উনিশ
উত্তেজিত অবস্থায় হোটেলে ফিরে এল রানা। পেয়েছে… অকাট্য প্রমাণ পেয়ে গেছে ও-ডেভিড ম্যাহোনির পরিচয়ধারী সিনেটর আসলে রাখাল বালক জিয়োভান্নি গুইদেরোনির ছেলে! পরিচয় বদলের এই ঘটনা ঘটেছে বিশ বছর আগে, আসল ম্যাহোনির অ্যাকসিডেন্টের পর। ডা. হ্যামার ভুল করেননি, আসলেই বাঁচানো যায়নি তাঁকে। তার বদলে নিজস্ব প্লাস্টিক সার্জনের মাধ্যমে বদলানো হয়েছে মাসিমোর চেহারা, রাতের অন্ধকারে তাকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে ম্যাহোনির বিছানায়। আর ম্যাহেনি চলে গেছেন কবরে… মাসিমোর কবরে! স্কিয়িং অ্যাকসিডেন্টের পুরো ঘটনাই মিথ্যে, ওটা শুধুই একটা কবর রচনার বাহানামাত্র। পুরো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে–তরুণ সেই প্লাস্টিক সার্জন, আর তিন নার্স
ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ফেনিস তথা জিয়োভান্নি গুইদেরোনির প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছে রানা। এত জটিল একটা পরিকল্পনা তৈরি, তারপর আবার সেটাকে বাস্তবে রূপ দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। মাই গড… মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদে নিজের ছেলেকে বসাতে চাইছে সে। পৃথিবীতে এরচেয়ে ক্ষমতাবান পদ আর একটিও নেই। এক অর্থে ধরণীর ঈশ্বরে পরিণত হবে লোকটা। তাকে ঠেকাবার মত মানুষ এখন কেবল একজন—ও নিজে! ভাবতেই বুকটা হিম হয়ে এল। গুইদেরোনিকে শুধু ঠেকালেই চলবে না, কুয়াশা আর সোনিয়াকেও উদ্ধার করতে হবে তার মুঠোর মধ্য থেকে। বড়ই কঠিন দায়িত্ব।
হোটেলে ফিরে দ্রুত ঢাকায় ফোন করল রানা। কথা বলল বিসিআই চিফের সঙ্গে। জানাল সবকিছু শোনার পর গম্ভীর হয়ে গেলেন মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খান। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কতখানি নিশ্চিত তুমি, এম.আর, নাইন?
‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট, স্যর,’ রানা বলল আমার হাতে প্রমাণ আছে। ডেভিড ম্যাহোনি আর মাসিমো গুইদেরোনির ডেন্টাল রেকর্ড!’
‘কিন্তু ওই রেকর্ডকে ভুয়া বলে দাবি করতে পারে লোকটা,’ চিন্তিত গলায় বললেন রাহাত খান। ‘যে-কোনও অভিযোগ অস্বীকার করা রাজনীতিবিদদের জন্মগত স্বভাব। বলবে তার প্রতিপক্ষ এসব ভুয়া অভিযোগ ছড়াচ্ছে।’
‘অভিযোগটা যদি ঠিকমত দাঁড় করানো যায়, তা হলে বাড়তি প্রমাণ জোগাড় করতে কষ্ট হবে না। ডিএনএ টেস্টের জন্য বাধ্য করা যাবে সিনেটরকে। ডেভিড ম্যাহোনির মা বেঁচে আছেন, তার সঙ্গে ডিএনএ ম্যাচিং করলেই ধরা পড়ে যাবে লোকটা।’
‘এ-ধরনের পদক্ষেপ নিতে চাইলে বড় ধরনের ব্যাকিং প্রয়োজন হবে তোমার সমস্যা হলো, মার্কিন প্রশাসনের বড় বড় বিভিন্ন পদে ফেনিসের লোক বসে আছে। তাদের পরিচয় জানা নেই কারও। পদে পদে বাধা পাবে তুমি।’
‘আমি যদি বর্তমান প্রেসিডেন্টের কাছে যাই, সার?’
‘প্রেসিডেন্ট? উনি ক্লিন?’
‘আমার তা-ই ধারণা। ওঁকে যদি হাত করতে পারত গুইদেরোনি, তা হলে এ-মুহূর্তে নিজের ছেলেকে হোয়াইট হাউসে বসানোর জন্য মাঠে নামত না। আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করত। এর মানে একটাই—বর্তমান প্রেসিডেন্ট, সেইসঙ্গে আগামী নির্বাচনের অন্য কোনও সম্ভাব্য প্রার্থীকে হাত করতে পারেনি সে।’
‘হুমম। সেক্ষেত্রে সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌছুনোর একটাই চ্যানেল আছে তোমার হাতে—জর্জ হ্যামিলটন।’
‘অ্যাডমিরল তো অসুস্থ, স্যর,’ মনে করিয়ে দিল রানা।
‘না,’ নেতিবাচক জবাব দিলেন রাহাত খান। ‘লেটেস্ট খবর জানা নেই তোমার—জর্জ এখন অনেকটাই সুস্থ। বাড়িতে ফিরে এসেছে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রমাণগুলো হোয়াইট হাউসে পাঠাবার ব্যবস্থা করো।
‘ইয়েস, স্যর। ইয়ে…’ ইতস্তত করল রানা, ‘মি. লংফেলোর কোনও খবর কি জানা আছে আপনার?’
মারভিন এখনও হাসপাতালে, পুরোপুরি আশঙ্কামুক্ত হয়নি। বিএসএস এজেন্টরা পাহারা দিচ্ছে ওকে। আমাদের কিছু লোকও রেখেছি হাসপাতালের আশপাশে। ওকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। চিন্তা করতে হলে কুয়াশা আর ওই মেয়েটার ব্যাপারে করো। কীভাবে ওদেরকে উদ্ধার করবে, ভেবেছ কিছু?
‘একটা প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি। এখনও ফাইনাল হয়নি।’
‘তোমার উপর আস্থা আছে আমার। আশা করি সফল হবে। তারপরেও সাবধানে থেকো। ফেনিসের বিশাল একটা লক্ষ্য ভেস্তে দিতে চাইছ। এত সহজে হার মানতে চাইবে না ওরা। ভেবেচিন্তে পা ফেলো। ঠিক আছে?’
‘জী, স্যর।’
‘বেস্ট অভ লাক, রানা।’
চিফের সঙ্গে কথা শেষ হলে তাড়াতাড়ি ওয়াশিংটনে ফোন করল রানা। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের বাড়িতে। ফোন ধরল চার্লি–অ্যাডমিরালের শোফার।
‘মি. রানা!’ রানার গলা চিনতে পেরে বলে উঠল সে। ‘নাইস টু হিয়ার ফ্রম ইউ। আজ সকালেই অ্যাডমিরাল আপনার কথা বলছিলেন।’
‘হ্যালো, চার্লি’ বলল রানা। তুমি ওখানে কী করছ? গাড়ি ছেড়ে একেবারে বাড়ির ভিতরে…..
‘অ্যাডমিরালের নিরাপত্তার জন্য থাকছি এখানে,’ জানাল শোফার। ‘বিশ্বস্ত লোক ছাড়া আর কাউকে কাছে থাকতে দিচ্ছেন না তিনি।’
‘তা-ই? একটু কথা বলা যাবে ওঁর সঙ্গে?’
‘অবশ্যই ধরুন।
কয়েক সেকেণ্ড পরেই কানে ভেসে এল হ্যামিলটনের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ।
‘রানা! মাই বয়! কোথায় তুমি?’
‘পরে জানাচ্ছি, স্যর,’ রানা বলল। ‘এই লাইনটা কি ক্লিন?’
‘হ্যাঁ। সকালেই চেক করা হয়েছে।
‘এ-কথা গত মিটিঙের আগেও বলেছিলেন।
‘ভুল বলিনি। তখনও আমার টেলিফোন ক্লিন-ই ছিল। রক ক্রিক পার্কের খবরটা কীভাবে ফাঁস হলো, তা বিরাট এক রহস্য। এনিওয়ে, খবর বলো।’
‘আগে আপনার শরীরের অবস্থা জানতে চাই।‘
‘দুর্বল… হুইলচেয়ারে চলাফেরা করছি। নইলে আর কোনও অসুবিধে নেই।‘
‘এ-কণ্ডিশনে চাপের মধ্যে ফেলতে ইচ্ছে করছে না আপনাকে, কিন্তু আর কোনও উপায়ও নেই। চিফের সঙ্গে কথা বলেছি, উনি প্রমাণগুলো আপনার হাতে তুলে দিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
‘কীসের প্রমাণ?’
ধীরে ধীরে সব খুলে বলল রানা।
‘হা যিশু!’ আঁতকে উঠলেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। ‘এ কী শোনাচ্ছ তুমি? আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট একজন ছদ্মবেশী? ফেনিসের নেতার ছেলে?’
‘অবিশ্বাস… কিন্তু সত্যি।’ শান্তগলায় বলল রানা।
‘আর তুমি প্রমাণ করতে পারবে সেটা?’
‘হ্যাঁ। ওগুলো আপনার হাতে পৌঁছে দিতে চাই, যাতে প্রেসিডেন্টকে দেখিয়ে সিন্টের ম্যাহোনি আর জিয়োভান্নি গুইদেরোনির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন। ওদেরকে আটকানো গেলে পুরো সংগঠনের কোমর ভেঙে যাবে।
‘আমি একমত। ডেন্টাল রেকর্ডগুলো কীভাবে পাঠাচ্ছ?’
‘আমার এজেন্সির স্পেশাল মেসেঞ্জার দিয়ে। গেটে বলে দিন, রানা এজেন্সির লোক এলেই যেন সরাসরি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাই দ্য ওয়ে, অ্যাডমিরাল, আশা করি বলে দিতে হবে না, প্রেসিডেন্টের কাছে যাবার আগে সবকিছু গোপন রাখতে হবে আপনাকে? দয়া করে কাউকে কিছু বলবেন না, যত ঘনিষ্ঠ… যত আপন-ই হোক না কেন।’
‘জানি। কখন পাঠাচ্ছ জিনিসগুলো?’
‘যত দ্রুত সম্ভব। রাতের মধ্যে, বা কাল সকালে পেয়ে যাবেন হাতে। এখন তা হলে রাখি, স্যর।’
‘ওকে, রানা। আমি অপেক্ষায় রইলাম।’
কথা শেষ করে হোটেলের লবি থেকে একটা ম্যানিলা এনভেলাপ আনাল রানা। ওটায় তরল সমস্ত এক্স-রে এবং কাগজপত্র। মুখ বন্ধ করে উপরে ঠিকানা লিখল অ্যাডমিরালের। এক্স-রে-গুলো কপি করে রাখবে কি না, ভাবল একবার; পরে আবার চিন্তাটা বাতিল করে দিল। এ-ধরনের কেসে কপি-র কোনও মূল্য নেই। আসল এক্স-রে ছাড়া আর কিছু গ্রহণযোগ্য হবে না আদালতে। তা ছাড়া কপি দেখিয়ে বোকাও বানানো যাবে না জিয়োভান্নি গুইদেরোনিকে। পরীক্ষা করলেই আসল-নকল ধরে ফেলতে পারবে সে।
হাতের কাজ শেষ করে কুয়াশা আর সোনিয়ার কথা ভাবতে বসল রানা। এবার ওদেরকে উদ্ধার করা দরকার। আর সেজন্যে ছোট্ট একটা চাল দিতে হবে ওকে। বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিল ও, তারপর তুলে নিল রিসিভার। দ্বিতীয়বারের মত ফোন করল ওয়াশিংটনে। তবে এবার অন্য নাম্বারে।
‘সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি’স অফিস।’ শোনা গেল সুরেলা কণ্ঠ।
‘সিনেটর কি আছেন?’ জিজ্ঞেস করল রানা। তাঁর সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমার নাম মাসুদ রানা।’
‘এক্সকিউজ মি, কী ব্যাপারে কথা বলবেন, জানতে পারি? সবার কল সিনেটরের কাছে ফরওয়ার্ড করি না আমরা।’
‘ওঁকে শুধু আমার নাম বলুন। তা হলে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারবেন।’
‘হোল্ড অন, প্লিজ।’
দু’মিনিটের মত নীরব রইল লাইন। তারপরেই ওপাশ থেকে ভেসে এল সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনির বিখ্যাত কণ্ঠ।
‘হ্যালো? কে বলছেন?’
হালকা হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ওর নাম শুনে ফোন ধরেছে লোকটা—এ থেকে প্রমাণ হয় অনেককিছু।
শীতল গলায় বলল, ‘সুইটজারল্যাণ্ডের কল দ্যু পিলঁ গ্রামে একটা কবর আছে। কিন্তু ওটার ফলকে যার নাম, কফিনে সে-লোক নেই।’
আঁতকে ওঠার মত একটা শব্দ শোনা গেল। তারপর ক্ষণিকের নীরবতা। শেষ পর্যন্ত আবার যখন কথা বলল সিনেটর, কণ্ঠস্বর ফ্যাসফেঁসে হয়ে গেছে। ‘ক…কে বলছেন? কে আপনি?’
‘আমাকে আপনি চেনেন, মাসিমো।’
‘স্টপ ইট!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সিনেটর।
‘বেশ, নাম উচ্চারণ করব না। কিন্তু আমাকে না-চেনার কোনও কারণ দেখছি না। আমার মনে হয় না রাখাল বালক তার ছেলের কাছে কোনও কিছু গোপন করে।’
‘না-আ! এসব শুনতে চাই না আমি…’
‘শুনতে আপনাকে হবে, সিনেটর!’ কড়া গলায় বলল রানা। ‘খবরদার, লাইন কাটবার চেষ্টা করবেন না। তাতে আপনারই ক্ষতি হবে। চুপ করে শুনুন আমার কথা। ছোটবেলায় অ্যাণ্ডোভারের এক ডেন্টিস্টের কাছে যেতেন আপনি আর আপনার বন্ধু। ওখানে আপনাদের দাঁতের এক্স-রে করা হয়েছিল। সেই ফিল্ম এখন আমার হাতে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, গতকাল আপনার বর্তমান ডেন্টিস্টের কাছ থেকেও ফাইল নিয়ে এসেছে একদল লোক। ম্যাসাচুসেটস্ জেনারেল হসপিটালে গেলে দেখবেন, ওদের আর্কাইভ থেকে গায়েব হয়ে গেছে ডেভিড ম্যাহোনির অ্যাকসিডেন্ট-পরবর্তী ডেন্টাল এক্স-রের ফিল্ম। সব এখন আমার কবজায়।’
গোঙানি ভেসে এল ইয়ারপিসে।
‘শুনতে থাকুন, সিনেটর,’ নির্বিকার কণ্ঠে বলে চলল রানা। ‘কুয়াশা আর সোনিয়া যদি বেঁচে থাকে, আপনার কিছুটা আশা আছে! মরে গেলে আপনিও শেষ। মাটির সঙ্গে আপনাকে মিশিয়ে দেব আমি। বুঝতে পেরেছেন?’
ভাষা খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লাগল মাসিমো গুইদেরোনির। শেষে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘প্লিজ…. বোকামি কোরো না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই আমরা…’
শুনতে রাজি আছি আমি। কিন্তু তার আগে আগে মুক্তি দিতে হবে আমার বন্ধুদেরকে।
‘এক্স-রে-গুলো?’
‘ওদের বিনিময়ে সেগুলো আপনাদের হাতে তুলে দেব আমি।’
‘কীভাবে? কখন?’
‘সেটা আমরা আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করে নেব। তার আগে আমাকে প্রমাণ দেখাতে হবে- আমার বন্ধুরা বেঁচে আছে… হাঁটাচলা করছে ওরা।’
‘প্রমাণ?’
‘হ্যাঁ। একটা ফোন নাম্বার চাই আমি, সেইসঙ্গে ওদেরকে দেখার সুযোগ। বিনকিউলার আছে আমার কাছে, দূর থেকেই দেখে নিতে পারব। বলা বাহুল্য, বস্টনে আছি আমি; সম্ভবত এ খবর ইতিমধ্যে পেয়েছেন আপনারা। আজকের দিনটা সময় দিচ্ছি আমার প্রস্তাব ভেবে দেখবার জন্য। কাল সকালে এই নাম্বারে আবার ফোন করব আমি – আপনার জবাব জানব তখন।
‘কিন্তু আগামীকাল সকালে সিনেট অধিবেশন আছে…’ প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল মাসিমো।
‘ওটা মিস করবেন আপনি,’ শীতল কণ্ঠে কথাটা বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা।
পোশাক বদলে নিল ও। বাইরে যাবে। তুহিনের মাধ্যমে ওয়াশিংটনে পাঠাবে ডেন্টাল রেকর্ডগুলো। তা ছাড়া বল মাঠে গড়িয়ে গেছে, খেলার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার জন্যও বেশ কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে ওকে।
.
পরদিনের সকাল হলো মেঘলা, গুমোট পরিবেশে! আটটা বাজতে না বাজতে ঝমঝম করে নামল বৃষ্টি। ঘুম থেকে উঠে ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেল রানা। কঠিন একটা দিন অপেক্ষা করছে সামনে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, কিছুই বলা যায় না। হয়তো বিজয়ীর বেশে কুয়াশা আর সোনিয়াকে নিয়ে ফিরবে ও, কিংবা হারিয়ে যাবে নাম-পরিচয়হীন কোনও কবরের ভিতরে। এমন পরিস্থিতি একেবারে নতুন নয় ওর জন্য, তবু প্রতিবারই বুক ঢিব ঢিব করে; অভিজ্ঞতা আর ট্রেইনিং ছাপিয়ে অস্তিত্বজুড়ে বসতে চায় ভয়াল আতঙ্ক। ওকে মনে করিয়ে দেয়—সবকিছুর পরেও আর দশজনের মত সাধারণ একজন মানুষই ও।
ব্রেকফাস্টের পর জানালায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বৃষ্টি দেখল রানা, তারপর ফিরে এল টেবিলের কাছে। রাতের কাজের ফসল শোভা পাচ্ছে ওতে। বেশ কিছু ঘড়ি কিনে এনেছিল, ওগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলেছে। স্পিণ্ডলের কাছে সবকটার মেইন-হুইলে ড্রিল করেছে, বসিয়েছে নতুন পিনিয়ন স্ক্রু। ব্যালান্স করেছে মিনিয়েচার বোল্ট। ঘড়িগুলো এখন টাইমারে পরিণত হয়েছে—ব্যাটারি টার্মিনালের সঙ্গে বেল-ওয়ায়্যারের সংযোগের জন্য তৈরি। অ্যালার্মের কাঁটার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যাবে ত্রিশ সেকেণ্ড থেকে বারো ঘণ্টার সময়সীমা, তারপর ওগুলো স্পার্কের সাহায্যে বিস্ফোরকে আগুন ধরিয়ে দেবে। কাল বিকেলে তুহিনের কাছ থেকে এক্সপ্লোসিভও সংগ্রহ করেছে।
সাবধানে সবকিছু একটা কাগজের কার্টনে ভরল ও। তারপর ওটা নিয়ে নেমে এল হোটেলের লবিতে। রিসেপশনিস্টকে জানাল, চেক-আউট করতে চায়। বিল রেডি করে যেন ওর কামরায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। কার্টুনটা ভাড়া করা গাড়ির ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রেখে রুমে ফিরে এল।
ঘড়ি দেখল রানা। আটটা পঁয়ত্রিশ। তারমানে এখনও অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছে পৌঁছেনি ওর প্যাকেট। রাতের ফ্লাইটে কোনও টিকেট ম্যানেজ করতে পারেনি তুহিন, তাই আজ ভোরে এজেন্সির অপারেটর শাহেদের মাধ্যমে পাঠাতে হয়েছে জিনিসটা। দশটায় ওয়াশিংটনে ল্যাণ্ড করবে ওর বিমান।
এয়ারপোর্টে ফোন করে ফ্লাইটের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিল ও। বারো মিনিট দেরি করে টেকঅফ করেছে ওয়াশিংটন-গামী ফ্লাইট সিক্স-ও-টু; তবে ই.টি.এ.. পরিবর্তন হয়নি। সন্তুষ্ট হলো রানা; খুব শীঘ্রি অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের হাতে পৌঁছে যাবে সব প্রমাণ। রাতে আরেক দফা কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, ডেন্টাল রেকর্ড হাতে পাবার পর কী ধরনের অ্যাকশন নেয়া হবে, সে-সব নিয়ে রিস্তারিত আলোচনা করেছে ওরা। আজই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি… যদি সব ঠিকমত এগোয়, তা হলে আগামীকাল সকালে অ্যারেস্ট করা হবে সিনেটর ম্যাহোনিকে; ওয়াল্টার রিভ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চালানো হবে নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। সমস্ত জারিজুরি তখন ফাঁস হয়ে যাবে জিয়োভান্নি গুইদেরোনির। ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠবে তার বিরুদ্ধে—ফেনিসকে লড়তে হবে দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে। দেখার মত একটা মজা হবে তখন।
তবে এসব ঘটার আগে… আজই উদ্ধার করতে হবে কুয়াশা আর সোনিয়াকে। কাল সকালে ওদের কোনও মূল্য থাকবে না। প্রতিশোধের নেশায় ওদের প্রাণ নিতে পারে রাখাল বালক। তাই যা করবার, করতে হবে আজই। একটা প্ল্যান এঁটেছে রানা, দেখা যাক সেটা সফল হয় কি না!
আবার ঘড়ি দেখল রানা। পৌনে ন’টা। মাসিমো গুইদেরোনিকে ফোন করা যেতে পারে এখন।
আজ আর সেক্রেটারি না, লোকটা নিজেই ফোন রিসিভ করল। রানার কণ্ঠ শুনে বলল, ‘জিয়োভান্নি গুইদেরোনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
‘রাখাল বালক স্বয়ং?’ কৌতুক ফুটল রানার গলায়। ‘আমার শর্ত তো বলেছি গতকাল। উনি রাজি আছেন?’
‘হ্যাঁ,’ বলল মাসিমো। ‘টেলিফোন নাম্বার দেয়া হবে তোমাকে। তবে দেখাদেখির ব্যাপারটা….
তা হলে আপনার সঙ্গে আর কোনও কথা নেই আমার, সিনেটর,’ কড়া গলায় বলল রানা। ‘বিদায়।’
‘দাঁড়াও! ফোন রেখো না!’
‘কেন? যা বলার, তা তো বলেই দিয়েছি। দূর থেকে আমার বন্ধুদেরকে দেখতে চেয়েছি বিনকিউলার দিয়ে। তাতে যদি আপনারা রাজি না থাকেন, তা হলে এখানেই আমাদের সংলাপ শেষ। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাপই যদি চিন্তা না করে, তা হলে আমার কী করার আছে!’
‘না!’ তড়িঘড়ি করে বলল মাসিমো। ‘ঠিক আছে… ঠিক আছে। তোমার কথাই সই। দেখানো হবে তোমার বন্ধুদেরকে। ফোন নাম্বারটা লিখে নাও। যখন যোগাযোগ করবে, তখন বলে দেয়া হবে—কোথায় কখন দেখতে পাবে ওদেরকে।
‘দুঃখিত। আপনাদের ফাঁদে পা দেবার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। সময় আর জায়গা আমি ঠিক করব।’
‘তুমি?’
‘হ্যাঁ। আজ বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে… ম্যাহোনি হলে ওদেরকে দেখতে চাই আমি। উত্তরদিকে, জ্যামাইকা পণ্ডের দিকটার জানালায়।’
‘ম্যাহোনি হলের নাম্বারই আমি দিতে যাচ্ছিলাম তোমাকে।’
না শোনার ভান করে বলে চলল রানা, ‘দু’জনকে দুটো কামরায় রাখবেন। ভিতরে আলো জ্বলা চাই। হাঁটাহাঁটি করবে ওরা, কথা বলবে… সোজা কথায় ওরা যে জ্যান্ত আর সুস্থ আছে, সেটা প্রমাণ করতে হবে আপনাদেরকে।’
‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো মাসিমো। ‘তোমার কথামত সব অ্যারেঞ্জ করা হবে।’
‘বাই দ্য ওয়ে, সিনেটর, আপনার লোকজনকে বলে দেবেন—আমাকে যেন খোঁজার চেষ্টা না করে। ধরতে পারলেও লাভ হবে না। এক্স-রে-গুলো থাকবে না আমার সঙ্গে। বরং এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি, যাতে আমি গায়েব হলে ওগুলো পৌঁছে যায় ওয়াশিংটনে।
‘কথা দিলাম, তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করবে না কেউ।’
‘ভেরি গুড।’
‘এক মিনিট, রানা! তুমি জিয়োভান্নি গুইদেরোনির সঙ্গে কথা বলবে না?’
‘বিকেলে… যদি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেন আর কী। সাড়ে পাঁচটায় ফোন করব আমি ম্যাহোনি হলে। নাম্বার দেয়ার প্রয়োজন নেই, ওটা টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে খুঁজে নিতে পারব।’
‘কিন্তু উনি এখুনি কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে।’ হাসল রানা। চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?’
‘বি সিরিয়াস, রানা। শুইদেরোনি নিশ্চিত হতে চান, তুমি এক্স-রে-গুলোর ডুপ্লিকেট তৈরি করবে না।
‘বিশ থেকে ত্রিশ বছরের পুরনো ফিল্ম ওগুলো, ডুপ্লিকেশনের জন্য হার্ড লাইটের তলায় যদি রাখি, স্পেক্টোগ্রাফে তার চিহ্ন দেখা যাবে। হাতে পাবার পর চেক করে নিতে পারবেন। ডোন্ট ওয়ারি, খামোকা নিজের বিপদ বাড়াবার কোনও ইচ্ছে নেই আমার।’
‘প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো। এখুনি কথা বলা উচিত তোমার। উনি বলেছেন, ব্যাপারটা খুবই জরুরি।’
‘সবকিছুই জরুরি।’
‘ভুল করছ তুমি, মাসুদ রানা। মস্ত ভুল।’
‘আমাকে যদি আজ বিকেলে সন্তুষ্ট করতে পারেন, তা হলে ভুলটা ধরিয়ে দেবার যথেষ্ট সুযোগ পাবেন গুইদেরোনি। আপনার পথও পরিষ্কার হয়ে যাবে। গুড বাই।’
কথা না বাড়িয়ে লাইন কেটে দিল রানা।
ওর ধারণাই ঠিক-ম্যাহোনি হলে বন্দি করে রাখা হয়েছে কুয়াশা আর সোনিয়াকে। সে-কারণেই ওর শর্ত দ্রুত মেনে নিয়েছে মাসিমো। জায়গাটা দুর্ভেদ্য, কাউকে লুকিয়ে রাখার জন্য আদর্শ। উদ্ধার করাও এককথায় অসম্ভব। কিন্তু রানার কাজ হিসেবি চাল দিয়ে ওদেরকে বের করে আনা।
ডায়াল ঘুরিয়ে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে এবার রিং করল ও। ‘রানা? সারারাত আমার ঘুম হয়নি।
‘অনেকেই কাল রাতে ঘুমাতে পারেনি, স্যর।’
‘প্যাকেজের খবর কী?’
‘রওনা হয়ে গেছে। ইস্টার্নের ফ্লাইট সিক্স-ও-টু। দশটায় ল্যাণ্ড করবে ওয়াশিংটনে।‘
‘হাতে বেশি সময় নেই। চার্লিকে এয়ারপোর্টে পাঠালে অসুবিধে আছে? প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটু আগে কথা হয়েছে আমার, দুপুর দু’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন। তার আগে এভিডেন্সগুলো স্টাডি করে নিতে চাই। চার্লি গেলে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে পারবে।’
‘ঠিক আছে, পাঠান ওকে। কিন্তু কী আনছে, সেটা বলবেন না। শুধু মেসেঞ্জারের নাম জানাবেন-শাহেদ আহমেদ।
‘ওকে। আর কিছু?’
‘কুয়াশা আর সোনিয়া কোথায় আছে, তার আভাস পেয়েছি। আপনার কাছে কাগজ-কলম আছে?’
‘হ্যাঁ। বলো।
‘ম্যাহোনি হলে রাখা হয়েছে ওদেরকে। ওটা বস্টনের উত্তরে, একটা পাহাড়ের চূড়ায়, জ্যামাইকা পণ্ডের উপরে। জিয়োভান্নি গুইদেরোনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছে, রাত সাড়ে এগারোটায় সময় দেব আমি। তখনই উদ্ধার করে আনব ওদের। আপনার সাহায্য দরকার।’
‘লোকাল ল-এনফোর্সমেন্ট হলে চলবে?
‘স্পেশাল ফোর্স হলে বেশি ভাল হয়। রীতিমত একটা অভিযান চালানোর কথা ভাবছি আমি।’
‘হুম। দেখি কী করা যায়। প্ল্যান অভ অ্যাকশন কী হবে?
সাড়ে এগারোটায় ওখানে ঢুকব আমি। তার পনেরো মিনিট পর পুরো এলাকা ঘিরে ফেলবে ওরা। চারদিকে যত রাস্তা আছে, সব আটকে দিতে হবে। সাবধানে কাজ করতে বলবেন ওদেরকে, ম্যাহোনি হলের সীমানায় প্রচুর গার্ড আছে। মেইন গেটে পৌঁছুনোর আগে, অ্যাপ্রোচ রোডের মাথায় একটা গার্ড পোস্ট আছে ওটা দখল করে কমাণ্ড সেন্টার বানাতে পারবে ওরা। আর হ্যাঁ, অপারেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত টেলিফোন লাইন কেটে দিতে হবে। জ্যাম করে দিতে হবে সেলফোনেরও সিগনাল।’
‘বলে যাও।’
ঠিক সোয়া বারোটায় ম্যাহোনি হল থেকে বেরিয়ে আসব আমি… আশা করছি কুয়াশা আর সোনিয়াকে সহ। মেইন গেটে পৌঁছুনোর পর দাঁড় করাব গাড়ি। ওখানে দু’বার ম্যাচ জ্বাল আমি—ওটাই সঙ্কেত। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে হামলা করবে স্পেশাল ফোর্সের কমাণ্ডোরা।’
টাইম এদিক-সেদিক হবার সম্ভাবনা কতটুকু?’
‘খুব বেশি না। গুইদেরোনিকে জানাব, ঠিক সোয়া বারোটায় আমি যদি গেটে না পৌঁছি, আমার লোক এক্স-রে নিয়ে ফিরে যাবে – ওখান থেকে।
‘কিন্তু ওগুলো তো এমনিতেও থাকছে না তোমার কাছে। ধাপ্পা দিতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে যাও?’
‘আমার অভিনয় অত কাঁচা হবে না, স্যর। তারপরেও যদি গোলমাল দেখা দেয়, ডাইভারশনের ব্যবস্থা থাকবে। ওদেরকে বলবেন রেডি থাকতে।’
‘মস্ত ঝুঁকি নিচ্ছ কিন্তু তুমি, রানা।
‘না নিয়ে উপায় নেই আমার, স্যর।’
‘তা আমি জানি।’
.
আধঘণ্টা পর বিল মিটিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল রানা। কয়েকটা হার্ডওয়্যার স্টোর ঘুরে কিনে নিল ড্রাইসেল ব্যাটারি, প্লাস্টিক কন্টেইনার, অ্যাডহেসিভ টেপ, বেল-ওয়ায়্যারের রোল আর কালো স্প্রে-পেইণ্ট। গাড়িতে বসে টাইমার, এক্সপ্লোসিভ আর সদ্য-কেনা জিনিসগুলোর সাহায্যে তৈরি করল দশটা বোমা। ঘড়ি দেখল—বারোটা চল্লিশ। টাইমারে এগারো ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের কাউন্টডাউন সেট করল—প্রতিটা দশ সেকেণ্ড পর পর বিস্ফোরিত হবে। কাজ শেষে টেপ দিয়ে মুড়ে ফেলল সবকটা বোমা, স্প্রে-পেইণ্ট দিয়ে রঙ করে নিল। কার্টনে ভরে ওগুলো রেখে দিল পিছনের সিটে।
গাড়ি চালিয়ে এরপর ওয়েস্ট রক্সবিউরিতে গেল রানা। একটা পে-ফোন খুঁজে নিয়ে ডিপার্টমেন্ট অভ স্যানিটেশনে রিং করল। ‘কমপ্লেইন সেকশন। রিসিভারে শোনা গেল কর্কশ গলা। ‘এক্সকিউজ মি, আমি ম্যাহোনি ড্রাইভ থেকে বলছি। একটা কমপ্লেইন, লেখাতে চাই।’
‘বলুন কী সমস্যা।
‘এখানকার সিউয়ারেজ লাইন বন্ধ হয়ে গেছে, ম্যান! বিষ্ঠা-আর্বজনা উপচে আমার লন ভরে যাচ্ছে।
‘কোথায় বললেন?’ ত্রস্ত হয়ে উঠল ওপাশের লোকটা
‘ম্যাহোনি ড্রাইভ। বিচনাট টেরাসের কাছে। ভয়াবহ অবস্থা এখানে! তাড়াতাড়ি একটা কিছু করুন!’
‘আমরা এখুনি একটা ট্রাক পাঠাচ্ছি, স্যর।’
‘প্লিজ, যত দ্রুত সম্ভব পাঠান।’
.
স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের সার্ভিস ট্রাক ম্যাহোনি ড্রাইভের একশো গজ দূরে পৌঁছুতেই রেইনকোট পরা একজন মানুষ বৃষ্টি ভেদ করে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। দু’হাত নাড়ছে পাগলের মত। ব্রেক কষে থামল ড্রাইভার। জানালা দিয়ে মাথা বের করে বিরক্ত গলায় জানতে চাইল, ‘অ্যাই, কী হয়েছে তোমার? গাড়ি থামালে কেন?’
জবাব না দিয়ে হাতছানি দিল মানুষটা। ডাকল তাকে। বোধহয় সাহায্য চাইছে। আশপাশে তাকাল ড্রাইভার! বৃষ্টি-বাদলের কারণে রাস্তা শূন্য। কী সমস্যা হয়েছে কে জানে, বোধহয় আর কাউকে না পেরে থামিয়েছে তাকে লোকটা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজা খুলল সে, নেমে এল ট্রাক থেকে।
ড্রাইভার নাগালের মধ্যে পৌঁছতেই বিদ্যুৎ খেলে ‘গেল রেইনকোট-ধারীর শরীরে। প্রচণ্ড এক ঘুসি হাঁকল সে অপ্রস্তুত ড্রাইভারের চোয়ালে। মাপা আঘাত, এক ঘুসিতেই কাত হয়ে রাস্তায় পড়ে গেল লোকটা। আগামী কয়েক ঘণ্টা জ্ঞান ফিরবে না।
এর পনেরো মিনিট পরে ম্যাহোনি এস্টেটের প্রহরীরা লক্ষ করল, স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের একটা ট্রাক উদয় হয়েছে তাদের সামনের রাস্তায়। পঞ্চাশ গজ পর পর থামছে ওটা, ভিতর থেকে নেমে একজন লোক কী যেন করছে প্রতিটা ম্যানহোলে। সন্দেহজনক গতিবিধি, তাই স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসে ফোন করে জানতে চাইল তারা ঘটনা।
‘বিচনাট আর ম্যাহোনি ড্রাইভ এলাকায় ব্লকেজের রিপোর্ট পেয়েছি আমরা, স্যর,’ জানানো হলো ওখান থেকে। ‘আমাদের লোক পাঠানো হয়েছে ওখানে—পুরো লাইন চেক করে দেখবার জন্য।
এরপর ট্রাকটাকে আর সন্দেহ করল না কেউ।
.
রেইনকোট পরে স্যানিটেশন কর্মীর ছদ্মবেশে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে রানা। তিনটে বেজে গেছে ইতিমধ্যে, শুরু হয়েছে সোনিয়া আর কুয়াশাকে দেখানোর সময়। উত্তরদিকে নজর থাকবে প্রহরীদের, বিনকিউলার হাতে কেউ আছে কি না, তা স্পট করায় ব্যস্ত থাকবে ওরা। এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে ও।
ম্যাহোনি ড্রাইভ প্রায় তিনশো গজ দীর্ঘ। সবমিলিয়ে গোটাবিশেক ম্যানহোল আছে ওতে। প্রতিটার সামনে ট্রাক থামাচ্ছে রানা, টুলকিট আর হোসপাইপ নিয়ে নামছে সুয়ারেজ লাইনের ভিতরে; বাছাই করা দশটার ভিতরে গুঁজে দিচ্ছে হাতে তৈরি বোমাগুলো।
কাজ যখন শেষ হলো, তখন চারটে বাইশ বাজে ঘড়িতে। ট্রাক নিয়ে বিচনাৰ্ট টেরাসে ফিরে এল ও। গালে চাপড় দিয়ে জ্ঞান ফেরাল ড্রাইভারের। তাকে ড্রাইভিং ক্যাবের ভিতরেই ফেলে রেখেছিল ও।
‘ক… কী হয়েছে?’ চোখ মেলেই রানাকে দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল লোকটা।
‘কিচ্ছু না,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ‘কিছুটা সময়ের জন্য তোমার ট্রাকটা ধার নিয়েছিলাম, এখন ফেরত দিচ্ছি। কিছু খোয়া যায়নি তোমার, কোনও ক্ষতিও হয়নি। আর হ্যাঁ, সুয়ারেজ লাইনে কোনও সমস্যা নেই। আমি চেক করে দেখেছি।’
‘তুমি পাগল!’ রাগী গলায় বলল ড্রাইভার।
পকেট থেকে একশো ডলারের পাঁচটা নোট বের করল রানা। বলল, ‘আপাতদৃষ্টিতে তা-ই মনে হতে পারে, তবে তোমার অসুবিধার জন্য কিছু টাকা দিতে চাই আমি। পাঁচশো ডলার। একটাই শর্ত, কাউকে এ-ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে না। যদি বলো, তোমাকে খুঁজে বের করব আমি।’
থতমত খেয়ে গেল ড্রাইভার। ‘পাঁচশো?’
মাথা ঝাঁকাল রানা। ভাল করে ভেবে দেখো, চোয়ালে একটু ব্যথা ছাড়া আর কোনও ক্ষতি হয়নি তোমার। মাঝখান থেকে পাঁচশো ডলার আয় করছ মুখ বন্ধ রাখার বিনিময়ে।’
‘তোমার মাথা-টাথা ঠিক আছে তো; মিস্টার?’
‘দেখো, তোমাকে বোঝানোর সময় নেই আমার হাতে,’ বিরক্ত গলায় বলল রানা। টাকাটা নেবে কি নেবে না?’
লোভের কাছে হার মানল লোকটা। হাত বাড়িয়ে নিল পাঁচশো ডলার।
.
নির্ধারিত সময় শেষ হবার ঠিক তিন মিনিট আগে ওদেরকে দেখল রানা। ম্যাহোনি হলের উত্তরদিকে আরেকটা উঁচু বিল্ডিং খুঁজে পেতে সময় নষ্ট হয়েছে ওর। ছাত থেকে বিনকিউলার দিয়ে তাকাল দুর্গপ্রতিম বাড়িটার দিকে। দোতলার আলোকিত জানালায় প্রথমেই দেখল কুয়াশাকে। বাঙালি বিজ্ঞানীর চেহারা বদলে গেছে—মুখের একটা পাশ ঢাকা পড়ে আছে রক্তাক্ত ব্যাণ্ডেজে, শার্টের বুকের যে-টুকু খোলা—সেখানেও একই দশা। শারীরিক অত্যাচারের স্পষ্ট – আলামত। তবে বেঁচে আছে সে, গাঁট্টাগোট্টা একজন প্রহরীর কাঁধে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটছে কামরার ভিতরে। মহৎ মানুষটার এই অবস্থা দেখে ক্রোধ অনুভব করল রানা।
আস্তে আস্তে বিনকিউলার ঘোরাল ও। পরমুহূর্তে হৃৎপিণ্ড একটা বিট মিস করে গেল। ওই তো, জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে সোনিয়া। সুন্দর মুখটা আতঙ্কে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। শূন্যদৃষ্টিতে তাকাচ্ছে বেচারি এদিক-সেদিক; রানাকেই খুঁজছে সম্ভবত। বোঝা গেল ওর উপর তেমন একটা অত্যাচার চালানো হয়নি। অন্তত শরীরের যে-টুকু দৃশ্যমান, সেখানে কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।
‘আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা টিকে থাকো তোমরা, কুয়াশা… সোনিয়া,’ বিড়বিড় করল রানা। ‘আসছি আমি।’
এরপরেই বন্ধ হয়ে গেল জানালা।