পুরস্কার-লাভ
জমজমাট সভা। মহকুমার ছোটো বড়ো সবাই জড়ো। ক্ষুদ্র মহৎ সকলেই জমায়েত। ইতর ভদ্রের কেউ বাকি নেই।
পিন্টুও এসেছে। বেশ সেজেগুজেই। ধোপদুরস্ত হাফ প্যান্ট, হাফ শার্ট—ঝকঝক করছে জুতোর বার্নিশ, চকচকে ব্যাকব্রাশ মাথার চুল।
জ্বলজ্বল করছে বুকের ওপর টাটকা পাওয়া সোনালি মেডেলটা। রুপোলি গোলকের ওপর সোনালি পাত-মোড়া, মিনার কাজ করা—তার বীরত্বের পুরস্কার।
মহকুমা শহরের স্কুল প্রাঙ্গণে সভা। রীতিমতো বিরাট সভাই বলতে হয়। তিনটে স্কুলের যত ছেলেমেয়ে ভিড় করেছে। এসেছে তাদের গার্জেনরা। অনাহূত, রবাহূত জমেছে আরও কত যে!
কলকাতার দৈনিকপত্রগুলির নিজস্ব সংবাদদাতারাও রয়েছেন। খবর পাঠাবেন নিজেদের কাগজে। পিন্টু যে-স্কুলের ছাত্র তার হেডমাস্টারমশাই হয়েছেন সভাপতি। পিন্টুর গর্বে তাঁর দেড় হাত ছাতি দশ হাত হয়ে উঠেছে। মহকুমার হাকিম সভার প্রধান অতিথি।
আর, চারিধার ঘিরে খালি দর্শক আর দর্শক।
প্রধান দ্রষ্টব্য হচ্ছে পিন্টু।
সবাই দেখছে পিন্টুকে। পিন্টু কিন্তু কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। মেডেল পেয়েও মোটে সেখুশি নয়। তাকে নিয়ে এই যে হইহল্লা, এত যে শোরগোল এতে যেন তার সাড়া নেই। সেযেন এ উৎসবের কেউ না। এইসব আদিখ্যেতার বাইরে। নির্লিপ্ত, নিস্পৃহ, নির্বিকার ভার ভার মুখ তার।
এমন দিনক্ষণে তাকে বেশ হাসিখুশিই দেখবে আশা করেছিল সবাই। ফুটন্ত ফুলের মতোই প্রফুল্ল দেখা যাবে। অবশ্যি, ফুল যেমন ফোটে তেমনি আবার আলপিনও তো! কেউ যেন আলগোছে তাকে পিন ফোটাচ্ছে এমনিতরো পিন্টুর মুখখানা।
সভার যিনি ঘোষক, তিনি মাইকটা এনে খাড়া করলেন তার সামনে—
‘এইবার আমরা আশা করি শ্রীমান পিন্টু নিজ মুখে, তার নিজের ভাষায়, সেই অসম সাহসিকতার কাহিনি আমাদের শোনাবে…’
সবাই চুপ। সমস্ত সভা নিস্তব্ধ। একটা পেনসিল পড়লেও শোনা যায়। যে রোমাঞ্চকর সু:সাহস কেবল বইয়ের পাতাতেই পড়া তা এবার কানের পাতে পরিবেশিত হবে—উদগ্রীব সকলেই। কিন্তু পিন্টুর শ্রীমুখ থেকে একটা কথাও শোনা গেল না।
মাইকওয়ালা এবার নিজেই শুরু করল গাইতে—‘ক্লাস এইট-এর ছেলে, এই পিন্টু—এই যে, আপনাদের সামনেই দাঁড়িয়ে। কতই-বা বড়ো হবে আর? বছর বারো কি তেরো বড়ো জোর ওর বয়েস। স্কুলের কাছের ছোট্ট মনোহারী দোকানে সেদিন যখন আগুন লাগল, সবাইকে ঠেলে একাই গেল সেএগিয়ে। থামল না বাধায়, মানল না কারও মানা, জ্বলন্ত চালাঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে সেঁধুল। দোকানদারকে টেনে নিয়ে এল একলাই, এক হাতে, অবলীলায়। ধোঁয়া আর আগুনের ভেতর থেকে তার অচেতন দেহখানাকে একাই সেবার করে আনল—বঁাচাল তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে……’
সভাসুদ্ধ হাততালি দিয়ে উঠল—সাধুবাদ পড়ল চারধারে। কিন্তু পিন্টুর কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।
‘এইটুকু ছেলের মধ্যে এমন বীরত্ব যেমন অভাবিত, তেমনি অভাবনীয়। এককথায় অভূতপূর্ব। সমবেত ভদ্রমন্ডলী এবং ছাত্রবৃন্দ। শ্রীমান পিন্টুর মুখেই এখন শুনব আমরা সেদিনকার কাহিনি। এখনই শুনতে পাব।…পিন্টু, তোমার সেই অগ্নি-অভিযানের কাহিনি— সেই জ্বলন্ত অভিজ্ঞতার কথা আমাদের কাছে তুমি বর্ণনা করো। দু-চার কথায় বলো আমাদের…’
‘ও আর এমন কী! ও কিছু না।’ পিন্টু একটু ইতস্তত করে বলে।
‘কিছু নয়! তুমি বল কী হে পিন্টু?’ মাইকওয়ালা অবাক হয়ে যান—‘দেখুন আপনারা, এইটুকু ছেলের মধ্যে কতখানি বিনয়—কীরকম সারল্য। তাকিয়ে দেখুন এত বড়ো কাজ করেও—এমন বীরোচিত বাহাদুরির পরেও—এটাকে সেকিছু না বলে উড়িয়ে দিতে চাইছে। ভেবে দেখুন একবার কতখানি বীরত্বের পরাকাষ্ঠা হলে এমনটা হতে পারে।…’
বীরত্বের পরাকাষ্ঠা বলতে! যে পরাক্রমের একটু ইদিক-উদিক হলে—ইতরবিশেষ ঘটলে পরাকাষ্ঠার বদলে পোড়া কাঠ হয়ে বেরোতে হত—সেই ব্যাপারটাকে সকলেই ভেবে দ্যাখে। এবং যতই দ্যাখে ততই আরও ভাবিত হয়।
‘এ আর এমন শক্ত কী! জলের মতোই সোজা তো!’ পিন্টু জানায়,—
‘এসব কাজ একদম কিচ্ছু না।’
আগুনের মধ্যে ঢোকা—জলের মতোই সহজ! বলে কী এ পিন্টু? জলের পক্ষে সোজা হতে পারে, দমকলের পক্ষেও হয়তো, কিন্তু জলজ্যান্ত মানুষের বেলায় কথাটা খাটে কি? মাইকওয়ালা অতিকষ্টে নিজের বিস্ময় দমন করেন—
‘হতে পারে তোমার কাছে এ কাজ তেমন কিছু নয়। তুমি বড়ো হয়ে আরও অনেক বড়ো কাজ করবে। আরও ঢের বেশি বীরত্ব দেখাবে আমরা আশা করি। কিন্তু তাই বলে তোমার এই কাজটিও তেমন ফ্যালনা নয়। তোমার এই আদর্শ—আত্মত্যাগের এই উজ্জ্বল উদাহরণ—আমাদের ছাত্রবন্ধুদের সামনে দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে থাক। এখন, সেই অগ্নিগর্ভে প্রবেশ করবার আগে সেদিনকার তোমার মনের ভাব তখন কেমন হয়েছিল সেই কথা তুমি বলো আমাদের—’
মাইকটাকে তিনি ওর মুখের কাছে এগিয়ে দেন।
পিন্টু ঢোঁক গেলে। জিভ দিয়ে ঠোঁটটা চাটে একবার। কী বলবে ভেবে পায় না।
‘যেমন ধরো, দোকানদারটাকে বঁাচাবার তোমার ইচ্ছে হল। কিন্তু কেন তোমার এমন ইচ্ছে জাগল হঠাৎ?’ শুরু করার ধরতাই হিসেবে কথাটা পিন্টুকে তিনি ধরিয়ে দিতে যান। উসকে দিতে চান।
পিন্টু কিন্তু উসকায় না। অনেক উশখুশ করে অবশেষে সেবলে—‘ওর দোকানে অনেক— অনেক চকোলেট। বিস্তর খেয়েছি আমি। বেশ খেতে।’ বলে নিজের ঠোঁট দুটো ভালো করে আরেকবার সেচেটে নেয়।
‘বেশ তো। চকোলেট খেয়েছ, তার দামও দিয়েছ তেমনি। ধারে খাওনি নিশ্চয়, যে, চকোলেটওয়ালার সেই ঋণ শোধ করবার মানসেই তুমি প্রাণ বিসর্জন দিতে গেছলে? তাকে বঁাচিয়ে তুমি তার যে উপকার করেছ সারা জীবন ধরে সহস্র চকোলেট ধারে খেলেও—অমনি অমনি চাখলেও তার দাম ওঠে না। কী বলেন মশাই, ঠিক বলিনি?’
উদ্ধৃত দোকানদার অদূরেই বসে ছিল। ঘাড় নেড়ে তার সায় দিল, বলতে না বলতেই।
‘পিন্টু সর্বদা নগদ দাম দেয় আমায়। ওর কাছে আমি এক পয়সাও পাইনে।’ একথাও সেজানাল তার ওপর।
‘কিন্তু পিন্টু’, মাইকওয়ালা উদ্ধারককে সম্বোধন করেন এবার, ‘গোটা দোকান যখন দাউদাউ করে জ্বলছে তখন নিশ্চয় তুমি চকোলেট কিনতে যাওনি? চকোলেট দাও বলে তার মধ্যে ঢোকোনি? দোকানদারকে বঁাচাবার জন্যেই গেছলে নিশ্চয়? তা, সেই আগুনের মধ্যে পা বাড়াতে কি তোমার একটুও ভয় করল না তখন?’
‘ভয় কেন? কীসের ভয়? ভয়ের কী আছে?’ পালটা তাকে প্রশ্ন হল পিন্টুর—‘আমি জানতুম আগুনের আঁচটুকুও আমার গায়ে লাগবে না।’
‘জানতে? কী করে জানলে?’
‘কী করে জানলুম? কেন, আপনি কি কোনো অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েননি?’ ভদ্রলোকের অজ্ঞতা দেখে পিন্টুকে অবাক হতে হয়।
‘অ্যাডভেঞ্চারের বই!’ মাইকওয়ালার দুই চোখে দ্বিগুণ বিস্ময়ের চিহ্ন দেখা দেয়।
‘বইয়েই তো! পড়েননি কি, মোহন আগুনের মধ্যে ঢুকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল? অগ্নিশিখারা লকলক করতে লাগল, চারপাশে, কিচ্ছুটি করতে পারল না তার। অনর্থক দাউদাউ করতে থাকল, বাজে বাজেই, কোনো কাজে এল না—তার কেশস্পর্শও করতে পারল না।’ বইয়ের শিক্ষা থেকে লেলিহান শিখাদের পিন্টু সভাস্থলে সবার সামনে টেনে আনে।
‘ও, বই!’ ভদ্রলোক ঢোক গেলেন—‘সেই সব বইয়ের কথা! হ্যাঁ, বইয়ে ওরকম লেখা থাকে বটে। তা, যখন তুমি ঢুকলে, নিজের প্রাণ হাতে করেই ঢুকলে, তখন কি তোমার এক বারও মনে হয়নি যে, মাথার ওপরের জ্বলন্ত চালটা যেকোনো মুহূর্তে তোমার ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়তে পারে?’
‘সেজন্য তো আমি তৈরি ছিলাম।’ পিন্টু অকাতর—অকপট—‘আমি জানতাম সেটা ভেঙে পড়বে। ঠিক সময়েই পড়বে। কিন্তু আমি বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত পড়বে না। আমার বেরোবার আগে নয়।’
‘কী করে জানলে তুমি? অ্যাঁ?’
‘বইয়ের থেকেই জানি। জ্বলন্ত চাল, যতই জ্বলুক—যতই দাউদাউ করুক-না—কক্ষনো ওরকম বেচাল করে না। করতে পারে না। উদ্ধারকারীর ঘাড়ের ওপর ভেঙে পড়ে না কক্ষনো,—ভুল করেও নয়। সব্বাই জানে একথা—আর, আপনি জানেন না?’
‘যাক গে, চালের কথা থাক গে’, বদচালটাকে তিনি পালটান—সেকথা চাপা দেন—‘আচ্ছা, তারপর তোমার আশেপাশে বঁাশগুলো সব ফাটতে লাগল ফটফট করে? তাই না কি?’
‘ফাটবেই, জানা কথা। ওতে আমি একটুও ভড়কাইনি। কেন ঘাবড়াব—বলুন? করুক-না বঁাশরা ফটফট! যত খুশি ওদের। ওদের ছটফটানিতে কী আমার আসে যায়? থোড়াই কেয়ার ওদের ফটফটানিকে। আমি আমার কাজ করব।’
‘আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য!’ মাইকওয়ালার মুখে কথা জোগায় না।—‘আমার দৃঢ়বিশ্বাস, বড়ো হয়ে তুমি আরও ঢের বীরত্বের কাজ করবে। বেড়ে উঠে আমাদের জাতীয় বাহিনীর বীর সৈনিক হবে তুমি। কিংবা সেনাপতিই না কী, কে জানে! লড়াইয়ে গিয়ে কামানের মুখে এগিয়ে ছিনিয়ে নেবে শত্রুর ঘাঁটি। যুদ্ধক্ষেত্রের গোলাবর্ষণকে অগ্রাহ্য করে তোমার আহত বন্ধুদের কুড়িয়ে নিয়ে আসবে মৃত্যুর মুখ থেকে…’
এমনি আরও অনেক কিছুই তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পিন্টু তাঁর কথায় কান দেয় না। মাঝখানে বাধা দিয়ে তাঁর পুঞ্জিত তুলনা এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়—‘সেআর এমন কী শক্ত মশাই? গোলাগুলি কি গায়ে লাগে নাকি কারও? কক্ষনো না। ওরা তো সব যত কানের এপাশ ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। খালি হিসহিস করে যায়, জানেন না?’ অবাক না হয়ে পারে না পিন্টু—‘সেকী, আশ্চর্য, আপনি কি একটাও কোনো অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েননি?’
গুলি তো হজমি গুলি। গুড়ুম গুড়ুম করাই তার কাজ। যেমন গর্জন তেমনি বর্ষণ হলেও ওরকম গোলাগুলি সেগুলে খেয়েছে কত যে!
‘হিস হিস করে? বল কী?’ ভদ্রলোকের সব যেন গুলিয়ে যায়। প্রচন্ড গোলাগুলিদের এককথায় গিলে ফেলা একটু কষ্টকর হলেও, কোনোরকমে তিনি হজম করেন। অগ্নিকান্ডের কথায় ফিরে আসেন ফের—‘সেকথা যাক—এখন সেদিনের কথাই হোক। যখন তুমি দোকানদারকে বঁাচাবার জন্যে এগুলে—’
‘আমি দোকানদারকে বঁাচাতে যাইনি মোটেই। আমি তার চকোলেটদের বঁাচাতে গেছলুম।’ পিন্টু কবুল করে সাফ।
‘অ্যাঁ। চকোলেটদের? কী বললে?’
‘হ্যাঁ। ভাবলাম, অতগুলো চকোলেট অমনি অমনি পুড়ে খাক হয়ে যাবে। মারা যাবে বেঘোরে। তাই—এই ফাঁকে যদি চারটে তাদের সরিয়ে ফেলা যায় মন্দ কী? চেষ্টা করে দেখাই যাক-না।’
‘বটে?…বটে বটে?…তারপর চকোলেটদের বঁাচাতে গিয়ে…?’
‘দোকানে ঢুকে চকোলেটদের দেখতে পেলাম না। একটাকেও না। দেখলাম তার বদলে মূর্তিমান এই দোকানদারকে। একটা বাক্স আঁকড়ে বেহুঁস হয়ে পড়ে আছেন ভদ্রলোক।’
‘তখন তুমি চকোলেটের কথা ভুলে গিয়ে তাঁকেই বঁাচাতে গেলে?’
‘মোটেই না। বাক্সটা তার হাত থেকে ছাড়াতে গেলাম আগে। আমার মনে পড়ল, আগুন লাগলে তো মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাকেই আঁকড়ে ধরে। তাকেই সবার আগে বঁাচাতে যায়। বইয়েই পড়েছিলাম। চকোলেটের চেয়ে প্রিয় জিনিস মানুষের আর কী আছে? এটা নিশ্চয়ই সেই চকোলেটের বাক্সই হবে। এই ভেবেই আমি—কিন্তু এমনি সেসাপটে ধরেছিল বাক্সটা যে, কিছুতেই তার হাত থেকে ছাড়ানো যাচ্ছিল না। কোনোরকমেই সেটাকে বেহাত করতে পারলুম না। দু-চার ঘা লাগালুমও, বেশ জোরে জোরেই—কিন্তু লোকটার হুঁস থাকলে তো! মার খেয়ে মানুষ অজ্ঞান হয়, আর ও কিনা অজ্ঞান হয়ে মার খেল। চোরের মার খেল পড়ে পড়ে। তবু সেতার বাক্স ছাড়ল না কিছুতেই। তখন বাধ্য হয়েই—’
‘বাধ্য হয়ে কী করলে তুমি?’
‘বাক্স সমেত টেনে আনলাম ওকে। আনতে হল বাধ্য হয়েই, করব কী? কান ধরে হিড়-হিড় করে টেনে আনলাম বাইরে…’
‘কান ধরে? কান ধরে কেন?’ মাইকওয়ালা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেন না—‘কেন, লোকটার কি হাত পা কিছু ছিল না?’
সভার সবাই উৎকর্ণ হয়। অদূরে বসা দোকানদারটিও নিজের কান খাড়া করে।
সবার টান-করা কানের দিকে পিন্টু নিজের উত্তরবাণ ত্যাগ করে—
‘ছিল। থাকবে না কেন? আমার হাতের কাছাকাছি ছিল। কিন্তু এমন রাগ হল আমার যে তার কান না মলে পারলাম না। আর কান মলতে গিয়ে—তবে হ্যাঁ, ওর কান ধরে না টেনে গোঁফ ধরেও আনা যেত বই কী। আর সেইটেই হত ঠিক। গোঁফ ধরে টান মারাই উচিত হত, উপযুক্ত শাস্তি হত লোকটার। কিন্তু অমন তাড়াহুড়ার মাথায় কি মাথার ঠিক থাকে? কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, আমি কি ভাবতে পেরেছি তখন? অত দিক খেয়ালই করিনি। সত্যি বলতে, ওর গোঁফের কথা একদম আমার মনেই ছিল না।’ পিন্টুর এখন আপশোস হয়—‘মনে থাকলে কি কেউ কারও কান নিয়ে টানাটানি করে।’
‘তারপর? লোকটাকে বাইরে আনবার পরে?’
‘কোথায় চকোলেট!’ পিন্টুর গোমড়া মুখে আরও বেশি গাঢ় গুমোট দেখা দেয়—‘বাক্সের মধ্যে খালি টাকা আর পয়সা! নোটের তারা কেবল! চকোলেটের ছিটেফোঁটাও নেই।’
বীরত্বের চূড়া থেকে বিরক্তির চরমে ওঠে পিন্টু। ঢের হয়েছে, ঢের সেসয়েছে—আর নয়! এতক্ষণ ধরে এমনধারা আদিখ্যেতা বরদাস্ত করা যায় না। বিকৃত মুখে বুকের মেডেলটাকে খুলে নিয়ে অবহেলায় সেহ্যাফপ্যান্টের পকেটে গুঁজে দেয়। তারপরে বিড়ম্বিত মুখ তুলে বলে—
‘এমন জানলে কি আমি এক পা এগুতাম?’ মাইক দূরে সরিয়ে পিন্টু তখন একেবারে অমায়িক—‘ধারে একটা লজেঞ্জুসও দেয় না, কে বঁাচাতে যেত ওই হতভাগাকে?’
‘আর…আর…’, তারপরেও পিন্টুর অনুযোগের থাকে—‘বইয়ের সব কথাই কিছু ঠিক নয়। আগুন লাগলে মানুষ যে তার প্রাণের জিনিসটাকেই আঁকড়ে ধরবে তারও কোনো মানে নেই।’