সেই কুয়াশা ২.১৭

সতেরো

প্রফেসর স্যাণ্ডার্সের বাড়ি থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল রানা। বেরুনোর আগে ম্যাহোনি পরিবার সম্পর্কে আরও দু-চারটে প্রশ্ন করেছে, তারপর উঠে পড়েছে ধন্যবাদ জানিয়ে। ওর এই অকস্মাৎ প্রস্থানে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হয়তো অবাক হলেন, কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। যা জানা দরকার, তা জেনে গেছে… এরপর আর ওখানে সময় নষ্ট করবার মানে হয় না।

সাইডও অক ধরে দ্রুত হাঁটতে থাকল হাঁটতে থাকল ও—উত্তেজিত, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন নয়। বৃষ্টির ছাঁটে গা ভিজে যাচ্ছে, পরোয়া করছে না। পেয়েছে… অবশেষে ফেনিসের মূল ব্যক্তিটির খোঁজ পেয়েছে ও! এখন শুধু ভেবে বের করতে হবে, কীভাবে তাকে ঘায়েল করা যায়।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার, সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনিকে আতঙ্কগ্রস্ত করবার মত অস্ত্র পেয়ে গেছে রানা। কিচ্ছু না, শুধু ওয়াশিংটনে ভদ্রলোকের কাছে একটা ফোন করতে হবে ওকে-বর্ণনা করতে হবে পঁচাত্তর বছর আগেকার একটা মিটিঙের বিবরণ। ঊনিশশো ছত্রিশের চৌঠা এপ্রিলের সেই মিটিং, বারেমি ভিলায় যেটাতে অংশ নিয়েছিল তার পিতামহ। কী বলবে তখন সিনেটর। অস্বীকার করতে পারবে, এত বছর ধরে একটা গুপ্তসংঘের সঙ্গে নিজের পরিবারের সংশ্লিষ্টতার কথা? এ তো বোঝাই যাচ্ছে, রাখাল বালকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছে সে-কারণ লোকটাকে ওরাই আজকের অবস্থানে পৌঁছতে সাহায্য করেছে।

খানিক ভেবেচিন্তে সরাসরি এগোনোর চিন্তা বাতিল করে দিল রানা। এখন পর্যন্ত এ-কৌশলে কোনও কাজ হয়নি। তা ছাড়া ডেভিড ম্যাহোনি ফেনিসের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চলেছে সে, তাকে রক্ষার জন্য হাজারটা পন্থা অবলম্বন করবে ওরা। রানার হাতে কোনও প্রমাণ নেই তার বিরুদ্ধে। জনসমক্ষে তার মুখোশ খুলতে চাইলে নিরেট তথ্য-প্রমাণ চাই।

তারমানে আরও গভীরে যেতে হবে ওকে

বাইরে যা দেখা যাচ্ছে, তা ডেভিড ম্যাহোনির আসল চরিত্র নয়। সময় নিয়ে… অত্যন্ত সুকৌশলে তাকে জনগণের সামনে পছন্দনীয় করে তোলা হয়েছে। উপসাগরীয় যুদ্ধের ওসব বীরত্ব কি তা হলে শুধুই কাহিনি? হাসপাতালের সামনে শত শত মানুষ জড়ো করা হয়েছিল কি টাকার বিনিময়ে? একেবারে অবাস্তব নয় চিন্তাটা। কাউকে জনপ্রিয় করে তুলবার জন্য এ-ধরনের নাটক অতীতে বহুবার করা হয়েছে। দক্ষ পরিচালকের হাতে সেই নাটক চরম সাফল্য অর্জন করতে পারে।

এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আসলে বীর নয় ম্যাহোনি, স্রেফ একটা পুতুল। তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষের পদে বসিয়ে নিজেদের অশুভ উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে জিয়োভানি গুইদেরোনি ও তার গুপ্তসংঘ। তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিতে চাইলে ম্যাহোনির নাগাল পেতে হবে কিন্তু কীভাবে?

চলে আসবার আগে প্রফেসর স্যান্ডার্সের কাছ থেকে সিনেটরের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে এসেছে রানা। কনকর্ডে তাঁর সরকারি আবাস, কিন্তু সেখানে শুধু গ্রীষ্মের সময়টা কাটান তিনি ও তাঁর পরিবার। পিতা ডেভিড ম্যাহোনি জুনিয়র মারা গেছেন বেশ ক’বছর আগে। এরপর তাঁর বিধবা মায়ের কাছ থেকে চড়া দামে ম্যাহোনি হল কিনে নিয়েছেন জিয়োভান্নি গুইদেরোনি; ম্যাহোনি পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখিয়ে কথা দিয়েছেন, ভবনের নাম বদলানো হবে না। বৃদ্ধা মিসেস ম্যাহোনি এখন বিকন হিলে থাকেন—লুইসবার্গ স্কয়্যারের পুরনো একটা ব্রাউনস্টোন বিল্ডিং ওটা। বয়স সত্তরের উপরে, নিভৃতচারী।

কিছু কি জানা যাবে ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে? পরিবারের মহিলারা সাধারণত গোপন তথ্যের বিশাল উৎস… এমন সব ব্যাপার জানা থাকে তাঁদের, যা ঘনিষ্ঠ পুরুষ আত্মীয়রাও বলতে পারে না। কথা বলা যায় না মিসেস ম্যাহোনির সঙ্গে? বাড়িটায় পাহারা থাকতে পারে, তবে রানা নিশ্চিত-সে-পাহারা খুব কড়া হবে না। নানা দিক চিন্তা করে তার সঙ্গে দেখা করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা। রিটজ কার্লটনে ওঠার আগে সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনির ব্যাপারে সবকিছু জেনে নিতে হবে ওকে।

.

চেস্টনাট স্ট্রিট থেকে লুইসবার্গ স্কয়্যারে যাবার ঢালু রাস্তাটা একেবারে নির্জন। মনে হয় যেন কোলাহলমুখর দুনিয়া থেকে আলাদা কোনও জগতে যাবার পথ ওটা। উজ্জ্বল নিয়ন-আলোর স্থান নেই ওখানে, তার বদলে মিটমিট করে জ্বলছে পুরনো আমলের গ্যাসবাতি। কবলস্টোনে গড়া রাস্তা আর চতুর একেবারে ধুলোবালি-হীন : স্কয়্যারে পৌছুনোর পর ছায়ার আড়ালে চলে গেল রানা। একটা বিনকিউলার কিনে এনেছে, ওটা চোখে লাগিয়ে তাকাল রাস্তার ধারে পার্ক করা গাড়ির সারির দিকে। নজরদারির জন্য ওসব গাড়ি আদর্শ, ভিতরে বসে অনায়াসেই কয়েক ঘণ্টা চোখ রাখা যায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে।

কিন্তু না, কেউ নেই কোনও গাড়িতে।

বিনকিউলার কোটের ভিতরে লুকিয়ে ফেলল রানা, হাঁটতে শুরু করল।  ব্রাউনস্টোনে গড়া মিসেস ম্যাহোনির বাড়ির দিকে। আশপাশের ইমারতগুলোর চেয়ে ব্যতিক্রম ওটা—নির্মাণশৈলী রাজকীয় ধাঁচের। চারপাশে রয়েছে খোলা জায়গা আর ফুলের বাগান। রাত নামায় তাপমাত্রা কমে গেছে, ঠাণ্ডা বাতাসে বার বার কেঁপে উঠছে বাড়ির বাইরে লাগানো গ্যাসবাতির শিখা।

নুড়িপাথরের ওয়াকওয়ে ধরে লন পেরুল রানা, সিঁড়ি ধরে উঠে এল ফ্রন্ট পোর্চে। দরজায় দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাল। বাড়ির ভিতরে শোনা গেল জলতরঙ্গের আবছা আওয়াজ, একটু পর ওপাশে প্রকট হয়ে উঠল পদশব্দ। একটু অস্বস্তি বোধ করল রানা, পোচটা বড্ড আলোকিত। ছায়া থাকলে ভাল হতো, ওর চেহারা দেখা যেত না। আশঙ্কাটা যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণিত হলো কয়েক সেকেণ্ড পরেই।

ছিটকিনি নামানোর শব্দ পেল রানা, তারপর খুলে গেল দরজা। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে উদয় হয়েছে চৌকাঠের ওপাশে, পরনে নার্সের ইউনিফর্ম : ওকে দেখেই চমকে উঠল চকিতের জন্য, পরমুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে। কিন্তু যা বোঝার বুঝে গেছে রানা—ওকে চিনে ফেলেছে মেয়েটা।

‘ইয়েস?’ গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে প্রশ্ন করল নার্স

‘মিসেস ম্যাহোনি আছেন?’

দুঃখিত, শুয়ে পড়েছেন উনি।’

দরজা বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করল নার্স, কিন্তু পারল না। রানা এক পা ঢুকিয়ে দিয়েছে চৌকাঠের মাঝখানে কঁধ দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিল পাল্লায়, মেয়েটা পিছন দিকে ছিটকে যেতেই ঢুকে পড়ল বাড়ির ভিতরে।

তুমি ধরা পড়ে গেছ, ডিয়ার!’ বলল রানা।

হিংস্রতা ফুটল নার্সের সাদাসিধে চেহারায়, দ্রুত হাত ঢোকাতে চেষ্টা করল ইউনিফর্মের পকেটে, কিন্তু রানা বাধা দেয়ায় ব্যর্থ হলো। খপ্ করে একহাতে মেয়েটার কবজি চেপে ধরল ও, আরেক হাতে ধরল গলা। এক ঝটকায় তাকে মেঝে থেকে শূন্যে তুলল, তারপর আছড়ে ফেলল মেঝেতে।

ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল নার্স, তবে সেই চিৎকার হলো ক্ষণস্থায়ী। গায়ের উপর চড়ে বসেছে রানা, গলায় চাপ বাড়তেই চোখ উল্টে ফেলল, বাতাসের অভাবে ছটফট করতে লাগল রানার দেহের তলায়। নিষ্ঠুরের মত গলাটা ধরে রাখল রানা, চাইলে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলতে পারবে, তবে অতদূর যাবার ইচ্ছে নেই ওর। মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেলে হাত সরাল, দেখে নিল পালস্, তারপর সরে এল দেহের উপর থেকে।

সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশে তাকাল রানা, বাড়িতে আরও লোক থাকতে পারে। মেয়েটার চিৎকারে ছুটে আসে কি না, সেটাই দেখার বিষয়। তবে কয়েক সেকেণ্ড পেরিয়ে যাবার পরও কিছু ঘটল না। না শোনা গেল উত্তেজিত কণ্ঠ, না শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। স্বস্তির শ্বাস ফেলল ও, মনোযোগ দিল নার্সের দিকে। শরীরতল্লাশি করে পকেটের ভিতর থেকে একটা রিভলভার বেরুল। ওটাই বের করে আনার চেষ্টা করছিল সে।

মিসেস ম্যাহোনির কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পুরো বাড়িতে থম থম করছে নিস্তব্ধতা। নার্সের কথাই কি তবে ঠিক? সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি? খোঁজ নেবে রানা, তবে তার আগে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়া প্রয়োজন।

মেয়েটার ইউনিফর্মের বোতাম খুলে ফেলল ও, অনাবৃত করল ঊর্ধ্বাঙ্গ। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে দেখল বুকটা। দুই স্তনের মাঝখানে, ব্রেসিয়ারের ঠিক নীচে জ্বলজ্বল করছে একটা বৃত্তাকার উল্কি- ফেনিসের চিহ্ন।

হঠাৎ… উপর থেকে একটা মোটরের গুঞ্জন ভেসে এল। লাফ দিয়ে অজ্ঞান নার্সের কাছ থেকে সরে গেল রানা, সিঁড়ির ছায়ায় লুকিয়ে পিস্তল তাক করল ওদিকে। একটু পরেই মাঝখানের ল্যাণ্ডিং পেরিয়ে উদয় হলেন এক বৃদ্ধা। সাদা রঙের চেয়ার-লিফটে বসে আছেন, দেয়ালের সঙ্গে বসানো গার্ড-রেইল বেয়ে নেমে আসছে ওটা। পরনে উঁচু কলারঅলা গাউন। বলিরেখায় জর্জরিত মুখ। যখন কথা বললেন, শোনা গেল খনখনে গলা।

‘যদি ডাকাতি করতে এসে থাকো, বলার কিছু নেই। তবে উদ্দেশ্য যদি সেক্সুয়াল হয়ে থাকে, তা হলে তোমার বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি, ইয়াং ম্যান।’

মাতাল হয়ে আছেন মিসেস ম্যাহোনি। হাবভাবে মনে হলো, বহু বছর থেকেই এমন মাতাল তিনি।

ছায়া থেকে বেরিয়ে এল রানা। বলল, ‘আমার একমাত্র উদ্দেশ্য-আপনার সঙ্গে দেখা করা, ম্যা’ম। এই মেয়েটা আমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, তাই আত্মরক্ষা করতে বাধ্য হয়েছি। ওর শরীরে লুকানো অস্ত্র আছে কি না, তা-ই চেক করে দেখছিলাম। আসলে আমি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, চাইলে আমার আই.ডি. দেখাতে পারি আপনাকে।’

হাত নাড়লেন মিসেস ম্যাহোনি। ‘দরকার নেই। তুমি কে, তাতে কিছু আসে যায় না।’ চেয়ার-লিফট পৌঁছে গেছে গ্রাউণ্ড ফ্লোরে। নেমে পড়লেন। দুর্বল পয়ে হাটতে হাটতে বললেন, ‘কাজ শেষ করো, লিভিংরুমে পাবে আমাকে।’

নার্সের ইউনিফর্মের বোতাম লাগিয়ে দিল রানা, তারপর অজ্ঞান দেহটা কাঁধে তুলে নিয়ে গেল সিঁড়ির তলার স্টোররুমে। ভিতরে ঢুকে মেয়েটার হাত-পা বাঁধল স্টোররুমে পাওয়া দড়ি দিয়ে। মুখে গুঁজে দিল রুমাল। ওকে ওখানেই ফেলে রেখে বেরিয়ে আটকে দিল দরজা। তারপর পা বাড়াল মিসেস ম্যাহোনির সঙ্গে দেখা করতে।

লিভিংরুমের ভিতরটা যেন মদ্যশালা। দুদিকের দেয়াল ঢাকা পড়ে আছে হাজারো তাক-অলা শেলফ আর করুকাজে ভরা কাঠের কাউন্টারে, সবখানে শোভা পাচ্ছে হরেক প্রকার মদের বোতল। যে-কোনও অ্যালকোহলিকের স্বর্গরাজ্য। পিঠ-উঁচু একটা সোফায় বসেছেন মিসেস ম্যাহোনি, হাতে মদের গ্লাস। নাগালের মধ্যে আছে অন্তত আরও চারটে বোতল।

‘বি মাই গেস্ট।’ রানা ভিতরে ঢুকতেই নিজের সংগ্রহের দিকে ইশারা করলেন বৃদ্ধা

‘না, ধন্যবাদ।’ ড্রিঙ্ক নিল না রারা। এগিয়ে গেল মিসেস ম্যাহোনির দিকে। জ্ঞান ফিরলে একটা কে পাবে আপনার নার্স- অযথা যার-তার দিকে যেন অস্ত্র তাক না করে। খুব অদ্ভুত কায়দায় আপনার সেবা করছে ও মিসেস ম্যাহোনি।’

‘অদ্ভুত তো বটেই,’ স্বীকার করলেন বৃদ্ধা। ‘কিন্তু যেহেতু ব্যর্থ হয়েছে ও, দয়া করে জানতে পারি, কে তুমি? কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?’

‘বসে বলি?’

‘প্লিজ!’

একটা চেয়ার টেনে বৃদ্ধার মুখোমুখি বসল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা-রানা ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির ডিরেক্টর। ভুয়া পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন মনে করছে না। নার্সের মাধ্যমে ওর সত্যিকার পরিচয় এমনিতেই ফাঁস হতে চলেছে। ‘কিছুদিন আগে একটা কেস নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধের সঙ্গে আপনার ছেলের সম্পৃক্ততার কথা জানতে পেরেছি…’

‘তাই নাকি?’ হেসে উঠলেন মিসেস ম্যাহোনি। ‘ভারি মজার ব্যাপার তো!’

‘দুঃখিত, ম্যা’ম। ব্যাপারটা হালকা চোখে দেখবার অবকাশ নেই।’

‘ভণিতা না করে আসল কথা বলো, ইয়াং ম্যান।’

ফেনিসের নাম উচ্চারণ করল না রানা, তবে ওদের মতই একটা সংগঠনের কথা বলল মিসেস ম্যাহোনিকে। সারাক্ষণ যাচাই করল তাঁর প্রতিক্রিয়া। কিন্তু এমন কিছু দেখল না, যাতে মনে হতে পারে- ফেনিস সম্পর্কে তিনি সচেতন। শেষে যোগ করল, ইয়োরোপ থেকে পাকা খবর পেয়েছি আমরা, মিসেস ম্যাহোনি। ওটা জনসমক্ষে প্রচার করবার আগে সত্য-মিথ্যা পরখ করে নিতে চাই। বুঝতেই পারছেন, এ-খবর ফাঁস হলে সিনেটর ম্যাহোনির অনেক ক্ষতি হবে।’

তাচ্ছিল্যের একটা হাসি ফুটল বৃদ্ধার ঠোঁটে। ‘বোকার স্বর্গে বাস করছ তুমি, ইয়ং মান কিছুই সিনেটরকে স্পর্শ করতে পারবে না। সামনের নির্বাচনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চলেছে ও, এটা জানো না? সবাই বলছে এ-কথা… সবাই তা চায়ও।’

‘কিন্তু এ-ধরনের একটা স্ক্যাণ্ডাল সে-সম্ভাবনা ভেস্তে দিতে পারে,’ জোর দিয়ে বলল রানা। প্লিজ, ম্যাম, আমাকে জানতে হবে—রাজনীতিতে নামার আগে আপনার ছেলে পারিবারিক ব্যবসায় কতখানি সক্রিয় ছিলেন? আপনার স্বামীর সঙ্গে কখনও কি তিনি ইয়োরোপে যেতেন? বস্টনে তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কারা ছিল? ম্যাহোনি হলে কারা দেখা করতে আসত তাঁর সঙ্গে?’

‘ম্যাহোনি হল?’ যেন স্মৃতির সাগরে ভেসে গেলেন বৃদ্ধা। ‘বস্টনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা ছিল ওটা… জানালা দিয়ে দেখা যেত পুরো শহরটাকে। আমার শ্বশুর তৈরি করেছিলেন বাড়িটা, প্রায় একশো বছর আগে। আহা, কী চমৎকার ছিল সেসব দিন…’

‘মিসেস ম্যাহোনি,’ ভদ্রমহিলাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল রানা, ‘আপনার ছেলে যখন গালফ ওঅর থেকে ফিরল…’

‘ওই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করি না আমরা!’ রূঢ় গলায় ওকে থামিয়ে দিলেন বৃদ্ধা। চেহারায় মেঘ জমেছে। আলোচনা করা বারণ।’

‘কেন?’

জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন বৃদ্ধা। সত্যি করে বলো তো, ওই নার্স তোমাকে আক্রমণ করেছিল কেন? কী বলেছিলে ওকে তুমি?’

‘তেমন কিছুই না। এটুকুই যে, আপনার খোঁজ নিতে সিনেটর ম্যাহোনি পাঠিয়েছেন আমাকে।’

হেসে উঠলেন মিসেস ম্যাহোনি। ‘আগে বলবে তো! তোমাকে ঠেকাবার চেষ্টা তো করবেই মেয়েটা।’

‘এসবের জন্য? চারপাশে শোভা পেতে থাকা মদের সংগ্রহ দেখাল রানা। ‘আপনাকে মাতাল অবস্থায় দেখতে দিতে চাইছিল না? ভাবছিল ওতে সিনেটর অসন্তুষ্ট হবেন?’

‘বোকার মত কথা বোলো না। ও বুঝতে পেরেছিল, ‘তুমি মিথ্যে কথা বলছ।‘

‘মিথ্যে?’

‘অবশ্যই! সিনেটর আমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎই করে না… খোঁজখবর নেয়া তো অনেক পরের কথা। আজ পর্যন্ত একবারও এ-বাড়িতে পা রাখেনি সে। শেষবার একান্তে আমাদের দেখা হয়েছে আট বছর আগে… আমার স্বামীর শেষকৃত্যে। এখন মা-ছেলে একত্রে দেখা দিই শুধু মিডিয়ার সামনে… ছবি তোলার জন্য। কথা বলি না কেউ কারও সঙ্গে। তা ছাড়া, ওসব অনুষ্ঠানে যাবার আগে ডাক্তারের কাছে পাঠানো হয় আমাকে; ওষুধ খাইয়ে স্বাভাবিক বানানো হয় আফটার অল, লোকের সামনে হবু প্রেসিডেন্টের মা মাতলামি করলে চলবে কেমন করে?’

‘আপনাদের সম্পর্কের এমন অবনতি হয়েছে কীভাবে, জানতে পারি?’

‘উঁহু, ওসব আমি বলতে পারব না। তবে তুমি যে-ফালতু অভিযোগের তদন্ত করতে এসেছ, তার সঙ্গে ওসবের সম্পর্ক নেই।’

‘যুদ্ধের ব্যাপারে আলোচনা বারণ বললেন কেন?’

‘খোঁচাখুঁচি বন্ধ করো, বাছা। আগুন নিয়ে খেলছ তুমি!’ সাবধান করলেন মিসেস ম্যাহোনি। কাঁপছেন তিনি, হাত থেকে পড়ে গেল গ্লাস। ঝুঁকে ওটা তুলে নিল রানা।

‘খারাপ লাগছে আপনার?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘ন… না। কিছু মনে না করলে আমাকে আরেকটা ড্রিঙ্ক এনে দেবে?

‘নিশ্চয়ই।’

বারের কাছে গিয়ে নতুন একটা গ্লাস নিল রানা। তাতে ব্র্যাণ্ডি নিয়ে ফিরে এল বৃদ্ধার কাছে। তাঁর হাতে তুলে দিল।

‘আমাকে জানতে হবে, ম্যাম,’ বলল রানা। যুদ্ধ নিয়ে কেন কথা বলতে চান না আপনি?’

‘বাজে একটা বিষয়, এটাই কি কারণ হিসেবে যথেষ্ট নয়?’

‘উঁহুঁ। আমি নিজেও বহু যুদ্ধে অংশ নিয়েছি, অভিজ্ঞতার অভাব নেই। যুদ্ধ-টুদ্ধ নিয়ে আলাপ করার জন্য আমার চেয়ে উপযুক্ত মানুষ আপনি আর পাবেন না।

‘তা-ই? যুদ্ধে শুধু প্রাণ যায় না মানুষের, বেঁচে থেকেও সত্তা হারায় তারা—তোমার বেলাতে ঘটেছে এমন কিছু?

‘কীসের কথা বলছেন?’

‘পরিবর্তন, ইয়াং ম্যান। যুদ্ধ মানুষকে বদলে দেয়! তুমি বদলাওনি?’

‘হ্যাঁ, বদলেছি,‘ স্বীকার করল রানা। ‘আপনার ছেলের বেলাতেও কি তেমন কিছু ঘটেছে?’

মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ম্যাহোনি। ‘ডাক্তাররা বলেছিল, যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পাল্টে দিয়েছে আমার ছেলেকে। আমূল বদলে গেছে ও…’

‘কী ধরনের পরিবর্তন?’

‘না… ওসব নিয়ে কথা বলা বারণ। আমি বলতে পারব না!’

‘প্লিজ, মিসেস ম্যাহোনি!’ অনুরোধ করল রানা। ‘বলুন মাকে। জানতে চাই আমি। হয়তো সাহায্য করতে পারব সিনেটরকে।‘

মলিন হাসি ফুটল বৃদ্ধার ঠোঁটে কীভাবে সাহায্য করবে? কোনও আশাই তো নেই। ভিতরটা বদলে গেছে ওর… এতটা বেশি, তা এখন আর ঠিক করার উপায় নেই। বাইরে থেকে যা দেখে লোকে, তা শুধুই এক মুখোশ। কিন্তু এমন ছিল না ও! কত্তো ভাল একটা ছেলে ছিল আমার ডেভিড… বুক ভরা ভালবাসা ছিল ওর, ছিল সবার জন্য দরদ। অথচ যুদ্ধে গিয়ে সব হারিয়ে গেল।’ চোখ থেকে অশ্রু নেমে এল তাঁর। মা হয়েও কিছুই করার ছিল না আমার…’

‘কেন? কী করেছিলেন তিনি?’

‘জানি না, বুঝতে পারিনি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে একেবারে অন্য মানুষে পরিণত হলো ও। শীতল, প্রাণহীন। ভালবাসা বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিল না ওর মাঝে। আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেল কোনও কারণ ছাড়া। বেঁচে থাকার পরও একমাত্র সন্তানকে হারালাম আমি। হতাশায় মদ খেতে শুরু করলাম…’ ফুঁপিয়ে উঠলেন মিসেস ম্যাহোনি।

এগিয়ে গিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রাখল রানা। নীরবে সান্ত্বনা দিল।

ভেজা চোখে ওর দিকে তাকালেন বৃদ্ধা। ‘থ্যাঙ্ক ইউ, ইয়াং ম্যান।‘

মাথা ঝোঁকাল রানা।

নিজেকে একটু সামলে নিলেন মিসেস ম্যাহোনি। গাউনের হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন। তারপর বললেন, ‘হয়তো অবাক হবে, কিন্তু এখনও আশা ছাড়িনি আমি। আজও বাড়ির একটা কামরা ওর জন্য আলাদা করে রেখেছি। সাজিয়ে রেখেছি ওর-ই জিনিসপত্র দিয়ে—ঠিক যেভাবে বহু বছর আগে ঘর ছাড়ার সময় রেখে গিয়েছিল ও।‘

হাঁটু গেড়ে তাঁর সামনে বসল রানা। ‘মিসেস ম্যাহোনি, ওই কামরাটা আমি দেখতে পারি? প্লিজ?’

উচিত হবে না, দ্বিধা করলেন বৃদ্ধা। ‘আমার ছেলের কামরা… ওর অনুমতি ছাড়া কীভাবে কাউকে ঢুকতে দিই? ওই কামরাই তো ডেভিডের একমাত্র স্মৃতি… আমার লক্ষ্মী, মিষ্টি ডেভিডের!’

‘আমি কোনও অসম্মান করব না তার স্মৃতির,’ নরম গলায় বলল রানা। ‘একবার… শুধু একবার দেখব কামরাটা। মনের ভিতর এমন তাগিদ অনুভব করছে কেন, তা ও নিজেও জানে না।

কয়েক মুহূর্ত ওর চোখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মিসেস ম্যাহোনি! তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমাকে কেন যেন খুব আপন মনে হচ্ছে, বাছা। ডেভিডের ছায়া দেখতে পাচ্ছি তোমার মাঝে। ঠিক আছে, চলো। আমাকে আমার চেয়ার-লিফট পর্যন্ত পৌঁছে দাও। কামরাটা ওপরতলায়।’

কয়েক মিনিট পরেই দোতলার করিডোর ধরে এগোল দু’জনে। বাড়ির শেষ মাথায়, বন্ধ একটা দরজার সামনে থামলেন বৃদ্ধা হাতল ঘোরাবার আগে বললেন, ‘কিছুতে হাত দিয়ো না। আমার ছেলে খুব গোছালো স্বভাবের। এলোমেলো জিনিস পছন্দ করে না।’

‘কথা দিলাম,’ মুখে হাসি এনে বলল রানা।

দরজা খুলে কামরায় ঢুকল দু’জনে। অল্পবয়েসী তরুণের রুম যেমন হয়, ভিতরটা তেমনি। বিছানার পাশে রয়েছে পড়ার টেবিল, পুরনো আমলের নানা রকম পোস্টার ঝুলছে দেয়ালে। শেলফে শোভা পাচ্ছে নানা ধরনের খেলাধুলার পদক আর ট্রফি। টেবিলের উপর রয়েছে একটা মাইক্রোস্কোপ আর কেমিস্ট্রি সেট! এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার একটা ভলিউমও খোলা অবস্থায় পড়ে আছে ওখানে। খোলা পাতায় আণ্ডারলাইন করা, মার্জিনে ছোট ছোট নোট। বেডসাইড টেবিলে কয়েকটা গল্পের বই আর ম্যাগাজিন। খাটের তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে জুতো, স্যাণ্ডেল আর স্পোর্টস্ শু-র সারি। আলনায় ঝুলছে রঙচঙা শার্ট-প্যান্ট, জিন্স আর জ্যাকেট।

অশুভ একটা অনুভূতি হলো রানার। এ-কামরার মালিক একজন জীবিত মানুষ, তাও সবকিছু সংরক্ষণ করা হয়েছে মৃতের প্রতি সম্মান জানানোর রীতিতে : অদ্ভুত ব্যাপার! পাশ ফিরে মিসেস ম্যাহোনির দিকে তাকাল— দেয়ালে ঝোলানো কতগুলো ফটোগ্রাফের উপর সেঁটে আছে তাঁর দৃষ্টি। ও-ও মনোযোগ দিল ওদিকে।

ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ডের অল্পবয়েসের ছবি ওগুলো-একাকী, কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে তুলেছেন। মাঝখানের ছবিটা তোলা হয়েছে একটা সেইলবোটের ডেকে, পিছনের ব্যানার বলছে: মার্কেলহেড সেইলিং চ্যাম্পিয়নশিপ, ১৯৮৫। মোট চারজনকে দেখা যাচ্ছে ছবিতে – ম্যাহোনি এবং তাঁর তিন সঙ্গী। একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটার উপর আটকে গেল রানার দৃষ্টি। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে—দৈহিক গড়ন আর চেহারায় প্রচুর মিল আছে ম্যাহোনির সঙ্গে। তাড়াতাড়ি বাকি ছবিগুলো দেখল, বেশক টাতেই আছে এই ছেলে। সিনেটরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিল নিঃসন্দেহে।

‘কে এই ছেলে?’ জানতে চাইল রানা। ‘চেহারা দেখে তো আত্মীয় মনে হচ্ছে।’

‘আত্মীয় নয়, তবে দু’ভাইয়ের মত বড় হয়েছে ওরা,’ উদাস গলায় বললেন মিসেস ম্যাহোনি। যুদ্ধেও যাবার কথা ছিল একসঙ্গে। কিন্তু আমার ডেভিডের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ও, পালিয়ে যায় ইয়োরোপে। আমার ছেলেকে একা যেতে হয় যুদ্ধে… বন্ধু ছাড়া, ভাই ছাড়া! যদি দুঃখকষ্ট শেয়ার করার জন্য কাউকে পেত, তা হলে হয়তো এভাবে বদলে যেত না ও! অবশ্য নিয়তিও প্রতিশোধ নিয়েছে ওর হঠকারিতার। গোস্তাদে স্কিইং করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছে ও। সেই থেকে আর কোনোদিন ওর নাম উচ্চারণ করেনি আমার ছেলে।’

‘সেই থেকে? কবে সেটা?’

‘বিশ বছর আগে।’

‘কে ছিল এই ছেলে? কী ওর পরিচয়?’

জানালেন মিসেস ম্যাহোনি। সঙ্গে সঙ্গে দম আটকে এল রানার। মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে। রাখাল বালককে খুঁজে পাবার পরও মন বলছিল তদন্ত না থামাতে… আর তার ফলাফল ও দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে। সব ধোঁয়া কেটে গেছে সামনে থেকে, দূর হয়ে গেছে সমস্ত খটক … পেয়ে গেছে সব প্রশ্নের জবাব। চরম সত্যটা জেনে গেছে ও, এখন শুধু তার স্বপক্ষে প্ৰমাণ জোগাড় করা প্রয়োজন।

তা-ই করবে রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *