গল্পের উপসংহার
ভজহরি গল্প লেখে।
ভাষার তার অভাব নেই, ভাবের তো খরস্রোত,—ছাপানোর কাগজও যথেষ্ট। অভাব যা কিছু প্লটের।
মাথা খাটিয়ে একটা প্লট যদি সেকোনোরকমে বাগিয়ে আনতে পারে গল্প, গল্প বানিয়ে ফেলতে তার কতক্ষণ?
ক্ষণজন্মা লোকদের বিপদ পদে পদে; জীবিত অবস্থায় কোনোই মূল্য নেই, কিন্তু মারা গেলেই অমর হয়ে যাবার ঘোরতর আশঙ্কা। আমাদের ভজহরি সাহিত্যিক, এই কারণেই সেক্ষণজন্মা এবং সেই কারণেই, এইমাত্র, আনমনা হয়ে প্লট ভাঁজতে ভাঁজতে, মোটরের পাল্লায় পড়ে প্রায় খরচ হয়ে যেতে বসেছিল আর কী!
যাক—খুব সামলে নিয়েছে, মোটর এবং ভজহরি দুজনেই।
অমরত্বের খর্পর হতে আত্মরক্ষা করে আত্মপ্রসাদের আতিশয্যে কাবু হয়ে পড়ে ভজহরি। এক পয়সার পাঁঠার ঘুগনি কিনে ফ্যালে তক্ষুনি—‘খাবি আয়ের’ কাছ থেকে, নগদ পয়সায়।
এই ‘খাবি আয়’ লোকটা খাসা ঘুগনি বানায় কিন্তু। সামনে পেলে প্রায়ই কিনে খায় ভজহরি। এক পয়সা থেকে এগারো পয়সা পর্যন্ত সেখেয়ে ফ্যালে এক-একদিন। একা একাই অবশ্য। এমন ফাসক্লাস, ঘুগনির ভাগ নিজেকে ছাড়া আর কারুকে দেবার কথা সেকল্পনাই করতে পারে না।
‘খাবি আয়’ ঘুগনিওয়ালার নাম নয় অবশ্যি, ও হচ্ছে ওর গৎ। ওই বলেই ও হেঁকে যায়; এ ছাড়া অন্যবিধ বিশেষণ-কি-বিশেষ্য পদবাচ্য আর কোনো বুলি ওর আড়তে নেই। ‘খাবি আয়’-হাঁক পেলেই ছেলের ঝাঁক বেরিয়ে আসে বাড়ির নেপথ্য থেকে। প্রায় ওর হাঁড়ির কাছাকাছিই। এবং খুব কম ছেলেই লোভ সংবরণ করতে পারে। লোভ আর পয়সা।
ঘুগনির গতি সাধারণত অন্তরের দিকেই। এই হেতু, ঘুগনি-সূত্রে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ‘খাবি আয়ের’ অন্তরঙ্গতাই আছে। দস্তুরমতোই অন্তরঙ্গতা।
অবশ্য, আন্তরিকতার এতটা বাড়াবাড়ি ভজহরির পছন্দ নয়। ‘খাবি আয়’ না বলে ‘খাবেন আসুন’ বললেই যেন তার আত্মসম্মান অব্যাহত থাকে। এরকম সম্বোধনের লঘুতায় ওর সাহিত্যিক মর্যাদার ভারি লাঘব হয়, নচেৎ সেনিশ্চয়ই ঢের—ঢের বেশি পয়সার ঘুগনি খেয়ে ফেলত। খাবি আয়—ডাক শুনে গণ্যমান্য লোকের পক্ষে এগুনোই শক্ত; পেটে পেটে ভয়ানক ইচ্ছা থাকলেও। কিন্তু কী আশ্চর্য, পাড়ার ছেলেদের এইসব খুঁটিনাটির প্রতি ভ্রূক্ষেপই নেই।
ছেলেরা কি আর মানুষ? ঘুগনি খায় আর ভাবে ভজহরি। আপন মনেই ভাবে।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ওর মাথা খুলে যায়। বা:—এই যে খাসা প্লট। এতক্ষণ সেঅনর্থক আজেবাজে ভেবে কাহিল হয়েছে আর এদিকে দিব্যি একখানা চোস্ত রকমের গল্প রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—দু-পায়ে ভর দিয়ে, ঘুগনির হাঁড়ি মাথায়! যাচ্চলে!
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই কালি-কলম নিয়ে বসে পড়ে ভজহরি।
‘বলো হরি হরিবোল!’
(এইরকম, গোড়াতেই কথোপকথন দিয়ে গল্প ফাঁদতে ভালোবাসে ভজহরি। ‘ইনভার্টেড কমার’ মধ্যে যা থাকে, ওর মতে তাই হচ্ছে কথোপকথন। ভজহরি বলে, ‘ডায়ালগ না হলে আবার গল্প? ধুর ধুর!’)
আবার গগন বিদীর্ণ করিয়া দশ দিক বিকম্পিত করিয়া আবার আর্তধ্বনি উঠিল, ‘বলো হরি হরিবোল’!
মহাশ্মশান। অমাবস্যার রাত।
(শ্মশান হলেই অমাবস্যাকে থাকতে হবে—মহাশ্মশানে তো বারো মাসই অমাবস্যা। ও-দুয়ে মিলে, যাকে বলে গিয়ে রাজযোটক,—ভজহরির মতে।)
মহাশ্মশান। অমাবস্যার রাত। ঘোর অমা নিশীথিনী। আকাশে ঘোর ঘনঘটা। থাকিয়া থাকিয়া বিদ্যুৎ চমকাইয়া অন্ধকারকে আরও গাঢ়—আরও ঘনীভূত করিয়া তুলিতেছে।
(বিদ্যুতের আর কাজ কী বল?)
নিমতলার ঘাট। একটি চুল্লি তখনও নিবায় নাই,—চুল্লি—?
(‘চুলোয় যাক’ বলে ভজহরি লাইনটা কেটে তৎক্ষণাৎ তাকে নিবিয়ে দেয়।)
নিমতলার ঘাট! দূরে দূরে ফেরুপাল—
(আবার বাধা। ফেরু আবার কী জিনিস রে বাবা? বিদ্যাসাগরি কেতাবে বহু বার ফেরুপালের সঙ্গে ওর দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে বটে, কিন্তু আলাপ-পরিচয় হয়নি কখনো। এইমাত্র জানে যে, ওদের বদস্বভাব হচ্ছে নাহক গর্জন করা। ভজহরি ঈষৎ বদলে দেয়—)
দূরে দূরে স্টিমারের পাল গর্জন করিতেছে। অর্থাৎ উহাদের বঁাশি বাজিতেছে। ঈশান কোণে মেঘ জমিয়াছে।
(কোন দিকটা যে ঈশান কোণ, ভজহরি সঠিক জানে না, তবে মেঘরা যে সাধারণত ওই অজ্ঞাত কোণেই জমায়েত হয়, এটা ওর জানা আছে)।
ঈশান কোণে মেঘ জমিয়াছে। বাতাসে বেগ। ঝড়ের ঝাপটের মধ্যে কে যেন বিনাইয়া বিনাইয়া করুণ সুরে কাঁদিতেছে।
(না কেঁদে উপায় কী?)
এতক্ষণ ঝিঁঝি ডাকিতেছিল। এইবার পেচক ডাকিতে শুরু করিল।
(নিতান্ত দোষ দেওয়া যায় না। এরকম স্থান-কালে ডাকাডাকি করাই ওদের দস্তুর!)
এইভাবে, আরম্ভটা জমিয়ে নিয়ে, ভজহরি গল্পের মধ্যে নেমে যায় সরাসরি—
চিতার পার্শ্বে খাট নামানো হয়। খাটে একটি সুকুমারমতি শিশু। শায়িত।
(একদম শায়িত, তাতে সন্দেহমাত্র নেই!)
কার এই নধর বালক? এই দুগ্ধপোষ্য কচি কলেবর? এই দেবকান্তি কুমার কার?
এইসব দুরূহ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এগিয়ে যেতে হয় ভজহরিকে। তার বৃত্তান্ত অনেক।…
সংক্ষেপে, এক ছিল ঘুগনিওয়ালা, তার নাম—। নাম? নাম খুঁজে পেতেও বেশ একটু ভুগতে হয়েছে ভজহরিকে। প্লট আসে তো নাম আসে না—সেএক হ্যাঙ্গাম। অনেক মাথা চুলকে, অগত্যা, নিজের এক চাল্লুস মামার নাম বসিয়ে দিয়েছে ভজহরি।
ঘুগনিওয়ালার নাম নরহরি।
(হুঁ—আবার চটে না গেলে হয় মামাজি! বা:, কাগজে নাম বেরিয়ে ‘ফেমাস’ হতে যাচ্ছে তাতে আবার চটে মানুষ? মাতুল বলে তো বাতুল নয় আর! তবু, কী ভেবে, নরহরিকে কেটে সেনরহোড়ে করে দেয়। সেফ সাইডে থাকাই ভালো!)
নরহোড়ে ঘুগনিওয়ালার ছেলে রামহোড়ে, এই সুকুমারমতি শিশু, কী করে দিন দিন শুক্লপক্ষের শশীকলার মতো বাড়তে বাড়তে অকস্মাৎ একদিন কলকাতার কোলাহলমুখর রাজপথে দিগবিদিক-জ্ঞানহীন বেতালা এক মোটরের ধাক্কায় একেবারে এক লাফে কালের কবলে গিয়ে চিত হয়ে পড়ল—সোজাসুজি এক লাফে—সেএক সুদীর্ঘ ইতিহাস।
অবশেষে কী করে তাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হল এবং কী কী কান্ড হতে থাকল ক্রমান্বয়ে—দারুণ শোকাবহ সব ব্যাপার!
তারপর? তারপরে কী হল?
তারপরে নরহোড়ে গেল খেপে। পুত্রশোক সহ্য করা সহজ নয়। তার পর থেকে তার আহারে রুচি নেই, নিদ্রায় লালসা নেই, পাঁঠাদের প্রতিও তার জিঘাংসা গেল কমে। অবশ্য, অভ্যাসবশত ঘুগনি সেবানায় রোজই, কিন্তু সেজন্য নতুন করে পাঁঠা আর সেকাটে না, বাজার থেকে কাটতি-হওয়া পাঁঠার নাড়িভুঁড়ি কিনে এনেই চালিয়ে দেয়। ঘুগনির হাঁড়ি মাথায় করে পথে পথে আজকাল পাড়ার ছেলেদের সেডেকে বেড়ায়—‘খাবি আয়! ওরে খাবি আয়!’
দাম? দাম সেচায় না আর। দিতে এলেও নেয় না। পয়সার কথা যেন সেভুলেই গেছে। অমন চাঁদের মতো ছেলে যার যায় সেকি আর—? ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার ছেলেকে ডেকে ডেকে অমনি ঘুগনি খাইয়েই আজ তার আনন্দ। সব ছেলের মধ্যে সেআজ তার রামহোড়েকে খুঁজে পেয়েছে। সবার মধ্যে দ্যাখে রামহোড়ের কচি মুখ। রামহোড়েকেই সেডেকে ফেরে—খাবি আয়! যেন রামহোড়েই এসে রোজ খেয়ে যায় তার ঘুগনি! সেই রামহোড়ে—সেই রাম! আহা!……
(মোদ্দা কথা, ঘুগনি খেতে কারুর এক পয়সা ব্যয় হয় না। ব্যায়রাম হয় কি না কে জানে!)
পরের সংখ্যায় চৌমাথা-তেই ছেপে বেরুল গল্পটা। পয়লা তারিখেই লেখার দক্ষিণা দশটা টাকা আদায় করে ভজহরি ভাবল—‘না:, আজ আর হেঁটে বাড়ি না! ট্যাক্সিতে সোজা! হুঁ!’
যে-মোটরে রামহরি গেল মারা, নরহরি পুত্রহারা, এবং সেনিজে একদিন একটুর জন্য অমর হতে হতে হয়নি, দৈবক্রমে অন্যায় রকমে রক্ষা পেয়ে গেছে, আজও সেই মোটর—কিন্তু ওপরে নয়—ভজহরির পদতলেই। হ্যাঁ।
এদিকে নরহোড়েও বেরিয়েছে ঘুগনির হাঁড়ি কাঁধে। রোজ বেরোয় যেমন। তার সেই এক হাঁক—‘খাবি আয়।’ রোজ যেমন হাঁকে।
চৌমাথা পেরিয়ে যেমনি-না সেপাড়ার মধ্যে ঢুকেছে, পাশের গলি থেকে সাঁ করে একটা ছেলে বেরিয়ে আসে।
—‘এই যে! তোমার জন্যেই বসেছিলাম এতক্ষণ! খেলতেও যাইনি আজ!’
নরহোড়ে একটু অবাক হয়। পায় বটে, কিন্তু এতখানি আপ্যায়ন সেপায় না কোনোদিন!
—‘দাও তো এক পয়সার!’ বলে ছেলেটা। ‘না না, দু-পয়সার দাও!’
তার পর ইষৎ ভেবে নেয়। ‘দু-পয়সারই বা কেন, একেবারে চার পয়সারই দিয়ে দাও! তোফা ঘুগনি তোমার! বেশ খেতে।’
পেছন থেকে ডাক দেয় ঘুগনিওয়ালা—‘কই, পয়সা দিলে না তো খোকাবাবু?’
‘পয়সা! পয়সা কেন?’ ছেলেটি ফিরে আসে। ‘তোমার তো ছেলে মারা গেছে। তবে আবার পয়সা কীসের?’
‘ছেলে!’ আকাশ থেকে পড়ে নরহোড়ে। ‘ছেলের কথা কী বলছ বাবু?’
‘সেই রামহোড় গো, রামহোড়ে! তোমার চাঁদপানা রাজপুত্তুর।’ বেশ জোর গলাতেই জবাব দেয় ছেলেটা। কোথায় আয়েস করে এতক্ষণ ঘুগনি চাখবে, না, কি এত ঐতিহাসিক ব্যাখ্যানা। বিরক্ত হয়ে যায় সে।
‘ছেলে আর কবে ছিল বাবু! বিয়েই করিনি তো ছেলে! বউ ছেলে থাকলে কি আজ আর এত কষ্ট আমার! পথে পথে ফিরি করে বেড়াই!’ দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে নরহোড়ের।
‘তোমার কি আর মাথার ঠিক আছে? তুমি তো খেপে গেছ! তুমি তো ভুলে মেরে দেবেই।’ ছেলেটিও দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ে, ‘কথায় বলে পুত্রশোক! এমনিতেই আমরা পড়া ভুলে যাই!’
ঘুগনিকে গলান্তরিত করতে করতে ছেলেটি চলে যায়। নরহোড়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী বলবে ভেবে পায় না।
কয়েক পা এগিয়ে, কতিপয় হাঁক-ডাক ছাড়তেই, একপাল ছেলে এসে ছেঁকে ধরে ঘুগনিওয়ালাকে।
—‘এই যে! এসে পড়েছে! দাও দাও, ঘুগনি দাও!’
এত সমাদর কিন্তু ভালো ঠেকে না নরহোড়ের। সন্দিগ্ধ স্বরে বলে—‘কই, পয়সা দেখি আগে?’
ছেলেরা হাসে। ‘হ্যাঁ:, পয়সা তুমি নাও নাকি আবার! তুমি তো অমনি খাওয়াও!’
‘অমনি খাওয়াই!’ এবার চটে যায় নরহোড়ে। ‘ভারি আমার গুরুপুত্তুর এলেন সব। অমনি খাওয়াই! ওসব হবে-টবে না বাবু! ঘুগনি খাবে তো পয়সা ফ্যালো!’
‘বটে? চালাকি পেয়েছ? আমরা বুঝি আর জানিনে?’ দস্তুরমতোই খেপে ওঠে ওদের একজন—‘যা তো বুবরি, নিয়ে আয় তো কাগজখানা!’
বুবরি তার ভাই তুবড়িকে হুকুম করে—শেষ নাগাদ ছোটোবোন চুবড়ি ছুটে গিয়ে কাগজখানা নিয়ে আসে।
‘কী? কী লিখেছে এতে? দ্যাখো-না পড়ে…’ অমন যে ঠাণ্ডা রেনটু, সেই ওঠে রুখে—‘অন্য সব পাড়ায় অমনি অমনি দেওয়া হয়, আর কেবল আমাদেরকেই ঠকানো? ছেলেমানুষ পেয়ে? বটে?’
ছোট্ট একটি খুকিও যোগ দেয় সেইসঙ্গে—‘সত্যিই তো, এত দিন ঠকানোই হয়েছে আমাদের! কিছু বলি না বলে তাই। দাও, সব পয়সা, এতদিনকার ফিরিয়ে দাও আমাদের।’
‘হুম। কম পয়সা বাপু তুমি হাতাওনি তো অ্যাদ্দিন। ফিরিয়ে দাও—দাও এক্ষুনি।’ চারধার থেকেই জোরজুলুম শুরু হয়।
অবশেষে নিজেদের মধ্যেই ওরা রফা করে। অকস্মাৎ ওরা উদার হয়ে ওঠে। পয়সার দাবি নিতান্তই ছেড়ে দেয়। ‘বেশ, পয়সা না দেবে তো নাই দেবে, ঘুগনি তো দাও! তাতে তো আর আপত্তি নেই তোমার?’
তথাপি, নরহোড়ে কেন যে ইতস্তত করে কিছুতেই বোধগম্য হয় না ওদের! অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে বিশ্বনাথ, ‘এখনও দেখছি টনটনে পয়সার জ্ঞান, এ কীরকম মাথাখারাপ বাপু তোমার? ভালো না তো!’
বুবরি বলে—‘পুত্রশোক না হাতি?’
তুবড়ি সায় দেয়—‘আমার যদি পুত্রশোক হত, তোমার মতো হাঁড়ি হাঁড়ি ঘুগনি অমনি— বিলাতাম আমি। তুমি তো দেবে মোটে এক পয়সার!’
জনতার ভেতর থেকে একজন এগিয়ে আসে—‘চিনতে পারছ আমায়? আমি তোমার সেই রামহোড়ে! আর কাউকে না দাও, আমাকে দেবে তো? ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো, সেই কচি মুখ! সেই সুকুমারমতি! সেই শায়িত!’
বুবরি উৎসাহ দেয়—‘হ্যাঁ হ্যাঁ! সেই যে তোমার কালের কবলে গিয়ে চিতপাত হয়ে পড়েছিল গো—সেই! কেবল আগে ও ছিল দুগ্ধপোষ্য আর এখন শুধু ঘুগনিপোষ্য এই যা তফাত।’
তবু কেমন উৎসাহিত হয় না নরহোড়ে। বরং যেন পালাবার ফিকির খোঁজে। আজ এসব যে কী ব্যাপার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
ইতিমধ্যে নবাবিষ্কৃত রামহোড়ে নবাবি শুরু করে, এক খাবলা বসিয়ে দ্যায় ঘুগনির হাঁড়িতে। হাঁ হাঁ করে ওঠে নরহোড়ে। ততক্ষণে তার আর এক খাবলা হয়ে গেছে। বাধা দিতে না দিতে সমবেত সমস্ত হাতের হাতাহাতি বেঁধে যায় তার হাঁড়ির মধ্যে। একেবারে যুগপৎ!
কাকে সামলাবে নরহোড়ে? হাঁড়ির মুখ, না, ছেলেদের মুখ? প্রথম হস্তপ্রদর্শক, সদ্যলব্ধ রামহোড়ের ওপর তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে। এক চড় কষে দেয় তার মাথায়।
রামহোড়েও হটবার ছেলে নয়—সেও বসায় এক থাপ্পড়, বসাবার আগে, ঘুগনি-মাখা হাতখানা নরহোড়ের পিঠেই ঘষে-মুছে শানিয়ে নেয় ভালো করে। তখন চারধার থেকেই কিল-চড়-চাপড়ের শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বেচারা নরহোড়ের আষ্টে-পৃষ্ঠে-ললাটে। হাঁড়ি তো ভেঙেছেই, হাড় ভাঙতে এখন বাকি কেবল।
ভজহরির ট্যাক্সি হর্ন বাজিয়ে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। শিশু-সপ্তরথীর চক্রান্তর্গত নরহোড়েকে চোখে পড়ে না তার।
সবাই মিলে চাঁদা করে চাঁটিয়ে নরহোড়েকে তারা নড়বড়ে করে এনেছে ততক্ষণে।
‘খাবি আয়’ তখন খাবি খায়। নিজেই।