আমার ভালুক শিকার
তোমরা আমাকে গল্প-লেখক বলেই জানো। কিন্তু আমি যে একজন ভালো শিকারি, এ খবর নিশ্চয়ই তোমাদের জানা নেই। আমি নিজেই এ কথা জানতাম না, শিকার করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত!
(আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, কোথায় নাকি দশ-বারো বছরের ছেলেরা, দশ-বারো হাত বাঘ শিকার করে ফেলেছে। আজকের এই জুলাইয়ের খবরের কাগজেই তোমরা দেখবে একটা সাত বছরের ছেলে ন-ফিট বাঘ সাবাড় করে দিয়েছে। বাঘটার উপদ্রবে গ্রামসুদ্ধ লোক ভীত, সন্ত্রস্ত। কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিল না। ভাগ্যিস সেখানকার তালুকদারের একটা ছেলে ছিল এবং আরও সৌভাগ্যের কথা যে বয়স ছিল মোটে বছর সাত, তাই গ্রামবাসীদের বাঘের কবল থেকে এত সহজে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হল।
তোমরা হয়তো বলবে যে, ছেলেটার ওজনের চেয়ে বন্দুকের ওজনই যে ভারী। তা হতে পারে, তবু এ কথা আমি অবিশ্বাস করি না, বিশেষ করে যখন খবরের কাগজে ছাপার অক্ষরে চোখে দেখেছি। আমার ভালুক শিকারের খবরটাও কাগজে দেখেছিলাম—তারপর থেকেই তো ঘটনাটায় আমার দারুণ বিশ্বাস হয়ে গেছে। প্রথমে আমি ধারণা করতেই পারিনি যে আমিই ভালুকটাকে মেরেছি, এবং ভালুকটারও মনে যেন সেই সন্দেহ বরাবর ছিল মনে হয়, মরার আগে পর্যন্ত। কিন্তু যখন খবরের কাগজে আমার শিকার কাহিনি নিজে পড়লাম, তখন নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে অমূলক ধারণা আমার দূর হল। ভালুকটার সন্দেহ বোধকরি শেষ অবধি থেকেই গেছল, কেন-না খবরের কাগজটা চোখে দেখার পর্যন্ত তার সুযোগ হয়নি—কিন্তু না-হোক, সেনিজেই দূর হয়ে গেছে।)
সেই রোমাঞ্চকর ঘটনাটা এবার তোমাদের বলি: আমার মাসতুতো বড়দা সুন্দরবনের দিকে জমি-টমি নিয়ে চাষ-বাস শুরু করেছেন। সেদিন তাঁর চিঠি পেলাম—‘এবার গ্রীষ্মটা এ ধারেই কাটিয়ে যাও না, নতুন জীবনের আস্বাদ পাবে, অভিজ্ঞতাও বেড়ে যাবে অনেক। সঙ্গে করে কিছুই আনতে হবে না, কয়েক জোড়া কাপড় এনো।’
আমি লিখলাম—‘যেতে লিখেছ যাব না-হয়। কিন্তু কাপড় নিয়ে যেতে হবে কেন বুঝতে পারলাম না। আমার সুটকেসে তো দু-খানার বেশি ধরবে না, এবং বাড়তি বোঝা বইতে আমি নারাজ! আর তা ছাড়া এই সেদিনই তো তুমি কলকাতা থেকে বারো জোড়া কাপড় নিয়ে গেছ! অত কাপড় সেখানে কী কর? বউদি নিশ্চয়ই ধুতি পরা ধরেননি। তোমার কাপড়েই আমার চলে যাবে—তুমি তো একলা মানুষ, বাপু!’
দাদা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন—‘আর কিছু না, বাঘের জন্য।’
আমার সবিস্মিত পালটা জবাব গেল—‘সেকি! বাঘে ছাগল গোরুই চুরি করে শুনেছি, আজকাল কাপড়-চোপড়ও সরাচ্ছে নাকি? কাপড়-চোপড়ের ব্যবহার যখন শিখেছে, তখন তারা রীতিমতো সভ্য হয়েছে বলতে হবে!’
দাদা উত্তর দিলেন—‘চিঠিতে অত বকতে পারি না। আমার এখানে এসে তোমার কাপড়ের অভাব হবে না, এ কথা নিশ্চয়ই—কিন্তু যে কাপড় তোমাকে আনতে বলেছি, তার দরকার পথেই। চিড়িয়াখানার বাঘই দেখেছ, আসল বাঘ তো কোনোদিন দেখনি, আসল বাঘের হুহুঙ্কারও শোনোনি। চিড়িয়াখানার ওগুলোকে বেড়াল বলতে পার। সুন্দরবন দিয়ে স্টিমারে আসতে দু-পাশের জঙ্গলে বাঘের হুঙ্কার শোনা যায়, শোনামাত্রই কাপড় বদলানোর প্রয়োজন অনুভব করবে। প্রায় সকলেই সেটা করে থাকেন। যত ঘন ঘন ডাকবে, (ডাকাটা অবশ্য তাদের খেয়ালের ওপর নির্ভর করে) তত ঘন ঘনই কাপড়ের প্রয়োজন। তবে তুমি যদি খাকি প্যান্ট পরে আস, তাহলে দরকার হবে না।’
অতঃপর চব্বিশ জোড়া কাপড় কিনে নিয়ে আমি সুন্দরবন গমন করলাম।
আমার মাসতুতো দাদাও একজন বড়ো শিকারি। এ তথ্যটা আগে জানতাম না; এবার গিয়ে জানলাম। শুধু হাতেই অনেক দুর্ধ্বর্ষ বাঘকে তিনি পটকে ফেলেছেন। বন্দুক নিয়েও শিকারের অভ্যাস তাঁর আছে, কিন্তু সেরকম সুযোগে তিনি বন্দুককে লাঠির মতো ব্যবহার করতেই ভালোবাসেন। তাঁর মতে কেঁদো বাঘকে কাঁদাতে হলে বন্দুকের কুঁদোই প্রশস্ত—গুলি করা কোনো কাজের কথাই নয়। কিছুদিন আগে এক বাঘের সঙ্গে তাঁর বড়ো হাতাহাতি হয়ে গেছল, তাঁর নিজের মুখেই আমার শোনা। বাঘটার অত্যাচার বেজায় বেড়ে গেছল, সমস্ত গ্রামটার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটাত ব্যাটা, এমনকী তাদের স্বপ্নের মধ্যে এসে হানা দিত পর্যন্ত!
দাদার নিজের ভাষাতেই বলি:— ‘তারপর তো ভাই বেরোলাম বন্দুক নিয়ে। কী করি, সমস্ত গ্রামের অনুরোধ। ফেলা তো যায় না—একাই গেলাম। সঙ্গে লোকজন নিয়ে শিকারে যাওয়া আমি পছন্দ করি না। একবার অনেক লোক সঙ্গে নিয়ে গিয়ে যা বিপদে পড়েছিলাম, কী বলব! বাঘ করল তাদের তাড়া তারা এসে পড়ল আমার ঘাড়ে; মানুষের তাড়ায় প্রাণে মারা যাই আর কি! গেলাম। কিছুদূর যেতেই দেখি সামনে বাঘ, বন্দুক ছুঁড়তে গিয়ে জানলাম টোটা আনা হয়নি—আর সেবন্দুকটা এমন ভারী যে তাকে লাঠির মতও খেলানো যায় না। কী করি, বন্দুক ফেলে দিয়ে শুধু হাতেই বাঘের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। জোর ধস্তাধস্তি, কখনো বাঘ ওপরে আমি নীচে, কখনো আমি নীচে বাঘ ওপরে—বাঘটাকে প্রায় কাবু করে এনেছি এমন সময়ে—’
আমি রুদ্ধ-নিশ্বাসে অপেক্ষা করছি, বউদি বাধা দিয়ে বললেন—‘এমন সময়ে তোমার দাদা গেলেন তক্তপোশ থেকে পড়ে। জলের ছাঁট দিয়ে, হাওয়া করে, অনেক কষ্টে ওঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনি। মাথাটা গেল কেটে, তিন দিন জলপটি দিতে হয়েছিল।’
এরপর দাদা বারো দিন আর বউদির সঙ্গে বাক্যালাপ করলেন না এবং মাছের মুড়ো সব আমার পাতেই পড়তে লাগল।
দাদা একদিন চুপিচুপি আমায় বললেন—‘তোমার বউদির কীর্তি জানো না তো! খুকিকে নিয়ে পাশের জঙ্গলে জাম কুড়োতে গিয়ে, পড়েছিলেন এক ভালুকের পাল্লায়। খুকিতো পালিয়ে এল, উনি ভয়ে জবু-থবু হয়ে, একটা উইয়ের ঢিপির উপর বসে পড়ে এমন চেঁচামেচি আর কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন যে, ভালুকটা ওঁর ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল।’
আমি বললাম—‘ওঁর ভাষা না বুঝতে পেরে হতভম্ব হয়ে গেছল, এমনও তো হতে পারে?’
দাদা বিরক্তি প্রকাশ করলেন—‘হ্যাঁ:! ভারি ত ভাষা! প্রত্যেক চিঠিতে দুশো করে বানান ভুল!’
বউদির পক্ষ সমর্থন করতে আমাকে, অন্ততঃ মাছের মুড়োর কৃতজ্ঞতাসুত্রেও বলতে হল,—‘ভালুকরা শুনেছি সাইলেন্ট ওয়ার্কার বক্তৃতা-টক্তৃতা ওরা বড়ো পছন্দ করে না। কাজেই বউদি ভালুক তাড়াবার ব্রহ্মাস্ত্রই প্রয়োগ করেছিলেন, বুঝলে দাদা?’
দাদা কোনো জবাব দিলেন না, আপন মনে গজরাতে লাগলেন। বউদির তরফে আমার ওকালতি শুনে তিনি মুষড়ে পড়লেন, কী ক্ষেপে গেলেন, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কিন্তু সেদিন বিকেলেই তাঁর মনোভাব টের পাওয়া গেল। দাদা আমাকে হুকুম করলেন পাশের জঙ্গল থেকে এক ঝুড়ি জাম কুড়িয়ে আনতে—সেই জঙ্গল, যেখানে বউদির সঙ্গে ভালুকের প্রথম দর্শন হয়েছিল।
দাদার গরহজম হয়েছিল, তাই জাম খাওয়া দরকার, কিন্তু আমি দাদার ডিপ্লোমেসি বুঝতে পারলাম। আমাকে ভালুকের হাতে ছেড়ে দিয়ে, আমাকে সুদ্ধ বিনা আয়াসে হজম করবার মতলব। বুঝলাম বউদির পক্ষে যাওয়া আমার ভালো হয়নি। আমতা-আমতা করছি দেখে দাদা বললেন—‘আমার বন্দুকটা না হয় নিয়ে যা, কিন্তু দেখিস, ভুলে ফেলে আসিস না যেন।’
ওঃ, কী কুটচক্রী আমার মাসতুতো বড়দা! ভালুকের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করা বরং আমার পক্ষে সম্ভব হতে পারে, কিন্তু বন্দুক ছোঁড়া—? একলা থাকলে হয়তো দৌড়ে পালিয়ে আসতে পারব, কিন্তু ওই ভারী বন্দুকের হ্যান্ডিক্যাপ নিয়ে দৌড়তে হলে সেই রেসে ভালুকই যে প্রথম হবে, এ বিষয়ে আমার যেমন সন্দেহ ছিল না, দেখলাম দাদাও তেমনি স্থির-নিশ্চয়।
দাদা জামের ঝুড়ি আর বন্দুকটা আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বললেন—‘চট করে যা, দেরি করিসনি। তোর ভয় কচ্ছে নাকি?’
অগত্যা আমায় বেরুতে হল। বেশ দেখতে পেলুম, আমার মাসতুতো বড়দা আড়ালে একুট মুচকি হেসে নিলেন। মাছের-মুড়োর বিরহ তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। না:, এই বিদেশে বিভুঁয়ে মাসতুতো ভাইয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে ভালো করিনি। খতিয়ে দেখলাম, ওই চব্বিশ জোড়া কাপড়ই বড়দার নেট লাভ।
বেরিয়ে পড়লাম। এক হাতে ঝুড়ি, আর এক হাতে বন্দুক। নিশ্চয়ই আমাকে খুব বীরের মত দেখাচ্ছিল। যদিও একটু বিশ্রী রকমের ভারী, তবু বন্দুকে আমায় বেশ মানায়। ক্রমশ মনে সাহস এল—আসুক না ব্যাটা ভালুক, তাকে দেখিয়ে দিচ্ছি এবং বড়দাকেও! মাসতুতো ভাই কেবল চোরে-চোরেই হয় না, শিকারিতে-শিকারিতেও হতে পারে! উনিই একজন বড়ো শিকারি, আর আমি বুঝি কিছু না?
বন্দুকটা বাগিয়ে ধরলাম। আসুক না ব্যাটা ভালুক এইবার! ঝুড়িটা হাতে নেওয়ায় যতটা মনুষ্যত্বের মর্যাদা লাঘব হয়েছিল, বন্দুকে তার ঢের বেশি পুষিয়ে গেছে। আমাকে দেখাচ্ছে ঠিক বীরের মতো। অথচ দুঃখের বিষয়, এই জঙ্গল পথে একজনও দেখবার লোক নেই। এ সময়ে একটা ভালুককে দর্শকের মধ্যে পেলেও আমি পুলকিত হতাম!
বন্দুক কখনো যে ছুঁড়িনি তা নয়। আমার এক বন্ধুর একটা ভালো বন্দুক ছিল, হরিণ-শিকারের উচ্চাভিলাষ বশে তিনি ওটা কিনেছিলেন। বহুদিনের চেষ্টার ও পরিশ্রমে তিনি গাছশিকার করতে পারতেন। তিনি বলতেন—গাছ-শিকারের অনেক সুবিধে; প্রথমত গাছেরা হরিণের মতো অত দৌড়ায় না, এমনকী ছুটে পালাবার বদভ্যাসই নেই ওদের, দ্বিতীয়ত—ইত্যাদি, সেবিস্তর কথা। তা, তিনি সত্যিই গাছশিকার করতে পারতেন—অন্তত বাতাস একটু জোর না বইলে, উপযুক্ত আবহাওয়ায় এবং গাছটাও হাতের কাছে হলে, তিনি অনায়াসে লক্ষ ভেদ করতে পারতেন—প্রায় প্রত্যেক বারই।
আমিও তাঁর সঙ্গে গাছ-শিকার করেছি, তবে যে কোনো গাছ আমি পারতাম না। আকারে-প্রকারে কিছু বড়ো হলেই আমার পক্ষে সুবিধে হত, গুঁড়ির দিকটাতেই আমার স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। বৃক্ষশিকারে যখন এতদিন হাত পাকিয়েছি, তখন ঋক্ষশিকারে যে একেবারে বেহাত হব না, এ ভরসা আমার ছিল।
জঙ্গলে গিয়ে দেখি পাকা পাকা জামে গাছ ভরতি! জাম দেখে জাম্ববানের কথা আমি ভুলেই গেলাম। এমন বড়ো বড়ো পাকা পাকা খাসা জাম! জিভ লালায়িত হয়ে উঠল। বন্দুকটা একটা গাছে ঠেসিয়ে, দু-হাতে ঝুড়ি ভরতে লাগলাম। কতক্ষণ কেটেছে জানি না, একটা খস খস শব্দে আমার চমক ভাঙল। চেয়ে দেখি—ভালুক!
ভালুকটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমি যা করছি সেও তাতেই ব্যাপৃত! একহাত দিয়ে জামের একটা নীচু ডালকে সেবাগিয়ে ধরেছে, অন্য হাতে নির্বিচারে মুখে পুরছে—কাঁচা ডাঁসা সমস্ত। আমি বিস্মিত হলাম বললে বেশি বলা হয় না! বোধ হয়, আমি ঈষৎ ভীতই হয়েছিলাম। হঠাৎ আমার মনে হল, ভালুক দর্শনের বাঞ্ছা একটু আগেই করেছি বটে, কিন্তু দেখা না পেলেই যেন আমি বেশি আশ্বস্ত হতাম। ঠিক সেই মারাত্মক মুহূর্তেই আমাদের চারি চক্ষুর মিলন!
আমাকে দেখেই ভালুকটা জাম খাওয়া স্থগিত রাখল এবং বেশ একটু পুলকিত-বিস্ময়ের সঙ্গে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। আমি মনে মনে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলাম। গাছে উঠতে পারলে বাঘের হাত থেকে নিস্তার আছে কিন্তু ভালুকের হাতে কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ভালুকেরা গাছে উঠতেও ওস্তাদ।
অগত্যা শ্রেষ্ঠ উপায়ে—পালিয়ে বঁাচা। বন্দুক ফেলে যেতে দাদার নিষেধ; বন্দুকটা বগল দাবাই করে চোঁচা দৌড় দেবার মতলব করছি, দেখলাম সেও আস্তে আস্তে আমার দিকে এগুচ্ছে। আমি দৌড়লেই যে সেআমার পিছু নিতে দ্বিধা বোধ করবে না, আমি তাকে বুঝতে পারলাম। ভালুক জাতির ব্যবহার আমার মোটেই ভালো লাগল না।
আমি দৌড়চ্ছি, ভালুকও দৌড়চ্ছে। বন্দুকের বোঝা নিয়ে ভালুক দৌড়ে আমি সুবিধে করতে পারব না বুঝতে পারলাম। যদি এখনও বন্দুকটা না ফেলে দিই, তাহলে নিজেকেই এখানে ফেলে যেতে হবে। অগত্যা অনেক বিবেচনা করে বন্দুককেই বিসর্জন দিলাম।
কিছুদূর দৌড়ে ভালুকের পদশব্দ না পেয়ে ফিরে তাকালাম। দেখলাম সেআমার বন্দুকটা নিয়ে পড়েছে। ওটাকে নতুন রকমের কোনো খাদ্য মনে করেছে কি না ওই জানে! আমিও স্তব্ধ হয়ে ওর কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিলাম।
ভালুকটা বেশ বুদ্ধিমান। অল্পক্ষণেই সেবুঝতে পারল ওটা খাদ্য নয়, হাতে নিয়ে দৌড়োবার জিনিস। এবার বন্দুকটা হস্তগত করে সেআমাকে তাড়া করল। বিপদের ওপর বিপদ—এবার আমার বিপক্ষে ভালুক এবং বন্দুক। ভালুকটা কী রকম শিকারি আমার জানা ছিল না। বন্দুকে ওর হাত অন্তত আমার চেয়ে খারাপ নয় বলেই আমার আন্দাজ।
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। কয়েক লাফ না যেতেই পেছনে বন্দুকের আওয়াজ। আমি চোখ কান বুজে সটান শুয়ে পড়লাম—যাতে গুলিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়—যুদ্ধের তাই রীতি কিনা! তারপর আবার দুড়ুম! ‘আবার সেই বন্দুক গর্জন! আমি দুরু দুরু বক্ষে শুয়ে শুয়ে দুর্গানাম করতে লাগলাম। ভালুক-শিকার করতে এসে ভালুকের হাতে না ‘শিকৃত’ হয়ে যাই।
আমি চোখ বুজেও যেন স্পষ্ট দেখছিলাম, ভালুকটা আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার গুলিতে আমি হতাহত—অন্তত একটা কিছু যে হয়েছি, সেবিষয়ে সেনি:সন্দেহ। গুলির আঘাতে না যাই, ভালুকের আঘাতে এবার গেলাম! মৃত্যুর পূর্বক্ষণে জীবনের সমস্ত ঘটনা বায়স্কোপের ফিলমের মত মনশ্চক্ষের ওপর দিয়ে চলে যায় বলে একটা গুজব শোনা ছিল। সত্যিই তাই—একেবারে হুবহুব! ছোটোবেলার পাঠশালা পালানো, আম্র-শিকার শুরু করে আজকের ভালুক শিকার পর্যন্ত—প্রায় চারশো পাতার একাট মোটা সচিত্র জীবনস্মৃতি আমার মনে মনে ভাবা, লেখা ছাপানো, প্রুফ কারেক্ট করা—এমনকী তার পাঁচ হাজার কপি বিক্রি অবধি শেষ হয়ে গেল।
জীবনস্মৃতি রচনার পর আত্মীয়স্বজনের কথা আমার স্মরণে এল। পরিবার আমার খুব সামান্যই—একমাত্র মা এবং একমাত্র ভাই— সুতরাং সেদুশ্চিন্তার সমাধান করাও খুব কঠিন হল না। এক সেকেণ্ড—দু-সেকেণ্ড—তিন—চার—পাঁচ সেকেণ্ড—এর মধ্যে এত কান্ড হয়ে গেল, কিন্তু ভালুক ব্যাটা এখনো এসে পৌঁছোল না তো! কী হল তার? এতটা দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কী?
ঘাড়টা ফিরিয়ে দেখি, ওমা, সেও যে সটান চিৎপাত! সাহস পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম—এ ভালুকটা তো ভারি অনুকরণপ্রিয় দেখছি। কিছু নড়ে না চড়ে না যে! কাছে গিয়ে দেখলাম, নিজের বন্দুকের গুলিতে নিজেই মারা গেছে বেচারা! বুঝলাম, অত্যন্ত মনক্ষোভেই এই অন্যায়টা সেকরেছে! প্রথম দিন বউদির ব্যবহারে সেলজ্জা পেয়েছিল, আজ আমার কাপুরুষতার পরিচয়ে সেএতটা মর্মাহত হয়েছে যে আত্মহত্যা করা ছাড়া তার উপায় ছিল না।
বন্দুক হাতে সগর্বে বাড়ি ফিরলাম। আমার জাম-হীনতা লক্ষ করে দাদার অসন্তোষ প্রকাশের পূর্বেই ঘোষণা করে দিলাম—‘বউদির প্রতিদ্বন্দী সেই ভালুকটাকে আজ নিপাত করে এসেছি! কেবল দুটো শট—ব্যাস খতম।’
দাদা, বৌদি এমন কী খুকি পর্যন্ত দেখতে ছুটল। আমিও চললাম—এবার আর বন্দুকটাকে সঙ্গে নিলাম না,—পাঁচজনে যাত্রা নিষেধ, পাঁজিতে লেখে। দাদা বহু পরিশ্রমে ও বউদির সাহায্যে, ভালুকের ল্যাজটাকে দেহচ্যুত করে, এই বৃহৎ শিকারের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ সযত্নে আহরণ করে নিয়ে এলেন। এই সহযোগিতায় ফলে দাদা ও বউদির মধ্যে আবার ভাব হয়ে গেল। আপনি আত্মদান করে ভালুকটা দাদা ও বউদির মধ্যে মিলনগ্রন্থি রচনা করে গেল—তার এই অসাধারণ মহত্ত্বে সেনতুন মহিমা নিয়ে আমার কাছে প্রতিভাত হল। আমার রচনায় তাকে অমর করে রাখলাম, অন্তত আমার চেয়ে সেবেশিদিন টিকবে আশা করি।
বাড়ি ফিরেই দাদা বললেন—‘অমৃতবাজার পত্রিকায় খবরটা পাঠিয়ে দিই কী বলিস?—A big wild bear was heroically killed by my young brother aged—aged —কত রে?’
‘আমার age তুমি তা জানোই!’—আমি উত্তর দিলাম।
‘উঁহু, কমিয়ে লিখতে হবে কিনা! নইলে বাহাদুরি কীসের! দশ বারো বছর কমিয়ে দিই, কী বলিস?’
কিন্তু দশ-বারো বছর কমিয়েও আমার বয়স যখন দশ-বারো বছরের কাছাকাছি আনা গেল না—(সাতে দাঁড় করানো তো দুঃসাধ্য ব্যাপার!) তখন বাধ্য হয়ে ‘Young’ এই বিশেষণের ওপর নির্ভর করে আমার বয়সাল্পতাটা লোকের অনুমানের ওপর ছেড়ে দেওয়া গেল।
সেদিন আমার পাতে দু-দুটো মুড়ো পড়ল, খুকি মাকে বলে রেখেছে তার কাকামণিকে দিতে। আমি আপত্তি করলাম না, ভালুকের আত্মবিসর্জনে যখন করিনি, খুকির মুড়ো বিসর্জনেই বা করব কেন? সবচেয়ে আশ্চর্য এই, আমার ঝোলের বাটির অস্বাভাবিক উচ্চতা দেখেও দাদা আজ ভ্রুক্ষেপ করলেন না!