তেরো
নাইটস্ব্রিজের একটা রুমিং হাউসে উঠেছে রানা, লণ্ডনের এই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গা-ঢাকা দেবার জন্য আদর্শ। সকাল সাড়ে নটায় ওখান থেকে বেরুল ও ব্রেকফাস্ট সারার জন্য। নিউজস্ট্যান্ডের সামনে ক্ষণিকের জন্য থামল সকালের পত্রিকা কিনতে, তারপর ছোট একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল। এন্ট্রান্সের কাছের একটা টেবিলে বসল ও, কাছেই একটা পে-ফোন ঝুলছে দেয়ালে। ঘড়িতে চোখ বোলাল, পৌনে দশটা বাজে। ঠিক সোয়া দশটায় মারভিন লংফেলোকে আবার ফোন করতে হবে — ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের খবর নেবার জন্য।
ওয়েইট্রেস এলে ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল রানা, তারপর ভাঁজ খুলে মেলে ধরল পত্রিকা। যা খুঁজছিল, তা পেয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম পাতার এক কোণে ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে খবরটা। নাশতা খেতে খেতে শুরু করল পড়তে।
ব্রুনা ভগেন-এর মৃত্যু
(নিজস্ব সংবাদদাতা)
এসেন, জার্মানি। ওয়ালথার ভরগেনের কন্যা, অ্যানসেল ভরগেনের নাতনি ব্রুনা ভরগেনের মৃতদেহ গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর ওয়ার্ডেনস্ট্রাসের পেন্টহাউসে আবিষ্কৃত হয়েছে। ডাক্তারের মতে, ম্যাসিভ করোনারি স্ট্রোকে অকালমৃত্যুর শিকার হয়েছেন তিনি। গত দু’দশক থেকে ফ্রাউলাইন ভরগেন তাঁর পিতার দিকনির্দেশনায় ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর পিতামাতা বর্তমানে স্ট্যাডওয়ান্ডের ব্যক্তিগত এস্টেটে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, কন্যার মৃত্যুসংবাদে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন ওয়ালথার ভরগেন; পারিবারিক ডাক্তার তাঁর জীবনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন…
তিক্ত একটা হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। দু’দুটো মৃত্যুর ঘটনাকে স্বাভাবিক দেখাবার জন্য ভাল কৌশলই বের করেছে ফেনিস। সন্দেহ নেই, ঘুষ পেয়ে জার্মানির বেশ কিছু লোকের পকেট ভারী, হবে এই উসিলায়। খবরের বাকি অংশ পড়ার আর আগ্রহ পেল না। কলামের নীচদিকে চলে গেল চোখ, ওখানে এ-সংক্রান্ত আরেকটা সংবাদ ছাপা হয়েছে।
ভরগেন-এর মৃত্যুতে ট্রান্সকমের উদ্বেগ
(নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি)
পুরো ওয়াল স্ট্রিটকে বিস্মিত করে দিয়ে আজ সকালে ট্রান্স-কমিউনিকেশন ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের একদল প্রতিনিধি এসেনের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। ফ্রাউলাইন ব্রুনা ভরগেনের অকালমৃত্যু এবং তাঁর পিতা ওয়ালথার ভরগেনের অসুস্থতার ফলে ভরগেন ইন্ডাস্ট্রিজ এখন নেতৃত্বশূন্য; এই অচলাবস্থা নিরসন-ই তাঁদের পরিদর্শনের মূল উদ্দেশ্য বলে জানা গেছে। এ-সংবাদ বিস্ময়জনক এ-কারণে যে, অতীতে ভরগেন ইণ্ডাস্ট্রিজে আমেরিকান পুঁজি বিশ শতাংশের বেশি নয় বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান কানাঘুষোয় বলা হচ্ছে, আসলে অস্ত্র-নির্মাতা ওই প্রতিষ্ঠানে আমেরিকান শেয়ার পঞ্চাশ শতাংশের ঊর্ধ্বে। যদিও ট্রান্সকমের বস্টন হেডকোয়ার্টার থেকে উক্ত গুজবের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়েছে…
বস্টন! ম্যাসাচুসেটস্ অঙ্গরাজ্যের রাজধানী! ভুরু কুঁচকে উঠল রানার। ডেভিড ম্যাহোনি ওখানকার-ই সিনেটর-ফেনিসের তালিকার চতুর্থ মানুষটার উত্তরসূরি। রাজনৈতিক ঐতিহ্যধারী অত্যন্ত প্রভাবশালী এই পরিবার… কেউ কেউ কেনেডি পরিবারের সঙ্গেও তুলনা করে ওদের। ট্রান্সকমের সঙ্গে কি সম্পর্ক আছে এই পরিবারের? খোঁজ নিতে হবে, ভাবল ও।
টেলিফোনের কর্কশ রিং শুনে ধ্যানভঙ্গ হলো রানার। দেয়ালে : ঝোলানো পে-ফোন বাজছে। ঘড়ি দেখল, দশটা আর্ট। ওয়েইট্রেসকে দেখল রিসিভার তুলতে। ভুরু কুঁচকে অপরপক্ষের সঙ্গে কথা বলল সে, তারপর রিসিভারটা হাতে ধরে কাস্টোমারদের দিকে ফিরল।
‘এখানে মি. কায়সার বলে কেউ আছেন? মাসুদ কায়সার?’
চমকে উঠল রানা। মাসুদ কায়সার ছদ্মনামে মাঝে মাঝে কাজ করে ও। সেটা তো কারও জানার কথা নয়। নাকি ব্যাপারটা : কাকতালীয়?
কয়েক সেকেণ্ড অপেক্ষা করল ও। শেষে পরাস্ত হলো কৌতূহলের কাছে। টেবিল থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়াল ওয়েইট্রেসের সামনে। ‘আমিই মাসুদ কায়সার।
ওর হাতে রিসিভার তুলে দিয়ে চলে গেল মেয়েটা। লম্বা করে শ্বাস নিল রানা। তারপর কথা বলল মাউথপিসে। ‘হ্যালো?’
সুপ্রভাত, মি. মাসুদ রানা!’ ভেসে এল পরিশীলিত একটা কণ্ঠস্বর-পুরুষ। ‘আশা করি রোম থেকে আসবার পর যথেষ্ট বিশ্রাম পেয়েছেন আপনি?’
‘কে তুমি?’
‘আমার নাম গুরুত্বহীন। আমাকে আপনি চেনেন না। শুধু এটুকু বুঝুন, আপনাকে খুঁজে পেয়েছি আমরা… চাইলে যে-কোনও মুহূর্তে হাতের মুঠোয় নিতে পারি। কিন্তু অযথা রক্তপাতে কারও উপকার হবে না। তারচেয়ে একসঙ্গে বসে নিজেদের বিভেদ মিটিয়ে নেয়া ভাল না? কথা বললে বুঝতে পারবেন, আমাদের বিভেদ যতটা বড় ভাবছেন, আসলে ততটা নয়।’
‘আমাকে যারা খুন করবার চেষ্টা করছে, তাদের সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি আছে আমার।
‘একটু ভুল হচ্ছে আপনার। কেউ কেউ আপনাকে খুন করতে চাইছে বটে, কিন্তু কেউ কেউ আবার বাঁচাতেও চাইছে।’
‘কীসের জন্য? কেমিক্যাল থেরাপি দেবার জন্য? যাতে আমি কী আবিষ্কার করেছি, তা জেনে নেয়া যায়?’
‘যা জেনেছেন, তা অর্থহীন। ওসব জেনে কিছুই করতে পারবেন না আমাদের বিরুদ্ধে। মাঝখান থেকে প্রাণটা হারাবেন! এমনিতেই শত্রুর অভাব নেই আপনার। আমেরিকান-রা আপনাকে জেনারেল ওয়ার্নারের হত্যার আভযোগে খুঁজছে। ড. ইভানোভিচের খুনি কুয়াশা-র সঙ্গে হাত মেলানোয় রাশান-রাও নাখোশ আপনার উপর। দেখামাত্র আপনাকে খুন করবে ওরা; পরিস্থিতি আপনার প্রতিকূলে, মি. রানা। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ামাত্র আপনাকে খতম করে দিতে পারি আমরা… এমনকী ভিতরেও!’
দ্রুত রেস্টুরেন্টের অভ্যন্তরে নজর বোলাল রানা, সন্দেহজনক চরিত্র খুঁজছে। বেশ ক’জনকেই তার সন্দেহজনক মনে হলো, কিন্তু নিশ্চিত হবার উপায় নেই। বাইরের ভিড়ে ক’জন ওঁৎ পেতে আছে, কে জানে। সন্দেহ নেই, ফাঁদে পড়ে গেছে ও। লড়াই করতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু তাতে রেস্টুরেন্টে উপস্থিত নিরীহ মানুষ আহত-নিহত হবে! কী করা যায়? বিএসএস চিফের কাছে সাহায্য চাইতে পারে, তবে নির্ধারিত সময়ের আগে ফোন করা যাবে না তাঁকে। ঘড়ি দেখে নিল, এখনও চার মিনিট বাকি। সময়টুকু নষ্ট করতে হবে এখানে।
‘দেখা করতে চাও আমার সঙ্গে?’ টেলিফোনের লোকটাকে বলল রানা। ‘তা হলে গ্যারান্টি দাও, আমাকে এখান থেকে নিরাপদে বেরুতে দেবে।’
‘দিচ্ছি গ্যারান্টি।’
মুখের কথায় বিশ্বাস করি না। তোমার অন্তত একজন লোককে আইডেন্টিফাই করো রেস্টুরেন্টের ভিতর।’
‘একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার, মি রানা,’ কাটা কাটা স্বরে বলল লোকটা। ‘তোমাকে এখানে আটকে রাখতে পারি আমরা, তারপর খবর দিতে পারি অ্যামেরিকান এম্বাসিতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়বে তুমি। যদি কোনোভাবে আমেরিকানদের ফাঁকি ও দাও, বাইরে আমরা অপেক্ষায় থাকব তোমার… আউটার সার্কেলে। কোনও চান্স নেই তোমার।
ব্যস্ত চোখে ঘড়ি দেখল রানা-দশটা বারো। আরও তিন মিনিট।
‘তা হলে তো বলব, আমার সঙ্গে দেখা করবার ব্যাপারে তেমন কোনও ইচ্ছেই নেই তোমাদের,’ বাঁকা সুরে বলল ও। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে, ফোনের লোকটা স্রেফ একজন বার্তাবাহক; ওকে জ্যাও ধরে নিয়ে যাবার নির্দেশটা অন্য কেউ দিয়েছে।
‘আমি এখনও বলব… ‘
‘একজনকে চিনতে চাই আমি,’ বাধা দিয়ে বলল রানা। ‘নইলে কোথাও যাচ্ছি না!’ দৃঢ়তা ফোটাল কণ্ঠে
কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে রইল অপরপক্ষ। তারপর শান্ত গলায় বলল, ‘বেশ, আশপাশে তাকান : চোয়ালভাঙা একজনকে দেখবেন, গায়ে খয়েরি কোট… ‘
‘দেখতে পাচ্ছি,’ বলল রানা। পাঁচ টেবিল দূরে বসে আছে লোকটা।
‘শুভ। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোন। ও আপনার পিছনে থাকবে। ও-ই আপনার গ্যারান্টি।
দশটা তেরো বাজে। আর দু’মিনিট।
‘ওর নিজের কোনও গ্যারান্টি আছে? আমার সঙ্গে ওকেও যে
খুন করে ফেলবে না ভোমরা, সেটা চানছি কীভাবে?’
‘ওহ্, কাম অন, মি. রানা!’
‘হেসো না। তোমার নাম কিন্তু এখনও জানা হলো না।’
‘বলেছি তো, ওটা গুরুত্বহীন।’
কিছুই গুরুত্বহীন নয়। নামটা জানতে চাই আমি।
‘স্মিথ। মেনে নাও।’
দশটা চোদ্দ। এক মিনিট। সময় হয়েছে।
‘ঠিক আছে, প্রস্তাবটা ভেবে দেখতে দাও আমাকে। নাশতাও শেষ করতে চাই।’
লোকটাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না ও। নামিয়ে রাখল রিসিভার। উল্টো ঘুরে এগিয়ে গেল চোয়ালভাঙার কাছে। আড়ষ্ট হয়ে উঠল লোকটা, এক হাত চলে গেল ওভারকোটের তলায়।
‘রিল্যাক্স!’ কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখল রানা। ‘আমাকে বলা হয়েছে, তুমি নাকি বাইরে নিয়ে যাবে আমাকে। আর হ্যাঁ… যাবার আগে একটা ফোনও করতে হবে। আমাকে নাম্বার দেয়া হয়েছে।’
বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছে না চোয়ালভাঙা। তাকে ওই অবস্থায় রেখে উল্টো ঘুরল রানা, ফিরে এল ফোনের কাছে রিসিভার তুলে দ্রুত ডায়াল করল। কয়েকবার রিং হলো, তারপর কল রিসিভ করলেন লংফেলো… সম্ভবত স্ক্র্যাম্বলার চালু করবার জন্য সময় নিয়েছেন।
তাড়াতাড়ি কথা সারতে হবে আমাদেরকে, বিএসএস চিহ্ন মুখ খোলার আগেই বলে উঠল রানা। ‘আমার খোঁজ পেয়ে গেছে ভরা বিপদে পড়ে গেছি।’
‘কোথায় ভূমি?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন লংফেলো। ‘আমি সাহায্য পাঠাচ্ছি।’
ঠিকানা বলল রানা। ‘দুটো সাইরেন দরকার আমার… রেগুলার পুলিশ কার হলেই চলবে। রেস্টুরেন্টে পলাতক আইরিশ বিপ্লবী আছে বলে জানাবেন ওদেরকে।
‘ধরে নাও রওনা হয়ে গেছে। আরেকটা ফোন তুলে হড়বড় করে নির্দেশ দিলেন লংফেলো।
‘উইটিংহ্যামের খবর কী?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আগামীকাল সন্ধ্যায়… বেলগ্রাভিয়ায় ওঁর বাড়িতে যেতে হবে। আমিই নিয়ে যাব তোমাকে।’
‘শিডিউলটা একটু এগিয়ে আনা যায় না?’
‘মাথা খারাপ? কাল যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছি, সেটাও সাত জনমের ভাগ্য। অ্যাডমিরান্টি থেকে একটা ভুয়া রেকমেণ্ডেশন দিতে হয়েছে ওটার জন্য।’ দম নেবার জন্য থামলেন লংফেলো। ‘বাই দ্য ওয়ে, তোমার সন্দেহ ঠিক-কাল রাতে আমি কোথায় ছিলাম, সেটা জানার চেষ্টা করেছে কারা যেন। হোম অফিসের নাম করে ফোন করেছিল আমার সেক্রেটারির কাছে। কী নাকি জরুরি খবর দিতে চেয়েছিল।’
‘তারপর?’
অ্যাডমিরাল্টি অফিসে একটা মিটিঙের কথা বলে বেরিয়েছিলাম… ওটাই জানিয়েছে আমার সেক্রেটারি!’
‘ওরা যদি ভেরিফাই করার চেষ্টা করে?’
‘ভয়ের কিছু নেই। তোমার সঙ্গে দেখা করে সোজা চলে গিয়েছিলাম অ্যাডমিরাল্টি অফিসে। রাত এগারোটার সময় সবাইকে দেখিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
‘ভাল করেছেন, স্যর। ইয়ে… উইটিংহ্যামকে আমার নাম বলেননি তো?’
‘উঁহুঁ। ভুয়া নাম দিয়েছি। তোমার মিটিং যদি ফলপ্রসূ না হয়, যথেষ্ট ঝামেলা পোহাতে হবে আমাকে
ঝামেলা এমনিতেও কম হবে না, ভাবল রানা। ফেনিস যদি সত্যিই ওর প্রতিটা পদক্ষেপের উপর নজর রাখে, তা হলে ইতিমধ্যেই বিপদ ঘনিয়ে এসেছে ফরেন সেক্রেটারি আর বিএসএস চিফের উপরে।
ও জানতে চাইল, ‘আগামীকাল কখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে?’
রাত আটটায়। তবে যাবার আগে ফোন করে যেতে বলেছে। তোমাকে সাতটার দিকে তুলে নেব আমি। কোথায় থাকবে?’
‘এখুনি বলতে পারছি না। আজ বিকেলে ফোন করে জানা আপনাকে… এই ধরুন, সাড়ে চারটার দিকে। অসুবিধে নেই তো?’
উঁহুঁ। বাই চান্স যদি না পাও আমাকে, আসল জায়গার দু’ব্লক দূরের অ্যাড্রেস দিয়ে রেখো আমার সেক্রেটারিকে। আমি খুঁজে নেব তোমাকে।
‘গতকাল আপনার ডিকয়-দেরকে যারা অনুসরণ করছিল, তাদের ছবি জোগাড় করতে পেরেছেন?’
‘দুপুরের মধ্যে আমার ডেস্কে পৌছুনোর কথা।’
‘আচ্ছা। এক কাজ করুন… ভেবেচিন্তে অফিশিয়াল একটা অজুহাত দাঁড় করান—কেন আমাকে নিয়ে ফরেন সেক্রেটারির বাড়িতে যেতে পারবেন না আপনি। তার বদলে প্রস্তাব দেবেন ওঁকেই বিএসএস হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসবার… আপনি নিজেই নিয়ে আসবেন বলে কথা দেবেন।’
‘হোয়াট।’ চমকে উঠলেন লংফেলো।
ব্রুনার কথা শেষ হয়নি। না শোনার ভান করে ও বলে চলল, ‘….কিন্তু হেডকোয়ার্টারে না, ওকে আপনি নিয়ে আসবেন কনৌট হোটেলে। রুম নাম্বার এখুনি বলতে পারছি না, ওটা বিকেলে ফোন করে জানাব। আপনি যদি না থাকেন, তা হলে সেক্রেটারিকে অন্য একটা নাম্বার দেব। সেটা থেকে বাইশ বিয়োগ করে নেবেন।’
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, রানা?’ হতভম্ব গলায় বললেন লংফেলো। ‘সোজা কথায় ফরেন সেক্রেটারিকে কিডন্যাপ করাতে চাইছ আমাকে দিয়ে। কেন?’
দুঃখিত, স্যর,’ ব্রিত গলায় বলল রানা। কিন্তু অনুরোধটা করছি আপনাদের দু’জনের নিরাপত্তার জন্যেই। প্লিজ… অমত করবেন না। আপনি ছাড়া আর কারও সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরুবেন না উইটিংহ্যাম।’
‘তুমি দেখছি আমাকে জেলের ভাত না খাইয়ে ছাড়বে না! গম্ভীর গলায় বললেন লংফেলো। ঠিক আছে, ব্যাপারটা ভেবে দেখব আমি। কিন্তু এখুনি কোনও কথা দিচ্ছি না।’
পুলিশের সাইরেনের আওয়াজ ভেসে এল বাইরে থেকে। রানা বলল, ‘আপনার পাঠানো সাহায্য চলে এসেছে। রাখি, পরে কথা হবে। ধন্যবাদ।’
ফোন রেখে ফেনিসের খুনির কাছে ফিরে এল ও।
কার সঙ্গে কথা বললে?’ সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল চোয়ালভাঙা। আমেরিকান উচ্চারণ।
‘নাম বলেনি,’ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল রানা। কিন্তু ইন্সট্রাকশন পেয়েছি। আমাদেরকে এখুনি বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।
‘কেন?’
‘ঝামেলা দেখা দিয়েছে। তোমাদের একটা গাড়িতে রাইফেল পেয়েছে পুলিশ, ওটা আটক করা হয়েছে। এই এলাকা আইআরএ টেরোরিস্টদের আখড়া, জানো না বুঝি? চলো পালাই।’
প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল চোয়ালভাঙা। ডানদিকে মুখ ঘুরিয়ে সামান্য মাথা ঝাঁকাল। সঙ্গে সঙ্গে আরেক টেবিল থেকে উঠে পড়ল এক মাঝবয়েসী মহিলা, তার কাঁধে একটা বড়-সড় পার্স।
হাঁটো!’ বলল চোয়ালভাঙা। ‘আমরা তোমার পিছনে থাকব।’
‘এক মিনিট,’ বলে উঠল রানা। ‘আমাকে বিল মেটাতে হবে।’
‘তাড়াতাড়ি করো।’
কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল রানা। আড়চোখে রেস্টুরেন্টের কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে নজর রাখছে। পুলিশের দুটো কার উদয় হয়েছে রাস্তার মোড়ে, এগিয়ে আসছে এদিকে। ইচ্ছে করে একটু সময় নিল ও বিল মেটাতে। বড় নোট দিল, যাতে ওটা ভাঙাতে সময় নেয় ক্যাশিয়ার। একটু পর খুচরো টাকা নিয়ে ও যখন উল্টো ঘুরল, তখন পুলিশের গাড়িদুটো রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ইউনিফর্মধারী চারজন অফিসার বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।
হাসি ফুটল রানার ঠোটে। হাঁটতে শুরু করল ও। একটু দূরত্ব রেখে ওকে অনুসরণ করল চোয়ালভাঙা আর মাঝবয়েসী মহিলা! হিসেবি কদম ফেলে দরজার কাছে পৌঁছুল ও, ঠিক যখন পুলিশ অফিসার-রাও পৌঁছেছে ওপাশে। দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল রানা, মুখোমুখি হলো তাদের, পরমুহূর্তে ঝট্ করে উল্টো ঘুরল। চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওই যে… ওরা! ওদের কাছে অস্ত্র আছে!’
থমকে দাঁড়াল দুই দুর্বৃত্ত। হতবাক হয়ে গেছে। সংবিৎ ফেরার আগেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ অফিসাররা। ব্যাটনের আঘাত করে শুইয়ে ফেলল মেঝেতে, পরাতে শুরু করল হাতকড়া।
রানা ওসব দেখছে না। চিৎকার দিয়েই ছুটতে শুরু করেছে ও চোখের পলকে পেরিয়ে এল দুই ব্লক। একটা গলিতে পৌঁছে থামল দম নেবার জন্য। পিছনটা দেখে নিল একই সঙ্গে। না, কেউ পিছু নেয়নি। রাস্তার ওপাশে দেখা যাচ্ছে একটা বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এক ছুটে ওটার ভিতরে গিয়ে ঢুকল ও। ট্রায়াল রুম বেছে নিল একটা। ওটায় ঢুকে দরজা আটকাল, তারপর সেলফোন বের করে রিং করল প্যারিসে। কুয়াশাকে সতর্ক করে দিতে হবে। লণ্ডনে পৌছুবার পর নাইটস্ব্রিজের রুমিং হাউসে আসবার কথা তার… রানার সঙ্গে দেখা করবার জন্য। কিন্তু ও-জায়গার খোঁজ জেনে গেছে ফেনিস। কুয়াশা এলেই আটকা পড়বে তাদের হাতে।
দু’বার রিং হলো, তারপর তোলা হলো ফোন। ওপাশ থেকে ভেসে এল কুয়াশার গলা। ‘ইয়েস?’
‘আমি…’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।’
‘কপাল ভাল আমাকে পেয়েছ।’ একটু অস্বাভাবিক মনে হলো কুয়াশার কণ্ঠ। যেন কথা বলতে দ্বিধা করছে। ‘একটু পরেই বেরিয়ে যাবার কথা আমার।
কপাল সত্যিই ভাল,’ রানা বলল। ‘কিন্তু… কী হয়েছে আপনার?’
‘কই… কিছু না তো। কেন?’
‘অদ্ভুত শোনাচ্ছে আপনার গলা। সোনিয়া কোথায়? ও ফোন ধরল না কেন?’
‘বাজার করতে গেছে। এসে যাবে শিগগির। গলা যদি অদ্ভুত শোনায়, তার কারণ—ফোন ধরতে পছন্দ করি না আমি।’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে এসেছে কুয়াশার। যুক্তিসঙ্গত কথা বলছে। ‘তোমার কী হয়েছে, সেটাই বলো! অসময়ে ফোন করলে কেন?’
‘এখানে পৌঁছুনোর পর জানবেন। তবে আপাতত নাইটস্ব্রিজের কথা ভুলে যান।’
‘তা হলে তোমাকে পাব কোথায়?’
সাঙ্কেতিক ভাষায় আরেকটা জায়গার নাম বলল রানা।
‘ঠিক আছে, ওখানেই দেখা হবে’ আলাপ শেষ করার সুরে বলল কুয়াশা।
‘দাঁড়ান… সোনিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলব আমি। ওকে বলবেন আধঘণ্টা পর ফোনের কাছে থাকতে।’
কয়েক মুহূর্তের জন্য নীরব হয়ে গেল কুয়াশা। তারপর বলল, ‘আসলে… বাজারশেষে ওর বেড়াতে যাবার কথা। লুভার মিউজিয়াম নাকি দেখেনি কোনোদিন। তাই ওকে ঘুরে আসতে বলেছি আমি। ফিরতে কতক্ষণ লাগবে, বলা মুশকিল। চিন্তা কোরো না, কিচ্ছু হয়নি ওর। রাখি :
রানাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইন কেটে দিল কুয়াশা।
থম্ মেরে গেল রানা। ও-কথা বলল কেন কুয়াশা? কিছু হয়নি সোনিয়ার… তারমানে কি আসলে কিছু হয়েছে? ও লুভার মিউজিয়ামে যাবে কেন? রু দ্য বাখ্-এর অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরুবারই তো কথা নয় ওর। যত ভাবল, ততই বদ্ধমূল হলো ধারণাটা-প্যারিসেও বিপদ দেখা দিয়েছে। যে-ভাবে ওকে লণ্ডনে খুঁজে বের করেছে ফেনিস, একই ভাবে ওখানেও হয়তো খুঁজে বের করেছে ওরা কুয়াশাকে। কী ঘটেছে ওখানে? কোনও ধরনের হামলা? আহত হয়েছে সোনিয়া?
জানার উপায় নেই। নিষ্ফল হতাশায় ছটফট করতে লাগল রানা।