দুগ্ধপানের ইতিহাস

দুগ্ধপানের ইতিহাস

আমাকেও যে একদিন ঘটি ঘটি দুধ গিলতে হবে তা আমি কখনো ভাবিনি।

কিন্তু বিনি-ঘটিত ঘটনাচক্র এমনি যে—

‘দুগ্ধং পিবতি বিড়ালঃ’ পাঠ্যবইয়ের এই কথা পড়ার পর থেকে দুধকে আমি বিড়ালের মতোই দুশো হাত দূরে হটিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু বিনি একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করল যে আমার শরীর নাকি ক্রমেই আরও কাহিল হচ্ছে। আর শরীর সারাতে হলে দুধের মতন আর হয় না।

কোন বইয়েই নাকি পড়েছিল ও। যে শরীর সারাবার জন্যে বাইরে আমরা চেঞ্জে যাই, সেই চেঞ্জই ঘরে বসে আমরা পেতে পারি রোজ রোজ দুধ খাই যদি। দুধ আমাদের ভেতরে ভেতরে চেঞ্জ আনে। ভেতর থেকে বদলায়। তিলে তিলে বদলে দিতে থাকে—শেষে একদিন আমরা তেলতেলে হয়ে দেখা দিই। দেহের তালগোল পাকাতে দুধের নাকি আর জুড়ি নেই।

‘দুধ খাও দাদা।’ সাধল বিনি—‘তোমার চেহারা ফিরে যাবে! আরেক চেহারা দেখা দেবে, দেখে নিয়ো। এমন শ্রী হবে শরীরের—সারা গা চকচক করবে কান্তিতে—তুমি মাস দুয়েক তো খেয়ে দ্যাখো। না যদি হয় তো আমার কানটি তখন কেটে নিয়ো।’ বলে বিনি নিজের কান টেনে দেখায়।

কানের জন্যেও না, কান্তির লোভেও নয়, মাস দুয়েকের ধাক্কা মনে করে সইতে আমি রাজি হলাম। অকারণে বোনের মনে ব্যথা দিতে প্রাণ চাইল না।

বিনির কথা মিছে নয়, চকচকে চেহারাটা গোড়াতেই দেখা গেল। দেখলাম সেই গোয়ালার। নাদুসনুদুস এক চাকচিক্য সারা দেহে বয়ে নিয়ে সেএল। তার খাঁটি দুধের সার্টিফিকেট রূপেই, বলা বাহুল্য!

কথা হল, দু-মাস রোজ দু-সের করে দুধ দেবে। খাঁটি দুধ। দাম নেবে মাসকাবারে।

আমি বিনিকে বললাম—না, দু-মাসকাবারে। সেই কথাই ওকে বলে দে। দুধ খাওয়ার ফলটা আগে হাতে হাতে পাই।

ওর মতন চাকচিক্য হয় কি না দেখে নিই, নইলে চকচকে টাকাগুলো ওর হাতে শুধু শুধু তুলে দিতে যাব কেন?

তাতেই রাজি গোয়ালা। ‘দাম কিন্তু পানসিকি বাবু। খাঁটি দুধ মাগছেন হাপনারা। সেরভর খাঁটি দুধ পানসিকির কোমে হোবে না। হেমনি হামরা এক টাকা সের বেচি—সে-দুধ কিন্তু তেমোন খাঁটি না হুজুর।’

আড়াই টাকার দুধ খাব রোজ? শুনতেই আমার যা খারাপ লাগে। অত পয়সার বাজে খরচা খালি। ওই টাকার আলুকাবলি, ডালমুট, ঝালমুড়ি, ঝুরিভাজা, চীনেবাদাম এসব খেলে কাজ দেয়। আর, খেতেও কত ভালো! আহা!

বিনি কিন্তু নারাজ নয়। সেশুধু বলে, ‘দাম কিন্তু সেই দু-মাস পরে, বুঝেছ বাপু?’

‘হাপনারা ভোদ্দোর আদমি। দুধ খেয়ে কি হাপনারা পালিয়ে যাবন? দাম দিবন না? সো-ভয় হামরা কোরি না দিদিমণি।’

গোয়ালা চলে গেলে বিনি একটু আপশোস করে—‘আহা, এখন আমের সময় নয়। নইলে আমে আর দুধে মিশিয়ে খেলে যা একখানা স্বাস্থ্য হত—আহা! দেখবার মতোই। তা, তা না হোক, শুধু দুধ খেলেও কিছু কম হবে না। এই দুধেই দেখো, তোমার এই ছিরি বদলে কী চেহারা দেখা দেয়!’

দিলও দেখা। ক-দিন না যেতেই চোখের কোণে কালি দেখা দিল। চোখের কোল ভাঙল। চোখের কালি উঠতে না উঠতে গালের খানিকটা খালি হয়ে গেল। ভাটপাড়ার মতন, টোল পড়ল গালে।

রোজ দু-সের দুধ খাই—দিনে চার বার। সকালের প্রাতরাশে, দুপুরে একরাশ ভাত গেলার পর, বিকেলের জলখাবারে আর রাতে শোবার আগে।

প্রতি বারে আধসের করে। আর বাথরুমে যাই সাত বার। রাতদিন ধরে।

ভাগ্যিস, এটা আমের সময় নয়। নইলে আমের রসের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে—বিনি বলেছিল, আমায় নাকি আর দেখতে হত না। কিন্তু তাতেই-বা কী, আম না খেলেও কি রেহাই আছে? এমনিতেই একদিন আমাশা এসে গেল।

ফলে গেল বিনির কথাটা। আরেক চেহারা দেখা দিল, সত্যিই!

চেহারাটা ডাক্তারের।

ডাক্তার দেখা দিলেন এবং দেখলেন। দেখেশুনে একটা ব্যবস্থাপত্রও বাতলালেন। দুধকে ‘কমন’ রেখে সাবু-বার্লির সঙ্গে মিশিয়ে, কিংবা শঠিফুডের সঙ্গে পটিয়ে খেতে বললেন আমায়।

সসংকোচে আমি শুধোলেম—‘দুধকেই তো আপনি পথ্য করছেন। কিন্তু একটা কথা ভেবেছেন কি? দুধটাই কি আসলে আমার ব্যাধি হতে পারে না?’

কেননা ভেবে দেখলে, দুধ যেমন মানুষের খাদ্য—মানুষও তেমনি দুধের খাদ্য হতে পারে। আমরা যেমন দুধ মারি, দুধও তেমনি মারতে পারে আমাদের। আর কিছু না হোক, নিছক প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার লালসাতেও তো? ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি মানুষেরই একচেটে নয়। আমাদের মধ্যেই জড়ো হয়ে নেই, জড়বস্তুর মধ্যেও তা জড়িয়ে থাকতে পারে। খাদ্যও একেক সময়ে খাদক হয়ে ওঠে।

আমার কথা শুনে ডাক্তার বললেন—‘ও কিছু না। অনভ্যস্ত পেটে দুধ পড়লে প্রথম প্রথম অমনটা হয়। পেট নামে, আমাশা দেখা দেয়। শরীরও একটু কাহিল হতে পারে। প্রথম চোটটা কেটে যাবার পর ওই দুধেই তখন গড়ে তোলে আবার। ওই দুধ খেয়েই শরীর সারে তখন! দুধের মতন ‘কমপ্লিট ফুড’ কি আর আছে মশাই?’

শুনে বিনি লাফিয়ে উঠল—‘কেমন? কী বলেছিলাম?’

তারপর বিনির উৎসাহ যেন বেড়ে গেল আরও। আরও তার চাড় দেখা গেল দুধ খাওয়াবার। আরও সের খানেক দুধ বাড়িয়ে দিল সে। পড়ে পড়ে দুধের মার খেতে লাগলাম—নিজের বোনের হাতে।

দুধটা চড়া দরের বলেই কিনা কে জানে, বোনের আদরে পেট চড়চড় করতে লাগল।

দুখ খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেল আমার।

‘জিজ্ঞেস করিস তো গোয়ালাকে’, বিনিকে আমি বললাম একদিন—‘কোথাকার দুধ সেনিয়ে আসে। তার নিজের গোয়ালের, না কি পদ্মাপারের কোনোখান থেকে আনা?’

‘পদ্মাপার থেকে দুধ আনতে যাবে ও?’ বিনি অবাক হয়—‘কেন, এদেশে কি গোরু নেই?’

‘মনে হচ্ছে পাকিস্তানের আমদানি। নইলে পেট এমন চড়চড় করছে কেন?’

‘পেট চড়চড় করছে? সেকী?’

‘তাই তো বলছিলাম—ওর গোয়ালের নয়, গোয়ালন্দের বোধ হয়। চরাটরা সব ও-ধারেই পড়ে বলে শুনেছি।’

‘চর তো নয়, দুধের সর!’ কার বইয়ে আমি পড়েছিলাম যেন। সেকথাটাও ওকে জানাই।

‘কই, সর তো তেমন পড়ে না তোমার দুধে। জল খুব মেশাচ্ছে মনে হয়, দাঁড়াও, দেখি তো।’ বলে বিনি এক ছুটে পাশের বাড়ি থেকে ল্যাকটোমিটার যন্ত্রটা নিয়ে আসে। দুধ পরীক্ষায় লাগে।

‘তাইতো বলি!’ বলে ওঠে বিনি—‘সবটাই তো জল দেখছি এর! প্রায় তিন ভাগের ওপর!’

‘আহা, তাইতো হবে রে!’ আমি বাতলাই—‘দুধের মধ্যে জল থাকবে না? দুধ হচ্ছে পৃথিবীর মতোই—তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। কিন্তু পৃথিবীর মতো তার স্থলরেখা তেমন স্পষ্ট করে দেখা যায় না। জলে-স্থলে একাকার। কিন্তু পেটে গিয়ে যখন চাড় মারে, পেট ভার হয়, তখনই আমরা টের পাই। দিনের পর দিন পেট ভারী হয়ে হয়ে ক্রমে পেটের ভুঁড়ি নামে। আর তাই হচ্ছে দুধের স্থলভাগ। দুধ খেলে গোড়ার দিকে পেট নামে, বলছিল-না ডাক্তার? কিন্তু শেষের দিকেও পেট নামে আবার। সেই হচ্ছে ভুঁড়ি। ভূরি ভূরি দুধ খাবার ফল। ভেবে দ্যাখ, ভুঁড়ি আসলে পেট নামানো ছাড়া কী?’

‘জল মেশাচ্ছে ব্যাটা, দাঁড়াও।’

‘তা তো মেশাবেই। দুধে জল মেশানো গোয়ালাদের দস্তুর। তবে কলকাতার কলের জল না আমাদের পদ্মার জল সেইটেই বিবেচ্য। সেইখানেই আমার ভাবনা। কারণ শুনেছি পদ্মার জলেই যত চরা পড়ে। মনে হচ্ছে আমার পেটেও পড়ছে।’

‘দাঁড়াও, দেখাচ্ছি ব্যাটাকে।’ বলে বিনি বেরিয়ে গেল। বাজার থেকে ইয়া ইয়া দুটো বালতি কিনে আনল।—‘ওর দুধের ব্যবস্থা করলাম।’ বালতিগুলো দেখিয়ে বলল।

‘ও বাবা, এতদিন তো ঘটি ঘটি খেয়েছি, এবার কি বালতি বালতি গেলাবি নাকি? তাহলে আর সত্যিই আমায় দেখতে হবে না—বিড়াল হতে তো পারব না, বিরল হতে হবে আমায়।’

বালতি দেখে সেই যে আমি শুয়ে পড়লাম, বিছানা ছাড়লাম মাস দুয়েক পর।

গোয়ালা দুধের দাম নিতে এল।—‘একশো ছওবিশ রুপেয়া, নে আনা, ছে পাই!’

একশো ছাব্বিশ টাকা! অ্যাঁ? বলে কী? নয় আনা ছয় পাইয়ের জন্যে ভাবিনে—শরীরটাই তো নয়-ছয় হয়েছে, কিন্তু এই একশো ছাব্বিশ টাকা—কোত্থেকে আসে এখন?

বিনি বলে, ‘ভাবতে হবে না তোমায় তার ব্যবস্থা আমি করেচি।’ বলে গোয়ালাকে ছাব্বিশ টাকা সাড়ে ন আনা গুনে দেয়। নগদ। তারপর বড়ো বড়ো বালতি দুটো করে দু-বালতি জল ভরে আনে—‘এই নাও তোমার দুধের দাম।’

গোয়ালা হাঁ করে থাকে।

‘যেটুকু দুধ পেয়েছি তার দাম ওই ছাব্বিশ টাকা। বাকিটা তো খালি জল দিয়েছ। সেটাও তোমায় ফিরিয়ে দিলাম এই।’ বলে বিনি কথাটা গোয়ালার কাছে জলের মতো পরিষ্কার করে দেয়।—‘কিছু মনে কোরো না বাপু, তোমাকে একটু শিক্ষা দিলাম কেবল।’

গোয়ালা সমঝদার লোক। শক্ত পাল্লায় পড়েছে যে, সেটা বেশ বুঝতে পারে। শেষটায় সেশুধু শুধোয়—‘বালতি ভি? বালতি ভি তো দিচ্ছ দিদিমণি?’

‘বালতি দুটোও চাও? তা, নেবে নাও গে বালতি।’ সমস্যাটা এত সহজে, বিনা গোলমালে মিটে যেতে দেখে সেবুঝি একটু উদার হয়ে ওঠে।

আমি গোয়ালাকে কিঞ্চিৎ সান্ত্বনা দেবার চেষ্ট করি—‘দ্যাখো গোয়ালাজি! দুধ তো আসলে খড়ের রূপান্তর?—কেয়া, রূপান্তর সমঝতা নেহি? মানে, খড়েরই আউর এক কিসিম! গোরু খড় খাতা হ্যায়, ওহি খড়মে দুধ বনতা হ্যায়। কুছভি মেহনত নেহি—আপ সেবন যাতা। দো আনাকে খড় খাকে গোরু দশ রুপেয়াকে দুধ দেতা—কাজেই বুঝতেই পারছ, ছাব্বিশ টাকায় দুধের দাম না উঠলেও খড়ের দামটা তোমার পুষিয়ে গেছে—।’

‘হাঁ বাবু, খড়ির দামঠো হামার মিলেছে ঠিক। দুধ তো হামি দেই না, খড়ি গুলে পানিসে মিলিয়ে—ও বাত ঠিক হ্যায়।…আউর সাচ বোলে তো, এহি দোনো বালতিই হমারা নাফা।’ বলে বিনিকেও একটা শিক্ষা দিয়ে বালতি হাতে হাসতে হাসতে সেচলে যায়।

তখন আমি বুঝি যে দুধের খরিদ্দার বলতে কী বোঝায়! আর বুঝতে পারি আমার সারা গায়ে এত খড়ি উঠছে কেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *