সেই কুয়াশা ২.১

এক

ভিয়া ফ্রাঙ্কাতি-তে দামি একটা রেস্তোরাঁ আছে, লুচিনি নামের তিন ভাই সেটার মালিক, যদিও রেস্তোরাঁ চালায় স্রেফ বড়জন। চতুর শেয়ালের মত স্বভাব, তবে সাদাসিধে চেহারা আর নিষ্পাপ অভিনয়ের মুখোশ দিয়ে নিজের আসল চরিত্র লুকিয়ে রাখায় সে ওস্তাদ। রোমের উঁচুমহলের লোকজনের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এই লুচিনি, কারণ গোমর রক্ষার ব্যাপারে তার জুড়ি হয় না। উঁচু স্তরের দালাল হিসেবে কাজ করে সে, তার মাধ্যমেই যোগাযোগ রক্ষা করে অগণিত মানুষ—তাঁদের মধ্যে অবৈধ সম্পর্কের জালে জড়ানো প্রেমিক-প্রেমিকা যেমন আছে, তেমনি আছে অসৎ সরকারি কর্মকর্তা আর অন্ধকার জগতের মানুষ। অনিশ্চয়তা আর অবিশ্বাসের সাগরে সে যেন এক অনড় দ্বীপ, যেখানে ভিড় জমায় সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকা মানুষেরা।

লুচিনিকে বহুদিন থেকেই ইনফর্মার হিসেবে ব্যবহার করছে মাসুদ রানা, সে-ও টাকার বিনিময়ে খুশিমনেই কাজ করছে ওর হয়ে। এমন কোনও খবর নেই, যা তার কাছে পাওয়া যায় না। যে-কোনও গুজব, বা কানাঘুষোর আড়ালে কতখানি সত্য লুকিয়ে আছে, তা একমাত্র লুচিনি-ই বলতে পারে। বিয়াঞ্চি পরিবারের বংশধরদেরকে ট্র্যাক করবার জন্য তার সাহায্য নেবার কথা এমনিতেই ভাবছিল রানা, সোনিয়া মাযোলার সঙ্গে কথা বলবার পর লুচিনির সঙ্গে যোগাযোগ করাটা একেবারে অপরিহার্য হয়ে, পড়েছে। বিয়াঞ্চি পরিবার এখন বিয়াঞ্চি-পাভোরোনি নামে- পরিচিত। ওই সার্কেলের খোঁজখবর নিতে হলে ধূর্ত রেস্তোরাঁমালিকের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। ওখানেই আজ দুপুরে লাঞ্চ সারবে বলে ঠিক করেছে ও।

হোটেলের জানালা গলে কামরায় ঢুকছে রোদ। নীচে… ভিয়া ভেনেতো-র রাস্তা থেকে ভেসে আসছে গাড়িঘোড়ার আওয়াজ। ঘড়ি দেখল রানা, লাঞ্চের এখনও অনেক দেরি। বারোটাও বাজেনি। রুমিং হাউসে আর ফেরা যাবে না, তাই ডা. চক্রবর্তীর অফিস থেকেই লানিতা হোটেলের এই স্যুইটটা রিজার্ভ করেছিল ও। ম্যানেজার ওর পূর্ব-পরিচিত, তাই রাত একটার সময় সার্ভিস এন্ট্রান্স দিয়ে ভিতরে ঢুকতে অসুবিধে হয়নি। কামরায় পৌঁছেই জোর করে ঘুমাতে পাঠিয়েছে সোনিয়াকে। নিরাপত্তামূলক কয়েকটা ব্যবস্থা নেবার পর নিজে শুয়েছে রাত আড়াইটার সময়… স্যুইটের বসার ঘরে, সোফায়।

কফির কাপে চুমুক দিল রানা, শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। ঘুম ভাল হয়নি। সকাল ন’টায় উঠে পড়েছে, নাশতা সেরে বেরিয়ে গিয়েছিল কেনাকাটার জন্য। রুমিং হাউস ছাড়ার সময় ভিয়া কণ্ডোট্টি থেকে সোনিয়ার জন্য কেনা কাপড়গুলো ডাফল ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছে ও, কিন্তু ওগুলোর সঙ্গে মেকাপের সরঞ্জাম নেই। তাই হোটেল সংলগ্ন একটা দোকানে গিয়ে মেকাপ-কিট কিনেছে মেয়েটার জন্য… আর কিনেছে একটা বড়-সড় গুচ্চি সানগ্লাস। মেকাপের রঙ দিয়ে মুখের দাগ ঢাকবে সোনিয়া, আর সানগ্লাসে ঢাকবে কালসিটে পড়া চোখ। যখন ফিরল, তখনও জাগেনি সোনিয়া। ওর পোশাক আর মেকাপের সরঞ্জাম বিছানার পাশে রেখে এসেছে রানা। তারপর সামনের কামরায় বসে অর্ডার দিয়েছে কফির। জানালার পাশে বসে নজর রাখছে বাইরে।

স্যুইটের বেডরুমের দরজায় নড়াচড়ার আভাস পেয়ে ঘাড় ফেরাল রানা। ঘুম ভেঙেছে সোনিয়ার, বেরিয়ে এসেছে কামরা থেকে। কালসিটে দাগে ভরা মুখ হাসিতে ঝলমল করছে। একহাতে ধরে রেখেছে হ্যাঙারে ঝোলানো সিল্কের ড্রেস। ইস্ত্রি করে … ওটাই বিছানার পাশে রেখে এসেছিল রানা।

‘গুড মর্নিং!’ বলল ও।

পাল্টা অভিবাদন জানাল না সোনিয়া। কপট রাগ ফুটিয়ে বলল, তুমি কি আমার কাজের লোক?’ উঁচু করল ড্রেসটা। ‘পোশাকটা আমি নিজেই ঠিকঠাক করে নিতে পারতাম না?’

তুমি ইস্ত্রির সময় পাবে না,’ রানা বলল। ‘তাই কাজ এগিয়ে রেখেছি। অসুবিধে কোথায়?’

এ-ধরনের সেবা পেতে অভ্যস্ত নই আমি,’ সামনে এগিয়ে এল সোনিয়া। ‘রাজকুমারীর মত লাগছে নিজেকে, চারপাশে যেন ভক্তরা সব ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমার কাজ করে দেবার জন্য উদ্‌গ্রীব। আমার ভিতরের সমাজবাদী আদর্শ সেটা মানতে পারছে না।’

‘আবার ভাষণ শুরু হয়ে গেল?’ বিরক্ত গলায় বলল রানা। ‘স্রেফ একটা ড্রেস ইস্ত্রি করে দিয়েছি, তোমার হাত-পা তো আর টিপে দিইনি! তা হলে নাহয় সেবাযত্ন বলা যেত! অযথা বকবক না করে হাত-মুখ ধুয়ে এসো। আমি কফির অর্ডার দিচ্ছি।’

‘শুধু কফি?’ ভুরু কোঁচকাল সোনিয়া!

‘ব্রেকফাস্টের সময় নেই। তুমি তৈরি হয়ে নিলে আমরা আর্লি-লাঞ্চে যাব। বিছানার পাশে মেকাপ-কিট পেয়েছ তো? ওটা ব্যবহার কোরো।’

‘লাঞ্চ? এত তাড়াতাড়ি?’

‘আসলে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি আমরা। যাও, দেরি কোরো না।’

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেল সোনিয়া। একটু পর বেডরুম থেকে ভেসে এল মৃদু গুঞ্জন—মনে হলো কর্সিকান কোনও গানের সুর ভাঁজছে মেয়েটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রানা, স্বাভাবিক হয়ে আসছে সোনিয়া। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেটে গিয়ে মুক্তির আনন্দ অনুভব করতে শুরু করেছে। এই অনুভূতির স্থায়িত্ব কতটুকু হবে, সেটাই প্রশ্ন। সামনে ভয়ানক বিপদ আসছে, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই রানার মনে। বিয়াঞ্চি পরিবারের পিছনে লাগার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেবে বিপদ। তখনও কি এই ভাব বজায় থাকবে মেয়েটার?

অর্ডার দিয়ে নতুন করে কফি আনাল রানা। তার খানিক পরেই থেমে গেল গুনগুন। বেডরুমের দরজা খুলে গেল, মার্বেলের মেঝেতে হাই-হিলের আওয়াজ পেল ও। ঘাড় ফেরাল রানা, ক্ষণিকের জন্য প্রশংসা ফুটল চোখে দোরগোড়ায় দাঁড়ানো অপরূপাকে দেখে। চেনাই যাচ্ছে না সোনিয়াকে, পুরোপুরি বদলে গেছে দামি পোশাক আর মেকাপের কল্যাণে। কর্সিকার রোদে পোড়া ব্রোঞ্জ কালারের কোমল চামড়ার সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে লাল-কালো সিল্কের ড্রেস। লিপস্টিক মাখা ঠোঁটদুটো যেন চুমো খাবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। সুন্দর চুলের গোছার একাংশ ঢাকা পড়েছে সাদা রঙের হ্যাটের তলায়, বাকিটা ঝুলে আছে বুকের উপর। তাকাবার পর আর দৃষ্টি সরাতে ইচ্ছে হয় না।

‘কেমন লাগছে আমাকে?’ জানতে চাইল সোনিয়া।

ঢোঁক গিলল রানা। ‘সুন্দর।’

গালের কাছে একটা হাত তুলল সোনিয়া। মুখের দাগগুলো

দেখা যাচ্ছে না তো?’

‘ভুলেই গিয়েছিলাম ওগুলোর কথা!’

‘তারমানে ঠিকই আছে।’ এগিয়ে এল সোনিয়া। কফির কাপ তুলে নিল।

‘শারীরিক কোনও অসুবিধে নেই তো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘ন… না।’

‘মিথ্যে বলছ,’ গম্ভীর হয়ে গেল রানা। ‘ব্যথা আছে এখনও, তাই না?’

‘ইয়ে… হ্যাঁ,’ ইতস্তত করে স্বীকার করল সোনিয়া। তারপর তাড়াতাড়ি যোগ করল, ‘কিন্তু সিরিয়াস কিছু নয়। তোমার ওই ডাক্তার ভদ্রলোক দারুণ ওষুধ দিয়েছেন। খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না আর।’

‘কখনও কোনও অসুবিধে হলেই চলে যেয়ো ওঁর কাছে,’ বলল রানা। ঠিকানা মনে আছে তো?’

‘এমনভাবে বলছ, যেন তুমি থাকবে না আমার সঙ্গে,’ ভুরু কোঁচকাল সোনিয়া। ‘একসঙ্গে কাজ করব আমরা, এমনটাই কিন্তু কথা হয়েছে!’

হুঁ। কিন্তু কাজের ধারা এখনও ব্যাখ্যা করিনি আমি। রোমে আপাতত একসঙ্গে থাকব আমরা যা তথ্য পাব, সেটার ভিত্তিতে এগিয়ে যাব আমি; আর তুমি এখানে থেকে আমার আর কুয়াশার মধ্যে লিয়াজোঁ মেইনটেইন করবে।’

‘পোস্টাফিস হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছ আমাকে? ওটা আবার কেমনতরো কাজ?’

‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেতে যেতে ব্যাখ্যা করব। কফি শেষ করো, আমি আমার হ্যাট আর তোমার কোট নিয়ে আসছি।’ ক্লজিটের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল রানা। সোনিয়াকে চকিতের জন্য ঠোঁট কামড়াতে দেখেছে… নিশ্চয়ই ব্যথায়। ‘সোনিয়া, আমার কথা শোনো। ব্যথা পেলে সেটা লুকানোর চেষ্টা কোরো না। তাতে কারও লাভ হবে না। কতটা খারাপ লাগছে?’

‘বেশি না… সত্যি। এ-ব্যথা চলে যাবে, আমি শিয়োর! অভিজ্ঞতা আছে আমার!

‘ডাক্তারের কাছে যাবে আরেকবার?’

‘না, প্রয়োজন নেই। চিন্তার কোনও কারণ নেই তোমার।

‘অবশ্যই আছে। অসুস্থ মানুষ ঠিকমত কাজ করতে পারে না। ব্যথা-বেদনার কারণে ভুলভাল হয়ে যায়। আমাদের কাজে ভুলের কোনও অবকাশ নেই।’

‘আমি পারব… বিশ্বাস করো। ভুল হবে না কোনও।’

কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল রানা। তারপর বলল, ‘বেশ, দেখা যাক।’

.

এক ঘণ্টা পর।

রেস্তোরাঁর ফয়েই-এ দাঁড়িয়ে আছে দু’জনে। লক্ষ করল রানা, আশপাশের লোকজনের মুগ্ধ দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে সোনিয়ার উপর। বিশেষ পাত্তা দিল না। ডাইনিং রুমের প্রবেশপথে, পর্দা সরিয়ে উদয় হয়েছে বড় লুচিনি। রানাকে দেখে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সে, দু’চোখে দানা বাঁধল শঙ্কার মেঘ। তবে তা কেটে গেল পরক্ষণে। বরাবরের মত একগাল কপট হাসি নিয়ে এগিয়ে এল লোকটা

‘বেনভেনুতো, আমিকো মিয়ো!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল লুচিনি।

‘কেমন আছ?’ লুচিনির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলল রানা। ‘আমার বান্ধবীকে তোমার ফেটুচিনি খাওয়াতে নিয়ে এলাম।’

‘অবশ্যই, অবশ্যই!’ মৃদু মাথা নোয়াল লুচিনি, সঙ্কেত বুঝতে পেরেছে। বিশেষ ওই খাবারটার নাম বলা মানে রানা একান্তে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ‘আমার ফেটুচিনি ইটালির সেরা, সিনোরিনা!’ দুই অতিথিকে পথ দেখিয়ে ডাইনিং রুমের একপ্রান্তে, নিয়ে গেল রেস্তোরাঁমালিক, খালি একটা টেবিলে বসাল। ‘একটু পর আপনিও বলবেন এ-কথা। তবে, আগে একটু ওয়াইন চেখে নিন। মুখের স্বাদ বাড়বে।’

চলে গেল লুচিনি। ওয়েইটার এসে ওয়াইনের বোতল দিয়ে গেল, খানিক পরে নিয়ে এল পাস্তা-সদৃশ ফেটুচিনিও। খাওয়া-দাওয়ার পর আবার দেখা মিলল রেস্তোরাঁমালিকের। রানার পাশের চেয়ারে এসে বসল সে। সোনিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিল রানা।

আমার সঙ্গে কাজ করছে ও,’ বলল রানা। ‘তবে সেটা কাউকে বলা যাবে না। বুঝেছ?

‘নিশ্চয়ই!’ মাথা ঝাঁকাল লুচিনি।

‘আমার কথাও না। কেউ যদি খোঁজ নিতে আসে, সোজা অস্বীকার করবে। সে যে-ই হোক না কেন।’

‘ঠিক আছে, সেনিয়র রানা। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি আমার। কিন্তু ব্যাপারটা কী? এত রাখঢাক কেন?’

‘সব তোমাকে খুলে বলা যাবে না। তবে এটুকু জেনে রাখো, মাঝে মাঝে সোনিয়া লেখা করবে তোমার সঙ্গে; আমার কাঁছে, কিংবা অন্য একজনের কাছে মেসেজ পাঠাবার জন্য সাহায্য করতে হবে তোমাকে।’

‘আপনার এজেন্সির কী হয়েছে? মেসেজ পাঠানোর জন্য আমার সাহায্য চাইছেন যে?’

‘রানা এজেন্সির উপর নজর রাখা হবে বলে সন্দেহ করছি আমি। তাই বিকল্প পন্থা ব্যবহার করা দরকার।’

‘হুম! কী করতে হবে আমাকে?’

‘আমি চাই মেসেজগুলো রি-রাউটিং করা হোক। আলাদা আলাদা পয়েন্ট অভ অরিজিন থেকে যাবে একেকটা মেসেজ। সেটা ম্যানেজ করতে পারবে?’

অসুবিধে হবার কথা না। ফিরেঞ্জ-এ আমার এক কাজিন থাকে; এথেন্স, তিউনিস আর

আর তেল-আবিবেও কয়েকজন এক্সপোর্টার আছে আমার। আমি যা বলব, তা-ই করবে ওরা। ওসব জায়গা থেকে মেসেজ রিলে করা যাবে।’

‘আর তোমার ফোন? সেটা ক্লিন তো?’

হাসল লুচিনি। ‘পুরো রোমে এমন কোনও লোক নেই, যে আমার ফোনে আড়ি পাতার সাহস করতে পারে।’

অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কথা মনে পড়ল রানার। ক’দিন আগে একই আশ্বাস শুনেছিল তাঁর মুখে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। সেটা বলল লুচিনিকে।

‘অ্যামেরিকার উদাহরণ দিয়ে লাভ নেই,’ হালকা গলায় বলল লুচিনি। ‘ভিয়া ফ্রাঙ্কাতি অন্য জগৎ। কারও গোমর ফাঁস হয় না এখান থেকে।

‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক,’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘ঠিক আছে, এবার কাজের কথায় আসা যাক। একটা নাম বলি, দেখি কী জানো। বিয়াঞ্চি-পাভোরোনি।’

একটা চুরুট ধরাল লুচিনি। বলল, ‘রক্ত খোঁজে টাকা, আর টাকা খোঁজে রক্ত। এ-ছাড়া কী-ই বা বলার আছে?

একটু বিরক্ত হলো রানা। ‘হেঁয়ালি শুনতে চাই না।’

চুরুটে টান দিল লুচিনি। ‘বিয়াঞ্চিরা রোমের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের একটা। ওদের কন্টেসা এখনও নিজের ঠাট বজায় রেখেছেন, কিন্তু সেসব লোক-দেখানো ব্যাপার। পুরো পরিবার দেউলিয়া হতে বসেছিল। অন্যদিকে পাভোরোনিদের অনেক টাকা, কিন্তু শিরায় এক বিন্দু নীল রক্ত ছিল না। বিয়ের মাধ্যমে একত্র হয়েছে দুই পরিবার… পারস্পরিক সুবিধের জন্য আর কী!’

‘কার বিয়ে?’

‘কণ্টেসার মেয়ের সঙ্গে সেনিয়র বার্নার্দো পাভোরোনির। সে বহু বছর আগের কথা। সে-আমলেই কয়েক কোটি লিরা যৌতুক দিয়েছিল পাভোরিনি-রা; সেই টাকায় কন্টেসার ছেলে বাপের উপাধি গ্রহণ করেছে।

‘নাম কী এই ছেলের?

‘মার্সেলো। কাউন্ট মার্সেলো বিয়াঞ্চি।

‘থাকে কোথায়?’

নির্দিষ্ট ঠিকানা বলা মুশকিল। ব্যবসার কাজে সারা বছর চরকির মত ঘুরে বেড়ায়। বোনের কাছাকাছি তিভোলিতে একটা এস্টেট আছে— ভিলা ভেস্তে। তবে সেখানে তেমন একটা থাকে না। এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? কাউন্ট নোংরা কোনও কাজের সঙ্গে জড়িত বলে ভাবছেন?’

‘প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তো বটেই।’

ভুল বলেননি। মার্সেলো বিয়াঞ্চি লোক সুবিধের নয়। ব্যক্তিত্ববান মানুষ, সামনাসামনি দেখলে কিছুই বোঝা যায় না, কিন্তু আমি জানি—তার ভিতরে একটা সাপ বসবাস করে।’

কপালে ভাঁজ পড়ল রানার। ‘তুমি কী করে জানলে?’

‘কাউন্টের সঙ্গে ভাল পরিচয় আছে আমার,’ জানাল লুচিনি। ‘বেশ ক’টা কাজ করে দিয়েছি অতীতে। কী করেছি, তা জানতে চাইবেন না। আগেই বলেছি, আমি কারও গোমর ফাঁস করি না।’

ঠিক আছে, ওসব জিজ্ঞেস করব না, সামনের দিকে ঝুঁকল রানা। ‘কিন্তু ওই কাউন্টের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই। মাসুদ রানা হিসেবে না, অন্য কোনও পরিচয়ে। ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?’

‘হয়তো… যদি উনি ইটালিতে থাকেন আর কী।’

‘আছে?’

‘সম্ভবত। সেদিন একটা পত্রিকায় পড়েছিলাম, কাউন্টের বউ একটা চ্যারিটি অনুষ্ঠান করছেন তাঁদের এস্টেটে। আগামীকাল সন্ধ্যায় হবে ওটা। রোমের নামি-দামি সমস্ত মানুষ থাকবেন ওখানে। এমন ইভেন্টে অনুপস্থিত থাকার কথা না কাউন্টের।’

‘আমিও ওটা মিস করতে চাই না,’ বলল রানা।

‘ঠিক আছে,’ মাথা ঝাঁকাল লুচিনি। দেখি কী করা যায়।

.

হোটেলে ফিরে কাপড় বদলাল সোনিয়া। সিল্কের ড্রেসটা ক্লজিটে ঢুকিয়ে রাখার আগে কোলের উপর রেখে হাত বোলাল কিছুক্ষণ, যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না জিনিসটা ওর। দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল রানা, ভাল লাগল। পোশাক নিয়ে ব্যস্ত মেয়েটা, মন থেকে হারিয়ে গেছে বন্দিত্ব আর বিপদ-আপদের চিন্তা। স্বাভাবিক হয়ে আসছে ধীরে ধীরে t

‘কী ভাবছ?’

সোনিয়ার কণ্ঠ শুনে ধ্যান ভাঙল রানার। অড়াতাড়ি সোজা হয়ে বসল সোফায়। বলল, ‘না… কিছু না।’

‘অবশ্যই কিছু ভাবছ,’ বেডরুম থেকে বেরিয়ে এল সোনিয়া। তাকিয়ে আছ আমার দিকে, কিন্তু মন পড়ে আছে অন্য কোথাও।’

‘আসলে তোমার কথাই ভাবছি। ড্রেসটা এত তাড়াতাড়ি খুলে ফেললে কেন? ভালই তো লাগছিল তোমাকে ওটায়।’

‘এত দামি একটা জিনিস ঘরের ভিতরে পরে থাকব তাই বলে?

‘অসুবিধে কী? নষ্ট হলে আরেকটা কিনে দিতাম।

‘এমনিতেই কম খরচ করোনি আমার পিছনে,’ রানার পাশে বসল সোনিয়া। ‘ধন্যবাদ। ক্রিসমাসেও এত দামি উপহার পাইনি আমি কোনদিন।’

‘ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই,’ বলল রানা। ‘ইকুইপমেন্ট হিসেবে ধরো ওগুলোকে। কাজ করতে গেলে যন্ত্রপাতি লাগে না? এই পোশাকগুলোই তোমার কাজের যন্ত্রপাতি।’

‘মন থেকে বলছ না কথাটা।

‘মানে!’

‘বাদ দাও,’ হাত নাড়ল সোনিয়া। এমনি বললাম।’

সোফা থেকে উঠে বারের কাছে গেল রানা। একটা গ্লাসে উইস্কি ঢালল। সোনিয়াকে বলল, ‘তুমি নেবে? রিলাক্সেশনের জন্য উইস্কি ভাল কাজ দেয়।’

‘না, ধন্যবাদ। এমনিতেই যথেষ্ট রিল্যাক্সড অবস্থায় আছি। কোনও ধরনের চাপ অনুভব করছি না। আচ্ছা, আমাদের নেক্সট প্ল্যান কী? পুরো বিকেল আর সন্ধ্যা পড়ে আছে সামনে। কী করবে বলে ভাবছ?’

কিছুই না। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন। যাও, শুয়ে পড়ো।’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছ? আমার সঙ্গ ভাল লাগছে না?’

‘আমি কি সেটা বলেছি?’

‘বলোনি, কিন্তু একা থাকতে চাইছ তুমি। আমার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছ।’

ক্ষণিকের জন্য মুখের ভাষা হারাল রানা। সচেতনভাবে নয়, কিন্তু অবচেতনভাবে এ-চিন্তাই খেলা করছিল ওর ভিতর। সোনিয়ার প্রতি যে-আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে, সেটাকে অগ্রাহ্য করবার চেষ্টা করছে ও। অসহায়, বিপন্ন একটা মেয়ে; তার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে ঘনিষ্ঠ হওয়া মানে অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়া। সেটাই এড়াতে চাইছিল ও। সোনিয়া তা বুঝে ফেলেছে।

‘না… মানে…’

‘কীসের ভয় তোমার, রানা?’ আহত গলায় বলল সোনিয়া। রানার প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করছে ও-ও। তাতে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছে। ‘কেন দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছ আমাকে? আমার অতীত জেনেছ বলে? বেশ্যার জীবন কাটিয়েছি আমি, নোংরা কাজ করেছি… তাই বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে? এমন মেয়েকে কাছে টানার প্রবৃত্তি হচ্ছে না?

‘ভুল বুঝছ তুমি,’ শান্ত গলায় বলল রানা। এমন কিছু ভাবছি না আমি…’

‘থাক, মিথ্যে সান্ত্বনা দিতে হবে না!’ আচমকা রেগে গেল সোনিয়া। তুমি মহাপুরুষ, আমার মত নরকের কীটকে কেন কাছে ‘ঘেঁষতে দেবে?’

বেডরুমে ছুটে গেল ও। দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা। ‘সোনিয়া, শোনো!’ পিছন থেকে ডাকল রানা, তাতে কোনও লাভ হলো না।

বিকেল পর্যন্ত কামরা থেকে বেরুল না মেয়েটা, রানাও ওকে আর ডাকাডাকি করল না। সময় দিল রাগ কমে আসার জন্য, তারপর নাহয় ভুল ভাঙানো যাবে। সন্ধ্যার ঠিক আগে স্যুইটের দরজায় টোকা পড়ল। শোল্ডার হোলস্টারে গোঁজা পিস্তলের বাটে হাত রেখে জবাব দিতে গেল রানা। পাল্লা একটু ফাঁক করে জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাই?’

‘ভিয়া ফ্রাঙ্কাতি থেকে একটা মেসেজ নিয়ে এসেছি, সেনিয়র।’ বলা হলো ওপাশ থেকে। ‘সেনিয়র লুচিনি পাঠিয়েছেন আমাকে।’

দরজা খুলে দিয়ে বক্তার মুখোমুখি হলো রানা। পরিচিত মুখ, লাঞ্চের সময় রেস্তোরাঁয় এই লোক ওদেরকে খাবার পরিবেশন করেছিল—একজন ওয়েইটার। লুচিনি কোনও ঝুঁকি নেয়নি, নিজস্ব লোককে পাঠিয়েছে মেসেজ দিয়ে লোকটার বাড়ানো হাত থেকে একটা খাম নিল রানা, ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, ‘গ্রাৎসি।’ পকেট থেকে পাঁচ লিরার একটা নোট বের করে বখশিশ দিল

‘প্রেগো, সেনিয়র,’ মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখাল ওয়েইটার। তারপর চলে গেল উল্টো ঘুরে।

দরজা বন্ধ করে স্যুইটের বসার ঘরে ফিরে এল রানা, খামটা খুলল। ভিতর থেকে বেরুল দুটো সোনালি বর্ডারঅলা নিমন্ত্রণপত্র; আর একটা চিঠি। তাতে লেখা:

কাউন্ট আন্তোনেলি খবর পেয়েছেন, ইটালিতে রঘুনাথ সাপ্রে নামে এক ভারতীয় ভদ্রলোক এসেছেন, যাঁর সঙ্গে ওপেক-ভুক্ত দেশগুলোর ভাল কানেকশন আছে। কাউন্টকে বোঝানো হয়েছে, এই ভারতীয় মানুষটি ওসব দেশের শেখদের হয়ে কেনাবেচার কাজ করেন। এ-সব কাজ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয় না, কাজেই কাভার মেইনটেনের জন্য বিশেষ চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে মোটামুটি আইডিয়া থাকলেই উৎরে যেতে পারবেন। তা ছাড়া কাউণ্টকে এ-ও বলা হয়েছে; মি. সাপ্রে স্রেফ ছুটি কাটাতে এসেছেন এ-দেশে… আমোদ-ফুর্তি করবার জন্য। তাই বলতে গেলে সেধেই তিনি চ্যারিটি অনুষ্ঠানের দুটো নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। আশা করি কাজে লাগাবেন ওগুলো। সিনোরিনার জন্য শুভেচ্ছা।

– লুচিনি।

মুচকি হাসল রানা। ভালই কাভার বেছেছে রেস্তোরাঁমালিক। আরব শেখদের দালাল কখনোই নিজের কাজ নিয়ে আলোচনা করবে না কোথাও। ও-প্রসঙ্গে তাই কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে না বিয়াঞ্চি অন্য বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা যাবে।

বেডরুমের দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ হলো। কয়েক মুহূর্ত কিছু ঘটল না, সম্ভবত ইতস্তত করছে সোনিয়া। একটু পর বেরিয়ে এল ও। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল রানা। সাদামাঠা একটা গাউন পরেছে মেয়েটা; অন্তর্বাস নেই, পোশাকের তলায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শরীরের আঁকবাঁক।

বুকের ভিতর কাঁপন অনুভব করল রানা। সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফোটাল। জিজ্ঞেস করল, ‘রাগ পড়েছে?’

জবাব দিল না সোনিয়া। কয়েক সেকেণ্ড নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ওর দিকে। তারপর প্রশ্ন করল, ‘কেন তুমি চাও না আমাকে?’

‘কারণ ফ্রেইটারের হোল্ডে তোমার সঙ্গে আটকা পড়া পশু নই আমি,’ বলল রানা।

‘তা আমি জানি, ‘বলল সোনিয়া। তারপরেও তোমার চোখে কামনার আগুন দেখেছি আমি, দেখেছি সে চোখ ঘুরিয়ে নিতে। কেন বঞ্চিত করছ নিজেকে?

‘বঞ্চিত করছি না। চাইলেই শারীরিক চাহিদা মেটাতে পারি আমি। সে-ব্যবস্থা করাই যায়।

‘চুপ করো!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল সোনিয়া। ‘বেশ্যা দরকার তোমার? আমাকে নাহয় তা-ই ভাবো!’

‘সেটা সম্ভব নয়, সোনিয়া।’

‘তা হলে ওভাবে তাকিয়ো না আমার দিকে। কখনও কাছে, কখনও দূরে… এমন খেলা খেলো না আমার সঙ্গে। কেন এমন করো? কী চাও তুমি?’

কাঁপছে মেয়েটা। হাত ধরে ওকে সোফার এনে বসাল রানা। নরম গলায় বলল, প্লিজ… আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। হ্যাঁ, তোমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করছি আমি। জানি, তুমিও তা-ই করছ। কিন্তু সেটাই সব নয়। খুবই কঠিন একটা জীবন আমার.. আমার সঙ্গে নিজেকে যতটা জড়াবে, ততটাই বিপদ বাড়বে তোমার। ভালবাসার প্রতিদানে পাবে শুধু কষ্ট আর বিচ্ছেদের যাতনা। কাউকে বাঁধনে জড়াবার জন্য জন্ম হয়নি আমার। জেনেশুনে কীভাবে তোমাকে সে আগুনে ঝাঁপ দিতে দেব আমি, বলো?’

রানার কণ্ঠের গভীরতা স্পর্শ করল সোনিয়াকে। অন্য এক চোখে ওর দিকে তাকাল সে। রানার মনের ব্যথা অনুভব করতে পেরে অশ্রু জমল চোখে। আস্তে আস্তে কাছ ঘেঁষে এল। বলল, ‘দয়া করো আমাকে, রানা। বেশিকিছু চাই না আমি কারও কাছে, একটু শুধু ভালবাসা। হোক তা ক্ষণিকের জন্য। আমার জন্য সেটাই অনেক। কোনোদিন কেউ ভালবাসেনি আমাকে।’

বাধা দিতে পারল না রানা, ওকে জড়িয়ে ধরল সোনিয়া… এবং চুমো খেলো। দীর্ঘ চুম্বন, উষ্ণ এবং চোখে পানিতে ভেজা -এর মধ্যে কাম-লোলুপতার ছিটেফোঁটাও নেই, আছে ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি, পরস্পরের প্রতি অঙ্গীকার— ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত এই জগৎসংসারে এটাই যেন একমাত্র সত্য ও সঠিক কাজ। ভাবাবেগেও নয়, নয় শারীরিক চাহিদার কাছে পরাজিত হয়ে, মেয়েটার আকস্মিক পরিবর্তনের প্রতি স্রেফ সমর্থন জানিয়ে পাল্টা চুমো খেলো রানা।

ফিসফিসিয়ে বলল সোনিয়া, ‘আমি তোমাকে এই মুহূর্তে চাই, রানা! এখুনি! কোনও দাবি নেই আমার, কোনও প্রত্যাশা নেই! তাহলে কেন পরস্পরকে আমরা বঞ্চিত করব? নির্লজ্জের মত হয়ে যাচ্ছে, তবু আমি বলব, আমাকে গ্রহণ করো, রানা, প্লিজ!’

সবকিছু ভুলে গেল রানা। সোনিয়ার নিখাদ আবেগের কাছে হার মানল ও। ওকে টেনে নিল নিজের বুকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *