আস্তে আস্তে ভাঙো
এমন এক-একটা দুঃসংবাদ আছে, যা আস্তে আস্তে ভাঙতে হয়। নতুবা, যার কাছে ভাঙবার, তাকে যদি একচোটে বলে ফ্যালো, সেনিজেই ভেঙে পড়তে পারে। তাকে আস্ত রাখাই কঠিন হবে তখন। এই ধরো না কেন, কেউ হয়তো লটারিতে লাখখানেক পেয়ে বসেছে। তাকে কি ঝট করে সেকথা বলতে আছে কখনো? যদি বলো, সেটাকা আর তার ভোগে লাগবে না। তার শ্রাদ্ধে, বারো ভূতের ভোজেই সব বেরিয়ে যাবে, সেইটেই সম্ভব।
শোনা যায়, কবে কোন এক সহিস নাকি ডার্বি জিতেছিল, এবং তার সাহেব, সেখবরটা, না— না— সহজে বেফাঁস করেননি— সইয়ে সইয়েই বলেছিলেন, প্রথমেই একচোট— শংকর মাছের হুইপেই— দস্তুরমতো একদফা তাকে চাবকে নিলেন; তারপর, যখন সেপ্রায় আধমরা। —যায়-যায় অবস্থা তার, তখন তার, কাছে চাবকানির অর্থ ব্যক্ত করলেন। এবং সেঅর্থ খুব সামান্য নয়— ডার্বির ফার্স্ট প্রাইজ, বুঝতেই পারছো। দুঃখের বিষয়, আমার কোনো শত্রুও, ভুলেও কখনো ডার্বি জেতে না যে, মনের সুখে কষে গিয়ে ঘা-কতক তাকে বসাতে পারি,— মনের দুঃখ মিটিয়ে নিই।
ডার্বির ফার্স্ট প্রাইজ কোনো শত্রুতে, কিংবা কোনো বন্ধুতেই মেরেছে (বন্ধু মারলেই বা ক্ষতি কী?) এটা সত্যিই খুব শোকাবহ সংবাদ সন্দেহ নেই, কিন্তু মাসতুতো ভাইয়ের খুড়শ্বশুর মারা যাওয়ার খবরটাই কি তার চেয়ে কিছু কম শোচনীয়? অথচ সেই দুঃসংবাদটাই টেলিগ্রামের মারফতে এইমাত্র আমার হাতে এসেছে। নকুড়ের খুড়শ্বশুর আর ইহলাকে নেই। এবং নকুড় যে-রকম শ্বশুর-কাতর, খুড়শ্বশুর-অন্ত প্রাণ, সেকেবল আমিই জানি। কী ভাগ্যিস, তার খুড়তুতো শালার পাঠানো তারটা, তার হাতে না পড়ে, আমার হাতে এসে পড়েছিল! নয়তো এতক্ষণে ও হয়তো হার্টফেল করেই ফেলত, কিংবা খুড়শ্বশুরের সহমরণে যাবার জন্যে সাজগোজ করতে লেগে যেত, অথবা— মানে— এতক্ষণে অভাবিত কিছু একটা বঁাধিয়ে যে বসেছে, তার আর ভুল নেই! নকুড় যেরকম সেনসিটিভ— একটুতেই যেরকম—! আর তার ওপরে খুড়শ্বশুরের ওপর ওর যা টান!
যাক, ভগবান বঁাচিয়েছেন খুব। তারটা ওর হাতে না-পড়ে আমার হাতেই পড়েছে। এখন আমাকে অতীব সুকৌশলে এই খবরটা ওর কাছে ভাঙতে হবে, যাতে আকস্মিক বিয়োগে-ব্যথায় বিমূঢ় হয়ে নিতান্ত নাজেহাল হয়ে না পড়ে ও। খুড়শ্বশুর হানি— অতি সামান্য ক্ষতি নয়তো! শোকাতুর হবার কথাই বই কী! তার ওপর, যা দারুণ ভালোবাসত ওর খুড়শ্বশুরকে! বলতে কী, খুড়শ্বশুরের আওতাতেই ও ছোটোবেলার থেকে মানুষ— যে-বয়সে ওর খুড়তুতো জামাই হবার অতি দূর সম্ভাবনাও কেউ সন্দেহের মধ্যে পোষণ করেনি, সুদূরপরাহতই ছিল— এমনকী, জামাই হওয়া দূরে যাক, জামা-ই গায়ে দিতে শেখেনি যে-বয়সে, তখন থেকেই তাঁর খড়ম পায়ে দিয়ে তাঁর গড়গড়ার নল মুখে করে তাঁর বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে ও মানুষ! এহেন খুড়শ্বশুরের খরচ— দুঃখের খাতায় গিয়ে কীরকম জমাট বঁাধবে, ভাবতে যাওয়াই দুঃসহ! না: খুব আস্তে আস্তেই ভাঙতে হবে কথাটা— বেশ কায়দা করেই— যাতে এত বড়ো ক্ষতিকে, ও ক্ষতি বলেই না গ্রাহ্য করে; বরং সবদিক খতিয়ে, সমস্ত বিবেচনা করে, ভগবানের এই মারকে লটারির ফার্স্ট প্রাইজ মারার মতই নিদারুণ লাভের ব্যাপার বলে ঠাওরাতে পারে, সেই ভাবেই কথাটা পাড়তে হবে তার কাছে।
পাড়ব তো বটে, কিন্তু পাড়ি কী করে? ওর খুড়শ্বশুরের আর কী, বলা নেই কওয়া নেই, হট করে হটে গেছেন— অম্লানবদনে নিজের ভবলীলা সংবরণ করে বসে আছেন! কিন্তু ওঁর এই হঠকারিতার ধাক্কা অপরে সামলাতে পারবে কি না, বিশেষ করে তাঁর খুড়তুতো জামাইয়ের পক্ষে তা কতদূর শোচনীয় হবে, সে-কথা ভাববার অবকাশও হয়তো তিনি পাননি— কিন্তু নকুড়ের খুড়তুতো শালাকেও বলিহারি! সেও কিনা বিনাবাক্যব্যায়ে তক্ষুনি এক টেলিগ্রাম করে— টেলিগ্রামের একটি মাত্র বাক্যে— খুব সংক্ষেপের মধ্যেই— এত বড়ো একটা মর্ম্মন্তুদ খবর এক লাইনের সেরে দিয়েছে! এক কিস্তিতেই তাতে যে মাত হতে পারে, সেদিকে মাথা না দিয়েই।
বাস্তবিক, আশ্চর্য এরা! অদ্ভুত এদের কার্যকলাপ! মর্মভেদী কান্ডকারখানা সব— এর মর্মভেদ করাই কঠিন।… কিন্তু আমাকে কী ফ্যাসাদে ফেলেছে ভাব দিকি একবার— কী মুস্কিল যে বাধল এখন! ওঁদের আর কী, ওঁরা তো চট করে সেরেছেন, নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন, বলতে কী; কিন্তু আমার পক্ষে তো ওঁদের মতো এমন ব্যস্তবাগীশ হওয়া চলবে না, আমার একটা দায়িত্ববোধ আছে, কান্ডজ্ঞান হারাইনি তো আমি, আমাকে আস্তে আস্তে, যেমন করে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ায়, তেমনি করে খবরটার খোলা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে, ধীরে ধীরে সব খোলসা করতে হবে।
মাথা ঘামাতে লেগে গেছি, দুস্তরমতই লেগেছি,— এমন সময়ে, ভালো করে মাথা ঘামতে না ঘামতেই, নকুড় এসে হাজির! আমি টুক করে টেলিগ্রামখানা গেঞ্জির ভেতরে লুকিয়ে ফেলি।
‘এই যে, নকুড় যে! কী মনে করে হঠাৎ?’ কাষ্ঠহাসি হেসে আমি বলি।
‘কী মনে করে— তার মানে?’ নকুড় বেশ অবাক হয়: ‘এই তো একটু আগেই তোমার সঙ্গে কথা কয়ে মেট্রোর ম্যাটানি শো-র টিকিট কাটতে গেলাম।— আর এখন বলছ, কী মনে করে? তার মানে?’
‘ও, তাই নাকি? তাই তো! হ্যাঁ, তাই তো বটে!—’ আমাকে একটু অপ্রস্তুত হতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে, আমাকে যে প্রস্তুত হতে হবে, সেকথাটাও আমার মনে পড়ে যায়।
‘তা বটে, তা বটে! তা, টিকিট কিনে ফেলেছো নাকি? আমি বলছিলাম কি, বায়োস্কোপটা আজ না দেখলে হত না।’
‘বা: চার্লি চ্যাপলিন যে!’ নকুড় বলে কেবল! এর বেশি বলার সেপ্রয়োজনই বোধ করে না।
‘ওঃ! তাই নাকি? চার্লি চ্যাপলিন? তাহলে তো— তা— তাইতো বটে! তাহলে আর কি করে কী হয়? কিন্তু আমি বলছিলাম কী, আজকের দিনটা গীতা পাঠ করে কাটালে কেমন হত?’
‘গীতা!’
নকুড়ের চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে। ও একেবারে আকাশ থেকে পড়ে, আমার ইজিচেয়ারটার ওপরেই পড়ে। কোথায় চার্লি, আর কোথায় গীতা! এতখানি ফারাক— উত্তর ও দক্ষিণ-মেরুর মধ্যের চেয়েও বেশি— ওর ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ও ধারণাই করে উঠতে পারে না। অনেকক্ষণ বিহ্বলের মতো থেকে অবশেষে সেবলে: ‘তুমি বলছ কী?’
কিন্তু আমি ততক্ষণে তাক থেকে গীতাকে পেড়ে এনেছি, এবং ওর কোনখানটা থেকে সুরু করব— মানে, ওর কোনখানটায় যে সেইখানটা আছে— যেই কথাই মনে মনে তাকনি করছি— কোথায় ঠিক খুলতে হবে— কোন পাতায় যে শ্রীভগবানের সেই সব মোক্ষম বাণী লুক্কায়িত রয়েছে— সেই সব অমোঘ উপদেশ— দুঃখশোকের অব্যর্থ দাবাই— সংস্কৃত শ্লোকের দুর্ভেদ্য এই অরণ্যের ভেতর থেকে, বিনা রোদনে খুঁজে পাব কি পাব না— ইত্যাদি সংশয়ে জজ্জর হয়ে ঝরঝর করে পাতা উলটে যাচ্ছি— পাতার পর পাতা— এমন সময়ে—
সত্যি, ভগবান কী জাগ্রত—! কী দারুণ জাগ্রত যে—!
ভালো করে মেলতেই, বইয়ের ঠিক সেই জায়গাটাই ঠেলে বেরিয়েছে! নকুড়কে সম্বোধন করে তখনই আমি শুরু করি: ‘‘গীতায় শ্রীভগবান কী বলেছেন শোনো— শোনো আগে— ‘নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।’ এর মানে কিছু বুঝলে? বুঝতে পারলে কিছু? এর মানে হচ্ছে—’’
বলতে বলতে নীচের সাদা বাংলায় প্রাঞ্জল-করা ব্যাখ্যার ওপর নজর বুলোতে থাকি—
‘—মানে, এর মানে হচ্ছে, শস্ত্রসকল ইহাকে কাটিতে পারে না, অগ্নি ইহাকে পোড়াইতে পারে না, এবং জল ইহাকে ভিজাইতে পারে না,— জল?’ আমার নিজের মনেই জিজ্ঞাসা জাগে: ‘উহুঁ, জল নয়, ওটা অশ্রুজল হবে, অর্থাৎ কিনা, কাহারো অশ্রুজলই ইহাকে কখনো ভিজাইতে পারে না, এবং বায়ু ইহাকে শোষণ করিতে—’
নকুড় বাধা দেয়— ‘কী সব বাজে বকছো! ইহাকে— কাহাকে? কী এসব যাচ্ছেতাই?’
‘ইহাকে— কাহাকে? দাঁড়াও, দেখি।—’ আবার তলার ফুটনোটে আমার চোখ ছোটে: ‘ইঁহাকে, মানে, এই আত্মাকে! অর্থাৎ কি না—’ প্রাণ-জল-করা ব্যাখ্যায় ফের পরিষ্কার করে আমাকে পরিস্ফুট করতে হয়: ‘মারা যাবার পর যা আমরা টের পাই। মানুষ মরে গেলেও যা টিকে থাকে। মানুষের ভেতরকার আসল সেই পদার্থ— অথচ আসলে যা কোনো পদার্থ নয়— একেবারেই অপদার্থ— সেই বস্তুই হচ্ছে, সমস্ত ভেজাল বাদে— একেবারে আদত জিনিস— সেই আত্মা— আসল সেই সোল— বুঝলে কিনা? এবং তাকেই কিনা অস্ত্রসকল কাটিতে পারে না, অগ্নিসকল পোড়াইতে পারে না, এবং জলসকল অর্থাৎ অশ্রুজলকণাসমূহ ভিজাইতে পারে না—’
‘না পারল বয়েই গেল!’ নকুড় বলে আর বুড়ো আঙুল দেখায়। ‘তার সঙ্গে আমার কী? আমাদের বায়োস্কোপ দেখার কী সম্বন্ধ?’
নকুড়ের অর্বাচীনতা আমাকে কাহিল করে। তবু সহজে আমি ঘাবড়াইনে— হাল ছাড়িনে চট করে— তার পরবর্তী শ্লোকে হোঁচট খাই: ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়, নবানি গৃহ্ণতি নরোহপরাণি—’
নকুড় তেড়ে মারতে আসে এবার: ‘জানি জানি! ওর সব জানি! তোমার চেয়ে ঢের ভালো জানি। ঢের ভালো মানে করে দিতে পারি। তোমার চেয়ে আওড়াতেও পারি ঢের ভালো। তোমার উচ্চারণ হচ্ছে না পর্যন্ত! অনেক লেখায় ওই সব কোটেশান পড়ে পড়ে হদ্দ হয়ে গেছি। ওর আগাপাশতলা সব আমার মুখস্থ। তা—ও-সব শোলোকের সঙ্গে আমাদের মতো লোকের— কী সম্পর্ক আমাদের? কেউ আমরা মরতে বসিনি। আমরা কিছু কলেবর ত্যাগ করে নতুন কাপড় পরতে যাচ্ছিনে হঠাৎ? তুমিও আজ মরছ না, আমিও না— তবে? তবে কেন?’
‘তা বটে! সেকথা বটে! মরছিনে অবশ্যি!’ আমি আমতা-আমতা করতে থাকি: ‘কিন্তু মরতে কতক্ষণ? কখন মরব কেউ কী বলতে পারে? মরলেই হল। এই আছি— এই নেই! সেজন্যে সব সময়েই প্রস্তুত থাকা ভালো নয় কী? বীরের মতো মরাটা পুরুষোচিত নয় কি? তা ছাড়া— কাল রাত্রে বিচ্ছিরি এক স্বপ্ন দেখেছি—’
‘তুমি পটল তুলেছ?’
‘উহুঁ, আমি না।’
‘তবে আমি?’ নকুড় হো-হো করে হেসে ওঠে: ‘ছো:! এই সব স্বপ্নে-টপ্নে আমার বিশ্বাস নেই। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমার ওয়ার্ড অফ অনার দিচ্ছি তোমায়— তুমি লিখে রাখতে পারো, আমি আজ মরব না, কাল মরব না, এ সপ্তাহে না, আগামী সপ্তাহে না— এ বছরে না, এ শতাব্দীতেই নয়। তুমি দেখে নিয়ো।’
নকুড় হেসেই উড়িয়ে দেয় এবং গীতাটাকে আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাক করে তার আগের তাকে ফেরত পাঠিয়ে দ্যায় আবার।
‘হ্যাঁ, অনেকে ওই রকম বলে বটে, কিন্তু মরতেও আবার কসুর করে না। আমার বেশ জানা আছে।’ আমিও বলতে ছাড়িনে।
‘আমাকে কি তুমি সেই ছেলে পেয়েছ? আমি এক কথার মানুষ। তেমন মিথ্যেবাদী লায়ার পাওনি আমায়! আমার কথা তুমি অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নিয়ো— দেখে নিয়ো, প্রাণ থাকতে কিছুতেই আমি মরতে যাচ্ছিনে। তেমন ছেলেই নই আমি।’
এই বলে নকুড় আর এক দফা হেসে নেয়।
‘হ্যাঁ, তুমি সিন্ধুবাদের কাঁধের সেই বুড়ো, সেই আহম্মোক বুড়ো, তা আমি বেশ বুঝেছি।’ রাগে আমার চোখ করকর করে।
‘ছি:! মন খারাপ করে না। কাঁদে না, ছি:!’ নকুড় রুমাল বার করে আমার চোখ মুছোতে আসে: ‘অশ্রুজল-সকল ইহাকে ভিজাইতে পারে না, সেকথা অবশ্যি ঠিক, কিন্তু ইহাকে পোড়াইতে পারে, এ-কথাও মিথ্যে নয়। তোমার ছলছলানো চোখ দেখে আমার মনের ভেতরটা— সেইখানেই তো আত্মা?—পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে ভাই! আহা বাছারে!—’ সেআমায় সান্ত্বনা দেয়: ‘কিন্তু ভাই অকারণ শোক করে তো লাভ নেই। আমার মতন বন্ধুর বিয়োগ তুমি সইতে পারবে না, তা জানি! কেই বা পারে? কিন্তু আমি না মরতেই মারা গেছি ভাবছ কেন তুমি?’
আমি মুখ টেনে নিই, চোখ মুছোতে এসে নকুড় আমার নাক মুছিয়ে দেয়।
‘তোমার ভাবনাই ভাবছি কিনা আমি!—’ বিরক্ত হয়ে আমি বলি। ‘ভারি আমার গুরুপুত্তুর! কী আমার দায় ঠেকেছে!’
‘তুমিও না, আমিও না, তবে কে আবার মরতে গেল?’ নকুড় এবার সত্যিই বিস্মিত হয়: ‘তুমি-আমি ছাড়া আবার কে আছে? কার মরার স্বপ্ন দেখে তুমি এত কাতর হচ্ছ তাহলে?’
‘তোমার সেই খুড়শ্বশুর—’ আমি আর ইতস্তত করিনে,— ‘সেআর বেঁচে নেই!’
‘দূর! তা কী হয়!’ নকুড় চমকে ওঠে!— ‘তা কী হতে পারে? এই সেদিনও চিঠি পেলাম শ্বশুরমশাই ভালো রয়েছেন, বহাল তবিয়তেই আছেন, আর এর মধ্যেই—? দূর, তা কী হয়? অবশ্যি, দিনকতক থেকে তাঁর দেহ ভালো যাচ্ছে না, শরীরগতিক সুবিধের নয়, এমনি লিখেছিলেন বটে— কিন্তু তা বলে এত শিগগির? না, না, অসম্ভব। ইদানীং একটু বাতেও ধরেছিল, ব্লাড-প্রেসারও বেড়েছিল নাকি, পক্ষাঘাতের মতোই হয়েছিল প্রায়, কিন্তু তবুও এত তাড়াতাড়ি তিনি আমাদের মায়া কাটাবেন, তা ভাবতেও পারা যায় না—’
দেখতে-না-দেখতে ওর মুখচোখ কাঁচুমাচু হয়ে আসে। ‘কেন, ভালো-মন্দ কোনো খবর পেয়েছো নাকি? চিঠি-টিঠি এসেছে কোনো?’
‘না! খবর আবার কী আসবে— চিঠি আবার পাব কার?’ আমি টাল সামলাই: ‘বলছি না যে স্বপ্ন?’
‘স্বপ্নও অনেকসময়ে সত্যি হয়। এ-ধরনের স্বপ্ন প্রায়ই ফলে যায়। ফসকায় না প্রায়, আকছার দেখা গেছে। না:, তুমি আমার মন খারাপ করে দিলে হে! খুড়শ্বশুর আমাকে অনাথ করে গেলে আমি আর বঁাচব না— কী নিয়ে বঁাচব। বাচব কী জন্য? বেঁচে কীসের সুখ? জীবনধারণে তখন আর আমার কী প্রয়োজন? অ্যাঁ?’
নকুড় একেবারে কাঁদো-কাঁদো হয়ে পড়ে! নাতজামাই না হয়েও নিজেকে অনাথ জামাই ভেবে কাঁদতে থাকে।
‘পাগল কোথাকার!’ আমি ওকে ভরসা দিই: ‘স্বপ্নের কথায় কেউ আবার বিশ্বাস করে? ওকি সত্যি হয় কখনো? স্বপ্ন তো সব বাজে!’
‘হপ্তাখানেক কোনো চিঠি-পত্র আসেনি— সত্যিই তো। খবরটা নিতে হয় তাহলে। একটা টেলিগ্রাম করে দিই নটবরকে। আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। প্রিপেড আর্জেন্ট— কী বল? সেই বেশ হবে? একেবারে প্রিপেড আর্জেন্ট?’
‘এত তাড়াহুড়ো কীসের? খবর যখন আসেনি, তখন বুঝতে হবে যে, ভালোই খবর। তোমার খুড়শ্বশুর দিব্যি আরামেই রয়েছেন!’
‘না কী বলছো— চলেই যাই নেকসট ট্রেনে? ঢাকা পৌঁছোতে কতক্ষণ আর? কী বলো তুমি?’
‘অবাক করলে নকুড়! সামান্য একটা স্বপ্নের ব্যাপারে তুমি এমন বেহুঁশ হয়ে পড়বে ভাবতে পারিনি। আচ্ছা লোক তুমি যাহোক!’
‘না:, আমার কিচ্ছু আর ভালো লাগছে না। ভারি বিচ্ছিরি লাগছে সব! না:, বায়স্কোপ আর যাব না আজ—’ বলতে বলতে নকুড় সিনেমার টিকিটগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করে— ‘যতক্ষণ না শ্বশুরের একটা সুখবর পাচ্ছি, ততক্ষণ আমার সোয়াস্তি নেই।’
‘দ্যাখোতো— দ্যাখোতো! আরে, আমার টিকিটখানাও কুঁচিয়ে ফেললে যে! বলি, আমার তো আর শ্বশুর মরেনি! আচ্ছা খ্যাপা মানুষ যাহোক! আর যদি মরেই থাকে নটবরের বাবা, তেমন মন্দটা কী হয়েছে শুনি? তোমার দিক থেকে ভাবতে গেলে সত্যিই খুব দুঃখের, ভুল নেই, কিন্তু তাঁর দিকটাও তো দেখতে হয়। বুড়ো খুড়শ্বশুরের কথাটাও ভাবতে হয় তো! এই না তুমি বলেছিলে, একে বাত, তাতে পক্ষাঘাত, তার ওপরে আবার ব্লাড-প্রেসার — এত দুর্ভোগ নিয়ে এই দুর্যোগে কষ্টে-সৃষ্টে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে নিস্তার পাওয়াটা কী ভালো নয়? মরলেই তো আবার নতুন জন্ম, নব কলেবর ফের, আনকোরা নতুন-নতুন ফুর্তি আবার—গীতায় যা বলেছে— ভেবে দেখলে আমারই তো মরতে লোভ হয়! এই ভাবে মরে বেঁচে যাওয়াটা ভালো নয় কী?’
‘অত ভালোয় আমার কাজ নেই। ভালো চাও তুমি মরোগে। আমার খুড়শ্বশুরের ভালো তোমায় করতে হবে না।’ নকুড় রাগ করে।
‘আমি আর কী করে ভালো করব? আমি কী ডাক্তার? বদ্যি হলেও বরং কথা ছিল। একবার চেষ্টা করে দেখতাম— এক ওষুধেই সেরে দিতাম— মানে— সরিয়ে দিতাম— না না, সারিয়ে দিতাম, সেই কথাই বলছি!’
‘আমি ভালো চাইনে— আমার নিজের খারাপ হোক, যারপরনাই মন্দ যা হবার তা হোক, কিন্তু আমার খুড়শ্বশুর বেঁচে থাকুন!’
‘অত কষ্ট পেয়েও?’
‘হ্যাঁ! একশো বছর। আরও একশো বছর। এক-শো বাহাত্তর বছর বেঁচে থাকুন তিনি! শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বর্তে থাকুন। আমি মারা গেলে তবে যেন তিনি মারা যান, আমায় না তাঁর মরা মুখ দেখতে হয়, এই আমি চাই।’ অম্লানবদনে নকুড় বলে।
‘তাহলে আর কী হবে!’ আমি হতাশ হয়ে পড়ি: ‘তুমি যখন এমন স্বার্থপর! কিন্তু ভেবে দেখলে, কে কার বলো! কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ! কার সঙ্গে কার কী সম্বন্ধ! কেইবা কার বাবা, কেইবা কার খুড়ো, আর কেইবা কার জামাই, ভালো করে ভেবে দ্যাখো যদি। আর আমি— এই আমি যদি আমার মাসতুতো খুড়শ্বশুরের মৃত্যুশোক সইতে পেরে থাকি, সহাস্যবদনে সয়ে থাকি, তাহলে তুমিই বা কেন পারবে না? মানুষ তো তুমি? আর মানুষে কী না পারে! চেষ্টা করলে কী না হয়!’
‘তোমার শ্বশুর! সেআবার কবে মোলো!’ নকুড় বিস্ময়াকুল: ‘তুমি আবার বিয়ে করলেই বা কবে?’
‘মাসতুতো খুড়শ্বশুরের কথা বলছিলে!’ আমি বুঝিয়ে দিই: ‘তুমি আমার মাসতুতো ভাই, তা ভুলে যাচ্ছ?’
‘কিন্তু তোমার মাসতুতো খুড়শ্বশুর তো সত্যিই মরেনি—’ নকুড় প্রতিবাদ করে: ‘তুমি তো স্বপ্ন দেখেছো শুধু।’
‘স্বপ্নই তো দেখেছি!’ আমি জানাই: ‘কিন্তু মরলেও কোনো ক্ষতি ছিল না! পরলোকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা জানো না তো! মরবার পরে কী আরাম যদি জানতে! সেযে কী আয়েস! এক দন্ডও এখানে বঁাচতে চাইতে না তাহলে! দাঁড়াও, ‘পরলোকের কথা’ বইটা পড়ে শোনাই তোমায়—’
‘পরলোক আমার মাথায় থাক! টেলিগ্রামটা করে আসি আগে।’ নকুড় বেরিয়ে পড়ে। হু-হু শ্বাসে বেরিয়ে যায়।
আমি ভাবতে থাকি, এটা কী খুব ভালো হল? খবরটা না ভেঙে, এই ভাবে মচকে রাখাটা অনুচিত হল না কি?
দুপুরের দিকে ফিরে এল নকুড়। হাসি-হাসি মুখেই ফিরল। এসেই বলল: ‘হ্যাঁ, পরলোকের কথা কী বলছিলে তখন? কই, বইটা পড়ে শোনাও তো, শুনি। বউ বলল, স্বপ্ন ফলে বটে, কিন্তু হুবহু ঠিক ঠিক কখনো ফলে না; যার মারা যাবার স্বপ্ন দেখবে, সেমরবে না; তার কাছাকাছি আর কেউ অক্কা পাবে। তার মানে, খুড়শ্বশুরের কোনো ভয় নেই, যদি মরতেই হয়, তাঁর কাছাকাছি আর কে? আমিই আছি! আমিই মারা যাব তাহলে। অতএব, পরলোকের হাল-চাল জানতে হলে আমারই তা জানা দরকার এখন।’ নকুড় জানায়। সমুজ্জ্বল মুখে জানায়, অকুতোভয় নকুড়! শ্বশুর-গদগদ নকুড়।
‘পরলোকের কথা’ বইটা খুঁজে বার করতে হয়। কিন্তু সেটা বেরোয় না; বিস্তর খোঁজাখুঁজির ফলে, ওর হিন্দি সংস্করণ, ‘পরলোককি বাৎ’ বেরিয়ে আসে। অল্প-স্বল্প হিন্দি যা জানি, তারই সাহায্যে, কথ্য বাংলা আর অকথ্য হিন্দির সহায়তায়, যথাসাধ্য ব্যাখ্যা করে পড়ে যাই। ও উৎকর্ণ হয়ে শুনতে থাকে।
সমস্ত শুনে-টুনে নকুড় দীর্ঘনি:শ্বাস ফ্যালে: ‘পরলোকটা নেহাত মন্দ নয় তাহলে, ইহলোকের চেয়ে ঢের ভালোই দেখছি!’
‘কী বলছিলাম তবে? সেই কথাই তো বলছিলাম তখন।’ আমি ওকে উৎসাহ দিই।
‘হ্যাঁ, মারা গেলে মন্দ হয় না নেহাত।’ নকুড় বলে।
‘আমি তো তাই বলছি হে! মারা পড়বার মতো আর কিছুই নেই। ভারি উপাদেয়, সেই কথাই তো বলছি আমি। মারা যাওয়া অতিশয় ভালো— তোমার পক্ষে— আমার পক্ষে— তোমার খুড়শ্বশুরের পক্ষে—’
নকুড় ব্যাঘাত দ্যায়: ‘না, না,— খুড়শ্বশুরের কথা বোলো না। তুমি-আমি মারা যাই ক্ষতি নেই, কিন্তু খুড়শ্বশুর;— কিন্তু খুড়শ্বশুরই বা নয় কীজন্য? তিনিই বা কেন এখানে একলা পড়ে থাকবেন? কী সুখেই বা পড়ে থাকবেন? তাঁকে ছেড়ে আমরাই বা— আমিই বা সেখানে থাকব কী করে?’
‘তাই বল? সেইটেই তো ভাবতে বলছি। আমি তোমার খুড়শ্বশুরকেও সঙ্গে নিতে বলেছি, খুব মন্দ বলেছি কি?’
নকুড় নতুন করে ভাবতে থাকে। নতুন দৃষ্টি খুলে যায় ওর— ঢালের অন্য ধারটাও ওর নজরে পড়ে।
‘খুড়শ্বশুর ব্যতিরেকে জীবনধারণ যেমন বৃথা, মরণলাভও তেমনি ব্যর্থ। তবেই বোঝো।’ আমি ওকে পুনরায় প্রণোদিত করি। মড়ার ওপরেই খাঁড়ার ঘা মারতে হয়— কী করব? আগুনের-মুখে-আগানো লোহাকেই তার গরমির মাথায় মারের চোটে বাগাও! তাই নিয়ম।
‘তা বটে!’ দীর্ঘনি:শ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়ে নকুড়: ‘তাই বটে!’
‘তাছাড়া আরও দ্যাখো, মারা যাবার সুবিধাও অনেক।— এই তোমার খুড়শ্বশুরের কথাই ধরো না! তিনি না-হয় বেঁচেই আছেন,— থাকুন বেঁচে ক্ষতি নেই— কিন্তু কীরকম অসুবিধায় ফেলেছেন তোমায়, ভাব দিকি? কেমন আছেন, টেলিগ্রাম করে কখন খবর আসবে— হা-পিত্যেশে বসে থাকতে হচ্ছে। অথচ, তিনি মারা গিয়ে থাকলে আর কথাটি ছিল না। প্ল্যানচেট করে কখন তাঁকে টেনে আনা যেত— সশরীরেই টেনে আনা যেত এখানে—সূক্ষ্মশরীরেই যদিও! তারপর যতক্ষণ খুশি তাঁর সঙ্গে আলাপ করো— বাধা ছিল না কোনো! দিন-রাত দুবেলাই তাঁকে টেনে এনে গল্প জমাও না কেন— আপত্তি কী? বাধা কোথায়? পরলোকের কথা তো শুনলে, নিজের কানেই শুনলে তো!’
‘এখন খুড়শ্বশুরকে প্ল্যানচেটে আনা যায় না এখানে?’ নকুড় জিজ্ঞেস করে।
‘এখন কী করে যাবে? জলজ্যান্ত বেঁচে যে এখন!’ আমি বলি: ‘প্ল্যানচেটে শুধু আত্মারাই আসতে পারে। জ্যান্ত মানুষ আসবে কী করে? জ্যান্ত মানুষের কি আত্মা আছে?’
‘তা বটে! তাদের কেবল হাড় আর মাংস— তার ভেতরে আত্মা থাকলেও তার পাত্তা নেই।’ নকুড়কে সায় দিতে হয়।
‘তার ওপরে বাত আর পক্ষাঘাত— তা নিয়ে নড়াচড়া করাই দায়।’ আমি যোগ করে দিই।
‘তাহলে তোমার মতে আমার খুড়শ্বশুরের মরাটাই বাঞ্ছনীয়?’ নকুড় প্রশ্ন করে। ‘তুমি তো তাই বলছ?’
‘আমি কিছু বলছিনে। তুমি যদি সদাসর্বদা তাঁকে হাতেনাতে পেতে চাও, কাছাকাছি রেখে কথাবার্তা কইতে চাও সব সময়, তাহলে, তোমার দিক থেকে তুমি নিজেই ভেবে দ্যাখো না কেন!’
নকুড় ভাবে। ‘ভেবে দেখলে তোমার কথাই ঠিক!’ থেমে থেমে নকুড় বলে।
‘আমি কি আর বেঠিক বলি? ভাবো তো, কোথায় তুমি এখানে, আর কোথায় তোমার খুড়শ্বশুর— ঝাকড়দা-মাকড়দা— না কোথায়— ঢাকা পড়ে রয়েছেন! কতদিন তুমি তাঁর বাক্যসুধায় বঞ্চিত, তাঁর সঙ্গসুখ লাভ করোনি কদ্দিন! অথচ তিনি মারা যেতে পারলেই— আজকেই— এই মুহূর্তেই— তাঁকে তুমি নিজের হুদ্দার মধ্যে আনতে পারো। তারপর মনের সাধে আলাপ জমাও— মন্দ কী?’
‘বাস্তবিক, ভেবে দেখলে অনেকদিন আগেই দেহরক্ষা করা উচিত ছিল ওঁর।’ নকুড় বলে অবশেষে: ‘এভাবে বেঁচে থেকে, দূরে সরে থেকে কী লাভ হচ্ছে ওঁর? তার চেয়ে— কিন্তু একটা কথা, মরব বললেই তো আর ঝট করে মরা যায় না; মরলে তো উনি বঁাচেন, বুঝছি; কিন্তু মরবেন কী উপায়ে? বাতে পক্ষাঘাতে তো পরমায়ু আরও বেড়ে যায় শুনেছি— ভালো বদ্যিরাও নাকি বধ করতে পারে না তখন,— তবে? তাহলে? তার পথ কিছু ভেবেছ?’
নকুড়ের শেষ প্রশ্নে পথের দাবী।
‘ভগবানের কৃপা থাকলে কী না-হয়? সবই হতে পারে। জ্যান্ত মাছেও পোকা পড়ে— তাঁর দয়ায়!’ বলে কুক্ষিগত টেলিগ্রামখানা বার করে ওর হাতে দিই: ‘মারে হরি তো রাখে কে?’
ওর সমস্যা-পীড়িত মুখমন্ডল থেকে আলো বিকীরিত হতে থাকে: ‘যাক, ভালোই হয়েছে তাহলে! একটা দুর্ভাবনা দূর হল! ফিরতি পথে একটা প্ল্যানচেট নিয়ে ফিরলেই হবে। তিনটে তো প্রায় বাজে, চলো এখন মেট্রোয় যাওয়া যাক! নতুন করে টিকিট কেটে চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখিগে!’