ইংরিজি যার নাম
দাড়ি কামাতে কামাতে শুনছিলাম…
দাড়ি হচ্ছে ঠিক টাকার মতোই—কামাবার জিনিস। রোজই কামাতে হয়, না কামালে চলে না। টাকার সঙ্গে অবশ্যি একটি তফাত আছে। কামালেও বাড়ে, না কামালেও বাড়ে। তাহলেও এটা হচ্ছে রোজকার রোজগার। আর রোজই খরচ করার।
সকালে উঠেই নিজের দাড়ি নিয়ে পড়েছি। কামিয়ে কামিয়ে টাকার মতো চকচকে না হলেও টাকের মতো মসৃণ করবার চেষ্টায় রয়েছি, এমন সময়ে টেলিফোনের ক্রিংকার শোনা গেল।
সেফটি ফার্স্ট, কথায় বলে। সেফটি রেজারের বেলাও সেই কথা। কামানো ফেলে রেখে টেলিফোনের ডাকে সাড়া দেয়া কোনো কাজের কথা নয়। ক্ষুর বোলাতে বোলাতে শুনছিলাম—! কিড়িং কিড়িং বোলের তালে তালে চালাচ্ছিলাম ক্ষুর…
কিন্তু সবাই কিছু সমান ক্ষুরধার হয় না। ক্ষুরের ধারেকাছেও যেতে হয় না, এমন মানুষও আছে। ফোনের সাড়া পেয়ে অসাড় হয়ে থাকবার কথা নয় তাদের। ইতু আর ভুতু দৌড়ে আসে পাশের ঘর থেকে…
‘হ্যালো…হ্যালো…হ্যালো…’
ওদের কথায় টেলিফোনের ওধারের ব্যক্তিটি হেলল বলে যেন বোধ হল। ইতুর মুখে হাসি ফুটতে দেখলাম।
‘কে রে? লুকু? আমি ইতু…ইতু…ইতু…’
বাধা দিয়ে বললাম আমি—‘তিন বার ইতু না বললে কি হয় না? এককথায় ইত্যাদি বললেই তো হয়। ইতুর বহুবচনে ইত্যাদি।’
‘কে আছে এখানে? আর কে কে এখানে আছে জানতে চাইচিস? আমি ইত্যাদি।’ ইতু জানায়।
‘না না। দিদিদের কেউ নেই এ ঘরে। খালি আমি আর ভুতু আর বড়দা। ইত্যাদির মধ্যে বড়দা। দাড়ি কামাচ্ছে।’
‘লাইট হাউসে যাচ্ছিস বুঝি আজ…দশটার শোয়ে? বাপির সঙ্গে বুঝি? তা যা। আমি? তোদের সঙ্গে যেতে বলচিস?…’
ভুতু মাঝখান থেকে কথা পাড়ে—‘আমাকে একটু বলতে দে ভাই এবার।’
‘তোদের সঙ্গে আমিও?…না—না—না! না না, তোকে না বলিনি, ভুতুকে বলছিলাম, ফোন ধরে টানাটানি করছে কিনা ভুতুটা। তা আমি যেতে পারি লাইট হাউসে। যাব বড়দা?’
আমি তখন ঠোঁটের ওপরটা কামাচ্ছিলাম—কামাতে কামাতেই বলি—‘উঁহুহুহুহু…’
ঠোঁটের ওপরটা মুখ বুজে কামাবার জিনিস। বাধ্য হয়ে উঁহুহু করতে হল—মুখ বুজেই। ওর বেশি মুখ খুলতে গেলেই ঠোঁট-কাটা হবার ভয় ছিল।
‘বড়দা যেতে বারণ করছে…’ ইতু বলতে যায়।
‘না না! বারণ করিনি। লুকুদের সঙ্গে যাবি তো কেন বারণ করব? লুকিয়ে যাচ্ছিস না তো। তার ওপর পাহাড়িদা যা খাওয়ায়! ভারি খাওয়াতে পারে লোকটা।’
‘এই লুকু! শোন—শোন—শোন। শুনচিস। তাহলে আমি যাব…যাব…যাব। যাব বুঝলি? এখান থেকে তোরা তুলে নিয়ে যাস আমায়…কেমন?
ভুতু এবার জোর করে টেলিফোনটা হাতিয়ে নেয়।
‘হ্যালো…হ্যালো…হ্যালো লুকু? এল ইউ কে ইউ—লুউকু? আমি কাবেরী—কাবেরী—কাবেরী।’ ভুতু নিজেকে জোর গলায় জাহির করে। আর বার বার তিন বার না বললে তো মেয়েদের হয় না।
‘দশটার শোয়ে কীসের ছবি ভাই লাইট হাউসে? অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড? ওয়াল্ট ডিজনির? আঃ, কী চমৎকার বই ভাই! কী বলচিস? তোদের সঙ্গে…ইতু আর আমিও? তা আমি আবার দেখতে রাজি আছি…যদিও দেখা বই, বড়দা দেখিয়েছিল একবার।’
‘দেখিয়েছিল না হাতি!’ ইতুর মুখখানা ইত্যাদির মতন হয়—‘খালি চীনেবাদামের ওপর দিয়ে। চকোলেট-টকোলেট কিচ্ছু না। সেআমার ভালোমতো দেখাই হয়নি। পাহাড়িদা কত খাওয়াবে!’
‘ছবি দেখার সঙ্গে খাওয়ার কী সম্পর্ক রে?’ আমি দ্বিরুক্তি না করে পারিনে—‘ছবি তো চোখে দেখার জিনিস। চেখে দেখবার না তো? সিনেমা কি নেমন্তন্নবাড়ি? সেখানে কি লোকে পেটভরে খেতে যায় না কি?’
‘তা কি যায়?’ গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মতোই প্রশ্ন দিয়েই ইতুর উত্তর দেয়া।
‘তোদের বাড়ি যেতে বলছিস? কিন্তু আমাদের গাড়ি যে…’ বলতে গিয়ে ভুতুর বুঝি বাধো বাধো লাগে। বাড়ির কথা বাইরে বেফাঁস করাটা ঠিক হবে কি না ভাবে বোধ হয়।
সেই ফাঁকে ইতু ফোনের হাতলটা বাগিয়ে ধরে—‘হ্যালো লুকু? আমি ইতু…ইতু…ইতু। আমাদের গাড়ির, ভাই, টায়ার গেছে ফেঁসে। এখনও নতুন টায়ার আনা হয়নি। কবে যে আসবে কে জানে। বড়দার ট্যাঁক এখন ফাঁক—ফাঁকা গড়ের মাঠ…বুঝেছিস ভাই লুকু?…’
ইতু কিছুই লুকোয় না, টায়ারের মতো আমার প্রেসটিজকেও ফাঁসিয়ে দেয়। ভাগ্যিস, লুকু কোনো পাবলিশার নয়। বাজারে চাউর হলে আমার বইয়ের দর পড়ে যেত।
‘কী হবে টায়ার লাগিয়ে?’ জুলপিটা চাঁছতে চাঁছতে বলি। নিলামে কেনা লজঝড় গাড়িতে আবার কেউ টায়ার লাগায়? অনর্থক বেচারাকে টায়ার্ড করা। ভাবছি এবার লোহার দরে বেচে দেব কারোকে। ভোরের দিকে ‘পুরানা লোহা বিকরি’ বলে যে লোকটা হাঁকতে হাঁকতে যায় তাকে ডাকিস তো রে ভুতু।’
‘কী করে যাব ভাই তোদের বাড়ি? গাড়ির টায়ার নেই যে। টায়ার? টায়ার বানান? টি—আই—আর—ই! হল না? হল না বুঝি? তাহলে ঝ-ষ্ক-অ—টি, —ষ্ক-ঢ-ষ্ক—আই, —অ-ছ-ষ্ক—আর—আর—ই। এ কী বানান বড়দা?’
‘হ্রস্ব ই, না দীর্ঘ ঈ?’ বানান সম্বন্ধে আমি ভারি খুঁতখুঁতে। এমনিতেই লেখকদের হ্রস্ব-দীর্ঘ জ্ঞান নেই বলে লোকের ধারণা।
‘কে জানে কোন ই। টায়ার বুঝলি তো? গাড়ির চাকায় যা জড়ানো থাকে বাপু।’
ইতুর মুখ ফের ইত্যাকার ধারণ করে। ‘টায়ার লাগাতে বলছিস? দাদা বলে যে কী হবে টায়ার লাগিয়ে। গাড়িটা আমাদের দাদুর মতন রিটায়ার করেছে এখন…’
‘কী বলছিস? টায়ার না থাকলেও চলে? চাকা থাকলেই চলবে! তাই নাকি রে? বড়দা, লুকু বলছে…?’
কান লুকুর দিকে রেখে সপ্রশ্ন চোখটাকে সেআমার ওপর রাখে।
‘বলে দে যে ইঞ্জিন বিগড়েছে…’ আমি বাতলাই।
‘ইঞ্জিন খারাপ গাড়ির।’—বলেই তখন মুশকিলে পড়ে ইতু—‘ইনজিন? ইনজিন কী বানান? কে জানে বাবা! ইঞ্জিন রে ইঞ্জিন! বানান না করলে কি তুই বুঝতে পারিসনে না কি? বাপি বলেছে বানান করে করে বুঝতে? ইনজিন? ইনজিন—ইনজিন হচ্ছে ইন আর জিন। আই এন ইন—ইন মানে ভিতরে, আর তারপরে জিন। জিন কী বানান, বড়দা?’
‘বর্গে জ-য়ে হস্ব ই আর দন্ত-ন-য়ে হসন্ত।’ বলতে হয় আমায়।
ইতু তাই বলে। বলে তার পরে বলে—‘হসন্ত? হসন্ত কী বানান গো?’ আবার তাকে আমার দিকে তাকাতে হয়।
‘হসন্ত?’ আমি দাড়ি চুলকাই—‘হসন্তের বানান আমার জানা নেই। বলে দে, ইঞ্জিন নয়, মোটরের কল।’
‘হসন্ত কেউ বানাতে পারে?’ ভুতু আপনার থেকে জানাতে আসে—‘হসন্তের বানান হয় না। ও আপনি হয়। শব্দের পায়ের তলায় লম্বা হয়ে পড়ে থাকে।’
আমি সায় দিই ওর কথায়—‘ঠিক বলেছিস, ওকে বলে বিরাম চিহ্ন। অবিরাম হয়ে থাকে। হতে থাকে। কথায় কথায়।’
‘তা, সিট কি তোরা বুক করে রেখেছিস না গিয়ে বুক করবি? ও, কাটা হয়ে গেছে টিকিট? তবু ভালো—কিউয়ে গিয়ে দাঁড়াতে হবে না।’ ইতুর নিশ্বাস পড়ে।
‘তিন টাকার টিকিট তোদের? ব্যালকনির? কিউয়ের কথা কেন তুললাম? বলিসনে ভাই, দাদার সঙ্গে গেলেই আমাকে কিউয়ে দাঁড়াতে হয়। লাইনে আমায় দাঁড় করিয়ে উনি ঘুরে-ফিরে হাওয়া খান। আবার বলেন, দশ আনার টিকিট থাকতে পাঁচ সিকেয় যাব কেন? সে-পয়সায় খেলে পরে কাজ দেবে। কিন্তু পরে আর খাওয়ার কোনো নামই নেই। খাবার বেলায় সেই চীনেবাদাম আর ডালমুট। তাও আধ মুঠো—দুঃখের কথা বলিসনে আর।’
ইতুর মুখে নিজের গুণবর্ণনা শুনে গলায় আমার ক্ষুর বসাতে ইচ্ছে করে। ইতুর নয়, নিজের গলাতেই।
‘কিউ কী বানান? কেন, কিউ—সোজাই তো! এল—এম—এন—ও—পি—কিউ? হল না? ও, গোড়ার থেকে বলতে হবে বুঝি? এ—বি—সি—ডি—ই—এফ—জি—এচ—অ্যাঁ? তা নয়? তাও নয়? তবে কি কিউয়ের পরেরগুলো বলে যাব? কিউ—আর—এস—টি—ইউ—ভি—অ্যাঁ? কী বলছিস? এ-কিউ সে-কিউ না? তবে আবার কোন কিউ রে?’ ইতু হাল ছেড়ে দেয়।
তার হতাশ মুখভাব দেখে ভুতু সাহসভরে এগোয়—‘আমি বলব? বলে দেব আমি? কে-ই-ওয়াই—কি, মানেও বলতে হবে? কি মানে চাবি, আর, আর, ওয়াই-ও-ইউ—ইউ, ইউ মানে তুই!’
‘যা বলেছিস।’ আমি সায় দিই।
‘ইংরিজি ভারি শক্ত! যেমন ওর বানান তেমনি ওর মানে!’ বলে ভুতু ঘাড় নাড়ে।—‘বিচ্ছিরি!’
‘বিতিকিচ্ছিরি।’ মুখ নাড়ে ইতু।—‘তা, কী নিচ্ছিস সঙ্গে? চকোলেট-টকোলেট? তোর বাপিকে বলে এক বাক্স কেনাবি—বুঝেছিস? লাইট হাউসে পৌঁছেই—কেমন তো? চকোলেট? না বাপু, চকোলেট বানান করতে আমায় বলিসনে!’
‘তাহলেই হয়েছে।’ ভুতু বলে ওঠে।
‘চ- কো- লে-ট বানান করতে না পারলে বাপি বুঝি কিনবে না?’ ইতু কড়িকাঠের দিকে তাকায়…‘তাহলে শোন—চকোলেট কিনে তবে কাজ নেই। চকোলেটের বদলে বরং…নেসলের চকোলেট পাওয়া যায় না আজকাল।’
‘নেসলে কী বানান কে জানে!’ মাঝখান থেকে আমি বলি।
‘তা ছাড়া, চকোলেট তেমন ভালোও নয় খেতে।’—ইতু বলে যায়—‘তার চেয়ে বিস্কুটই বেশ। বিস্কুটই নিস বরং এক টিন…’
‘বিস্কুট আরও শক্ত বানান’, ভুতু জানায়—‘কথাটা তো বিস্কুট নয়, বিসকিট। কিন্তু তাও আবার সোজাসুজি কে আই টি কিট না, তার ভেতরেও আবার অনেক মারপ্যাঁচ।’
‘তাহলে বিস্কুট নিয়েও কাজ নেই, বুঝলি লুকু? শোন, শোনপাপড়ি।…শোনপাপড়িই ভালো…কিংবা ডালমুট কি চীনেবাদাম!’
‘কেন, চকোলেটই হোক না।’ আমি উৎসাহ দিই—‘আমি বলে দিচ্ছি বানান।’ বলেই কিন্তু আমায় মাথা চুলকাতে হয়—‘দাঁড়া, জিজ্ঞেস কর তো, বানানের বদলে মানে বললে হয় কি না। মানে আমি বলতে পারি…চক-কোল-লেট…চক হল গে চকখড়ি—ইশকুলের ব্ল্যাকবোর্ডে যা দিয়ে লেখে। ব্ল্যাকবোর্ড কী তাও কি বানান করতে হবে? হবে না? তাহলে কোল হল গে কয়লা। খড়ি আর কয়লা—হল তো? তারপর রইল খালি লেট।…’
‘লেট হল গে টুলেটের। তার মানে খালি-বাড়ি-ভাড়া-দেওয়া’—ভুতু এগিয়ে আসে।
‘উঁহু। সে-লেট নয় রে! যে-লেট মানে স্বর্গীয়, সেই লেট। লে এ টি ই লেট—! খড়ি আর কয়লা, গুঁড়ো করে মিশিয়ে তাহাদের ভোল ফিরিয়ে যে স্বর্গীয় জিনিস তৈরি হয় তাই হচ্ছে চকোলেট। আহা, কী মিষ্টি—যেন কোনো স্বর্গের! কিন্তু কে খাওয়ায়! আমার দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে—‘যদি পাহাড়িদা কেনে এক বাক্স—কেনাতে পারিস যদি—তাহলে তার এক-আধটু আনিস এখানে—আনতে পারিস যদি কোনো গতিকে…’
‘আনব। পেটের মধ্যে পুরে আনব। নিশ্চয়। সেআর তোমায় বলতে হবে না।’ ইতু বলে।
‘আনবি কী করে? বানান করতেই পারবি না যে?’ ভুতু প্রকাশ করে—‘আর, বানান করতে না পারলে কি পাহাড়িদাকে দিয়ে কেনানো যাবে? লোকটা একটা ইংরিজির পাহাড়! চকোলেটের বানান তুমি সত্যিই জান না বড়দা?’
‘চিরদিন তো খেয়েইছি খালি, বানিয়েও খাইনি, বানান করেও খেতে হয়নি। কী করে জানব? তা ছাড়া ওই সব বানান-টানান—তার ওপরে আবার ইংরিজির—আমাকে তোরা জিজ্ঞেস করিসনে। ওসব আমার বড়ো আসে-টাসে না।’
‘কথায় বলে ইংরিজি।’ ভুতুর মুখখানাও বানানের মতোই শক্ত হয়ে ওঠে—‘ইংরিজি যার নাম! হুম।’
‘তুমি কী জান তবে? বাংলা বানানই তুমি জান নাকি?’ ইতু ঝংকার দিয়ে ওঠে—‘করো দেখি বানান—ইতু।’
‘ইতু? তা বুঝি আর বানান করতে পারব না? বলছিস তুই? অ-য়ে হস্বই ই আর ত-য়ে হস্বউ তু। ইতু।’