সেই কুয়াশা ২.২

দুই

সন্ধ্যার ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভিলা দেস্তে-র জাঁকজমক একবিন্দু কমেনি। আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে পুরো এস্টেট। জ্বেলে দেয়া হয়েছে ফ্লাডলাইট—খাড়া ঢাল বেয়ে নামা ঝর্ণার পানি ঝিকমিকিয়ে উঠছে বহুমূল্য হীরকখণ্ডের মত। বড় বড় পুলগুলোর মাঝখানে মাথা তুলে রেখেছে ফোয়ারা, ছাতার আকৃতি নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। বানানো হয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত, সেই পানি আছড়ে পড়ছে প্রাচীন একগুচ্ছ বাগান-ভাস্কর্যের সামনে। পানির ছিটেয় চকচক করছে পাথুরে মূর্তির ভেজা শরীর। আজকের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে এস্টেটের বাগান, নিষিদ্ধ করা হয়েছে সাধারণ জনতা এবং টুরিস্টদের ঘোরাফের’ : প্রবেশাধিকার পেয়েছেন কেবল সমাজের মানী-গুণী ব্যক্তিরা : অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য হিসেবে কাগজে-কলমে এই ঐতিহাসিক এস্টেট ও বাগানের সংস্কার কাজের জন্য ফাণ্ড জোগাড়ের বাহানা দেয়া হয়েছে; কিন্তু ভিতরে ঢুকলে বোঝা যায়—আসলে বাছাই করা একদল মানুষের মনোরঞ্জনই আজ সন্ধ্যার মূল লক্ষ্য। ভুল বলেনি লুচিনি, পুরো রোম আজ হাজির হয়েছে ভিলা দেস্তে-তে। সাধারণ মানুষের রোম নয়… টাক্সিডোর ভেলভেট ল্যাপেল স্পর্শ করে ভাবল রানা… ধনীদের রোম।

এস্টেটের মূল ফটকে গাড়ি থামাল ও। দু’জন ইউনিফর্ম পরা গার্ড এগিয়ে এল; দেখতে চাইল আমন্ত্রণপত্র। খোলা জানালা দিয়ে এনভেলাপে ভরা দুটো কার্ড বের করে দিল রানা। অতিথিদের তালিকা পরীক্ষা করছে গার্ডরা, রানা আর সোনিয়া সত্যি আমন্ত্রিত অতিথি কিনা নিশ্চিত হতে চাইছে। ‘তালিকায় নাম আছে দেখে হলদেটে চেহারায় হাসি ফুটল, কুর্নিশ করবার ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল, তারপর রিমোট ট্রান্সমিটারে চাপ দিয়ে খুলে দিল গেট। গাড়ি নিয়ে লম্বা পথটুকু দ্রুত পেরিয়ে এল রানা, থামল ভিলার পোর্টিকোর নীচে।

সোনিয়াকে দেখে মনে হলো কিশোরী একটা মেয়ে তাজমহল দেখতে এসেছে। ‘এত বড় পার্টিতে আগে কখনও আসিনি আমি। তোমাকে না বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিই।

‘ফেলবে না,’ আশ্বস্ত করল রানা। ‘নিজেকে বোঝাও, এটা স্রেফ একটা সামাজিক নাটক। রোমের এলিট-রা এ-ধরনের পার্টিতে আসেন, কারণ, হয় তাঁরা কিছু বিক্রি করতে চান, নয়তো কিছু কিনতে। হাস্য-রসাত্মক কথাবার্তা হবে, মদ্যপান চলবে, চালচলনে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে জাহির করবার চেষ্টা থাকবে, তারই ফাঁকে চলবে তথ্য বিনিময়।’

‘বোঝা যাচ্ছে, তুমি বহুবার এ-রকম পার্টিতে এসেছ।

মুচকি হাসল রানা, গাড়ি থেকে নেমে ভ্যালে-র হাতে চাবি- ধরিয়ে দিল। তারপর সোনিয়াকে নিয়ে পা বাড়াল ভিলার ভিতরে।

কোর্টইয়ার্ডের আদলে সাজানো হয়েছে ভিলার বৃহদায়তন হলঘর। পুরো কামরা জুড়ে বসানো হয়েছে ব্যাঙ্কোয়েট টেবিল, রয়েছে সোনার গিল্টি করা চেয়ারের সারি, দেয়াল ঢাকা পড়েছে নানা রঙের রেশমি পর্দায়। দামি পোশাক-আশাকে সজ্জিত মানুষেরা ভিড় জমিয়েছে সেখানে। মহিলাদের নাক-কান-গলায় শোভা পাচ্ছে সোনা-রূপা আর হীরার সমাহার, পুরুষদের পরনে দামি টাক্সিডো আর কোমরবন্ধনী। টাক পড়তে থাকা মাথা, ধূসর চুল আর হাতে দামি সিগার নিয়ে ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির নীরব প্রদর্শনী করছে তারা। এককোণে রয়েছে অর্কেস্ট্রা—জনাবিশেক মিউজিশিয়ান ধীর লয়ে বাজিয়ে যাচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে মানানসই সঙ্গীত

এতসব মানুষের মাঝে আলাদা জৌলুস নিয়ে হাজির হয়েছে সোনিয়া। গলায় বা হাতে কোনও অলঙ্কার নেই ওর, তার কোনও প্রয়োজনও পড়েনি। ব্রোঞ্জের মত রঙ আর মাখনের মত কোমল ত্বক-ই ওর অলঙ্কার। পরেছে সোনালি বর্ডারের একটা সাদা গাউন, তাতে পদ্মফুলের মত লাগছে ওকে। মুখের কালসিটে আর ফোলাভাব কমে গেছে ইতিমধ্যে, সানগ্লাসও পরতে হয়নি। পুরো কামরায় ওকে সবচেয়ে সুন্দরী বললে অত্যুক্তি হয় না মোটেই যে-ই তাকাচ্ছে, তারই চোখ আটকে যাচ্ছে ওর উপর।

রহস্যময় মি. রঘুনাথ সাপের বান্ধবী হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে সোনিয়ার, এসেছে লেক কোমো থেকে। কাভারটা চমৎকার, ওই এলাকা ভূমধ্যসাগরীয় ধনীদের প্রমোদরাজ্য হিসেবে বিখ্যাত। লুচিনির কাজে কোনও খুঁত নেই। অতিথিদের আগ্রহ জাগাবার মত যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করেছে, সেটা আবার এমন নয় যে কারও মনে খুঁতখুঁতানির সৃষ্টি হবে। প্রত্যাশিত ভঙ্গিতেই বেশ কিছু মানুষ এগিয়ে এল রানার দিকে, খাতির জমাবার চেষ্টা করল। তাদেরকে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি-বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু মূল্যবান উপদেশ খয়রাত করে সন্তুষ্ট রাখল ও, তারপর পাশ কাটিয়ে চলে এল সোনিয়াকে নিয়ে।

শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নজর বোলাল রানা, চারদিকে। অল্পক্ষণেই খুঁজে বের করে নিল কাউন্ট মার্সেলো বিয়াঞ্চিকে। এই প্রথম দেখছে, তারপরেও চিনতে কষ্ট হলো না। হলঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে স্বর্ণকেশী দুই যুবতীর সঙ্গে খোশগল্প করছে কাউন্ট, কথার ফাঁকে চঞ্চল দৃষ্টি বোলাচ্ছে অন্যান্য অতিথিদের উপর। লম্বা, একহারা দেহ; তীক্ষ্ণ চেহারা; কপালের দু’পাশের চুলে পাক ধরতে শুরু করেছে। কোটের ল্যাপেলে শোভা পাচ্ছে বহুরঙা রিবন, কোমরে বেঁধেছে একটা সোনালি স্যাশ। রিবনের গুরুত্ব যদি কেউ না-ও বোঝে; সোনালি কাপড়টা দেখে বুঝে নেবে তা। পুরো অনুষ্ঠানে একমাত্র কাউণ্ট বিয়াঞ্চি-ই পরেছে ওই জিনিস—প্রকাশ করছে আপন আভিজাত্য এবং অনুষ্ঠানের হোস্ট হিসেবে নিজের পদবী। পঞ্চাশোর্ধ মানুষটা রোমের সর্বোচ্চ সমাজের মূর্ত প্রতীক

‘কোথায় পাবে কাউণ্টকে?’ ফিসফিসিয়ে পাশ থেকে জানতে চাইল সোনিয়া

‘অলরেডি পেয়ে গেছি,’ বলল রানা। ‘ওই তো

‘ওই ভদ্রলোক?’ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে হলঘরের কোনায় তাকাল সোনিয়া। একটু পর মাথা ঝাঁকাল। ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। পেপারে দেখেছি আমি ওঁর ছবি। কী করবে? এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হতে চাও?’

‘মনে হয় না তার কোনও প্রয়োজন আছে। যদি ভুল করে না – থাকি, কাউণ্টই আমাকে খুঁজছে।’ হাতের ইশারা করল রানা। চলো, ব্যাঙ্কোয়েট টেবিলের ওপাশটায় চলে যাই। আমাদেরকে দেখতে পাবে তা হলে।’

নাহয় দেখল… চিনবে কীভাবে?’

‘পুরো হলঘরে আমিই একমাত্র ভারতীয় চেহারার লোক। তারপরেও যদি খেয়াল না করে, অন্তত তোমাকে খেয়াল করতে বাধা।’

‘বলেছে তোমাকে!’ মুচকি হাসল সোনিয়া।

হাসি মুখে ওকে নিয়ে টেবিলের দিকে এগোল রানা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, একটু পরেই পিছনে গমগম করে উঠল ভরাট গলা।

‘সেনিয়র সাপ্রে, আই বিলিভ?’

ধীরে ধীরে পিছন ফিরল রানা। চেহারায় গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে জানতে চাইল, ‘মাফ করবেন, আমরা কি পূর্ব-পরিচিত?’

হেসে উঠল কাউণ্ট। বলল, জী না, তবে পরিচয়টা গাঢ় হতে সময় লাগবে না।’ হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য। ‘আমি বিয়াঞ্চি…. মার্সেলো বিয়াঞ্চি।’ উপাধিটা উহ্য রাখল বুঝি গুরুত্ব বাড়াবার জন্যই। আপনার দেখা পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলাম, সেনিয়র সাপ্রে!

ও! আপনিই সেই বিখ্যাত কাউন্ট বিয়াঞ্চি? বিস্মিত হবার ভান করে হাত মেলাল রানা। ‘লুচিনিকে বলেছিলাম, এখানে এলে আপনার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করে যাব। আপনিই তো দেখি খুঁজে নিলেন আমাকে! চিনেছেন কীভাবে?’

কাউন্টের মুখের হাসি বিস্তৃত হলো, ঝিকমিকিয়ে উঠল মুক্তোর মত সাদা দাঁতের পাটি। ‘লুচিনি কাজের লোক, তবে খানিকটা দুষ্টুও বটে। এই সিনোরিনাকে নিয়ে যেভাবে উচ্ছ্বাস দেখাল…… সোনিয়ার দিকে ইশারা করল সে, ‘…তাতে বুঝতে পারলাম, পার্টির সবচেয়ে সুন্দরী মহিলাটিকে খুঁজে বের করলে আপনাকেও পাওয়া যাবে।’

‘ওফফো, আপনাদের তো পরিচয় করিয়ে দিইনি,’ সোনিয়ার বাহুতে হাত রাখল রানা। কাউন্ট বিয়াঞ্চি, এ হলো আমার বান্ধবী… সোনিয়া। লেক কোমো থেকে এসেছে।’

‘আ প্লেজার!’ ঝুঁকে সোনিয়ার হাতের উল্টোপিঠে চুমো খেল কাউণ্ট। ‘এমন রূপ সচরাচর চোখে পড়ে না।’

‘প্লিজ, সেনিয়র!’ কপট হাসি দিয়ে বলল সোনিয়া। আপনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন!’

মনে মনে ওর প্রশংসা করল রানা। সুন্দর অভিনয়!

রানার দিকে ফিরল বিয়াঞ্চি। ‘আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি, সেনিয়র সাপ্রে। শুনলাম আমার বন্ধুরা নাকি মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক নানা রকম প্রশ্ন করে আপনাকে বিরক্ত করেছে?’

না, না, ক্ষমা চাইবার কিছু নেই,’ মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রানা। ‘লুচিনির আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। তবে… আমার পেশা জানার পর লোকে কৌতূহলী হয়ে ওঠে-ই! এতে আমি অভ্যস্ত।’

‘বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল মানুষ।’

‘ওটা আসলে কঠিন কিছু না। তবে লোকে যতটা ভাবে, অতটা জ্ঞান আমার থাকলে মন্দ হতো না। এমনিতে আমি শুধু নিয়োগকর্তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি; তাঁদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করি না

‘কিন্তু ওসব সিদ্ধান্তের মাঝেও তো জানার মত অনেক কিছু থাকে, তাই না?’

‘তা তো বটেই। নইলে কী আর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জলাঞ্জলি দিচ্ছেন শেখ-রা।’

‘জলাঞ্জলি? সুন্দর উপমা দিয়েছেন।’ একটু যেন গম্ভীর হলো বিয়াঞ্চি। ‘কেন যেন মনে হচ্ছে, আপনাকে আগে কোথাও দেখেছি আমি, সেনিয়র সাপে –

আচমকা এ-প্রশ্নে ঘাবড়াল না রানা। এমন পরিস্থিতির জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে ও। হালকা গলায় তাই বলল, ‘দেখা হলে অবশ্যই মনে থাকত আমার। তবে… কোনও এম্বাসির পার্টিতেও দেখে থাকতে পারেন। হয়তো কথা হয়নি…..

‘এম্বাসি সার্কেলে নিয়মিত আসা-যাওয়া আছে আপনার?’

‘উঁহুঁ। শুধু পার্টিতে যাই… তাও আবার শেষ মুহূর্তের গেস্ট হিসেবে। কী আর বলব, মাঝে মাঝে লোকের মনে নানা রকম প্রশ্ন জাগে; সেগুলোর জবাব খোঁজার জন্য আমাকে ডেকে নিয়ে যায় তারা। এই আর কী! কিছু তো আর বলতে পারি না, মাঝখান থেকে বিনে পয়সায় খাওয়া-দাওয়া হয়ে যায়।’

আজকালকার যুগে যুদ্ধজয়ের জন্য… সে যে যুদ্ধই হোক না কেন… তথ্যই সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আপনি সে-অস্ত্র লুকিয়ে রাখছেন, সেনিয়র।’

‘কী যে বলেন! আমি যুদ্ধ-টুদ্ধ বুঝি না। স্রেফ জীবিকা নির্বাহ করছি।’

‘কোনকিছু জানার জন্য চাপাচাপি করব না আপনাকে, ঠোঁটের কোনা বাঁকা করল বিয়াঞ্চি। ‘আমার বিশ্বাস, আপনি অত্যন্ত পাকা বিক্রেতা। লাভক্ষতির হিসেব ছাড়া জিনিস বের-ই করবেন না।’

‘শুনে দুঃখ পেলাম,’ গলার সুর বদলে বলল রানা, যাতে ইটালিয়ান কাউন্ট পরিবর্তনটা ধরতে পারে। আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ করবার ইচ্ছে ছিল আমার।’

‘তা-ই?’ আগ্রহ ‘ফুটল বিয়াঞ্চির কণ্ঠে। ইয়ে … সিনোরিনা আবার ব্যবসায়িক আলাপ শুনে বিরক্ত হবেন না তো?’

‘আলোচনার সময় ও না থাকলেও চলে। বিকল্প ব্যবস্থা যদি করা যায়…’

‘আর কিছু বলতে হবে না।’ হাত তুলে কালো চুলের এক যুবককে ডাকল বিয়াঞ্চি। কাছে এলে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘এ হলো আমার ব্যক্তিগত সহকারী – পিয়েত্রো। সিনোরিনার দিকে নজর রাখবে ও।’ সহকারীর দিকে ফিরল, ‘খেয়াল রেখো, ওঁর যেন অসুবিধে না হয় কোনও।’ তারপর তাকাল সোনিয়ার দিকে। ‘চাইলে নাচতে পারেন, সিনোরিনা। পিয়েত্রো খুব ভাল ড্যান্সার।’.

মাথা ঝুঁকিয়ে বাউ করল যুবক, এক হাত বাড়িয়ে দিল সোনিয়ার দিকে। মৃদু হেসে সেটা গ্রহণ করল ও। এক পা এগিয়ে ঘাড় ফেরাল রানা আর কাউন্ট বিয়ার্কির দিকে।

‘চাও!’ ইটালিয়ানে বিদায়-সম্ভাষণ জানাল সোনিয়া, তারপর পিয়েত্রোর সঙ্গে চলে গেল একদিকে।

‘আপনাকে ঈর্ষা করতে হয়, সেনিয়র সাপ্রে,’ মন্তব্য করল বিয়াঞ্চি, সোনিয়ার অপসৃয়মাণ অবয়বের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ‘অপূর্ব এক মেয়ে… লেক কোমো-য় পেয়েছেন ওকে?’

লোকটার কণ্ঠে ফুটে ওঠা কামনার সুর কান এড়াল না রানার। সোনিয়ার ব্যাপারে লোভী হয়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই খোঁজখবর নেয়ার মতলব… সময়-সুযোগ বুঝে ওকে শয্যাসঙ্গিনী বানাতে চায়। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই রানার, কিন্তু এ-মুহূর্তে যদি খোঁজখবর নিতে শুরু করে, কাভার ফাঁস হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। তাই হালকা গলায় ও বলল, ‘সত্যি বলতে কী, আসলে কোত্থেকে এসেছে মেয়েটা, আমি জানি না। রিয়াদের এক বন্ধু নাম্বার দিয়েছিল ওর, ফোনেই ওকে ভাড়া করেছি। ফ্রান্সের নিস-এ আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ও। চেহারা-সুরত দেখে এত পছন্দ হয়ে গেল যে, ব্যাকগ্রাউণ্ডের ব্যাপার নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। বলেছে লেক কোমো থেকে এসেছে, তা-ই মেনে নিয়েছি। এমন হুর-পরী জাহান্নাম থেকে এলেই বা কী এসে যায়? দু’চারদিনের বেশি তো আর থাকছে না আমার সঙ্গে।

‘তা হলে ওর ক্যালেণ্ডারের ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে একটু জানাতে পারেন আমাকে? মানে… যদি আপনার আপত্তি না থাকে আর কী।’

‘না, না, আপত্তি কীসের? কবে নাগাদ ওকে চান আপনি?’

‘যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভাল। ওকে বলবেন, তুরিনের পাভোরোনি অফিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারবে আমার সঙ্গে ‘

‘তুরিন?’

হুঁ। দেশের উত্তরাঞ্চলে বেশ ক’টা প্ল্যান্ট আছে আমাদের। তুরিন… সেইসঙ্গে ইয়োরোপের একটা বড় অংশ চালাই আমরা— বিয়াঞ্চি-পাভোরোনিরা।’

‘আমার সেটা জানা ছিল না।’

‘তা-ই? আমি তো ভেবেছিলাম সেই কারণেই আপনি আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছেন।’

শ্যাম্পেনের গ্লাসে শেষবারের মত চুমুক দিল রানা। ওটা নামিয়ে রেখে নিচু গলায় বলল, কিছুক্ষণের জন্য আমরা বাইরে যেতে পারি? আমার এক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে কনফিডেশিয়াল মেসেজ আছে আপনার জন্য। আসলে….. সেজন্যেই আজ আমার এখানে আসা।’

‘কোথাকার ক্লায়েন্ট?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল বিয়াঞ্চি। ‘অ্যারাবিয়ান গালফ … . আপাতত এর বেশি বলতে পারছি না আপনাকে।’

‘অ্যারাবিয়ান গালফ থেকে মেসেজ?’ ভ্রূকুটি স্বাভাবিক হচ্ছে না বিয়াঞ্চির। রোম আর তুরিনের অন্যান্য এলিটদের মত ওখানকার বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় আছে তার, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা নেই কারও সঙ্গে। তা হলে মেসেজ পাঠিয়েছে কে? কৌতূহলী হয়ে উঠল। বলল, ঠিক আছে, বাগানে নাহয় একটু হাঁটব আমরা। আসুন…’

হাত তুলে তাকে থামাল রানা। ‘একসঙ্গে আমাদেরকে বেরুতে দেখা না গেলেই ভাল হয়। কোথায় যেতে হবে বলে দিন। আমি বিশ মিনিট পর পৌঁছচ্ছি ওখানে।

‘ইন্টারেস্টিং!’ মাথা দোলাল কাউন্ট। ইপোলিটোর ফোয়ারা চেনেন?’

‘খুঁজে নিতে পারব।’

‘বাগানের একটু ভিতরদিকে ওটা। নির্জন।

‘বেশ। বিশ মিনিট।

কাউণ্ট বিয়াঞ্চিকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে অতিথিদের ভিড়ে মিশে গেল রানা।

.

ফোয়ারার চারপাশ অন্ধকার, কোথাও আলো জ্বলছে না। পানির কুলুকুলু ধ্বনি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। পাথরসারি আর ঝোপঝাড়ের আড়াল ব্যবহার করে সন্তর্পণে ওখানে পৌঁছল রানা। কোনও ঝুঁকি নিচ্ছে না ও, আশপাশে কাউন্টের মোতায়েন করা প্রহরী থাকতে পারে। তেমন কিছুর আভাস পেলে অন্য জায়গা খুঁজে বের করবে কথা বলবার জন্য।

ভালমত তল্লাশি চালিয়েও কারও দেখা পাওয়া গেল না। একটু পর শোনা গেল পদশব্দ। নুড়ি বিছানো হাঁটাপথ ধরে ফোয়ারার দিকে আসছে কাউন্ট বিয়াঞ্চি। দৃষ্টিসীমায় উদয় হলে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল রানা। গলা খাঁকারি দিল। ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখল কাউন্ট। ফোয়ারার নিচু সীমানা-প্রাচীরের পাশে মুখোমুখি হলো দু’জনে। আবছা আলোয় লোকটার স্রেফ অবয়ব দেখতে পাচ্ছে রানা, ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। ছায়া অপছন্দ ওর।

‘এতদূর আসার কোনও প্রয়োজন ছিল কি?’ রুক্ষগলায় বলল রানা। ‘একান্তে কথা বলতে চেয়েছি, তাই বলে রোমের দিকে অর্ধেক রাস্তা হাঁটতে চাইনি।’

‘অমন কোনও ইচ্ছে আমারও ছিল না, সেনিয়র সাপ্রে, ‘ নিরুত্তাপ কণ্ঠে জবাব দিল বিয়াঞ্চি। কিন্তু একসঙ্গে বেরুতে চাইলেন না দেখে এ-জায়গার কথা ভাবতে হলো। আপনার সঙ্গে আমাকে দেখা গেলে সেটা হয়তো নিজের জন্যেই ভাল হবে না। আফটার অল, আপনি আরব শেখদের ব্রোকার।

‘তাতে সমস্যা কোথায়?’

‘তা হলে আপনিই বলুন, আলাদাভাবে বেরুতে চাইলেন কেন?’

সন্দেহপ্রবণ লোক, মনে মনে ভাবল রানা। ‘স্রেফ সতর্কতা, আর কিছু না। আমাদেরকে একসঙ্গে বেরুতে দেখার কথা কেউ মনে রাখুক, তা চাইছিলাম না। বাগানে কেউ বেড়াতে এসেও আমাদেরকে দেখে ফেলতে পারে, তবে সেটা কো-ইনসিডেন্স বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।’

‘সে-ভয় নেই, জানাল কাউন্ট। ইপোলিটোর ফোয়ারায় পৌঁছুনোর রাস্তা কেবল একটা। এন্ট্রান্সের সামনে আমার এক লোক পাহারা দিচ্ছে। কাউকে ঢুকতে দেবে না। সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্চ্যও করবে না কেউ। আমি যে মাঝে-মধ্যে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একাকী এখানে ঘুরতে পছন্দ করি, তা সবার জানা

‘ধরে নিচ্ছি, পাহারাদার বসিয়েছেন শুধু আমারই কারণে।’

গম্ভীর হয়ে গেল বিয়াঞ্চি। মনে রাখবেন, সেনিয়র সাথে, বিয়াঞ্চি-পাডোরোনি পুরো ইয়োরোপ-আমেরিকা জুড়ে ব্যবসা করছে। নিত্যনতুন মার্কেট খুঁজছি আমরা, তাই বলে আরব্য পুঁজি চাইছি না। কাজটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ-ধরনের ইনভেস্টমেন্ট ঠেকানোর জন্য দুনিয়াজুড়ে নানা রকম বিধি-নিষেধের দেয়াল দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। চেষ্টা করতে গেলে বিপদে পড়ব—তদন্ত-টদন্ত কিছুই হবে না, শুধু প্যারিস আর নিউ ইয়র্কের ইহুদি ব্যবসায়ীরাই আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে।’

‘যদি বলি বিয়াঞ্চি-পাভারোনির সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই?’ কণ্ঠে রহস্য ফোটাল রানা। ‘সম্পর্ক আছে শুধু বিয়াঞ্চি অংশটুকুর?’

‘স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে খোঁচাখুঁচি করছেন আপনি, সেনিয়র সাপ্রে। পরিষ্কার করে বলুন ঠিক কী বলতে চান।’

‘আপনি তো কাউণ্ট আলবার্তো বিয়াঞ্চির ছেলে, তাই না?’

‘এ তো সবাই জানে! পাভোরোনি ইণ্ডাস্ট্রিজের বিস্তারের পিছনে আমার অবদানের কথাও অজানা নয় কারও। বিয়াঞ্চি এবং পাভোরোনি নামদুটো এখন অবিচ্ছেদ্য, আশা করি সেটা বলে দিতে হবে না আপনাকে?’

‘না, তবে তার কোনও গুরুত্ব নেই। আমি স্রেফ একজন মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করছি—দুটো পক্ষের হয়ে খবর আদান-প্রদান ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই আমার। বাইরের দুনিয়া যদি কোনও প্রশ্ন তোলে, বলব তিভোলির এক পার্টিতে আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার, আর কিছু না। এই মিটিং-টা ঘটেইনি!’

‘খুব নাটকীয়তা করছেন। মেসেজটা নিশ্চয়ই ইম্পরট্যান্ট। কে পাঠিয়েছে?’

তাকে থামানোর ভঙ্গিতে হাত তুলল রানা। ‘প্লিজ… যদ্দূর বুঝি, তাতে এ-ধরনের কেসে প্রথম সাক্ষাতে ক্লায়েন্টের পরিচয় ফাঁস না করাই নিয়ম। আমি শুধু আপনাকে জিয়োগ্রাফিকাল লোকেশন এবং একটা রাজনৈতিক সমীকরণের কথা বলতে পারি, যাতে হাইপথেটিক্যালি দুটো পক্ষ রয়েছে।

সরু হয়ে এল বিয়াঞ্চির দু’চোখ, তার মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পেরেছে রানা। ‘বলে যান।’

আপনি একজন মানীগুণী মানুষ, কাজেই নিয়ম কিছুটা শিথিল করা যেতে পারে। ধরা যাক, আরব্য উপসাগরীয় এলাকায় জনৈক প্রিন্স আছেন। তাঁর চাচা… মানে দেশের বাদশাহ, পুরনো জামানার লোক। বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনও ইস্পাতকঠিন হাতে দেশ চালাচ্ছেন; তাঁর কথাই আইন। বহুকাল আগে বেদুঈন গোত্রের দলপতি ছিলেন, আজও সে-সময়ের মতই একগুঁয়ে তিনি। কারও মতামতের তোয়াক্কা করেন না, বাজে ইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা নষ্ট করেছেন… আজও করছেন। এর ফলে পুরো দেশের কোষাগার-ই শূন্য হবার দশা। দেশের স্বার্থে, দশের স্বার্থে… সেইসঙ্গে নিজের স্বার্থে তো বটেই….. আমাদের হাইপথেটিক্যাল প্রিন্স তাঁর চাচাকে সরিয়ে দিতে চাইছেন। তাই আলবার্তো বিয়াঞ্চির ছেলের মাধ্যমে কাউন্সিলের কাছে সাহায্য চাইছেন তিনি… ফেনিস কাউন্সিলের কাছে! মেসেজ বলতে এতটুকুই। তবে এর সঙ্গে আরও কটা কথা আমি যোগ করব…’

চমকে গেছে কাউণ্ট বিয়াঞ্চি, বিস্ফারিত হয়ে গেছে চোখ। ‘কে তুমি?’ কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল সে, সম্বোধন পাল্টে ফেলেছে। ‘কে পাঠিয়েছে তোমাকে?’

‘আমার কথা শেষ করতে দিন,’ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল রানা। প্রথম ধাক্কাটা সফলভাবে দেয়া গেছে, এবার দ্বিতীয়টার পালা। ‘নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে আপনাকে আমি বলতে পারি, আমাদের এই হাইপথেটিক্যাল সিচুয়েশনটা বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় পৌছে গেছে। নষ্ট করবার মত একটা দিনও হাতে নেই। প্রিন্স তাঁর প্রস্তাবের জবাব চান… এবং খুব শীঘ্রি। আমার মাধ্যমেই পাঠাতে হবে ওটা। আপনি এখুনি আমাকে কাউন্সিলের পারিশ্রমিক বলে দিতে পারেন; যত বেশিই হোক, তাতে কিছু যায় আসে না। এটুকু বলে রাখি, আমরা একশো মিলিয়ন ইউ.এস. ডলার পর্যন্ত দিতে, রাজি আছি।’

‘একশো মিলিয়ন।’ চমকে উঠল বিয়াঞ্চি।

দেয়া হয়েছে দ্বিতীয় ধাক্কা। কাউণ্ট বিয়াঞ্চির মত ধনী মানুষের জন্যেও একশো মিলিয়ন ডলার হেলাফেলার বস্তু নয়। অন্ধকার ইতিমধ্যে চোখে সয়ে এসেছে, আবছা আলোয় ফলাফল দেখতে পেল রানা। মুখ হাঁ হয়ে গেছে কাউন্টের, লোভীর মত ঠোঁট চাটল। আরেকটু খোঁচানো যেতে পারে।

‘বলা বাহুল্য, অফারটার সঙ্গে কিছু শর্ত আছে,’ বলল ও। ‘যে-অ্যামাউন্ট বলেছি, সেটা আমাদের সর্বোচ্চ অফার; তবে সেজন্যে এক্ষুণি জবাব দিতে হবে, যাতে দ্বিতীয়বার যোগাযোগ করবার দরকার না হয়। কাজটা সারতে হবে সাতদিনের মধ্যে। তবে সেটা সহজ হবে না। বুড়ো বাদশাহকে দিনরাত পাহারা দিচ্ছে সাবাথি নামে একদল পাহারাদার…’ একটু থামল রানা। হাসল। ‘অবশ্য… মনে হয় না শেখ নাঈম ইবনে আল-হাসান সম্পর্কে বেশিকিছু ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন আছে। আমার জানামতে, কর্সিকান ব্রাদারহুডের পুরনো মক্কেল তিনি। এনিওয়ে, প্রিন্স চাইছেন ব্যাপারটা যেন আত্মহত্যার মত দেখায়….

‘থামো!’ হিসিয়ে উঠল বিয়াঞ্চি। ‘কে তুমি, সাপে? কী চাও এখানে? আমাকে পরীক্ষা করতে এসেছ?’ গলার স্বর চড়ে গেল তার। ‘কবর হয়ে যাওয়া অতীত নিয়ে কথা বলছ তুমি, কোন্ সাহসে!’

‘আমি শুধু একশো মিলিয়ন ডলারের কথা বলছি,’ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল রানা। আর দয়া করে আমাকে, কিংবা আমার ক্লায়েন্টকে কবর বা অতীতের কথা বলবেন না। কবর তো হয়েছে প্রিন্সের বাবার–কাউন্সিলের পাঠানো খুনির ছুরিতে গলা দু’ফাঁক হয়ে। আর সেটার পিছনে ছিলেন স্বয়ং নাঈম ইবনে আল-হাসান।

সিংহাসন পাবার জন্য ঘটিয়েছিলেন তিনি কাণ্ডটা। যদি আপনাদের কোনও রেকর্ড থাকে, তা ঘেঁটে দেখুন। আমার কথার সত্যতা জানতে পারবেন। এতদিন পর প্রিন্স সে-অন্যায়ের প্রতিশোধ চাইছেন। বাদশাহকে তাঁর নিজের ওষুধই খাওয়াতে চাইছেন। আর সেজন্যে অরিজিন্যাল কন্ট্রাক্টের পাঁচগুণ খরচ করবেন তিনি।’ কণ্ঠে হতাশা ফোটাল ও। ‘পুরোটাই পাগলামি! প্রিন্সকে বলেছিলাম, এর অর্ধেক টাকায় বৈধ একটা আন্দোলন করানো যাবে… ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে তাঁর চাচাকে। জাতিসংঘ থেকেও সাপোর্ট এনে দিতে পারব আমি। কিন্তু না… এভাবেই কাজটা করতে চান তিনি! আমাকে বলেছেন, ফেনিসের পন্থাই একমাত্র পন্থা। ওরা বুঝবে আমার আদর্শ। আরও বলেছেন, তিনি আপনাদের সঙ্গে যোগ দিতে চান।

নার্ভাস হয়ে গেছে কাউন্ট বিয়াঞ্চি, পিছিয়ে গিয়ে হেলান দিল ফোয়ারার সীমানা-প্রাচীরের গায়ে। ‘কে তুমি? কেন এসব কথা বলছ? আমি জানি না এসবের অর্থ কী।’

‘সত্যি?’ বাঁকা সুরে বলল রানা। তা হলে ভুল লোকের কাছে এসেছি। অসুবিধে নেই, আসল লোককে খুঁজে নেব আমি। তাকে কী বলতে হবে, তা জানা আছে আমার।’

‘কী বলতে হবে?’

হাসল রানা। ফিসফিসাল, ‘পার নস্ত্রো…’

কথাটা শেষ করল না ও, আবছা আলোয় চুম্বকের মত সেঁটে রইল ওর দৃষ্টি সামনের মানুষটির মুখের উপর। কাউন্টের ঠোঁট ফাঁক হতে দেখল, তৃতীয় শব্দটা উচ্চারণ করতে চলেছে। কর্সিকার পাহাড়ে শোনা সেই পুরনো মন্ত্র প্রতিধ্বনিত হতে যাচ্ছে তিভোলির এই অন্ধকার বাগানে।

শেষ মুহূর্তে নিজেকে সংযত করল বিয়াঞ্চি। বিস্ময় কেটে গিয়ে এখন নিখাদ আতঙ্ক ভর করেছে তার ভিতর। বলল, ‘মাই গড! তুমি… না, এ হতে পারে না। সত্যি করে বলো, কোত্থেকে এসেছ তুমি? কী বলা হয়েছে তোমাকে?’

‘সঠিক লোকের কাছে এসেছি, এটুকু বোঝার জন্য যথেষ্ট। বলুন এখন, আমাদের মধ্যে কি চুক্তি হবে?

নিজেকে বড্ড সেয়ানা ভাবছ তুমি, সাপ্রে… অথবা যা-ই তোমার নাম হোক না কেন!’ হঠাৎ খেপে গেল বিয়াঞ্চি।

‘আপাতত ওই নামটাই থাকুক,’ উত্তেজিত হলো না রানা। ঠিক আছে, জবাব পেয়ে গেছি আমি। আপনি ফিরিয়ে দিচ্ছেন প্রস্তাব। আমার ক্লায়েন্টকে জানাব সেটা।’ চলে যাবার জন্য ঘুরল ও।

‘অল্টো!’ ইটালিয়ানে থামার জন্য চেঁচিয়ে উঠল বিয়াঞ্চি।

থামল রানা, কিন্তু ঘুরল না কাউন্টের দিকে। মাথাটা পাশ ফিরিয়ে বলল, ‘পাশে? চে কসা?’

‘তোমার ইটালিয়ান অত্যন্ত নিখুঁত, সেনিয়র। ইংরেজিতে বলল বিয়াঞ্চি।

‘সেইসঙ্গে আরও কয়েকটা, ভাষা। ঘোরাফেরার সময় খুব কাজে লাগে। আমি প্রচুর ট্র্যাভেল করি কি না! যাক সে-কথা, কী চার আপনি?’

‘আমি না বলা পর্যন্ত এখানেই থাকবে তুমি!’

‘তাতে লাভ?’ এবার কাউন্টের দিকে ফিরল রানা। জবাব তো দিয়েই ফেলেছেন আপনি!’

‘যা বলছি, তা-ই করো। কথা না শুনলে শুধু গলা চড়াতে হবে আমাকে। আমার লোক এসে আটকে ফেলবে তোমাকে।’

ভেবে দেখল রানা, এখনও কিছু অর্জন করতে পারেনি ও। কিছুই স্বীকার করেনি কাউণ্ট। হাবভাবে বোঝা যাচ্ছে, ফেনিসের সঙ্গে তার কানেকশন আছে; কিন্তু এখনও তো মুখে বলেনি সেটা। বরং ঘটনার আকস্মিকতায় যেন বোকা বনে গেছে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। নার্ভাসনেস দেখে মনে হচ্ছে, কারও সাহায্য কামনা- করছে সে। তবে কী…

হ্যাঁ… কোনও সন্দেহ নেই… নাগালের মধ্যে অন্তত আরেকজন আছে ফেনিসের; হয়তো আজকের পার্টির ভিতরেই। রাঘব-বোয়াল, বিয়াঞ্চির উপরের লোক। তার পরামর্শ নিতে চাইছে কাউন্ট’। ফোয়ারার প্রাচীরে পিঠ ঠেকাল রানা, জল আরেকটু ঘোলা করা দরকার।

তার মানে কি প্রস্তাবটা আবার ভেবে দেখছেন আপনি?’ মুচকি হাসির সঙ্গে বলল ও।

‘কিছুই ভাবছি না আমি!’

তা হলে অপেক্ষা করব কেন? আমাকে অর্ডার দেয়া সাজে না আপনার। আমি আপনার পোষা কুকুর নই। ব্যবসায়িক সম্পর্ক হতে পারে কেবল আমাদের মাঝে–হ্যাঁ, কিংবা না! দ্যাট’স অল।’

‘ব্যাপারটা এত সোজা নয়, সেনিয়র!’ খ্যাপাটে শোনাল বিয়াঞ্চির গলা।

‘আমার জন্য সোজা। এখানে স্রেফ সময় নষ্ট করছি আমি।’ আবার পা বাড়াল রানা। চাইছে গার্ডকে ডেকে পাঠাক কাউণ্ট। বাস্তবেও তা-ই ঘটল

‘নিকো!’ অদৃশ্য পাহারাদারের নাম ধরে ডেকে উঠল বিয়াঞ্চি। ‘প্রেস্তো!’

নুড়ি বিছানো পথে দ্রুত পদশব্দ হলো, কয়েক মুহূর্ত পরেই ফোয়ারার সামনের খোলা জায়গায় বেরিয়ে এল মুশকো এক পালোয়ান। মনিবের নির্দেশ পেয়ে কোটের আড়াল থেকে বের করে আনল একটা ছোট রিভলভার, তাক করল রানার দিকে।

মুখ খুলল বিয়াঞ্চি, কথার সাহায্যে পরিস্থিতিকে নিজের আয়ত্তে আনার প্রয়াস চালাল বুঝি : ‘জামানা বড়ই কঠিন, সেনিয়র সাথে। আমার মত মানুষকে সাবধানে চলতে-ফিরতে হয়, সশস্ত্র বডিগার্ড রাখতে হয় সঙ্গে। আশা করি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা? সবখানে এখন সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য।’

খোঁচা মারার লোভ সামলাতে পারল না রানা। কথার ছুরি চালাল সঙ্গে সঙ্গে। অবাক হচ্ছি না, এসব ব্যাপারে আপনাদেরই সবচেয়ে ভাল জানার কথা। মানে… টেরোরিস্টদের কথা… ব্রিগেডের কথা। আদেশগুলো কার কাছ থেকে আসে? রাখাল বালক?

যেন ভয়ানক এক ঘুসি খেয়েছে, এমন ভঙ্গিতে এক পা পিছিয়ে গেল বিয়াঞ্চি। কেঁপে উঠল শরীরের ঊর্ধ্বাংশ। কপাল বেয়ে ঘাম নামতে দেখল রানা। চোখদুটো যেন ভীত কোনও প্রাণীর!

‘খেয়াল রেখো ওর দিকে,’ ফিসফিসিয়ে গার্ডকে বল্‌ল কাউন্ট। তারপর ত্রস্ত পায়ে চলে গেল হাঁটাপথ ধরে।

নিষ্কম্প হাতে রিভলভার ধরে রানার কাছাকাছি চলে এল গার্ড। তার দিকে তাকিয়ে নার্ভাস হবার অভিনয় করল ও। ইটালিয়ানে বলল, ‘কী ঘটল, কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার বসের কাছে একটা বড়সড় ব্যবসায়িক প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলাম, উনি দেখি সেটা শুনে পাগলামি শুরু করলেন! ফর গডস্ সেক, আমি স্রেফ একজন ‘সেলসম্যান! আমাকে আটক করছে কেন?’

চুপ করে রইল গার্ড। কিন্তু রানাকে ঘাবড়ে যেতে দেখে পেশি একটু ঢিল করল সে। বিপদের আশঙ্কা করছে না আর, ওকে নিরীহ বন্দি বলে ভাবছে।

‘একটা সিগারেট ধরাতে পারি?’ বলল রানা। ‘বন্দুক-টন্দুক দেখলে ভীষণ নার্ভাস হয়ে যাই আমি।’

’ধরাও,’ অনুমতি দিল গার্ড।

পরের কয়েক ঘণ্টার জন্য ওটাই তার শেষ কথা।

সিগারেটের প্যাকেট বের করবার ভঙ্গিতে ডান হাত কোটের পকেটে ঢোকাল রানা, অন্যহাতটা রাখল শরীরের পাশে, ছায়ার আড়ালে। গার্ডের চোখ ওর মুঠো করা ডানহাতের উপর আটকে যেতেই ছোবল দিল। বাঁ হাতে খপ্ করে আঁকড়ে ধরল রিভলভার-সহ হাত, প্রচণ্ড এক মোচড় দিয়ে কবজি মচকে দিল চেঁচাতে পারল না লোকটা, ডানহাতও চালিয়েছে রানা প্রায় একই সঙ্গে। সাঁড়াশির মত ও-হাতটা টিপে ধরল গার্ডের গলা, শব্দ বেরুতে দিল না, তারপর প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে তাকে নিয়ে গেল ফোয়ারার পাশের ঝোপঝাড়ের ভিতরে।

তাল হারিয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল লোকটা। তার মচকানো হাতের মুঠো থেকে রিভলভার কেড়ে নিল রানা, উল্টে নিয়ে সজোরে নামিয়ে আনল কপালের উপর। বাটের সঙ্গে হাড়ের সংঘর্ষের বিচ্ছিরি আওয়াজ হলো। অস্ফুট আর্তনাদ করে নিথর হয়ে গেল গার্ড। অজ্ঞান দেহটাকে ঝোপঝাড়ের আরেকটু ভিতরে নিয়ে গেল রানা, তারপর রিভলভারটা কোমরে গুঁজে রওনা হলো ভিলার দিকে। হাতে একবিন্দু সময় নেই, কাউন্ট বিয়াঞ্চির হদিস পেতে হবে। দেখতে হবে, রহস্যময় রঘুনাথ সাগ্রে-র সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণ সে কার কাছে দিচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *