সেই কুয়াশা ২.৬

ছয়

সল্টিকভ-শেট্রিন লাইব্রেরির দক্ষিণ-পশ্চিম এন্ট্রান্সের উল্টোপাশে, একটা আর্চওয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা আর সিমকিন। সামনে… কমপ্লেক্সের আঙিনা উজ্জ্বলভাবে আলোকিত—সারি সারি ফ্লাডলাইটের আলো ছড়িয়ে পড়ছে উঁচু দেয়ালের মাথা থেকে… সৃষ্টি করছে দৃষ্টিবিভ্রম—মনে হচ্ছে যেন কোনও প্রিজন কম্পাউণ্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। পার্থক্য স্রেফ এ-ই যে, এই কারাগারে ইচ্ছেমত ঢুকতে-বেরুতে পারে মানুষ। আজ সন্ধ্যায় লাইব্রেরি অত্যন্ত ব্যস্ত। দলে দলে পুস্তকপ্রেমী আনাগোনা করছে আর্চওয়ে ধরে।

‘কী করছি আমরা, বুঝিয়ে বলো আমাকে,’ হঠাৎ অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল সিমকিন। ‘বুড়ো লোকটা কে? তাকে যে-অনুসরণ করছে, সে-ই বা কোন্ পক্ষের?

বিরক্ত হলো কুয়াশা। ‘এত কথা জানার দরকার কী তোমার?’

দরকার আছে, কুয়াশা। ব্ল্যাকমেইলের ভয় দেখিয়ে দেশবিরোধী কোনও কাজ করিয়ে নিচ্ছ কি না, সেটা শিয়োর হয়ে নিতে চাই।’

‘নিশ্চিন্ত থাকো, অমন কিছুতে অংশ নিচ্ছ না তুমি। মি. শেভচেঙ্কো নিপাট ভালমানুষ, তাঁকে ফলো করছে আমার এক শত্রু। ব্যাটাকে আটক করতে হবে আমাদেরকে, যাতে ওর কাছ থেকে ইনফরমেশন আদায় করা যায়।’

‘শেভচেঙ্কো… ওটাই বুড়ো ভদ্রলোকের নাম?’

‘নামটা ভুলে গেলেই ভাল করবে তুমি… ওই তো, বেরিয়েছেন উনি।’ চাপাস্বরে বলল কুয়াশা।

ওভারকোট আর কালো রঙের ফারের হ্যাট পরা এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এসেছেন এন্ট্রান্স দিয়ে। হিম বাতাসে কেঁপে উঠলেন একটু। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ, যেন বুঝতে পারছেন না, কোন আর্চওয়ে ধরে রাস্তায় যাবেন। মুখে ছোট করে ছাঁটা সাদা দাড়ি; উন্মুক্ত ফ্যাকাসে চামড়া বলিরেখায় ভরা। মিনিটখানেক দ্বিধায় থাকার পর পা বাড়ালেন তিনি, নামতে শুরু করলেন সিঁড়ি দিয়ে, আঙিনায় নামার পর বামদিকের আর্চওয়ে ধরে চলে গেলেন রাস্তার দিকে।

শেভচেঙ্কোর পিছনের ভিড়ের মধ্যে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল কুয়াশা, অনুসরণকারীকে সনাক্ত করতে চায়। খুব বেশি সময় লাগল না, নিঃসঙ্গ একটা মেয়ের উপর দৃষ্টি আটকে গেল ওর—ভিড় ঠেলে দ্রুত আগে বাড়ছে। তাড়াহুড়ো করে নামছে সিঁড়ি ধরে, এক মুহূর্তের জন্যও নজর সরাচ্ছে না বৃদ্ধের উপর থেকে। ভাল কৌশল, মনে মনে স্বীকার করল কুয়াশা। পুরুষের চেয়ে মেয়েরা ফেউ হিসেবে ভাল, কেউ সহজে সন্দেহ করে না মেয়েদেরকে। তবে এই মেয়ে শুধু অনুসরণের জন্য আসেনি এখানে, ওর আসল মিশন নিঃসন্দেহে কুয়াশাকে খুন করা। কতখানি ভয়ানক হতে পারে মেয়েটা, মনে মনে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল ও।

‘ওই মেয়েটাকে দেখছ?’ ফিসফিসিয়ে বলল কুয়াশা। খয়েরি ওভারকোট আর টুপি পরা… ও-ই আমাদের টার্গেট। মি. শেভচেঙ্কোর কাছে পৌঁছুতে দেয়া যাবে না ওকে। এসো।’

‘একটা মেয়ে?’ দ্বিধা ফুটল সিমকিনের কণ্ঠে, যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘সাধারণ মেয়ে নয়, বন্ধু। ওর থদের ভিতর অনেক চমক লুকানো আছে। চলো এগোই। এখুনি মি. শেভচেঙ্কোর কাছে যাবে না ও, ভদ্রলোককে একাকী পাবার জন্য অপেক্ষা করবে। সে-সুযোগটা কাজে লাগাব আমরা, ওকে দূরে সরিয়ে আনব কৌশলে। যাতে চেঁচামেচি করলে কারও কানে না যায়।’

‘চেঁচাবে?’

‘অবশ্যই! মেয়েমানুষকে কখনও চুপচাপ হার মানতে দেখেছ? আর কথা নয়। চলো।’

পরের বিশ মিনিট প্রত্যাশিতভাবেই কাটল। চরম বিভ্রান্তি আর অশান্ত ভঙ্গি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেন বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান। হাঁটলেন নার্ভাসভাবে—কখনও ফুটপাতে, কখনও বা বরফ ঢাকা সড়কে। ঘড়ি দেখলেন বার বার, তা করতে গিয়ে ক্রমাগত ধাক্কা খেলেন পথচারী লোকজনের সঙ্গে। বিড় বিড় করে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলেন অনবরত। কয়েক বারই উল্টো ঘুরে অনেক দূর চলে এলেন, সম্ভবত নির্দেশনা ঠিকমত ফলো করতে পারেননি বলে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন নিজের উপর। ভদ্রলোকের এই অনিশ্চিত- আচরণের ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটল—অনুসরণকারী মেয়েটাকেও একই ধরনের আচরণ করতে হলো। চিহ্নিত হয়ে যাবার ভয়ে কাছে যেতে পারল না বৃদ্ধের, দূরত্ব বজায় রাখতে হলো, থাকতে হলো ছায়ায় ঢাকা গলি কিংবা স্বপ্নালোকিত দোকানপাটের সামনে।

সামনের চওড়া অ্যাভিনিউ জরিপ করে নিল কুয়াশা। দু’পাশে দুটো অন্ধকার গলি দেখতে পাচ্ছে। শেভচেঙ্কো সামনে এগোনোর পর নিঃসন্দেহে ও-দুটোর একটাতে পজিশন নিতে হবে মেয়েটাকে।

‘এসো, সিমনিকে বলল কুয়াশা, ‘ভিড়ের আড়াল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব আমরা। একটু পরেই ওই গলিগুলোর একটাতে ঢুকবে মেয়েটা, ওখানেই ফাঁদ পাতব।

‘যদি না ঢোকে?’ সন্দেহ প্রকাশ করল সিমকিন।

‘ঢুকবে,’ কুয়াশা নিশ্চিত। ‘এতক্ষণ ধরে এ-পদ্ধতিই ব্যবহার করছে ও।’

যে-সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল, তা সমাগত। উত্তেজনা অনুভব করল কুয়াশা। গত বিশ মিনিট ধরে ওর সাজানো পরিকল্পনা চমৎকারভাবে কাজ দিয়েছে, এবার সেটার সফল সমাপ্তি, ঘটাবার পালা। দুটো বিষয়ে ও নিশ্চিত-প্রথমত, ওকে দেখামাত্র. চিনতে পারবে মেয়েটা; নিঃসন্দেহে তাকে ছবি আর শারীরিক গঠনের বিবরণ দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাকে দ্রুত ঘায়েল করতে না পারলে আরেকবার ইংরেজ আততায়ীর মত আত্মহত্যার ঘটনা ঘটবে। পুরো প্ল্যানের সাফল্য নির্ভর করছে টাইমিং এবং চমকে দেবার উপরে। প্রথমটা ওর দায়িত্ব, দ্বিতীয়টা সিমকিনের।

পথচারীদের আড়াল নিয়ে রাস্তা পেরুল দুজনে, মিশে গেল কিরভ থিয়েটারের সামনে জড়ো হওয়া দর্শকদের ভিড়ে। আড়চোখে পিছনটা দেখে নিল কুয়াশা। টিকেটের জন্য লাইন ধরা লোকজনের কাছাকাছি হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন শেভচেঙ্কো, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শ্বাস টানছেন জোরে জোরে।

সিমকিনের বাহু ধরে কাছে টানল কুয়াশা। ‘শোনো কী করতে হবে…’

ইউনিফর্মধারী কয়েকজন সৈনিক হেঁটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। তাদের পিছু পিছু আবার এগোতে শুরু করল ওরা। প্রথম গলিটা পেরিয়ে এল দু’জনে, দ্বিতীয় গলির সামনে পৌছে থামল। ইশারা পেয়ে ভিতরে ঢুকে গেল সিমকিন, আর কুয়াশা কয়েক কদম এগিয়ে গলির পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ওভারকোটের কলার তুলে দিল, মাথায় পরা হ্যাট একটু নামিয়ে নিল সামনে মাথা নামিয়ে রাখায় ওর চেহারা এখন আর দেখতে পাচ্ছে না কেউ।

আর মাত্র কয়েক মিনিট…

হ্যাটের কার্নিশের তলা দিয়ে শেভচেঙ্কোকে ওর সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে দেখল কুয়াশা। চোখ ঘোরাল—ক্ষণিকের জন্য প্রথম গলিতে ঢুকেছিল মেয়েটা, আবার বেরিয়ে এসেছে। দ্বিতীয় গলির সামনে চলে এল দ্রুতপায়ে, গলিমুখে দাঁড়াল এক মুহূর্তের জন্য, ভিতরে ঢুকে পড়ল পরক্ষণে।

কয়েক পা গিয়েই থেমে দাঁড়াল মেয়েটা। বুঝতে পেরেছে, গলিতে সে একা নয়। তাড়াতাড়ি উল্টো ঘুরল বেরিয়ে যাবার জন্য, কিন্তু থেমে গেল পিছনে সিমকিনের কণ্ঠ শুনে।

কমরেড, দাঁড়াও! সার্কোলো… পার নস্ত্রো সার্কোলো!’

থমকে গেল মেয়েটা। চমকে উঠেছে। ধীরে ধীরে ফিরল সিমকিনের দিকে। হিসিয়ে উঠে বলল, ‘কে তুমি?’

‘বন্ধু।’ কয়েক পা সামনে এগোল সিয়কিন। জরুরি মেসেজ আছে তোমার জন্য… রাখাল বালক পাঠিয়েছেন।’

আরেক দফা চমকাবার পালা মেয়েটার। বজ্রাহতের মত স্থির হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল কুয়াশার শরীরে। শিকারি শ্বাপদের মত ছুটল ও, দেয়ালের কোনা ঘুরে ঢুকে গেল গলিতে। পিছনে পায়ের শব্দ শুনে পাঁই করে ঘুরল মেয়েটা, কিন্তু প্রতিক্রিয়া দেখাবার আগেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়াশা।

প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়ে দেয়ালের উপর আছড়ে পড়ল মেয়েটা। ব্যথা পেয়ে চেঁচানোর চেষ্টা করতেই তার খোলা মুখে একটা দলা পাকানো রুমাল গুঁজে দিল কুয়াশা, আঙুলের খোঁচায় মুখ-গহ্বরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল ভালমত। দুই চোয়াল আর একত্র করবার উপায় রইল না মেয়েটার, মুখের ভিতর লুকানো সায়ানাইড পিলের আবরণ আর ভাঙতে পারবে না দাঁত দিয়ে।

পুরো ব্যাপারটা ঘটতে সময় লাগল মাত্র দশ সেকেণ্ড। কিন্তু এরপরেই সচল হয়ে উঠল মেয়েটা। পাক্কা প্রফেশনাল, মুখে গোঁজা রুমাল বের করবার চেষ্টা করল না, ওটাকে মেনে নিয়েই অ্যাকশনে গেল। দেয়ালের উপর তাকে চেপে ধরতে গেল কুয়াশা, কিন্তু বাউলি কেটে ওকে ফাঁকি দিল সে। শরীর বেঁকে গেল একটু, চাবুকের মত উঠে এল এক পা, মুখের একপাশে সজোরে আঘাত করল কুয়াশাকে। মাথা ঝনঝন করে উঠল, ছিটকে মাটিতে পড়ল কুয়াশা।

‘অ্যাই! থামো!’ গর্জে উঠল সিমকিন, কোটের ভিতর ঢুকিয়ে দিল হাত… পিস্তল বের করবার জন্য।

তাকে সে-সুযোগ দিল না মেয়েটা, দুই লাফে পৌঁছে গেল নাগালের মধ্যে। সোলার প্লেক্সাসে প্রচণ্ড এক গুঁতো খেয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল রাশান পুলিশ অফিসারের মুখ দিয়ে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। মাথার পাশে লাথি খেয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল পরক্ষণে। সিমকিনের উপর মরণ-আঘাত হানতে যাচ্ছিল মেয়েটা, কিন্তু পারল না… পিছন থেকে শক্তিশালী একজোড়া হাত জাপটে ধরে ফেলল তাকে, একটানে সরিয়ে আনল। আঘাত সামলে উঠে এসেছে কুয়াশা, আক্রমণ করেছে পিছন থেকে।

আলিঙ্গনের ভিতর মোচড়ামুচড়ি করল মেয়েটা, কিন্তু একচুল আলগা হলো না কুয়াশার হাতের বাঁধন। হিড় হিড় করে বন্দিনীকে টেনে নিয়ে গেল দেয়ালের কাছে। আচমকা কনুই চালাল মেয়েটা, পাঁজরের একপাশে আঘাত পেয়ে হুঁক্ করে উঠল ও, ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঢিল পড়ল দুই হাতে। নড়াচড়া করতে পেরে একটা পা উঁচু করল মেয়েটা, জুতোর তীক্ষ্ণ হিল নামিয়ে আনল কুয়াশার পায়ের পাতায়। তীব্র একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে মেয়েটাকে দেয়ালের উপর ছুঁড়ে ফেলল কুয়াশা, ইঁটের উপর নাক-মুখ-কপাল ঠুকে গেল তার। মুখে রুমাল গোঁজা, তাই শুধু গোঙানির আওয়াজ বেরুল!

প্রায় একই সময়ে আঘাত সামলে নিল দু’জনে। পরস্পরের মুখোমুখি হলো দুই ক্রুদ্ধ প্রতিপক্ষ। কুয়াশার মাথা লক্ষ্য করে আবারও লাথি চালাল মেয়েটা। তবে এবার ও তৈরি আছে, আলতোভাবে ডান হাত তুলে ঠেকাল আঘাত, অন্যহাতে সজোরে বসাল একটা লেফট হুক। ঘুসি খেয়ে একপাশে মুখ ঘুরে গেল মেয়েটার, ডান হাতের আরেক ঘুসিতে তাকে সিধে করল কুয়াশা। তারপর তলপেটের উপর লাখি বসিয়ে তৃতীয়বারের মত ছিটকে ফেলল দেয়ালের গায়ে।

দম ফুরিয়ে গেছে মেয়েটার, শরীরের পুরো ভর তার গায়ে চাপিয়ে দিল কুয়াশা, একটা হাত রাখল কণ্ঠার উপরে, চাপ দিল মৃদুভাবে। বাতাসের অভাবে খাবি খেতে শুরু করল বন্দিনী।

‘এবার আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবে তুমি,’ শীতল গলায় বলল কুয়াশা। আড়চোখে তাকাল সিমকিনের দিকে, ব্যথা সয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে সে। জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ঠিক আছ?’

মাথা ঝাঁকাল রাশান পুলিশ অফিসার।

‘গুড,’ বলল কুয়াশা। ‘পিস্তল বের করে কাভার দাও এই কুত্তিটাকে।’

শরীরের চাপ একটু কমাল কুয়াশা, আর তার সঙ্গে সঙ্গে একটা গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল পুরো গলি। ছিটকে পিছিয়ে এল’ ও, বিস্মিত হয়ে লক্ষ করুণ দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে গেছে মেয়েটার, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত, তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। শরীরের একপাশ ভিজে উঠেছে রক্তে। ঝট্ করে সিমকিনের দিকে তাকাল কুয়াশা!

‘আমি না!’ সভয়ে পিছিয়ে গেল রাশান পুলিশ অফিসার। ‘আমি না!!’ আবার বলল সে।

তাড়াতাড়ি মেয়েটার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল কুয়াশা, দ্রুত হাতে পরখ করল দেহটা। রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল—নাতালিয়ার ফ্ল্যাটের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। পিল ব্যবহার করতে পারেনি তো কী হয়েছে, কোটের আড়ালে লুকানো নিজের পিস্তলের ট্রিগার টিপে আত্মহত্যা করেছে ফেনিসের গুপ্তচর। পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় দেরি করেনি এক সেকেণ্ডও। পাঁজরের একপাশে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল এক গর্ত… পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্কে ফায়ার করবার ফলাফল। ধোঁয়া বেরুতে থাকা পিস্তলটা বের করে নিল কুয়াশা।

‘মাই গড!,ও মারা গেছে!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সিমকিন। ‘গুলির আওয়াজ… সবাই শুনতে পেয়েছে! আমাদেরকে সরে যেতে হবে, কুয়াশা!’

ওর কথার সত্যতা প্রমাণের জন্যই যেন গলির মুখে উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল কৌতূহলী পথচারীরা ।

‘শান্ত থাকো!’ ধমক দিয়ে উঠল কুয়াশা। ‘তোমার আই.ডি. কার্ড বের করো, ওটা দেখিয়ে ভাগাও ওদের। কাউকে ঢুকতে দিয়ো না গলিতে। দু’মিনিট চাই আমি।’

মেয়েটার পোশাকের সবগুলো পকেট হাতড়াল ও যা যা পেল, ঢোকাল নিজের পকেটে। এক ফাঁকে শার্টের বোতাম খুলে লাইটারের আলোয় দেখে নিল বুকের নীচটা। হ্যাঁ, আছে… ছোট একটা বৃত্তাকার উল্কি—ফেনিসের চিহ্ন।

‘জলদি করো!’ গলিমুখ থেকে চাপা গলায় তাড়া দিল সিমকিন

উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। সঙ্গীকে নিয়ে দ্রুতপায়ে ঢুকে পড়ল গলির আরও ভিতরে। আরেক পথে বেরিয়ে এল বড় রাস্তায়। সিমকিন কাঁপছে, মুখ থেকে সরে গেছে রক্ত। তার একটা হাত ধরে রাখল ও, যাতে নার্ভাসনেসের কারণে হঠাৎ দৌড় না দেয় লোকটা। ভাইবর্গের পুলিশ চিফকে এখনও মুক্তি দেবার সময় আসেনি। একটা মেসেজ পাঠাতে হবে রানার কাছে, সরকারি ইন্টারসেপশন এড়িয়ে এ-মুহূর্তে একমাত্র সিমকিনই পাঠাতে পারবে সেটা। কিন্তু হাতে বেশি সময় নেই, গলির ভিতরের গোলমাল শেভচেঙ্কো দেখতে পেয়েছেন কি না কে জানে! এমনিতেই নার্ভাস মানুষ, গোলমালের আভাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাবেন অফিসে। হয়তো বা খবর দেবেন পুলিশে। তার আগেই পৌছুতে হবে ভদ্রলোকের কাছে। আশপাশে চঞ্চল দৃষ্টি বোলাল কুয়াশা, সুস্থির হয়ে বসবার জন্য একটা জায়গা দরকার। রানার জন্য মেসেজ লিখতে হবে, ওটা আবার সাইফার -ও করতে হবে।

খুনে মেয়েটার লাথির প্রভাব এখনও যায়নি, মাথার এক পাশ টন টন করছে ওর। হাত তুলে আঘাতের জায়গাটা ছুঁলো। কপালের চামড়া কেটে গেছে ওখানটায়, রক্ত লেগে গেল গ্লাভে! কাটা জায়গাটা চেপে ধরল তাড়াতাড়ি। কপাল রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলে লোকের চোখে পড়বে।

তড়িঘড়ি করে হাঁটছে সিমকিন। ‘আস্তে হাঁটো,’ তাকে নিচু গলায় বলল কুয়াশা। ‘ওই যে একটা ক্যাফে; ওখানে কয়েক মিনিটের জন্য ঢুকব আমরা।

‘ভাল প্রস্তাব, আমার ড্রিঙ্ক দরকার,’ বলল সিমকিন। ‘মাই গড! আত্মহত্যা করল মেয়েটা… কে ছিল ও?’

‘এমন একজন, যে-একটা বড় ভুল করে ফেলেছিল। তুমি সেটা করতে যেয়ো না।’

ক্যাফেতে প্রচুর মানুষ। কপাল ভাল, এক কোণের একটা টেবিল খালি পেয়ে গেল। মুখোমুখি বসল কুয়াশা আর সিমকিন চারপাশটা দেখে নিল কুয়াশা।

ম্যানেজারের কাছে যাও,’ সিমনিকে বলল ও। ‘বলো যে, মাতাল হয়ে আছাড় খেয়েছে তোমার বন্ধু… কপাল কেটে গেছে। ব্যাণ্ডেজ আর অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে এসো।’ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল সিমকিন, সে-সুযোগ দিল না। ‘রিল্যাক্স, এ-সব জায়গায় মোটেই অস্বাভাবিক নয় ব্যাপারটা।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে উঠে পড়ল পুলিশ অফিসার।

পকেট হাতড়ে একটা বলপেন বের করল কুয়াশা। ‘সামনে থেকে একটা কাগজের ন্যাপকিন টেনে নিয়ে রানার জন্য মেসেজ লিখতে শুরু করল। সাবধানে একেকটা অক্ষর আর তার সাইফার বাছাই করছে। কয়েক দফা কাটাকাটি করতে হলো। একটু পরেই ফিরে এল সিমকিন। তার পিছু পিছু উদয় হলো ওয়েইট্রেস, একসঙ্গে তিনটে ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল রাশান অফিসার—দুটো নিজের, অন্যটা সঙ্গীর জন্য। কুয়াশা মাথা তুলল না, লিখে চলল আপনমনে।

আট মিনিট লাগল মেসেজ শেষ করতে। এরপর ন্যাপকিনটা ভাঁজ করে সিমকিনের হাতে তুলে দিল ও। ‘এটা কেইবল করে হেলসিঙ্কিতে পাঠাতে হবে তোমাকে হোটেলের নাম-ঠিকানা উপরে দেয়া আছে।’ তুলোয় অ্যান্টিসেপটিক পাউডার নিয়ে ক্ষতের উপর ঘষতে শুরু করল। ‘গোপন চ্যানেল ব্যবহার কোরো, আমি চাই না কেউ এটা ইণ্টারসেপ্ট করুক।’

ভুরু কোঁচকাল সিমকিন। ‘সেটা কীভাবে সম্ভব, বলতে পারো?’

‘ন্যাকামি কোরো না,’ শান্তস্বরে বলল কুয়াশা ‘নিশ্চয়ই ফিনিশ বন্ধুদের সঙ্গে নরমাল চ্যানেলে যোগাযোগ করো না তুমি?’

‘ওটার জন্য আলাদা শিডিউল আছে… যখন-তখন পাঠানো যায় না মেসেজ

‘সেক্ষেত্রে অন্য কোনও উপায় খুঁজে বের করো। আমি কোনও অজুহাত শুনতে চাই না। আজ রাতেই মেসেজটা চলে যাওয়া চাই।

মুখ গোমড়া করে ফেলল সিমকিন। ‘তা হলে কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে ছেড়ে দিতে হবে তোমাকে। টাকা-পয়সাও লাগবে বেশ কিছু, আমি তো কিছুই আনিনি।’

‘দুটোই পাচ্ছ তুমি…’ বলল কুয়াশা, ‘… আমার তরফ থেকে।’

বিস্ময় ফুটল সিমকিনের চেহারায়। ‘একাকী যেতে দেবে তুমি আমাকে? বিশ্বাস করবে?’

‘কেন নয়? বেঈমানী করলে আমার চেয়ে অনেক বেশি কিছু হারাবে তুমি। তাই না?’ অর্থপূর্ণ হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *