সেই কুয়াশা ২.৯

নয়

ব্যগ্র ভক্তদের ভিড় ঠেলে একজন চিত্রতারকা যেভাবে এগিয়ে যায়, সাদা থোকা থোকা মেঘগুলোকে ঠিক সেভাবেই সরিয়ে উঁচু আসমান দিয়ে উড়ছে ফিন-এয়ারের সেভেন ফোর সেভেন বোয়িং। স্টারবোর্ড সাইডে, বিমানের সামনের দিকে, প্যাসেজের ধারে একটা সিট, বিজনেস ক্লাস। খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে, একদিকে একটু কাত হয়ে তাতে বসে আছে একজন মানুষ, বয়স ষাট-পঁয়ষট্টির কম নয়। দেখে মনে হবে উদ্বেগ বা উত্তেজনার লেশমাত্র নেই তার মধ্যে। কিন্তু আধবোজা চোখ আর শিথিল পেশির আড়ালে সদা-সতর্ক রয়েছে মগজ, শরীরটা রয়েছে একটা বিপজ্জনক ভঙ্গি নিয়ে, পেঁচানো স্প্রিঙের মত, মুহূর্তের নোটিসে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে তৈরি।

ছদ্মবেশী এই মানুষটি আসলে কুয়াশা, আকাশপথে জার্মানিতে চলেছে। লেনিনগ্রাদের ফ্ল্যাটে নাতালিয়ার মৃতদেহ আবিষ্কার করবার পর কেটে গেছে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা। মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য ছক কেটেছে ও, জোর করে মন থেকে সরিয়ে রেখেছে নাতালিয়া আর শেভচেঙ্কোর পরিণতির কথা। বিচারবুদ্ধিহীন আবেগ কোনও কাজে আসবে না ওর। শত্রুপক্ষের মত নির্দয়, শীতল আর হিসেবি হতে হবে ওকে। তা হলেই প্রতিশোধ নিতে পারবে প্রিয় ওই মানুষদুটির হত্যাকাণ্ডের!

এসেন নিয়ে ভাবছে কুয়াশা। কোত্থেকে তদন্ত শুরু করবে ওখানে? বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান ঠিক বলেছিলেন… ষাট-সত্তর বছরের পুরনো ভূত খুঁজে বেড়াচ্ছে ও চরম বিশৃঙ্খলাময় একটা সময়ে হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষ এবং তার পরিবারকে। ওই আমলের আদৌ কোনও নথিপত্র আছে কি না সন্দেহ; থাকলেও সেগুলো হাতে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। ধরে নেয়া যাক পাওয়াও গেল, তারপর? অত পুরনো সূত্র ট্র্যাক করতে যে-পরিমাণ সময় এবং প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে, তার মধ্যে ওর উপস্থিতি ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, সাহায্য প্রয়োজন ওর। কিন্তু জার্মানির এসেন শহরে ঘনিষ্ঠ কেউ-ই নেই কুয়াশার। একদিক থেকে ভাল সেটা—নাতালিয়া বা শেভচেঙ্কোর মত প্রিয় কারও মৃত্যু দেখতে হবে না ওকে। শত্রুপক্ষও পুরনো কোনও বন্ধুর সূত্র ধরে ওকে খুঁজে বের করতে পারবে না। কিন্তু কথা হলো, অমন কোনও বন্ধু না থাকলে কে সাহায্য করবে ওকে?

ভালমত ভাবল কুয়াশা, এসেনে, ইতিপূর্বেও এসেছে ও, সে-সময়ে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাদের মধ্যে কার কাছে যাওয়া যায়। হঠাৎ মনে পড়ে গেল হাইনরিখ বোহ্‌ল-এর কথা পেশায় পেটেন্ট অ্যার্টনি… মানে উকিল, একবার তার মাধ্যমে নিজের কয়েকটা আবিষ্কারের পেটেন্ট নেবার চেষ্টা করেছিল ও জার্মানিতে। সফল হয়নি, সরকারি ভেরিফিকেশনের সময় নিজের পরিচয় ফাঁস হতে বসেছিল। তবে স্বল্প সময়ের ওই পরিচয়ে বোহ্‌ল-কে ভাল লেগেছিল ওর। সৎ এবং বুদ্ধিমান মানুষ, ওকালতি প্যাচ নেই তার মধ্যে। লোকটাকে নিয়ে ভালমত চিন্তা করে দেখল কুয়াশা—হ্যাঁ, কাজে লাগানো যেতে পারে তাকে। প্রিন্স ভারাকিন যদি আইনসঙ্গতভাবে নামধাম পাল্টে থাকে… যদিও তার সম্ভাবনা কম… তা হলে আদালতে যেতে হয়েছে তাকে। সে সবের রেকর্ড খোঁজার জন্য উকিল-ই দরকার।

অবশ্য এ-পন্থা অনিশ্চয়তায় ভরা। মনে মনে সেটা স্বীকার করল কুয়াশা। অনেককিছুই নির্ভর করছে ভাগ্যের উপর—আদৌ আদালতে গিয়েছিল কি না ভারাকিন, এখনও সে-আমলের রেকর্ড আছে কি না, থাকলে তা উদ্ধার করা যাবে কি না… ইত্যাদি। তবে আর কোনও পথও দেখতে পাচ্ছে না ও। অন্তত একটা কিছু ধরে তো শুরু করতে হবে ওকে!

.

এসেন, জার্মানি।

মানুষটি চল্লিশোর্ধ, সুঠামদেহী। আবহাওয়া ঠাণ্ডা হওয়ায় একটা উলের ট্রাউজার পরেছে, উপরে রয়েছে নীল রঙের সোয়েট-শার্ট জগিং করতে করতে একটা বাঁক ঘুরল সে, ঢুকে পড়ল মিউনিসিপ্যাল পার্কের ভিতরে। ঘাসে ঢাকা জমিন পেরিয়ে নুড়ি বিছানো ওয়াকওয়েতে উঠল, গতি বাড়িয়ে ছুটতে থাকল পার্কের ভিতরদিকে। দৌড়ের মাঝে আশপাশে নজর বোলাচ্ছে সে, হঠাৎ ভুরু কুঁচকে গেল লেকের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়ামূর্তিকে দেখে। সময়টা সাতসকাল হলেও পার্কে স্বাস্থ্য-সচেতন মানুষের অভাব নেই, সবাই কোনও না কোনও শারীরিক ব্যায়াম করছে; তাদের মাঝে ছড়িতে ভর দেয়া একজন পঙ্গু মানুষ খুবই বেমানান। দূর থেকে চেহারা বোঝা যাচ্ছে না, দাঁড়াবার ভঙ্গিটা কেন যেন খুব চেনা চেনা ঠেকছে।

কৌতূহল এড়াতে পারল না মানুষটা, দিক পাল্টে লেকের পাড়ে ছুটল। কাছাকাছি যেতেই বিস্ময় ফুটল তার চেহারায়, থেমে দাঁড়াল ছড়িঅলার কয়েক হাত তফাতে।

‘ভুল দেখছি না তো?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে। ‘কুয়াশা…. সত্যি তুমিই তো?’

‘হ্যালো, হাইনরিখ,’ হাসল কুয়াশা। ‘এখনও দেখছি তুমি আগের মতই স্বাস্থ্য-সচেতন।

‘তুমিও বদলাওনি,’ বলল হাইনরিখ বোহ্‌ল। ‘যখন-তখন মানুষকে চমকে দেবার অভ্যাস রয়ে গেছে। এখানে নিশ্চয়ই আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলে?

‘দেখতে চাইছিলাম, তুমি এখনও আগের রুটেই জগিং করো কি না।’

কথা ঘোরানোর দরকার নেই। কী কাজে এসেছ বলে ফেলো। আবারও পেটেন্টের আবেদন করতে চাও?’

‘উঁহুঁ। অন্য একটা ব্যাপার।’

‘শুনে দুঃখ পেলাম। চমৎকার কিছু আবিষ্কার আছে তোমার। ওগুলো প্রকাশ করা গেলে বহু লোকের উপকার হতো। এনিওয়ে, কাজটা কী?’

‘খুলে বলতে সময় লাগবে। চাইলে জগিং শেষ করে আসতে পারো। আমার হিসেবে আরও দু’মাইল দৌড়ানোর কথা তোমার।’

-’ধ্যাত্তেরি… রাখো তোমার জগিং! এতদিন পরে হাজির হয়েছ, নিশ্চয়ই ইম্পরট্যান্ট কোনও ব্যাপার?’-

‘হ্যাঁ, তোমার সাহায্য দরকার আমার। চলো কোথাও বসি।’

লেকের ধারে একটা নির্জন বেঞ্চে বসল দু’জন।

কুয়াশা বলল, ‘একজন মানুষকে খুঁজছি আমি। আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে, পরিবার-সহ রাশা থেকে জার্মানিতে এসেছিল সে। এই এসেনে। আমার বিশ্বাস, এখানকার আর্মামেন্ট ইণ্ডাস্ট্রিতে ঢুকে পড়েছে সে।’

মুখ বাঁকাল বোহ্‌ল। ‘খামোকা সময় নষ্ট করছ। ষাট-সত্তর বছর আগে… তখন এ-দেশের অবস্থা কী ছিল, সে-ব‍্যাপারে কোনও ধারণা আছে তোমার?’

‘হুম। পুরো ইয়োরোপ তখন জ্বলছিল ‘আগুনে। অস্থির এক সময় ছিল সেটা।’

‘ঠিক। রাশায় চলছিল আন্দোলন, ইয়োরোপ-জুড়ে যুদ্ধের দামামা। তার মাঝে এসেনে ঘটছিল অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক বিপ্লব। রোজই সম্পদের পাহাড় গড়ছিল লোকে, কিংবা হারাচ্ছিল সৰ্বস্ব। সে-সব কাহিনি গোপন রাখা হয়েছে। আর তার মাঝখানে বিশেষ একজনকে খুঁজে পেতে চাইছ তুমি? সুযোগসন্ধানী এক রাশান… যে কিনা অর্থনৈতিক বিপ্লবের ফায়দা লোটার জন্য এসেছিল?’

তুমি এ-ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাবে বলেই ভেবেছি আমি, শান্ত কণ্ঠে বলল কুয়াশা।

‘আর কী-ই বা আশা করতে পারো?’ হাসল বোহ্‌ল। ‘কে ওই লোক? নাম কী?’

‘ওটা এখুনি বলতে চাইছি না।’

‘তা হলে সাহায্য করব কীভাবে?’

‘পরামর্শ দিয়ে। আমার জায়গায় তুমি থাকলে কোথায় খোঁজ নিতে?’

‘রাশায়।’

‘ওখান থেকে ঘুরে এসেছি আমি। সরকারি আর্কাইভ ঘেঁটে দেখেছি।’

‘কিছুই পাওনি?’

ঠিক তার উল্টো। ওখানে পুরো পরিবারের মারা যাবার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা—ওটা মিথ্যে।’

‘এ-কথা কেন মনে হলো তোমার?’

‘ঘটনার বিবরণ পড়ে। ওদের এস্টেটে হামলা করেছিল বলশেভিক-রা। দিনভর লড়াই করে পুরো পরিবার, তারপর বাড়িতে আগুন ধরে যাওয়ায় পুড়ে মরে।

‘খেপা বলশেভিক মব-কে পুরো একটা দিন ঠেকিয়ে রেখেছিল অল্প ক’জন মানুষ? ঠিকই বলেছ, বিশ্বাসযোগ্য নয় ঘটনাটা।’

‘বর্ণনার মধ্যেও গোলমাল দেখেছি। আবহাওয়ার কথা লেখা আছে, বিশাল এস্টেটের প্রতিটা ইঞ্চির বিবরণ পর্যন্ত দেয়া আছে…. অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য একটাও পাইনি ওখানে। একজন সাক্ষীরও – নাম নেই, যারা কনফার্ম করতে পারত ঘটনাটা।’

কপালে ভাঁজ পড়ল বোহুলের। ‘কী বললে? এস্টেটের প্রতিটা ইঞ্চির বিবরণ?’

‘হুঁ। কেন… খটকা লাগছে তোমার?’

‘তা তো লাগছেই। আচ্ছা, পরিবারের সদস্যদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কীভাবে লেখা হয়েছে? ওর ভিতর কি লেখকের বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়েছে?’

ভেবে দেখল কুয়াশা। ‘না, বরং ওদের মহত্ত্ব আর সাহসিকতার গল্প লেখা হয়েছে ওখানে। লড়াই শুরু হবার আগে চাকর-বাকরদের বের করে দিয়েছিল বাড়ি থেকে, ওরা যাতে মারা না পড়ে। লড়াইও করেছে বীরের মত,.. আমৃত্যু লড়াই!’

‘বিপ্লব-পরবর্তী রেকর্ডে একটা অভিজাত পরিবারের ব্যাপারে এ-ধরনের বর্ণনা একটু অস্বাভাবিক না?’

‘তা-ই মনে হয় তোমার?’

‘আমার ধারণা, বিবরণটা ওই পরিবারেরই কেউ লিখেছে; তারপর কাউকে ঘুষ খাইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর্কাইভে। ব্যাপারটা সিম্পল হিউম্যান নেচার বলতে পারো – নিজেকে কেউ কখনও ছোট করে দেখাতে চায় না। হোক মিথ্যে বিবরণ, তবু সেখানে নিজেকে বীর হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছে তোমার ওই লোক… এটাই এর একমাত্র ব্যাখ্যা।

‘মানলাম, কিন্তু এতে আমার তো কোনও উপকার হচ্ছে না। রেকর্ড-টা ভুয়া, তা আমি এমনিতেই বুঝতে পেরেছি।’

‘হচ্ছে, কুয়াশা, হচ্ছে,’ হাসল বোহ্‌ল। উকিল হিসেবে বহু মানুষের সাক্ষ্য আর জবানবন্দি হ্যাণ্ডেল করেছি আমি। কী লক্ষ করেছি, জানো? লিখতে বসলেই লোকে সচেতন বা অবচেতনভাবে ব্যক্তিগত কোনও না কোনও তথ্য দিয়ে ফেলে ওতে। তোমার এই বিশেষ বিবরণটার কথাই ধরা যাক… ওটাতে পুরো এস্টেটের খুঁটিনাটি তুলে দেয়া হয়েছে, তাই না? আমার ধারণা, সম্পত্তি বা জমিজমার বিষয়ে এক ধরনের প্যাশন ছিল লেখকের।

‘বোধহয় ঠিকই আন্দাজ করেছ তুমি,’ মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। শেভচেঙ্কোর কথা মনে পড়ল-অত্যন্ত লোভী স্বভাবের লোক ছিল প্রিন্স ভারাকিন

‘এখানে এসেও ওই প্যাশন মেইনটেন করবার সম্ভাবনা কতটুকু?’

‘ভাল সম্ভাবনা আছে। টাকার অভাব ছিল না ওই লোকের। বড়-সড় যে-কোনও সম্পত্তি কিনে নেবার ক্ষমতা ছিল।

‘সেক্ষেত্রে নামটা বলো আমাকে। হয়তো সাহায্য করতে পারব।’

‘কীভাবে?’

বেঞ্চে হেলান দিল বোহ্‌ল। ‘জমি-জমার সমস্ত রেকর্ড থাকে স্টেট হাউসে। গুজব আছে, লেক বল্ডেনি-র উত্তর পারে রেলিংহাউসেন আর স্ট্যাডওয়ার্ল্ডের বেশ কিছু বড় বড় এস্টেট রাশানরা বহু বছর আগে কিনে নিয়েছিল।’

‘নিজ নামে কেনেনি আমার লোক। আমি শিয়োর।’

‘চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? তা ছাড়া…. জমি বেচাকেনা যত গোপনেই করা হোক, তা পুরোপুরি ধামাচাপা দেয়া যায় না। কিছু না কিছু চিহ্ন থেকে যায়।

‘তা হলে সেটা আমিই খুঁজে নেব। ঠিক কোথায় পাওয়া যাবে ওসব নথি, আমাকে বলে দাও।’

‘তাতে কোনও লাভ হবে না তোমার। সার্টিফায়েড উকিল ছাড়া আর কেউ হাত দিতে পারে না ওখানে। নামটা বলো আমাকে।’

‘খোঁজখবর নিতে গেলে বিপদ হতে পারে তোমার!’ সতর্ক করল কুয়াশা।

‘কী যে বলো না!’ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল বোহ্‌ল ‘সত্তর বছরের পুরনো একটা পারচেজ-রেকর্ড… ‘

‘জমিটা পুরনো, কিন্তু তার সঙ্গে এখনকার লোকজনের সম্পর্ক আছে,’ অ্যাটর্নির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল কুয়াশা। ‘ভয়ানক লোকজন!’

‘কতটা ভয়ঙ্কর?’

‘চরমপন্থী বললেও কম বলা হয়।

‘টেরোরিস্টদের চেয়েও খারাপ?’

‘হাজার গুণ। এর ভিতর নিজেকে জড়ালে ভুল করবে তুমি, হাইনরিখ। তারচেয়ে আমাকে একটা অথোরাইজেশন লেটার লিখে দাও। আমি নিজেই খুঁজে নেব ল্যাণ্ড রেকর্ড।

মাথা নাড়ল বোহ্‌ল। ‘না, তা করছি না। লিগ্যাল কাগজপত্রের কতটুকু বোঝো তুমি? ওখানে গিয়ে সুবিধে করতে পারবে না। আমাকেই যেতে হবে। তবে চাইলে তুমি আমার সঙ্গী হতে পারো।’

‘জেনে-শুনে ঝুঁকি নেবে তুমি?’ কুয়াশার কণ্ঠে বিস্ময় ফুটল। ‘কেন?’

‘তোমার ঋণ শোধ করবার জন্য,’ বলল বোহ্‌ল। কীভাবে আমাদের পরিচয় হয়েছিল, ভুলে গেছ? নিওনাজিদের হাতে পড়েছিলাম আমি, খুন হয়ে যেতে বসেছিলাম… তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলে। তার কোনও প্রতিদান দিতে পারিনি। তোমার আবিষ্কারগুলোর পেটেন্ট করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম, তা-ও পারিনি। কিছু একটা করতেই হবে আমাকে, নইলে শান্তি পাব না।

‘আমি প্রতিদান চাই না, হাইনরিখ,’ নরম গলায় বলল কুয়াশা। ‘এসব বলে পার পাচ্ছ না। আমি যাব-ই ওখানে, দ্যাটস্ ফাইনাল। নামটা বলো।

জার্মান অ্যাটর্নির আচরণ দেখে হেসে ফেলল কুয়াশা। তারপর বলল, ‘ভারাকিন।’

.

সময় ঠিক করে নিয়েছিল ওরা, অফিসের কাজকর্ম সেরে লাঞ্চের পর কুয়াশার সঙ্গে দেখা করল জার্মান অ্যাটর্নি। দুজনে চলে গেল হল অভ রেকর্ডস্-এ। রিসেপশনে ইউনিফর্ম-পরা এক মেয়ে বসে আছে, সে-ই ওখানকার কেরানি। তার সামনে হাজির হতেই আলাদা সমাদর পেল হাইনরিখ বোহ্‌ল। শহরের সবচেয়ে বড় ফার্মগুলোর একটা তার, সবাই তাকে চেনে। মেয়েটা নিজেই তাকে সাহায্য করবার জন্য আসতে চাইল, কিন্তু হাত তুলে বাধা দিল বোহ্‌ল। কুয়াশাকে দেখিয়ে জানাল, অ্যাসিসটেন্ট নিয়ে এসেছে।

প্রপার্টি রেকর্ডসের বিশাল কামরাটার চারপাশে মূর্তিমান দানবের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু স্টিলের কেবিনেট। মাঝখানে রয়েছে বেশ কিছু কিউবিকল, সেখানে বসে সার্টিফায়েড লইয়ার-রা রিসার্চের কাজ করে।

‘সময়কাল অনুসারে সমস্ত নথি সংরক্ষণ করা হয় এখানে, জানাল বোহ্‌ল। কবে নাগাদ ভারাকিন এসেনে জমি কিনেছিল বলে মনে হয় তোমার?’

উনিশশো ছত্রিশে গঠিত হয়েছিল ফেনিস কাউন্সিল, মনে পড়ল কুয়াশার। তার পরেই নিশ্চয়ই জার্মানিতে এসেছিল ভারাকিন। অ্যাটর্নিকে বলল সেটা। তারপর যোগ করল, ‘তবে নিজ নামে কেনেনি সম্পত্তি… আমি শিয়োর।’

‘আসল নাম বা সম্ভাব্য ছদ্মনাম… কোনোটাই খুঁজব না আমরা। অন্তত শুরুতেই না।’

‘ছদ্মনাম নয় কেন? টাকা ছিল তার, ভুয়া নামে কেনাকাটায় কোনও অসুবিধে ছিল না।’

‘পরিস্থিতির কারণে। এখনও সে-পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। যত টাকাই থাকুক, পরিবার-সহ একজন মানুষ নতুন কোনও কমিউনিটিতে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে বিশাল সম্পত্তি কিনতে পারে না। তাতে লোকে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ভারাকিনের ব্যাপারে যতটুকু শুনেছি তোমার কাছে, তাতে তো মনে হয় না কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল সে। খুব ধীরে… সময় নিয়ে মিথ্যে পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে তাকে

‘তা হলে কী খুঁজব?’

‘মালিকের অনুপস্থিতিতে উকিলের মাধ্যমে কেনাকাটার রেকর্ড। অথবা কোনও ব্যাঙ্কের মাধ্যমে জনস্বার্থে কেনা জমি। কিংবা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ছোট কোনও কোম্পানিও কিনে নিতে পারে স্থাবর সম্পত্তিসহ। মালিকানা লুকানোর এমন হাজারটা কায়দা আছে। তবে একটা সময়ে লুকোচুরি শেষ করতে হয়… যখন মালিক ওই জমির দখল নিতে চায়। এসবের একটা প্যাটার্ন থাকে, দেখলেই চিনতে পারব আমি। এসো, ছত্রিশের মে মাস থেকে শুরু করি। এখানে কোনও সূত্র থাকলে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে না। এসেনের আশপাশে ত্রিশ-চল্লিশটার বেশি এস্টেট নেই। তার মধ্যে রেলিংহাউসেন আর স্ট্যাডওয়াল্ডে বড়জোর আছে পনেরোটা।’

কেবিনেট থেকে মোটাসোটা কয়েক বাণ্ডিল ফাইল এনে কাজ শুরু করে দিল ওরা। পুরনো, হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের স্তূপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে লেনিনগ্রাদে চলে গেল কুয়াশা… মনে পড়ল, ক’দিন আগে ঠিক এভাবে বৃদ্ধ শেভচেঙ্কোর সঙ্গে রাশান আর্কাইভের কাগজ ঘেঁটেছিল ও। বুক টন টন করে উঠল তাঁর কথা ভেবে। আড়চোখে তাকাল হাইনরিখ বোহ্‌লের দিকে। পারিপার্শ্বিকতার কথা ভুলে গেছে জার্মান অ্যাটর্নি, চরম উত্তেজনা নিয়ে পরখ করছে একটার পর একটা এন্ট্রি… যেন খেলনার দোকানে ছাড়া পাওয়া কোনও শিশু। ভয় হলো কুয়াশার, ওর পরিণতিও শেভচেঙ্কোর মত হবে না তো? অবশ্য… বোলের সঙ্গে ওর কানেকশনের ব্যাপারে জানা নেই কারও। ফেনিসের ওয়াচলিস্টে তার নাম থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

‘এই যে… এটা দেখো, হঠাৎ বলে উঠল বোহ্‌ল। বিল্ডেনি ভ্যালির সাঁইত্রিশ একর জায়গা—ভারাকিনের মত লোকের জন্য আদর্শ। রেমওয়াল্ড পরিবারের অনাথ, নাবালক বাচ্চাদের জন্য কিনে নিয়েছিল স্টাটব্যাঙ্ক অভ ডুইসবার্গ। ইন্টারেস্টিং, তাই না?’

‘রেমওয়াল্ড নামটার ব্যাপারে খোঁজ নেব আমরা?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশী।

উঁহু, ওটা শুধুমাত্র জমি কেনার সময় ব্যবহার করা হয়েছে। পরে দখল নিয়েছে অন্য কেউ। দু-চার বছর পরের ফাইলে ওই নাম পাওয়া যাবে। ওটাই দরকার আমাদের।’

‘ওটাই তা হলে ভারাকিনের নতুন পরিচয়?’

‘এত খুশি হয়ো না,’ মাথা নাড়ল বোহ্‌ল। ‘এখানে এ-জাতীয় কেসের বহর দেখতে পাচ্ছি।’ আরেকটা দলিল বের করল। ‘এই তো… ক্রুপ-দের এক কাজিন রেলিংহাউসেনের বিশাল এক সম্পত্তি দান করে দিয়েছে ডুসেলডর্ফের এক মহিলার নামে—দীর্ঘ ত্রিশ বছর তার পরিবারের সেবা করবার পুরস্কার! বিশ্বাস করতে পারো?’

‘একেবারেই কি অসম্ভব?’

‘অবশ্যই। পরিবারের বাকি সদস্যরা কিছুতেই এত বড় সম্পত্তি দান করতে দিত না। আমার ধারণা, অজ্ঞাত কোনও ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়েছে ওটা। দলিলের এই মহিলার হয়তো কোনও অস্তিত্ব নেই, কিংবা থাকলেও এই ক্রেতার হয়ে কাজ করছে।

‘হুম। তা হলে দুটো কেস পেলাম।’

‘আরও পাওয়া যাবে। এসো দেখতে থাকি।’

এগিয়ে চলল কাজ। ১৯৩৬… ৩৭… ৩৮… ৩৯।

আগস্টের বিশ তারিখের একটা রেকর্ডে চোখ পড়তেই থমকে গেল কুয়াশা। একটা নাম। হাইনরিখ বোহ্‌লের চোখে ওটা গুরুত্বহীন, কিন্তু ওর চোখে নয়। দু’হাজার মাইল দূরে, লেনিনগ্রাদে দেখা আরেকটা নথির কথা মনে পড়ে গেল কুয়াশার -ভারাকিন পরিবারের ইতিহাস… আর তাতে উল্লেখ করা প্রিন্স আন্দ্রেই-এর বন্ধুদের তালিকা। এখানে সে-তালিকারই একটা নাম দেখতে পাচ্ছে।

ফ্রেডরিখ শট্।

‘এক মিনিট,’ বলল ও। ‘কোথায় এটা?’

‘স্ট্যাডওয়াল্ড। কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নেই এর মধ্যে। একেবারে আইনসম্মত, পুরোপুরি ক্লিন।’

‘সেটাই হয়তো অস্বাভাবিক। এই ফ্রেডরিখ শট সম্পর্কে কী জানো তুমি?’

ভুরু কোঁচকাল বোহ্‌ল। যদ্দূর মনে পড়ে, ক্রুপদের হয়ে কাজ করত শ… বড়-সড় একটা পজিশনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সরকারের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে, মুদ্রা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভবত বিচার হয়নি। এসব কেন জিজ্ঞেস করছ?’

‘কারণ খুন হয়েছিল শট… অজ্ঞাতনামা আততায়ীর হাতে। সেজন্যেই বিচার হয়নি ওর। ভারাকিনের বন্ধু ছিল সে। এস্টেটের কী হয়েছিল? ওটা কি বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল?’

‘হবারই কথা। শটের সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছিল সরকার। টাকার জন্য সম্পত্তি বিক্রি করা ছাড়া উপায় ছিল না তার বিধবা স্ত্রী-র।

‘শিয়োর হওয়া যায় না?’

‘নিশ্চয়ই। কবে খুন হয়েছিল শট, জানা আছে তোমার?’

‘বিয়াল্লিশে। চলো ওই ফাইল দেখি।’

‘মাঝেরগুলো বাদ দিয়ে যাব?’ দ্বিধা ফুটল বোলের কণ্ঠে।

‘খটকা-টা দূর করে নিই। তারপর না হয় আবার ফিরে আসব।’

আধঘণ্টা লাগল দরকারি ফাইলটা খুঁজে পেতে। ওটায় চোখ বুলিয়ে বোহ্‌ল বলল, ‘খামোকাই খেটেছি আমরা। এস্টেট-টা ভরগেন পরিবার কিনে নিয়েছে তেতাল্লিশের মার্চে।

‘ভরগেন? মানে… ক্রুপ-দের প্রতিদ্বন্দ্বী?’

সে-আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। তবে ওদেরকে সন্দেহ করার কিছু নেই। গত শতাব্দীর শুরুতে মিউনিখ থেকে এসেনে আসে ভরগেন পরিবার… উনিশশো পনেরো কি ষোলো সালে। সবাই জানে সেটা। ওরা বংশগতভাবে জার্মান, অত্যন্ত সম্মানিত গোটা দেশজুড়ে। নামের শুরুতে ভি পাচ্ছ, কিন্তু সেটা ভারাকিনের ভি নয়।

কী কী জানে, তা খতিয়ে দেখল কুয়াশা। এমন সব মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল কাউণ্ট বারেমি, যারা এককালে প্রভাব-প্রতিপত্তির শীর্ষে ছিল, কিন্তু সব হারাতে বসেছিল নীতিহীন সরকার আর ব্যবসায়ীদের বড়যন্ত্রে। ভারাকিন ‘পরিবার ওই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল—রাশার রাজ-পরিবারের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি হয়েছিল তাদের, ফলাফল হিসেবে ওদের সম্পত্তি গ্রাস করে নিচ্ছিল রোমানভ-রা। কাউন্টের ডাক পাবার আগে এ-অবস্থা থেকে বাঁচার কোনও চেষ্টা কি করেনি তারা? গোপনে এমনিতেই হয়তো দেশত্যাগ করছিল… সরিয়ে নিচ্ছিল নিজেদের সব সম্পদ…

একটা জিনিস মনে পড়তে চমকে উঠল ও। ভারাকিনদের পারিবারিক প্রতীক! লতা-পাতায় ঘেরা একটা বর্ণ—ভি! ওটার আলাদা গুরুত্ব ছিল ওদের কাছে! ওটার মায়া ত্যাগ করতে পারেনি ওরা, সঙ্গে নিয়ে এসেছে!

ঝট্ করে অ্যাটর্নি বন্ধুর দিকে তাকাল কুয়াশা। উত্তেজিত গলায় বলল, ‘মাই গড! হিসেবে ভুল করেছি আমরা! উনিশশো ছত্রিশে নয়, তার বহু আগেই দেশ ছাড়তে শুরু করেছিল ভারাকিন-রা! অন্তত বিশ বছর আগে থেকে! ভেবে দেখো—তুমি নিজেই বলেছ, নতুন পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য ধীরে ধীরে, সময় নিয়ে এগোতে হয়েছে ওদেরকে। দুই দশক সময় নিয়েছে, এরচেয়ে নিখুঁত আর কী হতে পারে? মিউনিখ বা জার্মান শিকড়ের মিথ্যা তথ্যকে লোকের মনে গেঁথে দেবার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে ওরা। তা ছাড়া সে-আমলে ইয়োরোপ জুড়ে যে-অস্থিরতা চলছিল, তাতে ওদের ব্যাপারে খোঁজ নেয়া সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে… খোঁজ নেবার মত কৌতূহলও কখনও জাগায়নি। রাশা থেকে একজন একজন করে এসেছে এসেনে, আস্তে আস্তে বড় হয়েছে পরিবার—খুব স্বাভাবিক দেখিয়েছে সবকিছু।’

দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল বোলের। ‘ভরগেনের বউ!’

‘কী হয়েছে বউয়ের?’

‘বলা হতো, সে হাঙ্গেরিয়ান … ডেব্রেসেন-এর ধনী এক পরিবারের মেয়ে। জার্মান ভাল বলতে পারত না।’

‘তার মানে লেনিনগ্রাদের এক অশিক্ষিত মহিলা ছিল সে, নতুন ভাষা শেখার ক্ষমতা ছিল না। ওর স্বামীর পুরো নাম কী?’

‘অ্যানসেল ভরগেন,’ স্তম্ভিত গলায় বলল বোহ্‌ল।

‘অ্যানসেল?’ হাসল কুয়াশা। ‘আন্দ্রেই-এর জার্মান প্রতিশব্দ। মানব-চরিত্র নিয়ে জ্ঞান আরও বাড়ল তোমার। শুধু আচার-আচরণ না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাম-ধাম পাল্টানোর সময়ও পুরনো পরিচয়ের মায়া কাটাতে পারে না লোকে।

‘তারমানে…’

‘হ্যাঁ। অ্যানসেল ভরগেনই আমাদের আন্দ্রেই ভারাকিন!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *