সাহিত্যিক সাক্ষাৎ

সাহিত্যিক সাক্ষাৎ

উঠতি বয়সে আমি একটা চলতি সাপ্তাহিকের সম্পাদক হয়েছিলাম। কাগজটা আমি ফিরি করতাম তখন।

রাজদ্রোহের দায়ে কাগজের সম্পাদকের কারাদন্ড হয়েছিল। অফিস থেকে কাগজ আনতে গিয়ে জানলাম, কাগজ আর বেরোবে না, সম্পাদকের জেল হয়েছে।

পরিচালক স্বয়ং কথাটা বললেন আমায়।

‘কেন, সম্পাদক কি আর পাওয়া যাচ্ছে না?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘পুলিশে সম্পাদকদের ধরছে কিনা ভয়ানক। কেউ বিশেষ রাজি হচ্ছে না জেলে যেতে।’

‘জেলে বুঝি ঘানি টানায় ভারি? খেতে দেয় না একদম?’

‘না, সেরকম নয়। সম্পাদকদের জেলে এ-ক্লাসে রাখে। খাওয়াদাওয়া খুব খাসা। ঘানি টানতে হয় না।’

‘তাহলে আর কেউ যদি সম্পাদক হতে না চায় আমি রাজি আছি হতে।’

‘তুমি! তুমি কি লিখতে জান?’ পরিচালক মশাই অবাক হয়ে গেলেন।

‘এক-আধটু পারি বোধ হয়। এই কাগজেই প্র্যাকটিস করেছি তো।’

‘কী লিখেছ এই কাগজে?’

‘গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা—তবে কবিতাই বেশিরভাগ। আমার নাম ছাপা রয়েছে সেসব লেখার মাথায়। দেখতে পাবেন। তবে যেগুলো সম্পাদকীয় হয়ে বেরিয়েছে তাতে আমার নাম নেইকো।’

‘সম্পাদকীয়ও লিখেছ নাকি আবার?’

‘না, লিখিনি। লিখতে চাইওনি। নাম হবে না এমন লেখা লিখতে কে চায়? কিন্তু সম্পাদকমশায়ের কোনোদিন দাঁত কনকন, মাথা টনটন, হাত ঝনঝন করলে তাঁর কাছে জমানো আমার প্রবন্ধের থেকে কোনো কোনোটার ল্যাজা মুড়ো ছেঁটে সম্পাদকীয় করে তিনি চালিয়ে দিয়েছেন।’

‘বটে?’

‘তবে, বলতে কী, নাম না হলেও দাম পেয়েছি; কাজ দিয়েছিল সেই লেখাগুলোতেই। সেগুলোর জন্যেই মাঝে মাঝে যা দু-পাঁচ টাকা রোজগার হয়েছে।’

‘এখন তুমি কী কর?’

‘আপনার এই কাগজ ফিরি করি! এতেই আমার চলে যায় কোনোরকমে। তা, চার-পাঁচ শো কাগজ আমি চালিয়ে থাকি হপ্তায়!’

‘তাই নাকি? তাহলে তো কাগজ চালাবার অভিজ্ঞতা তোমার বেশ আছে। তোমাকেই সম্পাদক করে দেওয়া হল আজ থেকে। লেগে যাও এক্ষুনি।’

তৎক্ষণাৎ আমি লেগে গেলাম।

গোড়াতেই লাগলাম কাগজটার মোড় ঘোরাতে। নতুন নতুন ফিচার বার করতে লাগলাম। হপ্তায় হপ্তায় আনকোরা নতুনত্ব।

যত সব নামকরা লেখক, বৈজ্ঞানিক, সমাজসেবক, দেশনেতার সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটা ফিচার করা গেল।

প্রথমেই গেলাম একজন নামকরা লেখকের কাছে—তাঁর ইন্টারভিউ নিতে।

রবীন্দ্রনাথই তখন শীর্ষস্থানীয়। তাঁর পরেই আর যাঁরা নাম কিনেছিলেন তাঁদের ভেতর থেকে একজনকে বেছে নিয়ে গেলাম তাঁর কাছে।

‘আমার কাছে কী দরকার?’ যাওয়ামাত্রই জিজ্ঞাসিত হলাম।

‘আজ্ঞে, আপনার ইন্টারভিউ নিতে এসেছি।’

‘অ্যাঁ? কী বললে কথাটা? ইন ইন ইন—?’ তিনি ভয়ানক বিচলিত হয়ে পড়লেন। —‘কীসের মধ্যে বললে হ্যাঁ?’

‘আজ্ঞে কিছুর মধ্যে বলিনি। কথাটা হচ্ছে ইন্টারভিউ। অর্থাৎ কিনা, আপনার জীবনের ইতিহাস এবং আরও নানান বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞাসা করব। আপনার মতামত জানতে চাইব, তার উত্তরে আপনি যা যা বলবেন সেইসব জবাব টুকে নিয়ে গিয়ে হুবহু আমার কাগজে ছেপে দেব।’

‘ছেপে দেবে? কাগজে ছেপে দেবে? বটে?’ তিনি কী যেন চিন্তা করে বললেন— ‘এরকম আর কেউ ছাপিয়েছে এর আগে?’

‘আজ প্রথম আপনার কাছেই এসেছি। অবিশ্যি, রবীন্দ্রনাথই আমাদের সবার মাথা। কিন্তু তিনি তো বোলপুরে থাকেন, নাগালের বাইরে। তাই আপনার কাছেই এলাম। আপনিও কিছু কম নন মশাই। আপনি হলেন আমাদের টিকিস্থানীয়।’

‘তা বেশ বেশ। এসেছ ভালোই করেছ।’ তাঁকে বেশ খুশিই দেখা গেল। ‘মাথা তো মাথা। সেই মাথার ওপরেই টিকির স্থান। তা, এর জন্য কত টাকা দেবে আমায়?’

‘টাকা! ইন্টারভিউয়ের জন্য টাকা দেওয়ার প্রথা নেই তো।’ আমি প্রকাশ করলাম। ‘অবশ্যি ছাপানোর জন্য আপনাকেও কোনো টাকা দিতে হবে না।’

‘উঁহু, তাহলে হবে না। টাকা ছাড়া আমি বাক্যব্যয় করিনে।’

‘বেশ, দেব তাহলে কিছু আপনাকে।’ মানিব্যাগে মোট দুখানা নোট ছিল, অনেক ইতস্তত করে একখানা বিসর্জন দিতে তৈরি হলাম।

‘ওখানাও দাও।’

দ্বিতীয় নোটখানা, আমাকে সতর্ক হবার সুযোগ না দিয়েই, একরকম তিনি ছিনিয়েই নিলেন বলতে গেলে।

‘বেশ, এইবার কী জানতে চাও বলো। পুলিশে ধরে এমন কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না যেন। পুলিশের আমার ভারি ভয়। জেলে যেতে আমি চাইনে।’

‘জেলে যাবার কোনো ভয় নেই আপনার। ধরলে কাগজের সম্পাদককেই ধরে পুলিশ। লেখককে ধরে না।’

‘ভালো কথা, তোমাদের কাগজের সম্পাদক কে?’

নাম জানালাম আমার।

‘শিব্রাম চকরবরতি। শিব্রাম চকরবরতি। নামটা যেন শোনা শোনা, কিন্তু ভদ্রলোকের সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় কখনো হয়নি।’

ততক্ষণে পদে এসেছি। বললাম, ‘এই যে চোখের সামনেই দেখছেন। আমিই সেই হতভাগ্য নরাধম।’

‘ওঃ, তুমি? তুমিই। তা বেশ বেশ। তুমিই সম্পাদক, আবার রিপোর্টারও?’

‘আজ্ঞে, এমন কাগজ আমি জানি যার সম্পাদক, লেখক, কম্পোজিটর, মুদ্রাকর এবং হকার একই লোক। এক কপিও বিক্রি হয় না, কাজেই পাঠক এবং গ্রাহকও সেনিজেই।’

‘বটে, এরকম আছে?’ তিনি একটু আশ্চর্য হন। —‘একাই একশো এমন ব্যক্তির সংখ্যা যত বাড়বে ততই আমাদের দেশের উন্নতি হবে।’ ক্ষণেকের জন্য থামেন, ‘দ্যাখো, আমার এই মতামতটা ছেপো না যেন। দেশের উন্নতির কথা আছে কিনা, পুলিশে, বুঝচই তো—’

‘যে আজ্ঞে, বাদ দিয়ে দেব।’ তাঁকে আশ্বস্ত করি, ‘এই দেখুন, আপনার সামনেই কেটে দিলাম। এইবার, আপনি অনুমতি করলে, আপনার অতীত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি।’

‘স্বচ্ছন্দে। কিন্তু একটা কথা, আমার মেমরিটা তত ভালো নয়, আগেই বলে রাখি। আমার বিস্মৃতিশক্তি অসাধারণ! অনেকসময় আমার নিজেরই কেমন গোলমাল ঠেকে অনেক বিষয়ে। তাতে কি অসুবিধা হবে কিছু?’

‘কীসের অসুবিধা?’ আমি ওঁকে উৎসাহ দিই—‘আপনার কাজ হচ্ছে বলা, আমার কাজ হচ্ছে টুকে নিয়ে গিয়ে ছেপে দেওয়া, আর পাঠকের কাজ হচ্ছে পয়সা দিয়ে কিনে পড়া—এর মধ্যে অসুবিধাটা কার? এবং কোনখানে? …এখন আমার প্রথম জিজ্ঞাস্য হচ্ছে আপনার বয়স কত?’

‘বয়স? কত আর? এই বাইশ। আসচে অঘ্রানে বাইশে পড়ব। অঘ্রানেই আমার জন্ম কিনা কিংবা আষাঢ়েও হতে পারে। মনে নেইকো ঠিক।’

‘বাইশ!’ আমি চমকে উঠি, ‘আমার ধারণা ছিল চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ এইরকম কিছু হবে— দেখেশুনে সেইরকম মালুম করেছিলুম।’

‘তার মানে? তুমি কি বলতে চাও আমি বাইশ বছর ধরেই এই বাইশ বছরে রয়ে গেছি, যাকে বলে ভদ্রলোকের এককথা?’ তিনি ঈষৎ ক্ষুণ্ণ হন।

‘না, না, তা বলব কেন? আপনার জন্মস্থান কোথায়?’

‘মুসুরিতে। মুসুরিতেই বোধ হচ্ছে। এই হাওড়ার পুল পেরিয়ে কদমতলার ট্রামে উঠে যেতে হয়। হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে, মনে পড়ছে, জায়গাটার নাম ঘুসুরি।’

‘মুসুরি তো বিখ্যাত জায়গা। চেঞ্জে যায় মানুষ—’ আমি বললাম, ‘তবে ঘুসুরিরও বিখ্যাত হবার আশঙ্কা রইল— আপনি জন্মেছেন যখন। তা আপনি লেখা শুরু করেছেন কতদিন?’

‘বছর আষ্টেক। তা বছর আষ্টেক হবে। মানে আট বছর বয়স থেকেই, বুঝলে কিনা! প্রথমে কলমের পিছন দিয়েই লিখতে শুরু করি, ইয়া ইয়া মোটা মোটা অক্ষরে দেওয়ালের গায়!’

‘এ সমস্তই প্রতিভার লক্ষণ। প্রথমজীবনে দেওয়াল থেকে শুরু, শেষ জীবনে দেয়ালায় গিয়ে খতম। আচ্ছা, জীবনে যত লোকের সংস্পর্শে আপনি এসেছেন তার মধ্যে কাকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে আপনার মনে হয়েছে?’

‘কেন, বঙ্কিম চাটুজ্যে।’ তিনি একটুখানি ভাবনায় পড়লেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, বঙ্কিমবাবুই। গল্পলেখক হিসেবেই বলছ তো? তাহলে প্রায় ঠিকই বলা হয়েছে।’ একটু থেমে বললেন আবার, ‘নিজেকে বাদ দিয়ে বলছি কিন্তু। নিজের সংস্পর্শেই আমি সবচেয়ে বেশি এসেছি কিনা জীবনে।’

‘সকলেই আসে; তাতে কিছু আসে-যায় না।’ আমি আশ্বাস দিলাম। ‘কিন্তু একটা প্রশ্ন, বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে যদি আপনার সাক্ষাৎ হয়ে থাকে, তিনি তো মারা গেছেন বহুকাল। তাহলে বাইশ বছর কী করে আপনার বয়স হয়?’

‘সেই তো আশ্চর্য।’ তিনি বললেন, ‘কী করে হল জানি না। আমারও এটা অদ্ভুত বলেই বোধ হচ্ছে। তুমি বলবার পর।’

‘তাহলে বঙ্কিমবাবুকে আপনি কখনো স্বচক্ষে দেখেননি, যদি বাইশ হয় আপনার বয়স’—আমি বলতে যাই, ‘তাঁর সম্বন্ধে ঘুণাক্ষরে কিছু শুনেছেন হয়তো।

‘আমার সম্বন্ধে আমার চেয়ে তুমিই যদি বেশি জান তবে আর আমাকে জিজ্ঞাসা করা কেন?’ চটেই গেলেন তিনি এবার।

‘যাক, যাক গে— যেতে দিন।’ কথাটা আমি উড়িয়ে দিই। —‘কী উপলক্ষ্যে কোথায় বঙ্কিমবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার?’

‘তাঁর শবযাত্রার সময়। হ্যাঁ, সেই প্রথম, সেই শেষ। তাঁর খাটের যেদিকে তাঁর মাথা সেই ধারটা ছিল আমার কাঁধে। শবযাত্রীদের মধ্যে আমিও ছিলাম একজন। ‘বঙ্কিমবাবু কি জয়, বঙ্কিমবাবু কি জয়,’ খুব জোরে জোরে চ্যাঁচাচ্ছিলাম আমরা। তিনি হঠাৎ ঘাড় তুলে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন। —‘আহা, কানের গোড়ায় অত গোল কোরো না হে! মাথা ধরে যাচ্ছে আমার।’

‘অ্যাঁ? বলেন কী? এই কথা তিনি বললেন’ শুনে তো আমার পিলে অবধি চমকে ওঠে; ‘মড়ায় কখনো কথা বলে?’

‘বলে। সময়ে সময়ে বলে। কিন্তু বলে ওই ফিসফিস করেই। আমার একটা উপন্যাসেও এক জায়গায় ওইরকম বলেছে, ছাপার অক্ষরে লেখা আছে, পড়ে দেখো। ছাপার অক্ষরে দেখলে তখন তোমার বিশ্বাস হবে বোধ হয়।’

‘কিন্তু চেঁচালে মড়া মানুষের মাথা ধরে যাবে এই-বা কেমন কথা।’

‘বঙ্কিমবাবু কি সাধারণ লোক ছিলেন তুমি বলতে চাও?’ তাঁর প্রতিভা কি তুমি স্বীকার কর না? ওইখানেই তো তাঁর অসাধারণত্ব।’

‘তাহলে তিনি মরেননি কখনো।’ সজোরে বললাম, ‘এ হতেই পারে না।’

‘তাও হতে পারে। কেউ কেউ বলছিল বটে, মরেননি। আবার কেউ কেউ বলছিল, মরেছেন। শবযাত্রীদের মতবিরোধ, মানে, বেশ দ্বিমত দেখা গেল।’

‘তাই বলুন!’ শুনে আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

‘তারা বলছিল, ওঁর আবার মৃত্যু কী? উনি তো অমর!’

‘তা বটে, আপনার লেখার নিয়ম কী? কীভাবে লেখেন?’

‘খুব আস্তে আস্তে। লিখতে আমার অনেক সময় লাগে। লিখি এবং ভাবি। ভাবি এবং লিখি। ভাবতেই বহুক্ষণ যায়। এক ঘণ্টায় এক লাইন লিখি। একদম কাটি না। আমার লেখা সব অকাট্য। দেখেছ আমার কতগুলো ফাউন্টেন পেন?’

‘আসামাত্রই দেখেছি। ও নিয়ে একটা প্রশ্নও করব এঁচে রেখেছি আমি।’

‘এইটে পার্কার, ওটা শেফার, এটা পেলিক্যান, ওটা হল গিয়ে ব্ল্যাকবার্ড, আর এটার নাম ওয়াটারম্যান, আর এই দুটো হল কনকলিন আর এফএন গুপ্ত। শেষেরটা এদেশি, কিন্তু প্রত্যেকটাই বেশ দামি।’

‘এতগুলো কলম কী কাজে লাগে?’

‘কেন, লিখতে? লেখার সময়ে প্রত্যেকটারই দরকার। কর্তাপদ আমি পার্কারে লিখি, আর ক্রিয়াপদ সব শেফারে; কর্মগুলো ব্ল্যাকবার্ডেই সারি। প্রিপজিশন ইত্যাদির সময় ওয়াটারম্যানের প্রয়োজন হয়। আর, কারও কাছ থেকে টাকার কোনো চেক পেলে তার পিছনে সই করবার কালে এই পেলিক্যানটা কাজে লাগাই।’

‘কেন, তখন পেলিক্যান কেন?’

‘তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে কিনা—এই টাকাটা পেলি ক্যান? কেন পেলে এই টাকা? আমার এইসব লেখার আবার দাম?’

‘তার মানে?’

‘তার মানে, আমার লেখা তো অমূল্য সব। তার কি কোনো মূল্য হয় নাকি?’

‘তা বটে।’

তারপর তিনি ফের কলমের কথায় আসেন—‘অনুস্বর, বিসর্গ এবং চন্দ্রবিন্দু কনকলিনে। কেবল জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ের চিহ্নের বেলায় ওই এফএন গুপ্ত। এইজন্যেই তো একটা সেনটেন্স লিখতে একঘণ্টা লেগে যায়। প্রাণ যায় আমার।’

‘ডেথ সেনটেন্স বলুন।’ আমি না বলে পারি না।

তিনি বলেই চলেন ‘এত কান্ড না করলে কি লেখা ভালো হয় কখনো? এমন সব দামি দামি কলমে লিখি বলেই আমার লেখার এত দাম। একটা জিনিসের অর্থ বুঝলে? কেবল জিজ্ঞাসা আর বিস্ময়ের চিহ্নের বেলাতেই কেন এফএন গুপ্ত ব্যবহার করি? তার মানে আছে। অর্থাৎ এদেশেও ফাউন্টেন পেন হয়! এইটেই বিস্ময়ের বিষয়। সত্যই হয় নাকি? এইখানেই প্রশ্ন। এই নিয়ে একখানা বইও আমি লিখে ফেলব ভেবে রেখেছি। বইয়ের নামও ঠিক করা আছে—কলমের গুপ্ত কথা। কেমন হবে নামটা?’

‘নামজাদা। বইয়ের এক কপি দেবেন আমায়, আমার কাগজে ভালো করে সমালোচনা করে দেব।’

‘সমালোচনা করতে পারো, আপত্তি নেই। করলে ভালো করেই কোরো। কিন্তু দাম দিয়ে কিনতে হবে, অমনি বই আমি কাউকে দিই না। আমার বউকেও নয়।’

‘তাহলে লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে পড়ে নেব। ভাববেন না আপনি। দু-দিন বাদে ফুটপাথেও পাওয়া যাবে। আচ্ছা, একটা কথা। চার খন্ডে রচিত আপনার বিখ্যাত গন্ধগোকুল বইটা কি আপনার নিজেরই জীবনচরিত?’

‘তা বলতে পারব না। গন্ধগোকুল? হ্যাঁ, বইটা লিখেছি বটে। আমিই লিখেছি। কিন্তু পড়া হয়নি আমার। পড়বার ফুরসত পাইনি এখনও। প্রুফ দেখবার সময় পড়ব ভেবেছিলাম। কিন্তু পাবলিশার ব্যাটা প্রুফ পাঠালই না। পাঠাতেই চায় না। বলে যে, আমি প্রুফ দেখলে নাকি বড্ড বেশি বানান ভুল হয়। কম্পোজিটররা নিজের বিদ্যায় অত আর শুধরে উঠতে পারে না। হিমশিম খেয়ে যায়।’

‘ও? এ সবই প্রতিভার লক্ষণ। যারা বানাতে জানে তারাই বানান জানে না। তা, আপনার ছেলেবেলার কথা কিছু মনে পড়ে? আপনার কি ভাইটাই ছিল আর?’

‘ভাই? হ্যাঁ, ছিল বটে একটা। একটাই ছিল। তুমিই মনে করিয়ে দিলে।’

‘যে আমাকে পথ দেখিয়ে আপনার কাছে নিয়ে এল সেই তো?’

‘সেতো বেয়ারা। বেয়ারাকে তুমি আমার ভাই বলছ? তুমি তো ভারি বেয়াড়া লোক হে।’

‘না না, সেকথা কি বলেছি।’ আমি সামলাবার চেষ্টা করি, ‘সেকথা বলব কেন!’

‘ছিল এক ভাই। তার নাম ভুতু—হ্যাঁ, যদ্দুর মনে পড়ে, ভুতুই তার নাম ছিল বোধ হচ্ছে। আহা, বেচারি ভুতু!’

‘বেচারি কেন? … সেকি মারা গেছে নাকি?’

‘মারা গেছে? তাই হবে। সঠিক আমি কিছু বলতে পারব না, সেএক রহস্যময় ব্যাপার।’

‘রহস্যময়? ভারি দুঃখের তো! নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে বুঝি?’

‘প্রায় নিরুদ্দেশই বটে। আমরা তাকে পুঁতে ফেলেছি।’

‘পুঁতে ফেলেছেন? কীরকম?’ চমকে যেতে হল। ‘মারা গেছে কি না, না জেনেই পুঁতে ফেলেছেন? তাজ্জব তো!’

‘মারা গেছে বই কী। যথেষ্টই মারা গেছে।’

‘মশাই মাপ করতে হবে।’ আমি সবিনয়ে বলি, ‘এবার সত্যিই আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ভুতুকে যদি আপনি গোরস্থই করে থাকেন তাহলে গোড়ায় সেমারা গেছল নিশ্চয়। এবং তা আপনার অজানা থাকবার কথা নয়।’

‘না না। ভুতুই যে মারা গেছে তা নিশ্চয় করে জানি না।’ তিনি ঘোরতর প্রতিবাদ করেন। —‘তবে আমাদের ধারণা যে সে-ই মরেছে।’

‘ধারণা? তবে কি সেআবার বেঁচে উঠেছিল?’

‘আমি বাজি ধরতে পারি—উঁহু’, তিনি জানান—‘কবরে যাবার পর কি আবার বেঁচে ওঠা সম্ভব? মাটিচাপা পড়ে গেল যে? অত মাটি ঠেলে উঠতেই পারবে না, বঁাচার কথা তো পরে। তবে হ্যাঁ, ভুতুর পক্ষে কিছুই তেমন অসম্ভব নয়। আর সেইখানেই আসল রহস্য।’

‘এমন অদ্ভুত কথা তো কখনো শুনিনি। একজন মারা গেল, তাকে পোড়ানো হল—(তিনি প্রতিবাদের ভঙ্গি করতেই) নাহয় পুঁতেই ফেললাম। যাক, চুকে গেল ল্যাঠা—এর ভেতর আবার রহস্য কোনখানে?’

‘এই যে বলছি’—তিনি নিজেই এবার প্রায় মড়ার মতোই, ফিসফিস শুরু করলেন— ‘ব্যাপারটা এইরকম। বুঝলে কিনা, আমরা ছিলাম যমজ—স্বর্গীয় ভুতু আর আমি—আমাদের মাত্র দু-মাস করে বয়স তখন, একদিন চান করবার সময় জলের গামলার মধ্যে আমাদের অদলবদল হয়ে যায়। এবং আমাদের মধ্যে একজন ডুবে মারা যায়, ওই গামলার গর্ভেই। কিন্তু কে যে মারা গেল ঠাওরই করতে পারা গেল না। আমরা ঠিক ধরতে পারিনি। কেউ কেউ ভাবল ভুতুই। কেউ কেউ ভাবল আমিই।’

‘হ্যাঁ, এটা একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বটে। এবং বেশ চাঞ্চল্যকর।’ আমি চটপট টুকে নিতে লাগলাম। —‘কিন্তু আপনার নিজের কী মনে হয়?’

‘কী করে বলব। খোদা-ই জানেন কেবল। যদি কেউ আমাকে তা বলে দিতে পারে, গোটা পৃথিবীটাই—আমার বাড়ি বাদ দিয়ে, তাকে আমি দিয়ে দিতে পারি। এই নিদারুণ রহস্য আমার সারা জীবন জুড়ে অন্ধকার ছায়া বিস্তার করেছে, কিন্তু একটা গুপ্ত কথা তোমাকে আমি বলছি। এর আগে কাউকে তা বলিনি। আমাদের দু-ভায়ের মধ্যে একজনের অদ্ভুত একটা চিহ্ন ছিল— বঁা-হাতের পিছনে এক জড়ুল। সেই হচ্ছে ভুতু, সেই ছেলেটি যে জলে ডুবে মারা গেছে।’

‘আমি তো এর মধ্যে কোনো রহস্য দেখছি না।’

‘দেখছ না, তবে এই দ্যাখো।’ বলে তিনি বঁা-হাতের পেছনের জড়ুলটা দেখালেন। সামনে ভুতু (কিংবা ভূত) দেখার মতোই আমি চমকে উঠলাম।

‘ভেবে দেখতে গেলে আশ্চর্য নয় কি?’ তিনি বললেন—‘লোকগুলো কি এতই উজবুক ছিল যে ভুল করে কাকে পুঁততে কাকে পুঁতে ফেলল? অদ্ভুত। যাক, একথা আর কাউকে বোলো না যেন। ঘুণাক্ষরেও নয়। কাগজেও প্রকাশ কোরো না। সামনেই, পঁচিশ বছর বয়সে আমার তাম্রজয়ন্তী আসছে কিনা। তারা যদি টের পায় যে আমি আর বেঁচে নেই, কচি বয়সেই মারা পড়েছি তাহলে কি আর—’

‘না না। তা কি প্রকাশ করি—আপনি যখন এত করে বলছেন। এটা বাদ দিয়েও ছাপাবার খোরাক যথেষ্টই পেয়েছি। কুড়িটা টাকা নিতান্ত জলে যায়নি। কিন্তু একটা আমার খটকা লেগেছে খুব। আপনারা তো হিন্দু; তাহলে না পুড়িয়ে পুঁততে গেল কেন আপনাকে?’

‘আহা তাও জান না—সম্পাদকি করছ। অতি শৈশবে মারা গেলে পুঁতে ফেলাই বিধি যে, যেমন সাপের কামড়ে মলে নিয়ম, জলে ভাসিয়ে দেয়া।’ ব্যাপারটা তিনি জলের মতোই পরিষ্কার করে দিলেন।

‘এইবার বুঝলাম। এবার বঙ্কিমবাবুর সম্বন্ধে আর একটি প্রশ্ন করব কেবল। আমি নিজেও বঙ্কিমবাবুর একজন ভক্ত কিনা। প্রায় সব বই-ই পড়েছি তাঁর। তাঁর শবযাত্রার ব্যাপারটা আমার ভারি চমৎকার লেগেছে। এর মধ্যে তাঁর বঙ্কিমদৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। আচ্ছা, বঙ্কিমবাবুকে আপনি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বলে কেন মনে করেন? এমন কী বৈশিষ্ট্য আপনি দেখেছেন তাঁর?’

‘এমন বিশেষ কিছু নয়। একশো জনের মধ্যে একজনও সেটা লক্ষ করেছে কিনা সন্দেহ। বঙ্কিমবাবুকে নিয়ে যখন ঘাটের কাছে গিয়ে নামানো হল, চিতাও সাজানো হয়েছে। এমন সময়ে তিনি খাটের উপরে উঠে বসলেন, বললেন, ‘‘আমি ঠিক মরিনি। আমি মরলে কত লোক জোটে, কত বড়ো প্রসেশন হয়, খবরের কাগজের স্পেশাল এডিশন বেরোয় কিনা, সভাটভা করে কিনা কেউ—এইসব দেখবার জন্যেই আমি মরেছিলাম।’’ এই কথা বলে বঙ্কিমবাবু—এর মধ্যেও তুমি তাঁর বঙ্কিমদৃষ্টির পরিচয় পাবে—একটা হকারের কাছ থেকে অমৃত বাজারের স্পেশাল এডিশন একখানা এক পয়সায় কিনে একটা ছ্যাকরা গাড়ি ডেকে তাতে গটগট করে চাপলেন। ‘আমার সম্বন্ধে কাগজে কী লিখেছে দেখতে হবে।’ এই কথা বলে তিনি চলে গেলেন। এটা কি খুব উল্লেখযোগ্য নয়? অসাধারণত্বের পরিচায়ক নয় কি এটা?’

আমি সর্বান্তঃকরণে সায় দিয়ে বিদায় নিলাম। রাস্তায় নেমেছি—কি নামিনি, তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন ‘ওহে ও। ভুলে যাচ্ছ যে বড়ো? আমার ফটো? ফটো নেবে না? এই নাও, এটাও তোমার ওই ইনটারের মাথায় ছেপে দিয়ো। আমার বাণীর সঙ্গে আমার ফটো না থাকলে কি মানায়? সম্পাদক হয়েছ, ঘটে বুদ্ধি নেইকো মোটে?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *