সেই কুয়াশা ২.১৮

আঠারো

মিসেস ম্যাহোনিকে তাঁর বেডরুমে নিয়ে গেল রানা, শেষ এক গ্লাস ব্র্যাণ্ডি খাইয়ে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। আসার পথে ডেভিড ম্যাহোনির কামরা থেকে একটা ছবি খুলে নিয়েছে। নার্সের এখনও জ্ঞান ফেরেনি, তাকে নিয়ে মাথা ঘামাল না। মোক্ষম একটা অস্ত্র পেয়ে গেছে ও ফেনিসের বিরুদ্ধে এখন ওই মেয়ের মাধ্যমে বস্টনে ওর উপস্থিতির কথা ফাঁস হলে কিছু যায় আসে না।

লুইসবার্গ স্কয়্যার থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ডাউনটাউনে চলে এল রানা। উঠল ছোট্ট একটা হোটেলে। রাত কাটাল ওখানে। গুছিয়ে নিল চিন্তা-ভাবনা আর পরবর্তী কর্মকৌশল। সকাল হতেই চলে গেল ম্যাসাচুসেটস্ জেনারেল হসপিটালে।

হাসপাতালের রেকর্ড অ্যাণ্ড বিলিং ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে আছে এক বয়স্কা নার্স। তাকে সরকারি একটা পরিচয়পত্র দেখাল রানা, বলল—সিনেটর ম্যাহোনির অফিস থেকে এসেছে। তারপর জানাল নিজের চাহিদা।

‘ডাক্তার আর নার্সদের তালিকা চান সিনেটর?’ বিস্মিত গলায় বলল নার্স। বিশ বছর আগেকার সড়ক দুর্ঘটনার পর যারা ওঁর চিকিৎসা করেছিলেন? কেন?’

মুখে অমায়িক হাসি ফোটাল রানা। ‘আগামী মাসে ওই ঘটনার বর্ষপূর্তি হতে চলেছে। সিনেটরের ভাষায় … ওটা ছিল তাঁর নবজন্ম। যারা তাঁকে এই নতুন জীবন দিয়েছেন, তাদেরকে সম্মান দেখাতে চান তিনি বিশেষ ওই দিনে।’

‘হ্যাঁ, আমাদের সিনেটরের কাছে এমনটাই আশা করা যায়!’ হাসল নার্সও। ‘অসাধারণ এক মানুষ! বেশিরভাগ মানুষ অমন অভিজ্ঞতার কথা ভুলে যেতে চায়; কিন্তু ম্যাহোনিকে দেখুন! ভোলা তো দূরের কথা, উল্টো স্মরণ করার ব্যবস্থা করছেন। যারা তাঁকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনল, তাদেরকে পুরস্কৃত করতে চাইছেন। এজন্যেই তাঁকে এত ভালবাসে লোকে।’

‘ঠিক বলেছেন।’

এক টুকরো কাগজে প্রফেসর স্যান্ডার্সের কাছে শোনা সন-তারিখ লিখে দিয়েছে রানা, সেটা নিয়ে ফাইলিং কেবিনেটের দিকে এগিয়ে গেল নার্স বলল, ‘দেখবেন, কেনেডির পর আবার আমরা এই স্টেট থেকে একজন প্রেসিডেন্ট পাব। পুরো দেশের উপকার হবে তাতে।’

‘আমি একমত,’ মহিলার সঙ্গে তাল দিল রানা। ইয়ে… পুরো ব্যাপারটা কিন্তু গোপন রাখতে হবে। সিনেটর কোনও পাবলিসিটি চাইছেন না।’

‘আর বলতে হবে না’ আশ্বাস দিল নার্স। ‘ধরে নিন, আমার ঠোঁট সেলাই হয়ে গেছে।‘

একটু পরেই ঢাউস এক ফোল্ডার নিয়ে ফিরে এল সে, তুলে দিল রানার হাতে। বলল, ‘এর ভিতরে পাবেন সব। দুঃখিত, হাতে অনেক কাজ, নইলে আমিই ফাইল ঘেঁটে নামগুলোর লিস্ট করে দিতাম।’

‘না, না,’ রানা বলল। ‘আমিই করে নিতে পারব। কোনও অসুবিধে নেই।’

‘ওই যে, ওদিকে চেয়ার-টেবিল আছে’ আঙুল তুলে দেখাল নার্স। ‘ওখানে বসে আরামে কাজ করতে পারবেন কেউ বিরক্ত করবে না। কাজ শেষ হলে ফাইলটা ওখানেই রেখে যেতে পারেন, আমি পরে তুলে রাখব : ‘

‘সো নাইস অভ ইউ!’

উঁহুঁ। সো নাইস অভ আওয়ার সিনেটর।’

হেসে নিজের কাজে চলে গেল মহিলা। ফোল্ডার নিয়ে টেবিলে বসল রানা। ধুলো ঝেড়ে খুলল ওটা। ভিতরে হাজারো কাগজের ভিড়ে মিশে আছে ডেভিড ম্যাহোনির ঊনিশশো একানব্বুই সালের মেডিক্যাল রেকর্ড। আস্তে আস্তে পড়তে শুরু করল রানা। যা পেল, তা বিস্ময়কর… কিন্তু ওর সন্দেহের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল রেকর্ডে।

আটাশে ডিসেম্বরে দুর্ঘটনাস্থল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ম্যাহোনিকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন তিনি প্রায়-মৃত। হাড়-গোড় ভেঙে, ধ্বংসস্তূপে থেঁতলে গিয়ে বলতে গেলে মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছিল শরীর। চেহারা এত বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে চেনারই উপায় ছিল না। হাজারো ড্রাগ আর সেরামের বিশাল এক ফর্দ পাওয়া গেল, ওগুলোর সাহায্যে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁকে। সেইসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল অত্যাধুনিক লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। প্রায় তিন মাস যমে-মানুষে টানাটানির পর বিরানব্বুই সালের মার্চে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি

নোটবুক খুলে তাতে সমস্ত ডাক্তার আর অ্যাটেন্ডিং নার্সদের নাম টুকে নিল রানা। দু’জন সার্জন, একজন স্কিন-গ্রাফট্ স্পেশালিস্ট, আর আটজন নার্স প্রথম সপ্তাহে চিকিৎসা করেছে ম্যাহোনির। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাদেরকে। তার বদলে নিয়োগ করা হয়েছিল মাত্র দু’জন ডাক্তার আর তিনজন প্রাইভেট নার্স।

 যা খুঁজছিল, তা পেয়ে গেছে রানা—পনেরোটা নাম। পাঁচটা প্রাইমারি, দশটা সেকেণ্ডারি। প্রথম গ্রুপটার উপর ভাল করে নজর দিতে হবে এবার—মানে ওই দুই ডাক্তার আর তিন নার্স। ফোল্ডার বন্ধ করে বয়স্কা নার্সের কাছে ফিরে গেল ও।

‘আমার কাজ শেষ, বলল রানা। ‘তবে ইয়ে… আরেকটু উপকার করতে পারেন আমার… মানে, সিনেটরের জন্য?’

‘নিশ্চয়ই!’ বলল নার্স। ‘কী চান বলুন।’

‘নামগুলো পেয়েছি, তবে একটু আপডেটিঙের প্রয়োজন। আফটার অল, রেকর্ডগুলো বিশ বছরের পুরনো। এখন কে কোথায় আছে, তা জেনে নিতে পারলে খুব ভাল হয়।’

‘এখানে তো ওসব পাবেন না। তবে চাইলে আপনাকে ওপরতলায় পাঠাতে পারি। এখানে সব পেশেন্টদের রেকর্ড, পার্সোনেল ডিপার্টমেন্ট তিনতলায়। ওখানে সবকিছু কম্পিউটারাইজড।’

‘ব্যাপারটা প্রচার হতে দিতে চাইছিলাম না…’ ইতস্তত করল রানা।

কিচ্ছু ভাববেন না। আমার বোনপো আছে ওখানে। ওর উপর আস্থা রাখতে পারেন। যাবেন?

রানা মাথা ঝাঁকালে ইন্টারকম তুলে নিল নার্স।

মিনিটদশেক পরে তার বোনপোর পাশে দেখা গেল রানাকে। অল্পবয়েসী এক তরুণ, নাম টমি, লেখাপড়ার পাশাপাশি খালার হাসপাতালে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছে। তাকে যা বলার বলে দিয়েছে নার্স, তাই খুশিমনেই সাহায্য করছে রানাকে।

‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত,’ কাজ শুরুর আগে বলল রানা।

‘কোনও সমস্যা নেই, স্যর,’ হাসিমুখে বলল তরুণ। ‘খালার কাছে শুনেছি সব। সিনেটর ম্যাহোনির জন্য কিছু করতে পারছি, এ তো আমার সৌভাগ্য।’ কম্পিউটারের কি-বোর্ড টেনে নিল নিজের দিকে। ‘বলুন, কী জানতে চান।’

প্রথম ডাক্তারের নাম দিল রানা–ডা. হ্যারল্ড ফ্ল্যানাগান। ওটা কম্পিউটারে টাইপ করে এন্টার চাপল টমি। স্ক্রিনে ভেসে উঠল দুটো মাত্ৰ শব্দ—নট ফাউণ্ড। ভুরু কুঁচকে কি-বোর্ড নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল টমি। কয়েক মিনিট পেরিয়ে যাবার পরও কোনও তথ্য হাজির হলো না স্ক্রিনে।

‘দ্যাটস্ অড!’ বিড়বিড় করল সে

‘কোনও সমস্যা?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

মাথা ঝাঁকাল টমি। ‘কম্পিউটারের রেকর্ড যদি ঠিক থাকে, তা হলে বলতে হয়—আপনার এই ডাক্তারের কোনও অস্তিত্ব নেই। এই হাসপাতালে একটা প্যারাসিটামলও ইস্যু করেনি সে কোনোদিন।’

‘অসম্ভব।’ বলল রানা। ‘ম্যাহোনি-র মেডিক্যাল রেকর্ডে নাম আছে তার!

‘অথচ কম্পিউটারে নেই। এর মানে একটাই হতে পারে—ডেটাবেজ থেকে মুছে ফেলা হয়েছে লোকটার তথ্য। কে মুছেছে, কেন মুছেছে, কবেই বা মুছেছে… তা আমি জানি না।’

‘হুম। ঠিক আছে, পরেরটা দেখা যাক। ডা. স্ট্যানলি অ্যাবোট।’

কি-বোর্ড খটখটাল টমি। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘হ্যাঁ, পাওয়া গেছে। কিন্তু ধরাধামে নেই বেচারা। এই হাসপাতালেই মারা গেছেন ভদ্রলোক— সেরিব্রাল হেমারেজে। একটু অদ্ভুতই বলতে হবে ব্যাপারটা—বয়স মাত্র তেত্রিশ হিল তার।  এত কম বয়সে হেমারেজ….’

‘কবে মারা গেছে?’

‘একুশে মার্চ, উনিশশো বিরানব্বুই।’

‘হাসপাতাল থেকে ম্যাহোনি ছাড়া পেয়েছিলেন তেরো তারিখে,’ বিড়বিড় করল রানা। এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই মারা গেল তার ডাক্তার? টমির দিকে ফিরল। ‘নার্সদের নামগুলো দেখো, প্লিজ।’

ক্যাথারিন কনেলি। মৃত. ২৬-৩-৯২।

অ্যালিস ডানবার। মৃত. ২৬-৩-৯২।

জ্যানেট ফ্রিম্যান। মৃত. ২৬-৩-৯২।

গম্ভীর মুখে চেয়ারে হেলান দিল টমি। বোকা নয় সে, গোলমালের আভাস পাচ্ছে। বলল, ‘মনে হচ্ছে মড়ক লেগেছিল, তাই না? বিয়ানব্বুইয়ের মার্চ মাসটা ছিল ভীষণ অপয়া, বিশেষ করে ছাব্বিশ তারিখটা। একসঙ্গে তিন-তিনজন নার্স মারা গেল…

‘কীভাবে মারা গেছে, তা লেখা আছে?’

উঁহুঁ। তারমানে হাসপাতালের সীমানার ভিতরে মারা যায়নি ওরা।’

‘কিন্তু একই দিনে মারা গেছে—ব্যাপারটা খুবই অস্বাভাবিক। যদি কারণটা জানা যেত…’

‘এক মিনিট,’ বলে উঠল টমি। ‘নিতলার সাপ্লাইরুমে পুরনো একজন স্টাফ আছে, আমরা সবাই দাদীমা বলে ডাকি তাকে। শুনেছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এখানে কাজ করছে সে দাঁড়ান, ওকে জিজ্ঞেস করে দেখি… হয়তো মনে আছে তার ঘটনাটা।’

ইন্টারকম তুলে ডায়াল করল সে। ওপাশে কল রিসিভ করা হতেই স্পিকার অন করে দিল।

‘ফার্স্ট ফ্লোর সাপ্লাই!’ খনখনে একটা কণ্ঠ শোনা গেল।

‘হাই, দাদীমা! কেমন আছ? টমি বলছি।’

‘টমি… দুষ্টু টমি! কী চাই?’

‘আমার এখানে এক ভদ্রলোক একেছেন, পুরনো কয়েকজন স্টাফের ব্যাপারে খোঁজ নিতে। আচ্ছা তোমার কি মনে আছে, বিরানব্বুই সালে তিনজন নার্স একসঙ্গে মারা গিয়েছিল কি না?’

‘কী যে বলো, সে-কথা কি ভোলা যায়। ক্যাথি কনোলি ছিল ওদের মধ্যে, মেয়েটাকে আমি খুবই ভালবাসতাম।’

‘কী ঘটেছিল?’

‘সাগরভ্রমণে গিয়েছিল তিন বান্ধবী। বাতাসে বোট উল্টে গিয়ে তিনজনই ডুবে যায় পানিতে। ওদেরকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

এবার প্রশ্ন করল রানা।

‘সাগরভ্রমণ? মার্চ মাসে?’

‘কী আর বলব, কপাল খারপ হলে যা হয় আর কী। বড়লোকের এক ছেলে ওদেরকে দাওয়াত করেছিল ইয়ট ক্লাবের

২৭৬

রানা-৪১৩

পার্টিতে। হৈ-হুল্লোড় করতে করতে রাতের বেলা ওদের খায়েশ জাগল বোট নিয়ে সাগরে যাবার… তখনই ঘটল দুর্ঘটনা!’

‘রাতে ঘটেছিল দুর্ঘটনা।‘

‘হ্যাঁ। সেজন্যেই তো লাশগুলো তার খুঁজে পাওয়া গেল না।’

‘আর কেউ মরেছে ওই দুর্ঘটনায়?’

‘না, স্যর,’ জানাল দাদীমা। সঙ্গের ছেলেগুলো ভাল সাঁতারু ছিল। ওদেরকে বাঁচাবার চেষ্টা করেনি কেন, সেটাই আশ্চর্য।’

‘কোথায় ঘটেছিল ওই ঘটনা, মনে পড়ে আপনার?’ হ্যাঁ। উপকূলের কাছে… মার্কেলহেডে।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে লাইন কেটে দিল রানা। চেহারায় মেঘ জমেছে ওর।

‘ঝামেলা, তাই না?’ এর মুখ দেখে বলল টমি।

‘হ্যাঁ, ঝামেলাই বটে, থমথমে গলায় বলল রানা। ‘আরও দশটা নাম আছে আমার হাতে। এগুলো দ্রুত চেক করে দিতে পারবে?’

আটজন নার্সের মধ্যে চারজনকে জীবিত পাওয়া গেল। তাদের ভিতর একজন চলে গেছে স্যান ফ্রান্সিসকোতে, ঠিকানা নেই; একজন ডালাসে বাস করছে নিজের মেয়ের সঙ্গে; আর শেষ দু’জন রয়েছে উস্টারের সেইন্ট অ্যাগনেস রিটায়ারমেন্ট হোমে। একজন সার্জন আর স্কিন গ্রাফট স্পেশালিস্ট মারা গেছেন; তবে দ্বিতীয় সার্জন… ডা. নাথান হ্যামার… তিয়াত্তর বছর বয়সে রিটায়ার করেছেন গত বছর; এখন কুইন্সিতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন।

‘তোমার ফোনটা ব্যবহার করতে পারি?’ টমিকে বলল রানা।

‘যত খুশি করুন,‘ হাসল তরুণ। ‘ফোন তো আমার না, হাসপাতালের।’

স্ক্রিন থেকে ডা. হ্যামারের নাম্বার দেখে নিল রানা, ডায়াল করল ওটায়।

দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল ভারী কণ্ঠ। ‘হ্যামার বলছি।’

‘আমার নাম মাসুদ রানা, স্যর,’ বলল রানা। ‘আমাকে আপনি চেনেন না। তবে জরুরি একটা বিষয়ে তথ্যের জন্য আপনাকে ফোন করেছি। ম্যাসাচুসেটস্ জেনারেলের একটা কেস… বিশ বছর আগেকার। আপনি একটু সময় দিলে খুব ভাল হয়।’

‘পেশেন্টের নাম কী? ওখানে তো বহু রোগী দেখেছি আমি।’

‘সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনি, স্যর।

কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ডা. হ্যামার। তারপর বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আগেই বোঝা উচিত ছিল, ব্যাপারটা কবর পর্যন্ত ধাওয়া করে বেড়াবে আমাকে। আরে বাবা, মানুষের কি ভুলচুক হয় না? ডাক্তার হয়েছি বলে কি ফেরেশতা হয়ে গেছি নাকি?’

‘ভুলচুক?’

‘জেনে রাখো বাছা, অমন ভুল জীবনে খুব কমই করেছি আমি। বারো বছর ডিপার্টমেন্ট অভ সার্জারির হেড ছিলাম, কেউ কোনোদিন অভিযোগ করতে পারেনি আমার বিরুদ্ধে। ওই কেসটায় নাহয় একটা ভুল ডায়াগনোসিস দিয়ে ফেলেছিলাম… কিন্তু তাতে আমার দোষ কোথায়? এক্স-রে আর অন্যান্য টেস্ট রেজাল্ট দেখে তো অমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল।’

ডা. হ্যামারের কোনও ডায়াগনোসিস দেখেনি রানা সিনেটরের ফাইলে। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনাকে কি তা হলে ভুল ডায়াগনোসিসের জন্য সরিয়ে দেয়া হয়েছিল ওই কেস থেকে?’

‘শুধু সরানো?’ রাগ ফুটল বৃদ্ধ সার্জনের কণ্ঠে। ‘আমাকে আর বেলফোর্ডকে বলতে গেলে লাথি দিয়ে তাড়িয়েছে ম্যাহোনির পরিবার।’

‘বেলফোর্ড… মানে, স্কিন-গ্রাফট্ স্পেশালিস্ট?’

‘হ্যাঁ, প্লাস্টিক সার্জনও বলতে পারো ওকে। নিজ পেশায় রীতিমত একজন শিল্পী ছিল ও। অথচ ওকে বাদ দিয়ে শেষ পর্যন্ত আনা হলো পুঁচকে এক ছোঁড়াকে। বেচারা … ম্যাহোনি সুস্থ হবার পর সে নিজেই মারা গেল।’

‘সেরিব্রাল হেমারেজে যে-ডাক্তার মারা গেছেন, তার কথা বলছেন?’

‘হ্যাঁ। যখন ঘটনাটা ঘটল, তখন সুইস ব্যাটা হাজির ছিল ওখানে। কেন বাঁচাতে পারল না, তা বোঝা মুশকিল।’

‘কোন্ সুইস?’

‘হের ডক্টর বলতাম আমরা ওকে। সার্জন… আমাকে রিপ্লেস করেছিল। জুরিখ থেকে আনা হয়েছিল তাকে। কী দেমাগ, ব্যবহার দেখে মনে হতো আমরা মেডিক্যাল স্কুল থেকে নকলবাজি করে পাশ করেছি!’

‘সে এখন কোথায়, বলতে পারেন?’

‘নাহ্। ম্যাহোনি সুস্থ হবার পর সুইটজারল্যাণ্ডে ফিরে গিয়েছিল। আমি খোঁজখবর রাখার আগ্রহ পাইনি।’

‘এক্সকিউজ মি, স্যর। ভুলের কথা বললেন আপনি। কী ধরনের ভুল?’

সিম্পুল। এক্স-রে আর টেস্ট রেজাল্ট থেকে শেষ কথা বলে। দিয়েছিলাম। ম্যাহোনির বাঁচার কোনও আশা ছিল না… অন্তত আমার অভিজ্ঞতা তা-ই বলছিল।’

কিন্তু সেখান থেকে প্রায় অলৌকিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি, রাইট? আপনার ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করলেন।’

‘নিজেকে নিখুঁত বলে দাবি করছি না আমি। তবে এ-কথা ঠিক, আমার এখনও বিশ্বাস হয় না, লোকটা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠল কীভাবে!’

‘সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ, স্যর।

‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে মিনিটখানেক চিন্তা করল রানা। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘এক্স-রে…’

‘কী?’ মুখ তুলে তাকাল টমি। ‘কীসের এক্স-রে?

একটা চেয়ার টেনে তরুণের পাশে বসল রানা। এই হাসপাতাল সম্পর্কে কতখানি জানো তুমি?’

‘ঠিক কী জানতে চান, বলুন তো?’ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল টমি।

‘এখানে পুরনো এক্স-রে রাখার ব্যবস্থা আছে? কোনও ধরনের রেপোজেক্টরি?’

‘কত পুরনো? বিশ বছর?’ ভুরু নাচাল টমি :

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল রানা

‘আছে। কার এক্স-রে চান?’

‘সিনেটর ম্যাহোনির মুখের।’

‘হোয়াট!’

‘হ্যাঁ। দুর্ঘটনায় সিরিয়াস রকমের আহত হয়েছিলেন তিনি, ‘ সারা শরীরের হাড়গোড় ভেঙে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই প্রচুর এক্স-রে করা হয়েছিল সে-সবের অবস্থা দেখতে। মুখেরও নিশ্চয়ই আছে তার মধ্যে। ওগুলোই আমার চাই… বিশেষ করে দাঁতেরগুলো।

‘আপনি আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছেন, মিস্টার।’

‘এর জন্য ভাল পারিশ্রমিক পাবে। এক হাজার ডলার।’ লোভ দেখাল রানা। কাজটা কিন্তু খুবই সহজ। পুরনো এক্স-রে নিশ্চয়ই সোনাদানার মত পাহারা দেয়া হয় না?’

জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল টমি। ভেবে দেখল প্রস্তাবটা। শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল। ‘ঠিক আছে, আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন।‘

চলে গেল সে।

টেলিফোনের রিসিভার আবার কানে ঠেকাল রানা। এবার ওর এজেন্সির সাহায্য নেয়া যেতে পারে। তাই ফোন করল ওয়াশিংটন শাখা-প্রধান মাহবুবকে। ওপাশে সাড়া পেতেই তড়িঘড়ি করে বলল, ‘মাহবুব, আমি!’

‘একটু ধরুন,’ রানার কণ্ঠ চিনতে পেরে স্ক্র্যাম্বলার অন করল মাহবুব। ‘হ্যাঁ, এবার নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেন, মাসুদ ভাই। আপনি কোথায়?’

‘বস্টনে। শোনো, হাতে সময় নেই, জলদি একটা কাজ করতে হবে তোমাকে।’

‘কী কাজ?’

‘সিনেটর ডেভিড ম্যাহোনির ডেন্টিস্টকে খুঁজে বের করো। তার অফিস থেকে ম্যাহোনির দাঁতের এক্স-রে জোগাড় করে আনতে হবে। পারবে?’

চুরি করতে হলে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, মাসুদ ভাই!’

‘না, চুরি না। ভুয়া ডকুমেন্ট ব্যবহার করো, ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে ইন্সপেকশনের নাম করে ঢোকো ডেন্টিস্টের অফিসে। ডাক্তারের কাজ রিভিউ করার বাহানায় কিছু কেসফাইল নিয়ে আসবে। সিনেটর ম্যাহোনির ফাইল থাকবে ওর মধ্যে। আজ রাতের মধ্যে ওটা আমার হাতে পৌঁছুনো চাই।’

‘কোথায় পাঠাব?’

‘এজেন্সির বস্টন ব্রাঞ্চে পাঠিয়ো। আমি কালেক্ট করে নেব সময়মত।‘

‘বুঝতে পেরেছি, মাসুদ ভাই।’

কথা শেষ করে টমির কম্পিউটারের সামনে বসল রানা। ইন্টারনেটের সংযোগ আছে ওতে। ব্রাউজার খুলে গ্লোব পত্রিকার ওয়েবসাইটে ঢুকল। সেখান থেকে গেল আর্কাইভে। একে একে ১৯৯১-এর ডিসেম্বর থেকে পুরনো সংখ্যাগুলো ঘাঁটতে শুরু করল। ডেভিড ম্যাহোনির দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেল তাতে। ডিসেম্বরের শেষ ক’দিন আর ৯২-এর জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মুখর হয়ে আছে পত্রিকা তার হালচাল নিয়ে। কিন্তু ওসবে আগ্রহী নয় রানা, অন্য একটা খবর খুঁজছে। এপ্রিলে গিয়ে পেল সেটা। শিরোনামটা এ-রকম:

গোস্তাদের স্কিইং ট্র্যাজেডিতে বস্টনিয়ানের মৃত্যু

ঝটপট খবরটা পড়ে ফেলল রানা। জরুরি তথ্যটা পেল শেষ প্যারায়। তাতে লেখা হয়েছে:

…আল্পসের প্রতি হতভাগ্য সুরকটির অকৃত্রিম ভালবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে পর্বতশ্রেণীর গোড়াতেই চির-সমাহিত করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পরিবার। জানা গেছে, কল দ্যু পিল গ্রামের ছোট্ট গোরস্থানে শেষ নিদ্রায় শায়িত হবে সে…

কে শুয়ে আছে কল দ্যু পিলঁ-র কবরে? ভাবল রানা। আদৌ কোনও লাশ দাফন করা হয়েছে, নাকি কফিনটা খালি?

খুব শীঘ্রি সেটা জানা যাবে।

এক্স-রে নিয়ে ফিরে এসেছে টমি। ওকে পাওনা মিটিয়ে দিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল রানা। রেন্টাল এজেন্সিতে গিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করল, ওটা নিয়ে চলে গেল ম্যাহোনি হল দেখতে। বিশাল এক এস্টেটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ওটা, উঁচু এক পাহাড়ের চূড়ায়; পুরো এলাকার নামই বিখ্যাত পরিবারটার নামে–ম্যাহোনি ড্রাইভ, ম্যাহোনি হিল, ইত্যাদি। পুরনো আমলের পাথরের প্রাচীরে ঘেরা সীমানা, রাস্তা থেকে ছাত ছাড়া কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। ওখানে প্যারাপেট দেখে আন্দাজ করল রানা, পুরনো আমলের দুর্গের আদলে তৈরি হয়েছে বাড়িটা। চারপাশ ভাল করে দেখে মিল ও, লক্ষ করল–এস্টেটের সামনে, রাস্তার ওপারে নতুন একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। ওটার ছাতে উঠতে অসুবিধে হলো না। ওখান থেকে বিনকিউলার দিয়ে তাকাল এস্টেটের ভিতরে।

যা ভেবেছে তা-ই। আসলেই একটা দুর্গ ওটা। ভীমদর্শন এক ইমারত, মোটা আর ভারী পাথরে গড়া। চারকোনায় চারটা টাওয়ার। সামনে কেউইয়ার্ডের আদলে রয়েছে বিশাল এক কংক্রিটের উঠান—বোধহয় পার্কিং লট হিসেবে ব্যবহার হয় ওটা! একপাশে গ্যারাজ, তাঁতে অন্তত বিশটা গাড়ি রাখা যাবে। নিরাপত্তার খাতিরে প্রায় খালিই রাখা হয়েছে চারপাশের জমি। ছোটখাট বাগান আছে, কিন্তু বড় গাছের সংখ্যা একেবারে কম। ইউনিফর্ম-পরা গার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে সবখানে, ওদের ফাঁকি দিয়ে উন্মুক্ত ওই জমি পেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছুনো প্রায় অসম্ভব একটা কাজ।

এ-মুহূর্তে অনুপ্রবেশের কোনও ইচ্ছে নেই রানার। তাই রেকি শেষ করে ফিরে এল হোটেলে। দিনের বাকিটা সময় বিশ্রাম নিল, সেইসঙ্গে সাজাল নিজের পরিকল্পনা।

রাত ন’টায় আবার বেরুল ও, তখন মনোলোভা সাজে রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে বস্টন নগরী। ভাউনটাউনের ছোট্ট একটা পাবে চলে গেল, রওনা হবার আগে ফোনে কথা হয়েছে রানা এজেন্সির বস্টন শাখার সঙ্গে জানতে পেরেছে, রাত আটটার ওয়াশিংটন টু বস্টন ফ্লাইটে দরকারি ফাইলটা পাঠিয়ে দিয়েছে মাহবুব। ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে ওটা।

 রানা যখন পাবে ঢুকল, ভিতরে তখন বেশ ভিড়। কোমল, মৃদু, ঠাণ্ডা আলোয় স্বপ্নাচ্ছন্ন একটা পরিবেশ বিরাজ করছে। উদাস চেহারার এক যুবক স্টেজে এসে দাঁড়াল, হাতে স্প্যানিশ গিটার, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, এলোমেলো চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ভারী, বিষণ্ণ সুরে গান ধরল সে।

গান শোনায় মন নেই রানার, তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিল চারদিক। কোন টেবিল খালি নেই। সবার থেকে একটু দূরে, কোণের টেবিলে একা বসে আছে তরুণ এক বাঙালি। ঈগলের মত ধারালো চেহারা, পরনে জিন্স আর লেদার জ্যাকেট, চোখে রিমলেস চশমা। রানা এজেন্সির বস্টন শাখাপ্রধান তুহিন। কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে হাতঘড়ির উপর চোখ বুলিয়ে মুখ তুলে তাকাতেই রানাকে দেখতে পেল সে, ভাঁজটা মিলিয়ে গেল কপাল থেকে। একটা হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওর

দু’সারি টেবিলের মাঝখান দিয়ে দৃঢ়, দ্রুত পায়ে এগোল রানা। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তুহিন, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে করমর্দন করল রানার সঙ্গে। বসল রানা। আঙুল তুলে ওয়েইটারকে ডাকল, দু’জনের জন্য কফির অর্ডার দিল।

‘এনেছ ওটা?’ ওয়েইটার চলে গেলে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল রানা।

‘হ্যাঁ।’ টেবিলের তলা দিয়ে একটা ব্রাউন পেপারের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল তুহিন। ‘সিনেটর ম্যাহোনির ডেন্টাল রেকর্ড।’

‘গুড।’ প্যাকেটটা কোটের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলল রানা।

‘কিছু মনে করবেন না, মাসুদ ভাই,’ তুহিন বলল। ‘ব্যাপারটা কী নিয়ে, আমাকে বলা যাবে? ম্যাহোনির পিছনে লেগেছেন কেন আপনি?’

‘আপাতত ওসব না জানাই ভাল তোমার জন্য।’

‘কিন্তু ঢাকায় চিফ অস্থির হয়ে উঠেছেন। সোহেল ভাই খবর পাঠিয়েছেন আমাদের সব ব্রাঞ্চে- আপনার খোঁজ পাওয়ামাত্র যেন রিপোর্ট করি।’

‘বস্টনে এসেছি, এটা জানিয়ে দিতে পারো। অন্যান্য ইনফরমেশন আমি নিজেই পাঠাব যথাসময়ে।’

‘বুঝতে পারছি, এ-মুহূর্তে পুলসেরাত পার হচ্ছেন। আমার করণীয় কিছু আছে, মাসুদ ভাই??

‘না, আপাতত একাই এগোতে চাই আমি। সাহায্য দরকার হলে তোমাদেরকে জানাব।’

কফি এসে গেছে। তাড়াতাড়ি কাপ খালি করে উঠে পড়ল রানা।

.

পরদিন সকালে অ্যাণ্ডোন্ডারের মেইন স্ট্রিটে হাজির হলো রানা, ‘মার্কাস স্ট্যানটন নামে এক ডেন্টিস্টের অফিসে। রাতে সিনেটর ম্যাহোনির ডেন্টাল রেকর্ডের ফাইল পড়ে দেখেছে ও, জানতে পেরেছে—তাঁর ছেলেবেলায় এই ডাক্তারই পুরো ম্যাহোনি পরিবারের দাঁতের চিকিৎসা করতেন। ভেবে দেখেছে রানা, ম্যাহোমি আর তার ছোটবেলার বন্ধুর মধ্যে যে-রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাতে ওদের একই ডেন্টিস্টের কাছে যাবার কথা। ধারণাটা কতখানি সত্যি, সেটাই দেখতে এসেছে।

অফিসে ঢোকার পর রিসেপশনিস্ট জানাল, ডা. স্ট্যানটন বেশ কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। এখন তাঁর জায়গা নিয়েছে তাঁরই ছোট ছেলে-ম্যাথিউ স্ট্যানটন। বাপের মত সে-ও ‘ডেন্টিস্ট। গতকালকের কাভারটাই ব্যবহার করছে রানা, সিনেটরের অফিস থেকে আসা স্টাফ সেজেছে। কাজেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে দেরি হলো না। ডাক্তারের কাছে সিনেটর আর তার পুরনো বন্ধুর

রেকর্ড চাইল ও, বলল–অফিশিয়াল কাজের জন্য ওগুলো প্রয়োজন।

কিছুই সন্দেহ করল না ডাক্তার, প্রিয় সিনেটরের কথা শুনেই গলে গেছে সে। পুরনো সমস্ত রেকর্ড ফেলে রাখা হয়েছে অফিসের স্টোররুমে, অ্যাসিসটেন্টকে নিয়ে নিজেই ঢুকে পড়ল ওখানে বেরিয়ে এল ঘণ্টাখানেক পর। সারা শরীরে ধুলোবালি মাখা অবস্থায়। হাতে ধরে রেখেছে পুরনো একটা বাক্স।

‘পেয়েছি আপনার জিনিস, মি. রানা, হাসিমুখে বলল ডা. স্ট্যানটন। বাক্স থেকে দু’সেট এক্স-রে বের করে দিল। ‘বাপ রে, স্টোরটার যে এমন দুর্দশা, তা আগে জানা ছিল না। সময় করে পরিষ্কার করতে হবে ওটা।’

‘সরি, কষ্ট দিলাম আপনাকে,’ ভদ্রতা দেখিয়ে বলল রানা। ‘সিনেটরকে বলব আপনার কথা, নিশ্চয়ই খুশি হবেন তিনি।

‘না, না, এ আর এমন কী?’ বিনয়ে বিগলিত হয়ে গেল ডাক্তার। ‘আমাদের জন্য কত কী করছেন উনি, আমরা বুঝি এইটুকু করতে পারব না?’

‘তা হলে আরেকটু কষ্ট দেব আপনাকে।’ ব্রিফকেস থেকে গতকাল সংগ্রহ করা এক্স-রে ফিল্মগুলো বের করল রানা। ‘এগুলোও সিনেটর আর তাঁর বন্ধুরই। কিন্তু তাড়াহুড়োয় মিশিয়ে ফেলেছি। কোটা কার, মনে করতে পারছি না। একটু মিলিয়ে দেবেন?’

‘শিয়োর!’ সরগুলো এক্স-রে নিয়ে একটা ল্যাম্পের সামনে চলে গেল ডাক্তার। আলো ফেলে মেলাল সেট। তারপর ফিরিয়ে দিল রানার হাতে। ‘হয়ে গেছে।

‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে, ডা. স্ট্যানটন। ‘

‘ধন্যবাদ আপনাকেও। কোনও দরকার পড়লেই সোজা চলে আসবেন এখানে।’

বিদায় নিয়ে ডেন্টিস্টের অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। গাড়িতে উঠে কোলের উপর তুলে নিল ফাইলদুটো। কী দেখবে? উত্তেজনায় কাঁপছে দু’হাত।

ফাইলের উপরে সিনেটর আর তার বন্ধুর নাম লিখে দিয়েছে ডাক্তার। প্রথমে ডেভিড ম্যাহোনিরটা খুলল। ছেলেবেলার এক্স-রে-র সঙ্গে ওতে রাখা হয়েছে হাসপাতাল থেকে আনা এক্স-রে—চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল রানা। কিন্তু ওয়াশিংটনের সেটটা নেই এখানে! তারমানে সিনেটে যে-মানুষটা বসে আছে, সে কোনোদিন অ্যাকসিডেন্ট করেনি ম্যাসাচুসেটস টার্নপাইকে! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট যে হতে চলেছে, সে ডেভিড ম্যাহোনি দ্য থার্ড নয়!

প্রমাণ পেয়ে গেছে রানা। কাঁপা হাতে দ্বিতীয় ফাইল খুলল। বন্ধুর ডেন্টাল এক্স-রে-র সঙ্গে ওয়াশিংটনের সেটটা রেখেছে ডাক্তার। আর কোনও সন্দেহ নেই। ফাইল বন্ধ করে উপরে লেখা নামটা পড়ল ও।

মাসিমো গুইদেরোনি- রাখাল বালকের ছেলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *