একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা

একটি স্বর্ণঘটিত দুর্ঘটনা

বিশ্বেশ্বরবাবু সবেমাত্র সকালে কাগজ খুলে বিশ্বের ব্যাপারে মনযোগ দেবার চেষ্টা পাচ্ছেন, এমন সময়ে বিশ্বেশ্বর-গৃহিণী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। ‘ওগো সর্বনাশ হয়েছে—!’

বিশ্বজগৎ থেকে তার বিনীত দৃষ্টিকে অপসারিত করেন বিশ্বেশ্বরবাবু। চোখ তুলে তাকান গৃহিণীর দিকে।

‘ওগো আমার কী সর্বনাশ হল গো। আমি কী করব গো—!’

বিশ্বেশ্বরবাবুকে বিচলিত হতে হয়। ‘কী—হয়েছে কী?’

‘চুরি গেছে। আমার সমস্ত গয়না। একখানাও রাখেনি গো’—

বিশ্বেশ্বরবাবুর বিশ্বাস হয় না প্রথমে। ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করেন তিনি। অবশেষে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন—‘ও! গয়না চুরি! তাই বলো! আমি ভেবেছি না-জানি কী!’ বিশ্বেশ্বরবাবু যোগ করেন। তাঁর অ্যানাটমিতে ব্যস্ততার চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।

‘আমার অত গয়না! একখানাও রাখেনি গো!’

‘একখানাও রাখেনি নাকি?’ বিশ্বেশ্বরবাবুর বঁাকা ঠোঁটে ঈষৎ হাসির আভাস যেন উঁকি মারে। ‘তা হলে ভাবনার কথা তো।’

বিশ্বেশ্বরবাবুর ভাবভঙ্গি গৃহিণীকে অবাক করে, কিন্তু অবাক হয়ে থাকলে শোক প্রকাশের এমন সুযোগ হারাতে হয়। এহেন মাহেন্দ্র যোগ জীবনে ক-টা আসে? ‘ভাবনার কথা কী গো! আমার যে ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কে আমাদের এমন সর্বনাশ করে গেল গো’— তারস্বর ছাড়তে উদ্যত হন তিনি।

‘যাক, যেতে দাও। যা গেছে তার জন্য আর দুঃখু করে কী হবে?’—হাসিমুখেই বলেন বিশ্বেশ্বরবাবু—‘গতস্য শোচনা নাস্তি বুদ্ধিমানের কার্য।’

এহেন বিপর্যয়ের মধ্যেও হাসতে পারছেন বিশ্বেশ্বরবাবু? সর্বস্বান্ত হয়ে দুঃখের ধাক্কায় তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেল না তো? না, গিন্নিকে সান্ত্বনা দিতেই তাঁর এই হাসিখুশির ভান? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না, না পেরে আরও তিনি বিগড়ে যান—‘তুমি বলছ কী গো! হায় হায়, আমার কী সর্বনাশ হল গো!’ বাজখাঁই গলা বার করেন গৃহিণী।

‘আরে থামো থামো, করছ কী।’ এবার বিশ্বেশ্বরবাবু সত্যিই বিচলিত হন—‘চেপে যাও, পাড়ার লোক জানতে পারবে যে!’

‘বয়েই গেল আমার!’—গিন্নি খাপ্পা হয়ে ওঠেন—‘আমার এত টাকার গয়না গেল আর পাড়ার লোক জানতে পারবে না। কোনোদিন গা সাজিয়ে পরতে পেলুম না, দেখাতেও পেলুম না হিংসুটেদের। জানুক-না মুখপোড়ারা—মুখপুড়িরা।’

‘উঁহুঁহুঁ, তুমি বুঝছ না গিন্নি!’—বিশ্বেশ্বরবাবু মুখখানা প্যাঁচার মতো করে আনেন—‘চুরির খবর পেলে পুলিশ এসে পড়বে যে!’

‘পুলিশ?’ পুলিশের কথায় গিন্নির ভয় হয়।

‘আর পুলিশ এলেই বাড়িঘর সব খানাতল্লাশি হবে! আষাঢ়ের ঘন মেঘে বিশ্বেশ্বরবাবুর হাঁড়ি-পানা মুখ ভারী হয়ে আসে। ‘সেএক হাঙ্গামা।’

এবার ভড়কে যান গিন্নি।—‘কেন, চুরি গেলেই পুলিশে খবর দেয় এই তো জানি। চোরেই তো পুলিশের কিনারা করে।’ পরমুহূর্তেই ভুল শুধরে নেন—‘উঁহুঁ! পুলিশেই তো চুরির কিনারা করে, চোরকেও পাকড়ায়!’

‘সেহাতেনাতে ধরতে পারলেই পাকড়ায়’—বিশ্বেশ্বর গোঁফে মোচড় দেন, ‘তা না হলে আর পাকড়াতে হয় না।’

‘হ্যাঁ হয় না;’—গিন্নি মাথা নাড়েন, ‘তুমি বললেই আর কী?’

‘তা তেমন পীড়াপীড়ি করলে নিয়ে যায় পাকড়ে। একটাকে নিয়ে গেলেই হল! এখানে চোরকে হাতে না পেয়ে আমাকেই ধরে কি না কে জানে!’

‘তোমাকে কেন ধরতে যাবে?’ গিন্নির বিস্ময় হয়।

‘সব পারে ওরা। হাঁস আর পুলিশ, ওদের পারতে কতক্ষণ?’ বিশ্বেশ্বরবাবু বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘তবে তফাত এই, হাঁস পাড়ে হাঁসের ডিম। আর ওরা পারে ঘোড়ার ডিম। ঘোড়ার ডিমের আবার মামলেটও হয় না, একেবারে অখাদ্য।’ তাঁর মুখ বিকৃত হয়।

‘তোমাকে কক্ষনো ধরবে না।’—গিন্নি সজোরে বলেন।

‘না ধরবে না আবার। আমাকেই তো ধরবে।’ বিশ্বেশ্বরবাবুর দৃঢ়বিশ্বাসের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় হয় না। ‘আর ধরলেই আমি স্বীকার করে ফেলব। তা বলে রাখছি কিন্তু। করাবেই ওরা আমাকে স্বীকার। স্বীকার করানোই হল ওদের কাজ, তাহলেই ওদের চুরির কিনারা হয়ে গেল কিনা।’

‘চুরি না করেও তুমি স্বীকার করবে চুরি করেছ?’

‘করবই তো! পড়ে পড়ে মার খেতে যাব নাকি? সকলেই স্বীকার করে। করাটাই দস্তুর। আর নাও যদি মারে, হাজত বলে এমন একটা বিশ্রী জায়গায় আটকে রাখে শুনেছি, সেখানে ভারি আরশোলা আর নেংটি ইঁদুর। আরশোলা আমার দু-চক্ষের বিষ, আর নেংটি ইঁদুর? বাবা:, সেবাঘের চেয়েও ভয়ানক! অমন অবস্থায় পড়লে সকলকেই স্বীকার করতে হয়।’

‘যদি তেমন দেখ না হয় স্বীকার করেই ফ্যাল। তাহলেই ছেড়ে দেবে তো?’

‘হ্যাঁ; দেবে। একেবারে জেলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে।’

‘তবে কাজ নেই তোমার স্বীকার করে।’—গিন্নি এবার শান্ত হন, ‘গয়না আমি চাই না।’

‘হ্যাঁ, সেই কথাই বলো! আমি বেঁচে থাকতে তোমার ভাবনা কী? আবার গয়না গড়িয়ে দেব নাহয়।’

‘হ্যাঁ, দিয়েছ! সে-বার বালিগঞ্জের জমিটা বিক্রি করেই তো হল।’

‘এবার না হয় টালিগঞ্জের বাড়িটাই বেচে ফেলব।’

এতক্ষণে গিন্নির মুখে হাসি দেখা দেয়—‘জমিটা বেচে পাঁচ হাজার টাকার গয়না হয়েছিল। পুরানো বাড়ির আর কত দাম হবে?’

‘যতই কম হোক, বিশ হাজারের কম তো না। আমি ব্যাঙ্কে টাকা জমানোর চেয়ে গয়না গড়িয়ে রাখতেই বেশি ভালোবাসি। তুমি তো জান! মাটিতে পুঁতে রাখার চেয়েও ভালো।’—একটু দম নেন।—‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। জলে ফেলে দেওয়ার চেয়েও।’

‘কিন্তু এত টাকার গয়না! পুলিশে খবর না দাও, নিজে থেকেও একটু খোঁজ করলে হত না! হয়তো পাওয়া যেত একটু চেষ্টা করলে।’

‘হ্যাঁ; ও আবার পাওয়া যায়। যা যায় তা আর ফেরে না। ও আমি অনেক বার দেখেছি। কেবল খোঁজাখুঁজিই সার হবে!’ বিশ্বেশ্বরবাবু বুড়ো আঙুল নাড়েন।

‘তবু’—গিন্নির তথাপি খুঁতখুঁতুনি যায় না।

‘খুঁজব কী, কে যে নিতে পারে তা তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না।’ বিশ্বেশ্বরবাবু কপাল কোঁচকান, ‘কার যে এই কাজ?’

‘কার আবার! কার্তিকের! তা বুঝতেও তোমার এত দেরি হচ্ছে? যে চাকর টেরি কাটে, সেচোর না হয়ে যায় না।’

‘কার্তিক? এতদিন থেকে আছে, অমন বিশ্বাসী? সেচুরি করবে? তা কি হয় কখনো?’

‘সেকরবে না তো কি আমি করেছি?’ গিন্নি এবার খেপে যান।

‘তুমি?’—বিশ্বেশ্বরবাবু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকান—‘তোমার নিজের জিনিস নিজে চুরি করবে? আমার বিশ্বাস হয় না।’—

‘তাহলে কি তুমি করেছ?’

‘আমি? অসম্ভব।’ বিশ্বেশ্বরবাবু প্রবলভাবে ঘাড় নাড়েন।

‘তুমি করনি, আমিও করিনি, কার্তিকও করেনি—তাহলে কে করতে গেল? বাড়িতে তো এই তিনটি প্রাণী!’ গৃহিণী অন্তরের বিরক্তি প্রকাশ করেই ফেলেন।

‘তাই তো ভাবনার বিষয়।’ বিশ্বেশ্বরবাবু মাথা ঘামাবার প্রয়াস পান,—‘এইখানেই গুরুতর রহস্য!’ গোয়েন্দার মতো গোলমেলে হয়ে ওঠে তাঁর মুখ।

‘তোমার রহস্য নিয়ে তুমি থাকো, আমি চললুম। গয়না গেছে বলে পেট তো মানবে না,’ চলে যেতে যেতে বলে যান গিন্নি, ‘তুমি টালিগঞ্জের বাড়িটার বিহিত করো এদিকে, তা ছাড়া আর কী হবে তোমাকে দিয়ে! গয়নার কী গতি করতে পারি, আমি নিজেই দেখছি।’

‘কার্তিককে কিছু বোলো না যেন। প্রমাণ নেই, বৃথা সন্দেহ করলে বেচারা আঘাত পাবে মনে।’—কর্তা উদবেগ প্রকাশ করেন।

‘কী করতে হয় না-হয় সেআমি বুঝব।’

‘আর পাড়ায় কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়’ বিশ্বেশ্বরবাবু ঈষৎ ব্যস্তই হন,—‘চুরি যাওয়া একটা কেলেঙ্কারিই তো?’

‘অত টাকার গয়না, একদিন গা সাজিয়ে পরতেও পেলুম না। তোমার জন্যেই তো। কেবলই বলেছ, গয়না কি পরবার জন্যে। ও-সব বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! এখন হল তো, সব নিয়ে গেল চোরে?’ গিন্নির কেবল কাঁদতে বাকি থাকে।

‘সেতো তোমার ভালোর জন্যেই বলেছি। পাড়ার লোকের চোখ টাটাবে। তোমায় হিংসে করবে—সেটা কি ভালো?’

‘বেশ, তবে এবার ওদের কান টাটাক। আমি গলা ফাটিয়ে ডাক ছেড়ে বলব যে, আমার এত টাকার গয়না ছিল। বলবই তো!’

‘উঁহুঁহুঁ। তাহলেই পুলিশে জানবে। চুরির কিনারা হবে, ভারি হাঙ্গামা। ও নিয়ে উচ্চবাচ্যও কোরো না। আমি আজ বিকেলেই বরং টালিগঞ্জে যাচ্ছি।’

গিন্নি চলে গেলে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়েন বিশ্বেশ্বরবাবু। নিজের গৃহের সমস্যা থেকে একেবারে স্পেনের গৃহ সমস্যায়। বিশ্ব ব্যাপারে ওতপ্রোত হয়ে কতক্ষণ কাটে বলা যায় না, হঠাৎ সদর দরজায় প্রবল কড়া নাড়া ওঁকে সচকিত করে। নীচে নেমে যেতেই পাড়ার সবাই ওঁকে ছেঁকে ধরে।

‘কোথায় গেল সেই বদমাইশটা?’ তাঁকেই জিজ্ঞাসা করে সবাই।

‘কে গেল কোথায়?’ বিশ্বেশ্বরবাবু বিচলিতই হন।

‘সেই গুণধর আপনার চাকর? কার্তিক? চুরি করে পালিয়েছে বুঝি?’

‘পালিয়েছে? কই তা তো জানি না! কার চুরি করল আবার?’

‘আপনাকেই তো পথে বসিয়ে গেছে আর আপনিই জানেন না? আশ্চর্য!’

‘আমাকে? পথে বসিয়ে?’ বিশ্বেশ্বরবাবু আরও আশ্চর্য হন, ‘আমি তো এতক্ষণ ওপরেই বসেছিলাম।’

‘দেখুন বিশ্বেশ্বরবাবু, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবেন না। আপনার ও-চাকরটি কম নয়। আমরা তখন থেকেই জানি। যে চাকর টেরি কাটে, সেচোর ছাড়া আর কী হবে? আমরা সবই জানতে পেরেছি, আপনার গিন্নির থেকে আমাদের গিন্নি, আমাদের গিন্নিদের থেকে আমরা।’

‘হ্যাঁ, কিছুই জানতে বাকি নেই।’ জনতার ভেতর থেকে একজন বেশি উৎসাহ দেখায়—‘এখন কোথায় গেল সেই হতভাগা! পিটিয়ে লাশ করব তাকে। সেইজন্যই আমরা এসেছি।’

‘দেখুন, সমস্তই যখন জেনেছেন তখন আর লুকোতে চাই না।’—বিশ্বেশ্বরবাবু বলেন,—‘কিন্তু একটা কথা। মেরে কী লাভ হবে? মারলে অন্য অনেক কিছু বেরুতে পারে, কিন্তু গয়না কি বেরোবে?’

‘আলবত বেরোবে।’—তাদের মধ্যে দারুণ মতের ঐক্য দেখা যায়, ‘বার করে তবে ছাড়ব। বেরোতেই হবে।’

বিশ্বেশ্বরবাবু দেখেন, এরা সব বাল্যকাল থেকে এখন পর্যন্ত এ যাবৎকাল বাবার কাছে, মাস্টারের কাছে, স্কুলে আর পাঠশালায়, খেলার মাঠে আর সিনেমা দেখতে গিয়ে সার্জেন্টের আর গুণ্ডার হাতে যেসব ঠ্যাঙানো, ঠোক্কর আর গুঁতো খেয়ে এসেছে আজ সুদে-আসলে নিতান্তই ধরা পড়ে যাওয়া কার্তিককেই তার সমস্ত শোধ দেবার জন্য বদ্ধপরিকর। বেওয়ারিশ মাথায় চাঁদা করে চাঁটাবার এমন অর্ধোদয়যোগ সহজে এরা হাতছাড়া করবে না। তবু তিনি একবার শেষ চেষ্টা করেন—‘একটা কথা ভাবার আছে। শাস্ত্রে বলে ক্ষমা হি পরমো ধর্মঃ। মার্জনা করে দেওয়াই কি ভালো নয় ওকে?’

‘আপনার চুরি গেছে আপনি ক্ষমা করতে পারেন। আপনার চাকর আপনি তো মার্জনা করবেনই। কিন্তু আমরা পাড়ার পাঁচজন তা করতে পারি না।’

‘কী মুশকিল, কী মুশকিল! তাহলে এক কাজ করুন আপনারা। অর্ধেক লোক যান হাওড়ায়, অর্ধেক শেয়ালদায়। এই দুটো পথের একটা পথেই সেউধাও হয়েছে এতক্ষণ।’

পাড়ার লোকেরা হতাশ হয়ে চলে যায়। পলায়মান চোরের পশ্চাদ্ধাবনের উৎসাহ প্রায় কারোরই হয় না। বিশ্বেশ্বরবাবু আবার কাগজের মধ্যে ফিরে আসেন। এমনই সময়ে টেরি-সমন্বিত কার্তিকের আবির্ভাব।

‘কী রে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?’—বিশ্বেশ্বরবাবু খবরের কাগজ থেকে চোখ তোলেন। ‘সকাল থেকে তো দেখতে পাইনি।’ ওঁর কন্ঠে সহানুভূতির সুর।

‘আত্মীয়র বাড়ি গেছলাম’—আমতা আমতা করে কার্তিক। কিন্তু একটু পরেই ফোঁস করে ওঠে—‘গেছলাম এক স্যাকরার দোকানে।’

বিশ্বেশ্বরবাবু যেন ঘাবড়ে যান—‘আহা, কোথায় গেছলি আমি জানতে চেয়েছি কি! যাবি বইকী, একটু বেড়াতে-টেড়াতে না গেলে হয়। বয়স হয়ে আর পেরে উঠি না তাই, নইলে আমিও এককালে প্রাতভ্রমণ করতাম! রেগুলারলি।’

‘গিন্নিমা আমার নামে যা-নয়-তাই বদনাম দিয়েছেন। পাড়ায় কান পাতা যাচ্ছে না—’ চাপা রাগে ফেটে পড়তে চায় কার্তিক।

বাধা দেন বিশ্বেশ্বরবাবু—‘ওর কথা আবার ধরে নাকি! মাথার ঠিক নেই ওর। তুই কিছু মনে করিসনে বাপু।’

‘আমি কিনা—আমি কিনা—!’ কার্তিক ফুলে ফুলে ওঠে। অকথ্য উচ্চারণ ওর মুখ দিয়ে বেরোতে চায় না।

‘আহা, কে বলেছে!’—বিশ্বেশ্বরবাবু সান্ত্বনা দেন, ‘আমি কি বলেছি সেকথা? বলিনি তো? তা হলেই হল।’

‘পাড়ার পাঁচজনে নাকি আমায় পুলিশে দেবে। দিক-না—দিয়েই দেখুক-না মজাটা।’

‘হ্যাঁ, পুলিশে দেবে! দিলেই হল!’—বিশ্বেশ্বরবাবু সাহস দেন—‘হ্যাঁ, দিলেই হল পুলিশে। কেন মিছে ভয় খাস বল তো। ওরা পুলিশে দেবার কে? আমি আছি কীজন্যে?’

‘ভয় যার খাবার সেই খাবে। আমি কেন ভয় খেতে যাব? কোনো দোষে দুষী নই আর আমারই যত বদনাম। আসুক-না একবার পুলিশ। আমি নিজেই নাহয় যাচ্ছি থানায়।’

বিশ্বেশ্বরবাবু বেজায় দমে যান এবার—‘আরে, তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? কোথায় পুলিশ, কে কাকে দিচ্ছে তার ঠিক নেই, হাওয়ার সঙ্গে লড়াই।’ একটু থেমে ট্যাঁক থেকে একটা টাকা বের করেন—‘বদনাম দিয়েছে তার হয়েছে কী? গায়ে কি লেগে রয়েছে? এই নে, বকশিস নে—কিছু খা গিয়ে।’

ঝনাৎ হতেই তৎক্ষণাৎ তুলে নেয় কার্তিক। একটু ঠাণ্ডা হয় এতক্ষণে।

‘কিন্তু একটা কথা বলি বাপু। যদি কিছু নিয়েই থাকিস, এখান থেকে সরিয়ে ফ্যাল। একখানাও রাখিসনি যেন এখানে। পাড়ার লোক যদি খবর দেয়, পুলিশ যদি এসেই পড়ে, খানাতল্লাশি হতে কতক্ষণ?’ সদুপদেশ দিতে যান বিশ্বেশ্বরবাবু!

‘কী নিয়েছি, নিয়েছি কী?’ কার্তিক খেপে ওঠে।

‘আমি কি বলেছি কিছু নিয়েছিস? কিছু নিসনি। তবু যদি কিছু নিয়ে থাকিস বলে তোর সন্দেহ হয়।…আচ্ছা, এক কাজ কর-না কেন, কার্তিক? আমি তোকে গাড়িভাড়া এবং আরও কিছু টাকা দিচ্ছি, এখান থেকে পালিয়ে যা-না কেন?’

‘কেন পালাব? আমি কি চুরি করেছি? তবে পালাব কেন?’ কার্তিক দপদপ করে জ্বলতে থাকে।

‘আহা, আমি কি পালাতে বলেছি? বলছি, দিন কতক কোথাও বেড়াতে যা-না? এই হাওয়া খেতে, কি চেঞ্জে কোথাও—শিলং কি দার্জিলিং, পুরী কিংবা ওয়ালটেয়ারে? লোকে কি যায় না? চুরি না করলে কি যেতে নেই? দেশেও তো যাসনি অনেক দিন! আমি বলি কী—’

কিন্তু তাঁর বলাবলির মধ্যে বাধা পড়ে। ‘বিশ্বেশ্বরবাবু বাড়ি আছেন?’ বলতে বলতে কতকগুলি ভারী পায়ের শব্দ ক্রমশ উপরে উঠতে থাকে, সটান তাঁর ঘরের মধ্যে এসে থামে। জন কতক পাহারাওয়ালা নিয়ে স্বয়ং দারোগাবাবুকে দেখা যায়।

‘আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ। আপনি নাকি বাড়িতে চোর পুষেছেন?’

বিশ্বেশ্বরবাবু আকাশ থেকে পড়েন, ‘এসব মিথ্যে কথা কে লাগাচ্ছে বলুন তো? কার খেয়েদেয়ে কাজ নেই? ঘরবাড়ি কি চোর পুষবার জন্যে হয়েছে? কেউ শুনেছে কখনো এমন কথা?’

‘আপনার কি গয়নার বাক্স চুরি যায়নি আজ?’—দারোগা জিজ্ঞাসা করেন।

বিশ্বেশ্বরবাবু ভারি মুষড়ে যান। চুপ করে থাকেন। কী আর বলবেন তিনি?

‘চুরির খবর থানায় রিপোর্ট করেননি কেন তবে?’—দারোগাবাবু হুমকি দেন।

‘গিন্নি বলছিলেন বটে চুরি গেছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি।’ কার্তিকের দিকে ফেরেন এবার—‘এই, তুই এখানে কী করছিস? দাঁড়িয়ে কেন? বাড়ির ভেতরে যা। কাজকর্ম নেই?’

‘এই বুঝি আপনার সেই চাকর? কী রে ব্যাটা, তুই কিছু জানিস চুরির?’

‘জানি বই কী হুজুর, সবই জানি। চুরি গেছে তাও জানি; কী চুরি গেছে তাও জানি—’ কার্তিক বলতে থাকে।

বিশ্বেশ্বরবাবু বাধা দেন—‘দারোগাবাবু, একে ছেলেমানুষ তার ওপর ওর মাথাখারাপ। চাকর হয়ে টেরি কাটে, দেখছেন না? কী বলতে কী বলে ফেলবে, ওর কথায় কান দেবেন না। বহুদিন থেকে আছে, ভারি বিশ্বাসী, ওর ওপর সন্দেহ হয় না আমার।’

‘বহুদিনের বিশ্বস্ততা একদিনেই উপে যায়, লোভ এমনই জিনিস মশাই!’—দারোগাবাবু, বলেন, ‘আকচারই দেখছি এরকম।’ কার্তিকের প্রতি জেরা চলে—‘এ চুরি—কার কাজ বলে তোর মনে হয়?’

‘আর কারও কাজ নয় হুজুর, আমারই কাজ।’

‘কেন করতে গেলি এ কাজ?’

‘ওইতো আপনিই বলে দিয়েছেন হুজুর! লোভের বশে।’ কার্তিক প্রকাশ করে, ‘তা শিক্ষাও আমার হয়েছে তেমনি। সবই বলব আমি, কিছুই লুকব না হুজুরের কাছে।’

‘যা যা:! আর তোকে সব বলতে হবে না!’—বিশ্বেশ্বরবাবু দুজনের মাঝে পড়েন, ‘ভারি বক্তা হয়েছেন আমার! অমন করলে খালাস করাই শক্ত হবে তোকে। দারোগাবাবু, ওর কোনো কথায় কান দেবেন না আপনি।’

দারোদাবাবু বিশ্বেশ্বরের কথায় কান দেন না—‘কোথায় সেসব গয়না?’ কার্তিককেই জিজ্ঞাসা করেন।

‘কোথায় আবার?’ আমারই বিছানার তলায়!’ বিরক্তির সঙ্গে বিস্তারিত করে কার্তিক।

ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে নাড়াচাড়া শুরু করতেই কার্তিকের লাখ টাকার স্বপ্ন বেরিয়ে পড়ে। নেকলেস, ব্রেসলেট, টায়রা, হার, বালা, তাগা, চুড়ি, অনন্ত—সব কিছুরই অন্ত মেলে। দড়ি দিয়ে বঁাধা হয় কার্তিককে। সেকিন্তু বেপরোয়া। এবার বিশ্বেশ্বরবাবু নিজেই ওকালতি শুরু করেন ওর তরফে—‘দেখুন দারোগাবাবু! নেহাত ছেলেমানুষ, লোভের বশে একটা অন্যায় করেই ফেলেছে। ছেলেবেলা থেকে আছে, প্রায় ছেলের মতোই, আমার কোনো রাগ হয় না ওর ওপর। এই ওর প্রথম অপরাধ, প্রথম যৌবনে—এবারটা ওকে রেহাই দিন আপনি। সুযোগ পেলে শুধরে যাবে, সকলেই অমন শুধরে যায়। যে অভিজ্ঞতা আজ ওর লাভ হল তাই ওর পক্ষে যথেষ্ট। অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ বড়ো হয় জীবনে। এই থেকে ও কর্পোরেশনের কাউন্সিলার, কলকাতার মেয়রও হতে পারে একদিন—হবে না যে তা কে বলবে? আর যদি নিতান্তই রেহাই না দেবেন, তবে দিন ওকে গুরুতর শাস্তি। আমি তাই চাই আপনার কাছে। চুরির চেয়েও গুরুতর। ও কি চোর? ও চোরের অধম। ও একটা গুণ্ডা! দেখছেন না কীরকম টেরি? ওকে আপনাদের গুণ্ডা অ্যাক্টে একসটার্ন করে দিন—ঘাড় ধরে বার করে দিন এ দেশ থেকে। যাবজ্জীবন নির্বাসন। আমি ওকে এক বছরের বেতন আর গাড়িভাড়া আগাম গুনে দিচ্ছি, ও এক্ষুনি কেটে পড়ুক, ছাপরা কি আরা জেলায়—যেখানে খুশি চলে যাক। গয়না তো সব পাওয়া গেছে, কেবল সাধু হবার, নতুন করে জীবন আরম্ভ করবার একটা সুযোগ দিন ওকে আপনি।’

বিশ্বেশ্বরবাবুর বক্তৃতায় দারোগার মন টলে! কেবল বক্তৃতাই নয়, সেইসঙ্গে বক্তার দুই নয়নের দর বিগলিত ধারায় দারোগাবাবু বিমুগ্ধ, ব্যথিত, ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তিনি শিকার ফেলে চিত্তবিকার নিয়ে চলে যান।

পুলিশের কবল থেকে অব্যাহতি পেয়েও একটুও কাহিল হয় না কার্তিক। তার সঙ্গে যেন ভয়ানক অভদ্রতা করা হয়েছে, ভয়ানকরকম ঠকানো হয়েছে তাকে, এহেন ধারণার বশে একটা জিঘাংসার ভাব তার প্রত্যেকটি আচরণ-বিচরণ থেকে প্রকাশ পেতে থাকে।

অবশেষে চিরবিদায়ের আগের মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে। কর্তা অনেক আদর-আপ্যায়নে, অযথা বাক্য বিস্তারে, অযাচিত বখশিসের প্রাচুর্য দিয়ে ওর যাবজ্জীবন নির্বাসনের দুঃখ ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করেন কিন্তু ও কি ভোলে? ওর ব্যথা কি ভোলবার? ওই জানে!

‘তোমার আদরেই তো সর্বনাশ হয়েছে ওর! মানুষ এমন নেমকহারাম হয়!’ গিন্নি নিজের অসন্তোষ চাপতে পারেন না—‘যথেষ্ট মাথা খেয়েছ, আর কেন? বরং, দড়ি-কলশি কিনে ডুবে মরতে বলো ওকে!’

নিভে যাবার আগে শেষ বারের মতন উসকে ওঠে কার্তিক। ‘দড়ির ভাবনা নেই, কর্তার পুজোয় দেওয়া ছেঁড়া সিল্কের জামাটা পাকিয়েই দড়ি বানিয়ে নেব, কিন্তু কলশি আর হল কোথায়? বড়ো দেখেই কলশি গড়াতেই চেয়েছিলাম মা-ঠাকরুন, কিন্তু গড়তে আর দিলেন কই? হ্যাঁ, বেশ ভালো একটা পেতলের কলশি হত—’ বলে একটু থেমে সেউপসংহার করে—‘আপনার গয়নাগুলি গালিয়েই!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *