একুশ
থমকে গেছে রানা, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে পারছে না দৃশ্যটা। চার্লি… অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের দশ বছরের পুরনো শোফার… সে কীভাবে ফেনিসের লোক হয়? আচমকা ও বুঝতে পারল, রক ক্রিক পার্কে কে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। নুমা চিফের নিরাপদ টেলিফোনে মিটিং ঠিক করবার পরও কীভাবে হাজির হয়েছিল ফেনিসের খুনিরা। চার্লিই খবর দিয়েছিল ওদেরকে।
মাথায় রক্ত চড়ে গেল রানার। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। সরোষে এগোতে শুরু করল বেঈমান শোফারের দিকে 1
‘খবরদার!’ হুইলচেয়ারের পিছন থেকে একটা হাত তুলে আনল চার্লি। মুঠোয় ধরে রেখেছে নাইন মিলিমিটার অটোমেটিক। ‘যেখানে আছেন, ওখানে থাকলেই ভাল করবেন, মি. রানা। ‘ বিনয়ের মুখোশ খসে পড়েছে তার চেহারা থেকে।
থেমে গেল রানা। তাকাল অ্যাডমিরালের দিকে। দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করেছ তুমি ওঁর?’
‘তেমন কিছু না, পিস্তলের বাট দিয়ে সামান্য একটু আঘাত,’ চার্লি বলল। ‘কিছুতেই আসতে চাইছিলেন না কিনা! হোয়াইট হাউসে যাবার জন্য জেদ ধরেছিলেন।
‘কবে বিক্রি হয়েছ তুমি এদের কাছে?’
চার্লির হয়ে জবাবটা দিল গুইদেরোনি। বলল, আমাদের আদর্শের অনুসারী হয়েছে ও, রানা। এর সঙ্গে টাকাপয়সার কোনও সম্পর্ক নেই। মেরিন সার্জেন্ট ছিল চার্লি, জানো নিশ্চয়ই? দেশের জন্য বহুবার জীবন বিপন্ন করেছে, অথচ রিটায়ার হবার পর সামান্য পেনশন ছাড়া আর কিছুই দেয়নি ওকে সরকার। অভাব-অনটনে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল… চিকিৎসার অভাবে একমাত্র সন্তান মারা গেছে ওর, এটা জানো? আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল, এমন সময় আমরা ওকে দলে টেনে নিই। এখানে এসে সত্যিকার আদর্শের সন্ধান পেয়েছে ও। পেয়েছে বেঁচে থাকার প্রেরণা।
‘আমার ধারণা ছিল, ওর দুর্দশার কথা জেনেই শোফারের চাকরিটা দিয়েছিলেন অ্যাডমিরাল,’ বলল রানা।
না, রানা! তার বহু আগেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইন ফ্যাক্ট, নুমা চিফের কাছে আমরাই পাঠিয়েছিলাম ওকে দুঃখকষ্টের কাহিনিটা খুব কাজে লেগেছে তখন। ধীরে ধীরে অ্যাডমিরালের আস্থা অর্জন করেছে ও। তাঁর উপর দিনরাত নজর রেখেছে আমাদের হয়ে। তার সুফল তো নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছ!’ জোরে হেসে উঠল গুইদেরোনি। ‘তোমার ধাপ্পা ধরা পড়ে গেছে, রানা। মাটি হয়ে গেছে প্ল্যান-প্রোগ্রাম। ডেন্টাল রেকর্ড আর এক্স-রে-গুলো এখন আমার হাতে! ওগুলো আর কোনোদিনই পৌছুবে না প্রেসিডেন্টের কাছে। উদ্ধার পাবারও উপায় নেই তোমার। স্পেশাল ফোর্সের কমাণ্ডোরা আজ কেন… কোনোদিনই আসছে না ম্যাহোনি হলে।’
মনে মনে কপাল চাপড়াল রানা, পুরোপুরি ফাঁদে পড়ে গেছে। এতক্ষণ নিশ্চিন্ত ছিল ওর পরিকল্পনা নিয়ে, তাই কুয়াশার কাছ থেকে পিস্তল পাবার পরও সেটা বের করার প্রয়োজন মনে করেনি। আর এখন… চাইলেও ওটা ব্যবহার করতে পারবে না। চার্লি নিষ্কম্প হাতে অটোমেটিক তাক করে রেখেছে ওর দিকে।
‘আমি কথা বলব ওঁর সঙ্গে। পিস্তলকে পরোয়া না করে সামনে বাড়ল রানা। হাঁটু গেড়ে বসল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের সামনে। ‘স্যর, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?’
ধীরে ধীরে চোখ মেললেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। ‘রানা… দুর্বল গলায় বললেন তিনি, ‘আমি দুঃখিত, রানা। কিছুই করতে পারিনি। হোয়াইট হাউসে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আমার মিটিং ক্যানসেল করেছে ওরা, তারপর ধরে নিয়ে এসেছে এখানে… প্রাইভেট একটা বিমানে। কেউ জানে না কী ঘটেছে… কেউ আসছে না সাহায্য করতে…
‘এনভেলাপটা?’
‘তোমার লোক চার্লিকে চেনে, তাই ওর হাতে তুলে দিয়ে বস্টনে ফিরে গেছে। স্যরি, রানা… ওটা আমার হাতেই পৌঁছেনি!’ আহত চোখে তাকালেন তিনি এক সময়ের বিশ্বস্ত শোফারের দিকে। ‘আর কিছু করার নেই আমাদের, সব শেষ হয়ে গেছে…..
‘কিছুই শেষ হয়নি, অ্যাডমিরাল,’ দৃঢ় গলায় বলল রানা। ‘এখনও সফল হয়নি ওদের নোংরা পরিকল্পনা।’
কিন্তু হোয়াইট হাউস দখল করতে চলেছে ওরা! আমেরিকার প্রশাসন হবে আসলে ফেনিসের প্রশাসন!’
‘ওদের এই স্বপ্ন কোনোদিন সত্যি হবে না।’
‘হবে, রানা, হবে!’ গমগম করে উঠল গুইদেরোনির কণ্ঠ। দুনিয়াও বদলে যাবে। পৃথিবীর বুক থেকে সংঘাত আর হিংসা দূর হবে, নেমে আসবে হাজার বছরের শান্তি।‘
‘হাজার বছর?’ উঠে দাঁড়াল রানা। ‘আরেক ম্যানিয়াক বলেছিল এ-কথা। রাইখ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল সে। কী পরিণতি হয়েছে, তা নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না?’
‘এ-ধরনের তুলনা অর্থহীন। হিটলারের সঙ্গে কোনও মিল নেই আমাদের।’ ডেস্কের পিছন থেকে উঠে এল গুইদেরোনি। দু’চোখে আবার আগুন জ্বলে উঠেছে। ‘আমাদের পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি তাদের নেতা বাছাই করতে পারবে, বজায় রাখতে পারবে আত্ম-পরিচয়। কিন্তু সরকার পরিচালিত হবে কোম্পানির সাহায্যে। বিশ্ববাজারে নানা ধরনের অবদান রাখার মাধ্যমে সৃষ্টি হবে সংহতির।’
‘আত্ম-পরিচয়?’ রেগে গেল রানা। ‘ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক আর কর্মচারীদের কোনও আত্ম-পরিচয় থাকে?
‘বৃহত্তর স্বার্থে কিছুটা ত্যাগ তো স্বীকার করতেই হবে।’
‘তারমানে রোবট বানাতে চান আপনি মানুষকে।‘
‘কিন্তু শান্তিতে থাকবে ওরা, বেঁচে থাকবে — ধুঁকে ধুঁকে মরবার চেয়ে ওটা কি অনেক ভাল নয়?’
‘না। ভুল করছেন আপনি, মি. গুইদেরোনি। মস্ত ভুল। দুনিয়া রসাতলে গেলেও মানুষ কোনোদিন দাসত্ব মেনে নেবে না। বিসর্জন দেবে না নিজের সত্তা, বা স্বাধীনভাবে বাঁচবার অধিকার।’
‘ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই তোমার, মাসুদ রানা, কঠিন হয়ে উঠল রাখাল বালকের কণ্ঠ। ‘একটাই জিনিস বিসর্জন দেবে তুমি—নিজের প্রাণ।’
বেল্টে গোঁজা পিস্তলের ওজন অনুভব করছে রানা। বুঝতে পারছে, খুব শীঘ্রি ওটা বের করতে হবে ওকে। খুন হয়ে যাবে সন্দেহ নেই, কিন্তু মরবার আগে সামনের উন্মাদটাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবে ও। এখন শুধু সিদ্ধান্ত নেবার অপেক্ষা।
‘আমাকে, বা এখানে বন্দি অন্যদেরকে খুন করে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না আপনি, মি. গুইদেরোনি,’ বলল ও। ‘কী করছি আমরা… কী আবিষ্কার করেছি, তার খবর অনেকেই জানে। শুধু প্রমাণ নেই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে ওরা, এমনটা ভাবলে বিরাট ভুল করবেন। নিজেই তো বললেন, শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছাড়বে না কোনও সরকার। তার আগে আপনাদেরকে ঠেকানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। নিশ্চিত থাকুন।
এমনভাবে হেসে উঠল গুইদেরোনি, যেন খুব মজার কথা বলছে রানা। বলল, ‘আমাদের ক্ষমতা সম্পর্কে এখনও তোমার কোনও ধারণা নেই, রানা। যারা অ্যাকশন নেবে বলে ভাবছ, তাদের সবাই এখন আমাদের, পকেটে। আজ রাতে তাদের অনেকেই হাজির আছে এখানে। দেখতে চাও?’
লাইব্রেরির একপ্রান্তে চলে গেল সে। কর্ড টেনে দেয়াল ঢেকে রাখা বিশাল দুটো পর্দা সরাল। ওপাশটা কাঁচের তৈরি, স্বচ্ছ দেয়াল ভেদ করে দেখা গেল প্রকাণ্ড এক কনফারেন্স রুম। মাঝখানে বৃত্তাকার এক টেবিল ঘিরে বসে আছে বেশ কিছু মানুষ। সভা চলছে ওখানে। পর্দা সরাবার পরেও কোনও প্রতিক্রিয়া হলো না তাদের মাঝে। রানা বুঝল, কাঁচটা আসলে একমুখী। ওপাশ থেকে লাইব্রেরির অভ্যন্তর দেখা যায় না।
কনফারেন্স রুমের একপাশের দেয়ালে বড় একটা ওয়ার্ল্ড ম্যাপ ঝুলছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত একজন মানুষ পয়েন্টার হাতে নির্দেশ করছে সেটার বিভিন্ন অংশ, ব্রিফ করে চলেছে সভায় উপস্থিত সঙ্গীদেরকে। কথা শোনা গেল না, রুমটা সাউণ্ডপ্রুফ। তবে লোকটাকে চিনতে পারল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফ; জেনারেল গ্রেগরি ওয়ার্নারের মৃত্যুর পর এ-লোকই স্থলাভিষিক্ত হয়েছে তাঁর।
‘জেনারেলকে মনে হয় চিনতে পেরেছ তুমি,’ রানার মুখভঙ্গি লক্ষ করে বলে উঠল রাখাল বালক। ওকে এই পদে বসানোর জন্যই সরিয়ে দেয়া হয়েছে আগের জেনারেলকে। একটু ভাল করে তাকাও, বাকিদেরকেও চিনতে পারবে।’
একে একে কনফারেন্স টেবিলে বসা মুখগুলো ভাল করে লক্ষ করল রানা। শিরদাঁড়ায় বইতে শুরু করল শীতল স্রোত। সেক্রেটারি অভ স্টেট, সিআইএ-র ডিরেক্টর, এফবিআই-এর ডেপুটি ডিরেক্টর, প্রেসিডেন্টের চিফ অ্যাডভাইজর… এমনি বেশ কিছু নামীদামি মার্কিন ব্যক্তিত্বকে দেখতে পাচ্ছে—মাসিমো গুইদেরোনি ওরফে সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনির দু’পাশে বসে আছে। শুধু তাই নয়, সভায় উপস্থিত রয়েছে রাশান অ্যাম্বাস্যাডর, স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চিফ, চিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জার্মান পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার-সহ অন্তত বিশজন উচ্চপদস্থ লোক। ইটালি থেকে বার্নার্দো পাভোরোনিও এসেছে, ছবি দেখা থাকায় চেনা গেল তাকে। এতগুলো প্রভাবশালী লোক ফেনিসের সদস্য, তা ভাবা যায় না!
পায়ে পায়ে কাঁচের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে রানা। ওর কাছে এসে মুচকি হাসল গুইদেরোনি। ‘ইম্প্রেসিভ, তাই না? তাও তো এখানে কাউন্সিলের সবাই নেই! ইমার্জেন্সি মিটিং ডাকায় সবার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি।
‘আর কে কে আছে এই কাউন্সিলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘বিস্তারিত তালিকা চাও? আমার ডেস্কে আছে। কিন্তু দেখে কী লাভ? কাউকে ওদের নাম জানাবার সুযোগ পাচ্ছ না তুমি।
অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের দিকে চোখ পড়ল রানার। দৃষ্টির ইশারায় কী যেন বলতে চাইছেন তিনি। পিছন থেকে হুইলচেয়ারের পাশে চলে এসেছে চার্লি, একহাতে আস্তে আস্তে চাকা ঘুরিয়ে ওর দিকে ঘুরতে শুরু করেছেন তিনি। বুঝতে পারল রানা তাঁর মতলব-থাবা দিয়ে চার্লির হাতের পিস্তলটা কেড়ে নিতে চাইছেন অ্যাডমিরাল। ইশারা করছেন কথা চালিয়ে যেতে, যাতে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত থাকে গুইদেরোনি আর বেঈমান শোফারের।
চট করে ঘড়ি দেখে নিল রানা। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ম্যাহোনি ড্রাইভে সেট করা বোমাগুলো ফাটতে শুরু করবে আর ছ’মিনিট পর। ওটাই ওর শেষ ভরসা। বিস্ফোরণগুলো ডাইভারশন হিসেবে কাজ করবে, সেই সুযোগে যদি বেরিয়ে পড়া যায় এই মৃত্যুপুরী থেকে। কিন্তু তার আগে ঘায়েল করতে হবে চার্লি আর রাখাল বালককে। কনফারেন্স রুমে একজন অস্ত্রধারী প্রহরী আছে বটে, কিন্তু একমুখী কাঁচ আর সাউণ্ডপ্রুফ কামরার কারণে লাইব্রেরিতে কী ঘটছে, তার কিছুই টের পাবে না সে। এখন শুধু কথা বলে ব্যস্ত রাখতে হবে দুই শত্রুকে।
‘গুইদেরোনির দিকে ফিরল ও। ‘ভিলা বারেমির সেই রাতের কথা মনে আছে আপনার, যে-রাতে গিলবার্তো বারেমিকে খুন করেছিলেন?’
ভুরু কুঁচকে রানার দিকে তাকাল বৃদ্ধ ম্যানিয়াক। ‘ওটা ভুলবার মত স্মৃতি নয়। তবে পাদ্রোনিকে খুন করিনি আমি, শুধু আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। খামোকা ওই কথা টানছ কেন?’
‘একটা খটকা দূর করবার জন্য। বুঝতে পারছি না, কী ভেবে মাত্র দশ বছর বয়সী একটা বাচ্চার হাতে ফেনিসকে ছেড়ে গেলেন কাউণ্ট বারেমি। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত।’
‘এ-ই কথা?’ একটু যেন আগ্রহী হয়ে উঠল গুইদেরোনি। ‘বয়স দশ বছর হলেও তার চারগুণ ম্যাচিউর্ড ছিলাম আমি… চারগুণ জ্ঞান ছিল আমার। বুঝলে না এখনও? চাইল্ড জিনিয়াস ছিলাম আমি, রানা… একজন প্রডিজি। ওই বয়সেই শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর দর্শনশাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম। কথা বলতে পারতাম ছ’টা ভাষায়! সেটা জানতে পেরে আমাকে নিজের শিষ্য বানিয়ে নেন পাদ্রোনি। ঔরসে জন্ম না নিয়েও আমি হয়ে উঠেছিলাম তাঁর আরেক সন্তান। আমার কাছে ফেনিসকে দিয়ে যাবেন না তো কার কাছে দিয়ে যাবেন? আমার ভবিষ্যৎও ঠিক করে দিয়ে যান তিনি…’
আড়চোখে অ্যাডমিরালকে দেখল রানা, এখনও ঘুরছেন তিনি। ম্যাহোনি পরিবারের সঙ্গে তা হলে কাউণ্ট বারেমি-ই চুক্তি করে গিয়েছিলেন আপনার ব্যাপারে?’
মাথা ঝাঁকাল গুইদেরোনি। ‘আমেরিকা ছিল লজিকাল চয়েস এ-দেশে তখন বিস্ময়কর গতিতে শিল্প-বিপ্লব ঘটছে। প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হচ্ছে নিত্যনতুন সুযোগ। প্রতিভাবান একজন শিশুর বিকাশের জন্য এরচেয়ে ভাল পরিবেশ আর হতে পারে না।’
‘আপনি তো বিয়ে করেছিলেন?
‘বিয়ে না, আমি শুধু আবাদের জন্য একখণ্ড জমি সংগ্রহ করেছিলাম—নিখুঁত একজন নারী, যার গর্ভে আমার উত্তরসূরি জন্ম নিতে পারে। আমাদের ছকে ওর ভূমিকা বহু আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল।
‘আসল ডেভিড ম্যাহোনির মৃত্যুও কি সেই ছকেরই অংশ?’
‘যে-প্রশ্নের উত্তর তোমার জানা, তা না করলেই কি নয়?’ বিরক্ত স্বরে বলল গুইদেরোনি। ‘যথেষ্ট কথা হয়েছে, এবার তোমাকে বিদায় জানানোর পালা।’
আর দেরি করা চলে না। জায়গামত পৌঁছে গেছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন, তাঁর দিকে তাকিয়ে একটু মাথা ঝোঁকাল রানা। সঙ্গে সঙ্গে হুইলচেয়ার থেকে ঝাঁপ দিলেন নুমা চিফ, খপ্ করে ধরে ফেললেন চার্লির পিস্তলধরা হাত, শুরু হলো ধস্তাধস্তি! তবে তা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য। হঠাৎ গর্জে উঠল অস্ত্রটা, কাত হয়ে পড়ে গেলেন অ্যাডমিরাল।
ঝট্ করে সিধে হলো চার্লি, পিস্তল ঘোরাল রানার দিকে। তবে ততক্ষণে ওর হাতেও বেরিয়ে এসেছে কুয়াশার দেয়া পিস্তলটা। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ট্রিগার চাপল ও, কপালে তৃতীয় নয়ন নিয়ে মেঝেতে উল্টে পড়ল বিশ্বাসঘাতক শোফার। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে আছাড় খাওয়ার আগেই।
যন্ত্রচালিতের মত দরজার দিকে ঘুরে গেল রানা। ওর ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে পরমুহূর্তে দুই গার্ড ঢুকল লাইব্রেরিতে—এরাই ওকে এসকর্ট করে নিয়ে এসেছিল, লাইব্রেরিতে ঢুকিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল হলঘরে। নিমেষে আগুন ঝরাল ওর পিস্তল। ধরাশায়ী হলো দুই গার্ড। এবার জিয়োভান্নি গুইদেরোনির দিকে ব্যারেল ঘোরাল রানা।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্থবির হয়ে গেছে ফেনিস-অধিপতি। নিজের দিকে পিস্তল তাক হতে দেখে সংবিৎ ফিরে পেল, নড়ে উঠল সে। ছুটে পালাতে চাইল, কিন্তু থেমে গেল রানার মৃত্যুশীতল কণ্ঠ শুনে।
‘ডোন্ট মুভ, মি. গুইদেরোনি!’
চকিতে কাঁচের দেয়ালের দিকে তাকাল রানা। কনফারেন্স রুমে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। দেয়ালের এপাশে কী ঘটেছে, সে-ব্যাপারে কোনও ধারণা নেই তাদের কারও।
‘ক… কীভাবে?’ তোতলাল গুইদেরোনি। ‘বাড়িতে ঢোকার আগে সার্চ করা হয়েছে তোমাকে। পিস্তল পেলে কোথায়?’
‘আপনার চেয়ে অনেক বড় আরেক জিনিয়াসের কাছ থেকে।’ পেটে পিস্তল ঠেকিয়ে, কলার চেপে তাকে ডেস্কের কাছে নিয়ে গেল রানা। মন দিয়ে শুনুন, আপনার মত নরকের কীটকে বাঁচিয়ে রাখার কোনও ইচ্ছে নেই আমার। কথামত যদি কাজ না করেন, খুব আনন্দের সঙ্গে ট্রিগার চাপব আমি….’
‘না!’ আতঙ্ক ফুটল রাখাল বালকের চেহারায়। ‘মেরো না আমাকে। আমার কাজ এখনও শেষ হয়নি…’
‘হবেও না কোনোদিন,’ হিংস্র গলায় বলল রানা।
.
বয়েলস্টোন স্ট্রিটের পুলিশ স্টেশনের ডেস্ক সার্জেন্ট বিরক্ত চোখে তাকাল সামনে দাঁড়ানো শুকনো মহিলার দিকে। মেসেঞ্জার সার্ভিসের ইউনিফর্ম পরে আছে, চেহারায় রাগ। অভিযোগের সুরে বলল, ‘আপনি খামটা অমন হেলাফেলা করে ফেলে রাখলেন কেন?
‘দেখুন ম্যাম’ বলল সার্জেন্ট, ‘আপনার কাজ ডেলিভারি দেয়া ডেলিভারি দিয়েছেন। এখন আমি কী করি, সেটা নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে আপনার।’
‘কিন্তু আপনাদের লোক তো বলেছিল, মেসেজটা জরুরি! ওটা এভাবে ফেলে রাখলে চলবে কী করে?’
‘আমাদের লোক?’
‘হ্যাঁ। ইন্টার-ডিভিশনাল এগজামিনেশন সেকশনে কাজ করে। বলল আজ রাতে নাকি মহড়া আছে আপনাদের, সেটার জন্য এই মেসেজটা পৌনে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে অবশ্যই পৌঁছুতে হবে এখানে!
আজ কোনও মহড়া নেই আমাদের। ইন্টার-ডিভিশনাল এগজামিনেশন নামেও কোনও সেকশন নেই আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টে।’ সন্দিহান হয়ে উঠল সার্জেন্ট। তাড়াতাড়ি খামটা খুলল। ভিতর থেকে বেরুল হলুদ একটা কাগজ — কালো মার্কার দিয়ে তাতে একটা চিঠি লেখা হয়েছে। চোখ বুলিয়েই আঁতকে উঠল সে। চেঁচাল, ‘অ্যাই, কে আছ… এই মহিলাকে আটকাও!’
চোখের পলকে উদয় হলো দু’জন পুলিশ, ধরে ফেলল এডিথকে। সে-ও চেঁচাতে শুরু করল।
হইচই শুনে ভিতর থেকে বেরিয়ে এল স্টেশনের ডিউটি অফিসার। ডেস্ক সার্জেন্টকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার? গোলমাল কীসের?’
জবাব না দিয়ে তার হাতে হলুদ কাগজট ধরিয়ে দিল সার্জেন্ট। পড়ল অফিসার:
বস্টনের বেজন্মা পরিবার আর অ্যালাব্যাস্টার ব্রাইডের রক্ষাকর্তাদের জন্য আমাদের এই বার্তা। নিপাত যাক ধনী রক্তচোষারা! ধ্বংস হোক ম্যাহোনি হল! তোমরা যখন এ-বার্তা পড়ছ, তখন আমাদের বোমা ধ্বংস করতে যাচ্ছে। মানবজাতির কলঙ্ক জিয়োভান্নি গুইদেরোনিকে। সুইডসাইড স্কোয়াড পাঠানো হয়েছে তার প্রাসাদে, ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হবে সব। এই শহর মুক্তি পাবে শয়তানটার অশুভ ছায়া থেকে।
-থার্ড ওয়ার্ল্ড আর্মি অভ লিবারেশন অ্যাণ্ড জাস্টিস।
.
‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল পুলিশ অফিসার। দ্রুত নির্দেশ দিল সার্জেন্টকে। ‘এক্ষুণি ফোন করে: ম্যাহোনি হলে, ওখানকার সিকিউরিটিকে জানিয়ে দাও কী ঘটতে চলেছে। আশপাশে যত প্যাট্রোল কার আছে, সবাইকে যেতে বলো এখানে। কুইক! আমি যাচ্ছি সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলতে। সোয়াট টিম চাই আমাদের!’
.
গুইদেরোনির দিকে পিস্তল তাক করে রেখে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে পরীক্ষা করল রানা। বাঁ হাতে গুলি লেগেছে, তবে সিরিয়াস কিছু নয়। তাঁকে একটা রুমাল দিল ও, ক্ষতটা চেপে ধরে রাখতে বলল। তারপর মনোযোগ দিল ফেনিস-অধিপতির দিকে।
‘কী চাও তুমি?’ খ্যাপাটে গলায় প্রশ্ন করল গুইদেরোনি। নিজেকে সামলে নিয়েছে সে।
‘আগে যা চেয়েছি, তা-ই,’ রানা বলল। ‘আমার বন্ধুদেরকে উদ্ধার করতে। তবে এখন নতুন দুটো জিনিস যোগ হয়েছে। কাউন্সিল মেম্বারদের একটা তালিকা আছে বলেছিলেন… ওটা সঙ্গে নিয়ে যাব! আর নেব ডেন্টাল রেকর্ডগুলো বের করুন ওগুলো।’
নড়ল না গুইদেরোনি ‘খামোকা সময় নষ্ট করছ, রানা। কিছুতেই পালাতে পারবে না তুমি। বাড়ির ভিতর-বাইরে অসংখ্য গার্ড কনফারেন্স রুমের মত লাইব্রেরিটাও সাউণ্ডপ্রুফ বলে এখনও কিছু টের পায়নি ওরা, কিন্তু নিশ্চিত থাকো—বাইরে পা রাখামাত্র বাধা দেয়া হবে তোমাকে।’
‘ওটা আমি বুঝব,’ রানা নির্বিকার। ‘তালিকাটা … প্লিজ।‘
চোয়াল শক্ত করে ডেস্কের পিছনে গেল গুইদেরোনি। ড্রয়ার থেকে বের করে আনল একটা ফাইল। ওটা হাতে নিয়ে পলকের জন্য চোখ বোলাল রানা। অনেকগুলো নাম-ঠিকানা লেখা আছে ভিতরে। রয়েছে অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছে পাঠানো প্যাকেটটাও। সন্তুষ্ট হয়ে কোটের ভিতরের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল সব।
ঠিক এই সময়ে ডেস্কে রাখা ইন্টারকম বেজে উঠল। জবাব দেয়া না হলে অস্বাভাবিক দেখাবে, তাই রানা বলল, ‘স্পিকার অনু করুন।’
সুইচ টিপল গুইদেরোনি। শোনা গেল উত্তেজিত কণ্ঠ:
‘বিরক্ত করবার জন্য দুঃখিত, স্যর। আমি সিকিউরিটি সেন্টার থেকে বলছি। বস্টন পুলিশ থেকে একটা মেসেজ পেয়েছি আমরা-থার্ড ওয়ার্ল্ড আর্মি নামে একটা সন্ত্রাসীদল নাকি বোমা হামলা করতে চলেছে এখানে। আমাদের লিস্টে এ-জাতীয় কোনও সংগঠনের নাম নেই। হুমকিটা ভুয়া হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু বস্টন পুলিশ কোনও কথা শুনতে চাইছে না। ওরা সোয়াট টিম পাঠাচ্ছে এখানে।’
রাজি হবার জন্য ইঙ্গিত করল রানা। তাই গুইদেরোনি বলল, ‘ঠিক আছে, আসতে দাও ওদেরকে। কিন্তু এস্টেটের ভিতরে ঢুকতে দিয়ো না, বাইরে পাহারা দেবে।’ শেষ কথাটা নিজেই যোগ করল। এরপরে ইন্টারকমের লাইন কেটে দিয়ে হাসিমুখে তাকাল রানার দিকে।
‘কাজটা ভাল করলেন না,’ থমথমে গলায় বলল রানা।
‘পুলিশকে ভিতরে ঢুকতে না দিয়ে?’ হাসি বিস্তৃত হলো গুইদেরোনির। ‘ঢুকলেই বা কী করতে পারবে? ভেবেছ ওরা উদ্ধার করবে তোমাদেরকে? বড্ড কাঁচা চাল দিয়েছ তুমি, রানা। থার্ড ওয়ার্ল্ড আর্মি… হাহ্! অ্যামেরিকান আর্মিও এখন তোমার কাজে আসবে না। বাড়ির বাইরে পা দেয়ামাত্র তোমাদেরকে গুলি করে ফেলে দেবে আমার লোক। অর্ডার দেয়া আছে।’
‘আপনি সঙ্গে থাকলেও?’
মুখের হাসি মুছে গেল গুইদেরোনির।
‘জী, মি. গুইদেরোনি,’ বলল রানা, ‘আপনিও যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে। এসকর্ট করে বাইরে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।’
‘কক্ষনো না।’
‘তা হলে আপনাকে বেহুঁশ করে সঙ্গে নিয়ে যাব। তাতেও কাজ হবার কথা।’
নিষ্ফল আক্রোশে গরগর করে উঠল রাখাল বালক। তাকে পাত্তা না দিয়ে আবার অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছে গেল রানা। জিজ্ঞেস করল, ‘স্যর, হাঁটতে পারবেন আপনি?
‘না, রানা, মাথা নাড়লেন অ্যাডমিরাল। আমার কথা ভুলে যাও।’
‘উঁহুঁ। আপনাকে ফেলে যাচ্ছি না আমি।’
অ্যাডমিরালের আপত্তির মুখে একটা হাত বাড়িয়ে দিল রানা, তাঁকে প্রায় জোর করেই ওঠাতে শুরু করল হুইলচেয়ারে। ক্ষণিকের জন্য মনোযোগ টুটে গেল গুইদেরোনির দিক থেকে, নড়ে গেল পিস্তলের নল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল লোকটার শরীরে। ডেস্কের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিল, লুকানো খোপ থেকে বের করে আনল একটা ছোট্ট পিস্তল। চমকে ওদিকে তাকাল রানা, পরক্ষণে অ্যাডমিরালকে নিয়ে ঝাঁপ দিল মেঝেতে।
আগুন বর্ষণ করল গুইদেরোনির পিস্তল, ওদের শরীরের উপর দিয়ে চলে গেল বুলেট। মেঝেতে একটা গড়ান দিল রানা, পিস্তল সোজা করে পাল্টা গুলি করল ও-ও, নিশানা ঠিক করবার জন্য সময় নিল না।
ফেনিস-অধিপতির গলায় আঘাত হানল বুলেট। ঘড়ঘড় শব্দ তুলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। একহাতে চেপে ধরল ক্ষতস্থান, অন্যহাতে ধরা পিস্তল তাক করে আবার গুলি করবার চেষ্টা করল। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিল না রানা। ট্রিগার চাপল নিষ্কম্প হাতে। হৃৎপিণ্ড বরাবর একটা ক্ষত নিয়ে মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ল মহাপ্রতাপশালী জিয়োভান্নি গুইদেরোনি। একটু ঝাঁকুনি খেয়ে নিথর হয়ে গেল দেহটা।
‘স্যর, আপনি ঠিক আছেন?’ অ্যাডমিরালকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘হ্যাঁ,’ বললেন হ্যামিলটন। তাকালেন গুইদেরোনির লাশের দিকে। ‘ওকে খুন করে ফেললে? এখন তা হলে এ-বাড়ি থেকে বের হবে কীভাবে?’
‘ডাইভারশনের সুযোগ নিতে হবে আমাদেরকে।’ ঘড়ি দেখল রানা। সময় হয়ে গেছে প্রায়, আর এক মিনিট পর ফাটতে শুরু করবে ম্যাহোনি ড্রাইভে পেতে রাখা বোমাগুলো।
কনফারেন্স রুমের দিকে তাকাল ও। জয়েন্ট চিফ অভ স্টাফের ব্রিফিং থেমে গেছে, সবার মধ্যে চাঞ্চল্য। না, লাইব্রেরির বন্দুকযুদ্ধ টের পায়নি ওরা, তবে সম্ভবত পুলিশ আসবার খবর পেয়েছে। তাদের কাছে উচ্চপদস্থ এতজন লোকের সমাবেশ ব্যাখ্যা করা মুশকিল হয়ে যাবে, তাই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছে ওরা। তর্ক-বিতর্ক শুরু হলো, বোধহয় কী করা হবে, তা নিয়েই।
‘সময় নেই আমাদের হাতে,’ অ্যাডমিরালকে হুইলচেয়ারে ওঠাতে ওঠাতে বলল রানা। ‘ওরা কনফারেন্স রুম থেকে বেরুলেই সর্বনাশ।’
‘আটকে রাখা যায় না?’ জিজ্ঞেস করলেন হ্যামিলটন।
‘হয়তো,’ বলল রানা। চলুন দেখা যাক।’
হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে হলঘরে বেরিয়ে এল রানা, আসার পথে নিহত গার্ডের কাছ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে বাড়তি পিস্তল। হলঘর এ-মুহূর্তে খালি। চারপাশে যতগুলো প্যাসেজ দেখতে পেল, সবগুলোর দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি টেনে দিল ও। এতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আটকা পড়বে বাড়ির ভিতরের লোকজন। এরপর অ্যাডমিরালকে নিয়ে চলে গেল সোনিয়া-কুয়াশার কামরার দিকে। তালা ঝুলছে বাইরে, লাথি মেরে পাল্লা ভেঙে ফেলল রানা, ঢুকল ভিতরে।
দুই বন্দিকে ব্যস্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল ও। শরীরের বেহাল দশাকে পাত্তা না দিয়ে উঠে পড়েছে কুয়াশা। সোনিয়ার সাহায্য নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে বালিশ, বিছানার চাদর আর তোষক। ছড়িয়ে রেখেছে সারা ঘরময়। খাটের পায়াও ভেঙেছে, ন্যাকড়া পেঁচিয়ে বানিয়ে নিয়েছে দুটো মশাল।
‘কী করছেন আপনারা?’ বিস্মিত রানা প্রশ্ন করল।
‘আগুন লাগাবার প্ল্যান করেছেন মি. কুয়াশা,’ জবাব দিল সোনিয়া!
‘ভাল আইডিয়া, মাথা ঝাঁকাল রানা। বাড়িতে আগুন দেখা দিলে কাউন্সিলের লোকেরা আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। বাধ্য হবে বেরিয়ে আসতে — পুলিশের সামনে… দুনিয়ার সামনে! কিন্তু তাড়াতাড়ি করো। সময় নেই আমাদের হাতে…’
কথা শেষ হতে না হতে দূর থেকে ভেসে এল গুরুগম্ভীর বিস্ফোরণের আওয়াজ—প্রথমে একটা, দশ সেকেণ্ড পর আরেকটা। ফাটতে শুরু করেছে। ম্যাহোনি ড্রাইভের তলায় লুকিয়ে রাখা বোমাগুলো। তার পিছু পিছু ভেসে এল উত্তেজিত কণ্ঠের চেঁচামেচি–বাড়ির ভিতর-বাহির দু’দিক থেকেই।
‘কুইক!’ বলে সামনে বাড়ল রানা। কুয়াশা ইতিমধ্যে মশালদুটো জ্বেলেছে, একটা নিয়ে নিল তার হাত থেকে। আগুন ধরাল মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা তুলা আর ন্যাকড়ার স্তূপে। ধরাল জানালায় ঝুলতে থাকা পর্দাতেও।
ততক্ষণে আরও চারটে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। কুয়াশাকে টেনে ওঠাল রানা, নিজের কাঁধে ভর রাখতে দিল। সোনিয়াকে বলল, ‘হুইলচেয়ার ঠেলো তুমি, সোনিয়া।’
ব্যস্ত ছিল বলে এতক্ষণ খেয়াল করেনি, কিন্তু এবার অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠল কুয়াশা। অস্ত্র গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘উনি কোত্থেকে?’
‘রাখাল বালকের কাজ, রানা জানাল। ধরে নিয়ে এসেছে। আর কথা নয়, চলুন।‘
কামরা থেকে হলঘরে বেরিয়ে এল ওরা। বাইরে তখন নরক ভেঙে পড়েছে। বাড়ির ভিতরেও কমবেশি একই অবস্থা। বন্ধ দরজার ওপাশে আটকা পড়েছে মানুষ, ধুমধাম বাড়ি পড়ছে পাল্লায়। কনফারেন্স রুমের দিকের দরজাটা প্রায়, ভেঙে পড়েছে, খুব শীঘ্রি বেরিয়ে আসবে সশস্ত্র গার্ডরা।
রানাকে ছেড়ে দিল কুয়াশা। খুঁড়িয়ে সরে গেল দু’পা।
‘কী করছেন আপনি?’ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘যা করতে চাইছ, তাতে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনা ষোলো আনা, ‘ শান্ত কণ্ঠে জানাল কুয়াশা। ‘দু-দু’জন আহত মানুষকে বয়ে নিতে গেলে কেউই বেরোতে পারবে না এখান থেকে। বাইরের গার্ডরা বাধা দেবে তোমাকে, দরজা ভেঙে হামলা চালাবে ভিতরের লোক-ও। ফাঁদে পড়ে যাবে তুমি।’
‘কী বলতে চান?’
‘পিস্তল দাও, এদিকটা আমি কাভার দেব। বোঝা কম থাকবে তোমার, অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন আর সোনিয়াকে নিয়ে সহজেই পালাতে পারবে।’
‘না, কুয়াশা!’ প্রতিবাদ করল রানা। ‘আপনাকে রেখে যাব না আমি।’
‘পাগলামি কোরো না!’ ধমক দিল কুয়াশা। ‘চারজনের চেয়ে একজনের মরা ভাল না? তা ছাড়া একা মরব না আমি, ফেনিসের মাথাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’ বন্ধ দরজার দিকে ইশারা করল ও।
‘প্লিজ, কুয়াশা…’ অনুরোধ করবার চেষ্টা করল রানা।
এগিয়ে এসে ওর হাত থেকে পিস্তল নিয়ে নিল অকুতোভয় মানুষটা। নরম গলায় বলল, ‘যাও। যেতেই হবে তোমাকে আমাদের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ফেনিসের অভিশাপ এখনও ছড়িয়ে আছে পুরো দুনিয়াজুড়ে। যদি দু’জনেই মারা যাই, তা হলে সে-অভিশাপ দূর করবার মত কেউ থাকবে না।’
স্থির হয়ে রইল রানা। কী করতে চলেছে কুয়াশা, তা জানতে পেরে শ্রদ্ধায় নুয়ে আসছে মাথা। প্রিয়জন হারাবার মত ব্যথায় ভরে যাচ্ছে অন্তর। চোখ ভরে আসতে চাইছে পানিতে।
কামরা থেকে মশাল নিয়ে এল কুয়াশা। হলঘরের একপাশে আগুন ধরাতে ধরাতে চেঁচাল, ‘যাও, রানা! যাও!!’
দাঁতে দাঁত পিষে ভাবাবেগ দমন করল রানা। কোমর থেকে বাড়তি পিস্তলটা বের করল, যেটা লাইব্রেরির মৃত গার্ডের কাছ থেকে এনেছে তারপর সোনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মুভ!’
‘কিন্তু কুয়াশা…’ বলার চেষ্টা করল সোনিয়া।
‘ফরগেট হিম,’ রুক্ষ গলায় বলল রানা, ‘এগোও।’
অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ওরা। দেখতে পেল পোর্চের তলায় গাড়ির দীর্ঘ সারি। গোলমালের আভাস পেতেই বাহন নিয়ে ছুটে এসেছে বিশ্বস্ত শোফাররা, তাদের মনিবদেরকে সরিয়ে নেবার জন্য। ইঞ্জিন চালু রেখে ড্রাইভিং সিটে অপেক্ষা করছে, মুহূর্তের নোটিশে কেটে পড়বার জন্য তৈরি। সন্দেহ নেই, এদের প্রত্যেকে ফেনিসের অনুগত।
হঠাৎ বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে এল গুলিবর্ষণের শব্দ। দরজা ভেঙে ফেলেছে গার্ডের দল। বেরিয়ে আসতে চাইছে হলঘরে, গুলি করে ওদেরকে ঠেকিয়ে রাখছে কুয়াশা।
একের পর এক বোমা বিস্ফোরণ, তারপর আবার বাড়ির ভিতরে গোলাগুলি… হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে শোফারের দল। সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল রানা। এক ঝটকায় অ্যাডমিরালকে কাঁধে তুলে নিল, তারপর তীরবেগে নামতে শুরু করল সিঁড়ি ধরে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পৌঁছে গেল প্রথম গাড়িটার কাছে।
ঝট্ করে ব্যাকডোর খুলল রানা, অ্যাডমিরালকে খড়ের তৈরি পুতুলের মত ছুঁড়ে দিল পিছনের সিটে—এখন তাঁর সুবিধে-অসুবিধের দিকে নজর দেবার সময় নেই। সোনিয়াও এসেছে পিছু পিছু, ওর জন্য দরজাটা খোলা রেখে সামনে এগিয়ে গেল। ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে ফেলল ও, ভিতরে বসা হতভম্ব শোফারের চোয়ালে বিরাশি শিক্কার একটা ঘুসি ঝাড়ল। তারপর কলার চেপে ধরে বের করে আনল ভিতর থেকে, ছুঁড়ে ফেলল বাইরে। লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল ও। ইঞ্জিন চালুই আছে, গিয়ার বদলে চেপে ধরল অ্যাকসেলারেটর।
টায়ার ঘর্ষণের বিচ্ছিরি শব্দ হলো, জ্যা-মুক্ত তীরের মত সামনে বাড়ল গাড়ি। দ্রুত স্টিয়ারিং ঘোরাল রানা, আড়াআড়িভাবে লন পেরিয়ে এস্টেটের ফটকে পৌঁছুতে চাইছে। পিছনে গুলির শব্দ হলো, কোথায় লাগল বোঝা গেল না। হঠাৎ করে সামনে একদল গার্ড উদয় হলো, কর্ডন করবার ভঙ্গিতে এগোবার পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। সবার হাতে উজি সাবমেশিনগান— ধরেছে উঁচু করে, ফায়ার করতে যাচ্ছে গাড়ির উপর।
নিচু হয়ে গেল রানা, কুঁকড়ে ফেলল শরীরকে, কিন্তু গতি কমাল না। প্রচণ্ড গতিতে কর্ডনকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ি। দু’জন পড়েছে বাম্পারের সামনে, ট্রিগার চাপার সময় পায়নি, তার বদলে আছড়ে পড়ল উইণ্ডশিল্ডের উপর, মড়মড় করে ভাঙল কাঁচ। দলা-পাকানো লাশদুটো মুহূর্তের জন্য স্থির থাকল, তারপর খসে পড়ল মাটিতে। কর্ডনের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল; সেখান দিয়ে অপ্রতিরোধ্য ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল রানা বেষ্টনী ভেদ করে।
পলায়নরত বাহনটার পিছু পিছু দৌড়াতে শুরু করল বাকি গার্ডরা, অস্ত্র তুলে ফায়ারও করছে একই সঙ্গে। গাড়ির পিছনে ইস্পাতের ফুলকি উড়ল, ভেঙে পড়ল কাঁচ, গুলির আঘাতে রিয়ার এণ্ড ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে।
‘মাথা নামিয়ে রাখো!’ চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল রানা।
আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে গাড়ি, একটু পরে পিছে ফেলে দিল পদব্রজে ছুটতে থাকা ধাওয়াকারীদের। সামনে আরও গার্ড আছে, কিন্তু গুলি করল না। গেটের ওপাশে হাজির হয়েছে বিশাল পুলিশ বাহিনী, সম্ভবত তাদের সামনে অযাচিত দৃশ্যের অবতারণা করতে চায় না। তার বদলে বন্ধ করে দিতে শুরু করল মেইন গেটের পাল্লা। ফ্লোরবোর্ডের উপর অ্যাকসেলারেটর চেপে ধরল রানা, গেট পুরোপুরি বন্ধ হবার আগেই পৌঁছে গেল ওখানে।
গাড়ির চেসিসের ধাক্কায় বেঁকে গেল পাল্লা, ছিটকে গেল দু’দিকে! সেই ধাক্কায় উড়ে গেল কয়েকজন গার্ড। এস্টেটের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি। রাস্তার উপর জটলা পাকিয়ে থাকা পুলিশ-সদস্যরা কীপ দিয়ে সরে গেল ওটার গতিপথ থেকে।
আচমকা একটা পুলিশ ভ্যান দেখতে পেল রানা, পার্ক করে রাখা হয়েছে ঠিক ওর মুখোমুখি। ব্রেক কষল ও, বন বন করে ঘোরাল স্টিয়ারিং। মাতালের মত ঘুরে গেল গাড়ি, কিন্তু থামল না পুরোপুরি। স্কিড করে সোজা আছড়ে পড়ল ভ্যানের গায়ে। চেসিসের ডানপাশ থেঁতলে গেল। প্রচণ্ড ঝাঁকি খেয়ে বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন।
স্টিয়ারিঙের সঙ্গে ভীষণ এক বাড়ি খেয়েছে রানা, কপাল কেটে ঝরঝর করে নামছে রক্ত। আচ্ছন্নের মত পড়ে রইল উবু হয়ে। চারপাশে হইচই শোনা গেল। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ছুটে এল ইউনিফর্মধারী পুলিশ, ওকে টেনে-হেঁচড়ে নামাল গাড়ি থেকে বনেটের উপর উপুড় করে ফেলা হলো ওকে, দু’হাত পিছমোড়া করে লাগিয়ে দেয়া হলো হ্যাণ্ডকাফ।
বাধা দিল না রানা। ম্যাহোনি হলের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে ও। আগুন ধরে গেছে প্রাসাদোপম বিশাল বাড়িটাতে। লেলিহান শিখায় পুড়ছে জিয়োভান্নি গুইদেরোনির আবাস… কাউন্সিল অভ ফেনিসের মিলনস্থল।
‘থামো তোমরা!’ শোনা গেল বাজখাঁই গলা। ধমক দিয়ে উঠেছেন অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন। ‘আমি অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন, ডিরেক্টর অভ ন্যাশনাল আণ্ডারওয়াটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সি। এখানকার ইনচার্জ কে? তোমাদের পুলিশ চিফের সঙ্গে কথা বলব আমি।’
পরিচয় পেয়ে সটান স্যালিউট ঠুকল পুলিশেরা। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল রানার বুক চিরে। আর কোনও চিন্তা নেই, পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য মাঠে নেমে পড়েছেন নুমা চিফ। বুকটা হু-হু করছে শুধু কুয়াশার কথা ভেবে। ওদেরকে বাঁচাবার জন্য প্রাণ দিল আশ্চর্য, মহৎ মানুষটা।
হ্যাণ্ডকাফ খুলে দেয়া হলো। ওর পাশে এসে দাঁড়াল সোনিয়া। একই অনুভূতি কাজ করছে ওর ভিতরেও। চোখ দিয়ে নেমে আসছে অশ্রুধারা। সোনিয়াকে এক হাতে জড়িয়ে ধরল রানা। দু’জনে একসাথে মাথা নোয়াল জ্বলন্ত ম্যাহোনি হলের দিকে ফিরে… এক অকুতোভয় বীরের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে।