শ্রীকান্তের ভ্রমণকাহিনি
দেশ-বিদেশ বেড়াতে তোমরা সকলেই খুব ভালোবাস। সব ছেলেই ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের শ্রীকান্তর ভ্রমণে আনন্দ নেই, তার কাছে ভ্রমণের মানেই হচ্ছে দেড় মন।
তার মামা ভারি কৃপণ—কোথাও যেতে হলে গোটা বাড়িখানাই সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। কী জানি, বিদেশে কোনো জিনিসের দরকার পড়লে যদি সেটা আবার পয়সা খরচ করে কিনতে হয়! কিন্তু শ্রীকান্তর এদিকে প্রাণ যায়; সেই বিরাট লটবহর তাকেই বইতে হয় কিনা! সেসব মালপত্র গাড়িতে তুলতেও শ্রীকান্ত, গাড়ি থেকে নামতেও শ্রীকান্ত, স্টেশনে যে কুলি নামক একজাতীয় জীবের অস্তিত্ব আছে, একথা শ্রীকান্তকে দেখলে মামা একদম ভুলে যান।
কেবল কুলির কাজ করেই কি নিষ্কৃতি আছে? তাকে সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গাড়ির দরজায় পাহারা দিয়ে। কেননা মামার ধারণা, ওইভাবে দরজার মুখে মাথা গলিয়ে খাড়া থাকলে সে-কামরার দিকে কেউ আর এগোয় না! এবং যে-কামরার দিকে কেউ এগোয় সেদিকে কেবল একজন নয়, সেই স্টেশনের যত ভোম্বলদাস সবাই সেই কামরাটার দিকেই ঝুঁকে পড়ে—তা তার ভেতর জায়গা থাক বা না থাক। কিছু দূরে খালি কামরা থাকলেও সেদিকে তাদের যেন দৃষ্টি যায় না।
তার মামা আবার পারতপক্ষে মেল-গাড়িতে যান না, প্যাসেঞ্জার গাড়ি পেলে। যা দু-চার পয়সা বঁাচে। সময়ের আর কী মূল্য আছে বল? দু-ঘণ্টা পরে পৌঁছোলে যদি দুটো পয়সা বঁাচে, তারই দাম। প্যাসেঞ্জার গাড়ির সব স্টেশন ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়—দু-তিন মিনিট অন্তর স্টেশন— কাজেই একটুখানি বসতে না বসতে আবার গিয়ে দরজায় দাঁড়াতে হয়। রাত্রেও ছাড়ান নেই— কেননা তখন যাতে কামরাতে স্থানবাহুল্য না কমে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রাখা দরকার। তার মামা আয়েসি লোক, সারা রাত দিন গাড়িতেও বাড়ির মতো আরাম চান—তখন যদি অনাহূত কেউ এসে তাঁর জায়গা জুড়ে বসবার জন্য তাঁর ঘুম ভাঙাতে চায়, তাহলে যে কী দুর্ঘটনাই ঘটে তা শ্রীকান্ত ভেবে পায় না। কাজেই রিজার্ভ কামরার নোটিশ বোর্ডের মতো তাকে গাড়ির দরজায় লটকে থাকতে হয়।
এইসব নানা কারণে ভ্রমণে শ্রীকান্তের সুখ নেই, শখও নেই। কিন্তু না চাইলেও অনেক জিনিস আপনি আসে। হাম হোক, কে আর চায়? কিন্তু হামেশাই তা হচ্ছে। ফেল হতে আর কোন ছেলের বাসনা, তবু কাউকে না কাউকে ফেল হতেই হয়।
যেমন আজ তাকে যেতে হচ্ছে। ছ্যাকরা গাড়ির ছাদে যা জিনিস ধরে তার চার গুণ চাপানো হয়েছে, গাড়ির মধ্যে শ্রীকান্ত, তার মামা এবং মামি, আর মামাতো বোন টেঁপি। কিন্তু তারই ফাঁকে গাড়ির ফোকরেও মালের কিছু কমতি নেই,—জলের কুঁজো, হ্যারিকেন লন্ঠন, হাতব্যাগ, ছাতা, পানের ডিবে, খাবারের চাঙারি, টুকরোটাকরা কত কী! কিন্তু এগুলোর জন্য শ্রীকান্তর ভাবনা নেই, কেননা এসব টেঁপির ভার—পানের ডিবে মামিমা সামলাবেন আর খাবারের চাঙারি মামা। কিন্তু গাড়ির ছাদে বাক্সতোরঙ্গ, বিছানার লাগেজ আর কাপড়-চোপড়ের বিপুলকায় হোল্ডঅল—ওসব এখন থেকেই যেন শ্রীকান্তের ঘাড়ে চেপে বসেছে।
শিয়ালদহ পৌঁছেই মামা সর্বাগ্রে নামলেন। নেমেই বললেন, ওগো হাতপাখাটা দাও তো! শ্রীকান্ত মোটঘাট সব নামা। ও বাপু কোচম্যান, তুমি একটু ধর, বুঝলে? আমি টিকিটগুলো কেটে আনি।
গাড়ি দাঁড়াতেই জনকতক কুলি এসে জুটেছিল, তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাল নামাতে গেল। মামা টিকিট কাটতে পা বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু কুলিদের এই অযাচিত কর্মস্পৃহা দেখে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। বাধা দিয়ে বললেন, ‘কী, তোমরা মাল নামাবে না কি? আবদার তো কম নয়! কেন, আমাদের কি হাত পা নেই?’
একজন কুলি শ্রীকান্তর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলল, ‘এই বাচ্চা ছেলে, ওকি সেকবে বাবু?’
‘কেন সেকবে না শুনি? ওদের বয়সে আমরা লোহা হজম করেছি। শ্রীকান্ত, সব চটপট নাবিয়ে ফ্যাল, ও ব্যাটাদের ছুঁতে দিসনে। যাও, যাও, একী রুটি সেকা? এখন থেকেই ওকে সব সেকতে হবে। তোমরা সব যাও।’
বলে যেভাবে মাছি তাড়ায় সেইভাবে কুলিদের তাড়াবার একটা চেষ্টা করলেন, কিন্তু তারা নড়ল না দেখে বললেন, ‘দেখ বাপু মালে হাত দিয়ো না, পয়সা পাবে না আগেই বলে দিচ্ছি।’
এই কথা বলে টিকিট কিনতে চলে গেলেন। শ্রীকান্তর ইচ্ছা হল একবার বলে যে লোহা হজম করা যদিবা সম্ভব হয়, সেই লোহা বহন করা তত সহজ নয়। কিন্তু বলেই বা কী লাভ, সমালোচনা করলে তো লোহার ওজন কমবে না এই ভেবে সেআস্তে আস্তে বাক্স-প্যাঁটরা, বাসনের ছালা, বিছানার লাগেজ, সুটকেস, মায় জলের কুঁজোটি পর্যন্ত গাড়ি থেকে নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের একাংশে স্তূপাকার করতে লাগল।
টিকিট কিনে মামা ছুটতে ছুটতে ফিরলেন—‘বললেন, গাড়ি ছাড়তে আর দেরি নেই রে, মোটে আট মিনিট বাকি। শ্রীকান্ত, এই সামান্য ক-টা জিনিস প্ল্যাটফর্মে নিতে তোর কবার লাগবে? বার তিনেক, বোধ হয়? বার তিনেক হলে ফি বারে দু মিনিট—মোটে ছ মিনিট, বাড়তি থাকে আরও দু মিনিট, খুব গাড়ি ধরা যাবে। টেঁপি, তুই এখানে দাঁড়িয়ে মালপত্রগুলো আগলা, শেষবারে শ্রীকান্তর সঙ্গে আসবি। আমি আর তোর মা এগোলাম। একটা খালি দেখে কামরা দেখতে হবে তো। শ্রীকান্ত, তুই ট্রাঙ্কটা মাথায় নে, তার উপরে ছোট সুটকেসটা চাপিয়ে দিচ্ছি, পারবি তো? বিছানার লাগেজটা বঁা-বগলে নে, আর ডান হাতে বড়ো সুটকেসটা। বঁা হাতে লন্ঠন দুটো ঝুলিয়ে নিস, তাহলেই হবে। দ্বিতীয় বার বাসন-কোসনের থলেটা আর তোর মামির তোরঙ্গটা নিবি। দৌড়ে যাবি আর দৌড়ে আসবি—নইলে গাড়ি ফেল হয়ে যাবে, বুঝেছিস? আমি এগোই ততক্ষণ।’
তিনি তো এগোলেন, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে দেখেন শ্রীকান্তর দেখা নেই। তিনি আশা করেছিলেন যে শ্রীকান্ত তাঁর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে, তাকে দেখতে না পেয়ে তিনি ক্ষুণ্ণ হলেন। ফিরে এসে দেখেন, শ্রীকান্ত মালপত্রের বোঝা নিয়ে একেবারে যেন চিত্র পুত্তলিকা!
—‘কী রে, এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে? গাড়ি ফেল করবি না কি?’
—‘কী করব আমি এগোতে পাচ্ছি না যে। বড্ড ভারী হয়েছে মামা। টেঁপিকে বললাম তুই পেছন থেকে ঠেলে ঠেলে দে, আমি চলতে থাকি, তা ও—’
—‘বা রে! বাবা আমায় এখানে জিনিস আগলাতে বলল না? আমি ওকে ঠেলতে ঠেলতে যাই আর এদিকে সব চুরি হয়ে যাক। তোমার আর কী, জিনিস কমে গেলে তোমাকে তো আর বইতে হবে না।’
মামা বললেন, ‘তাই তো, ভারি মুশকিল হল দেখছি।’
একটা কুলি এবার সাহসভরে এগিয়ে এসে বলল, ‘খোকাবাবু সেকবে কেনো? সোব ফেলে ভেঙে চুরমার হোবে। আর ইদিকে টিরেনভি ছোড়ে দিবে।’
‘তাই তো! ভারি মুশকিল!’
কুলি করলে তো নগদ লোকসান, এদিকে জিনিস ফেলে ভাঙলেও ক্ষতি, গাড়ির সময় নেই—কিন্তু ভাববার আর সময় কই? কাজেই বাধ্য হয়ে মামাকে দুটো কুলি করতে হল। আধঘণ্টা আগে বেরুলে এই অপব্যয়টা হত না। শ্রীকান্তই পাঁচ-ছ বারে কম কম করে গাড়িতে মালগুলো তুলতে পারত। থাক গে, আর উপায় কী?
অতঃপর একটা দেখবার মতো দৃশ্য হল। দুটো কুলি আগে আগে, তাদের মাথায় দুটো বড়ো বড়ো তোরঙ্গ। একজনের বগলে বিছানার লাগেজ, আরেক জনের বগলে বাসনের থলে। মামি নিয়েছেন জলের কুঁজো আর টেঁপি নিয়েছে পানের বাটা। মামার এক হাতে একটা ছোটো হাতব্যাগ, অন্য হাতে তালপাখা—তারই ভারে মামা কাতর; এতই ঘেমে উঠেছেন যে, ওরই ফাঁকে তালপাখার হাওয়া খেতে হচ্ছে তাঁকে।
সব শেষে চলেছে শ্রীকান্ত—একেবারে কুঁজো হয়ে। বাড়তি ট্রাঙ্কটা তারই ঘাড়ে চাপানো হয়েছে। শোভাযাত্রাটা দেখবার মতো।
গাড়িতে উঠেই মামা লম্বা করে বিছানা পেতে ফেললেন। এতক্ষণ গুরুতর পরিশ্রম গেছে, সেজন্য যথেষ্ট বিশ্রাম দরকার। চলতি গাড়ির ফাঁকা হাওয়া গায়ে লাগতেই তিনি আরামে চক্ষু-বুজে বললেন, ‘আঃ, এতক্ষণে দেহটা জুড়োল। গোটা গাড়িটা ভরতি, কিন্তু এ কামরাটা খুব খালি পাওয়া গেছে; কারোর চোখে পড়েনি বোধ হয়।’
বিচিত্র লটবহরে ওই ছোট্ট কামরার প্রায় সমস্তটাই ভরে গেছল, তারই একধারে বসে শ্রীকান্ত তার পীড়িত ঘাড়ে শুশ্রূষা করছিল। তার অবস্থাটা বুঝে মামি বললেন, ‘বড্ড লেগেছে না কি রে?’
অপ্রতিভ হয়ে শ্রীকান্ত ঘাড়ে হাত বুলানো বন্ধ করল—‘না, মামিমা।’
মামা বললেন, ‘ওয়েট লিফটিং একটা ভালো একসারসাইজ। এতে ওর ঘাড় শক্ত হবে। সেটা দরকার। এর পরে ওর বউ-এর বোঝা রয়েছে না?’
বউ-এর, না, বইয়ের—কীসের বোঝা বললেন মামা, বোঝা গেল না সঠিক।
মামি বললেন, ‘তোমার যেমন। যাচ্ছি তো কদিনের জন্য বিয়ের নেমতন্নে। এত মালপত্র নিয়ে বেরোনো কেন? কী কাজে লাগবে এসব?’
মামা বললেন, ‘যাকে রাখ সেই রাখে, কথাটা জান তো? সব জিনিসই কাজে লাগে, কাজের সময় তখন পাওয়া না গেলেই মুশকিল।’
মামি বললেন, ‘মদনপুরে গাড়ি তো দাঁড়ায় মোটে এক মিনিট। বোধ হয় এক মিনিটও দাঁড়ায় না। তার মধ্যে কি এই লটবহর নিয়ে নামা যাবে? দেখো, তখন কী ফ্যাসাদে পড়! বাক্স-প্যাঁটরা সব গাড়িতেই থেকে যাবে দেখছি।’
মামা বললেন, ‘কী জান গিন্নি, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়। কিচ্ছু ভেবো না তুমি।’
মামার কথায় শ্রীকান্তর হৃৎকম্প হল, কেননা মদনপুর স্টেশন যেখানে এক মিনিট মাত্র গাড়ি থামে কিংবা তাও থামে না, সেখানে ভগবানের জায়গায় নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই সেকল্পনা করতে পারল না। এই বিরাট এবং বিচিত্র লটবহর তাকেই গাড়ি থেকে নামাতে হবে। তাহলেই তো সেগেছে, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না—শ্রীকান্তর সারা শরীর রি রি করে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দমদমে গাড়ি দাঁড়াতেই জন কতক কৃষ্ণকায় ফিরিঙ্গি যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। মামার এবং মালপত্রের বহর দেখে তারা একেবারে হতভম্ব। অবশেষে তাদের একজন ভাঙা বাংলায় মামাকে বলল, ‘টোমরা এ গাড়িতে কেনো বাবু? এটা সাহেবডের জন্যে—দরজায় নোটিশ দেখ নাই, ‘For Europeans only’ টোমাডের নামিটে হবে।’
সবেমাত্র আয়েস করছেন, নামার কথায় মামার মাথা গরম হয়ে উঠল। তিনি বললেন, ‘কেনো নামটে যাব? আমরাও তোমাদের মটই খাঁটি ইউরোপিয়ান আছি। চাহিয়া ডেখো টোমাডের ও আমাদের গায়ের রং একপ্রকার।’
—‘অল রাইট। ডেখি তোমরা নামিবে কি না?’ বলে তারা নেমে গেল এবং পরবর্তী স্টেশনে একজন রেল-কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে এল।
কর্মচারীটিও এসে নামতে অনুরোধ করলেন।
মামা বললেন, ‘সমস্ত গাড়ি ভরতি, কেবল এইটা খালি, কোথাও জায়গা না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমরা এই কামরায় উঠেছি। অন্য কোথাও বা উঁচু ক্লাসে আমাদের জায়গা করে দিন, এখুনি আমরা নেমে যাচ্ছি।’
‘আচ্ছা দেখছি জায়গা’ বলে কর্মচারীটি নেমে গেলেন, ফিরিঙ্গিরা গাড়িতেই রইল! শ্রীকান্তর ভয় হল পাছে কর্মচারীটি অন্য কোথাও জায়গা খুঁজে পান তাহলে তো এখুনি তাকে ভগবানের অবতার হয়ে আবার লটবহর বওয়াবওয়ি করতে হবে।
কিন্তু কর্মচারীটি আর ফিরলেন না, গাড়িও ছেড়ে দিল। কেবল ফিরিঙ্গিরা নিজেদের মধ্যে গজরাতে লাগল। মামা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করলেন না। কিন্তু মামি বললেন, ‘কাজ নেই বাপু, পরের স্টেশনে চলো অন্য কামরায় যাই।’
—‘হ্যাঁ:, কোথাও খালি রয়েছে না কি?’
—‘না-থাকে, পরের গাড়িতে যাব নাহয়।’
—‘পাগল!’
—‘সবই তো পরের গাড়ি মামিমা, কোনটা আমাদের নিজেদের গাড়ি?’ বলল শ্রীকান্ত। আবার ওঠা নামার ঝক্কি বওয়ার দায় এড়াতে বলতে হল তাকে!
—‘যদি পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। সাহেবদের গাড়ি যে!’ মামিমা কন।
—‘হ্যাঁ, ধরলেই হল! তুমি চুপ করে থাকো, ব্যাটারা বাংলা বোঝে—তুমি ঘাবড়ে গেছ জানলে আরও লাফাবে।’
অগত্যা মামি চুপ করলেন।
খানিক বাদেই ব্যারাকপুর এল। গাড়ি দাঁড়াতেই ফিরিঙ্গিগুলো একজন সাহেব কর্মচারীকে ডেকে আনল। তিনি এসে বললেন, ‘বাবু টোমাডের নামিটে হইবে—যাহাদের সাহেবি ড্রেস, এ কেবল টাহাডিগের জন্য!’
মামা বললেন, ‘তা একথা আগে বলনি কেন সাহেব? আমাডেরো সাহেবি পোশাক আছে। আমাদের সময় দাও, আমরা এখুনি সাহেব বনে যাচ্ছি। ওগো ট্রাঙ্কের চাবিটা দাও তো—’
অগত্যা সাহেব কর্মচারীটি চলে গেল। মামার সত্যিই কিছু সাহেবি পোশাক ছিল না, একটা চাল মারলেন মাত্র। এদিকে গাড়িও ব্যারাকপুর ছাড়ল।
অতঃপর ফিরিঙ্গিরা আর কোনো উপায় না দেখে এদের তাড়াবার ভার নিজেদের হাতে নিল। পরস্পর পরামর্শ করে এমন চেঁচামেচি শুরু করে দিল মামি দস্তুরমতো ঘাবড়ে গেলেন। মামারও যে একটু ভয় না হল এমন নয়। মামি বললেন, ‘হ্যাঁ গা, কামড়ে দেবে না তো?’
মামা খানিকক্ষণ নি:শব্দে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কী জানি!’
কামড়াবার কথা শুনে টেঁপি একেবারে বাবার বিরাট পরিধির পেছনে এসে আশ্রয় নিল!
মামা বললেন, ‘ভালো ফন্দি মাথায় এসেছে। শ্রীকান্ত তুই কুকুর ডাকতে পারিস?’
—‘বেড়ালের ডাক খুব ভালো পারি মামা। ডাকব? ম্যা—’
—‘না, না, বেড়াল ডাকতে হবে না। মাঝে মাঝে তুই কুকুরের মতো ডাক দিখি!’
শ্রীকান্ত ডাকল—‘ঘেউ ঘেউ।’
—‘আর একটু জোরে।’
—‘ঘেউ ঘেউ ঘেউউ।’
সহসা কুকুরের ডাক শুনে ফিরিঙ্গিরা সব চুপ। শ্রীকান্ত আবার ডাকল—‘ঘেউ ঘেউ ঘেউ—’
একজন জিজ্ঞাসা করল, ‘ওরোকম ডাকছে কেনো সে? তার কি হোয়েছে?’
মামা গম্ভীরভাবে বললেন, ‘ও কিছু নয় সাহেব। দশ-বারো দিন হল ওকে একটা পাগলা কুকুরে কামড়িয়েছে। Bitten by a mad dog বুঝলে?’
ফিরিঙ্গিরা যেন লাফিয়ে উঠল।—‘অ্যাঁ? হাইড্রোফোবিয়া! একথা আগে বল নাই কেন? ওটো কামড়াইটে পারে?’
মামা বললেন, ‘না না, কামড়াইবে না। সে-ভয় নাই।’
বলতে বলতে নৈহাটি এসে পড়ল। ফিরিঙ্গিরা আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ হুড়মুড় করে সেই কামরা থেকে পিটটান দিল।
‘যাক, বঁাচা গেল’ বলে মামা যেই মাত্র না স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন অমনি আরেক জন ফিরিঙ্গি যুবক এসে সেই কামরায় উঠল। সেকোনো উচ্চবাচ্য না করে এককোণে গিয়ে বসল, মামাদের দিকে তাকালও না। মামা বললেন, ‘দাঁড়াও। তোমাকেও ভাগাচ্ছি পরের স্টেশনে। শ্রীকান্ত, গাড়ি ছাড়লেই—বুঝেছিস?’
যুবকটি ডিটেকটিভ নভেল বের করে পড়তে শুরু করে দিয়েছিল, হঠাৎ কুকুরের ডাক শুনে চমকে উঠে মামাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাপার কী? কী হয়েছে ওর?’
সাহেবের মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে মামা বাংলাতেই জবাব দিলেন—‘ও কিছু না, জলাতঙ্ক—যাকে তোমরা হাইড্রোফোবিয়া বল!’
—‘ওঃ! তাই না কি? ওতে ওর উপকার হবে।’
বলে ছোকরা আবার বইয়ে মন দিল। তার নিশ্চিন্ত নির্বিকার ভাব দেখে মামার পিত্তি জ্বলে গেল। তবু তিনি বললেন, ‘তোমাকে সাবধান করা আমার কর্তব্য। কী জানি, যদি কামড়ে দেয়, বলা তো যায় না। তখন তোমাকেই ওই রোগে—’
যুবকটি মৃদু হেসে বলল, ‘আহা, না না ! যে কুকুর ডাকে সেকি আর কামড়ায়?’
অগত্যা মামা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন এবং শ্রীকান্তও ডাক ছেড়ে দিল। তাকে কুকুর বলাতে সেমনে মনে এমনই চটেছিল যে, তার ইচ্ছা করছিল এখুনি গিয়ে ফিরিঙ্গিটাকে কামড়ে দেয়।
কাঁচড়াপাড়ায় গাড়ি থামতেই যুবকটি মুখ বাড়িয়ে বাইরে দেখছিল। তার পরিচিত বন্ধুদের দেখতে পেয়ে ডাকাডাকি শুরু করতেই সেই পুরাতন দল এসে উপস্থিত। তারা তাকে ওই কামরায় দেখে ভারি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি নিরাপদে আছ তো? ওখানে যে মারাত্মক হাইড্রোফোবিয়া!’
—‘সেআমি সারিয়ে দিয়েছি।’
—‘সারিয়ে দিয়েছ কীরকম?’
তখন মামার চাল যুবকটি বন্ধুদের কাছে ফাঁস করে দিল—সেকামরায় ঢুকেই ছেলেটিকে জল খেতে দেখেছিল, জলাতঙ্ক রোগে যা কখনো সম্ভব নয়। তখন শ্রীকান্তর ভারি রাগ হল তার মামার উপর, জলাতঙ্ক রোগে জল খেতে নেই একথা কেন তাকে তিনি আগে বলেননি। তাইতো তাকে এমন অপদস্থ হতে হল। কুকুর না হবার অপমান সইতে হল এমন!
এইবার ফিরিঙ্গিরা আবার সেই কামরায় জাঁকিয়ে বসল এবং স্পষ্ট ভাষায় মামাকে জানাল যে এবার তাঁকে নামতেই হবে এবং এর পরের স্টেশনেই।
অসহায়ভাবে মামি বললেন, ‘ওগো, কী হবে তাহলে?’
মামা বললেন, ‘কিছু ভেব না গিন্নি ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য।’
ভগবানের নাম শুনে শ্রীকান্তর নিজেকে মনে পড়ল এবং ঘাড়ের ব্যথাটা এতক্ষণে কতটা মরেছে জানবার জন্য সেএকবার ঘাড়টাকে খেলিয়ে নিল।
পরের স্টেশন আসতেই মামা বললেন, ‘এখানে তো হয় না, পরের জংশনে নাহয় বদলানো যাবে। এখানে তো মিনিট খানেক যাত্রীগাড়ি থামে। এত মালপত্তর আমাদের!’
—‘না, টা হইবে না, এইখানেই টোমাকে নামটে হইবে।’
তখন তারা সবাই মিলে মামার বাক্স, তোরঙ্গ, বিছানা, সুটকেস-এ হাত লাগাল।
—‘ডেখি, টুমি কেমন না নাম।’ এই বলে একজন বাসনের থলেটা নামিয়ে দিয়ে বলল—’Here you are আর এই নাও টোমার জলে ‘পিচার!’
কুঁজোর জাত যাওয়ায় মামিমা হায় হায় করতে লাগলেন। ততক্ষণে দুজন মিলে ধরাধরি করে ভারী ট্রাঙ্কটা নামিয়ে ফেলেছে। মামা তখন বাঙ্কের উপরের আরও ভারী হোল্ডলটা ওদের দেখিয়ে দিলেন। একজন গিয়ে সেটা নামাল।
মামা বললেন, ‘বেঞ্চির তলায় ওই তোরঙ্গটা—ওই যে।’
একজন সেটা নামিয়ে বলল ‘এই নাও, টোমার টুরঙ্গ।’
মামা সংশোধন করে দিলেন—তুরঙ্গ নয়, তোরঙ্গ। সর্বশেষে বুদ্ধিমান যুবকটি ছোটো হাতব্যাগটা মামাকে এগিয়ে বলল, ‘গুডবাই, মিস্টার!’
মামা এতক্ষণ পুলকিত হয়ে ওদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। এই বার বললেন, ‘ইহাই মদনপুর—এইখানেই আমরা নামতাম। অতএব গুডবাই মিস্টারস এবং থ্যাঙ্কস’।