আপনার ঠিকানায় যেতে বলব।’

হর্ষবর্ধনের আপত্তির কোনো কারণ দেখা গেল না। যে নাকি তাঁকে পরলোকের পথ থেকে ঘুরিয়ে আনে, তেমন আপনার লোকের জন্যে একটুখানি ঘুরে যাওয়া এমন কিছু কঠিন বলে তিনি বোধ করেন না।

গোপাল নগরের মোড়ে তাঁর বাসা। সেখানে পৌঁছোতে হাতিবাগান পাঁচ মাথার মোড় পাইকপাড়া ঘুরে, এমনকী সারা কলকাতায় ঘুরপাক খেতে খেতে যেতে হয়, বেহালা হয়ে আলিপুর হয়ে আলিপুরের কোনো এক টেরেসেই যেতে হয় তাঁকে তাতেও তাঁর আপত্তি নেই। তিন টাকার জায়গায় তিপান্ন টাকা উঠে গেল ট্যাক্সি মিটারে। ওই একটুখানি ঘুরতে গিয়ে, কিন্তু তিনি তা গায় মাখলেন না।

ঘরে ঢুকেই গোমড়া মুখে পড়লেন তিনি গোবরাকে নিয়ে—‘তুই তো আদপে গেরাহ্যিই করিসনে। কী দারুণ শক্ত ব্যারাম আমার—’

‘শক্ত ব্যারাম?’ শুনেই ভায়ের চোখ চড়কগাছ।

‘শক্ত না? একেবারে শীর্ষে উঠে গেছে।’

‘শিষে? সেআবার কী?’

‘শিষে মানে শীর্ষদেশে। ধানের শিষ তো ধানের শীর্ষদেশকেই বলা হয়। হতভাগা মুখ্য তাও তুই জানিসনে কতদিন বলেছি না যে আমার শরীর বড়ো খারাপ। কোনো একটা ভারী ব্যারাম আমাকে ধরেছে। এখন হল? হল তো এখন?’

‘কী হল তোমার দাদা?’ দেখে শুনে গোবরা তো হতবাক।

‘কী আবার হবে? একেবারে শিষে উঠে গেলাম আমি। সেখান থেকে কে নামায়, কবে নামি, কে জানে!’

‘তা হলেও ওই শিষের ব্যারামের নাম তো আছে একটা? নেই?’

‘ভারি বিদঘুটে ব্যারাম রে। যা হলে বুক ধড়ফড় করে।’

‘সেতো পেট গরম হলেও করে।’

‘তোকে বলেছে। পেট গরম হলে হার্ট ফেল করে কেউ? করোনারি হয়ে মারা পড়ে কেউ?’

‘করোনারি! ও তোমার ওই হাত কাঁপার কথা বলছ? বাত হলেও তা হয়।’

‘ধুত্তোর বাত। তোর সঙ্গে কোনো বাতচিত করতেই ইচ্ছে করে না আমার। এক নম্বরের আহাম্মক তুই। করোনারির সঙ্গে ওই হাত কাঁপার সম্পর্ক কোথায় শুনি’?

‘ওই কথায়। কর মানে হাত, আর নাড়ি মানে নাড়া—নাড়ানাড়ি—তার মানেই তোমার হাত-কাঁপানো। তবে হ্যাঁ, নারী আবার মেয়েছেলেও হয় বটে।’

‘ধুত্তোর মেয়ে! মেয়ের নিকুচি করেছে। মেয়ে নয় রে বাবা। করোনারিশিষ হচ্ছে কথাটা। নারি আর শিষের মধ্যে বেমক্কা একটা কথা রয়েছে, মনে পড়ছে না কিছুতেই— মোদ্দাকথা, তার মানে বুক ধড়ফড় করা।’

‘বুঝতে পেরেছি, করবেই তো বুক ধড়ফড়। হিড়িম্বা মার্কা কোনো মেয়ে যদি হাত নাড়ে কি শিষ দিয়ে কোনো ইশারা করে তাহলে কি তার বুক ধড়ফড় করবে না? ইয়া ইয়া পাঠঠা জোয়ানেরও প্রাণ কেঁপে উঠবে। এমনকী, হিড়িম্বার ওই কান্ড দেখে সাক্ষাৎ ওই ঘটোৎকচও উলটে পড়বে, আমি বলতে পারি। কিন্তু তুমি দাদা, গুরুজন, তোমার কাছে সব রহস্য বলা যায় না— তুমি কি বুঝবে?’

দাদার বুকের গুড়গুড়ুনির গুরুত্বের দিকটা কিছুতেই তাই সেবেফাঁস করতে পারে না। চেপে যায়।

হর্ষবর্ধন স্বয়ং তখন ভায়ের কাছে বিশদ হন। ব্যক্ত করেন আস্তে আস্তে। দুপুরের ব্যাপারটার আগাগোড়া হুবহু। শুনেটুনে গোবরা বলে—‘বুঝেচি, আর বলতে হবে না। লোকটা তোমার ঘাড়ে চেপে নিজের বাড়ি ফেরার জন্যেই এই চালটা চেলেছে’।

‘আমার ঘাড়ে চেপে?’ ভায়ের কথায় দাদাকে খাপ্পা হতে হয়।

‘ঘাড় না হয়ে ট্যাক্সিই হল না হয়। একই কথা। নইলে তোমার ইয়া বুক— এমন লম্বা-চওড়া—আর এইসা ছাতি—যা খোলা যায় কিন্তু কিছুতেই বোজানো যায় না, এর মধ্যে কোনো গলা ঢুকতে পারে?’

গোবরার কথাটাও মনে লাগে দাদার। নেহাত মিথ্যে বলছে না সে— ‘হ্যাঁ, যা বলেছিস! তা ছাতি একখানা বটে। খোলা যায়, তবে এই শীতকালে যায় না। খুললে এখুনি বুক গুড়গুড় করে হার্ট ফেল হয়ে যাবে হয়তো। ফলে যাবে লোকটার কথা।’

‘খুলতে হবে না, বোজাই থাক।’ ভাই কয়—‘তবে রোগ ব্যারাম কিছুই হয়নি তোমার। লোকটা এক নম্বরের জোচ্চোর। মিথ্যেবাদী চালিয়াত। ফক্কর ফাজিল। পাজি ইস্টুপিট। পরের পয়সায় ট্যাক্সি চাপার ফিকিরে ফেরে।’

‘ফেরেববাজ একজন? বলছিস তুই?’

‘বলবই তো। সত্যি কি না দেখতে পাবে এক্ষুনি। ডাক্তার পাঠাবে বলেছিল না লোকটা? তা আর পাঠিয়েছে। দেখে নিয়ো তার ডাক্তার ভুলেও এ পথে পা বাড়াচ্ছে না। দেখো তুমি।’

দেখলেন হর্ষবর্ধন, সারাদিন ধরেই দেখলেন। হার্ট স্পেশালিস্ট দূরে থাক, কোনো কম্পাউণ্ডারের টিকিও দেখা গেল না একদম।

‘খুব অসুস্থ বোধ করছেন কি আপনি?’ সামনে পড়ে কে যেন এসে শুধাল হর্ষবর্ধনকে হঠাৎ। আর একদিন। ‘খারাপ বোধ হচ্ছে খুব?’

হর্ষবর্ধন তাকিয়ে দেখেন একবার। তারপর কন—‘হচ্ছিল না, তবে এখন হচ্ছে। বেশ হচ্ছে।’

‘কী হচ্ছে বলুন তো?’ দুশ্চিন্তিত ভদ্রলোককে দারুণ জিজ্ঞাসু বলে বোধ হয়।

‘ওই খারাপ বোধটা। এই আপনাকে দেখেই—এই মাত্তর।’

‘তার মানে, মাস দুয়েক আগে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল না? চিনতে পেরেছি আপনাকে। সেই থমবোসিসওয়ালা—আপনিই-না মশাই? হাড়ে হাড়ে চিনেছি আপনাকে। না মশায়, না। কিছু অসুস্থ বোধ করছিনে, ভালো আছি বেশ, বহালতবিয়তে দস্তুর মতোই, তোফা আছি, খাসাও বলা যায়—বুক ধড়ফড়-টড়ফড় কিছু আমার নেই, কী আশ্চয্যি, আপনি একটা লোককে দু-বার ঠকাতে এসেছেন? একটা খাসিকে ক-বার জবাই করবেন মশাই!’

‘খাসা! বলছেন খাসা। খাসি বলছেন নিজেকে। খাসা! তবে খাসির চেয়ে মোষ বলাটাই মানাত আপনাকে মশাই!’

‘চুপ।’ বলে হর্ষবর্ধন কথাটার রাষ্ট্র ভাষায় অনুবাদ করে দেন সঙ্গে সঙ্গে—‘চুপ করুন। খামোশ!’

‘না মশাই। যত করেই বলুন-না। আপনাকে আমি খেতে পারব না। খেলে হজম হবে না।’—ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন—‘তবে পুলকিত হয়েছি খুব—আপনার কথায়। আসুন আপনার সঙ্গে কোলাকুলি করি।’

‘রক্ষে করুন, খুব হয়েছে।’ তিন-পা পিছিয়ে আসেন তিনি।—‘আর আপনার ওই কোলাকুলিতে কাজ নেই। বুঝতে পেরেছি আপনার মতলব। কোলাকুলির ছুতোয় আপনি কিছু একটা শুঁকিয়ে দেবেন আমায়, অমনি আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ব— তারপর হুঁশ হলে দেখব—’

দেখবেন যে তাঁর জুতো নেই, জামা নেই, পরনে গামছা, পকেট ফাঁকা, ট্যাঁকঘড়ি আর মানিব্যাগ লোপাট। একটা অন্ধকার ঝুপরির ভেতর ঘুপটি মেরে শুয়ে রয়েছেন। আজ সকালের কাগজেই এমনধারা দুর্ঘটনার খবর তিনি পড়েছেন। না, সেই নাজেহালের মধ্যে পা বাড়াতে তিনি নারাজ। সাধ করে কে গলা বাড়িয়ে বদমাশদের বগলে যায়? বিপাকে পড়ে খাবি খায়?

এক-পা এক-পা করে তিনি পেছন। ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায়। কিন্তু কপালে বেহুঁস হওয়া থাকলে কে আটকায়? রেহাই আছে তার থেকে?

হুঁস হলে তিনি দেখতে পান যে শুয়ে আছেন—খুপরি ঝুপরির ভেতরে নয়—নিজের ঘরেই। খাটের উপরে, হাতে-পায়ে ব্যাণ্ডেজ বঁাধা। গোবরা বসে তার পাশটিতে।

‘কী হয়েছে রে গোবরা? আমার হাতে-পায়ে ব্যথা কেন রে?’—কাতর স্বরে তিনি শুধান ভাইকে।—‘কী হয়েছে আমার?’

‘এমন কিছু হয়নি দাদা। মোটরের চোট লেগেছে একটু, না না, মোটরচাপা পড়নি তুমি। তুমি যে-সময়ে ফুটপথ থেকে নামছিলে-না? সেই সময় একটা ট্যাক্সি তোমার পিছনে এসে ধাক্কা মারে সেখানে। তার ধাক্কায় তুমি পড়ে যাও। একটু চোট লেগেছে তাইতেই। তাও এমন কিছু না, হাত-পা এক-আধটু ছড়ে গেছে—এই মাত্তর। দু-চার দিনের মধ্যেই তা সেরে যাবে, ভয়ের বা ভাবনার কোনো কারণ নেই, বলে গেছেন ডাক্তার।

‘আর সেই লোকটা?’ হর্ষবর্ধনের মনে পড়ে তখন—‘আমার ঘড়ি, মানিব্যাগ, ফাউন্টেন পেন?’

‘সব ঠিক আছে। ছোঁয়নিকো কেউ, ট্যাক্সিওয়ালা লোক খুব ভালো। তক্ষুনি নিজের ট্যাক্সি করে তোমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে এখেনে। পকেট-টকেট মারেনি কেউ। আর সেই ট্যাক্সিওয়ালা—এমন লোক প্রায় দেখা যায় না। মিটারে যা উঠেছিল তার বেশি একটা পয়সাও সেচায়নি। বড়ো ভালো লোক।’

‘আমার ঠিকানা সেজানল কী করে?’

‘তোমার যে বন্ধুটি সঙ্গে ছিল সেই তাকে বলে দিয়েছিল তোমার ঠিকানা।’

‘আমার বন্ধু?’—হর্ষবর্ধনের তাজ্জব লাগে—‘বন্ধু আবার কে ছিল আমার?’

‘তোমার সঙ্গে ছিল যে, তাকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসতেই তো দেরি হল ট্যাক্সিওয়ালার। নইলে তোমায় আরও ঘণ্টা খানেক আগে সেআনতে পারত। আলিপুর না চিড়িয়াখানায় কোথায় যেন থাকেন তোমার বন্ধুটি। গড়পারে না কি গড়ানহাটায়। সেসব জায়গা ঘুরে যেতেই এই বিয়াল্লিশ টাকা পড়েছিল। নইলে তিন টাকার মধ্যে সেএনে ফেলতে পারত।’

‘যাক গে বিয়াল্লিশ টাকা।’ হর্ষবর্ধন টাকার কথাটা টাকার মতো উড়িয়ে দেন— ‘অসময়ের বন্ধু তো! আর বাহাদুরও বলতে হয় লোকটাকে। মোটর ছাড়া যে এক পা নড়ে না, তাও আবার নিজের পয়সায় নয়। কিন্তু আমি ভাবছি, রোজকার ট্যাক্সি ভাড়াটা তার নাহয় পরের ট্যাঁক থেকেই আসে, সেনিজের পেট চালায় কী করে? কার ঘাড় ভেঙে খায় তাই আমি ভাবছি।’

হর্ষবর্ধক হর্ষবর্ধনের আর এক কাহিনি বলি।

সেদিন হর্ষবর্ধনের বাড়ি গিয়ে দেখি ভারি তুলকালাম কান্ড! দারুণ তাঁর মারমার কাটকাট!

‘কী! কী হয়েছে মশাই?’ আমি বলি—‘হঠাৎ এমন মারমূর্তি ধরেছেন কেন? এমনটা তো দেখিনি কখনো।’

‘আমার আবার মূর্তি দেখলেন কবে? ছেলেমেয়ে হয়েছে আমার? আমি কি ছেলের বাপ?’—তাঁর জবাব সাফ!

‘তাহলেও মামার মূর্তি তো দেখাবেন আমায়? আমার কাছে অন্তত।’ টিকলু কয়— সেআমার সঙ্গে ছিল। ‘আমি কি আপনার ভাগনে না হর্ষমামা? আপনি আমার শিব্রাম মামার বন্ধু যে কালে—’

উনি ওর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করলেন কেবল, কিন্তু কানে তুললেন না কথাটা।

‘হয়েছেটা কী বলুন তো?’ সেশুধোয়।— ‘দেখি আমি কী করতে পারি।’

‘তুমি আর কী করবে তার? আমার রক্ষাকবচ হারিয়ে গেছে, আমি মারা পড়ব এবার। মরব নির্ঘাত। তুমি কি আর কী করবে।’

‘রক্ষা করব। রাতদিন পাহারা দেব আপনাকে। আমিই হব আপনার রক্ষাকবচ। দেখি কেটা কী করতে পারে।’—দাপটের সঙ্গে সেজানায়।

‘তা পারলেও পারতে পারে বটে।’ আমি সায় দিই ওর কথায়— ‘বয় স্কাউটের লিডার ও। পাড়ার গার্ড। তা ছাড়া ছোটোখাটো একটা গোয়েন্দাও বলা যায়।’

‘গোয়েন্দা? ঝুড়ি ঝুড়ি ডিটেকটিভ বই পড়া গোয়েন্দা বুঝি?’ তাহলেও কথাটায় যেন উনি একটু আশ্বাস পান—‘কাজটা ওই টিকটিকিদেরই বটে।’

‘তাহলে ঠিক ঠিক বলুন তো মামু, হয়েছে কী?’ টিকলুর টিক্কনি।

‘বললুম-না আমার রক্ষাকবচ হারিয়েছে, আমার গুরুদেবের দেওয়া। আমার মৃত্যুবাণ খোয়া গেছে। রাবণের যেমন মৃত্যুবাণ ছিল-না? মর্মর স্তম্ভের মধ্যে লুকানো’।

‘আপনারটা কোনখানে লুকোনো ছিল দেখান কোন দেয়ালে? দেয়ালের কোনখানটায়?

‘কোনো দেয়ালে নয়, আমার হাতেই ছিল তো।’

‘হাত থেকে খোয়া গেল? সেকী!’ টিকলু অবাক হয়।

আমিও কম অবাক হই না।—‘আপনার হাতের কবচ কোনোদিন তো আমার নজরে পড়েনি মশাই?’

‘হাতের মধ্যে হাতার ভেতর ঢাকা থাকত না? দেখবেন কী করে?’

‘তাই বলুন। তা, কতবড়ো হবে কবচটা? সোনার না কি?’—শুধোই।

‘সাধারণ মাদুলির মতোই সাইজ। মাদুলি যেমনটা হয়-না—তেমনটাই। সাধারণ তামার মাদুলি। ওর ভিতর গুরুদেবের রক্ষামন্ত্র পড়া রয়েছে কিনা—কবচ বলা হচ্ছে সেইজন্যেই।’

‘তাই বলুন!’ টিকলু হাঁফ ছাড়ে—‘আপনার ওই কবচ আমি খুঁজে দেব এক্ষুনি’।

‘তা ওই মাদুলির জন্যে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন আপনি? খোঁজাখুঁজি করেও সেটা নিতান্তই যদি না মেলে তো কী হবে তাহলে? স্বর্গ রসাতল হয়ে যাবে না।’

‘বললাম-না, আমার মৃত্যুবাণ। ওটা হারালে আমি প্রাণ হারাব। ধনেপ্রাণে মারা পড়ব আমি। এখন ক্ষণে ক্ষণে আমার মৃত্যুভয়। মুহূর্তে মুহূর্তে বিপদের আশঙ্কা। ব্যাবসাপত্তর সব ডকে উঠল। সবাই মিলে সবংশে গোল্লায় যাবার ধাক্কা। এখন-তখন অবস্থা যাকে বলে-না? ঠিক তাই এখন।’

‘তাই নাকি? তাহলে বলুন, আমি যদি আপনার মাদুলিটা বের করে দিতে পারি কী দেবেন আপনি আমাকে?’ —টিকলুর জিজ্ঞাস্য।

‘যা চাইবে তাই পাবে। কী চাও?’

‘একটা স্কুটার। মানে, তার দামটা হাজার দশেক টাকা।’

‘এক্ষুনি এক্ষুনি।’ হর্ষবর্ধন সম্মত হন—‘বার করে দাও তাহলে।’

‘খুঁজে দেখি।’ টিকলু এঘরে-ওঘরে খোঁজাখুঁজি করে। আমিও এধার-ওধার আতিপাঁতি করে দেখি— কোনোখানেও পলাতক মাদুলির টিকিটি দেখা যায় না।

আমিও তার সাথে সাথে হেথায় হোথায় ঘুরি। ওই ঘোরাঘুরিই সার। আমি বলি— ‘খুঁজে দেখবি কী তুই? ওর আবার পাত্তা পাবি নাকি? তুই ভেবেচিস ওরা অচল পদার্থ, হাত থেকে খসে কোথাও নির্জীবের মতন বসে রয়েছে? এর মধ্যে হিল্লি-দিল্লি চলে গেছে ব্যাটা। জড়পদার্থ হলেও বেজায় লজঝর। এক নম্বরের ধড়িবাজ ওরা— বেজায় হুঁশিয়ার বদমাশ!’

‘তুমি বলছ কী মামা? নেহাত নির্জীব একটা মাদুলিকে মিলখা সিং বানিয়ে দিচ্ছ একেবারে।’

‘সাধে কি দিচ্ছি। আমি ওদের স্বভাব জানি যে। ওদের হাবভাব আমার সব জানা— ওই অপদার্থদের। হাড়ে হাড়ে শিক্ষা হয়ে আছে আমার। দস্তুরমতন নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি আমি।’

‘কীরকম শুনি একবার?’

‘শোন তবে—তাহলেই বুঝবি তোর হাজার খোঁজাখুঁজিতেও কোনো লাভ হবে না, হয়রানিটাই সার হবে। একটা আধুলি আমার ট্যাঁক থেকে খসে পড়েছিল একবার— তার বিবরণ শোন। ঘরের মধ্যে পড়ল। ঠং করে আওয়াজ পেলাম। কানে শুনলাম, কিন্তু চোখে পড়ল না মোটেই। কোথাও নেই আধুলিটা। ঘরের মধ্যেই পড়ে সাড়া দিয়ে এর ভেতরে সেউধাও হল কোথায়? সারা ঘরে পাত্তা নেই। দেখতে দেখতে চক্ষের পলকে কোথায় গেল সে? না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছি।’

‘কাছাকাছি কোনো ব্যাঙের কাছে খবর নিতে পারতে।’

‘ব্যাঙ্কে গিয়ে খবর নেব? কামারখানায় ছুঁচের খবর? যেখানে হাজার হাজার লাখ লাখ টাকার কারবার, একটা আধুলির খোঁজে যাব সেখানে?’

‘ব্যাঙ্ক নয় মামা, ব্যাং। ব্যাং-রা আধুলি জমায় শোননি?’

‘কিন্তু ব্যাঙের কাছে যাবার পাত্র নয় আধুলিরা। ওরা তো বোষ্টুম না যে ভেক ধরবে!’

‘তবে গেল কোথায় আধুলিটা?’

‘যাবে কোথায়। পড়বার পরই লাফিয়ে উঠেছিল টঙের ওপর। সেখানে ঘুলঘুলির ফাঁকে আরামে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল আমার কার্যকলাপ। তারপর একটা চড়ুই পাখির কাছে ঠ্যাঙানি খেতেই-না—’

‘চড়ুই পাখি তাকে ঠ্যাঙাতে গেল কেন?’

‘চড়ুই পাখি তো আর ব্যাং নয়, আধুলির কদর বুঝবে কী! ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে গোড়াতেই শুট করে ফেলে দিয়েছে ঘরের মেজেয়। ঠ্যাং-এর মার খেয়ে ঠং করে উঠতেই আমি দেখতে পেলাম। ধর ধর ধর—ধরতে গেছি। আমার চোখের ওপরই সটকে পড়ল কোথায়! আর তাকে দেখতে পাই না। সন্দেহ হল ঘরের নর্দমা দিয়ে গলে মেন পাইপের নল বেয়ে নেমে গেছে নীচেয়। ছুটলাম তলায়। না, সেখানেও নেই, ড্রেন দিয়ে গলে গেছে সটাং। তারপর অনেক দিন বাদ গঙ্গার ঘাটে তাকে কুড়িয়ে পাই।’

‘সেটাই?’

‘সেটা ছাড়া আর কেউ নয়। আণ্ডারগ্রাউণ্ড পয়ঃপ্রণালী বেয়ে সাগরসঙ্গমে বেরিয়েছিল বোধ হয়, পাজি, ছুঁচো, নচ্ছার।’

‘তা, নচ্ছার তাকে বলতে পারো মামা। ছারপোকা নয় যখন।’

‘তাই বলছিলাম। এখানে মাদুলির কোনো পাত্তা পাবিনে। পেতে হলে যেতে হবে তোকে সেই ডায়মণ্ড হারবার।’—আমি বাতলাই।

‘দ্যাখো-না, বার করছি ব্যাটাকে এক্ষুনি। আমার হাতেই আছে সে।’—বলতে বলতে সেতার মুঠোর ভেতর থেকে মাদুলিটাকে বার করে দেখাল।

‘অ্যাঁ, ভেলকি নাকি।’ চমকে গিয়ে বলি—‘জাদুকর পিসি সোরকারের শাগরেদগিরি করেছিস নাকি কখনো! কী করে বার করলি শুনি?’

‘ওইরকম। ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। ইচ্ছাশক্তি যার নাম।’

হর্ষবর্ধনের হাতে মাদুলিটা দিতেই তাঁর মুখখানা মুহূর্তে যেন ক্লাইভ স্ট্রিট হয়ে গেল। বত্রিশ পাটি বিকশিত করে তিনি ফস ফস চেক লিখতে বসলেন।

‘দশ হাজারের জায়গায় আমি এগারো হাজার দিলাম তোমায়। তুমি আমার জীবনদান করলে। ধনেপ্রাণে বঁাচালে আমায়।’

‘এক হাজার বেশি কেন মামা? ও আমার চাইনে।’ টিকলু বলে।

‘ওই হাজার খানেক দিলাম তোমার খাবার জন্যে। কিছু খাওদাও গে—কিনে-টিনে।’

‘অত আমি খেতে পারি? আমি কি হাতি নাকি?’

‘একদিনে না পার, পাঁচ দিনে খাও— দশ দিনে, বিশ দিনে, ত্রিশ— চল্লিশ— পঞ্চাশ— দুশো দিন ধরে খেয়ে ওড়াও।’

‘এসো শিব্রাম মামা, চলো স্কুটার কিনি গে। তুমি পছন্দ করবে।’—বলে আমাকে টেনে নিয়ে সেবেরিয়ে পড়ে।

‘আগে যাব ব্যাঙ্কে, এটা ভাঙাব। তারপর যাব চাংগোয়ায়। ভালোমন্দ কিছু পেটে দিয়ে সোজা যাব স্কুটারের দোকানে।’

খাবার কথায় সঙ্গে যাওয়ার উৎসাহ দেখা দেয় আমার। উল্লসিত হয়ে কই—‘তা তো হল, কিন্তু মাদুলিটা তুই বার করলি কী করে? না শোনা পর্যন্ত আমার ঘুম হচ্ছে না।’

‘এখানে ঘুমোবে কি? এখন কি ঘুমোবার সময়? খেতে যাচ্ছি-না আমরা। খেয়েদেয়ে তার পরে না-ঘুম? এখন খাবার ঘুম। পাঁচশো টাকার খানা খাব আজকেই দুজনায়। ফাঁক করব চাংগোয়া।’

‘ঘুম দূরে থাক, আমার খিদেই পাচ্ছে না না-শুনলে। চলতেই পারছি না বলতে গেলে।’—আমি যেন চলচ্ছক্তিহীন নট নড়নচড়ন হয়ে পড়ি হঠাৎ।

‘শুনবে নিতান্তই? শোনো, কিন্তু বোলো না কাউকে। ওই হর্ষমামাকে তো কখনোই নয়। ছোটো বেলায় আমায় নাকি পেঁচোয় পেয়েছিল, তাই মা আমায় একটা মাদুলি পরিয়ে দিয়েছিল।’

‘কই, দেখিনি তো কখনো।’

‘হাতে পরলে খারাপ দেখায়, বন্ধুরা ঠাট্টা করে, তাই কোমরের ঘুনসিতে লুকোনো থাকত। তুমি যখন তাকাচ্ছিলে না, সেই সময় ঘুনসিটা ছিঁড়ে, অ্যাদ্দিন প্রায় পচে গিয়েছিল ঘুনসিটা— বের করে নিয়েছিলাম।’

‘তাই নাকি? কিন্তু হর্ষবর্ধন ওটাকেই নিজের মাদুলি বলে চিনলেন কী করে?’

‘চিনবেনই। চিনতে হবে আমি জানতাম। সব গোরু আর চীনেম্যান যেমন একরকম, একটার থেকে আর একটাকে আলাদা করে চেনা যায় না, তেমনি সব মাদুলিরই এক চেহারা।

‘তা বটে।’—কথাটা মানতে হয় আমায়—‘কিন্তু ছোটোবেলায় তোকে পেঁচোয় পেয়েছিল বলে শুনিনি তো আমি। জয়া তো বলেনি আমায়।’

‘ছোটোবেলায় তুমিই আমায় বেশি করে পেতে তো তুমিই ধরতে আদর করতে বেশি। তাই—পাছে তুমি শুনে কষ্ট পাও বলে তাই আর বলেনি তোমায় মা।’

‘শেষটায় আমাকেই প্যাঁচা ঠাওরাল সে।’

‘না না, তা নয়। প্যাঁচার মতন দেখতে কি তুমি।’— সেআমায় সান্ত্বনা দেয়।— ‘তোমার কথাবার্তা কেমন যেন প্যাঁচালো। লেখাটেখাও। তাই না? সেইজন্যেই হয়তো মা ওইরকম ভেবে থাকবে। তুমি কিছু মনে কোরো না মামা।’

ট্যাক্সির দাপটে ততক্ষণে আমরা চাংগোয়ার টেবিলে এসে পড়েছি।

তখন কে আর ওসব কথা মনে করে?

চাংগোয়ার থেকে চর্ব্যচোষ্য করে বেরুলাম আমরা। বেরুলাম তো, কিন্তু অত খাওয়ারা পর নড়াচড়ার শক্তি নেই আমার। খাই আর শুই—খাওয়ার পর বিছানায় গড়িয়ে পড়ার অভ্যেস চিরকালের, কী করা যায় এখন?

অবশ্যি চাংগোয়ায় আরও খানিক বসা যেত, বসতে দিত না যে তা নয় কিন্তু অমনি না, আরও কিছু খেতে হত হয়তো ওর ওপর। কিন্তু সেটা হত আমার পক্ষে সাপের ছুঁচো গেলার মতোই। ছুঁচো গিলব কী সামান্য একটা ছুঁচ গলাবারও জায়গা ছিল না কোথাও।

টিকলু বলল, ‘আমার বাইকের ব্যাক সিটে এসে বসো মামা। আমি তোমায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’

বলেছিল সেঠিকই, কিন্তু আপত্তি দেখা গেল আমার দিকে। একটা বাচ্চা ছেলের পেছনে বসে তার কোমর জড়িয়ে যাওয়াটা যেন কেমন দেখায় না? অন্তত আমার মতো এক মোটাসোটা লোকের পক্ষে তেমন শোভা পায় না।

অগত্যা সেএকাই আমার সামনে দিয়ে চলে গেল।

আমি চাংগোয়ার সামনেই হঠাৎ একটা ন-নম্বরের বাস পেয়ে সোজা চলে গেলাম আমার এক ভাইপোর বাড়ি। গিয়ে ভাইপোটির কাছে ভাগনের নগদবিদায়ের বার্তা বলি।

শুনে সেবললে—‘এ আর এমন কী নগদবিদায়! আমি এর তিন ডবল নগদবিদায় হাতে হাতে আদায় করতে পারি হর্ষকাকার কাছ থেকে।’

‘কী করে?’

‘কোনো হাতাহাতি না করে। জানতে চাও? অনেক দিন থেকেই আমার মাথায় একটা প্ল্যান খেলছে। এবার সেটা কাজে লাগাব। আটঘাট বেঁধে তার নকশা করা।’

‘কোনো নকশালি কারবার না তো রে? ওসবের ভেতরে যেয়ো না বাপু। মেরে ভূত বানিয়ে দেবে পুলিশ।’

ভাবিত হয়ে বাড়ি ফিরলাম। পরদিন হর্ষবর্ধনের বাড়ি যেতেই তিনি বললেন— ‘কাল রাত্তিরে এক অভাবিত কান্ড হয়ে গেছে মশাই। নকশাল সেজে একদল চ্যাংড়া আমাদের আক্রমণ করেছিল।’

‘নকশাল সেজে—বুঝলেন কী করে?’

‘মুখে দাড়ি-গোঁফ লাগানো ছিল যে। বাচ্চাদের কি গোঁফ-দাড়ি বেরোয়? বিলকুল ঝুটো দেখলেই তা বোঝা যায়। টেনে দেখলে টের পাওয়া যেত কে তারা?’

‘চিনতে পারেন কি কাউকেও?’

‘কী করে চিনব? দাড়ি-গোঁফের আড়ালে ছেলেদের চিনতে পারে কেউ? মেঘের আড়ালে চাঁদ বোঝা যায়?’

‘বোঝা দায়। তা বটে?’—আমি হাঁফ ছেড়ে বললাম।

‘দেখতাম টেনে একটার’—বলল গোবরা—‘কিন্তু হাতে পিস্তল ছিল যে, সাহস হল না আমার।’

এমনসময় একটা পুঁটুলি হাতে ভাইপোরত্নটি হাজির।

এসে বলে—‘হর্ষকাকু, এমনটা আপনাদের কাছে আমরা আশা করিনি কখনো। এরকম করলেন আপনি আমাদের সঙ্গে?’

‘কী করলাম বাবা?’—হর্ষবর্ধন হতবাক।

‘এই নিন আপনাদের সব গয়নাপত্তর’। —বলে পুঁটুলিটা সেসামনে রাখে।

শ্রীমতী হর্ষবর্ধিনীর তাবৎ অলংকার তার ভেতর পাওয়া যায়। তিনি এসে খুঁটিয়ে দেখে নেন, তারপর কী দেখে কন—‘এটাও কি আমার গয়নার মধ্যে ছিল?’

‘পিস্তল দেখছি।’—হাতে তুলে দেখেন হর্ষবর্ধন।—‘না, ছিল না তবে একই জিনিস।’ সেজানায়—গয়নাও যা এটাও তাই—এক কিসিমের ঝুটো মাল। তাই একসঙ্গে দিয়ে গেলাম। ওটা নিয়ে কী হবে আর আমাদের? কিছুই হোল না তো।’

‘তুমি এরকম ছলনা করলে কেন ছেলেদের সঙ্গে?’

হর্ষবর্ধন গিন্নির দিকে ভ্রূক্ষেপ করেন—‘এটা তোমার উচিত হয়নি গিন্নি।’

‘আজকালকার দিনে এক-গা গয়না পরে হাটে-বাজারে কেউ বেরোয় নাকি? আসল জিনিস তো ব্যাঙ্কের সেফটি ভলটে থাকে। ঝুটো গয়না গায়েই বেড়ায় সবাই।’—গিন্নির কৈফিয়ত।

‘তাহলেও বেচারাদের বিড়ম্বিত করা হয়েছে। তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত।’—কর্তার বক্তব্য।

‘লজ্জা পাচ্ছি। সত্যিই।’—ওঁর গিন্নির জবাব—‘কিন্তু কী করে জানব যে ওনার ভাইপোরা এসে এমন হামলা করবে হঠাৎ। উনি তো ঘুণাক্ষরেও জানাননি আমাদের আগে। জানলে পরে ব্যাঙ্ক থেকে কিছু নাহয় তুলে এনে রাখতাম।’

‘যাক, যা হবার হয়ে গেছে। এর জন্যে দায়ী কে—বুঝলে?’ —তিনি হাত তুলে দেখান— ‘কাল আমার এই মাদুলিটা হারিয়ে গেছল-না? টিকলু এসে বার করে দিল যে। তা না-হলে সর্বনাশ আমাদের হতই ঠিক। তোমরাও খাঁটি জিনিস পেতে। এর জন্যে দায়ী উনিও নন, তোমরাও নও, এই মাদুলিটাই। বুঝেচ?’

‘যাক তোমরা কিছু মনে কোরো না ভাই। তোমাদের নগদ বিদায়ও কিছু মন্দ হবে না। এই ধরো একশো টাকা। সবাই মিলে ফুর্তি করো গিয়ে।’

একখানা বড়ো নোট তার হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন।

ঈষৎ গোঁফের রেখার মতো একটুখানি হাসি ফুটল তার মুখে। গোঁফের রেখার ঠিক তলাতেই দেখা গেল সেটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *