সেই কুয়াশা ২.৭

সাত

ডিনারের সময় হয়ে গেছে। সল্টিকভ-শেদিন লাইব্রেরির বৃহদায়তন রিডিং রুমগুলো এখন আর আগের মত কর্মব্যস্ত নয়। লম্বা লম্বা টেবিলগুলোয় বিক্ষিপ্তভাবে বসে আছে কিছু পাঠক; হাতে গোনা অল্প ক’জন ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে, মুগ্ধচোখে দেখছে প্রাচীন এই ভবনের ট্যাপেস্ট্রি আর অয়েল পেইন্টিংগুলো।

পশ্চিম উইঙের মার্বেলে গড়া হলওয়ের মাঝে ছড়িতে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল কুয়াশার। জ্ঞান আহরণের নেশায় কত দিন… কত বিনিদ্র প্রহর কাটিয়েছে ও এই লাইব্রেরিতে! বইয়ের ভিড়ে ঢুকলেই ভুলে যেত বাইরের জগতের কথা… ভুলে যেত সার্বক্ষণিক বিপদ আর ধরা পড়ার ভয়। ওই সময়টুকুর জন্য বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান আইভান শেভচেঙ্কো-ই ছিলেন ওর একমাত্র বন্ধু, সহমর্মী। কুয়াশার সত্যিকার পরিচয় জানার পর থেকে বদলে গেছে সে-সব। বন্ধুত্বের খাতিরে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেননি লোক, কিন্তু মানা করে দিয়েছেন এখানে পা রাখার ব্যাপারে। তাঁর এই ইচ্ছেকে সম্মান দেখিয়েছে কুয়াশা এতদিন, কিন্তু আজ আর তা সম্ভব হচ্ছে না। প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিনের খোঁজ পেতেই হবে ওকে… আর সে জন্য এই লাইব্রেরি এবং এর লাইব্রেরিয়ানের সহায়তা না নিয়ে উপায় নেই।

রাশার এ-অঞ্চলে সল্টিকভ-শেট্রিন লাইব্রেরির চেয়ে বড় কোনও লাইব্রেরি নেই। বিশাল এক জ্ঞানের আধার… সেইসঙ্গে দেশের সবচেয়ে বড় আর্কাইভগুলোর একটা রয়েছে এখানে। জারিস্ট, মানে রাজকীয় শাসনব্যবস্থার পতন ঘটেছে রাশায় বহুকাল আগে। নীল রক্তধারী পরিবারগুলো তার পরেও বেশ কিছুদিন ব্যবহার করেছে ডিউক, কাউন্ট, প্রিন্স এ-জাতীয় পদবী… তবে ধীরে ধীরে তাদেরকে বিতাড়িত কিংবা সাধারণ জনতার ভিড়ে মিশিয়ে ছেড়েছে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। রোষানল থেকে বাঁচার জন্য বেশিরভাগ অভিজাত পরিবারই নিজেদের নামধাম পাল্টে ফেলেছিল, তাই কুয়াশা’ নিশ্চিত—শুধু নাম দিয়ে প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিনের খোঁজ পাওয়া যাবে না আর। কী ঘটেছে এই বিশেষ মানুষটির এবং তার পরিবারের ভাগ্যে—তা জানা যেতে পারে শুধুমাত্র প্রাচীন এই লাইব্রেরির সার্কাইভ, বা লাইব্রেরিয়ানের বিশ্বকোষ-তুল্য মস্তিষ্ক থেকে।

করিডোরের বাঁক ঘুরে ঘোলা কাঁচের একটা দরজার সামনে পৌঁছুল কুয়াশা। আশপাশের সব কামরা অন্ধকার, শুধু এই একটাতেই ম্লান আলো জ্বলছে। ভিতরে কার যেন নড়াচড়ার আভাস। মি. শেভচেঙ্কোর অফিস এটা—গত পঁচিশ বছর ধরে এখানেই কাটছে তাঁর দিনরাতের একটা বড় অংশ। একটু ইতস্তত করল ও, তারপর মৃদু টোকা দিল দরজায়।

ওপাশ থেকে একটা ছায়া পড়ল, ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজা। শেভচেঙ্কোর মুখোমুখি হলো কুয়াশা। চশমার পিছনে ভদ্রলোকের দু’চোখে শঙ্কার মেঘ ঘনাল। বেশিক্ষণ হয়নি বাইরে থেকে ফিরেছেন, এখনও পরে আছেন ওভারকোটটা। ঠাণ্ডা বাতাসে কুঞ্চিত চামড়া এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

‘কুয়াশা!’

‘হ্যালো, মি. শেভচেঙ্কো। দুঃখিত, আপনাকে এতদিন পর আবার বিরক্ত করতে হলো।

‘কী চাও তুমি? কেন এসেছ এখানে?’

‘বাইরে দাঁড়িয়ে বলব? একটু ভিতরে আসি?’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরজা ছাড়লেন শেভচেঙ্কো। অফিসের ভিতরে ঢুকে চারপাশে তাকাল কুয়াশা। একদমই বদলায়নি জায়গাটা। দু’দিকের দেয়ালে শেলফ, মাঝখানে পুরনো এক ডেস্ক… উপরে স্তূপ হয়ে আছে নানা রকম কাগজপত্র আর বই। এক কোণে একটা বিশ-ইঞ্চি পর্দার টিভি-চলছে, তবে কমিয়ে রাখা হয়েছে ভলিউম। কামরার আরেক কোণে নিচু টেবিলের উপরে রয়েছে একটা বিদ্যুৎ-চালিত হট প্লেট, তার উপরে বসিয়ে রাখা হয়েছে চায়ের কেতলি। আগের কেতলিটাই কি না, ঠিক বোঝা গেল না।

দরজা ঠেলে দিয়ে উল্টো ঘুরলেন বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান। কুয়াশাকে অবাক করে দিয়ে আলিঙ্গন করে বসলেন ওকে। কঠিন… আন্তরিক আলিঙ্গন। একটু পর ওকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম স্যরি, মাই বয়। অনেক খারাপ কথা বলেছি তোমাকে, মানা করেছি আর কোনোদিন দেখা করতে… কিন্তু ওসবের একটাও আমার মনের কথা ছিল না।’

‘ভুলে যান, স্যর,’ হাসল কুয়াশা। ‘আমি কিছু মনে করিনি।’

‘না, বলতে দাও আমাকে। লোকে যা-ই বলুক,

আমি তো জানতাম তুমি আসলে কী। আর দশটা সাধারণ মানুষের মত ছিলে না তুমি, সেটাই তোমার অপরাধ… কিন্তু কী করব, পরিবারের কথা ভাবতে হয়েছে আমাকে। একা আমি নাহয় পুলিশি হাঙ্গামা সহ্য করলাম, আমার বউ-ছেলে-মেয়েরা কেন করবে?’

‘প্লিজ, স্যর,’ বৃদ্ধের কাঁধে হাত রাখল কুয়াশা, এসব নিয়ে আর কিচ্ছু বলার প্রয়োজন নেই আপনার। সবই বুঝেছি আমি। তা ছাড়া… আপনার ব্যবহারে দুঃখ পেয়ে দূরে সরে যাইনি আমি। সরে গেছি আপনার নিরাপত্তার কথা ভেবে। আমার কোনও অভিযোগ নেই, স্যর।’

মলিন হাসি ফুটল শেভচেঙ্কোর ঠোঁটে। কুয়াশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। কপালের কাটা জায়গাটা দেখে ভুরু কোঁচকালেন। ‘ব্যথা পেয়েছ কীভাবে?’

‘ও কিছু না, সামান্য অ্যাকসিডেন্ট।’

‘ওষুধ-টষুধ লাগবে কিছু?

‘নাহ্, মাথা নাড়ল কুয়াশা। তবে একটু চা পেলে মন্দ হয় না। কেতলির দিকে ইশারা করল। ‘আপনার চা লেনিনগ্রাদের সেরা।’

হেসে ফেললেন শেভচেঙ্কো। অস্বস্তিকর পরিবেশটা সহজ হয়ে এল তাতে। ‘বাড়িয়ে বলবার স্বভাব তোমার যায়নি দেখছি। বসো। চেয়ার টেনে বসল কুয়াশা। দু’কাপ চা নিয়ে এলেন বৃদ্ধ—একটা দিলেন ওকে, অন্যটায় চুমুক দিতে দিতে বসলেন মুখোমুখি।

‘কী বলতে এসেছ, সেটা শুনি এবার,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘আধঘণ্টা ধরে লেনিনগ্রাদের রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি, কিন্তু তুমি দেখা দাওনি। কারণ কী?’

‘দুঃখিত,’ বলল কুয়াশা, নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টটা দিতে হয়েছে আপনাকে। এখন আমরা নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারব।’

‘সমস্যায় পড়েছ?’

‘হুঁ, সমস্যাই বটে।’ চা খেতে খেতে বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানকে সংক্ষেপে ফেনিস সম্পর্কে খুলে বলল কুয়াশা। ব্যাখ্যা করল সংগঠনটার সূচনার সঙ্গে প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিনের কানেকশনের ব্যাপারটা।

‘তা হলে ভারাকিন পরিবারকে ট্র্যাক করতে চাও তুমি?’ ওর কথা শেষ হলে প্রশ্ন করলেন শেভচেঙ্কো।

মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। ‘আপনি সাহায্য করতে পারবেন আমাকে?’

‘দেখা যাক,’ চেয়ারে হেলান দিলেন বৃদ্ধ। ‘নামটা অপরিচিত নয় আমার কাছে। যদ্দূর মনে পড়ে… রাশান বিপ্লবের পর ওদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছিল নতুন সরকার। অবশ্য তার আগে থেকেই ধীরে ধীরে সব গ্রাস করে নিচ্ছিলেন রোমানভ আর তাদের ইণ্ডাস্ট্রিয়াল পার্টনাররা। নিকোলাস আর তার ভাই… মিখায়েল … একেবারেই পছন্দ করতেন না ভারাকিন পরিবারকে। প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছিলেন, ভারাকিন-রা নাকি গোটা উত্তর রাশার সবচেয়ে বড় ডাকাত। বলা বাহুল্য, তোমার ওই প্রিন্সকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চেয়েছিল বলশেভিক-রা। ভারাকিনদের একমাত্র ঢাল ছিলেন আলেকজান্দার কেরেনস্কি… মানে রাশান প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের দ্বিতীয় প্রাইম মিনিস্টার। অভিজাত পরিবারগুলোকে এক টানে মাটিতে নামাবার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। কিন্তু উইন্টার প্যালেসের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ওই ঢাল হারায় ভারাকিন পরিবার।’

‘প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?’

‘নথিপত্র তো বলে, ফাঁসি দেয়া হয়েছে তাকে। তবে নিশ্চিত হবার উপায় নেই। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগেই বিভিন্ন কায়দায় বহু লোক পালিয়ে গিয়েছিল… সঠিক কোনও তালিকা পাওয়া যাবে না তাদের। এদের অনেকে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গায় উদয় হয়েছে, কিন্তু আন্দ্রেই ভারাকিনকে দেখা যায়নি কোথাও।

‘হয়তো গেছে, কিন্তু টের পায়নি কেউ, ধারণা করল কুয়াশা।

‘উঁহু,’ মাথা দোলালেন শেভচেঙ্কো। প্রিন্স ভারাকিনের পক্ষে অতটা লো-প্রোফাইল মেইনটেন করা সম্ভব ছিল না।’

‘এ-কথা কেন বলছেন?’

‘ওদের রেপিউটেশনের কারণে। পুরো পরিবারই ছিল কুখ্যাত, কুয়াশা। প্রিন্সের বাপ-দাদা ছিল চায়নিজ আর আফ্রিকান স্লেভ ট্রেডার। ভারত মহাসাগর থেকে আমেরিকান দক্ষিণ উপকূল পর্যন্ত ছিল ওদের আধিপত্য। রাজকীয় ব্যাঙ্কগুলোকে ম্যানিপুলেট করত ওরা, ইচ্ছেমাফিক যে-কোনও মার্চেন্ট ফ্লিট বা কোম্পানিকে পথে বসাতে পারত। যা পছন্দ হতো, তা-ই দখল করে নিত। আমি শুনেছি, ওদেরকে রাজদরবার থেকে গোপনে বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন জার, কিন্তু পারেননি। প্রিন্সের বাবা জারের মুখের উপর কথাও শুনিয়ে দিয়ে এসেছিল… এমনই ছিল ওদের প্রভাব-প্রতিপত্তি। এসব অবশ্য বিপ্লবের বহু বছর আগের কথা।

‘আপনি বলছেন, গোপনে বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন… কারণ কী? জার যদি প্রকাশ্যেই কাজটা করতেন, অসুবিধে কী ছিল?’

‘সে-আমলে অভিজাত পরিবারের সঙ্গে রাজপ্রাসাদের কোনও ধরনের সংঘাতের খবর প্রকাশ করা হতো না। স্ক্যাল এড়ানোর একটা উপায় আর কী!‘

‘হুম। প্রিন্স ভারাকিনের কোনও ছেলে-মেয়ে ছিল?’

‘জানি না। তবে থাকারই কথা… বৈধ না হলেও অবৈধ তো বটেই। রক্ষিতার অভাব ছিল না তার।’

‘আর বাকি পরিবার? তাদের কী হয়েছে?’

‘ও-ব্যাপারেও নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারি না। তবে আমার ধারণা ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিপ্লব-পরবর্তী বিচারগুলোতে নারী এবং শিশুদের ব্যাপারে নমনীয় ছিল নতুন সরকার, তাদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ দিয়েছিল… কিন্তু কথাটা সব পরিবারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কিছু কিছু পরিবারের উপর প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল বিপ্লবীদের, তাদেরকে ঝাড়ে-বংশে শেষ করে দিয়েছে। ভারাকিন-রা তেমনই একটা পরিবার ছিল, তাই কাউকে বাঁচতে দেবার কথা নয় ওদের। তবে… আগেই বলেছি, আমি শিয়োর নই।

‘আমাকে শিয়োর হতে হবে।

‘বুঝতে পারছি। তবে এখন পর্যন্ত যা বলেছি, তাতে তো তোমার ওই ফেনিস কাউন্সিলের থিয়োরির সঙ্গে মতদ্বৈততা দেখা দিচ্ছে।’

‘কীভাবে?’

‘নিজেই ভেবে দেখো, প্রিন্স যদি পালাতে পারত, তা হলে গা-ঢাক নিয়ে তো কোনও লাভ হতো না তার। সে-আমলে পলাতকরা সংগঠিত হতে করেছিল, সত্যিকার পদবীধারীদেরকে দু’হাত বাড়িয়ে বরণ করে নিচ্ছিল বিদেশি বিভিন্ন ব্যাঙ্ক আর প্রতিষ্ঠান। পলাতক হলেও কানেকশন কম ছিল না ওদের, এ-কারণে ওদের মাধ্যমে নতুন নতুন ব্যবসা পাচ্ছিল ওসব প্রতিষ্ঠান। এমন প্রলোভন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মানুষ ছিল না প্রিন্স ভারাকিন। উঁহু, কুয়াশা, আমার মনে হয় মারাই গিয়েছিল সে।

বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল কুয়াশা, চেষ্টা করল তাঁর ধারণার মধ্যে খুঁত বের করতে। উঠে দাঁড়াল ও,

চায়ের কেতলি থেকে ভরে নিল নিজের কাপ, তারপর ফিরে এল নিজের চেয়ারে। চায়ে চুমুক দিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘একটা কারণে ও-কাজ করতে পারে ভারাকিন। যদি ও-সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বেশি টাকা দেয়া হয় তাকে… নিজেকে লুকিয়ে রাখার জন্য।

‘ফেনিস?’ জিজ্ঞেস করলেন শেভচেঙ্কো।

‘হ্যাঁ। রোম আর জেনোয়ায় ওদের কাজ শুরু করবার জন্য ফাণ্ড রেখে গিয়েছিলেন কাউন্ট বারেমি। নিঃসন্দেহে সেখান থেকে বড় অঙ্কের শেয়ার পেয়েছিল প্রিন্স।’

‘কিন্তু ও-টাকার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন, যুক্তি দেখালেন শেভচেঙ্কো। ‘যদ্দূর বুঝেছি তোমার কথা থেকে…. টাকাটা দেয়া হয়েছিল খুনি ভাড়া করবার জন্যে… গিলবার্তো বারেমির প্রতিহিংসার দীক্ষা ছড়িয়ে দেবার জন্যে। রাইট?’

‘পাহাড়ের ওই বৃদ্ধা মহিলা তো তা-ই বলেছেন আমাকে।’

‘তারমানে টাকাটা কারও হারানো সম্পদের ক্ষতিপূরণ, বা নতুন পুঁজির জন্য নয়। ইউ সি, এখানেই আমার খটকা লাগছে। যদি পালাতেই পারত, নতুন সুযোগগুলোর দিকে পিঠ ফেরাত না সে… অন্তত দুনিয়ায় অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নামা একটা গুপ্তসংঘের জন্য তো নয়ই! লোভী এবং বাস্তববাদী স্বভাবের মানুষ ছিল প্রিন্স ভারাকিন।’

ঠোঁটের কাছে কাপ তুলছিল কুয়াশা, থেমে গেল মাঝপথে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের দিকে। ‘কী বললেন আপনি?’

‘বলছি যে, লোভী এবং বাস্তববাদী স্বভাবের লোক ছিল….

‘না, না। তার আগে। টাকাটা কারও হারানো সম্পদের ক্ষতিপূরণ বা…‘

‘নতুন পুঁজির জন্য নয়,’ বাক্যটা শেষ করলেন শেভচেঙ্কো। ‘যে-টাকা ব্যবসায় খাটাতে পারবে না, তার জন্য বাইরের সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন প্রিন্স? ব্যাঙ্ক আর কোম্পানিগুলো অভিজাত রাশানদের প্রচুর টাকা সাধছিল!’

ডেস্কের উপর চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল কুয়াশা। দু’চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বলল, ‘জায়গামত তীর লাগিয়েছেন আপনি, স্যর। নতুন পুঁজি… দ্যাটস্ ইট! দীক্ষা কীভাবে ছড়ানো যায়? ভিখিরি আর উন্মাদ-রা ছড়ায় রাস্তাঘাটে, ধর্মযাজকরা ছড়ান উপাসনালয়ে… আর রাজনীতিকরা ছড়ায় ভাষণ-মঞ্চ থেকে। কিন্তু সন্ত্রাসের দীক্ষা, যা প্রচারে বাধার সম্মুখীন হতে হবে, তা ছড়াবেন কীভাবে? উত্তরটা খুব সহজ-আড়াল থেকে… সংগোপনে। অলরেডি বিদ্যমান আছে, এমন সব স্ট্রাকচারের সাহায্য নিয়ে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে সেটা—বিভিন্ন দেশে যার শাখা আছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হয় নির্দিষ্ট একটা কেন্দ্র থেকে। যথেষ্ট পরিমাণ টাকা খরচ করবেন আপনি, এ-ধরনের একটা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব কিনে নেবেন… ব্যস, ওটাকে ব্যবহারের উপায় পেয়ে গেলেন।

‘তারমানে তুমি বলতে চাইছ,’ বললেন শেভচেঙ্কো, ‘কাউন্ট বারেমি তার টাকাগুলো রেখে গিয়েছিল বড় বড় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনার জন্য?’

‘এগজ্যাক্টলি!’ মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। ‘ভুল জায়গাতে খোঁজ নিতে এসেছি আমি। প্রিন্স ভারাকিন পালিয়ে যায়নি… পালাবার প্রয়োজনই হয়নি তার। সম্ভবত বিপ্লব-টিপ্লবের বহু আগেই রাশা ছেড়ে চলে গেছে সে। এখানে এমনিতেই কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না তার, রোমানভ সরকার গ্রাস করে নিচ্ছিল তার সহায়-সম্পত্তি। কোনও উপায় ছিল না কাউন্ট বারেমির টাকাগুলো এখানকার কোনও ব্যবসায় খাটানোর। ভেবে দেখুন, এমন পরিস্থিতিতে রাশায় কেন থাকবে সে? বিপ্লব ঘটার আগেই তাই দেশত্যাগ করেছে… এ-কারণেই পলাতক অভিজাতদের মাঝে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার বহু আগেই নামধাম পাল্টে নতুন পরিচয় নিয়েছিল।’

‘তুমি ভুল করছ, কুয়াশা। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় প্রিন্স, ভারাকিনের নাম দেখেছি আমি।’

‘কিন্তু সত্যিই ফাঁসি হয়েছিল কি না, তা তো বলতে পারছেন না।’

‘এত লোকের মাঝে নির্দিষ্ট একজনকে খুঁজে পাওয়া…’

‘ওটাই আমার পয়েন্ট।

‘কিন্তু কেরেনস্কি-র প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের সঙ্গে তার যোগাযোগের রেকর্ড আছে। সেটা ব্যাখ্যা করবে কীভাবে?’

‘রেকর্ড জাল করা হয়েছে,’ দৃঢ় গলায় বলল কুয়াশা। প্রতিটা ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করছে, সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ও ‘আত্মগোপনের জন্য বিপ্লবের সময়টা চমৎকার একটা সুযোগ হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল প্রিন্স ভারাকিনের সামনে। বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতায় ডুবে গিয়েছিল গোটা রাশা… স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে অনেক সময় লেগেছে। সরকারি রেকর্ড ম্যানিপুলেট করা খুব সহজ হয়েছে তার জন্য

‘যতটা সহজ ভাবছ, ততটা মোটেই ছিল না, দ্বিমত পোষণ করলেন শেভচেঙ্কো। ‘হ্যাঁ, বিশৃঙ্খলা চলছিল রাশায়, কিন্তু তার ভিতরে একদল পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়েছিল দেশের আনাচে-কানাচে, নিরপেক্ষভাবে সমস্ত ঘটনার বিবরণ লেখার জন্য। বুদ্ধিজীবীরা জানতেন, ভবিষ্যতে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ওই বিশেষ সময়টা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক দেখা দেবে। তাই নেয়া হয়েছিল ওই পদক্ষেপ। পর্যবেক্ষক-রা সবকিছুর রেকর্ড রেখেছেন, কুয়াশা… ঘটনা বা তথ্য যতই অপ্রীতিকর হোক না কেন।’

‘তা হলে ওসব রেকর্ডে চোখ বোলাতে চাই আমি।’ বলল কুয়াশা। ‘লাইব্রেরির আর্কাইভে নিশ্চয়ই রাখা আছে ওগুলো?’

‘অনুরোধটা রাখতে পারলে খুশি হতাম,’ বিব্রত কণ্ঠে বললেন শেভচেঙ্কো। কিন্তু সমস্যা হলো, আর্কাইভ খোলার ক্ষমতা নেই আমার।’

‘কার আছে?’

‘অনুমতি আসে মস্কো থেকে-মিনিস্ট্রি অভ কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের মাধ্যমে। ওটা পাবার পর লেনিনগ্রাদ অফিস থেকে লোক পাঠানো হয় নীচতলার চাবি দিয়ে। এখানে আর্কাইভের কোনও চাবিই থাকে না।

‘যাকে পাঠানো হয়, তার সঙ্গে আর্কাইভের কোনও সম্পর্ক আছে? মানে… সে কি কোনও ধরনের স্কলার?’

‘উঁহুঁ। স্রেফ চাবিঅলা।’

‘শেষ কবে খোলা হয়েছে আর্কাইভ?’

‘উম্‌ম্‌… সম্ভবত মাসখানেক আগে। দানোভের এক হিস্টোরিয়ান এসেছিল রিসার্চের কাজে।’

‘কাজ করেছে কোথায়?’

‘নীচের আর্কাইভ রুমে। ওখান থেকে কোনও কিছু বের করা নিষেধ!’

হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। ধরে নিন, কিছু একটা বের করে নিয়েছিল সে। ওটা আবার ফেরতও পাওয়া গেছে। যত দ্রুত সম্ভব জিনিসটা আবার রেখে দেয়া দরকার আর্কাইভে। একটা ফোন করবেন নাকি কালচারাল অ্যাফেয়ার্স অফিসে?’

.

বিশ মিনিটের মাথায় এক যুবক হাজির হলো বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের অফিসে। হাতে ব্রিফকেস, ঠাণ্ডায় মুখ নীল হয়ে আছে। পকেট থেকে আই.ডি. কার্ড বের করে দেখাল; বলল, ‘আমি দিমিত্রি শেপিলভ, স্যর। কালচারাল অ্যাফেয়ার্স অফিস থেকে এসেছি। নাইট ডিউটি অফিসার বললেন, ব্যাপারটা নাকি জরুরি…..

কথা বলতে বলতে চেয়ারে বসা কুয়াশার উপর দিয়ে ঘুরে গেল তার দৃষ্টি।

‘জরুরি তো বটেই,’ বললেন শেভচেঙ্কো। ‘একই সঙ্গে অত্যন্ত সিরিয়াস। কিন্তু…’ একটু দ্বিধা করলেন তিনি, ‘…তোমাকে তো আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’

‘অফ-আওয়ারে ফোন করেছেন আপনি,’ কৈফিয়ত দিল যুবক। ‘সাধারণত যিনি চাবি নিয়ে আসেন, তাঁকে পাওয়া যায়নি।’

‘তুমি চাবি এনেছ তো?’

‘হ্যাঁ।’ ব্রিফকেস খুলে একটা লম্বা চাবি বের করল যুবক। বার বার তাকাচ্ছে কুয়াশার দিকে। ওর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটতে দেখে ইতস্তত করল। ‘কিছু মনে করবেন না, আপনার পরিচয় জানতে পারি?’

‘আমার ধারণা, তুমি আমাকে চেনো, হালকা গলায় বলল কুয়াশা। ‘আর কিছু না হোক… চেহারার বর্ণনা দেয়া হয়েছে তোমাকে।’

সময় যেন থমকে গেল হঠাৎ করে। স্থির হয়ে গেল যুবক। শীতল চোখে মাপতে শুরু করল ওকে। ধীরে ধীরে চেহারা বদলে যাচ্ছে।

একই সঙ্গে ঝাঁপ দিল ওরা।

এক লাফে চারফুট এগিয়ে এল যুবক। ফেলে দিয়েছে চাবি, ভোজবাজির মত হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা ধারালো ছুরি। কোমরের কাছ থেকে উপর দিকে, কুয়াশার বুক লক্ষ্য করে ছুটে এল ছুরি। লাফিয়ে চেয়ার থেকে শূন্যে উঠে গেছে কুয়াশা, একটু কাত হয়ে পিছনে হেলল, সেইসাথে ভাঁজ করে নিল ডান পা।

ছুরির ফলা নাগালের মধ্যে পেল না কুয়াশাকে! নেমে এল ও। বাম পা মেঝে স্পর্শ করবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড এক লাথি মারল যুবকের হাঁটুতে। ছুরিটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় এমনিতেই ভারসাম্য হারিয়েছিল সে, হাঁটুর উপর প্রচণ্ড সাইড কিক খেয়ে পা মচকে গেল, তার, হুড়মুড় করে পড়ে গেল ব্যালান্স হারিয়ে। কব্জির উপরে আরেকটা লাথি পড়তেই ছিটকে চলে গেল ছুরিটা নাগালের বাইরে।

তবে হার মানতে রাজি নয় যুবক। ক্রুদ্ধ গর্জন করে কুয়াশার দু’পা ধরে ফেলল সে, প্রচণ্ড এক ঝটকায় ওকে ভূপাতিত করল। মেঝেতে আছাড় খেয়ে দাঁতে দাঁত চাপল কুয়াশা, পরমুহূর্তে কনুই দিয়ে ওর বুকে আঘাত হানল যুবক। চোখে অন্ধকার দেখল কুয়াশা, দম নিতে পারছে না। ব্যথা সামলে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াতেই প্রমাদ গুনল। ছুরিটা আবার কুড়িয়ে নিয়েছে যুবক ভয়ঙ্কর বেগে ছুটে আসছে ওর পেটে গেঁথে দেবার জন্য।

চট্‌ করে সরে গেল ও প্রতিপক্ষের গতিপথ থেকে, যুবক ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে কষে একটা লাথি মারল। ছিটকে লাইব্রেরিয়ানের টিভির উপর মাথা দিয়ে পড়ল শত্রু।

সচল টিভির পিকচারটিউব বিস্ফোরিত হলো, ফলে পথ পেয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে গেল যুবকের মাথা। আগুনের ফুলকি মেঘের আকৃতি পেল। তারপর একরাশ কালো ধোঁয়ায় ভরে উঠল ঘর। লোকটার শরীর টান টান হয়ে উঠল, তারপর শুরু হলো অদম্য ঝাঁকুনি। কয়েক সেকেণ্ড পর নির্জীব, অসাড় হয়ে গেল সে। টেলিভিশন এখনও মাথার চারধারে ফিট করা, কার্পেটের উপর আছাড় খেল প্রকাণ্ড শরীরটা। তারপর আর নড়ল না।

প্রয়োজন নেই, তাও গিয়ে পালস চেক করল কুয়াশা। নাহ্, বেঁচে নেই যুবক।

‘শিট!’ নিজেকে গাল দিয়ে উঠল ও। ‘একটাকেও জ্যান্ত ধরতে পারছি না!’

ঘটনার আকস্মিকতায় বোকা বনে গেছেন বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান। তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কি…. ও কি….’

‘ফেনিসের লোক,’ বলল কুয়াশা। লাশের বুক উন্মুক্ত করে বৃত্তাকার উল্কিটা দেখাল তাঁকে।

চমক কাটছে না শেভচেঙ্কোর। আবার প্রশ্ন করলেন, ‘ত্… তুমি ব্… বুঝলে কী করে?’

‘নতুন লোক শুনেই সন্দেহ জাগল। তাই একটু খোঁচা দিলাম… ফলাফল তো নিজ চোখেই দেখতে পেলেন।’ উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। ‘মিনিস্ট্রি-র অফিসে ফোন করুন। বলে দিন যে, ডকুমেন্টগুলো আর্কাইভে সাজিয়ে রাখার জন্য সময় দরকার; তাই ওদের লোকের ফিরতে একটু দেরি হবে। নইলে পুলিশ-টুলিশে খবর দিয়ে বসতে পারে।

নিজেকে একটু সামলে নিলেন শেভচেঙ্কো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এখানে ফেনিসের লোক এল কীভাবে। অফিসটা তো একেবারেই গুরুত্বহীন!’

‘অফিস থেকে আসেনি এ-লোক,’ বলল কুয়াশা। ‘আপনার ফোন লাইন ট্যাপ করেছিল। চাবিঅলাকে সম্ভবত পথের মাঝখানে অ্যামবুশ করেছে, তারপর নিজে এসেছে এখানে। আমার জন্য ফাঁদ পাততে চেয়েছিল।

মাথা ঝাঁকালেন শেভচেঙ্কো। ডেস্ক থেকে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন মিনিস্ট্রি অভ কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের অফিসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *