দশ
গিল্ডেনপ্লাজ-এর রাস্তা ধরে হাঁটছে কুয়াশা আর বোহ্ল আশপাশের দোকানপাট ঝলমল করছে কৃত্রিম আলোয়, বিল্ডিঙের মাথায় লাগানো বিলবোর্ডগুলোতে নিয়নবাতি জ্বলছে-নিভছে নির্দিষ্ট ছন্দে। রাত আটটা বাজে, আকাশ অন্ধকার, বইছে হিমেল হাওয়া। হাঁটাহাঁটির আদর্শ পরিবেশ নয়, কিন্তু প্রপার্টি রেকর্ডসের গুদামতুল্য অফিসে ছ’ঘণ্টা কাটাবার পর মুক্ত বাতাস বড়ই ভাল লাগছে ওদের।
নীরবে হাঁটছিল দু’জনে। হঠাৎ বোহ্ল বলল, ‘ভেবেছিলাম অবাক হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি আমি। ওকালতি করতে গিয়ে অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার গা-সওয়া হয়ে গেছে। কিন্তু আজকে যা পেলাম, তা অবিশ্বাস্য। ভারাকিনের পিছনে কেন লেগেছ তুমি, কুয়াশা?’
‘কোনও একদিন হয়তো বলব তোমাকে,’ শান্ত গলায় বলল কুয়াশা।
‘ওটা কোনও জবাব হলো না।
আপাতত এ-নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তোমাকে। এখন ভরগেন পরিবার সম্পর্কে কী জানো, তা বলো আমাকে।
‘বলবার মত আসলে কিছু নেই। অ্যানসেলের বউ মারা গেছে পঞ্চাশের দশকে। কয়েক পছর পর তার বড় ছেলে আর ছেলে-বউও মারা পড়ে একটা সড়ক-দুর্ঘটনায়। পাহাড়ি খাদে গাড়ি-সহ পড়ে গিয়েছিল, লাশদুটো শেষ পর্যন্ত পাওয়াই যায়নি। এক মেয়ে ছিল, সে-ও উনিশশো একাত্তরে ক্যান্সারে মারা গেছে। অ্যানসেল অবশ্য বহুদিন বেঁচেছে, ক্রুপ-দের মত যুদ্ধাপরাধের কারণে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি তাকে। মারা গেছে আশি সালে, হর্স-রাইডিঙের সময় হার্ট অ্যাটাক করে।
‘কে বেঁচে আছে?’
‘ছোট ছেলে—ওয়ালথার ভরগেন। তার বউ, আর এক মেয়ে—ব্রুনা। মেয়েটা চিরকুমারী, বিয়ে-শাদী করেনি; তার মানে এই নয় যে, পুরুষদেরকে পছন্দ করে না সে।’
‘ঠিক বুঝলাম না।’
হাসল বোহ্ল। ‘এ-ধরনের মেয়েদেরকে পুরুষখেকো বলে। যৌবনে বেশ বদনাম ছিল তার-রোজ রাতে নাকি শয্যাসঙ্গী পাল্টাত। বয়স বাড়ার সঙ্গে পরিণত হয়ে উঠেছে, ব্রুনা-ই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ভরগেনদের পুরো ব্যবসা। ওয়ালথার আর তার বউয়ের বয়স আশি পেরিয়ে গেছে… সাধারণত জনসমক্ষে বেরোয় না ওরা।’
‘থাকে কোথায়?’
‘স্ট্যাডওয়াল্ডেই। না… শটের ওই এস্টেটে না। দলিল তো দেখেছ তুমি, ওটা পঞ্চান্ন সালে ডেভেলপারদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এ-জন্যেই ওটার কথা জানা ছিল না আমার। দুই বুড়ো-বুড়ি এখন স্ট্যাডওয়ার্ল্ডের ভিতরদিকের একটা বাড়িতে বাস করে।’
‘আর ব্রুনা?’
কাঁধ ঝাঁকাল বোহল। ‘সেটা নির্ভর করে ওর মর্জির উপর। ওয়ার্ডেনস্ট্রাসে একটা পেন্টহাউস আছে ব্রুনার নানা ধরনের, নানা বয়সের, নানা পেশার পুরুষেরা আনাগোনা করে ওখানে। শুনেছি, প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে সেক্সুয়ালি ব্ল্যাকমেইল করা হয় ওখানে আর হ্যাঁ… বাপ-মায়ের জমিতে একটা কটেজও বানিয়েছে, মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে ওঠে।’
‘শুনে তো মনে হচ্ছে খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র।’
‘তা তো বটেই। পঁয়তাল্লিশতম জন্মদিন পালন করেছে গত বছর, কিন্তু আজকালকার মেয়েরা পেরে উঠবে না ওর সঙ্গে—রূপ, বা মেধা… কোনও দিক দিয়েই না।’ একটু থামল বোহ্ল। ‘একটা খুঁত আছে ব্রুনার। শক্ত হাতে ব্যবসা সামলাচ্ছে, তারপরেও শুনেছি মাঝে মাঝে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। তখন বাবার পরামর্শ নিতে যায়। হাবভাবে তো মনে হয়, মেয়ে যতই কৰ্তৃত্ব দেখাক, আসল নিয়ন্ত্রণ এখনও রয়ে গেছে বুড়ো ওয়ালথারের হাতে।’
‘তোমার পরিচয় আছে লোকটার সঙ্গে?’
‘স্রেফ মুখচেনা, গভীর কিছু নয়।’
‘কী মনে হয় তাকে?’
‘খুব বড় কিছু নয়। প্রতিভা আছে স্বীকার করি, কিন্তু কর্মজীবনে লোকটা তার প্রতিফলন দেখাতে পারেনি। তা হলে ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রি পুরো ইয়োরোপের বাজার দখল করে নিতে পারত।’
হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে দুর্বল দেখিয়েছে ওয়ালথার ভরগেন, ভাবল কুরাশা। কেনিলের শীর্ষপদগুলোর একটায় থাকা অবস্থায় দুনিয়ার সামনে জাহির করতে চায়নি নিজেকে।
‘ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি,’ বলল ও। ‘একা। বাড়িটাতে গেছ কখনও।’
‘একবার… বেশ ক’বছর আগে,’ জানাল বোহ্ল। ‘পেটেণ্ট, সংক্রান্ত একটা সমস্যা সমাধান করতে পারছিল না ওদের নিজস্ব লইয়ার-রা, তাই আমাকে ভাড়া করেছিল। তখনই গিয়েছিলাম ওখানে, লিগ্যাল ডকুমেন্টে বুড়ো ভরগেনের একটা সই নেবার জন্য। সই-টা ব্রুনা করলেও চলত, কিন্তু ও তখন দেশের বাইরে। আমি ওখানে হাজির হয়েছি শুনেই ফোন করে বসল। চেঁচামেচি করে জানাল, ওর বাবাকে বিরক্ত করে নাকি মহা-অন্যায় করেছি আমি। ভদ্রভাবে কারণটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাভ হলো না। গালাগালি করে আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলল। সেইসঙ্গে টেলিফোনেই বরখাস্ত করল আমাকে।’
‘মনে হচ্ছে খুব রেগে আছ ঘটনাটায়,’ মুচকি হাসল কুয়াশা।
‘রাগব না? নিজের উকিলকে ওভাবে অপমান করে কেউ?’ তিক্ত গলায় বলল বোহ্ল। ‘সেদিনই শিয়োর হয়েছি, ব্রুনা একজন ইতর মহিলা।’
সহানুভূতি অনুভব করল কুয়াশা বন্ধুর জন্য। ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আশা করি এর প্রতিদান কোনও একদিন পাবে ওরা! এনিওয়ে, শেষ দুটো অনুরোধ আছে আমার। প্রথমটা হলো, আমাদের এই সাক্ষাতের কথা কাউকে বোলো না তুমি, নিজের বউকেও না।’
‘ঠিক আছে,’ বলল বোহ্ল। ‘আর দ্বিতীয় অনুরোধ?’
‘ভরগেনের বাড়িটা সম্পর্কে জানতে চাই আমি। লোকেশন, সীমানা, গেট, সিকিউরিটি… সোজা কথায় যতকিছু মনে পড়ে, সব খুলে বলো আমাকে।
.
হেডলাইটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে উঁচু এক প্রাচীরের কোনা, ভাড়া করা মার্সিডিজের অ্যাকসেলারেটরে পায়ের চাপ কমাল কুয়াশা। চকিতের জন্য দেখে নিল অডোমিটার, প্রাচীরের শুরু থেকে মূল ফটকের দূরত্ব হিসাব করল—প্রায় আঠারোশ’ ফুট। লোহার তৈরি প্রকাণ্ড ফটকটা এ-মুহূর্তে বন্ধ। যান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় ওটা।
দেয়ালের শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটু থামল ও। এ-পাশটা গেটের ও-পাশ থেকে সামান্য ছোট। দেয়ালের পরেই গাছপালার সারি, ঘন অরণ্যের ভিতর তৈরি করা হয়েছে ভরগেন কম্পাউণ্ড। আবার সামনে এগোল গাড়ি নিয়ে, চঞ্চল চোখে গাছগাছালির মাঝে এক টুকরো জায়গা খুঁজছে, যেখানে লুকানো যায় মার্সিডিজটাকে।
বড় দু’টো গাছের মাঝখানে পাওয়া গেল অমন জায়গা, মাথার উপরে ঘন ডালাপালার কারণে প্রাকৃতিক একটা গুহার মত আকৃতি পেয়েছে ওটা। গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে ওখানে ঢুকে পড়ল কুয়াশা, এগিয়ে গেল যতদূর সম্ভব, বাইরে থেকে যেন দেখা না যায় ওটাকে। একটু পর ইঞ্জিন বন্ধ করল ও। পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এল রাস্তায়, পিছন ফিরে দেখে নিল জায়গাটা। অন্ধকারে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছে মার্সিডিজ।
ছড়িতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ভরগেন কম্পাউণ্ডের দেয়ালের দিকে হাঁটতে শুরু করল কুয়াশা। ভবঘুরের মত বেশভূষা নিয়ে এসেছে, হঠাৎ দেখলে হতভাগ্য একজন পঙ্গু মানুষ ছাড়া আর কিছু মনে হবে না ওকে। হাঁটতে হাঁটতে দেয়ালের উপর নজর বোলাল, ওটা টপকাতে পারলে সহজেই বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে বলে আশা করছে। ইলেকট্রনিক্যালি পুরে জঙ্গলকে স্ক্যান করা সম্ভব নয় কারও পক্ষে। বুনো পশু-পারির অত্যাচারে সারাক্ষণই নানা ধরনের সঙ্কেত দিতে থাকবে সেন্সরগুলো। কাজেই প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা যা থাকার, থাকবে কেবল সীমানার প্রাচীরে।
দেয়ালের পাশে পৌঁছে লাইটার জ্বালল কুয়াশা, কাঁপা কাঁপা আলোয় পরীক্ষা করল দেয়ালের গা। বিশেষত্বহীন। কারসাজি তা হলে দেয়ালের মাথায় করা হয়েছে। মাথা ঘোরাল ও। কয়েক গজ দূরে দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একটা ওক গাছ, দেয়ালের দিকটাতে ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, যেন ওটা ধরে সীমানার ভিতরে যেতে না পারে কেউ। তাতে অসুবিধে নেই কুয়াশার। ছড়িটা ভাঁজ করে ঢুকিয়ে ফেলল পকেটে, তারপর তরতর করে গাছ বেয়ে উঠে গেল মগডালে।
উপরে পৌঁছে দেয়ালের দিকে তাকাল ও। যা ভেবেছে তা-ই দেয়ালের মাথায় ইলেকট্রিক্যাল ওয়ায়্যার আর মোশন সেন্সর ফিট করে রাখা হয়েছে কম্পাউণ্ডের পুরো সীমানা জুড়ে। ভিতরে কোথাও নিয়ন্ত্রণ-কেন্দ্র আছে, সেখান থেকে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করা হচ্ছে ওগুলো। ভেবে দেখল কুয়াশা, চেষ্টা করলে হয়তো অচল করা যাবে দু-একটা সেন্সর, কিন্তু সেটা করতে গেলে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে প্রহরীদের। ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি সিস্টেম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করাই ভাল। কম্পাউণ্ডের ভিতরদিকে নজর বোলাল এরপর। চকিতের জন্য একজন গার্ডকে দেখতে পেল—টহল দিচ্ছে। তারমানে সিস্টেমটা শুধুমাত্র সীমানার জন্য, ভিতরটা কাভার করা হচ্ছে টহলের মাধ্যমে। নিশ্চিন্তে এগোনো যেতে পারে।
বড় করে শ্বাস টানল ও, কোমর থেকে খুলে নিল বেল্ট। জিনিসটা ওর নিজের আবিষ্কার—নিখুঁতভাবে ডিজাইন করা বাকলের ভিতর খুদে একটা পিটন-সহ পঁচাত্তর ফুট হাই-টেনসিল কর্ড রয়েছে। ওই কর্ড ওর ভার বহন করার জন্য যথেষ্ট শক্ত। আঙুল দিয়ে বাকলের সেফটি ক্যাচ খুঁজে নিল কুয়াশা, ঠেলে সরিয়ে দিল অফ সেটিং-এ, তারপর বেল্টটা ডান কবজিতে পেঁচাল।
হাত তুলল ও, লক্ষ্যস্থির করল কম্পাউণ্ডের ভিতরের একটা গাছের দিকে। আবার বড় করে শ্বাস টেনে তিন পর্যন্ত গুনল, তারপর চাপ দিল বাকলে লাগানো ফায়ারিং মেকানিজমে কবজিতে ঝাঁকি খেলো বেল্ট, ছুটে যাচ্ছে পিটন, পিছনে সাপের মত হাই-টেনসিল কর্ড। এক নিমেষে পৌঁছে গেলেও, কুয়াশার মনে হলো ঘটনাটা ঘটছে স্লো-মোশনে। দম বন্ধ করে আছে, প্রার্থনা করছে খুদে পিটন যেন আটকায় গাছের কাণ্ডে। তারটা দেয়ালের উপর আছড়ে পড়লেই সর্বনাশ, হাই-ভোল্টেজ ইলেকট্রিসিটি ছুটে আসবে ইস্পাতের কর্ড বেয়ে… শক খেয়ে ঘায়েল হতে হবে ওকে।
আশঙ্কাটাকে অমূলক প্রমাণ করে ঠক করে আওয়াজ তুলল পিটন, গেঁথে গেছে গাছের গায়ে। বেল্ট ধরে টান দিয়ে পরীক্ষা করল কুয়াশা-না, খুলে আসার ভয় নেই… ভালভাবেই আটকেছে ওটা। কর্ডের এ-প্রান্তটা ওক গাছের কাণ্ডের সঙ্গে টানটান করে বাঁধল ও, তারপর ঝুলে পড়ল–হাত-পা ব্যবহার করে র্যাপেলিঙের মাধ্যমে এগোচ্ছে কম্পাউণ্ডের দিকে।
প্রায় ষাট ফুট প্যারালাল র্যাপেলিং—সহজ কাজ নয়। পিঠ আর হাতের পেশি ব্যথা হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। শীতবোধ উধাও হয়ে গেছে, পরিশ্রমে সারা শরীর ঘামছে দরদর করে। থামল না ও, এগিয়ে চলল। শেষে যখন ওপাশের গাছটার ডালে পা রাখল, তখন সারা শরীর কাঁপছে।
ধাতস্থ হতে একটু সময় নিল কুয়াশা, তারপর সাবধানে উঁকি দিল নীচে। না, দেখা যাচ্ছে না কাউকে। ওর অনুপ্রবেশ টের পায়নি প্রহরীরা। চিকন কর্ডটাও রাতের অন্ধকারে মিশে আছে, খালি চোখে দেখা যায় না। নিশ্চিত হয়ে গাছ থেকে নেমে এল ও। গাছগাছালির ছায়া আর ঝোপঝাড়ের আড়াল ব্যবহার করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ভরগেনদের বাড়ির দিকে। কম্পাউণ্ডের ঠিক মাঝখানে ওটা। দূর থেকে জানালার আলো চোখে পড়ছে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল কুয়াশা, ঝট্ করে বসে পড়ল ঝোপের আড়ালে। ওর ঠিক দশ হাত সামনে উদয় হয়েছে একটি ছায়ামূর্তি। ফস করে দেশলাই জ্বলে উঠল, সিগারেট ধরাল লোকটা। আগুনের আভায় ইউনিফর্মধারী একজন পুরুষকে দেখা গেল—গায়ে উইন্টার জ্যাকেট, পায়ে ভারী বুট; কোমরের বেল্টে রয়েছে হোলস্টারে ভরা পিস্তল। একজন গার্ড।
আয়েশ করে মিনিট পাঁচেক ধরে সিগারেট টানল লোকটা, তারপর ছোট হয়ে আসা গোড়াটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষল। হাই তুলল সে, ধীর গতিতে হেঁটে চলে গেল বিশ গজ, তারপর আবার ফিরে আসতে শুরু করল। মনে হলো এই ছোট্ট অংশটাই তার টহলের সীমানা। সন্দেহ নেই, ঠিক একই কায়দায় বাড়ির চারপাশে মোতায়েন করা হয়েছে আরও প্রহরী। পুরনো আমলের রাজা-বাদশাদের যে-ভাবে রক্ষা করা হতো, ঠিক সে ভাবে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রেখেছে। তবে এখন আর রাজা-বাদশাদের যুগ নেই… নেই সে-আমলের মত বিপদের ঝুঁকিও! তাই ঢিলেঢালা ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে প্রহরায়। ডিউটির সময়ে সিগারেট ফোঁকা, হাই তোলা, আর অলসভাবে হাঁটাহাঁটি তারই লক্ষণ।
লোকটাকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যেতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু অসুবিধে দেখা দেবে তার পরে। সামনের লন পেরিয়ে ড্রাইভওয়ের ছায়ায় পৌছুতে হবে ওকে, জায়গাটা বাড়ির ছাতে লাগানো ফ্লাডলাইটের আলোয় আলোকিত। কী করা যায় ভাবল কুয়াশা, একটু পরেই হাসি ফুটল ঠোঁটে। বেশভূষা বদলাতে হবে ওকে গার্ডের পোশাক পরা একজন মানুষ যদি লন পেরিয়ে বাড়ির দিকে যায়, কেউ কিছু সন্দেহ করবে না
ঝোপের পিছনে ধৈর্যপরীক্ষায় নামল কুয়াশা, অপেক্ষা করছে সামনের গার্ডের পরবর্তী সিগারেট-ব্রেকের জন্য। মিনিট বিশেক পর সমাপ্তি ঘটল প্রতীক্ষার। হাঁটা বন্ধ করে ওর কয়েক গজ দূরে দাঁড়াল, পকেট থেকে বের করে আনল সিগারেটের প্যাকেট। নিমেষে বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে পিছন
পিছন থেকে শিকারি-বাঘের মত হামলা করল ও। মুখের কাছে লাইটার তুলছিল গার্ড, ঘাড়ের উপর প্রচণ্ড এক রন্দা খেয়ে বেহুঁশ হয়ে গেল। মুখটা জাপটে ধরে ফেলল কুয়াশা, যাতে চিংকার করতে না পারে। অজ্ঞান দেহটা সাবধানে নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল ঝোপের পিছনে
কাপড় বদলাতে সময় লাগল মাত্র দু’মিনিট। তারপরেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ও। হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। আগেই দেখে নিয়েছে গার্ডের হাঁটার ধরন। অলস পায়ে লন পেরুতে থাকল, আড়চোখে বার বার তাকাচ্ছে ডানে-বাঁয়ে। মনে আশঙ্কা, এই বুঝি কেউ চেঁচিয়ে ওঠে।
তেমন কিছু ঘটল না। নিরাপদেই ড্রাইভওয়ের ছায়ায় পৌঁছে গেল কুয়াশা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওখানে পৌঁছে। ড্রাইভওয়েটা পঞ্চাশ ফুট লম্বা। শেষ মাথায় একটা খোলা দরজা দিয়ে এক চিলতে আলো আছড়ে পড়ছে পেভমেন্টের উপর। স্থূলদেহী এক মহিলার অবয়ব দেখা গেল ওখানে, দু’হাতে গার্বেজ ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে বাড়ির ভিতর থেকে। চাকরানী নিঃসন্দেহে।
নির্দ্বিধায় তার দিকে এগিয়ে গেল কুয়াশা। খাঁটি জার্মান ভাষায় বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আমার ক্যাপ্টেন একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন হের ভরগেনের জন্য!
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল মেইড়। ‘কে তুমি?’
‘নতুন এসেছি, তাই চিনতে পারছেন না।’ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল কুয়াশা। ‘ব্যাগগুলো দিন, আমি সাহায্য করছি আপনাকে।’
নড়ল না মহিলা। ‘হুঁ, নতুন ই বটে তুমি। নইলে আমাকে সাহায্য করতে চাইতে না। তোমার সঙ্গী-সাথীরা তো সারাদিন এটা-ওটা ফরমায়েশ দিতে দিতে জান খারাপ করে দেয় আমার। ভাব দেখায় আমি যেন ওদের কেনা বাঁদী।’
‘কথা না শুনলেই পারেন। ওরা নিশ্চয়ই বেতন দেয় না আপনাকে?’
‘তা দেয় না, কিন্তু চাইলেই আমার চাকরি খেতে পারে। বলবে যে, বাড়ির নিরাপত্তার জন্য আমি একটা হুমকি। ব্যস, তাতেই…’
‘এত ভয় পাবেন না। আপনার পক্ষে কথা বলবার লোকও দেখবেন ঠিকই পাওয়া যাবে। দিন ব্যাগগুলো।
‘থাক, কষ্ট করতে হবে না, আমিই পারব।’ হাসল মেইড, কুয়াশার কথায় খুশি হয়েছে। ‘কী নাম তোমার?’
‘গটফ্রিড।
‘আমি হেলগা। পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। কী কাজে যেন এসেছ?’
‘একটা মেসেজ… হের ভরগেনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। ‘আমাকে দিলে চলে? আমি পৌঁছে দেব নাহয়।’
‘সরি, সরাসরি ওঁর কাছেই দিতে হবে ওটা। কোথায় পাওয়া যাবে ভদ্রলোককে
হাতঘড়ি দেখল হেলগা। ‘দশটা বেজে গেছে। তারমানে বুড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে, আর বুড়ো গিয়ে ঠাঁই নিয়েছে তার চ্যাপেলে।’
‘কোথায় ওটা?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। দুঃখিত, এখানকার কিছুই চিনি না আমি।’
‘কোনও অসুবিধে নেই, আমি নিয়ে যাব তোমাকে;’ বলল হেলগা। ‘এক মিনিট সময় দাও আমাকে। ময়লাগুলো ফেলে আসি।’
বাড়ির পিছনের গার্বেজ ক্যানে ব্যাগদুটো রেখে এল সে। তারপর কুয়াশাকে নিয়ে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে। সংকীর্ণ একটা প্যাসেজ ধরে এগোল ওরা, একটু পর পৌছে গেল বাড়ির এন্ট্রান্স হলে। বিশাল এক বৃত্তাকার কামরা—পায়ের নীচে দামি কার্পেট, দেয়ালগুলো মেহগনি কাঠের প্যানেলে মোড়া। ঘর জুড়ে শোভা পাচ্ছে বহুমূল্য পেইন্টিং আর অ্যান্টিকের সংগ্রহ। একপাশে রয়েছে ঘোরানো সিঁড়ি, ধাপগুলো ইটালিয়ান মার্বেলে গড়া, রেলিংটা খাঁটি রূপার—উঠে গেছে দোতলার ইনার ব্যালকনিতে। অনেকগুলো দরজা রয়েছে ওখানে, প্রতিটার পিছনে একটা করে রুম। এন্ট্রান্স হলে দাঁড়াবার সৌভাগ্য হলো না, বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলেছে মেইড। তাকে অনুসরণ করল কুয়াশা। সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে, কামরার এক প্রান্তে একটা ভারী দরজার সামনে থামল ওরা, পাল্লার গায়ে বাইবেলের বিভিন্ন দৃশ্য খোদাই করে রাখা হয়েছে।
হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল হেলগা, ওপাশের ছোট্ট সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল ভূ-গর্ভে। ছোট একটা অ্যান্টিচেম্বারে পা রাখল ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে। হলঘরের সিঁড়ির মত মার্বেলে তৈরি করা হয়েছে মেঝে, দেয়ালে নানা রকম ট্যাপেস্ট্রি—তাতে খ্রিস্টানদের বিভিন্ন ধর্মযুদ্ধের দৃশ্য আঁকা। পুরনো আমলের চার্চে যে-ধরনের পানির কল আর বেসিন থাকত, তেমনই একটা অ্যান্টিক সাজিয়ে রাখা হয়েছে অ্যান্টিচেম্বারের এক কোণে। আরেক প্রান্তে রয়েছে আর্চওয়ে–অ।কৃতির একটা বন্ধ দরজা, ওপাশে ওয়ালথার ভরগেনের চ্যাপেল।
‘চাইলে ব্যাঘাত ঘটাতে পারো,’ হেলগা বলল, ‘দোষ যা হবার তোমার ক্যাপ্টেনের হবে। তবে একটু অপেক্ষা করলে ভাল হয়। প্রিস্টের ওয়াজ-নসিহত শেষ হয়ে যাবে ততক্ষণে।’
‘প্রিস্ট!’ চেষ্টা করেও বিস্ময়টা চাপা দিতে পারল না কুয়াশা। ‘ফেনিসের ধারক-বাহক ধর্মচর্চা করছে?
‘হুঁ,’ বলে উল্টো ঘুরল হেলগা। ‘কী করবে সেটা এখন তোমার সিদ্ধান্ত। আমি যাই, অনেক কাজ পড়ে আছে।’ সিঁড়ি ধরে চলে গেল সে।
এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান পাতল কুয়াশা। ভিতর থেকে ভেসে আসছে মন্ত্রপাঠের আওয়াজ। একটু খেয়াল করতেই বুঝল, রুশ ভাষায় চলছে সে-আবৃত্তি। ওয়ালথার ভরগেন যে প্রিন্স ভারাকিনের সন্তান, ধারণাটা আরও দৃঢ় হলো ওর। বিস্ময় জাগছে কেবল নিভৃত-ধর্মচর্চা নিয়ে। যারা দুনিয়াকে ধ্বংস করে দিতে চায় অন্যায় আর অপরাধের মাধ্যমে, তাদের একজন কেন ঈশ্বরের প্রার্থনা করবে?
সাবধানে দরজার হাতল ঘোরাল কুয়াশা, পাল্লা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক করে উঁকি দিল ভিতরে। নাকে ভেসে এল কৃত্রিম সুবাস, চোখে আঘাত করল সার বেঁধে জ্বলতে থাকা মোমবাতির আলো। দৃষ্টি স্বাভাবিক হলে চ্যাপেলের অভ্যন্তর দেখতে পেল ও। খুব বড় নয়, মাত্র পাঁচ সারি আসন ওখানে। ভিতরটা সাজানো হয়েছে . রাশান অর্থোডক্স চার্চের আদলে, দেয়ালে ঝুলছে ক্রুশবিদ্ধ যিশু আর নানা রকম ধর্মীয় প্রতীক। শেষ প্রান্তে উঁচু মঞ্চ আর প্রার্থনাবেদি, সেখানে সিল্কের আলখাল্লা পরা একজন মাঝবয়েসী প্রিস্ট প্ৰাৰ্থনা পরিচালনা করছেন। তাতে অংশ নিচ্ছে একজন মাত্র মানুষ–অশীতিপর এক বৃদ্ধ, মাথার চুল পাতলা হয়ে গিয়ে টাক দেখা যাচ্ছে। চেহারা বোঝা গেল না, মানুষটা এদিকে পিঠ ফিরিয়ে মঞ্চের সিঁড়িতে সেজদার ভঙ্গিতে পড়ে আছে। ঈশ্বরের সামনে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদনের ভঙ্গি ওটা। সন্দেহ নেই, এ-ই ওয়ালথার ভরগেন।
বড় করে শ্বাস নিল কুয়াশা, তারপর দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল চ্যাপেলে। সারি বাঁধা আসনগুলোর মাঝের আইল ধরে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে গেল ও মঞ্চের দিকে। পদশব্দ শুনে মাথা তুললেন প্রিস্ট, ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। সেজদা থেকে উঠে পড়ল বৃদ্ধও, ঘুরল কুয়াশার দিকে।
‘অ্যাই!’ কর্কশ গলায় বলে উঠলেন প্রিস্ট। ‘এখানে ঢোকার অনুমতি কে দিয়েছে তোমাকে?’
লোকটাকে পাত্তা দিল না কুয়াশা, মঞ্চের কাছে গিয়ে থামল। বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি একজন সত্যসন্ধানী, ভারাকিন। লেনিনগ্রাদ থেকে এসেছি। আশা করি আর কিছু বলবার প্রয়োজন নেই?’
কেঁপে উঠল ওয়ালথার ভরগেন, পড়েই যাচ্ছিল…. পিছন থেকে তাকে ধরে ফেললেন প্রিস্ট। রাগী গলায় বললেন, ‘কে তুমি? ঈশ্বরের প্রার্থনায় বাধা দেয়ার অধিকার কে দিয়েছে তোমাকে?’
‘অধিকারের কথা বোলো না, শয়তানের দোসর!’ পাল্টা তেজে বলল কুয়াশা। ‘তোমাদেরকে দেখলে আমার ঘেনা হয়!
উত্তেজিত হলেন না প্রিস্ট। বললেন, ‘কারও দোসর নই আমি। ঈশ্বরের সেবা করি… এর বাইরে আর কোনও কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক নেই আমার।’
প্রিস্টের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ওয়ালথার ভরগেন। পুরো শরীর কাঁপছে তার। ভাঙা গলায় বলল, ‘তা হলে শেষ পর্যন্ত তুমি এলে? জানতাম, হাল ছাড়বে না তোমরা। প্রতিশোধ নেবার অধিকার শুধুই ঈশ্বরের, কিন্তু তা তোমরা মানো না। তোমার সঙ্গে কোনও সংঘাত নেই আমার, তবুও এসেছ প্ৰাণ কেড়ে নিতে। ঠিক আছে, যা খুশি করো, বলশেভিক। কিন্তু এই প্রিস্টকে যেতে দাও। ও ভারাকিন নয়।
‘আমি বলশেভিক নই,’ শান্ত গলায় বলল কুয়াশা।
‘নও?’ বিস্ময় ফুটল ওয়ালথার ভরগেনের কণ্ঠে। ‘তা হলে কেন…’
‘কারণ আপনি একজন ভারাকিন।’
‘হ্যাঁ… আমার দুর্ভাগ্য, স্বীকার করল বৃদ্ধ, এবং আমার কলঙ্ক। দুটোই এত বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি আমি। ঈশ্বরের কৃপা না থাকলে সম্ভব হতো না এ-লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকা।’
‘একজন বলছে অধিকার, আরেকজন ঈশ্বরের কথা!’ ঘৃণা প্রকাশ পেল কুয়াশার গলায়। ধিক্ তোমাদেরকে। হিপোক্রিটের দল! পার নস্ত্রো সার্কোলো!’
চোখ পিট পিট করল ওয়ালথার ভরগেন। চেহারা প্রতিক্রিয়াহীন। ‘কী বললে?’
‘শুনতে পাওনি?’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কুয়াশা। ‘পার নস্ত্রো সার্কোলো!’
‘শুনছি তোমার কথা… কিন্তু বুঝতে পারছি না।
‘ফিনিক্স কাউন্সিলের কথা বলছি আমি। কর্সিকা… পোর্তো ভেচিয়ো… কাউণ্ট গিলবার্তো বারেমি!’
ঘাড় ফিরিয়ে প্রিস্টের দিকে তাকাল ওয়ালথার ভরগেন। ‘ফাদার, শুনতে ভুল করছি না তো? কীসের কথা বলছে ও?’
‘ব্যাখ্যা করো!’ বললেন প্রিস্ট। ‘কে তুমি? কী চাও? ওই কথাগুলোরই বা মানে কী?’
‘তোমার মনিবের সেটা জানা আছে,’ বিদ্রূপের স্বরে বলল কুয়াশা।
‘কী জানা আছে?’ ভরগেনের কণ্ঠে নিখাদ বিস্ময়। স্বীকার করছি, ভারাকিন হিসেবে আমাদের হাতে বহু নিরীহ রাশানের রক্ত লেগে আছে… কিন্তু যা জানি না, তা স্বীকার করব কীভাবে?’
‘আরও ক্লু দিতে হবে?’ বলল কুয়াশা। ‘তোমার গুরু… রাখাল বালকের ব্যাপারে জানতে চাই আমি।’
‘আমার কোনও ক্লু নেই’ বলল ভরগেন। ঈশ্বরই আমার সব!’
‘আমি বিশ্বাস করি না।’
উঠে দাঁড়ালেন প্রিস্ট। ‘থামাও এসব!’ চাবুকের মত গর্জে উঠল তার কণ্ঠ। ‘নিরীহ, ধর্মভীরু একজন ভালমানুষের সঙ্গে এমন ব্যবহার করবার কোনও অধিকার নেই তোমার। কী করেছেন উনি? দিনের পর দিন… বছরের পর বছর ধরে পূর্বপুরুষদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে যাচ্ছেন— এমন পাপ, যাতে তাঁর নিজের কোনও হাত ছিল না। তারপরেও ক্ষমা চাইছেন ঈশ্বরের কাছে! ছোটবেলা, থেকে ধর্মের পথ অনুসরণ করতে চেয়েছেন মানুষটা, অনুমতি পাননি… কিন্তু এখন নিজেকে ঈশ্বরের অনুসারী করে গড়ে তুলেছেন। এ তো অন্যায় নয়!’
ঈশ্বর না, ও ফেনিসের অনুসারী।’ সরোষে বলল কুয়াশা।
‘এর অর্থ কী, জানা নেই আমার। কিন্তু এই মানুষটা কেমন, তা জানি। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা দান করেন তিনি ক্ষুধার্ত, দুস্থ মানুষের সেবায়। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তৈরি করেন মন্দির, মসজিদ আর গির্জা। বিনিময়ে আজ পর্যন্ত কিছুই চাননি।
‘লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্য করে ওসব… ফেনিসের টাকায়! আসল উদ্দেশ্য থাকে অন্য কিছু
‘মিথ্যে বলছ তুমি!’
এই সময় ধড়াম করে খুলে গেল চ্যাপেলের দরজা। ঝট্ করে উল্টো ঘুরল কুয়াশা। কালো পোশাক পরা এক লোক উদয় হয়েছে ওখানে। পজিশন নিয়েছে দু’পা ফাঁক করে, হাতদুটো সামনে প্রসারিত, মুঠোর মধ্যে ধরে রেখেছে একটা নাইন মিলিমিটারের অটোমেটিক… তাক করেছে ওর দিকে।
‘ডোন্ট মুভ!’ হুকুম দিল লোকটা। ‘অস্ত্র ফেলে দাও।
কথামত কাজ করল কুয়াশা। ফাঁদে পড়ে গেছে।
কয়েক মুহূর্ত পরে চ্যাপেলে ঢুকল দুজন নারী। প্রথমজন বেশ লম্বা, তীক্ষ্ণ চেহারা, ফ্যাশন মডেলদের মত একহারা দেহ, পরনে বিজনেস সুট। যুবতী বলা যাবে না, তবে বয়সের কোনও বিরূপ প্রভাব পড়েনি তার অবয়বে; বরং বয়স তার ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। চোখের তারায় আগুন, গায়ের রঙ পোর্সেলিনের মত ধবধবে সাদা। ঘন কেশরাজি বেঁধে রাখা হয়েছে খোঁপায়, ভাল করে তাকালে একটা-দুটো ধূসর চুল হয়তো বা দেখা যাবে। দ্বিতীয়জন খর্বকায়, সাদাসিধে গাউন আর ওভারকোট পরেছে। চেহারা অতি পরিচিত, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একে দেখেছে কুয়াশা—- হল অভ রেকর্ডসের রিসেপশনে। মেয়েটা ওখানকার সেই কেরানি!
‘এ-ই সেই লোক,’ প্রথমজনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে জানাল সে।
‘ধন্যবাদ,’ মাথা ঝাঁকাল বিজনেস সুট পরিহিতা মহিলা। ‘এবার তুমি যেতে পারো। আমার শোফার তোমাকে শহরে পৌঁছে দেবে। টাকাও জমা হয়ে যাবে তোমার অ্যাকাউন্টে।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, ম্যা’ম… থ্যাঙ্ক ইউ।’
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। হলঘরে অপেক্ষা করছে শোফার। শুভরাত্রি।
‘শুভরাত্রি, ম্যাম।’
চলে গেল মেয়েটা।
‘ব্রুনা!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ওয়ালথার ভরগেন। প্রিস্টের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ইতিমধ্যে। ‘এই লোকটা…’
‘দুঃখিত, বাবা,’ বাধা দিয়ে বলল ব্রুনা ভরগেন, ‘বংশের ঐতিহ্যের সঙ্গে কোনোদিনই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারোনি তুমি। অনেক কিছুই তাই গোপন রাখা হয়েছে তোমার কাছ থেকে। সন্দেহ নেই, এ-লোক আজ তোমাকে এমন কিছু শুনিয়েছে, যা শোনার কথা ছিল না তোমার।
ঘাড় কাত করে নিজের সঙ্গীকে ইশারা দিল সে। পরমুহূর্তে গর্জে উঠল অস্ত্রধারীর অটোমেটিক, একপাশে সরে এসে গুলি চালিয়েছে লোকটা। ওয়ালথার ভরগেনের শীর্ণ দেহ ঝাঁকি খেলো, বুক চেপে ধরে প্রার্থনামঞ্চের সিঁড়িতে আছড়ে পড়ল সে। খুনির পরের গুলির শিকার হলেন মাঝবয়েসী প্রিস্ট। কপালের একটা ‘– অংশ উড়ে গেল তাঁর, রক্ত আর মগজ ছিটিয়ে লাশটা ধড়াম করে পড়ে গেল মঞ্চের উপর।
আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনের বেশ কয়েক মুহূর্তের জন্য ভাসল চ্যাপেলের ভিতর। তারপর নেমে এল থমথমে নীরবতা।
অকস্মাৎ এ-হত্যাকাণ্ড দেখে স্থবির হয়ে গিয়েছিল কুয়াশা। যখন সংবিৎ ফিরল, তখন দাউ দাউ করে মাথায় জ্বলছে আগুন। চিবিয়ে চিবিয়ে ও বলল, ‘এ-রকম ঠাণ্ডা মাথার খুন আর কোনোদিন দেখিনি আমি।’
‘দ্য গ্রেট কুয়াশাকে মুগ্ধ করতে পেরে ভাল লাগছে; হেসে এক পা সামনে এগোল ব্রুনা। বিশ্বাস করতে পারছি না, ওই অথর্ব বুড়ো আর সাদাসিধে এক প্রিস্টকে আমাদের অংশ ভেবেছিলে তুমি
‘মানুষ চিনতে ভুল হয়েছে আমার, নাম চিনতে হয়নি। ভারাকিন আর ফেনিল একই সুতোয় গাঁধা।’
‘ভারাকিন নয়; ভরগেন,’ সংশোধন করে দিল ব্রুনা। নামে কিছু আসে যায় না। ফেনিসে জন্ম-পরিচয়ের স্থান নেই। আমাদেরকে বাছাই করা হয়েছে যোগ্যতার ভিত্তিতে।’ মৃত পিতার দিকে ইশারা করল। ‘দুর্বল ছিল ও… আদর্শবাদী। কোনোদিনই আমাদের পরিবারের অতীতকে মেনে নিতে পারেনি, বরং চেষ্টা করেছে তা থেকে সরে আসবার। তাই মারা যাবার আগে দাদু আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছেন ফেনিস কাউন্সিলের পদ।’ আবার ফিরল কুয়াশার দিকে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, লেনিনগ্রাদে ভালই খেল দেখিয়েছ তুমি। আমাদের তিন-তিনজন লোককে হারাতে হয়েছে তোমার কারণে।’
‘ওটুকুই একমাত্র সাফল্য নয়,’ বলল কুয়াশা। ‘গন্ধ শুঁকে তোমাদেরকেও খুঁজে বের করে ফেলেছি। ভরগেন-রাই যে ভারাকিন, সেটা জেনে নিয়েছি।’
‘স্রেফ একটা নাম ওটা, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। কী জেনেছ না জেনেছ, তাতে কিছু যায় আসে না। দুনিয়ার সামনে যতই গলা ফাটিয়ে চেঁচাও, সব অস্বীকার করব আমরা।’
‘আমার হাতে প্রমাণ নেই, এমনটা ভাবছ কেন?’
‘নিশ্চিত হয়েছি আমরুঝ,’ ব্রুনা নয়, কথা বলে উঠল অস্ত্রধারী খুনি। ‘লেনিনগ্রাদে আমাকে ফাঁকি দিয়েছ তুমি; কিন্তু ওই বুড়ো লাইব্রেরিয়ান আর সুন্দরী মেয়েটা ফাঁকি দিতে পারেনি। ঘুম পাড়াবার আগে ভালমত ইন্টারোগেট করেছি ওদেরকে। আমার ধারণা, অন্তত একটা ইন্টারোগেশনের পরিণতি দেখতে পেয়েছ তুমি।’ হাসল লোকটা। ‘কী যেন নাম মেয়েটার… নাতালিয়া, ভাই না? খুব এনজয় করেছি ওকে।
‘তুমি?’ চাপাস্বরে গর্জে উঠল কুয়াশা। অদম্য আক্রোশে সারা শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। শেভচেঙ্কো আর নাতালিয়ার হত্যাকারী দাঁড়িয়ে আছে কয়েক গজ দূরে… অথচ ও অসহায়! কিচ্ছু করবার নেই!
‘কুল ডাউন, কুয়াশা,’ হাসন ব্রুনা। ‘মাথা গরম করে কোনও উপকার হবে না তোমার। আমাদের ব্যাপারে আর কী জেনেছ, সেটা শুনি।’
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল কুয়াশা। ‘সব জেনে গেছি আমি!’
‘সব? কী রকম?’
দাঁতে দাঁত পিষল কুয়াশা। এক এক করে উচ্চারণ করল শব্দতিনটে, ‘পার… নস্ত্রো… সার্কোলো!’
হাসি মুছে গেল ব্রুনা ভরগেনের ঠোঁট থেকে। থমথমে গলায় বলল, ‘অতীতের মন্ত্র… সেইসব মানুষের জন্য, যারা নিতান্তই অন্ধ আর বোকা। আদর্শের সত্যিকার স্বরূপ ওদের জানা নেই।’
‘তা-ই? কিছু না জেনেই জীবন উৎসর্গ করছে ওরা তোমাদের জন্য?’
‘হ্যাঁ।’
হাতে সময় নেই, বুঝতে পারছে কুয়াশা। যা করবার এখুনি করতে হবে। নইলে মৃত্যু অনিবার্য। দু’পা এগিয়ে গেল ও ব্রুনার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে হ্যামার টানল খুনি, অস্ত্রটা বুক থেকে উঠে তাক হলো ওর মাথার দিকে।
‘হুম,’ বলল কুয়াশা। ধরে নিলাম ওরা নাদান… কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই নও? কাউন্ট বারেমির সত্যিকার অনুসারী, রাখাল বালকের সহচরী—এ-ই নিশ্চয়ই তোমার পরিচয়?’
থমকে গেল ব্রুনা। বুঝতে পারছে, ওর ধারণার চেয়ে অনেক বেশি জানে কুয়াশা। মহিলার এই হতভম্ব অবস্থার সুযোগ নিল ও। এগোল আরও দু’পা। দু’জনের মধ্যে এখন মাত্র পাঁচ ফুট দূরত্ব।
‘থামো!’ গর্জে উঠল খুনি।
কথা শুনল না কুয়াশা। স্প্রিঙের মত টান টান হয়ে ছিল ওর শরীর, আচমকা ঝাঁপ দিল ব্রুনা ভরগেনকে লক্ষ্য করে। প্রায় একই সঙ্গে ট্রিগার চাপল খুনি। বদ্ধ চ্যাপেলের অভ্যন্তর প্রকম্পিত হলো বজ্রপাতের মত কানফাটা আওয়াজে।