প্রেম এবং দাঁত
প্রেমের দাঁত সব জায়গায় সহজে বসে না, কিন্তু একবার বসলে আর রক্ষে নেই! ঐরাবত ব্যতীতও—হস্তিনাপুরীর বাইরেও—দাঁতালো প্রেম দেখা দিতে পারে।
মঞ্জুলা একেবারে গালে হাত দিয়েই হাজির!—‘ডলিদি যে এ কাজ করতে পারেন, আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।’
‘কী কাজ করলেন শুনি?’ আমি প্রশ্ন করি—‘আর তোমার এই ডলিদিটিই বা কিনি?’
‘ডলিদি? ডলিদি আমাদের পাড়ার এক মেয়ে! মেয়ে বললে ঠিক পরিচয় হয় না, এ-পাড়ার যুবতীদের তিনি অন্যতমা। যদিও বয়েসটা তাঁর সাঁইত্রিশ বছরের এক ঘণ্টাও কম না এবং যদিও সবার প্রতি তাঁর ঘৃণারও অবধি নেই।’ মঞ্জুলা বলে।
‘খুব বুঝি অবজ্ঞার চক্ষে দেখে থাকেন তোমাদের?’
আমি জিজ্ঞাসা করি, একটু আশ্চর্য হয়েই বলতে কী। অন্তত মঞ্জুলার মতো মেয়ের প্রতি তাঁর ঘৃণার একটু অবধি থাকা উচিত ছিল—ওকে তো কোনো কারণেই আমি অবজ্ঞেয় ভাবতে পারি না। অবিশ্যি অজ্ঞেয় কোনো কারণ থাকলে তা আমার জানা নেই। কিন্তু তাহলেও একটি মেয়ের সম্পর্কে আমি আর ডলিদি যে সব বিষয়ে একমত হতে পারব, এতটা আশা করা অন্যায়।
‘আমাদের নয় গো আমাদের নয়। তোমাদের পুরুষদের ওপরেই তাঁর অপরিসীম ঘৃণা।’ মঞ্জুলা জানায়।—‘অন্তত আজ পর্যন্ত আমরা তাইতো জানতাম।’
‘বল কী?’ মঞ্জুলা আমাকে রীতিমতো অবাক করে দেয় এবার।
‘সত্যি, আমরা বড্ড শক খেয়েছি। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ একেবারে বিয়ের নোটিশ! লোকটার সঙ্গে মাত্র তিন দিনের আলাপ—এর মধ্যেই—! অদ্ভুত কান্ড ডলিদির!’
‘পূর্বজন্মের পরিচয় থাকলে এ জীবনে তিন মিনিটের ঝালিয়ে নেওয়াই যথেষ্ট। তাই নয় কি?’ আমি বলি। ‘পাত্রটি কে শোনা যাক।’
‘ডলিদির অফিসেই কাজ করে। সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টে। দেখেছি পাত্রকে। কিন্তু সেযে কী দেখেছে ডলিদির মধ্যে সেই জানে।’
প্রশ্নটা মঞ্জুলার নিকট জটিল রহস্য হলেও আমার কাছে জলবৎ। প্রেমের চক্ষু কিছুই দ্যাখে না। দেখতে শুরু করলেই তা জ্ঞানের চক্ষু হয়ে দাঁড়ায়। মাছ কি বঁড়শি দেখতে পায়? কচুগাছ কি অসিকে চেনে? অন্তত কচুকাটা হবার আগেভাগে? ডলিদির সুপাত্র যদি ডলিদির মধ্যে বর্ষিয়সীকে না দেখে থাকে, তাতে বিস্মিত হবার কিছু ছিল না।
‘দ্যাখো, দেখাদেখির কথাটা তুলো না। সবাই তো আমাকে ভয়ংকর বিচ্ছিরি দ্যাখে, কিন্তু তুমি—’ আমি বলতে যাই।
‘আমিও তাই দেখি।’ মঞ্জুলা বাধা দিয়ে বলে—‘কিন্তু আমার কথা আলাদা। আমার তুলনা কেন? পুরুষমানুষের তো একটা রুচি থাকা উচিত?’
‘তা বটে কিন্তু সবার কি থাকে? এই যেমন—’ বলে এবার আমি নিজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে এগুই এবং আবার মঞ্জুলার তরফ থেকে ধাক্কা আসে এবং ধাক্কার মতো ধাক্কাই এবার।
‘তাও যদি ডলিদির দাঁতগুলো পোকায় না খেয়ে দিত!’ মঞ্জুলা প্রাঞ্জল করে—‘ডলিদির বঁাধানো দাঁত তা জান?’
এ সংবাদ আমায় বিচলিত করে। সমস্যাটা আপাতদর্শনে মৌখিক মনে হলেও আসলে অতি গভীর। বঁাধানো দাঁত, ভেবে দেখলে, সর্বপ্রকার খাদ্যাখাদ্যের অন্তরায়। এমনকী যে জিনিস লোকে স্থির হয়ে খায় এবং খেলে স্থির হয়ে যায়—জীবনের মুখ্যতম জিনিস!—কিন্তু বঁাধানো দাঁতের ব্যপদেশে তারও কোনো স্থিরতা থাকে না।
‘সত্যি, খুব ভাবনার কথা।’ না বলে আমি পারি না।
‘আসছে হপ্তায়ই বিয়ে হবে ঠিক হয়েছে।’ মঞ্জুলা ব্যক্ত করে—‘সিভিল ম্যারেজ, কিন্তু এদিকে তো মিলিটারি তাড়া!’
‘সিভিল ম্যারেজ? তাহলে আর কী! তাহলে তো বরযাত্রী, কন্যাযাত্রী কিছুই নেই। তোমাকেও আর সবান্ধবে নেমন্তন্ন করছে না।’ আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। যেখানে ভোজের আসরে আমার মঞ্জুলিত হবার আশা নেই তেমন বিয়েকে আমি ভোজবাজি বলেই মনে করি।
নেমন্তন্ন নেই!— কথাটার খোঁচা আমার কোথায় যেন লাগে। হৃদয় কিংবা হৃদয়েরই কাছাকাছি কোথাও যেন, ঠিক বোঝা যায় না। ব্যথাটা উদরেরই হওয়া উচিত, কিন্তু সেই জন্মে অবধি ধরাধামে থাকার জন্যে, মাধ্যাকর্ষণের টানেই কি না কে জানে, আমার হৃদয় তিলে তিলে স্থানচ্যুত হয়ে ক্রমশ উদরে এসে বাসা বেঁধেছিল। অন্তত আমার তাই ধারণা। এই কারণে আমি দেখেছি, একটা নেমন্তন্ন ফসকে গেলে পেটের দুঃখটা আমার মনের মধ্যে লাগে। আবার কোনো কারণে হৃদয়ে আঘাত পেলে এক ভাঁড় রাবড়ি খেয়ে দেখা গেছে বেশ মলমের কাজ করে। ওদের উভয়ের এই হরিহরাত্মা (‘হৃদয় আমার হারিয়েছি’!) এই একাকার-দশার জন্যই আমার উদরের পরিধি একটু বাড়বার দিকে কি না তা আমি বলতে পারব না। যা-ই হোক, মঞ্জুলার কথায় আমার মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল।
‘ডলিদির বিয়েতে কী উপহার দেওয়া যায়, আমি তাই ভাবছি।’ মঞ্জুলা বলে।
ওর একেবারে অন্য ভাবনা। মেয়েদের যে হৃদয় নেই বলে থাকে কথাটা মিথ্যে নয়।
‘শাড়িটাড়ি?’ আমি প্রস্তাব করি।
‘ওরেব্বা, যা দাম!’ মঞ্জুলা চমকে ওঠে, ‘দামের জন্যও কিছু যায়-আসে না—পাব কোথায়? তা ছাড়া, ডলিদির আবার শাড়ির অভাব?’
চাকরি থেকে যে মোটা টাকা আসে ডলিদি তা নিজের সুখ এবং শাড়ির জন্যই উড়িয়ে দেন জানা গেল। বাড়িতে গলগ্রহ কেউ নেই, এ পর্যন্ত হবার মতো কেউ জোটেওনি (এই বিয়েটার আগে অবধি), কাজেই সুখের বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলা না গেলেও শাড়ির ডলিদির সীমা ছিল না।
‘তাহলে আর কী দেবে? দাঁতের মাজন-টাজন দিয়ে কি কোনো লাভ আছে?’ আমি জানতে চাই।
‘ঠিক বলেছ! ডলিদিকে নতুন এক সেট বঁাধানো দাঁত দিলে কেমন হয়? খুব সারপ্রাইজ হবে, নয় কি?’ মঞ্জুলা উৎসাহিত হয়ে ওঠে।
উপহাররূপে খুব আনকোরা আর চমকদার যে হবে তাতে কোনো ভুল ছিল না। এক ধারে উপহারিতা এবং উপকারিতার এমন চমৎকার যোগাযোগ বিরল। তবু আমি একটু খুঁতখুঁত করি—‘বরের সামনে যেন উপহারটা দিয়ে বোসো না, বিয়ের আগে তো নয়ই। কনের খুঁত বেরিয়ে গেলে বিয়েটা ভেঙে যেতে পারে।’
তখন কী করে ডলিদিকে না জানতে দিয়ে তাঁর দাঁতের মাপ আদায় করা হবে সেই সমস্যা দাঁড়াল। অবশেষে ডেনটিস্টের কাছে যাওয়া হল। ডলিদিকে যদি ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা আস্ত আপেলে আকর্ণ-বিস্তৃত কামড় বসাতে বাধ্য করা যায় তাহলে তার ভুক্তাবশিষ্ট থেকে মাপসই এক পাটি বঁাধাবার কোনো অসুবিধা হবে না তিনি জানালেন। তবে কেবল ওপরের এক পাটিই হবে এই যা। মঞ্জুলার মতে উপহারের পক্ষে তাই যথেষ্ট। খরচটাও যে অর্ধেক কমে যাবে সেটাও তো অবিবেচ্য নয়।
ডলিদিকে দিয়ে আপেল খাওয়ানো মঞ্জুলার পক্ষে তেমন কষ্টকর হয়নি, পরদিন গিয়ে শুনলাম। দাঁতের ফরমাশ দেয়া ছাড়াও মঞ্জুলা নানা রকমের টুথপেস্ট কিনে এনেছে এর মধ্যে। খান কয়েক ফ্যান্সি চেহারার টুথব্রাশও তার ভেতর রয়েছে দেখা গেল।
মেয়েরা ওইরকমই! কোনো কাজে হাত দিলে তার কোনো ত্রুটি রাখে না, একটু নুন ঝাল কম-বেশি হবার জো নেই। তবে আমাদের যদি গিলতে বাধে সেনেহাত এই গলার দোষ! গেলবার গলদ—তা ছাড়া আর কী?
বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যেবেলা মঞ্জুলাদের বাড়ি গেছি, দেখি সেগুম হয়ে বসে আছে। তার বদলে যে আমাকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাল সেতার সেই এক পাটি দাঁত। মুক্তার মতো ঝকঝকে দাঁতগুলো টেবিলের ওপর মুক্তহাসি ছড়াচ্ছিল। ষোড়শীর দাঁতের মতোই অনিন্দ্যনীয় ষোলোটি সেই দাঁত।
মঞ্জুলাও তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল—পরকীয়া দন্তরুচি!
‘কী হয়েছে? এমন মনমরা কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, দাঁতের পাটিটা হাতে নিয়ে। ডলিদি হয়তো আজ হঠাৎ এসে পড়ায় উপহারের ব্যাপারটা বেফাঁস হয়ে গেছে আমার মনে হতে থাকে। ‘ডলিদি সব জেনে ফেলেছে বুঝি? এত কষ্ট করে এত হাঙ্গামা পোয়াবার পর এমন উপহার বুঝি ওর পছন্দ হল না?’
‘না না, ডলিদির খুব পছন্দ হয়েছিল—’ মঞ্জুলা মৃদুলা হয়ে জানায়— ‘দাঁত দেখে ডলিদি নেচে উঠেছিল, বলতে কী! কিন্তু কিন্তু—’ বলতে গিয়ে দুঃখের ভারে ভেঙে পড়ল মঞ্জুলা।
‘কিন্তু আবার কী হল?’ আমি খোঁজ নিই।
‘সমস্ত সেই নষ্ট আপেলটার কারসাজি।’ সেবলে—‘সেই যে সেই আধখানা আপেল ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে গেছলাম মনে আছে? পথে যাবার সময়ে সেযে শুকিয়ে আরও আধখানা হয়ে যাবে তা কে জানত? ফলে দাঁতের পাটিটাও মাপে খাটো হয়ে গেছে— ডলিদির মুখের সঙ্গে মোটেই খাপ খাচ্ছে না।’
‘ও, এই? এর জন্য এত দুঃখ কীসের? পরে কাজে লাগবে ক্ষণ। ডলিদির মেয়ের জন্য রেখে দাও। ছেলে-মেয়েরা বাপ-মার দোষ-গুণ পেয়ে থাকে বলে নাকি। উত্তরাধিকারসূত্রে সেহয়তো দাঁত না নিয়েই জন্মাতে পারে।’ এই বলে আমি ভরসা দেবার চেষ্টা করি।
‘আহা, তা নয়। মুশকিল হয়েছে এই, আজ সকালে ডলিদির নিজের ওপরের পাটিটা মাজবার সময়ে হঠাৎ হাত ফসকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে। একেবারে টুকরো টুকরো। তার মানে ডলিদির সারা ওপরের সারি ফাঁক। অথচ কাল ডলিদির বিয়ে।’
‘ও, বুঝেছি। দাঁতের সঙ্গে বিয়েটাও ভেঙে গেল।’ অলক্ষে আমার অশ্রুজল পড়ে। হায়, এই পৃথিবীতে দাঁত, প্রেম, জীবন সবই ক্ষণভঙ্গুর। কিছুই কিছু নয়। সমস্তই বিধাতার কাঁচা কাজ—কাচের কাজ।
‘না, অতটা গড়ায়নি,’ মঞ্জুলা বলে, ‘তার কারণ, ডলিদির বর—ডলিদির বর—’ কী করে যে সেই মহাভাব সেব্যক্ত করবে ভেবে পায় না।
‘বড্ড ভালোবাসায় পড়ে গেছে ডলিদির, এই তো?’ আমাকেই ভাষা জোগাতে হয়।
‘হ্যাঁ।’ মঞ্জুলা আধা হাত ঘাড় নাড়ে। ‘ডলিদির দাঁতের কথা না শুনে তক্ষুনি সেতার নিজের দাঁত বার করে ফেলল—দু-পাটিই—তারও বঁাধানো দাঁত জানা গেল তখন! তারপর সেই দাঁত সেমেজেয় আছড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল—তক্ষুনি—সেই দন্ডেই। দুজনের কারোই এখন কোনো দাঁত নেই। আর দুজনেই বেশ হাসিখুশি।’
‘ব্যাস! সুখে থাকলেই হল। দাঁতে কী আসে-যায়?’ আমি শাবাশ দিয়ে বলি।—‘গোটা কয়েক দাঁত থাকলেই কী আর না থাকলেই-বা কী? ভালোবাসাই হচ্ছে আসল।’
‘আমিও সেই কথাই ভাবছি তখন থেকে।’ মঞ্জুলা বলে—‘মনে করো আমার যদি একটাও দাঁত না থাকত তুমি কি আমায় ভালোবাসতে?’
কথাটা ভাববার মতো। কিন্তু এখনই ভাববার মতো বোধ হয় নয়। কেননা দাঁত থাকতে দাঁতকে মর্যাদা না দেওয়ার কি কোনো মানে হয়? তাই ওর দুর্ভাবনাটা অক্লেশেই আমি হেসে উড়িয়ে দিতে পারি—
‘নিশ্চয়! তোমার যদি একটাও দাঁত না থাকে তাতে আমার ভালোবাসা বিন্দুমাত্রও কমবে না। তুমি দেখে নিয়ো।’
‘সত্যি বলছ? সত্যি? আঃ, বঁাচলাম। এত আমার আনন্দ হচ্ছে কী বলব! কিন্তু—তুমি কিন্তু—তোমাকে কিন্তু তোমার সব দাঁত বজায় রাখতে হবে—সেই বুড়ো বয়স পর্যন্ত। রাখবে তো আমার এই অনুরোধ?’
প্রেমের উপর এটা যেন একটু বেশি রকমের জুলুম করা হচ্ছে বলে আমার মনে হয়—দাবিটা একটু জবরদস্তিই যেন। তথাপি ওকে আশ্বাস দিতে আমি পেছপা হইনে—‘চেষ্টা করব বই কী। প্রাণপণ চেষ্টা করব রাখবার। তবে কথা এই, দাঁতরা অনেকটা মেয়েদের মতোই, অতিশয় চঞ্চলা! আমি তো রাখতে চাইব, এখন দাঁত আমাকে রাখলে হয়।’
‘দাঁত নেই, এমন কারও সঙ্গে ভাব রাখা স্বপ্নেও আমি ভাবতে পারি না।’ মঞ্জুলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অবশেষে মনের গোপন কথাটি প্রকাশ না করে পারে না।