বাইশ
পরের এক মাসে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটল গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দৃশ্যপটে। বড় বড় বিভিন্ন দেশের উচ্চপদস্থ অনেক মানুষ পদত্যাগ করলেন, গ্রেফতার হলেন, কিংবা প্রাণ হারালেন রহস্যময় দুর্ঘটনায়, আত্মহত্যা করলেন, এমন লোকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বলা বাহুল্য, এর সবই ঘটল ম্যাহোনি হল থেকে রানার উদ্ধার করে আনা ডেন্টাল রেকর্ড এবং ফেনিস কাউন্সিলের তালিকার বদৌলতে। সংবাদপত্রগুলো মুখর হয়ে রইল নানা ধরনের গুজব এবং বানোয়াট কাহিনিতে, কিন্তু আসল ঘটনা জানতে পারল না সাধারণ মানুষ। মূল সত্যকে ধামাচাপা দেয়া হলো রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে।
এ-কাজে সবচেয়ে ব্যস্ত রইল আমেরিকান প্রশাসন। জনগণের কাছে সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড-এর মৃত্যুর বিবরণ দেয়া হলো নিয়তির নির্মম পরিহাস হিসেবে—ম্যাসাচুসেটস্ হাইওয়েতে সড়ক-দুর্ঘটনায়। ঠিক এমনই একটা দুর্ঘটনা থেকে বিশ বছর আগে রক্ষা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই অকালমৃত্যুতে ব্যথিত হলো সরকার। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শোক প্রকাশের জন্য একটা বিমানে চেপে রওনা হলেন কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সেটা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ক্র্যাশ করল কলোরাডো পর্বতমালায়। জানা গেল, তাতে সেক্রেটারি অভ স্টেট, নতুন জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফ, সিআইএ ডিরেক্টর, এফবিআই-এর ডেপুটি ডিরেক্টর-সহ বেশ ক’জন উঁচুসারির ব্যক্তিত্ব মারা গেছেন। প্রচারমাধ্যমে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল প্রেসিডেন্টের—নির্দেশ দিলেন, আগামীতে উঁচু পদের কর্মকর্তারা একসঙ্গে বিমানভ্রমণ করতে পারবেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ-ধরনের প্রাণহানি এক অপূরণীয় ক্ষতি, ইত্যাদি ইত্যাদি। টানা সাতদিন রাষ্ট্রীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার ঘোষণা দিলেন তিনি।
ম্যাহোনি হলের অগ্নিকাণ্ড এবং তাতে জিয়োভান্নি গুইদেরোনির মৃত্যু নিয়েও নানা রকম বিবৃতি দিল সরকার। গঠন করা হলো উচ্চ-পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। মাসশেষে তাদের দেয়া রিপোর্টে জানা গেল, থার্ড ওয়ার্ল্ড আর্মি অভ লিবারেশন অ্যাণ্ড জাস্টিস নামে একটি সংগঠন ওই ঘটনার জন্য দায়ী। এফবিআই এবং ইন্টারপোল থেকে হুলিয়া জারি করা হলো ওই সংগঠনের সদস্যদের নামে। সরকার এ-ও জানাল, জেনারেল গ্রেগরি ওয়ার্নারের হত্যাকাণ্ড আসলে ওরাই ঘটিয়েছে। জনৈক মাসুদ রানার নামে ইতিপূর্বে জারি করা হুলিয়া ফিরিয়ে নিল তারা। রাশাতেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলো মনসুর আলী কুয়াশার ব্যাপারে।
পত্রিকাঅলারা অনেক খোঁজাখুঁজি করল এই বিশেষ দু’জন মানুষকে—তাদের প্রতিক্রিয়া জানবার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোথাও পাওয়া গেল না ওদেরকে। কেন ওদের নামে মিথ্যে অভিযোগ দেয়া হয়েছিল, কীসের ভিত্তিতে তা আবার প্রত্যাহার করে নেয়া হলো—এসব সাধারণ মানুষ জানতে পারবে না কোনোদিনই!
.
ক্যারিবিয়ানের এক অজ্ঞাত দ্বীপ।
কটেজের জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল রানা। শেষ বিকেলের মোলায়েম রোদে সৈকতের বালির উপর শুয়ে আছে সোনিয়া। পরনে একটা টু-পিস বিকিনি, চোখে সানগ্লাস। পায়ের কাছে অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়ছে ফেনাঅলা ঢেউ। রেডিও সেটের পাওয়ার অফ করে কটেজ থেকে বেরিয়ে পড়ল ও-ও। ফুসফুস ভরে টেনে নিল তাজা হাওয়া, চোখ বোলাল চারপাশে।
গত একমাস থেকে ছোট্ট এই দ্বীপে আছে ওরা-বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) রাহাত খানের নির্দেশে। পরিস্থিতি পরম থাকায় রানাকে গা ঢাকা দেবার জন্য বলেছিলেন তিনি। তা ছাড়া বিশ্রামও প্রয়োজন ছিল ওর। চিফের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে রানা–গত কিছুদিনে নারকেল গাছে ছাওয়া ছোট্ট এই স্বর্গে ভালোবাসা, সমুদ্রস্নান আর প্রলম্বিত আড্ডা ছাড়া আর কিছুই করেনি ওরা দুজন।
পায়ের শব্দ শুনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সোনিয়া। জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘কথা বলছিলাম আমার বন্ধু সোহেলের সঙ্গে,’ জানাল রানা। ‘ছুটি শেষ, তলব পাঠিয়েছেন আমার চিফ।’ বালিতে ওঁর পাশে বসে পড়ল ও।
‘চলে যাবে তুমি?’ ধড়মড় করে উঠে বসল সোনিয়া। ‘তা হলে আমার কী হবে?’
‘সেটা সম্পূর্ণ তোমার উপর নির্ভর করছে। রেড ব্রিগেডের বিরুদ্ধে ইটালিয়ান পুলিশ বড় ধরনের অ্যাকশন নিতে যাচ্ছে। তোমার সাহায্য চাইছে ওরা। চাইলে যেতে পারো রোমে। ভাল. বেতন, সেইসঙ্গে আলাদা সিকিউরিটিও পাবে।’
‘যেতে বলছ?’
‘জোর দেব না, তবে এটুকু বলব—গেলে উপকৃত হবে বহু মানুষ। যে-দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তোমাকে, তা আর কোনও তরুণ-তরুণীর বেলায় ঘটবে না। জেনে রেখো, শুভ যদি অশুভের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায়, তা হলে কোনোদিনই শান্তি আসবে না- পৃথিবীতে।
একটু ভাবল সোনিয়া। ‘ঠিক আছে, যাব তা হলে। আর কিছু না হোক, মি. কুয়াশার জন্য। ওঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাই আমি… পৃথিবীকে মুক্ত করতে চাই সন্ত্রাসের অভিশাপ থেকে।’
‘একটা অদ্ভুত ব্যাপার কী, জানো?’ ইতস্তত করে বলল রানা। ‘সোহেল বলল, ম্যাহোনি হলের ধ্বংসস্তূপে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কুয়াশার লাশ পাওয়া যায়নি।
‘কী?’ চমকে উঠল সোনিয়া। ‘উনি মারা যাননি?’
‘না, না, সে-কথা বলছি না। আসলে… শিয়োর হতে পারছে না কেউ। বেশ কটা লাশ আইডেন্টিফিকেশনের অযোগ্য অবস্থায় পাওয়া গেছে—খুব বেশি পুড়ে গেছে ওগুলো, কিংবা ইঁট-পাথরের তলায় পড়ে থেঁতলে গেছে। ওর মধ্যে থাকতে পারে কুয়াশা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
‘ইশ্… যদি সত্যিই বেঁচে থাকতেন!’ গলা ধরে এল সোনিয়ার।
‘থাক, ওর কথা ভেবে এখন আর মন খারাপ কোরো না।’ ওকে জড়িয়ে ধরল রানা। কাল চলে যেতে হবে… আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আমাদের হাতে। চলো, এই সময়টুকু স্মরণীয় করে রাখি।’
চোখ মুছল সোনিয়া। ‘কীভাবে?’
‘অনেক রকম আইডিয়া আছে আমার মাথায়,’ অর্থপূর্ণ কণ্ঠে বলল রানা। ‘তবে সবগুলোর শুরু হচ্ছে এভাবে…’
সোনিয়াকে চুমো খেতে গেল ও। পারল না। ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিল মেয়েটা। খিলখিল করে হেসে ছুটতে শুরু করল পানির দিকে। ওকে তাড়া করল রানা। পানির ধারে গিয়ে ধরে ফেলল জাপটে, দু’জনে পড়ে গেল ফেনাময় ঢেউয়ের মাঝখানে।
একটু ধস্তাধস্তি করল সোনিয়া, তারপর হার মানল। ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল রানার নিষ্ঠুর ঠোঁটজোড়া। কিন্তু থেমে গেল মাঝপথে। বিস্মিত হয়ে তাকাল দূরের নারকেল-বীথির দিকে। মিষ্টি একটা সুর ভেসে আসছে ওদিক থেকে
‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করল সোনিয়া।
‘শুনতে পাচ্ছ?’ বলল রানা। ‘সরোদ বাজছে!’
‘তো?’
‘অস্বাভাবিক না? এই দ্বীপে অম্ল ক’ঘর জেলে ছাড়া আর কেউ থাকে না। তা হলে সরোদ বাজাচ্ছে কে?’
‘কী বলতে চাও?’
জবাব দিল না রানা। একটা সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভাবছে গিয়ে দেখবে কি না কে ওই সরোদশিল্পী।
‘না, যেয়ো না। ওর মনের কথা পড়তে পেরেই যেন বলে উঠল সোনিয়া। শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ওকে। ‘ভালই তো লাগছে, বাজতে দাও।’
হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। সোনিয়ার আহ্বানে সাড়া দিল ও। উত্তাল ঢেউয়ের তলায় ঢাকা পড়ে গেল দুটো শরীর। প্রকৃতিও মেতে উঠেছে যেন সরোদের সুরে।
***