জবাই!

জবাই!

জবার মতন মেয়ে আর হয় না, এই কথা সবার। কিন্তু হলে কী হবে, কী যেন হয়েছে মেয়েটার! একেবারে না-হবার তালে আছে কি না কে জানে, তিলে তিলে শুকিয়ে যাচ্ছে দিনকের দিন।

কী যে হয়েছে মেয়েটার। খেতে বসল কি উঠে পড়ল অমনি। ভাতের দু-গরাসের বেশি তিনটি গরাস তাকে গেলাও দেখি? সেএক মহামারি কান্ড! আর এমনি করে না খেয়ে খেয়ে—

না খেলে যা হয় তাই হয়েছে! দিনের পর দিন—ক্ষীণের পর ক্ষীণ! রোগা, বেরঙা, শুকনো। চোখের কোণে কালি, গলার কন্ঠা বার-করা—আমাদের উৎকন্ঠা-বাড়ানো—নীরক্ত সাদাটে চেহারা। পরমহংসদেব যে একটা সাদা জবাফুল বানিয়েছিলেন শোনা যায়, একেক সময়ে আমার সন্দেহ জাগে—এইটিই সেইটি নয়তো? বৃন্তচ্যুত হয়ে এসে পড়েছে এই বাড়িতে?

এদিকে কিন্তু মেয়েটা বেশ কাজের। সর্বদাই একটা না একটা কাজ নিয়ে আছে। হয় বুনছে নয় সেলাই করছে, নয় তো কলেজের বইয়ে উপুড়। শীত এল কি সোয়েটার বানাতে বসল জবা। মামাদের গায়ে জামাদের চাপাতে ব্যস্ত হল। সোয়েটারের তাঁদের অভাব নেই, জবার শ্রীহস্তের বোনাই কয়েকটা করে রয়েছে—তার ওপরেই আরেকটা। গায়ে-পড়া জামা গায়ে পরার এই দায়।

মামার স্থলে না হলেও জামার স্থলে আমি আছি। অনেক বোন আছে, কেমন যেন বন্য প্রকৃতির—যাদের মন দুর্জ্ঞেয়—রহস্যের কোনো থই মেলে না। সেইসব বোন, যাকে বলে, বেশ শ্বাপদসংকুল। আপদজনক রীতিমতন।

তাদের যদি জামার বোতাম আঁটতে দাও তো গা থেকে খুলে দেওয়াই নিরাপদ। নইলে, তাদের হাতের ছুঁচ বোতাম ভেদ করে কোথায় গিয়ে যে আটকাবে কেউ বলতে পারে না। হতভাগ্য ভাইদের তারা অন্ধকারের মতোই সূচিভেদ্য জ্ঞান করে। কিন্তু জবা সেরকমের না। ভেদাভেদজ্ঞান তার আছে। বোনের মতো হয়েও বন্ধুর মতন। জামা গায় দিয়েই তাকে বোতাম টেঁকতে দেওয়া যায়। জামাওয়ালাকে ছ্যাঁদা না করেও সেসেলাই-এর সূত্রপাত করতে পারে। দেহাবরণের সঙ্গে সূচিকাভরণের পাত্র হবার আশঙ্কা নেই ওর কাছে। ছিদ্রান্বেষী মন নয় ওর।

জামা টেঁকে জামাকে টেঁকানোর—এই জবর কাজ হচ্ছে জবার। কাজেই তাকে টেঁকসই করতে লাগতে হল আমাকেই। নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। তিনি ওজন নিলেন, ভোজনের খবর নিলেন, তারপর সব দেখেশুনে কডলিভারের ব্যবস্থা দিলেন।

সুপার-ডি-ভিটামিনঘটিত ওই তেল এক চামচ করে খাবার পরে তিন বার করে রোজ। প্রথম ডোজ আজ দুপুর থেকেই শুরু হোক।

প্রথম বারের প্রথম খাবারের—খবর নিতে মাসিমার বাড়ি গেলাম বিকেলে।

চৌকাটে পা দিতেই ইতু ছুটে এল চিৎকার করে—‘জবাদি মোটে আধ চামচে খেয়েছিল আজ…’

‘মোটে আধ চামচ?’ শুনে আমি একটু ক্ষুণ্ণ হই।

হ্যাঁ, তাই খেয়েই যা বমি করেছে একখানা—তা দেখবার মতো। ঠিক তিনটি গেলাস! জবাদি বলেছে আর ও খাবে না।’

‘কই দেখি।’ এরপর আর অক্ষুণ্ণ থাকা যায় না।

‘সেকি আর তোমার জন্যে পড়ে আছে এখনও?’ ইতু জানায়, ‘কিন্তু যদি দেখতে বড়দা? সেকী বমি! দেখবার মতোই একখানা। দেখতে কিন্তু একটুও ভালো নয়।’

তা বটে। বমির মধ্যে দ্রষ্টব্য কিছু নেই। তার বেশি-কম হতে পারে, ভালো-মন্দ হয় না। সুদৃশ্য বমি এ পর্যন্ত একটাও কারও চোখে পড়েছে বলে শোনা যায়নি এখনও।

‘আমি কি বমি দেখতে চেয়েছি? কডলিভারটা দেখি আন, কেমন কডলিভার।’

কডলিভারটাকেই আমি একবার দেখতে চাই। বমিদায়ক এ কেমন কডলিভার!

কডলিভারের সাথে সাথে জবাও আসে।

বোতলটা হাতে করে আমি দেখি। লালায়িত চোখে দেখি।—‘আহা, কী সুন্দর সোনালি রং! যেন গলানো সোনা টলটল করছে। মরি মরি!’

‘আহা, কী কথাই শোনালে!’ জবা মুখ বেঁকায়—‘অল দ্যাট গ্লিটারস…’

‘থাম, তোর ইংরেজি বিদ্যে ফলাতে হবে না।’ আমি বোতলের ছিপি খুলি—শুঁকে দেখি—‘আরে, কী মিষ্টি গন্ধ রে! ভুরভুর করছে খুশবু।’

‘মিষ্টি গন্ধ?’ জবা ভুরু কুঁচকে বলে—‘নাকের মাথা খেয়েছ নাকি?’ বলতে বলতে সেতেতে ওঠে—‘চেখে দ্যাখো-না এক চামচ!’

‘চাখবই তো। কডলিভার পেলে কেউ ছাড়ে? অমনি অমনি পায় যদি?’ আমি ওকালতি করি—‘আজকের বাজারে ক-টা লোক খেতে পায় এমন কডলিভার শুনি? এই সুপার ডি?’

জবা একথার জবাব দিতে পারে না। অন্য কথার জাবর কাটে—‘বেশ তো, খাও-না তুমি! কে বারণ করছে?’

‘খাবই তো! খাবার জন্যেই তো এসেছি। আহা, অনেক দিন খাইনি এই কডলিভার! সেই কবে ছোট্টবেলায় খেয়েছিলাম—!’ তার সুখস্মৃতি—সেই সুখের দিনগুলি যেন আমার চোখের মধ্যে এসে উঁকি মারে—‘আহা, তার সু-তার এখনও যেন আমার জিভের ডগায় জড়িয়ে আছে।’

জবা হাঁ করে থাকে। ইতুর চোখ বড়ো বড়ো হয়—‘নিয়ে আসব চামচটা বড়দা?’

‘বড়ো চামচটা নিয়ে আয় যা।’ আমি ফরমাস দিই। বোতল থেকে আধ চামচ ঢালি। কী বিশ্রী বীভৎস জিনিস! ঘন আর ঘোলাটে। আমার গা ঘোলায়, বমি বমি করে। আস্তে আস্তে চামচ ভরতি হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার ফুর্তি হয়—‘বা:, কী চমৎকার! কেমন দেখতে! আহা! কি রে, চাখবি নাকি একটু?’ ইতুকে ডাকি।

‘আমি? না, বাবা!’ সেতিন পা পিছিয়ে যায়। আমার নেমন্তন্নের হাত পাঁচেক দূর থেকে বলে—‘ওই বিচ্ছিরি তেল আমি খাব? মরে গেলেও না।’

না:, ইতু ভারি ভীতু মেয়ে।—‘না খেলি তো বয়েই গেল! খেলে মোটা হতিস। স্বাস্থ্য ভালো হত—দেখতে সুন্দর হতিস আরও। এ জিনিস কেউ ফেলে? যাক, তাহলে আমিই খাই। খেয়ে নিজের চেহারাটা বাগাই।’

এই চেহারা আরও বাগালে—আরও বেশি আগালে—কী বিপুল আর বপুলই-না হবে! ভাবতে ভাবতে চামচটা গালে তুলি। ইতু অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা ছোটোখাটো পর্যায়ের দেখেছে, সেটা তার কাছে পর্যাপ্ত নয়। বমির একটা রাজ সংস্করণ দেখবার লালসায় উদগ্রীব হয়ে সেঅপেক্ষা করে।

চামচটা আমার হাঁ-এর মধ্যে গলাই।

তেলটা জিভের থেকে গলায়, গলার থেকে তলায় নামে। নেমেই যেন ফের ঠেলে উঠতে চায়। কী যেন একটা তেড়ে-ফুঁড়ে উঠে আসে। সেকীসের ঠেলা আমি বলতে পারব না। সেইটেই হয়তো বমি হবে। যা-ই হোক, তাই ভেবে তাকে আমি প্রাণপণে চেপে থাকি। মনের জোর দিয়ে উঠতি তোড়টাকে ঠেলে নামাই। রামবমিটাকে উঠতে দিই না।

কিন্তু, কী গন্ধ রে বাবা! পৃথিবীর যত শুঁটকি মাছের গন্ধসার যেন নির্যাস-করা। জিভে ঠেকাতে না ঠেকাতেই দম বন্ধ হয়ে আসে, চোখ অন্ধকার। শরীর আড়পাড় করে। তবু আমি তারিয়ে তারিয়ে খাই—চেটেপুটে নিই চামচ। খেয়ে ফের তারিফ করি—‘আহা, কী মধুর খোসবাই! কী চমৎকার খেতে! ইলিশ মাছের তেল কোথায় লাগে রে! কেমন মিষ্টি মিষ্টি আঁশটে গন্ধ। আরেকটু খাব নাকি?’ জিজ্ঞেস করি জবাকে—‘তোর আবার কমে যাবে না তো? এ জিনিস এক চামচ খেলে কি আশ মেটে? এই ছোট্ট একটা চামচের?’

শুনেই না ইতু লাফিয়ে ওঠে। ‘রান্নাঘর থেকে বড়ো হাতাটা আনব বড়দা?’ হাতার নামেই আমার মাথা ঘোরে। এক হাতা কডলিভার তেল যদি আজ আমায় গিলতে হয়, তাহলে কাল আর আমাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার নিজের লিভার কড়কে যাবে তার তাড়সে।

বিপদের মাথায় মাসিমা এসে বঁাচান। একথালা মুড়ি নিয়ে আসেন—‘মুড়ি খাবি? আচারের তেলমাখা মুড়ি?’

‘আচারের তেল মাখিয়ে আনলেন? আহা, এই কডলিভার মেখেই খেতাম নাহয়? মাছের তেল মাখিয়ে খেতে মন্দ লাগত না। যাক, মেখে ফেলেচেন যখন,—দিন দুটিখানি। খাওয়া যাক।’

আচারে লক্ষ্মী—বিচারে পন্ডিত। মাসিমা সত্যিই আমার খুব লক্ষ্মী। এই মুহূর্তে এমন সদাচারের পরাকাষ্ঠা হয়ে দেখা না দিলে, কে জানে, আমি—আমিও হয়তো বমি করে বসতাম। জিভের ওপরে বদগন্ধের যে পলস্তারা পড়েছিল, আচার-মুড়ির সাহায্যে তাদের পাচার করতে লাগা যায়।

‘যা, রেখে দেগে বোতল। কাল এসে খাওয়া যাবে আবার। ভালো করে রাখিস। দেখিস, কেউ যেন ফের লুকিয়ে-চুরিয়ে না খায়। আড়ালে না ঢুকুঢুকু ঢালে। জবা খায় তো ভালোই—ওরই তো জিনিস। না খায় যদি, আরও ভালো। আমি একাই খেয়ে সাবড়ে দেব। দু-দিনেই এই দোহারা চেহারা তেহারা করে ফেলব দেখিস। ভুঁড়িদার এমন একখানা বানাব যার জুড়িদার দুনিয়ায় মিলবে না।’

পরেরদিন গিয়ে শুনলাম, খাবার পরে জবা আজ শখ করে একটুখানি চেখেছে। পুরো এক চামচও নয়, কিন্তু তা না হোক—আর, মুখ ব্যাজার করেই হোক-না—খেয়েছে তো! আধ চামচা গিলেই—তার পরেই—এক খামচা চিনি দিয়েছে গালে। এবং…এবং বমি করেনি।

শুনে উৎফুল্ল হয়ে বগল থেকে আধ পাউণ্ডের রুটিখানা আমি বার করি—‘কই নিয়ে আয় তো বোতলটা। কডলিভার দিয়ে জেলির মতন মাখিয়ে খাব বলে এনেছি। তেলতেলে রুটি খেতে এমন ভালো লাগে যে, কী বলব! মাখম-মাখানো টোস্ট কোথায় লাগে তার কাছে!’

রুটির চাকলা করে তার ওপরে কডলিভারের তৈলচিত্র আঁকি। তার পিঠে আরেক চাকলা রুটি দিয়ে ঢাকি। তার পরে চাখি। তারিয়ে তারিয়ে—আরাম করে।

জেলখানার রুটি কীরকম, খাইনি কখনো; এখন এই জেলিয় রুটির খানা খাই। হাসিমুখ করে খাই।

সাধতে হয় না, আমার হাসি হাসি মুখ দেখে জবা আপনার থেকেই হাত বাড়ায়—‘দাও তো আমায় এক স্লাইস। চেখে দেখি একটু।’

জেলিয়-রুটি আমার পেটের জেলায় গিয়ে ঘোরতর আন্দোলন লাগায়। নাড়িতে নাড়িতে পাক দেয়, অন্নপ্রাশনের অন্ন ডাক দেয়; কিন্তু মানতে হয় জবাকে—‘না, সত্যিই! রুটি দিয়ে খেতে তেমন মন্দ লাগে না তো!’

‘রসগোল্লা দিয়ে খেতে আরও ভালো। খাজা তো পাওয়া যায় না, নইলে তা দিয়ে খেলে আরও খাসা। কড়া-পাকের সন্দেশ দিয়ে খেলে আরও কড়া। কালকে নিয়ে আসব কড়াপাক। কিন্তু দেখিস, সাবধান, এর মধ্যেই আর কেউ যেন ঘুচ করে ফাঁক করে না দেয় আবার!’

‘করতে দিলে তো!’ ইতুর হাত থেকে জবা আপন হাতে বোতলের হেফাজত নেয়।

‘দরবারি পায়েস দিয়ে খাব বড়দা?’ ইতু আমায় শুধোয়, ‘মা আজ দরবারি পায়েস রেঁধেছে। তাতেও তোমার ওই রসগোল্লা আছে। তা ছাড়া কিশমিশ পেস্তা বাদাম, আরও কত কী আছে তার সঙ্গে যে!’

‘তেল দিয়ে দরবারি পায়েস? তা, বেশ তো!’ আমি মাথা নাড়ি।—‘আন-না! মন্দ কী?’

ইতু রান্নাঘরের দিকে ছুটছিল কিন্তু মাসিমা বাধা দেন। কডলিভারের আদর দিয়ে নিজের পায়েসের দর বাড়াতে তিনি নারাজ। বেঁকে দাঁড়ান একেবারে—‘কডলিভার দিয়ে আমার পায়েস? না বাপু, তোমার আর পায়েস খেয়ে কাজ নেই।’

তেল দিয়ে আয়েস করে একটু যে পায়েস খাব তার কি জো আছে? মুখ ভার করে বলি—‘নাই খেলাম! নাই দিলে পায়েস। আমার খাবার সাধের চেয়েও তোমার পায়েসের মান-অপমান বড়ো হল! বেশ, কাল আমি রাবড়ি নিয়ে আসব। রাবড়ির এক-একখানা সর মাছের তেলে ডুবিয়ে খেতে আহা, সেযে কী আরাম! তারপর রাবড়ির ঝোলের সঙ্গে মিশিয়ে—আহা!’

ভাবতেই আমার জিভের জল শুকিয়ে যায়। নির্জীব হয়ে পড়ি।

জবা কিন্তু আপত্তি করে এবার—‘বা রে! তুমিই যদি আমার ওষুধ খেয়ে সাবড়ে দেবে তাহলে আমি খাব কী? খালি বোতলটা শুঁকব নাকি?’

মাসিমাও না বলে পারেন না—‘সত্যিই তো! রোগা দেহটা কার শুনি? তোর, না, ওর? তুই-ই যদি সবটা খেলি তাহলে ও বেচারি…।’

‘বেশ, বেশ তো! তাহলে ও-ই খাক। আমি আর খেতে চাইনে।’ মুখ ভার করে আমি বলি। রীতিমতো রাগ করেই।

রাগ করে তারপরে ও-তেলের তিলমাত্রও মুখে তুলি না আমি। নাম মুখে আনি না পর্যন্ত। শুনি যে জবা দেবী নিজেই খাচ্ছেন নিয়মিতভাবেই, বেশ আগ্রহের সহিত। দু-বেলা খাবার পরে তো বটেই—তা ছাড়াও, রুটি দিয়ে—হালুয়া দিয়ে—রাজভোগ দিয়েও। চামচের পর চামচ। যতই শুনি ততই আরও চমৎকৃত হই।

খেতে খেতে কডলিভারের বিশ্রীটা যেমন ফিরেছিল, জবার শ্রীও ফিরছিল তেমনি। বোতলের পর বোতল ফাঁক হচ্ছিল। আহার যেমন বাড়ছিল জবার, তার গলার হাড় ঢাকা পড়ছিল তেমনি।

এমনিই হয়। এই মনেই হয়ে থাকে। কুইনিন যে তেতো আর তেঁতুল যে তুলনাহীন তার অনেকখানিই আমাদের মনে। মনের জিভে। মনই হচ্ছে আসল। স্বাদ-গন্ধ সব কিছুই এই মনের মধ্যেই জীবন্ত। নিমের মধ্যে কিছু তিক্ততা নেই, মনেই তার নিমিত্ত। মিষ্টতার সম্বন্ধেও সেই কথা।

অনেক দিন পরে আবার গেলাম জবাদের বাড়ি। ভোল পালটেছে জবা, চোখ-ভোলানো হয়েছে আবার। কডলিভার খেয়ে দিব্যি তেল-চুকচুকে চেহারা—স্বর্ণাভ তেলের মতোই সোনালি টুকটুকে, গোলগাল, চেনাই যায় না ওকে আর।

‘আসনি যে বড়ো অ্যাদ্দিন? কডলিভার খেতে দেয়া হয়নি বলে সেই রাগেই বুঝি—?’ সেজবাবদিহি চায়।

‘হবে না রাগ?’ আমি বলি—‘সাধ করে একটু খেতে চেয়েছিলাম বই তো না। তাইতেই তোদের…সামান্য শখ মেটাতে পারিসনে, তোরা আবার সখ্যের বড়াই করিস! যাক, দিনটা আজ মেঘ-মেঘ করছে—বেশ বাদলা বাদলা—একটু আচারের তেল-মেখে মুড়ি নিয়ে আয় তো, খাই।’

‘আচারের তেল তো নেই বড়দা, কবে ফুরিয়ে গেছে। দাঁড়াও, দেখি যদি একটু পড়ে থাকে—’

খানিক বাদে এক থালা মুড়ি নিয়ে আসে জবা।—‘একটু খানিই ছিল—বোতলের তলায় পড়েছিল। সেই তলানি দিয়েই মেখে আনলাম—তা মন্দ হবে না নেহাত। প্রথম দিনটিতেই তুমি যা খেতে চেয়েছিলে—নাও, তোমার সেই কডলিভার-মাখা মুড়ি।’

কডলিভার-মাখা মুড়ি! শুনেই আমার মুড়ো ঘুরে যায়। নাক সিঁটকাই আমি। আঁশটে গন্ধটা যেন দূর থেকেই আমায় জাপটে ধরে।

‘ক-ড-লি-ভা-র মাখা মুড়ি!’ আওড়াই আমি—আপন মনেই—করকাহতের মতোই।

‘হ্যাঁ, এখন তো মিটল শখ? বড্ড যে সখ্যের খোঁটা দিচ্ছিলে? নাও, আশ মিটিয়ে খাও এখন।’

ওর উত্তরে আমি কিছু বলতে পারি না। দায়ে পড়ে এক গাল মুখে তুলি। তারপরে শুধু বলি—ওয়াক।

এককথায় জবার কথার জবাব দিই। এতদিনকার না-বলা আমার কথাটির সেই প্রথম ওয়াক-আউট! কথাটা গলার তলা থেকে ঠেলে ওঠে হঠাৎ। এক ছত্রের কথা ছত্রাকারে ছড়িয়ে থাকে টেবিলের তলায়।

ইতুর পায়ের গোড়ায় গড়িয়ে যায়—সেই ইত্যাদি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *