তিন
নুড়ি বিছানো পথটা পাশে রেখে ঘাসের উপর দিয়ে দ্রুত ছুটল রানা, এগোল ছায়ায় ছায়ায়। ভিলার কাছে পৌঁছে গতি কমাল। সামনে উঁচু সিঁড়ি, গিয়ে মিশেছে মূল ভবনের গায়ে। ওখানেই কোথাও গেছে কাউন্ট বিয়াঞ্চি। কিন্তু কার কাছে? এমন কে আছে, বিয়াঞ্চির মত প্রভাবশালী লোকও যার মুখাপেক্ষী হয়? নীচে বসে থাকলে তার জবাব পাওয়া যাবে না। তাই সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করল রানা। বিপদ মোকাবেলার জন্য তৈরি। কোমরে রয়েছে গার্ডের রিভলভার, কোটের তলায় শোল্ডার হোলস্টারে নিজের সিগ-সাওয়ার।
ফ্রেঞ্চ ডোর ঠেলে কোর্টইয়ার্ডের আদলে সাজানো হলঘরে ঢুকল ও। মিউজিশিয়ানদের বাজনা বদলে গেছে, জোড়ায় জোড়ায় নারী-পুরুষ মেতে উঠেছে যুগল নৃত্যে। এদের মাঝে সোনিয়া নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তাকে খোঁজার চেষ্টা করল না রানা। আগে কাউন্ট বিয়াঞ্চিকে চাই। কোথায় সে? চঞ্চল চোখ বোলাল ও কামরার ভিতরে। ভিলার ভিতরদিকে যাবার দুটো দরজা দেখতে পেল, ওগুলোর একটা দিয়ে গেছে বিয়াঞ্চি। কিন্তু কোনটা?
কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই জবাব পাওয়া গেল। নৃত্যরত জুটিদের মাঝ দিয়ে পথ করে দু’জন যণ্ডামার্কা লোক ছুটে যাচ্ছে বুফে টেবিলের ওপাশের দিকে। ডাক পেয়েছে তারা… সতর্ক করে দেয়া হয়েছে! রানাও এগোল ওদিকে
দরজার ওপাশে সিঁড়ি। লালচে পাথরের ধাপগুলো উঠে গেছে উপরদিকে। পায়ের আওয়াজ শুনল রানা… আর শুনল উত্তেজিত কণ্ঠ-উপর থেকে আসছে। দু’জন মানুষ, একজন কথা বলছে শান্ত ভঙ্গিতে, অন্যজন রীতিমত চেঁচাচ্ছে হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মত। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় কণ্ঠটা কাউন্ট বিয়াঞ্চির।
পা টিপে টিপে সিঁড়ি ধরে উঠতে শুরু করল রানা, পিঠ মিশিয়ে রেখেছে দেয়ালের সঙ্গে। হাতে বেরিয়ে এসেছে বিশ্বস্ত সিগ-সাওয়ার। প্রথম বাঁকটার কাছে একটা দরজা আছে, কিন্তু ওটার ওপাশ থেকে কথোপকথনের কোনও আওয়াজ আসছে না। আরেকটু উঠল ও। উপরে… তৃতীয় ল্যাণ্ডিঙের পাশে রয়েছে আরেকটা দরজা; শিকার ওখানেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজার পাশে পৌঁছে গেল ও, চোখ রাখল চাবির ফুটোয়। কাউন্টের পিঠ দেখতে পেল, নাগালের মধ্যে এইমাত্র কামরায় ঢোকা দুই ষণ্ডাও আছে। কিন্তু দ্বিতীয় বক্তা নেই দৃষ্টিসীমার ভিতরে। ভিতরের কণ্ঠদুটো আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। কথাগুলো শুনতে পেল রানা।
ব্রিগেডের কথা বলছে ও! আর… মাই গড়… কর্সিকানদের রাখাল বালকের কথা! সব জানে ও! মাদার অভ গড়… স-অ-ব!’
‘মাথা ঠাণ্ডা করো!’ মৃদু ধমক শোনা গেল। ‘স্রেফ খোঁচাখুঁচি করছে ও, আর কিছু না। এমন চেষ্টা যে করতে পারে, সে-ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে আমাদেরকে। স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তথ্য আছে আমাদের প্রতিপক্ষের কাছে, তা তো আশুরা জানিই! এক অ্যাডমিরালের ফোন পেয়েছিল আমাদের লোক, তখনই বোঝা গেছে ব্যাপারটা। স্বীকার করছি, ওটা সামান্য চিন্তার বিষয়…’
‘সামান্য চিন্তা?’ চেঁচিয়ে উঠল বিয়াঞ্চি। বলুন বিপর্যয়! এ-ব্যাপারে কেউ যদি নিঃশ্বাসও ফেলে, আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে : সবখানে!’
‘সর্বনাশ? তোমার?’ বিদ্রূপের সুরে বলল অচেনা লোকটি। ‘কে তুমি, মার্সেলো? আমরা তোমাকে যা বানিয়েছি, তার বেশি তো কিছুই না। মনে রেখো কথাটা। আর হ্যাঁ… ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি তো স্বীকার করোনি কিছু। চলে এসেছ লোকটার সামনে থেকে। কিছুই প্রমাণ হয় না এতে।’
একটু নীরবতা বিরাজ করল। তারপর নিচু স্বরে বিয়াঞ্চি বলল, ‘ওকে আটক করেছি আমি। একজন গার্ডের পাহারায় রেখে এসেছি ফোয়ারার পাশে।’
‘কী বললে?’ এবার দ্বিতীয়জনের চেঁচানোর পালা। ওকে আটক করেছ? পাগল হয়েছ নাকি? কেন?
‘কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না….’
‘তাই বলে সন্দেহ জাগাবে ওর?’
‘সন্দেহ জাগলেই বা কী? সামান্য এক ভারতীয় লোক… ওকে ট্যাকেল করা কঠিন কিছু না।’
‘তুমি আমাদের সংগঠনের সবচেয়ে দুর্বল লিঙ্ক, মার্সেলো… আবার প্রমাণ করে দিলে সেটা, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল অদেখা লোকটা। এখনও বুঝতে পারোনি, যাকে সামান্য এক ভারতীয় তারই, সে আসলে দুর্ধর্ষ এক বিজ্ঞানী কুয়াশা! গিরগিটির মত রঙ বদলাতে জানে ও, তোমার মত বেকুবকে ধোঁকা দিতে পারে। হাহ্, তোমার ওই গার্ডকে পোকামাকড়ের মত পিষে মারতে একটুও দ্বিধা করবে না সে। না, এ-ভুল অক্ষমণীয়। তোমাকে দলে রেখে আর বিপদ বাড়ানো চলে না। ভিটো! আন্তোনিয়ো।’
দুই ষণ্ডার নাম ধরে ডাক দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের হাতে বেরিয়ে এল সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল। অস্ফুট স্বরে কিছু বলতে গেল বিয়াঞ্চি, কিন্তু সুযোগ পেল না। ঘাতকদের পিস্তলে দুপ্ দুপ শব্দ উঠল। মেঝের উপর লুটিয়ে পড়ল কাউন্টের প্রাণহীন দেহ।
লাশের দিকে এগোতে যাচ্ছিল এক ষণ্ডা, তাকে থামাল রহস্যময় লোকটা। বলল, ‘থাক, ওকে নিয়ে এখন সময় নষ্ট কোরো না। ওর ডেডবডি পাওয়া যাবে–আগামীকাল সকালে… হেড্রিয়নের খাদে, নিজের গাড়ির ভিতর। এখন ওই রঘুনাথ সাথে ওরফে কুয়াশাকে খুঁজে বের করো। ওকে জ্যান্ত আটকাবার চেষ্টা করবার দরকার নেই। দেখামাত্র গুলি করবে। সঙ্গের ওই সাদা পোশাক পরা মেয়েটাকেও। যাও, দুজনেরই লাশ চাই আমি!’
চোয়াল শক্ত হলো রানার, ওদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে শত্রু! ইচ্ছে হলো এখুনি ঢুকে পড়ে কামরার ভিতরে, আক্রান্ত হবার আগেই আক্রমণ করে বসে, খতম করে দেয় ভিতরের দুই খুনি আর তাদের অচেনা মনিবকে। তা-ই করতে যাচ্ছিল, থেমে গেল লোকটা আবার মুখ খোলায়।
শালার মার্সেলো… সব গুবলেট করে দিয়েছ তুমি!’ এক যণ্ডাকে নির্দেশ দিল এরপর। কাজ শেষ করে তুরিনে যোগাযোগ কোরো। ওদেরকে বলবে দুই ঈগল আর বেড়ালকে খবর দিতে কী ঘটেছে এখানে, সেটা যেন জানিয়ে দেয়…’
মাথা ঝাঁকিয়ে দরজার দিকে এগোল দুই খুনি। আর দেরি করা যায় না। সোনিয়াকে বাঁচাতে হবে। উল্টো ঘুরে সিঁড়ি ধরে নামতে শুরু করল রানা… যত দ্রুত পারে। খুব শীঘ্রি বেরিয়ে এল হলঘরে। চঞ্চল দৃষ্টি বোলাল সঙ্গিনীর খোঁজে, কিন্তু প্রথম দর্শনে খুঁজে পেল না। এদিকে সময়ও ফুরিয়ে আসছে। খুনিরা বেরিয়ে আসবে এখুনি। কী করা যায়?
ভেবে দেখল রানা—দু’জন খুনি আসছে… এর মধ্যে একজনকে যদি ঘায়েল করা যায়, তা হলে বিপদের মাত্রা কমিয়ে আনা যায় অনেকখানি। দু’জন যতটা দ্রুত অন্যান্য গার্ডদেরকে সতর্ক করে দিতে পারবে, একজন ততটা পারবে না। তা ছাড়া যাকে ঘায়েল করবে, তার মুখ থেকে অচেনা লোকটার পরিচয়ও জেনে নেয়া যেতে পারে।
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল, দরজার পাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা। একটু পরেই পাল্লা ঠেলে বেরিয়ে এল দুই খুনি। প্রথমজন ছুটে গেল ফ্রেঞ্চ ডোরের কাছে, ভিলা থেকে বেরিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ইপোলিটোর ফোয়ারার কাছে! দ্বিতীয়জন দাঁড়িয়ে পড়ল কয়েক হাত তফাতে, রানার দিকে পিঠ দিয়ে রেখেছে। তীক্ষ্ণ নজর বোলাচ্ছে ড্যান্স ফ্লোরে, খুঁজছে সোনিয়াকে। সন্তর্পণে তার দিকে এগিয়ে গেল রানা, আচমকা জাপটে ধরল পিছন থেকে।
ধস্তাধস্তি করল খুনি, কিন্তু সুবিধে করতে পারল না। রানার শক্তিশালী দু’হাতের বজ্র-আঁটুনিতে আটকা পড়েছে। এমনভাবে ধরেছে রানা, তাতে লোকটার পক্ষে কোটের ভিতর থেকে পিস্তল বের করা সম্ভব নয়। টান দিয়ে তাকে পিছনে নিয়ে এল ও, হাতের দুটো আঙুল দিয়ে প্রচণ্ড এক খোঁচা মারল কিডনিতে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল খুনি, কিন্তু তার চিৎকার চাপা পড়ে গেল হলঘরের উদ্দাম সঙ্গীত, নৃত্যরত জুটিদের কলকাকলিতে। সবাই নাচানাচিতে ব্যস্ত; আশপাশে কী ঘটছে, সেদিকে নজরই দিচ্ছে না। সুযোগটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল রানা। কাতরাতে থাকা খুনিকে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল দেয়ালের পাশের একটা চেয়ারে, কেড়ে নিল পিস্তল। লোকটার উরুসন্ধির উপরে একটা হাঁটু তুলে দিল ও, চেপে বসল গায়ে। কেড়ে নেয়া পিস্তলটা সবার চোখের আড়ালে রেখে ঠেকাল ব্যাটার বুকে।
খুনির কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল রানা, দূর থেকে তাকালে মনে হবে, কানে-কানে কথা বলছে দুই মাতাল বন্ধু। ফিসফিস করে ও বলল, উপরের লোকটা… কে সে? জলদি বলো, নইলে নিজের পিস্তলের গুলিতেই ফুটো হয়ে যাবে তুমি। সাইলেন্সার লাগানো আছে, কেউ টের পাবে না কিছু। কুইক! কে ওই লোক?’
‘না!’ শরীর মুচড়ে নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করল খুনি। হাঁটুর চাপ বাড়িয়ে দিল রানা, এক আঙুলে খোঁচা মারল ব্যাটার শ্বাসনালীতে। চোখে অন্ধকার দেখল খুনি। ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু চেঁচাতে পারছে না বাতাসের অভাবে। টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করল দু’চোখ।
‘লাস্ট চান্স। কে ওই লোক?? রানার কণ্ঠে মৃত্যুর শীলতা।
ওর চোখে চোখ রেখে নিয়তির অমোঘ পরিণতি টের পেল খুনি। বুঝতে পারল, কোনও দয়া পাবে না; কথা না শুনলে মরতে হবে তাকে। তাই ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল, ‘সেনিয়র পাভোরোনি।’
লোকটার ঘাড়ের উপর একটা কারাতে চপ বসাল রানা। অজ্ঞান দেহটাকে শুইয়ে দিল পাশাপাশি দুটো চেয়ারের উপর। তারপর উল্টো ঘুরে নেমে পড়ল ড্যান্স ফ্লোরে। হাতে সময় নেই, সোনিয়াকে খুঁজে বের করে এখুনি সরে যেতে হবে এ জায়গা থেকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করল ও। বিয়াঞ্চির সহকারীকে জড়িয়ে ধরে নেচে বেড়াচ্ছে। কাছে গিয়ে দু’জনকে থামাল রানা। সহকারীকে বলল, ‘তোমার নামই তো পিয়েত্রো, তাই না?’
‘জী, সেনিয়র।’
কাউন্ট বিয়াধি এখুনি যেতে বলেছেন তোমাকে। কী যে ইমার্জেন্সি দেখা দিয়েছে।
‘নিশ্চয়ই, সেনিয়র। কোথায় উনি?’
‘ওপরতলায়।’
সোনিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল পিয়েত্রো। টান দিয়ে মেয়েটাকে এবার ড্যান্স ফ্লোর থেকে সরিয়ে আনল রানা।
‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল সোনিয়া।
‘চলে যাচ্ছি আমরা,’ বলল রানা। ওকে নিয়ে এল হলঘরের একপ্রান্তে। সারি বাঁধা চেয়ারগুলোর উপর এলোমেলোভাবে পড়ে আছে অসংখ্য কাপড়চোপড়। নাচতে যাবার আগে বাড়তি পরিচ্ছদ খুলে রেখে গেছে অতিথিরা। ওখান থেকে একটা কালো রঙের আলখাল্লা খুঁজে নিল রানা, বাড়িয়ে ধরল সঙ্গিনীর দিকে। ‘পরে ফেলো এটা।’
‘কেন?’
‘আমাকে…. সেই সঙ্গে সাদা গাউন পরা একটা মেয়েকে খুঁজছে গার্ডরা। কথা বাড়িয়ো না, জলদি পরো।’
ত্রস্ত হাতে গাউনের উপর আলখাল্লা চড়াল সোনিয়া। তারপর রানার দিকে ফিরল, ‘চলো।’
‘এখনও না, মাথা নাড়ল রানা। ‘একটু পরে। ডাইভারশনের জন্য অপেক্ষা করছি।’
‘কীসের ডাইভারশন?’
‘শীঘ্রি টের পাবে।’
কয়েক মিনিট পরেই ভেসে এল উত্তেজিত হাঁকডাক। জ্যা-মুক্ত তীরের মত সিঁড়ির দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে এল পিয়েত্রো! ইটালিয়ানে চেঁচামেচি জুড়ল। পরমুহূর্তে শুরু হয়ে গেল তাণ্ডব। আতঙ্কে অস্থির হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল অতিথিরা। কয়েকটা শব্দ ক্রমাগত ভেসে আসছে কানে।
ওমিসিডিয়ো!
টেরোরিস্তি।
ফুগিনি!
মানে পরিষ্কার—কাউণ্ট বিয়াঞ্চির লাশ আবিষ্কৃত হয়েছে।
হুড়োহুড়ি করে ভিলা থেকে পালাতে চাইছে অতিথিরা, তাদের ভিড়ের মাঝে মিশে গেল রানা আর সোনিয়া। ধাক্কাধাক্কি করে বেরিয়ে এল হলঘর থেকে। যেদিক দিয়ে বেরিয়েছে, সেখানে একটা বড় টেরাস। পা রেখেই থমকে গেল ওরা।
অ্যাই! থামো তোমরা!’ শোনা গেল হুঙ্কার।
পথ আটকে সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রথম খুনি। হাতে উদ্যত পিস্তল … গুলি করতে যাচ্ছে। এক ধাক্কায় সোনিয়াকে সরিয়ে দিল রানা, নিজে ডাইভ দিল অন্যপাশে। খুনির বুলেট চলটা ওঠাল টেরাসের পাথরের। গড়ান দিয়ে সিধে হলো রানা, হোলস্টার থেকে বের করে এনেছে নিজের সিগ-সাওয়ার। নিমেষে দুটো গুলি ছুঁড়ল ও। বুকে ভারী বুলেটের আঘাত পেয়ে মাটিছাড়া হলো খুনি, আছড়ে পড়ল টেরাসের ওপাশের সিঁড়িতে, পড়াতে গড়াতে নেমে গেল নীচে।
গুলির আওয়াজে অতিথিরা আরও ভয় পেয়ে গেছে। নারীকণ্ঠের চেঁচামেচিতে কানে তালা লেগে যাবার উপক্রম। হামাগুড়ি দিয়ে সোনিয়ার কাছে গেল রানা। টেরাসের একপাশে রেলিঙের উপর গিয়ে পড়েছে বেচারি রানার ধাক্কা খেয়ে। বেমক্কা আঘাত পেয়েছে পেটে আর বুকে। মাটিতে বসে পড়ে চেষ্টা করছে ব্যথা সামলাতে।
‘লেগেছে তোমার?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল রানা।
ফ্যাকাসে হাসি দেখা দিল সোনিয়ার ঠোঁটে। ‘বেঁচে তো আছি!’
‘তা হলে ওঠো!’
টান দিয়ে সোনিয়াকে দাঁড় করাল রানা। উকি দিল রেলিঙের ওপাশে। লন বেশি নীচে নয়। সঙ্গিনীকে নিয়ে লাফ দিয়ে নেমে
পড়ল ওখানে। সোজা হয়ে সামনে তাকাল, দেখতে পেল সুন্দরভাবে ছাঁটা ঝোপ আর বাগান-ভাস্কর্যের সারি।
‘মুভ!’ চাপা গলায় নির্দেশ দিল ও। তারপর ছুটতে শুরু করল নাক বরাবর সামনে, ঢুকে গেল ঝোপঝাড় আর মূর্তির ভিড়ের ভিতর। কৃত্রিম জলপ্রপাতের পানির ছিটেয় ভিজে আছে পুরো জায়গাটা, কিছুদূর গিয়েই আছাড় খেল সোনিয়া, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে।
থামল রানা, ধরাধরি করে ওকে উঠতে সাহায্য করছে, এমন সময় শোনা গেল নতুন কণ্ঠ
‘দানিষিয়োন!’
‘এক্কোলা!’
‘ল্য ডোনা!’
চিৎকারগুলো ভেসে এসেছে পিছন থেকে, তার সঙ্গে এল গুলির আওয়াজ। দাঁড়াল না আর রানা, সোনিয়াকে নিয়ে পিছিয়ে গেল একটা ঝোপের নীচে। কয়েক মুহূর্ত পরেই বাগানের নুড়িপথ ধরে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল দৃষ্টিসীমায়। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। পিছন থেকে ভেসে আসা আলোয় প্রকট হয়ে উঠেছে অবয়বদুটো।
নির্দ্বিধায় গুলি করল রানা। একজন বুক চেপে ধরে চিৎ হয়ে গেল, অন্যজন কাঁধে আঘাত পেয়ে ঘুরে গেল আধপাক। ছিটকে পড়ল একটা মূর্তির গায়ে। লোকটার ওজন সহ্য করতে পারল না পুরনো ভাস্কর্য, কাত হয়ে গেল। মূর্তি আর মানুষ… উভয়েই জড়াজড়ি করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। লোকটার বুকের উপর পড়েছে ভারী মূর্তি, পাঁজরের হাড় ভাঙার মটমট শব্দ হলো। ক্ষণিকের জন্য আর্তচিৎকার শোনা গেল, তারপর চুপ।
একটু অপেক্ষা করল রানা, আর কেউ আসে কি না দেখার জন্য। এল না কেউ, তাই সোনিয়াকে নিয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। ছুটতে শুরু করল আবার। দূরে কোথাও একের পর এক গাড়ির ইঞ্জিন জ্যান্ত হয়ে ওঠার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। এগোতে থাকল সেদিক লক্ষ্য করে। ‘
বাগানের সীমানা ভেদ করে একটু পর বেরিয়ে এল ওরা। সামনে বিশাল এক খোলা জায়গা—এস্টেটের পার্কিং লট। ভিলার গোলমাল এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে ধোপদুরস্ত শোফার আর ভ্যালে-দের মধ্যেও। ছোটাছুটি করে একেকটা গাড়িতে উঠছে তারা, স্টার্ট দিয়ে ছুটছে মালিকদেরকে উঠিয়ে নেবার জন্য। কিছু অতিথি গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে রাজি নয়, রাস্তা ধরে দৌড়ে চলে এসেছে তারা পার্কিং লটে। চেঁচামেচি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজেদের বাহন। মহা-বিশৃঙ্খলা চলছে জায়গাটায়। বুঝতে পারল রানা, এর মাঝখানে নিজের গাড়ি খুঁজে বের করা সম্ভব নয়… অন্তত সবার অলক্ষে।
কাছাকাছি দাঁড়ানো একটা মার্সিডিজের দিকে এগিয়ে গেল ও। শোফার দাঁড়িয়ে আছে পাশে, আশ্চর্য রকম শাস্ত্র তার চেহারা, আশপাশের উত্তেজনা যেন স্পর্শ করছে না তাকে। ট্রেইনড মাল… সম্ভবত শত্রুপক্ষের লোক। বেঢপভাবে ফুলে আছে ইউনিফর্মের একটা পাশ… সশস্ত্র! বোঝা গেল, স্রেফ গাড়ি চালায় না সে, দেহরক্ষীর দায়িত্বও পালন করে।
‘এক্সকিউজ মি,’ বলল রানা। ‘এটা কি কাউন্ট বিয়াঞ্চির গাড়ি?’
‘জী না, সেনিয়র,’ রূঢ় কণ্ঠে বলল শোফার। দূরে থাকুন…’ কাছাকাছি পৌঁছে গেছে রানা, বিদ্যুৎচমকের মত নড়ে উঠল ওর হাত। সিগ-সাওয়ারের বাট হাতুড়ির মত চালাল লোকটার কপালের পাশে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘায়েল হলো বেচারা। কাটা কলাগাছের মত হুড়মুড় করে পড়ে গেল মাটিতে। তার পকেট হাতড়ে চাবি বের করে নিল রানা, দরজা খুলে চড়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। তারপর হাতছানি দিয়ে ডাকল সঙ্গিনীকে।
দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠে পড়ল সোনিয়া। ওকে নির্দেশ দিল রানা, ‘মাথা নামিয়ে রাখো। তারপর স্টার্ট দিয়ে আগে বাড়াল মার্সিডিজকে। তাড়াহুড়ো করল না, শান্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে এল পার্কিং লট থেকে। কিছুদূর গিয়েই অবশ্য থেমে যেতে হলো। এস্টেটের ‘মূল ফটক বন্ধ করে দিয়েছে প্রহরীরা, গেটের সামনে বিশাল এক যানজট। অস্ত্রধারী একদল লোক, তল্লাশি চালাচ্ছে প্রতিটা গাড়িতে।
দাঁড়িয়ে থাকা মানে ধরা পড়ে যাওয়া। দাঁতে দাঁত পিষে স্টিয়ারিং ঘোরাল রানা। দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে সবেগে এগোতে শুরু করল। মার্সিডিজের একপাশের চাকা নামিয়ে দিয়েছে মাটিতে, রাস্তার পাশের ফুলের কেয়ারি তছনছ করে ছুটছে যান্ত্ৰিক বাহন। হৈ-হৈ করে উঠল প্রহরীর দল, অস্ত্রহাতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেল সামনে, চেষ্টা করল পথরোধ করতে। নির্মম ভঙ্গিতে বাম্পারের ধাক্কায় তাদেরকে উড়িয়ে দিল ও, গতি কমাল না।
ঘটনার আকস্মিকতার স্থবির হয়ে গেছে প্রহরীদল, ভুলে গেছে গুলি করতে। সংবিৎ ফিরে পাবার আগেই গেটের কাছে পৌঁছে গেল মার্সিডিজ। ফ্লোরবোর্ডের উপর অ্যাকসেলারেটর দাবিয়ে রেখেছে রানা, বুনো ষাঁড়ের মত ফটকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়িটা। ইস্পাত ছেঁড়ার বিশ্রী শব্দ হলো, তুবড়ে গেল মার্সিডিজের নাক, কিন্তু প্রচণ্ড চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো গের্টের পাল্লাদুটো। বেঁকে গেল পক্ষাঘাতগ্রস্তের মত, কবজা থেকে ছিঁড়ে আছড়ে পড়ল রাস্তার উপর। ক্ষিপ্ত পশুর মত ওগুলোকে মাড়িয়ে এগিয়ে চলল মার্সিডিজ, বেরিয়ে গেল এস্টেটের সীমানা থেকে।
ব্রেকে চাপ দিল রানা, বনবন করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে রাস্তার উপর সিধে করল গাড়িকে। ভারসাম্য ফিরে পেতেই পূর্ণ গতিতে ছুটল। ইঞ্জিন থেকে বাজে শব্দ বেরুচ্ছে, সংঘর্ষে সম্ভবত মারাত্মক জখম হয়েছে ওটা; কিন্তু পাত্তা দিল না। বিপদ এখনও কাটেনি। সোনিয়াকে মাথা তোলার চেষ্টা করতে দেখে ধমকে উঠল, ‘ওখানেই থাকো!’
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না ধাওয়াকারীদের দেখা পেতে। খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট, তার পরেই রিয়ারভিউ মিররে উদয় হলো একটা ফিয়াট ইউটিলিটি পিকআপ। দ্রুত এগোচ্ছে, কমিয়ে আনছে দূরত্ব। পিছনে লেগে আছে ছায়ার মত।
দু’মাইল এগিয়ে গেল রানা। তারপর আচমকা মোড় নিল মণ্টে মারিয়ো হিল-ড্রাইভের দিকে। চুলের কাঁটার মত বাঁক ঘুরে স্প্রিঙের মত পেঁচিয়ে ওঠা রাস্তা ধরে দ্রুতগতিতে উঠে চলল। লাৎসিয়ো মাউন্টেইন রেঞ্জের অন্তর্গত এ-পাহাড়, ঢালে ফার্নের জঙ্গল। পথের প্রতিটি বাঁক পেরিয়ে একটু করে অ্যাকসেলারেটরে পায়ের চাপ বাড়াচ্ছে রানা। ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও অনুগত রয়েছে মার্সিডিজ, হেয়ারপিন বেগুগুলো নিপুণভাবে পেরিয়ে যাচ্ছে, যেন রেলের ওপরে বসানো রয়েছে গাড়ির চাকা। ফাঁকে ফাঁকে রিয়ারভিউ মিররে দেখছে রানা, মার্সিডিজের সঙ্গে তাল রেখে ছুটতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ফিয়াটের ড্রাইভার। পিকআপ-টার শরীর মার্সিডিজের চেয়ে বড়, নড়তে-চড়তে জায়গাও নেয় বেশি।
প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই শুরু হলো হামলা। কোনোরকম আগাম সঙ্কেত না দিয়েই ছুটে এল বুলেট। দরজার পাশে বসানো ছোট্ট সাইডভিউ মিররটা চুরমার করে দিল গুলি। স্টিয়ারিঙের উপরে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল রানা, অ্যাকসেলারেটরে পুরো চেপে বসল পা।
গুলির শব্দ পায়নি রানা, তারমানে ধাওয়াকারীরা সাইলেন্সার ব্যবহার করছে। বিড়বিড় করে গাল দিল নিজেকে, শহরের দিক থেকে সরে হয়তো মস্ত বোকামি করে ফেলেছে। যেদিকে যাচ্ছিল, সেদিকে চলাটাই বরং নিরাপদ ছিল। এখন ওর একমাত্র চিন্তা কিভাবে গুলি এড়িয়ে রোমে পৌঁছনো যায়। কপাল ভাল হলে অবশ্য এর আগেই পথে কোনও পুলিশের গাড়ির সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু রিয়ারভিউ মিররে আবার চোখ পড়তেই আঁতকে উঠতে হলো : মার্সিডিজের পিছনের বাম্পারের ত্রিশ গজের মধ্যে এসে গেছে ফিয়াট।
পরিষ্কার বুঝল রানা, পিকআপের ইঞ্জিনে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে—বাইরের চেহারা যা-ই হোক, ধুঁকতে থাকা মার্সিডিজ নিয়ে ওটাকে খসানো ওর সাধ্য নয়। স্পিডেই পারবে না ওটার সঙ্গে।
সামনে দু’হাজার ফুট উপরে উঠে গেছে পথটা, তারপর তীক্ষ্ণ কয়েকটা মোড় নিয়ে আবার নেমে গেছে রাজধানীর দিকে। মাইলখানেক একেবারে সোজা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল মার্সিডিজ, এক মাইলে আরও কিছুটা এগিয়ে এল ফিয়াট।
সামনে আবার মোড়। গতিবেগ কমাল না রানা। যতটা সম্ভব নিচু করে রেখেছে মাথা। স্পিডোমিটারের কাঁটা পঁচাত্তর ছুঁই ছুঁই করছে।
মার্সিডিজের একেবারে পাশে চলে এল পিকআপ। নির্দ্বিধায় রাস্তার সেন্টার লাইন ক্রস করে এগিয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে একপলকের জন্যে ড্রাইভারের দিকে তাকাল রানা। কুৎসিত চেহারার এক লোক। লম্বা কালো চুল। কালো চোখের তারা জ্বলছে। বাদামি চামড়ায় ঢাকা ছোট্ট নাক। পিকআপের খোলা পিছনদিকটায় অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আরও দু’জন। ড্রাইভারের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, বাগে পেয়েছে শিকারকে!
ড্রাইভারের হাসির জবাবে, তার বোঁচা নাকের ওপর প্রচণ্ড এক ঘুসি বসিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হলো রানার। রীতিমত অসহায় বোধ করছে। আঁকাবাঁকা রাস্তার কারণে ড্রাইভিঙে দিতে হচ্ছে পুরো মনোযোগ, পিস্তল বের করে গুলি ছুঁড়বে… সে সুযোগ নেই। পিকআপের খুনিদের গুলিতে এখন স্রেফ করো হয়ে যাবার অপেক্ষা।
বিস্ময়ের ব্যাপার, গুলি করল না ওরা। কারণ জানার জন্য সময় নষ্ট করল না রানা, সামনে… বাঁয়ে চুলের কাঁটার মত বাঁক নিয়েছে রাস্তা। ঝড়ের বেগে একটা সাইনবোর্ড পার হয়ে গেল, হলদে রঙে লেখা— গতিবেগ বিশ মাইল। কিন্তু তিন গুণ গতিতে ছুটছে মার্সিডিজ। ওটার মত এত দ্রুত মোড় নিতে পারল না ভারী পিকআপ, বাধ্য হয়েই পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু মুহূর্তের জন্য। মোড়টা ঘুরেই অ্যাকসেলারেটর পুরো চেপে ধরল ড্রাইভার। দ্রুত এগিয়ে
আসছে আবার।
তুমুল বেগে চিন্তা চলছে রানার মাথায়। কী করে পার পাওয়া যাবে, ভাবছে। একটার পর একটা ফন্দি আঁটছে, কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না কোনোটাই। আরেকটা মোড় আসছে। গতি কমানোর জন্যে ব্রেকে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গেই একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। ব্রেক ছেড়ে অ্যাকসেলারেটরে পায়ের চাপ বাড়াতে লাগল, রিয়ারভিউ মিররে ফিয়াট এবং ড্রাইভারের গতিবিধি লক্ষ করছে। ফিয়াটকে আবার মার্সিডিজের পাশে নিয়ে আসতে চাইছে ড্রাইভার।
গুলি চালাচ্ছে না আর প্রতিপক্ষ। পিকআপের উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে গেল রানার কাছে। মার্সিডিজকে ঠেলে পাহাড়ের কয়েকশো ফুট নিচের উপত্যকায় ফেলে দিতে চাইছে ওরা। দুশো গজ পরেই আরেকটা বাঁক। গতি কমাল না রানা। ক্রমেই মার্সিডিজের সামনের লেফট-ফেণ্ডারের কাছে এসে যাচ্ছে ফিয়াট। আর একটু এগিয়ে একটা ধাক্কা লাগাতে পারণেই আকাশে উড়ে যাবে ওদের গাড়ি। পড়বে গিল নীচের পাথুরে মাটিতে।
অ্যাকসেলারেটর পুরো চেপে ধরল রানা। ধরে রাখল, তারপর আচমকা ছেড়ে দিয়ে ব্রেক করল। হঠাৎ মার্সিডিজের এই অদ্ভুত ব্যবহারে ক্ষণিকের জন্যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল ড্রাইভার। হাসি মিলিয়ে গেল মুখ থেকে। মার্সিডিজের সঙ্গে সঙ্গে সে-ও গতি বাড়িয়েছিল। পাশে গিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়ার সুযোগটা নিতে চেয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ গতি বাড়িয়ে অসতর্ক করে দিয়েছে তাকে রানা। বাঁকে পৌছে গেছে ওর গাড়ি।
ব্রেক চেপে রেখেই বন্ বন্ করে স্টিয়ারিং কেটে মার্সিডিজের নাক ঘোরাল রানা। রাস্তার সঙ্গে ঘষা খেয়ে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ তুলল টায়ার। মাটি কামড়ে রয়েছে মার্সিডিজ, তবু গাড়ির পিছনটা স্কিড করে রাস্তার বাইরে চলে যেতে শুরু করল। সেইদিকেই সামান্য একটু স্টিয়ারিং কাটল রানা। সোজা হয়ে গেল গাড়ি আবার। হ্যাণ্ডব্রেক টেনে আড়াআড়িভাবে পুরোপুরি থামিয়ে ফেলল মার্সিডিজকে। গাড়িটা এখন ব্যারিকেড সৃষ্টি করেছে ফিয়াটের পথে।
চাইলে সরাসরি ওটাকে আঘাত করতে পারত ফিয়াটের ড্রাইভার। কিন্তু পরিস্থিতিটার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না সে। চমকে যাওয়ায় ড্রাইভার-সুলভ নিখাদ রিফ্লেক্স অ্যাকশনে চলে গেল তার দু’হাত। সংঘর্ষের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘুরিয়ে ফেলল স্টিয়ারিং। নাক ঘুরে গেল পিকআপের, বাঁকের পাশ ঘেঁষে হুড়মুড় করে নেমে গেল ঢালে। ভেসে এল আতঙ্কিত চিৎকার আর পাহাড়ি ঢালে ইস্পাতের ঘষা খাওয়ার আওয়াজ।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল রানা। তারপর গাড়ি থেকে নেমে ঢালের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। নীচে ঝোপঝাড়ের উপরে উড়ছে ধুলোর মেঘ। পাহাড়ের গোড়াটা যেখানে উপত্যকায় মিশেছে, তার কাছ থেকে একটু দূরে পড়ে আছে ফিয়াট। ইঞ্জিনটা ফ্রেম থেকে ছিঁড়ে একপাশে ছিটকে পড়েছে। তালগোল পাকানো ধাতব বস্তুতে পরিণত হয়েছে পিকআপের শরীর। ড্রাইভার আর দুই খুনি থেঁতলে গেছে ওটার তলায় পড়ে।
নির্বিকার রইল রানা। ফিরে এল গাড়িতে, স্টার্ট দিয়ে নাক ঘোরাল, এগোল সামনে। সোনিয়া উঠে বসেছে সিটের উপরে। হতভম্ব চেহারা। জিজ্ঞেস করল, ‘কী ঘটল?’
‘পিছনে লেগেছিল,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি ওদেরকে।’
‘আর ভিলার ভিতরে?
গাড়ি চালাতে চালাতে সংক্ষেপে সব খুলে বলল রানা-ফোয়ারার পাশে বিয়াঞ্চির সঙ্গে সাক্ষাৎ, তারপর কাউন্টের খুনের ঘটনা। শেষে যোগ করল, ‘ওরা আমাকে কুয়াশা ভেবেছে। কেন, তা বুঝতে পারছি না। মনে হলো আমার কথা ভাবতেই পারেনি ওরা, শুধু কুয়াশাকে আশা করেছে। ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না।’
‘একটু অদ্ভুত হয়ে গেল না ব্যাপারটা? তোমরা দু’জনেই তো পিছনে লেগেছ ফেনিসের। সেটা তো ওদের জানা থাকার কথা।’
‘অবশ্যই! তারপরেও কুয়াশাকে সন্দেহ করল কেন?’ একটু ভাবল রানা। ‘একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে এর। ওদের ধারণা… কিংবা ওদেরকে জানানো হয়েছে… আমি মারা গেছি!’
‘এমন একটা ভুয়া কথা ছড়াবে কেন কেউ?
‘ভাল প্রশ্ন। ছড়াতে হলে আমিই ছড়াতাম সেটা, ওদের চোখে নিজেকে মৃত দেখিয়ে গোপনে কাজ করতাম। কিন্তু তা করিনি… তা হলে এ-খবর ছড়াল কে?’
‘এমন হতে পারে না, কোনও কারণে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে ওদের মনে? হয়তো কোনও লড়াইয়ে বেঁচে থাকার কথা ছিল না তোমার?’
মাথা নাড়ল রানা। এমন কোনও সিচুয়েশনে পড়িনি এখন পর্যন্ত। মরে যাবার গুজবও ছড়াইনি। কৌশলটা অবশ্য বেশ ভাল, কিন্তু গল্পটা বিশ্বাসযোগ্য বানাতে হলে অনেক ধরনের আয়োজন লাগে; এত সময় ছিল না হাতে, তাই আর চেষ্টা করিনি।’ চুপ হয়ে গেল ও। মনে পড়ে গেছে পাভোরোনির কথাগুলো।
…তুরিনে যোগাযোগ কোরো। ওদেরকে বলবে দুই ঈগল আর বেড়ালকে খবর দিতে…
‘কী ভাবছ?’ জানতে চাইল সোনিয়া
‘অন্য একটা বিষয়,’ বলল রানা। ‘বার্নার্দো পাভোরোনি… ও কি তুরিনে বিয়াঞ্চি-পাভোরোনি কোম্পানিগুলো চালায়?’
‘এককালে চালাত… কন্টেসার মেয়েকে বিয়ে করবার পরে। শুধু তুরিন না; রোম, মিলান, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস-সব জায়গার দায়িত্বই ছিল তার কাঁধে। তবে পরবর্তীতে তার শ্যালক–কাউন্ট মার্সেলো সবকিছু আবার নিজে বুঝে নেয়। এখন তো সে-ই ওদের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের মাথা। মানে… পত্র-পত্রিকায় তা-ই বলে।’
‘ওটা স্রেফ কাভার,’ বুঝতে পারছে রানা। ‘লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্য দেখিয়েছে। কাউন্ট বিয়াঞ্চি ছিল একটা শো-পিস, আড়াল থেকে এখনও কলকাঠি নাড়ছে পাভোরোনি।’
‘তা হলে কাউন্ট বিয়াঞ্চি ফেনিসের অংশ ছিল না?’
‘তা ছিল। এক অর্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বললেও ভুল হবে না। উঁচু বংশের স্ত্রী-র পাশাপাশি ফেনিসকে সে আর তার মা তুলে দিয়েছে পাভোরোনির পাতে। কথা হলো, পাভারোনি এর সঙ্গে জড়াল কেন? তার মত ব্যবসায়ীর জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদেরই। এ-জন্যে পলিটিক্যাল পার্টিদের পিছনে টাকা ঢালে ওরা, চেষ্টা করে এমন মানুষকে ক্ষমতায় বসাতে, যারা অপরাধ আর সন্ত্রাসী কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে পারবে।
‘এমন সরকার ইটালিতে নেই,’ মন্তব্য করুন সোনিয়া।
‘সে-কথা বহু দেশের বেলাতেই খাটে। তার মানে এই নয় যে, ব্যবসায়ীরা চেষ্টা করে না। ইউ সি, সাধারণ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে যায়। তাই অস্থিরতা চায় না ব্যবসায়ীরা, চায় সুস্থ পরিবেশ। কিন্তু ফেনিসের দর্শন ঠিক উল্টো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে ওরা, সাহায্য করছে অপরাধী আর টেরোরিস্টদেরকে। পাভোরোনি কীসের জন্য এদের হয়ে কাজ করবে?.
‘দু’রকম কথা বেরুচ্ছে তোমার মুখ দিয়ে, রানা,’ আস্তে রানার কাঁধে হাত রাখল সোনিয়া। ‘একবার বলছ বার্নার্দো পাভোরোনি ফেনিসের সদস্য; আবার বলছ সেটা হতে পারে না।’
‘আমি শুধু দ্বিধার কথা বলছি,’ রানা বলল। ‘পাভারোনি ওদের লোক, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন যোগ দিয়েছে, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘জানার চেষ্টা করবে?
‘এখানে আর না। ইটালি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে, আমরা সরে পড়ছি এ-দেশ থেকে। হয়তো পরের জায়গায় সূত্র খুঁজে পাব।’
‘আমরা সরে পড়ছি মানে! আমার না এখানেই থাকার কথা?’ ঘাড় ফেরাল রানা। আজ রাতের ঘটনা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে, সোনিয়া। তোমার জন্য রোমে থাকা মোটেই নিরাপদ নয়।’
‘তা হলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?’
‘প্যারিস। ওখানে যোগাযোগ মেইনটেন করবার মত নিজস্ব সেটআপ আছে আমার। তোমার থাকার জায়গাও করে দেব।’
‘তুমি কোথায় যাবে?’
‘লণ্ডন। পাভোরোনির ব্যাপারে জানতে পেরেছি আমরা—ও-ই বিয়াঞ্চি-র উত্তরসূরি। এবার লণ্ডনের পালা।’
‘ওখানে কেন?’
‘পাভোরোনি তার লোককে দুই ঈগল আর বেড়াল-কে খবর দিতে বলছিল। কর্সিকায় তোমার দাদীর কাছে যা শুনেছি, তা থেকে কোডগুলোর অর্থ বের করা কঠিন কিছু না। দুই ঈগল হচ্ছে আমেরিকা আর রাশা…’
‘এক মিনিট,’ বাধা দিয়ে বলল সোনিয়া, ‘রাশার প্রতীক তো ঈগল না, ভালুক!’
‘এ-ক্ষেত্রে নয়,’ ব্যাখ্যা করল রানা। রাশান ভালুক আসলে বলশেভিক; কিন্তু রাশান ঈগলটা হচ্ছে জারিস্টদের প্রতীক। ভিলা বারেমির সেই প্রথম সভার তৃতীয় অতিথি ছিল প্রিন্স আলেক্সেই ভারাকিন—সেইন্ট পিটার্সবার্গের বাসিন্দা, এখন ওটা লেনিনগ্রাদ নামে পরিচিত। ওখানেই গেছে কুয়াশা।’
‘আর বেড়াল?’
ব্রিটিশ সিংহ। সভার দ্বিতীয় অতিথি ছিল স্যর নাথান উইটিংহ্যাম। তাঁর বংশধর, নাইজেল উইটিংহ্যাম, এখন ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারি।’
‘এ তো খুবই হাই পজিশন।
‘বড্ড বেশি উঁচু, বড্ড বেশি দৃশ্যমান। ইনিও ফেনিসের সঙ্গে জড়াবেন বলে বিশ্বাস হতে চায় না। একই দশা আমেরিকায়। ওখানকার যে-সিনেটরের নাম বেরিয়ে আসছে, তিনি সম্ভবত আগামীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন। এসব লোক ফেনিসের সদস্য হবেন কেন, তার কোনও আগামাথা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আর সে-কারণেই ভয় পাচ্ছি।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘রহস্যটা সমাধানের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কাজটা কঠিন হচ্ছে ক্রমে। আমাদের ব্যাপারে সচেতন ফেনিস, সমস্ত সূত্র মুছে দেবার চেষ্টা করবে ওরা। দুই ঈগল আর এক বেড়ালের পিছনে কী লুকানো আছে, তা বের করা সহজ হবে না।’
তুমি তো বিপদে ঝাঁপ দিচ্ছে, রানা!’ নিখাদ উদ্বেগ প্রকাশ পেল সোনিয়ার গলায়।
‘আমার চেয়েও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে কুয়াশার জন্য। ওরা ভাবছে আমি মারা গেছি, সে-কারণে খানিকটা হলেও সুবিধে পাব। কিন্তু কুয়াশা তা পাচ্ছে না। আজই যোগাযোগ করব হেলসিঙ্কিতে ওকে সতর্ক করে দেয়া দরকার।
‘কী ব্যাপারে?’
‘ওকে বলে দিতে হবে, লেনিনগ্রাদের রাস্তাঘাটে কাউকে যদি ভারাকিন পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ নিতে দেখে ফেনিস, তার মৃত্যু অনিবার্য।’
‘সর্বনাশ!’ আঁতকে উঠল সোনিয়া।
আনমনে মাথা নাড়ল রানা। ‘অন্ধের মত এগোচ্ছি আমরা। কাউন্সিলের চার প্রতিষ্ঠাতার বংশধরকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, কারণ তাদের নাম আছে আমাদের হাতে। কিন্তু পুরো ষড়যন্ত্রটার পিছনে বসে আছে আরেকজন! সে-ই নাটের গুরু। তাকে বের করতে না পারলে এই চারজনকে দিয়ে কিছুই হবে না।’
‘কে সেটা?’
‘কর্সিকার জনৈক রাখাল বালক। তাকেই আসলে খুঁজে বের করা দরকার আমাদের, অথচ আমার কোনও আইডিয়া-ই নেই কীভাবে সেটা সম্ভব হতে পারে।