এগারো
কুয়াশার কানের পাশ দিয়ে ছুটে গেল বুলেট। ব্রুনাকে জাপটে ধরে মেঝেতে পড়ে গেল ও। গড়ান দিয়ে মহিলাকে নিয়ে এল নিজের দেহের উপর-মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে তাকে। দেখা যাক, মনিবের উপর গুলি চালানোর সাহস আছে কি না খুনির।
দেখা গেল নেই। দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে এল সে, বোধহয় ভাবছে ব্রুনাকে ছাড়িয়ে নেয়া সম্ভব কি না। এটাই চাইছিল কুয়াশা। আলিঙ্গনের মধ্যে আটকে রাখা মহিলাকে ছুঁড়ে দিল খুনির দিকে। ওজন বেশি নয় ব্রুনার, খড়ের পুতুলের মত আছড়ে পড়ল লোকটার গায়ের উপর। তাল হারিয়ে দু’জনেই হুড়মুড় করে ভূপাতিত হলো।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা। ব্রুনাকে শরীরের উপর থেকে সরিয়ে সিধে হবার চেষ্টা করছিল খুনি, ছুটে গিয়ে তার কবজিতে একটা পেনাল্টি কিক মারল। হাড় ভাঙার মড়মড় আওয়াজ হলো, ব্যথায় কাতরে উঠল লোকটা, নাইন মিলিমিটারের পিস্তল উড়ে চলে গেল একদিকে। ঘাড় ধরে ব্রুনাকে তুলে আনল কুয়াশা, টান দিয়ে ফেলে দিল পিছনে। তারপর চড়ে বসল খুনির বুকে। নির্দয়ের মত ঘুসি চালাতে থাকল নাক-মুখে। উন্মাদ হয়ে গেছে, থামছে না এক মুহূর্তের জন্যও।
মারের চোটে রক্তাক্ত হয়ে গেল খুনির মুখ। ঠোঁট ফেটে গেল, বসে গেল নাক, ভাঙলো দাঁত, থেঁতলে গেল পুরো মুখের মাংস। ভুরুর চামড়া ছিঁড়ে নেমে এল চোখের উপর। নিজেকে সামলে নিয়ে পিছন থেকে হামলা করল ব্রুনা, চেষ্টা করল কুয়াশাকে নিজের অনুচরের উপর থেকে সরিয়ে আনতে, কিন্তু সফল হলো না। পাঁজরের নীচে কুয়াশার কনুইয়ের বেমক্কা এক আঘাত পেয়ে চোখে অন্ধকার দেখল, বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করতে করতে বসে পড়ল হাঁটু মুড়ে।
পরাস্ত খুনির চেহারার নকশা পাল্টে দিয়ে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা শান্ত ভঙ্গিতে কুড়িয়ে নিল নাইন মিলিমিটারের অটোমেটিকটা। ফিরে এসে ওটা তাক করল লোকটার পায়ের দিকে।
‘এগুলো আইভান শেভচেঙ্কোর জন্য,’ বলে দুই হাঁটুতে গুলি করল ও। ‘আর, এগুলো নাতালিয়ার জন্য।’ বলে দুই কনুই ও উড়িয়ে দিল।
হাড়ের জয়েন্ট গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়ায় অসহ্য ব্যথায় কাতরাচ্ছে খুনি, নির্বিকার রইল কুয়াশা। পিস্তলের নল ঘুরে গেল পেটের দিকে। শীতল গলায় বলল, ‘আর এগুলো হলো বোনাস!’
লোকটার পেটে পিস্তলের ম্যাগাজিন খালি করল ও। গোঙানির বেশি আর কিছু করতে পারল না খুনি। সীমাহীন কষ্টে পুরো নার্ভ-সিস্টেম অচল হয়ে যেতে বসেছে। তিলে তিলে মরবে এভাবে। এরচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু আর কিছু হতে পারে না।
নাইন মিলিমিটার ফেলে দিয়ে এবার নিজের পিস্তল তুলে নিল কুয়াশা। মন দিল ব্রুনা ভরগেনের দিকে। এখনও পাঁজরের ব্যথায় বাঁকা হয়ে আছে সে। চুল ধরে মহিলাকে দাঁড় করাল ও, পিস্তল ঠেকাল ঘাড়ে।
‘ছাড়ো আমাকে!’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রুনা।
‘দুটো পথ আছে তার জন্যে,’ কঠিন গলায় বলল কুয়াশা। ‘হয় আমার কথা শোনো, নয়তো তোমার সৈনিকদের মত গিলে ফেলো সায়ানাইড পিল।
‘আমার কাছে সায়ানাইড পিল নেই। নেতারা আত্মহত্যা করে না।’ শরীর মোচড়াল ব্রুনা। ‘মরণ যদি কারও হয় এখানে, সেটা হবে তোমার!’
হয়তো,’ স্বীকার করল কুয়াশা। কিন্তু একা যাব না আমি, তুমিও সঙ্গে যাবে। নড়াচড়া বন্ধ করো, এখুনি গুলি চালাবার ইচ্ছে নেই আমার।
স্থির হয়ে গেল ব্রুনা। ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী চাও তুমি?’
‘ইনফরমেশন।’
‘গুড, আমিও চাই তা। যদি বাঁচতে চাও তো বলো, রাখাল বালক সম্পর্কে কী জানো তুমি?’
মুঠোয় ধরা চুলে টান বাড়াল কুয়াশা। ‘প্রশ্ন যা করবার, তা আমি করব।’
‘বোকামি করছ তুমি, কুয়াশা। বাঁচার কোনও উপায় নেই । তোমার! আমাকে সহযোগিতা করলে ভাল করবে।’
পিস্তলের ব্যারেল দিয়ে মহিলার গালে খোঁচা মারল কুয়াশা। ‘পরিস্থিতি কিন্তু উল্টো কথা বলছে।’
কাঁধ ঝাঁকাল মা। ‘বেশ, তা-ই ভেবে যদি সন্তুষ্ট থাকো, তাতে আমার কী?’ মুখ ঘুরিয়ে নিল। ‘কী জানতে চাও তুমি?’
‘ফেনিসের উদ্দেশ্য কী?’
‘শৃঙ্খলা।’
‘অথচ দুনিয়াকে বিশৃঙ্খলার অতলে তলিয়ে দিছে তোমরা!’
‘ওর মাঝ দিয়েই আবার ফিরে আসবে শৃঙ্খলা… আমরাই ফিরিয়ে আনব সেটা। যাদের নিয়ন্ত্রণে এই পৃথিবীর থাকা উচিত, তাদের মাধ্যমে!’
‘লেকচার শুনতে চাই না। তোমাদের প্ল্যান জানতে চাই আমি।’
‘সেটা একমাত্র রাখাল বালক জানেন। আমরা শুধু ছোট ছোট মিশন সম্পন্ন করি।’
‘কে এই রাখাল বালক? কী তার পরিচয়?’
‘সেটা কোনোদিনই তুমি জানতে পারবে না আমার কাছ থেকে।’
‘বলতেই হবে তোমাকে! নইলে খারাবি আছে তোমার কপালে।’
‘টরচার করবে?’ হাসল ব্রহ্মা। ‘সময় কোথায় তোমার? চ্যাপেলটা মাটির তলায় বলে গুলির শব্দ হয়তো শোনা যায় না বাইরে, তার মানে এই নয় যে অনন্তকাল থাকতে পারবে এখানে। খুব শীঘ্রি কেউ না কেউ আমার খোঁজ নিতে আসবে।’
‘সেক্ষেত্রে এস্টেট থেকে বেরিয়ে যাব আমরা… তুমিই নিয়ে যাবে আমাকে। ভেবো না মুখ বন্ধ রাখলেই গোপন থাকবে সবকিছু।’ মেঝেতে পড়ে থাকা খুনির দিকে তাকাল। ‘ওর পেটে গুলি করেছি কেন, জানো? মরার আগে যেন জানিয়ে যেতে পারে কী ঘটেছে। ভরগেন সাম্রাজ্যের মাখাকে নিয়ে যাচ্ছি আমি, পরিস্থিতি সামলানোর জন্য কী করে ফেনিস, তা দেখব আমি আড়াল থেকে। মুখ খোলানোর জন্য কাকে এরপর ধরতে হবে, সেটা বুঝাতে পারব তখন।
‘না-আ!’ প্রতিবাদ করল ব্রুনা। ‘যাব না আমি তোমার সঙ্গে।’
‘তা হলে তুমি মরবে,’ কাটা কাটা স্বরে বলল কুয়াশা। ‘আমাকে নিয়ে ভেবো না, একাকী এখানে ঢুকতে যখন পেরেছি, বেরিয়েও যেতে পারব।’
‘অসম্ভব! চ্যাপেলে আসার আগে অর্ডার দিয়ে এসেছি আমি—কাউকে যেন এস্টেট থেকে বের হতে দেয়া না হয়।
‘বেরুতে যাচ্ছে কে?’ নিজের পোশাক দেখাল কুয়াশা। ‘ইউনিফর্ম পরা একজন গার্ড… নিজের পোস্টে ফিরবে। সেখান থেকে গায়েব হয়ে যাবে রাতের অন্ধকারে। কে সন্দেহ করবে আমাকে? আমি বুঝতে পেরেছি, গার্ড-রা ফেনিসের লোক নয়; সাধারণ প্রহরী-ধনী লোকজনকে পাহারা দেয়াই ওদের একমাত্র পেশা।’ পিত্তলটা ব্রুনার ঘাড়ে ভালমত চেপে ধরল কুয়াশা। এখন .. তুমিই সিদ্ধান্ত নাও- আমার সঙ্গে যাবে, নাকি পড়ে থাকবে পোষা কুকুরটায় পাশে।
চোখের দৃষ্টি বদলে গেল মহিলার। হার মানল। নিচু গলায় বলল, ‘বাবার গাড়িটা ব্যবহার করতে পারি আমরা। চলো।’
‘কোনও চালাকি নয়, ব্রুনা!’ হুমকি দিল কুয়াশা :
‘তার প্রয়োজন পড়বে না। তুমি আমার কাছে ইনফরমেশন চাইছ… আমিও তোমাকে চমকে দেবার মত একটা তথ্য জানি। ওটা শোনার পর বুঝতে পারবে, লড়াই করা বৃথা। আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় তোমার নেই…’
‘যথাসময়ে সেটা দেখা যাবে,’ বলে ব্রুনার চুল ছেড়ে দিল কুয়াশা। ‘হাঁটো। আমি তোমার পিছনে থাকছি।’
.
গ্যারাজ থেকে ওয়ালথার ভরগেনের লিমাজিনটা ধার করল ওরা। ড্রাইভিং সিটে থাকল ব্রুনা, কাঁধে হাত রেখে ঘনিষ্ঠ ভঙ্গিতে তার পাশে বসল কুয়াশা। ইতিমধ্যে খুলে ফেলেছে গার্ডের জ্যাকেট, ঊর্ধ্বাঙ্গে স্রেফ একটা সাদা শার্ট ছাড়া আর কিছু নেই এ-মুহূর্তে। হাবভাব দেখে মনে হয়ে ব্রুনা ভরগেনের নতুন প্রেমিক। মহিলার কানের কাছে মুখ নিয়ে রাখল ও; নীচে, পিস্তলের মাজল ঠেকিয়ে রাখল তার পাঁজরের একপাশে।
ধীরগতিতে এস্টেটের মূল ফটকে পৌঁছল লিমাজিন। দু’জন গার্ড এগিয়ে এল আরোহীর পরিচয় জানার জন্য। কয়েক সেকেণ্ডের জন্য ট্রিগারের উপর প্রস্তুত থাকল কুয়াশার আঙুল। কিন্তু না, কোনও কৌশল খাটাবার চেষ্টা করল না ব্রুনা, হাতের ইশারায় গেট খুলতে বলল গার্ডকে। মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল তারা, একটু পর মৃদু যান্ত্রিক গুঞ্জন তুলে সরে গেল পাল্লা। গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল ব্রুনা।
বাঁয়ে মোড় নিতে যাচ্ছিল সে, খপ্ করে এক হাতে স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরল কুয়াশা, ঘুরিয়ে দিল ডানে। মাতালের মত দুলে মুখ ঘোরাল লিমাজিন, রাস্তায় সিধে হবার পর হাত সরিয়ে আনল। সঙ্গে সঙ্গে আবার বাড়িয়ে দিল বাম পা, ব্রুনার পায়ের উপর দিয়ে চেপে ধরল অ্যাকসেলারেটর। হু হু করে ছুটতে শুরু করল গাড়ি।
‘অ্যাই!’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রুনা! কী করছ তুমি?’
‘ফাঁদ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি,’ শান্ত গলায় বলল কুয়াশা। ‘এসেনের রাস্তায় নিশ্চয়ই আরেকটা গাড়ি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য?’
মুখ থেকে রক্ত সরে গেল ব্রুনার, কুয়াশার সন্দেহই ঠিক তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘আ… আমি…’
‘রিল্যাক্স। একেবারে শান্ত-সুবোধ মেয়ে হয়ে যাবে, তা আশা করিনি আমি। কিন্তু এটাই তোমার লাস্ট চান্স।’ পা সরিয়ে আনল কুয়াশা। ‘ঠিকমত ড্রাইভ করো। ষাটের নীচে যেন না নামে স্পিড।’
জঙ্গলের মাঝ দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে দশ মাইল গেল লিমাজিন। এরপর একটা ওয়াই-জাংশান। ডানের পথ ধরতে চাইছিল ব্রুনা; কিন্তু স্টিয়ারিং ধরে আবার আগের পদ্ধতি অনুসরণ করল কুয়াশা, গাড়িকে ঘুরিয়ে নিল বাঁয়ের পথটাতে।
‘অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবে তুমি!’ রাগী গলায় বলল ব্রুনা। ‘কোনদিকে যেতে চাও, সেটা আমাকে বললেই হয়!’
‘তোমাকে কিছুই বলতে বাধ্য নই আমি।’ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল কুয়াশা। জঙ্গল ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে লিমা জিন দু’পাশে এখন ফসলের খেত, কোথাও কোথাও ফাঁকা মাঠ। সামনের একটা খালি জায়গার দিকে আঙুল তাক করল। ‘রাস্তা থেকে নামো। ওখানে নিয়ে দাঁড় করাও গাড়ি।
‘কী?’
পিস্তল উঁচু করে ব্রুনার কপালের পাশে ঠেকাল কুয়াশা। ‘এক কথা দু’বার বলতে পছন্দ করি না আমি।’
স্টিয়ারিং ঘোরাল ব্রুনা। খালি জায়গাটায় পৌঁছে ব্রেক কষল। হাত বাড়িয়ে ইগনিশন বন্ধ করল কুয়াশা, চাবিটা খুলে নিয়ে পকেটে ভরল। পিস্তলের ইশারায় নামতে বলল বন্দিনীকে। নিজেও নামল। দু’জনে শুরু করল হাঁটতে। মাঠের মাঝখানে পৌঁছে থামল। মাথার উপরে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ, দূরে একটা ফার্মহাউস চোখে পড়ল। কোনও আলো জ্বলছে না, সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে ওখানকার বাসিন্দারা।
মৃদু হাওয়ায় ঢেউ উঠেছে গমের খেতে। সেদিকে তাকিয়ে নার্ভাস গলায় ব্রুনা জানতে চাইল, ‘এখানে কী?’
‘একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে,’ শীতল গলায় বলল কুয়াশা। ‘দেখব, আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ করবার সাহস আছে কি না তোমার।’
ভয় দেখা দিল ব্রুনার চোখের তারায়। নার্ভাস গলায় বলল, ‘পাগলামি কোরো না, কুয়াশা। আমাকে কে খুন করে কোনও লাভ হবে না তোমার! অনেক এগিয়ে গেছি আমরা…. পৃথিবীর মঙ্গলের জন্যই বেঁচে থাকা দরকার এখন আমাদের।’
‘ভুল। খুনিদের হাতে কারও কোনদিন মঙ্গল হতে পারে না।’
‘কেন হবে না? খুনের মাধ্যমে যদি মন্দ লোকদেরকে সরিয়ে দেয়া যায়, সেটা মঙ্গল নয়? সময় আছে, কুয়াশা, যোগ দাও আমাদের সঙ্গে। জীবন বদলে যাবে তোমার।’
‘লোভনীয় প্রস্তাব। কিন্তু পুঃখিত, রাজি হতে পারছি না আমি।’
‘তা হলে নিজেরই ক্ষতি করছ। বলেছি তো, আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই তোমার হাতে…
‘ও হ্যাঁ… আমাকে চমকে দেবে বলেছিলে। কী সেটা?’
‘মাসুদ রানা মারা গেছে, কুয়াশা। ‘তুমি এখন একা!’
সত্যি সত্যি চমকে উঠল কুয়াশা। এ কী শুনছে! রানা মারা গেছে? কখন? কীভাবে? তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ব্রুনার মুখের দিকে না, ধাপ্পা দিচ্ছে বলে মনে হলো না।
‘কোথায় মারা গেছে ও? কবে?’ শান্ত স্বরে জানতে চাইল ও।’
‘ওয়াশিংটনে। কয়েক দিন আগে… রক ক্রিক পার্কে।’
ধন্দে পড়ে গেল কুয়াশা। যে ঘটনার কথা বলছে মহিলা, সেখানে ওর নিজেরও ভূমিকা ছিল। অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল ও আর রানা। হামলা একটা চালানো হয়েছিল বটে, অ্যাডমিরালও আহত হয়েছেন, কিন্তু বহাল তবিয়তেই ফিরে এসেছে ওরা দু’জন। তা হলে …
হঠাৎ বুঝতে পারল কুয়াশা, ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে ব্রুনা ভরগেনকে? কে দিয়েছে। কেন? তবে কি ফেনিসের ভিতর থেকে কেউ সাহায্য করতে চাইছে ওদেরকে সেজন্যেই প্রচার করেছে রানার মৃত্যুর মিথ্যে সংবাদ? ব্যাপারটা খতিয়ে দেখা দরকার।
ওর নীরবতার ভুল অর্থ করল ব্রুনা। নার্ভাসনেস দূর হয়ে গেল চেহারা থেকে। বলল, ‘বুঝতেই পারছ, তুমি একা। কিছুই করতে পারবে না আমাদের বিরুদ্ধে। শত্রুতা ভুলে গিয়ে হাত মেলালেই ভাল করবে। তুমি একটা প্রতিভা, কুয়াশা। তোমার মত লোকের প্রয়োজন আছে আমাদের সংগঠনে।’
মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল কুয়াশা। ঠিক আছে, একটু বাজিয়ে দেখা যাক। বলল, ‘হুম, মনে হচ্ছে ঠিক কথাই বলছ তুমি। কিন্তু আমাকে কনভিন্স করতে চাইলে কোনও কিছুই গোপন রাখা চলবে না। ফেনিস সম্পর্কে সবকিছু বলতে হবে তোমাকে। তোমাদের উদ্দেশ্য, কাজের ধারা, রাখাল বালকের পরিচয়… সব!’
‘অস্থির হবার কিছু নেই, ডার্লিং,’ হাসল ব্রুনা। একে একে কোট আর শার্টের বোতাম খুলল। কাপড় সরিয়ে দেখাল নিজের বুকের বৃত্তাকার উল্কি। আসলে প্রলোভিত করতে চাইছে শিকারকে। ‘এ-জিনিস যখন তোমার বুকেও শোভা পাবে, তখন মিলবে সব প্রশ্নের জবাব।’
‘গায়ে উল্কি করাবার আগ্রহ নেই আমার,’ চাঁছাছোলা গলায় জানাল কুয়াশা। ‘আমার কৌতূহল এখুনি মেটাতে হবে তোমাকে।’
‘গোঁয়ার্তুমি কোরো না…..’
ব্রুনার কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল ইঞ্জিনের ভারী আওয়াজে। কয়েক সেকেণ্ড পরেই চোখে পড়ল এক জোড়া হেডলাইট, রাস্তা ধরে গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা গাড়ি। লিমাজিনকে দেখতে পেয়ে দিক বদলাল, নেমে এল মাঠে। থামল পাশে গিয়ে। দরজা খুলে ঝটপট নামল চারটা ছায়ামূর্তি। সবার হাতে রাইফেলের অবয়ব দেখা গেল।
‘ওরা আমাদের খোঁজ পেয়ে গেছে,’ বলল ব্রুনা। ‘তোমার জবাব, কুয়াশা! বাঁচার কোনও উপায় নেই, বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই? পিস্তলটা দিয়ে দাও আমাকে। আমার একটা আদেশে জীবন বদলে যেতে পারে তোমার। নইলে নিশ্চিত মৃত্যু!’
শান্ত চোখে চারপাশ জরিপ করল কুয়াশা। গমখেতের মধ্যে কাভারের অভাব নেই। আলো-আঁধারিও যথেষ্ট সাহায্য করবে ওকে। পালিয়ে যেতে কষ্ট হবে না। ওটাই সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু কেন যেন নড়তে পারল না। ভাবছে ব্রুনার ভাষ্য নিয়ে। সত্যিই যদি ফেনিসের ভিতরে কোনও মিত্র থাকে, তার নাগাল পাওয়া দরকার। আর সেজন্যে একটাই পথ দেখতে পাচ্ছে।
‘কুইক!’ তাড়া দিল ব্রুনা। ‘তোমার সিদ্ধান্ত জানাও!’
বড় শ্বাস নিল কুয়াশা। পিস্তলটা উল্টো করে ধরে বাড়িয়ে দিল ব্রুনার দিকে। বলল, ‘আমি রাজি। তোমার লোকদেরকে থামতে বলো।’
‘এতদিনে একটা বুদ্ধিমানের মত কাজ করলে,’ সন্তোষ ফুটল ব্রুনার কণ্ঠে। কুয়াশার হাত থেকে পিস্তল নিয়ে উল্টো ঘুরল। এগোল কয়েক পা। গলা চড়িয়ে বলল, ‘অ্যাই, থামো তোমরা। গুলি করবার দরকার নেই।’
একটা ফ্ল্যাশলাইট জ্বলে উঠল, আলোকরশ্মি আছড়ে পড়ল মহিলার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেল কুয়াশা কী ঘটতে চলেছে। ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে ব্যস্ত মাত্র একজন, বাকি তিনজন ফ্রি। ওর গায়ে নয়, আলোটা ফেলা হয়েছে ব্রুনার গায়ে। একটাই অর্থ এর, নতুন আদেশ পেয়েছে খুনিরা। পাশের শস্যখেত লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল ও।
পরমুহূর্তে আগুন ঝরাল ভিন রাইফেল। এক পশলা বুলেট ছুটে এল. অরক্ষিত ব্রুনা ভরগেনকে লক্ষ্য করে। বুক-পেট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার, ভারী শেলের আঘাতে ছিটকে পড়ল কয়েক হাত দূরে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে দেহটা মাটি স্পর্শ করবার আগেই।
আলো ঘুরে গেল কুয়াশার খোঁজে, একই সঙ্গে রাইফেলের নল। হামাগুড়ি দিতে দিতে আবারও গুলির আওয়াজ শুনল কুয়াশা, ওর চারপাশে ধুলো ওড়াল ব্যর্থ বুলেট। নিচুস্বরে ভাগ্যকে গাল দিয়ে উঠল ও। পিস্তলটা হাতছাড়া করা মোটেই উচিত হয়নি।
কয়েক দফা গুলি ছুঁড়ে থেমে গেল খুনির দল। ধীরে ধীরে এগোল সামনে। সবার হাতেই এবার জ্বলে উঠেছে ফ্ল্যাশলাইট, খেতের মাঝখানে আলো ফেলে খুঁজছে কুয়াশাকে। মাঠের মাঝখানে ছোট একটা খোঁড়ল পেয়ে তাতে শরীর সেঁধাল কুয়াশা। গোড়া থেকে কয়েকটা গমগাছ উপড়ে এনে ঢেকে ফেলল দেহের উপরিভাগ। একটু পরেই শুনতে পেল পদশব্দ। ওর খুব কাছে এসে গেছে একজন খুনি।
লোকটাকে পেরিয়ে যেতে দিল কুয়াশা, তারপর ভূতের মত উঠে দাঁড়াল পিছনে। শব্দ শুনে ঘোরার চেষ্টা করল খুনি, কিন্তু তার ‘আগেই বাম হাতের ভাঁজে তার গলা আটকে ফেলল ও। রাইফেল কেড়ে নেবার চেষ্টা করল না, তার বদলে লোকটার কোমরের হোলস্টার থেকে তুলে নিল পিস্তল। গোলমালের আভাস পেয়ে ঘুরতে শুরু করেছে বাকি তিনটে ফ্ল্যাশলাইট, বিন্দুমাত্র দেরি না করে গুলি করল ও! একবার… দু’বার … তিনবার!
খুনিদের হাত থেকে সশব্দে এসে পড়ল ফ্ল্যাশলাইট আর রাইফেল… পিছু পিছু প্রাণহীন দেহ। হাতের ভাঁজে আটকানো লোকটার মাথার একপাশ আঁকড়ে ধরল কুয়াশা। প্রচণ্ড এক ঝটকায় মটকে দিল ঘাড়। অস্ফুট আর্তনাদ করল সে, যুক্তি দিতেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। থেমে গেছে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুয়াশা। লম্বা কদম ফেলে হাঁটতে শুরু করল লিমাজিনের দিকে!
.
ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর __ এয়ারলাইন্সের বিমানে দেখা গেল কুয়াশাকে, ইকোনমি ক্লাসের শেষ সারির একটা সিটে নিঃসঙ্গভাবে বসে আছে। আবারও নিয়েছে বৃদ্ধের ছদ্মবেশ। ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট কফি দিয়ে যাওয়ায় মৃদু স্বরে ধন্যবাদ জানাল, তারপর ডুবে গেল আপন চিন্তায়।
আর একঘণ্টা পর প্যারিসে ল্যাও করবে ও। কর্সিকান মেয়েটার সঙ্গে দেখা করে যোগাযোগ করবে রানার সঙ্গে। আলাদাভাবে এগোনোর পালা শেষ। এ-মুহূর্তে একসঙ্গে কাজ করা দরকার ওদের। খুব দ্রুত ঘটছে সব ঘটনা। তাল মেলানোর জন্য ইংল্যাণ্ডে রানার সঙ্গে যোগ দিতে হবে ওকে।
মারিয়া মাযোলা-র কাছ থেকে পাওয়া অতিধি-তালিকায় দুটো নাম ভেরিফাই করা হয়েছে বিয়ানি আর ভারাকিন। দু’জনের উত্তরাধিকারীই মৃত… খুন করা হয়েছে ওদের চোখের সামনে। পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বলি দেয়া হয়েছে তাদেরকে। এদের মৃত্যু একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিচ্ছে—কাউন্সিল-সদস্যদের বংশধররা খরচযোগ্য… ওরা মরে গেলেও কিছু যায় আসে না।- কাউন্ট বারেমির আদর্শের সত্যিকার উত্তরসূরি এখন অন্য কেউ… মার্সেলো বিয়াঞ্চি আর ব্রুনা ভরগেন তাদের বার্তাবাহক ছাড়া আর কিছু ছিল না। ওরা নিজেরাও হয়তো জানত না সেটা।
কথা হলো, তালিকার শেষ দুই অতিথির বংশধর … ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি নাইজেল উইটিংহ্যাম এবং অ্যামেরিকান কংগ্রেসের সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড-এর স্ট্যাটাস-ও একই ধরনের কি না। তাদের বুকেও কি পাওয়া যাবে বৃত্তাকার ওই উকি? এখন পর্যন্ত যা দেখেছে, তাতে তো মনে হচ্ছে ওটা অকালমৃত্যুর প্রতীক। __ প্রত্যেকেই মারা পড়েছে কুয়াশার চোখের সামনে।
রানা এখন ইংল্যাণ্ডে তদন্ত করছে। অথচ ওর-ই মৃত্যুর খবর ‘ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ফেনিস-সদস্যদের মধ্যে। কেন? কী উদ্দেশ্যে? কে চেষ্টা করছে রানাকে বাঁচাবার?
যতই ভাবছে, ততই খোঁট পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। পরিষ্কার বুঝতে পারছে কুয়াশা, এসব প্রশ্নের জবাব পেতে চাইলে রাখাল বালক নামের ওই রহস্যময় লোকটার কাছে পৌঁছুতে হবে ওদেরকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেদিকে এক কদমও এগোতে পারেনি ওরা। হতাশা অনুভব করল ও।
কফি শেষ করে কাপ নামিয়ে রাখল কুয়াশা। চোখ ফেরাল পাশে। আইলের ওপাশের সিটে বসেছে এসেনের এক ব্যবসায়ী। ঘুমিয়ে গেছে লোকটা, কোলের উপর পড়ে আছে আজকের খবরের কাগজ। ওটার উপরে ক্ষণিকের জন্য দৃষ্টি আটকাল কুয়াশার, পরমুহূর্তে ছলকে উঠল বুকের রক্ত। তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে টেনে নিল কাগজটা।
প্রথম পাতার নীচদিকে ছাপা হয়েছে হাইনরিখ বোহ্লের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। সঙ্গে শিরোনাম : অ্যাডভোকেট মার্ডারড্! তাড়াতাড়ি পড়ল খবরটা।
গতকাল রাত দশটায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে খুন হয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী হাইনরিখ বোহ্ল। পথরোধ করে তাঁর গাড়ি থামায় অজ্ঞাতনামা আততায়ী, উপর্যুপরি গুলি চালায় তাঁর বুকে-পেটে। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। প্রাথমিকভাবে পুলিশ এ ঘটনাকে পুরনো শত্রুতার জের বলে ধারণা করছে, তবে বিস্তারিত তদন্তের আগে কোনও ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা…
তীব্র অনুশোচনায় মাথা নাড়ল কুয়াশা। গতকাল স্ট্যাডওয়ান্ড থেকে ফেরার পর কয়েক দফা ফোন করেছিল ও বোলের কাছে; একবারও রিসিভ করা হয়নি সেই ফোন। শেষ পর্যন্ত ভয়েস মেইলে মেসেজ দিয়ে রেখেছিল…. সতর্ক করে দিয়েছিল তাকে। এখন বুঝতে পারছে, অযথাই চেষ্টা করেছে; হল অভ রেকর্ডস থেকে বাড়িই ফিরতে পারেনি বেচারা, পথেই শিকার হয়েছে ফেনিসের আততায়ীদের। ওর জন্য… শুধু ওরই জন্য মারা গেল আরেকজন নিরপরাধ মানুষ। সাহায্য চাইতে গিয়ে ও-ই তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে বোহ্লকে!
নিজেকে একেবারে অসহায় মনে হলো কুয়াশার। ফেনিসকে মনে হলো পৌরাণিক কোনও দানব… একটা মাথা কাটলে বেরিয়ে আসছে দশটা মাথা। কীভাবে লড়বে এই দানবের সঙ্গে? আদৌ কি একে পরাস্ত করা সম্ভব?
সময়ই তা বলে দেবে।