চটির সঙ্গে চটাচটি
না:, বিয়ের নেমন্তন্ন পেলে আর ছাড়া নয়। উৎসবের প্রধান অতিথিরূপে, বররূপে বাদ গেছি বলে লুচির পাতাতেও বরবাদ যেতে হবে, এতটা ক্ষতিস্বীকার আমার কোষ্ঠীতে লেখে না। বরং, যতদূর সাধ্য খাদ্যাখাদ্যের ওপর দিয়েই তার শোধ তুলতে হবে, এই হচ্ছে আমার মত।
অতএব, বটকেষ্টর বিয়ের নেমন্তন্ন গ্রহণ করতে দ্বিধা করলাম না।
কাছেই শ্রীরামপুরে বিয়ে। ঘড়ি ধরে শেষ লোকাল ধরতে গিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম, গাড়ি আমার ধরাধরির অপেক্ষা রাখেনি। আমিও পৌঁছেচি, আর উনিও ছেড়েছেন! কামরাগুলি একে-একে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে—কামরা তো নয়, কামড়াবার জিনিস সব—অতগুলি পায়েস-পিষ্টক-সন্দেশ-মিষ্টিই যেন গালের বাইরে দিয়ে গলে যাচ্ছে—এ দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখা দুঃসহ।
অমন অবস্থায় লোকে মরিয়া হয়ে ওঠে, প্রাণ দিয়ে ফেলতেও পরোয়া করে না। অন্ধ ইচ্ছার বশে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে আমিও অচিরে চলমান ট্রেনের ওপরে কোনোরকমে নিজেকে টেনে এনে নিক্ষেপ করেছি।
একেশ্বর নেতাকে (কেবলমাত্র কন্ঠস্বর সম্বল করে) জনসমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেচ? না দেখে থাকলে শ্রদ্ধানন্দ পার্কের ওপরে লক্ষ রেখো—শ্রদ্ধা ও আনন্দ দুই-ই একদিন টের পাবে। জনসমুদ্রকেও ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় একেক সময়ে— একমাত্র ফুটবল-রেফারির ওপরে। কিন্তু আমার বেলায় যেন দুয়ের যোগাযোগ ঘটল। আমিও লাফিয়ে পড়লাম, আর অসংখ্য বাহুও ঝাঁপিয়ে এল সেইসঙ্গে। হাতাহাতি হয়ে জানালা ভেদ করে কী করে যে কামরার গর্ভে পা দিলাম জানিনে।… (জীবনের ক-টা রহস্যই-বা শেষ দীর্ঘনিশ্বাসের আগে জানা যায়? কিন্তু হায়, তখন জানা গেলেও আর জানানো যায় না!)
কামরার মধ্যে পা দিয়েই, পায়ের দিকে লক্ষ পড়ল আমার। আর অমনি আমি চিৎকার করে উঠেছি— ‘অ্যাঁ? আমার জুতো গেল কোথায়? আরেক পাটি আমার?’
বলতে না বলতে অসংখ্য পাটি বেরিয়ে এল—পদতল থেকে নয়—আর-সবার মুখগহ্বর হতে।
‘ও! আপনার আরেক পায়েও জুতো ছিল বুঝি? কিন্তু কই, দেখচিনে তো!’ বললেন কামরার একজন।
‘জুতো ছিল মানে? আমি কি এক পায়ে জুতো পরে ইস্টিশনে এসেছি নাকি?’
লোকটার কথার ধরনে অবাক না হয়ে পারা যায় না—‘কেউ কি এক পায়ে জুতো পরে নেমন্তন্ন খেতে যায় মশাই?’
‘খাবেন তো মুখে, তার পায়ের সঙ্গে কী? কিন্তু তা বলছিনে, আপনার এক পায়েই আপাতত দেখা যাচ্ছে কিনা, তাই বলছিলাম।’
‘তাই কী বলছিলেন শুনি? আমার আরেক পাটি জুতো ছিল না—বুঝি?’ এবার আমার রাগ হয়ে যায়—‘কখনো আমি দু-পাটি জুতো একসঙ্গে দেখিনি—না কি?’
‘না, না—সেকথা নয়, আপনি দু পায়ে জুতো পরেই বেরিয়েছিলেন তো? মনে আছে তো ঠিক?’
‘মনে আছে, তার মানে?’
ভদ্রলোকের রসিকতা পেকে উঠে আমার মনের মধ্যে পাক লাগায়, আমার মুঠোর মধ্যে ঘুসির মতো পাকিয়ে উঠতে থাকে।
‘বলেন তো, এই দন্ডে আপনাকেও মনে পড়িয়ে দিতে পারি, দিতে হবে?’
‘আহা, চটছেন কেন? দু-পাটি জুতোই একসাথে কেন ক্ষইতে থাকে, এই ভেবে কেউ কেউ আলাদা আলাদাও তো পরতে পারে! আপনিই যে সেই সুবিবেচকদের একজনা হবেন না, তার কি কোনো মানে আছে?’
একথায় আমি কোনো কথা বলিনে, আপন মনে গজরাতে থাকি—
‘যেমন কান্ড আপনাদের! বলা নেই কওয়া নেই, হইহই করে জানালা দিয়ে টেনে তুললেন— যেন বেওয়ারিশ একটা লাশ পেয়েছেন! এমন তাড়াহুড়ো লাগালেন যেন, চোখে-কানে দেখতে দিলেন না! কোনোদিকে যে একটু তাকাব, তার ফুরসত দিলেন না পর্যন্ত! তাইতো এমন কান্ডটা ঘটল! এই বিচ্ছিরি ব্যাপারটা! কেন মশাই, অমন করে ধরে-বেঁধে টানাহ্যাঁচড়া করে টেনে তোলবার কী দরকারটা ছিল শুনি? জানালা দিয়ে ওইভাবে আমাকে আমদানি না করলে কি চলত না? আর, অমন করে অত কষ্ট করে জানালা দিয়েই-বা আমি আসব কেন? আসতে যাব কেন? কেন, আমি কি টিকিট কেটে আসিনি? নগদ পয়সায় শ্রীরামপুরের টিকিট কাটিনি নাকি আমি?’
‘আপনি নিজেই কাটা পড়তেন যে! টিকিটের মতোই কাটা পড়তেন ঠিক! গাড়ি ছেড়ে দিয়েছিল কিনা।’ জানালেন ওঁদের একজন।
‘কাটা পড়তাম, সেও আমার ভালো ছিল। তাহলে তো আমার জুতোটা এভাবে খোয়া যেত না। নতুন কেনা বোম্বে-স্লিপার মশাই, ন-টাকা ছ-আনা দাম! হায় হায়, তার সবটাই নয়-ছয় হয়ে গেল!’
আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়তে থাকে—‘তার ওপরে সাতাশ পয়সা সেল-ট্যাক্স আবার। কত বার কত বাড়ি নেমন্তন্ন খেলে তবে সে-টাকাটা উঠবে, কে জানে।’
‘আরে মশাই, এত দুঃখ করছেন কেন? কাটা পড়লে ল্যাঠা চুকে যেত ঠিকই, জুতোর শোকটা আর গায়ে লাগত না আপনার; কিন্তু আপনার ওপর ভগবানের নেক-নজর থাকতে পারে তো? সেরকম থাকলে, Neck-এর দিকে না কাটা পড়ে— মানে, তাঁর করুণায় পুরোপুরি যে মরতেন, মরে বঁাচতেন, তার কী গ্যারান্টি? নিজের পাঁঠা তিনি ল্যাজের দিকেও তো কাটাতে পারেন। গলদেশে না গিয়ে, মাথায় মাথায় বেঁচে, তলদেশে পায়ের দিকেও কাটা যেতে পারতেন তো?’
অপর একজন ভয়াবহতর অঘটনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল—‘জুতো খোয়া যাওয়ার চেয়েও সেটা আরও বেশি খোয়ার হত না কি?’
‘আর, পা খরচ হয়ে গেলে জুতো পরতেনই-বা কোথায়?’ আরেক জনের অনুযোগ শুনতে হল সেইসঙ্গে।
‘পরতুম আমার মাথায়।’ বিরক্ত হয়ে বলি, এবং জানালার বাইরে ভ্রূক্ষেপ করি। কিন্তু এখন তাকানো বৃথা! গাড়ি কখন প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে, লাইনের গোঁজামিল এড়িয়ে, সিগন্যাল-সমারোহ পার হয়ে লিলুয়ার পথে এসে পড়েছে! এখান থেকে সেই পলাতক স্লিপারের টিকি দেখার চেষ্টা দুরাশামাত্র!
তাহলে আর এই আরেক পাটি আগলে রেখে লাভ? কোন কাজে লাগবে এ। পায়েও লাগবে না, লেগেও লাগবে না। মাঝখান থেকে মনে লাগবে কেবল। জুতোর কাঁটার মতোই খচখচ করবে মনের মধ্যে। না:, তার আর কাজ নেই।
অন্যটিকেও জানালা গলিয়ে আগেরটির অনুসরণে পাঠাতে যাচ্ছি, গাড়ির সবাই হাঁ-হাঁ করে উঠল।
‘আহা-হা! করেন কী! করেন কী!! অমন করে কাউকে কি তাড়িয়ে দিতে আছে? যাকে রাখো সেই রাখে—একথাটাও কি জানেন না মশাই?’
জানি বই কী, কিন্তু যে আমাকে পায়ে রাখবে না—তাকে রেখে লাভ? এ বরং সামনে থেকে, হারানো আরেক জনের কথা মনে করিয়ে দেবে আমায়—প্রতিপদেই আমার পুরোনো শোক উথলিয়ে তুলবে, সেই কি ভালো?… এই কথাটাই, জুতমতো ভাষায়, জুতোর দৃষ্টান্ত সামনে রেখে জানাই তাঁদের। হাতের জুতো হাতে রেখেই বলি।
‘ফেলতে চান ফেলুন! আপনার জিনিস আপনি ফেলবেন, আমরা না বলবার কে? আমরা কোনো বাধা দিতে চাইনে! আর বাধা দিলেই কি শুনবেন আপনি? তবে আরেকবার আরেক পাটি জুতো ঠিক এইভাবেই গেছল—আর তার মালিককে একদিন হাহুতাশ করতে হয়েছিল তার জন্যে। বলছিলাম তাই। আপনাকেও-না ফের সেইরকম আফশোস করতে হয়!’ প্রবীণ গোছের একজন ফোঁস করে উঠলেন।
সেই কথা শুনে—কাহিনি না শুনেই—ভড়কে গেলাম আমি। হাতের জুতো হাতেই থেকে গেল আমার।
‘শুনি তো গল্পটা?’ গাড়িসুদ্ধ সবার গলা থেকে নিজের প্রশ্নটাই শুনতে পেলাম যেন!
‘সেও ঠিক এইরকমই ব্যাপার। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে গিয়ে—কিংবা, সঠিকভাবে বললে, পায়ের লক্ষণ হাতের ঠেলায় পড়ে— শেষটায় পস্তানি!’ এই বলে ভদ্রলোক একটু জিরিয়ে, আমাদের কৌতূহল আরও বাড়িয়ে নিয়ে শুরু করলেন তখন—‘শরৎচন্দ্রের নাম শুনেছেন তো? সাহিত্যসম্রাট শরৎচন্দ্র? তাঁরই গল্প।’
শুরু হল ভদ্রলোকের—
‘শুনুন তাহলে। তাঁর গল্প বটে, কিন্তু তাঁর লেখা কোনো গল্প নয়, তাহলে তো তাঁর গ্রন্থাবলিতেই পেতেন। এ হচ্ছে তাঁর নিজের জীবনে ঘটিত এক গল্প।
শিশিরকুমারের থিয়েটারে শরৎচন্দ্র তাঁর নিজেরই কী-একটা বইয়ের অভিনয় দেখতে গেছলেন। অভিনয় তো দেখলেন, অভিনয় দেখতে আর কষ্ট কী এমন? তবে কষ্টের ব্যাপার ঘটল তার পরে—পালা শেষ হলে নিজের পামশুর একপাটি আর দেখতে পেলেন না!
পামশুর একপাটি যাবে কোথায় আবার? পায়ের কাছাকাছিই তো পড়ে থাকবার কথা—কিন্তু তার ত্রিসীমানাতেও সেনেই। কুশন-চেয়ারের এধারে-ওধারে চারধারে পা দিয়ে যতটা হাতড়ানো যায়, তিনি তার কসুর করলেন না, কিন্তু কিছুতেই সেটাকে হাতানো গেল না। কাজেই, বিরক্ত হয়ে শরৎচন্দ্র আর যে-পাটিটাকে হাতের কাছে পেলেন, তাকেই হস্তগত করে উঠে পড়লেন।
শরৎচন্দ্রের বন্ধুরা থিয়েটারের বাইরে এসে তো অবাক। দেখা গেল, শরৎচন্দ্রের খালি পা এবং খালি একপাটি পামশু। তাও আবার তাঁর যথাস্থানে নেই—পায়ে নয়—হাতেই শোভা পাচ্ছে। অবাক হবার কথাই নয় কি?
‘এ কী দাদা? আপনার জুতো কোথায়? আরেক পাটি দেখচিনে যে?’ চেঁচিয়ে উঠলেন একজন।—‘আরেক পাটি শু আপনার?’
‘দেখতে পেলে শ্রীচরণেষুই দেখতে!’ বললেন শরৎচন্দ্র—‘কষ্ট করে আর এই শ্রীহস্তে দেখতে হত না।’
‘তবে ওটাকে আর কেন হাতে করে রয়েছেন? ফেলে দিন। জুতো কারও হাতে মানায় না। আপনার তো নয়ই!’ জানালেন একজন। হাতজোড়া জুতোর ওই দৃশ্য তাঁর দৃষ্টিকটু লাগছিল। জুতোর এই অপদস্থ হওয়া হয়তো সইছিল না তাঁর।
শরৎচন্দ্র চারধারে তাকালেন। বিশেষ করে সেই লোকটিকে দেখে নিলেন একবার। বেশ সন্দিগ্ধ নেত্রেই। তারপর বললেন—‘উঁহু, সেটি হচ্ছে না। বাইশ টাকা দামের সেদিনের কেনা দামি এই পামশু আমি এইখানে ফেলে যাব ভেবেচ? চোর ব্যাটা এখানেই কোথাও আড়ালে আছে। তক্কে তক্কে রয়েছে! একপাটি রেখে আর কী হবে এই ভেবে মনের বৈরাগ্যে যেই-না আমি এটিকে ফেলতে যাব, অমনি উনি এসে মজা করে এটিকেও হাতাবেন—পুরো জোড়াটাই হাতসাফাই করবেন। না, সেটি হচ্ছে না। আমার পামশু নিখরচায় পেয়ে উনি আরাম করে বেড়াবেন, সেটি আমি হতে দিচ্ছি না। এ আমি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’
এই বলে আশপাশের চোরের আশায় ছাই দিয়ে বিজোড় জুতোটাকে বগলদাবাই করে বাড়ির দিকে তিনি রওনা দিলেন…’
‘তারপর কী হল? তারপর কী হল?’ গাড়িসুদ্ধু সবাই আমরা কৌতূহলী হলাম।
ভদ্রলোক একটু দম নিচ্ছিলেন।—‘শুনুন-না বলি। সেকথাই তো বলচি!—
চোর হচ্ছে অনেকটা চোরকাঁটার মতো। কাপড়চোপড়ের কোথাও যদি লাগে তো ছাড়ানো দায়। সে-সময়ে তিনি কলকাতার অপরপারে—হাওড়া পেরিয়ে—বাজে শিবপুরে থাকতেন। তখন ছিল সাবেক হাওড়ার পুল। গঙ্গার ওপর দিয়ে ট্রামের যাতায়াত ছিল না, হেঁটে পুল পেরুতে হত। হাওড়া পুলের মাঝামাঝি এসে শরৎবাবুর মনে হল, জুতোর লোভে লোভে চোরটা তাঁর পাছু পাছু আসছে না তো? শেষটায় একটা জুতোর ছুতোয় এসে তাঁর বাড়ির খবর জেনে আরও সব তাঁর দামি জুতোদেরও না ফাঁক করে যায়! না, বেনোজল ঘরে এনে ঘরের জল বার করে দেয়া কোনো কাজের কথা নয়, এই কথাই তিনি ভাবলেন।
ডিটেকটিভ বইটই শরৎচন্দ্রের পড়া ছিল নিশ্চয়ই— চোর যে অদৃশ্যভাবে তাঁকে ‘ফলো’ করে আসছে, সে-বিষয়ে তাঁর অণুমাত্র সন্দেহ ছিল না। আরও ‘ফলো’ করে তাঁর বাড়ির খবর পেয়ে শেষপর্যন্ত ব্যাটার বরাতে আরও বেশি ফলোদয় হোক, এটা তিনি বাঞ্ছনীয় বোধ করলেন না।
বাজে শিবপুরে কাজের লোকের আমদানি কেন রে বাপু? তিনি করলেন কী, হাওড়া-ব্রিজ পেরুনোর কালে, মাঝগঙ্গায় খুব ঘটা করে (চোরকে দেখানোর খাতিরেই—বুঝতেই পারছেন!) সেই অবশিষ্ট অসহায় একমাত্র পামশুটিকে একেবারে জলাঞ্জলি দিলেন। দিয়ে, চোরকে কলা দেখিয়ে, তবেই নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেন তিনি।’
‘বা:! বা:! শরৎচন্দ্রের তো বুদ্ধি ছিল ভারি!’ তারিফ দিল গাড়ির সবাই।
‘বা:, বুদ্ধি থাকবে না? কত বড়ো ঔপন্যাসিক তিনি! অত বড়ো মনস্তাত্ত্বিক আর এদেশে জন্মেছে নাকি কখনো? সবার মনের খবর ওঁর নখদর্পণে থাকত। চোরকে দেখতে না পেয়েও, তার সঙ্গে কথা না কয়েও তার মনের কথা তিনি জলের মতো পরিষ্কার দেখেছিলেন।’
কিন্তু বলতে কী, অত বড়ো মনস্তাত্ত্বিক না হয়েও, চোরকে যেন আমি চোখের ওপরই দেখছিলাম। ওই গল্প-বক্তার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলাম যেন! তা নইলে, শরৎচন্দ্রের জুতো-বিসর্জনের অত ঘটা উনি দেখলেন কী করে? ডিটেকটিভ বইটই কি আমারও এক-আধখানা পড়া নেই নাকি?
আমি কুটিল নেত্রে কথকের দিকে তাকাতেই তিনি জুতোর কথাটা চাপা দিলেন অন্য কথায়—
‘পরের দিন শিশিরকুমারের আগমন হল শরৎচন্দ্রের বাড়ি। তাঁর হাতে একটি প্যাকেট এবং মুখে প্রশ্ন—‘বলতে পারেন শরৎদা’, কী আছে এর ভেতর?’
এখন, শরৎচন্দ্রের মতো মনস্তত্ত্ববিদ দুনিয়ায় খুব বিরল ছিল। আপনারা যদি তাঁর গ্রন্থাবলি পড়ে থাকেন তো আমাকে তাঁর পরিচয় দিতে হবে না। তাঁর বইয়ের নায়ক-নায়িকাদের মনের কথা তিনি গণৎকারের মতো বলে দিতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্যাকেটের মন বলে কোনো বস্তু নেই—প্যাকেট তো আর প্রাণী নয়—মনস্বীও না—অতএব, তার অন্তরের কথা তিনি বাতলাবেন কী করে? কাজেই, অত্যন্ত স্বভাবতই, তাঁর নিজের মনে তখন যে-তত্ত্বের উদয় হয়েছিল, প্যাকেটের মনস্তত্ত্বরূপে সেই কথাই প্রকাশ পেল।
‘কোনো খাবারদাবার বুঝি?’ শুধোলেন শরৎচন্দ্র।
‘না দাদা, আপনার সেই আরেক পাটি! কোন ফাঁকে আপনার কুশনের তলায় গিয়ে সেঁধিয়েছিল, আজ চেয়ারগুলো তোলা-নাড়ার সময়ে ধরা পড়েছে। ফেরারি আসামিকে আপনার হাতে সমর্পণ করতে পাকড়ে নিয়ে এসেছি।’
এরপর শরৎচন্দ্রের মনস্তত্ত্ব কীরূপ হয়েছিল, তা অনুমান করার ভার আপনাদের ওপর। তাঁর গ্রন্থাবলি যদি পুনঃপুন আপনাদের পড়া থাকে, তাহলে তা টের পেতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না আপনাদের।…
এই বলে উক্ত ভদ্রলোক নিরস্ত হলেন।
আমি জুতো হাতে উঠে পড়লাম। গাড়ির মধ্যে, এধারে-ওধারে চারধারে খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিলাম। এর বেঁাচকা, ওর পুঁটলি, তার ট্রাঙ্ক, তোরঙ্গ, লটবহর সব নড়িয়ে-সরিয়ে দেখতে লাগলাম। এমনকী, ওই কথক ভদ্রলোককেও একবার তুলে দেখতে দ্বিধা করলাম না। কিন্তু না:, কোথাও নেই—ওই ভদ্রলোকের তলাতেও না!
একধারে গোটা কতক শিশিবোতল ঢেরি করা ছিল। সেগুলোকেও ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখা হল। শরৎচন্দ্র শিশির সৌজন্যে তাঁর হারানো মানিক ফিরে পেয়েছিলেন, আমিও যদি এইসব শিশির দৌলতে পেয়ে যাই!
কিন্তু হায়, হাওড়া স্টেশনেই যে হাওয়া হয়েছে, তাকে উত্তরপাড়া পেরিয়ে কামরার মধ্যে পাওয়ার চেষ্টা বৃথা!
অগত্যা আর উপায়ান্তর না দেখে, এবং সেই একমাত্র স্লিপারকে বারংবার দেখে দেখে অসহ্য বোধ হল। ‘ধুত্তোর!’ বলে হতভাগ্যকে সবেগে জানালার বাইরে উধাও করে দিলাম। কারও আবেদন-নিবেদন, বাধানিষেধ, বাদ-প্রতিবাদে কান না দিয়ে।
শু-জুতোর সঙ্গে আমার ছোটোবেলার থেকে আড়ি। তাদের পরলেই আমার পায়ে ফোসকা পড়ে। তাই আধুনিক চটি—এই স্লিপারদের চিরকাল আমি ভালোবেসেছি। তার সঙ্গে এভাবে চটাচটি করবার ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু একজনের এরকম ব্যাভারের পর আর কাঁহাতক ভাব রাখা যায়?
যাক গে, বিয়েবাড়িতে যখন যাচ্ছি, তখন জুতোর ভাবনা নেই—জুতোর অভাব হবে না। খালি পায়ে ফিরতে হবে না এটা ঠিক; এমন কী, কপালে থাকলে, শরৎবাবুর মতন দামি নরম পামশুও পেয়ে যেতে পারি, চাইকী! সবাই কিছু এখনও এত সেয়ানা হয়ে যায়নি যে, ছেঁড়া স্যাণ্ডাল পায়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করে তবে আত্মীয়তা রক্ষা করতে এসেছে।
শ্রীরামপুর ইস্টিশনে নামলাম। ওমা, একী! গাড়ির পাদানির ওপরে বসে—ইনি কে? পলাতক শ্রীমান— সেই স্লিপারই নয় কি?
চিনতে দেরি হল না। বিদায় করেছি যারে নয়নজলে— সেই তারই অপর পাটি।