ইতর বিশেষ

ইতর বিশেষ

সবে কাগজ কলম নিয়ে গল্প ফেঁদে বসেছি, এমন সময়ে এক হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক, বিলকুল অচেনা, তাঁর মতোই তুল্যাকারের এক বর্মা চুরুট হাতে ধরে প্রবেশ করে আমার টেবিলের সামনের চেয়ারে জাঁকিয়ে বসলেন।

চিরকালেই আমি এহেন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখছি—গল্প লেখার সময়টিতেই কেউ না কেউ কোথাও কিছু না পেয়ে গল্প করার জন্যে জোটেন। ইনিও কোনো নোটিশ না দিয়ে দুম করে এসে পড়লেন আচমকা। তেমনি অবশ্যি গল্প করার কালেও অনেকসময় গল্প লেখার রসদ জুটে যায়, গল্পের মালমশলা পেয়ে যাই আমি। তাতেই ক্ষতিটা পুষিয়ে যায় নিশ্চয়ই। তাই আমি তেমন কিছু মনে করি না।

‘ডাক্তারবাবু, বলুন তো আমার এ অসুখটা কি সারবার?’ শুধোলেন সেই ভদ্রলোক বসেই না। সারবার কথায় একটু সাড় হল আমার। এবং একটু উৎসাহও হল কইতে কী!

চিরকাল ধরেই আমার ধারণা, লেখার চেয়ে চিকিৎসাটাই আমি ভালো করে জানি, আর এতাবৎ নিজেকে বাদ না দিয়ে আপনাদের সকলের সর্ববিধ ব্যারামের দাবাই আমি বাতলে আসছি। এবং সুবিধে পেলেই, সুযোগ যদি পাই চিকিৎসাটাই আমি করতে চাই। আমার সেই অন্তর্নিহিত ইচ্ছাই কি এই বাঞ্ছাপূরণের রূপ ধরে আমার সামনে আবির্ভূত হলেন অকস্মাৎ?

‘কেন সারবে না? কী অসুখটা আপনার বলুন দেখি?’

‘অসুখটা যে কী তাইতো জানতে এলাম আপনার কাছে। আপনিই তো সেটা বলবেন। সবসময় অসুখ অসুখ বোধ করি। কিন্তু আমার ইতরবিশেষটা যে কী তা ঠিক ঠাওর করতে পারি না।’ তিনি জানালেন আমাকে।

তাবৎ ইতরবিশেষ সমেত তাঁকে আমি পর্যবেক্ষণ করলাম।—‘আপনার প্রথম ব্যারাম যা আমি দেখছি, দেখতে পাচ্ছি, সেটা এই যে, বেজাই মোটা আপনি, খেয়ে না খেয়ে বেধড়ক মুটিয়েছেন। এত মোটা হওয়াটা ভালো নয়।’

‘অ্যাঁ? বলেন কী মশাই।’

‘হ্যাঁ, তাই বলি। আপনি মাখন, চর্বি, আলু, মিষ্টি জিনিস বড়ো বেশি খান, বেশি বেশি খান, খেতে চান। সেই সঙ্গে চকোলেটও খান কি না কে জানে! এগুলো ভারি মোটায়—মুটিয়ে দেয়। মোটামুটি যা দেখা গেছে।’

‘সেকী বলছেন আজ্ঞে? ও ছাড়া ধরাধামে খাবার কী আছে আর? ওই সবগুলোই তো আমি ভালোবাসি মশাই। বাদ দিই কী করে?’

‘বাদ না দিলে আপনার জীবনটাই বরবাদ দিতে হবে বুঝেছেন?’ আমি জানাই, ‘নইলে নির্ঘাত কোনোদিন থ্রমবোসিস হয়ে যাবে আপনার।’

চেয়ার সমেত তিনি চমকে উঠলেন যেন—‘অ্যাঁ? কী বললেন?’

‘গায়ে আপনার এত চর্বি জমেছে যে ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় আপনার ভেইনই খুঁজে পাবে না। ভেইন খোঁজার বৃথা চেষ্টা খানিকক্ষণ করে ইনভেইন যেখানে-সেখানে ইঞ্জেকশন ঠুকে দেবে—চাই কী, দুটো-তিনটে সিরিঞ্জ ভেঙে বসতেও পারে। সিরিঞ্জের সেই ছুঁচগুলো আপনার চর্বিতে বসে থাকবে জমিয়ে, সূচিভেদ্য আপনার থেকে তাদের বার করা সহজ হবে না।’

‘তার ফলে?’

‘তাতে অবশ্যি আপনাকে মরতে হবে না।’

‘বঁাচলাম।’ বলে তিনি হাঁপ ছাড়লেন।

‘হ্যাঁ, থ্রমবোসিসে মরার ফাঁক আর পাবেন না আপনি। আপনি মারা যাবেন ধনুষ্টংকারে। তার আগেই… মানে, তার পরেই।’

‘সেআবার কী কথা?’ তাঁর দ্বিতীয় চমক।

‘এই কথা। তারপর দ্বিতীয় দুর্লক্ষণ যা দেখছি, আপনি বড্ড বেশি চুরুট খান। সিগ্রেটও ফোঁকেন নিশ্চয়। গাঁজাটাজাও খান কি না কে জানে। না খান তো, এতেই হবে। অত্যধিক এই ধূমপানেই আপনি যাবেন।’

‘কোথায় যাব? টেঁসে?’

‘হাসপাতালে। ক্যানসার হাসপাতালে। কিন্তু জানেন তো, ক্যানসারের কোনো অ্যানসার নেই, বার হয়নি এখন অবধি। সিগ্রেট খেলে ক্যানসার হয় জানেন নিশ্চয়?’

‘হ্যাঁ কানে এসেছে কথাটা। কোথায় যেন শুনেছিলাম?’

‘আমি চোখে দেখছি… আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক ভদ্রলোক, এই ক্যানসারেই ফ্ল্যাট হলেন শেষটায়। এবং এ পাড়ার এক প্রফেসার। তিনিও। তা ছাড়া আর এক ভদ্রমহিলা। তাঁরও ওই ক্যানসারেই।’

‘ভদ্রমহিলাও? তিনিও সিগ্রেট টানতেন নাকি?’

‘না, তাঁর নিজস্ব টান নয়, সেকেণ্ড হ্যাণ্ড। তাঁর ছেলেপুলে, নাতিপুতি সবাই বাড়ির কর্তাকে লুকিয়ে তাঁর ঘরে সিগ্রেট টানতে যেত, আর সারাদিন সেই ধোঁয়া তাঁর নাকে ঢুকত। আর কর্তা টানতেন সারারাত। সবার এই দিনরাত সিগ্রেট টানাটানির সব ধকল সইতে হত তাঁকে। তাতেই নাকি তাঁর ক্যানসার হয়ে যায়।’

‘ও, তাই বুঝি সিনেমা হলে সিগ্রেট টানা একদম মানা হয়েছে? যাতে ওই সেকেণ্ড হ্যাণ্ড সিগ্রেট খেয়ে না কেউ অক্কা পায় শেষটায়?’

‘তা হবে হয়তো। এবং’ আমি বলে যাই—‘আপনার তৃতীয় গোলমাল যা আমার নজরে পড়েছে সেটা—সেটাই হল আপনার গোড়ার গোলমাল, তা হচ্ছে আপনার এই গুলিয়ে ফেলাটা। ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন আপনি। এসে যদিও তেমন ভুল করেননি। তাহলেও আমি বলতে চাই, আমি ডাক্তার নই, লেখক। ডাক্তারবাবু থাকেন এর পাশের ফ্ল্যাটে।’ সঙ্গে সঙ্গে আমার অনুযোগ—‘তবে এর জন্যে ততটা হয়তো দোষ দেওয়া যায় না আপনাকে। ডাক্তারের নেম প্লেটখানা দুটো ফ্ল্যাটের মাঝামাঝি এমন জায়গায় বসানো যে স্বভাবতই ভুল হতে পারে সবাইকার।’

‘আরে মশাই সেখানেই তো গেছলাম গোড়ায়’, তিনি কন—‘দেখি যে ভদ্রলোক দিস্তা দিস্তা কাগজ নিয়ে কীসব ছাইভস্ম লিখে যাচ্ছেন। একটানা লিখছেন একান্ত মনে, অবাক হয়ে ভাবছি, এত এত প্রেসক্রিপশন লিখতে হয় নাকি ডাক্তারদের? কিন্তু কিছু বলার আগেই আমায় দেখে তক্ষুনি তিনি বলে উঠলেন—না না এখন না এখন না। এখন আমায় বিরক্ত করবেন না। দেখছেন-না লিখছি আমি? তিনটে উপন্যাস লিখতে হবে, তিনখানা পুজো সংখ্যার জন্যে, সময় মোটে নেই আর। এই মোট না নামালে নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পাব না। আচ্ছা, আসুন এখন, নমস্কার। এই বলে তিনি আমায় বিদেয় করে দিলেন। আচ্ছা, যাই তাহলে। তবে যাবার আগে একটা কথা না বলে পারছি না। আমিও একটা দারুণ ব্যারাম দেখলাম আপনাদের। আপনাদের দুজনেরই। তা হচ্ছে—লেখকের ডাক্তারি আর ডাক্তারের লেখকগিরি—এই ইতরবিশেষ—এটাও বড়ো কম নয়। তবে কে বিশেষ ইতর তা আমি কইতে চাইনে। নমস্কার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *