সেই কুয়াশা ২.৪

চার

হেলসিঙ্কির ইটা কাইভোপুইস্তো-র রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে কুয়াশা, থেমে দাঁড়াল একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে। আমেরিকান দূতাবাস এখান থেকে বেশি দূরে নয়; যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকেই চোখে পড়ছে বিল্ডিংটার আলো। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, নেমে এসেছে নির্জনতা। আশপাশে না আছে মানুষ, না চলছে গাড়ি।

চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে ওর মাথা। গতকাল পৌঁছেছে ও ফিনল্যাণ্ডে, রাতটা বিশ্রাম নিয়েছে টাভাস্টিয়ান হোটেলে, সকালবেলায় রিসিভ করেছে রানার পাঠানো সাঙ্কেতিক মেসেজ। ইটালিয়ান ক্রিস্টালের আমদানি-সংক্রান্ত রিপোর্টের আদলে পাঠানো হয়েছে ওটা, দিনের প্রায় পুরো সময় লেগেছে তার পাঠোদ্ধার করতে। যে-সব তথ্য জানতে পেরেছে ও থেকে, তা একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং জটিল। অল্প সময়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে রানা।

ফেনিসের প্রথম কানেকশন আবিষ্কার করে ফেলেছে দুর্ধর্ষ ছেলেটা। কাউণ্ট বিয়াঞ্চির সূত্র ধরে জানতে পেরেছে, ওই দিকটাতে কে এখন ফেনিসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বার্নাদো পাভোরোনি। একটাই অর্থ হতে পারে এর- রানাও তার মেসেজে একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছে-ফেনিসের নিয়ন্ত্রণভার এখন আর মূল চার পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কালের আবর্তনে পরিবারের বলয় পেরিয়ে এখন সেখানে স্থান নিয়েছে দক্ষ, যোগ্য নেতারা। পারিবারিক উত্তরসূরি, সেইসঙ্গে এ-সব লোকের হাতে পড়ে অনেক বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সংগঠনটা। দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে ফেনিসের ফিরে আসার পিছনে নিশ্চয়ই এদের হাত আছে।

পরিস্থিতি যে আগের চেয়ে গুরুতর হয়ে পড়েছে, তা বুঝতে পারছে কুয়াশা। বিয়াঞ্চির ওখানে রানাকে উদয় হতে দেখে এবার সতর্ক হয়ে যাবে ওরা। লেনিনগ্রাদে ভারাকিন পরিবারের বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে কী ধরনের বিপদে পড়তে হবে, তা কল্পনাও করতে পারছে না এ-মুহূর্তে। কিন্তু সে-কারণে পিছিয়ে যাবার মানুষ নয় সে। যত ঝামেলাই আসুক… যত বিপদই দেখা দিক, এগিয়ে সে যাবেই! আজ রাতে ইটা কাইভোপুইস্তো-র রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে সেজন্যই। অপেক্ষা করছে বিশেষ একজন মানুষের, যে ওকে রাশায় ঢোকার পথ করে দেবে।

সোনিয়া মাযোলার ব্যাপারেও বিস্তারিত জানিয়েছে রানা—মেয়েটাকে আর সন্দেহ করবার কিছু নেই, বরং ওকে দুজনের মাঝখানে রিলে হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে। তাতে বিশেষ আপত্তি নেই কুয়াশার। রানা যে এসব বিষয়ে ওর চাইতে অনেক বেশি অভিজ্ঞ, তা তো অস্বীকার করবার উপায় নেই। যোগাযোগের নিয়মও ঠিক করে দিয়েছে ও সরাসরি প্যারিসে সোনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করবে না কুয়াশা। ওর কন্ট্যাক্ট হবে টাভাস্টিয়ান হোটেলের ম্যানেজার – পুরনো, বিশ্বস্ত লোক সে। সোনিয়ার সঙ্গে এই ম্যানেজারই যোগাযোগ রক্ষা করবে। কুয়াশাকে শুধু মেসেজ পৌঁছাতে হবে তার কাছে। একইভাবে রানাও নিজের মেসেজ পৌঁছাবে সোনিয়া পর্যন্ত। সরাসরি তথ্য আদান-প্রদান হবে শুধুমাত্র সোনিয়া এবং ম্যানেজারের মধ্যে।

গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল কুয়াশার। মাথা ঘোরাতে একটা লঞ্চড়মার্কা সেডান দেখতে পেল। কাছাকাছি এসে একবার হেডলাইট জ্বালল- নেভাল গাড়িটা, রাস্তার উল্টোপাশে পৌঁছে থামল ক্ষণিকের জন্য। চালকের আসনে লেদারের জ্যাকেট পরা এক লোক বসে আছে, গলায় লাল মাফলার। এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের পাশে উঠে বসল কুয়াশা। কোনও কথা বলল না কেউ কারও সঙ্গে।

আবার চলতে শুরু করল গাড়িটা। রাশার পথে নিয়ে যাচ্ছে ওকে।

.

ফিনল্যাণ্ড সীমান্তে, লেক সাইমা-র উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ছোট্ট শহর ভাইনিকালা। পানি পাড়ি দিলে প্রতিবেশী দেশ রাশা। হ্রদের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে টহল দিয়ে বেড়ায় রাশান সীমান্তরক্ষীরা; তবে সে-টহল যত না অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানোর জন্য, তার চেয়ে বেশি স্রেফ রুটিন রক্ষা করবার তাগিদে। এ-অবস্থা চলছে সেই সোভিয়েত আমল থেকেই। আসলে… বলকান অঞ্চলের প্রলম্বিত শীতকালে, কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় এ-রুটে চলাফেরা করা অত্যন্ত কঠিন। একেবারে অনন্যোপায় না হলে কেউ এমন জায়গা দিয়ে রাশায় ঢুকতে বা বেরুতে চায় না। এ তো গেল শীতকাল, কিন্তু গ্রীষ্মে আবার ভিন্ন চিত্র। গরমের সময়টাতে তালিন আর রিগা, সেইসঙ্গে লেনিনগ্রাদ থেকে এত বেশি ট্যুরিস্ট ভিসা ইস্যু করা হয় যে, পুরো এলাকায় লেগে থাকে বিদেশি লোকজনের প্রচণ্ড ভিড়। এতসব মানুষকে মনিটর করা দুঃসাধ্য। ক’জন বৈধ, আর ক’জন অবৈধভাবে ঢুকছে দেশে; তার হদিস রাখা সম্ভব হয় না কিছুতেই। সে-চেষ্টাও করে না কেউ। তাই নর্থ-ওয়েস্টের গ্যারিসনগুলো সবসময়েই রাশান মিলিটারির অলস, বিরক্ত সৈনিকদের আখড়া। শাস্তিমূলক বদলি ছাড়া আর কাউকে পাঠানো হয় না ওখানে। রাশায় ঢোকার জন্য ভাইনিকালা একটা বড় চেকপয়েন্ট, তারপরেও সেখানকার লোকজন একেবারে তৃতীয় শ্রেণীর… এমনকী পাহারাদার কুকুরগুলোও।

তবে ফিনিশদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। উনিশশো ঊনচল্লিশে তাদের দেশে সোভিয়েত আগ্রাসনের কথা ভোলেনি ওরা। এই এলাকার জলাশয় আর বনাঞ্চলের ব্যাপারে নিখুঁত জ্ঞান আছে তাদের, সে-আমলে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ঠেকিয়ে দিয়েছিল বিদেশি হানাদারদেরকে; আজও সে ধরনের হামলা মোকাবেলার মত প্রস্তুতি রেখেছে। ফিনিশ এসকর্টের গাড়িতে একের পর এক সামরিক প্রতিরক্ষা-ব্যুহ পেরুতে পেরুতে ব্যাপারটা উপলব্ধি করল কুয়াশা—ভাইনিকালাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে, বিবেচনা করছে ফিনিশরা।

সারা রাস্তায় সঙ্গীর সঙ্গে বলতে গেলে কথাই বলেনি ও, হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল লোকটা মুখ খোলাতে।

‘এটা আপনার ওয়ান-ওয়ে ট্রিপ, মিস্টার। শুধু ঢুকতে পারবেন রাশায়, এ-পথে বেরিয়ে আসতে পারবেন না।’

মাথা ঘুরিয়ে তাকাল কুয়াশা। ‘বিশেষ কোনও কারণ আছে তার পিছনে?

‘কী ধরনের গোলমাল পাকাবেন ওখানে, তার কিছুই জানি না। ঢুকতে দিয়ে বিপদে পড়ব নাকি?’

তর্ক করল না ‘কুয়াশা। লোকটা সরকারি কর্মচারী, গোপনে ফিনিশ আণ্ডারগ্রাউণ্ডের সঙ্গে জড়িত। কাভার মেইনটেনের জন্য ঝামেলা এড়িয়ে চলতে হয় তাকে। পুরনো এক উপকারের প্রতিদান হিসেবে চেকপয়েন্ট পার করে সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে ওকে, তার মানে এই নয় যে, বিপদ দেখা দিলেও পাশে থাকবে।

‘বুঝতে পেরেছি,’ বলল কুয়াশা। ‘রিল্যাক্স, নিজের ব্যবস্থা করে নিতে পারব আমি।’

পাকা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ল সেডান। ঝাঁকি খেতে খেতে এগিয়ে চলল বন্ধুর পথ ধরে। মাইলখানেক গেল, তারপর থেমে দাঁড়াল। হ্যাণ্ডব্রেক টেনে ফিনিশ এসকর্ট বলল, ‘এ-পর্যন্তই সামার দৌড়। হাত ভুলে তুষার আর ঝরাপাতায় ছাওয়া সামনের পথ দেখাল। নাক বরাবর হাঁটতে থাকুন। জঙ্গল পেরোলে আরেকটা রাস্তা পাবেন– রাশান হাইওয়ে। গাড়ির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, ওটা আপনাকে দক্ষিণে ভাইবর্গ হয়ে যেলেনোগর পর্যন্ত নিয়ে যাবে।’

‘কেন?’ · ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা। এ-ধরনের কোনও অ্যারেঞ্জমেন্ট চায়নি ও। আমি তো ওর জন্য টাকা দিইনি।’

‘ব্যাপারটা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই করা, হাসল ফিনিশ এসকর্ট। ‘বর্ডারের কাছে আপনি ধরা পড়ে গেলে সমস্যা। ইন্টারোগেশনে আপনার সাহায্যকারীদের নাম-ধাম বেরিয়ে যেতে পারে। আমার বসেরা চাইছেন না তেমন কোনও ঝুঁকি নিতে।’

‘ঝুঁকি এতেও কম নেই। যে-লোক গাড়ি নিয়ে এসেছে, সে যদি ধরিয়ে দেয় আমাকে?’

‘সে-ভয় নেই। পুরনো বন্ধু আমাদের, বর্ডারের ওপারে স্মাগলিঙের সবকিছু ও-ই দেখে।

‘ওকে আমি চিনব কী করে?’

‘গাড়ি দেখলেই কাছে গিয়ে সময় জিজ্ঞেস করবেন… রাশান ভাষায়। জবাব না দিয়ে সে যদি ঘড়িতে চাবি দিতে শুরু করে, তা হলে বুঝবেন ও-ই আপনার ড্রাইভার!’

‘এ-সবের দরকার ছিল না। রাশায় ঢোকার পর আমি একা থাকলেই সবচেয়ে ভাল হতো… আমাদের দু’পক্ষের জন্যই।’

‘এটাও ভাল হয়েছে। আমাদের লোক আপনাকে খুব সহজে রাশান চেকপোস্টগুলো পার করে নিয়ে যেতে পারবে। একা থাকলে আপনার পক্ষে সেটা সম্ভব হতো না। এত দুশ্চিন্তা করছেন কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ওকে তো আপনার অ্যাসিসটেন্ট বানিয়ে দিইনি। যখন প্রয়োজন ফুরোবে, তখন নাহয় ছেড়ে দেবেন!’

কাঁধ ঝাঁকাল কুয়াশা। তারপর নেমে পড়ল গাড়ি থেকে।

.

দূর থেকেই দেখা গেল গাড়িটা–পুরনো মডেলের একটা পোবেদা… রাস্তার পাশে __ পার্ক করে রাখা হয়েছে, চারপাশে সাদা তুষার। ভোর হতে বেশি দেরি নেই; খুব বেশি হলে এক ঘণ্টা, তারপরেই সূর্যের প্রখর কিরণ আছড়ে পড়বে কুয়াশার আবরণে মোড়া প্রকৃতির উপর। রাতভর বিরাজ থাকা হিম আবহাওয়া বদলে দিয়ে আসবে আরামদায়ক উষ্ণতা। কিন্তু সে-সব নিয়ে উচ্ছ্বাস নেই কুয়াশার মাঝে। গ্লাভ-পরা হাতে নিজের পিস্তল বের করে নিয়েছে ও, হাতটা শরীরের আড়ালে লুকিয়ে লঘু পায়ে চলল পোবেদার দিকে। সরাসরি এগোল না, একটু ঘুরপথে চলে গেল গাড়ির পিছনে, সেখান থেকে সন্তর্পণে অগ্রসর হলো বাহনটার দিকে।

ফারের কোট আর ভারী মাফলার জড়িয়ে মাঝবয়েসী একজন মানুষ বসে আছে ড্রাইভিং সিটে। ক্ষণে ক্ষণে মুখের কাছে উঠে আসা সিগারেটের আগুনে আলোকিত হয়ে উঠছে চেহারা। সাইডভিউ মিররে সে চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল কুয়াশা। এ-লোককে ও চেনে। ক্যাপ্টেন গ্রিগোরি সিমর্কিন-ভাইবর্গে রাশান পুলিশ স্টেশনের প্রধান! কুয়াশাকে গ্রেফতারের জন্য এককালে আদাজল খেয়ে লেগেছিল লোকটা, হারভাবে মনে হয়েছিল তার মত নিবেদিতপ্রাণ পুলিশ অফিসার আর কেউ হতে পারে না। আর এখন বুঝি এ-ই ফিনিশ অপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্মাগলিং করছে? বিশ্বাস করা কঠিন, টাকার জন্য মানুষ কতটা নীচে নামতে পারে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হলো ও। লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে : গেল গাড়ির পাশে।

অন্যমনস্ক ছিল সিমকিন, কুয়াশা একেবারে পাশে না আসা পর্যন্ত টেরই পেল না কিছু। হঠাৎ জানালার পাশে একটা অবয়ব দেখতে পেয়ে চমকে উঠল। তাড়াতাড়ি একটা টর্চলাইট তুলে আলো ফেলল -বাইরে। আগন্তুকের চেহারা দেখল না, তার বদলে দেখল পিস্তলের নিষ্কম্প নল… সোজা তার মাথার দিকে তাক করে রাখা হয়েছে। স্থির হয়ে গেল সে।

‘গুড মর্নিং, কমরেড সিমকিন! কী সৌভাগ্য, আবার দেখা হয়ে গেল আমাদের।’

কণ্ঠটা পরিচিত মনে হলো সিমকিনের, কিন্তু মনে করতে পারল না কোথায় শুনেছে। কয়েক মুহূর্ত পর কুয়াশা একটু ঝুঁকে মুখোমুখি. হলো তার, চেহারা দেখে চমকে উঠল সে।

‘মাই গড! কুয়াশা… আপনি?’

হাসল কুয়াশা। ‘যদি ভুল করে না থাকি, গাড়ি নিয়ে আমার জন্যই অপেক্ষা করছ তুমি। ক’টা বাজে, জানতে পারি?

‘ক্‌…কী?’

‘সময় জানতে চাইছি। বাই দ্য ওয়ে, যদি সত্যিই টাইম বলো, তোমাকে খুন করা ছাড়া গতি থাকবে না আমার।’

সচকিত হয়ে উঠল সিমকিন। তাড়াতাড়ি হাতঘড়িতে দম দিতে শুরু করল।

‘গুড,’ সন্তুষ্ট গলায় বলল কুয়াশা, তবে পিস্তল সরাল না। ‘অত আপসেট হবার কিছু নেই। আমরা দু’জনেই এখন একই পথের পথিক। কিছু মনে না করলে… গাড়ির চাবিটা আমাকে দেবে?’

‘ক্… কেন?’ তোতলাচ্ছে সিমকিন।

ইনশিয়োরেন্স। গাড়িতে ঢোকার পর ওটা আবার ফেরত পাবে তুমি। হয়েছে কী, তুমি এখন নার্ভাস হয়ে আছ। আর নার্ভাস লোক উল্টোপাল্টা কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। আমি চাই না তুমি আমাকে ফেলে চলে যাও। চাবি দাও, প্লিজ।

মুখের কয়েক ইঞ্চি তফাতে স্থির হয়ে থাকা পিস্তলের ব্যারেলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল সিমকিন। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতে ইগনিশন থেকে খুলে আনল চাবির গোছা, তুলে দিল কুয়াশার হাতে।

‘ধন্যবাদ,’ বলল কুয়াশা। পিস্তল ঢুকিয়ে ফেলল কোর্টের আড়ালে। গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে প্যাসেঞ্জার সাইডে চলে এল, দরজা খুলে উঠে বসল সিমকিনের পাশে। ‘সো নাইস অভ ইউ, ক্যাপ্টেন।’ চাবির গোছা ফিরিয়ে দিল ও। ‘এসো, বন্ধু হই আমরা। পুরনো শত্রুতার কথা ভুলে যাই। কেউ কারও দুর্বলতার সুযোগ নেব না, তাতে দু’জনেরই ক্ষতি।’

নিজেকে সামলে নিয়েছে সিমকিন। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘যদি জানতাম, তোমাকে তুলে নেবার জন্য পাঠানো হয়েছে আমাকে…’

‘কী করতে? অ্যারেস্ট করতে আমাকে?’ বিদ্রূপের সুরে বলল কুয়াশা। ‘তাতে তোমার ফিনিশ বন্ধুরা কেমন খেপে যেত, জানো না? ওদের সঙ্গে পার্টনারশিপের ইতি ঘটত তোমার, বাড়তি ইনকাম বন্ধ হয়ে যেত চিরতরে, খেতে হত জেলের ভাত।

‘হুম, হয়তো ঠিকই বলেছ,’ মাথা ঝাঁকাল সিমকিন। ‘আমাকে বলা হয়েছে—যাকে রিসিভ করব, সে ফিনিশদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনেকদিন আগে নাকি ওদের এক মাফিয়া চিফের মেয়ে কিডনি ফেইলিওরের কারণে মরতে বসেছিল। কোথাও ওই মেয়ের উপযোগী কিডনি পাওয়া যাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত তুমি নিজের কিডনি দান করে দিয়েছিলে।

‘পুরনো ইতিহাস,’ উদাস গলায় বলল কুয়াশা। ‘ওসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে তোমার।

‘না ঘামিয়ে পারছি না। মাফিয়া জাতীয় ক্রিমিনালদের সঙ্গে সাপে-নেউলে সম্পর্ক তোমার। ওদের মুখের গ্রাস কেড়ে নাও যখন-তখন। অথচ নিজের কিডনি একজন মাফিয়া-সন্তানকে দিয়ে দিলে?’

বাপ মাফিয়া হতে পারে, মেয়ে তো নয়। যাক গে, কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালু করো। অনেকদূর যেতে হবে আমাদেরকে।

ইগনিশন-কী ঘোরাল সিমকিন। ‘কোথায় যাবে?’

‘লেনিনগ্রাদ, শান্ত গলায় বলল কুয়াশা। একাকী কাজ করবার সিদ্ধান্ত পাল্টেছে। সিমকিনের মত একজন বড় পুলিশ অফিসার সঙ্গে থাকলে সুবিধে পাবে অনেক। লোকটা বেঈমানীও করতে পারবে না। তার গোপন স্থাগলিঙের খবর জেনে গেছে কুয়াশা, বেঈমানী করতে গেলে সেটা ফাঁস হয়ে যাবে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও কুয়াশার অনুগত থাকতে হবে তাকে।

‘কিন্তু তোমাকে শুধু যেলেনোগরস্ক পর্যন্ত পৌঁছে দেবার কথা আমার!’ প্রতিবাদ করল সিনকিন।

‘এত খেপছ কেন? নাহয় বাড়তি কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করতে হবে তোমাকে। খুব বেশি কিছু তো নয়।’

‘কিন্তু সকালে আমাকে ভাইবর্গে থাকতে হবে! একটা মিটিং আছে।’

‘ফোন করে অন্য কাউকে যেতে বলো। বিশ্বাসযোগ্য একটা অজুহাত খাড়া করতে খুব অসুবিধে হবে না নিশ্চয়ই? চাইলে আমিও সাহায্য করতে পারি।

অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে উঠল সিমকিনের চেহারায়। বেকায়দা পরিস্থিতির মুখে পড়ে গেছে, আভাসে-ইঙ্গিতে ওকে ব্ল্যাকমেইল করছে কুয়াশা। উপায়ান্তর না দেখে গাল দিল ভাগ্যকে নিচু কণ্ঠে ।

‘পাগলামি করছ তুমি,’ বলল সে। ‘কেউ কিছু টের পেলে। আমরা দু’জনেই শেষ!’

‘এখুনি সেটা ঘটছে না। লেনিনগ্রাদে কাজ আছে আমাদের চলো।’

হ্যাণ্ডব্রেক রিলিজ করে পোবেদাকে আগে বাড়াল সিমকিন।

.

ওরা যখন কিরভ ব্রিজ অতিক্রম করল, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। শহর এলাকায় ঢুকেছে গাড়ি, তারপরেও দু’পাশে তাকিয়ে প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখতে পেল কুয়াশা—পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা শীতকালীন বাগানগুলো নববধূর সাজে সেজেছে, ফুলে-ফুলে ভরে গেছে গাছগাছালি। ব্রিজ পেরিয়ে দক্ষিণে চওড়া রাস্তা চলে গেছে নেস্কি প্রসপেক্টের দিকে। জানালা দিয়ে লেনিনগ্রাদের মনুমেন্ট দেখতে পেয়ে ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে গেল ও। লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে নেভা নদীর তীরের বরফে ঢাকা বন্ধ্যাভূমি পরিণত হয়েছে আজকের এই সুসজ্জিত নগরে।

নেস্কি প্রসপেক্ট পেরিয়ে এল পোবেদা, অ্যাডমিরান্টি বিল্ডিঙের দর্শনীয় অগ্নিশিখাকে পাশ কাটিয়ে পৌছে গেল নদীর ধারে। সামনেই জারিস্ট আমলের হৃত গৌরবের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উইন্টার প্যালেস। সেদিকে তাকিয়ে প্রিন্স আলেক্সেই ভারাকিনের কথা ভাবল কুয়াশা—জারিস্ট বংশের শেষ মানুষদের একজন। লেনিনগ্রাদে এখনও কি আছে তার পরিবার? শীঘ্রি এ-প্রশ্নের জবাব পেতে হবে ওকে।

‘আনিচভ ব্রিজ পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নাও, নিৰ্দেশ দিল কুয়াশা ‘পুরনো হাউজিং ডেভেলপমেন্ট ডিস্ট্রিক্টে ঢোকো। কোথায় থামবে, সেটা বলে দেব আমি।’

‘কী আছে ওখানে?’ জানতে চাইল সিমকিন। ধীরে ধীরে কৌতূহলী হয়ে উঠছে সে।

‘জানো না বুঝি? একগাদা অবৈধ বোর্ডিং হাউস আর সস্তা দরের হোটেল। সরকারকে পছন্দ করে না ওখানকার লোকজন, পুরোপুরি আলাদা একটা জগতে বাস করে। গা-ঢাকা দেবার জন্য পুরো লেনিনগ্রাদে এরচেয়ে ভাল জায়গা আর দুটো নেই।’

‘এখানেই লুকাও তুমি সবসময়?’

হাসল কুয়াশা। ‘আগে জানা থাকলে খুব সুবিধে হতো তোমার, তাই না? আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারতে সহজে। উঁহুঁ, ধারণাটা ভুল। ওখানকার প্রতিটা বিল্ডিঙে পালাবার জন্য গোপন পথ আছে {

কাঁধ ঝাঁকাল সিমকিন। ‘ওসব কিছুই ভাবছি না আমি। আমাকে কতক্ষণ আটকে রাখবে তুমি, জানতে পারি?’

‘এখুনি বলতে পারছি না। আগে অবস্থা বুঝে নিই।’ কুয়াশা নির্বিকার।

বিরক্তিতে গজগজ করে উঠল সিমকিন।

সাদোভায়ার ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে পুরনো হাউজিং ডিস্ট্রিক্টে ঢুকল পোবেদা। চারপাশে মান্ধাতা আমলের বিবর্ণ বিল্ডিঙের সারি। এমনিতে জায়গাটা পরিচ্ছন্ন… দেখে বোঝার উপায় নেই, কী কষ্টের জীবন যাপন করছে এখানকার মানুষেরা। একেকটা ফ্ল্যাটে দুই থেকে তিনটা পরিবার বাস করে, কামরাগুলোতে থাকে পাঁচ-ছ’জন করে মানুষ। আধুনিক নাগরিক সুবিধা বলতে কোনও কিছুর অস্তিত্ব নেই এখানে কোথাও। এ-কারণে চাপা ক্ষোভে ফুঁসছে অধিবাসীরা, মাঝে-মাঝে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে তার বিস্ফোরণও ঘটে।

‘সামনের বাঁকের পাশে গাড়ি রাখো, একটু পর বলল কুয়াশা। ‘অপেক্ষা কোরো আমার জন্য। যার কাছে যাচ্ছি. সে যদি না থাকে, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসব। আর যদি দেখা পেয়েই যাই, হয়তো বা ঘণ্টাখানেক থাকতে হতে পারে আমাকে।

রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা কতগুলো সাইকেলের পিছনে গাড়ি থামাল সিমকিন। নামার আগে কুয়াশা তাকে বলল, ‘একটা বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। দুটো অপশন আছে তোমার হাতে—এখানকার পুলিশ ডেকে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারো, অথবা সাহায্য করতে পারো আমাকে। প্রথমটা যদি করো, তা হলে তোমার গোমর ফাঁস করে দেব আমি। নিজের পজিশনের সুযোগ নিয়ে কী ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছ, তা জানিয়ে দেব সবাইকে। শাস্তি একা আমার হবে না, তোমারও হবে তাতে। আর যদি দু’নম্বর পন্থা অবলম্বন করো… কাজশেষে বড় অঙ্কের একথোক টাকা দেব আমি, তোমার উপরি কামাই-ও চলতে থাকবে আগের মত। এখন নিজেই ভেবে দেখো, কোনটা তোমার জন্য লাভজনক।’

মুখ বাঁকাল সিমকিন। ‘কী করব, তা তুমি খুব ভাল করেই জানো। কোনও বিকল্প নেই আমার হাতে… এখানেই অপেক্ষা করছি আমি।’

‘গুড, মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। দরজা খুলে নেমে গেল গাড়ি থেকে। মোড় পেরিয়ে একটা চারতলা বিল্ডিং, সেটার সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করল। সবমিলিয়ে বিশটা ফ্ল্যাট আছে এ-বিল্ডিঙে, অন্তত দু’শো লোক বাস করে। একমাত্র নাতালিয়া সিমোনোভার ফ্ল্যাটটা তার ব্যতিক্রম। একাকী থাকে ও, কোনও রুমমেট নেই… মানে, শেষ খবর যদ্দূর জানে আর কী। অনেকদিন কোনও যোগাযোগ হয়নি ওদের মধ্যে।

তিনতলায় উঠতে উঠতে পুরনো স্মৃতি মনে পড়ল কুয়াশার—মনে পড়ল কীভাবে দু’জনের পরিচয় হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে মহা-বিপদে পড়ে গিয়েছিল নাতালিয়া… এমনই বিপদ, যার কারণে মৃত্যুদণ্ড হতে যাচ্ছিল ওর। রাশান ইন্টেলিজেন্সে কাজ করত মেয়েটা, গণিতবিদ হিসেবে এমনিতে অত্যন্ত মেধাবী, মস্কো ইউনিভার্সিটি-র ডক্টোরাল গ্র্যাজুয়েট, লেনিন ইন্সটিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া। ফিল্ডে ওর মত দক্ষ কম্পিউটার প্রোগ্রামার খুব কমই আছে। এ-কারণে লেনিনগ্রাদের ইন্টেলিজেন্স অফিসে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল ওকে। হঠাৎ করে সেখান থেকে বেশ কিছু ক্লাসিফায়েড ডকুমেন্ট চুরি যাওয়ায় ফেঁসে যায় বেচারি। অ্যারেস্ট করা হয় ওকে, শুরু হয় বিচার। আসল অপরাধী ছিল অন্য আরেকজন, কিন্তু পুরো ঘটনাটা সে এমনভাবে ঘটায়, যাতে নাতালিয়ার উপরেই সমস্ত সন্দেহের তীর বিদ্ধ হয়। এমন সব মিথ্যে প্রমাণ ছড়িয়ে রেখেছিল, যার কারণে সরকারি তথ্য পাচারের অভিযোগে চরম শাস্তি হতে যাচ্ছিল মেয়েটির। কেউ ছিল না ওকে সাহায্য করবার।

এ-পরিস্থিতিতে ব্যাপারটার মধ্যে নাক গলায় কুয়াশা… এবং সেটা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে। রাশান ইন্টেলিজেন্সের এক কন্ট্যাক্টের মুখে নাতালিয়ার কথা শোনার পর খারাপ লেগেছিল ওর-নিরপরাধ একটা মেয়ে অকারণে মারা যাবে, সেটা মেনে নিতে পারছিল না কিছুতেই। তাই নিজের স্বভাবজাত কৌশলে সমাধান করেছিল রহস্যটা, আড়াল থেকে বের করে এনেছিল সত্যিকার অপরাধীকে, মুক্ত করেছিল নাতালিয়াকে। কাজটা করতে গিয়ে যথেষ্ট গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল ও, তারপরেও ছাড়া পাবার পর কীভাবে যেন ওর খোঁজ বের করে ফেলে মেয়েটা। মুখোমুখি হয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। সেই থেকে চমৎকার এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক বিরাজ করছে ওদের মধ্যে। সম্পর্কটা হয়তো আরও গভীর হতে পারত, কিন্তু সচেতনভাবে সেটাকে এড়িয়ে চলেছে কুয়াশা। ওর ফেরারী জীবনের সঙ্গে কোনও মেয়েকে জড়ানো চলে না, তেমন কোনও ইচ্ছেও নেই ওর। তা ছাড়া নাতালিয়ার নিরাপত্তার জন্যই দূরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন, শত্রুরা কুয়াশার নাগাল পাবার জন্য যেন ওকে ব্যবহার করতে না পারে। ইন্টেলিজেন্সের চাকরি এখনও করছে মেয়েটা, রাশান ইন্টেলিজেন্সের কম্পিউটার … নেটওয়ার্কে ওর রয়েছে অবাধ গতিবিধি। সে কারণেই এতদিন পর আবার ওর কাছে চলেছে কুয়াশা!

নাতালিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে কবজিতে বাঁধা ঘড়ি দেখল ও—একটা বাজতে দশ মিনিট। দুপুরের এ-সময়টাতে ঘরেই থাকার কথা মেয়েটার। রাতের শিফটে ডিউটি করে, সকাল আটটায় ছুটি। এরপর বাসায় ফিরে দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। এখনও কি সে-রুটিন আছে? একটু দ্বিধায় ভুগল কুয়াশা কলিংবেল চাপার আগে। বোতামটাতে চাপ দেয়া মানেই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে নাতালিয়াকে জড়িয়ে ফেলা। কিন্তু এ-ছাড়া উপায়ও নেই আর। লেনিনগ্রাদে বিশেষ যে মানুষটির নাগাল পেতে চাইছে ও, তার কাছে সরাসরি পৌঁছুনো সম্ভব নয়। কী আর করা, কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজার পাশে হাত বাড়িয়ে দিল কুয়াশা, কলিংবেলের বোতাম চাপল। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, নাতালিয়াকে সবকিছু খুলে বলবে। এরপর ও-ই ঠিক করুক, কুয়াশাকে সাহায্য করবে কি করবে না।

দরজার ওপাশে পায়ের আওয়াজ হলো— হিল পরে কাঠের মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে আসছে কেউ। কয়েক মুহূর্ত পর নামানো হলো ছিটকিনি, আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করল পাল্লা… পুরোপুরি নয়, অর্ধেক। দেখা গেল নাতালিয়ার সুঠাম অবয়ব। ওকে দেখেই খটকা লেগে গেল কুয়াশার-উজ্জ্বল রঙের একটা পোশাক পরে আছে মেয়েটা… সামার ড্রেস, ঘরের পোশাক বলা যাবে না মোটেই। মাথাভরা বাদামি চুলের গোছা এলোমেলো ভঙ্গিতে পড়ে আছে কাঁধের উপর। চোখের তারায় শঙ্কা, সুন্দর মুখশ্রী আড়ষ্ট হয়ে আছে। এতদিন পর ওকে দেখে যতটা অবাক হওয়া উচিত, তার ছিটেফোঁটাও হলো না।

কুয়াশা।’ বলল নাতালিয়া। ‘কী সৌভাগ্য আমার!’

গলার স্বরটা স্বাভাবিক নয়। সতর্ক হয়ে উঠল কুয়াশা, নাতালিয়া কি সতর্ক করতে চাইছে ওকে? ওর চোখে চোখ রাখল, পরমুহূর্তে নিশ্চিত হলো—ঠিকই অনুমান করেছে। একা নয় মেয়েটা। ভিক্ষরে আরও কেউ আছে… অপেক্ষা করছে ওর-ই জন্য!

‘সৌভাগ্য আসলে আমার, নাতালিয়া, কুয়াশা বলল, মৃদু মাথা ঝোঁকাল পাল্টা সঙ্কেত দেবার জন্য। আড়চোখে তাকাল দরজার কবজা আর চৌকাঠের ফাঁক দিয়ে। জ্যাকেটের একাংশ আর ধূসর প্যান্ট দেখতে পাচ্ছে; পাল্লার পিছনে লুকিয়ে আছে শত্রু। ‘কতদিন পর দেখা, বলো তো?’

‘কী জানি, হিসেব রাখিনি আমি।’ বলতে বলতে পিছিয়ে গেল নাতালিয়া।

‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই তোমার সঙ্গে।’ পা বাড়াল কুয়াশা। ডোরওয়েতে পৌঁছেই আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আধখোলা দরজার উপর। ধাক্কা খেয়ে প্রচণ্ড বেগে কবজার উপর ঘুরল পাল্লা, খ্যাচ করে আছড়ে পড়ল আত্মগোপনকারীর গায়ে। ককিয়ে উঠল লোকটা, দরজার পাল্লা আর দেয়ালের মাঝখানে পিষ্ট হয়েছে সে।

লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল কুয়াশা। দরজার পিছন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রতিপক্ষ, পাল্লাটা একটু টেনে আবার তাকে ছ্যাঁচা দিল ও। এবার রীতিমত আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। কাত হয়ে হামাগুড়ির ভঙ্গিতে চলে গেল মেঝেতে। একটা পিস্তল দেখা গেল হাতে, লাথি মেরে সেটা সরিয়ে দিল কুয়াশা। নিজের পিস্তল এরই মধ্যে চলে এসেছে মুঠোয়, সেটাকে উল্টো করে ধরে প্রচণ্ড এক ঘা বসাল লোকটার মাথার পিছনে। হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে।

শান্ত ভঙ্গিতে দরজা বন্ধ করে দিল কুয়াশা। তাকাল নাতালিয়ার দিকে। ‘তুমি ঠিক আছ?’

মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা। ‘থ্যাঙ্ক গড, আমার ইশারা তুমি বুঝতে পেরেছ।’

‘না বোঝার কিছু ছিল না,’ হাসল কুয়াশা। শীতকাল চলছে এখন… অথচ তোমার গায়ে গ্রীষ্মের পোশাক!’

‘বেশিরভাগ পুরুষ কিন্তু বুঝতে পারত না সেটা। ভাগ্য ভাল যে তুমি পেরেছ।

‘তা হলে অন্য কোনও বুদ্ধি খাটাওনি কেন?’

‘সুযোগ ছিল না। কাপড় বদলানো ছাড়া আর কোনও কিছু করতে দেয়নি ব্যাটা আমাকে।’

‘হুম! কে ও? কিছু ধারণা করতে পারো?’

‘আর যা-ই হোক, রাশান নয়। খুব সম্ভবত ইংরেজ। ওর রাশান উচ্চারণে ব্রিটিশ টান লক্ষ করেছি আমি।’

‘ঘরে ঢুকল কীভাবে?

ভুয়া একটা আই.ডি. কার্ড দেখিয়ে। অভিনয় করছিল, যেন মস্কোর হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছে। চ্যালেঞ্জ করতেই পিস্তল বের করল। তখন আর কিছু করবার ছিল না আমার। অনেকক্ষণ অনুরোধ করবার পর শুধু ঘরের জামাটা বদলে নিতে দিয়েছে… তাও আবার ওর চোখের সামনে!’

‘কী জন্যে এসেছে, তা বলেনি?’

‘তোমার ব্যাপারে খোঁজ নিতে। বলেছি কিছু জানি না আমি, কিন্তু বিশ্বাস করেনি আমার কথা। তার খানিক পর তো তুমিই হজির হলে

পিছনে নড়াচড়ার শব্দ শুনে পাঁই করে ঘুরল কুয়াশা। জ্ঞান ফিরে এসেছে ইংরেজের। ওঠার চেষ্টা করছে না দেখে অবাক হলো, পরক্ষণেই ধরতে পারল রহস্যটা। মুখ নড়ছে ব্যাটার। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ও, দু’হাতে গলা চেপে ধরে চেষ্টা করল ঠেকাতে… কিন্তু লাভ হলো না। লোকটার কথা বেয়ে নেমে এল সাদাটে ফেনা। ঝাঁকুনি দিয়ে স্থির হয়ে গেল দেহটা।

‘হোয়াট দ্য…’ বিস্মিত গলায় বলল নাতালিয়া। ‘কী ঘটল?’ পরাজিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। বলল, ‘সায়ানাইড পিলু-মুখের ভিতরে লুকানো ছিল। আত্মহত্যা করেছে ব্যাটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *