সেই কুয়াশা ২.১৫

পনেরো

জানালা গলে সকালের রোদ মুখে পড়তেই জেগে উঠল সোনিয়া। নড়ল না সঙ্গে সঙ্গে, নিঃসাড়ে পড়ে রইল কয়েক মিনিট। আবছাভাবে কানে ভেসে আসছে পরিচিত দুটো পুরুষকণ্ঠ। আস্তে আস্তে চোখ মেলল ও, কনুইয়ে ভর দিয়ে বিছানায় উঁচু হলো একটু। চোখ বোলাল চারপাশে। কামরাটা অচেনা, হোটেলের বেডরুম বলে মনে হলো। কখন-কীভাবে এখানে এসেছে, কিছু মনে নেই। তবে রানা-কুয়াশার কণ্ঠ অন্তরে বুলিয়ে দিচ্ছে স্বস্তির পরশ।

বিছানা থেকে নেমে পড়ল সোনিয়া। চেয়ারের ব্যাকরেস্টের সঙ্গে ঝুলছে একটা রোব-ওটা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এল স্যুইটের বসার ঘরে। সোফায় বসে আছে বাংলাদেশের দুই দুর্ধর্ষ মানুষ, ঝুঁকে রয়েছে সেন্টার টেবিলের উপর বিছানো একটা ম্যাপের উপর। নিচুস্বরে আলোচনা করছিল, পায়ের শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকাল।

‘ঘুম ভেঙেছে তা হলে?’ হাসি ফুটল রানার মুখে। সোফা ছেড়ে উঠে এল ওর দিকে। ‘কেমন বোধ করছ?’

রাতে অসুস্থতার ঘোরে রানাকে ঠিকমত চিনতেই পারেনি সোনিয়া, এখন দেখামাত্র আবেগ ভর করল। রানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ও। ফিসফিস করে বলল, ‘এসব কী ঘটছে, রানা?

গলা খাঁকারি দিল কুয়াশা। তাড়াতাড়ি রানাকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হলো সোনিয়া। মুখ অরম্ভ হয়ে উঠেছে। ‘সরি, মি. কুয়াশা।’

‘সরি না, ধন্যবাদ জানাও ওঁকে,’ বলল রানা। ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উনিই তো উদ্ধার করেছেন তোমাকে

বিস্ময় ফুটল সোনিয়ার চোখে। ‘তা-ই?’

‘ও কিছু না,’ হাত নাড়ল কুয়াশা। ‘এসব আমাদের জন্য সহজ কাজ।‘

‘কোথায় আমরা?’ চারপাশে তাকাল সোনিয়া।

‘লণ্ডনের একটা হোটেলে,’ রানা বলল। ‘গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে এসেছেন কুয়াশা। কিডন্যাপাররা একটা ড্রাগ দিয়েছিল তোমাকে, তাই কিছু টের পাওনি।’

‘লণ্ডন?’ বিস্ময় ফুটল সোনিয়ার চেহারায়।

‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল কুয়াশা। ‘কেমন বোধ করছ তুমি? কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘একটু দুর্বল লাগছে, আর কিছু না।’

‘গুড। ড্রাগটা তা হলে শরীর থেকে বেরিয়ে গেছে। গোসল-টোসল সেরে খাওয়া-দাওয়া সারো। সুস্থ হয়ে নাও পুরোপুরি। আজ রাতে তোমাকে দরকার হবে আমাদের।’

‘কীসের জন্য?’ কৌতূহল ফুটল সোনিয়ার চোখে।

‘পরে জানতে পারবে,’ বলল কুয়াশা। ‘এখন যাও।’

‘তোমার জন্য কিছু জামা-কাপড় কিনে এনেছি সকালে,’ যোগ করল রানা। কুজিটে পাবে। ‘

মাথা ঝাঁকিয়ে বেডরুমে চলে গেল সোনিয়া।

কুয়াশার পাশে এসে বসল রানা। বলল, ‘রাতের অপারেশনে ওকে রাখার ব্যাপারে এখনও মনের সায় পাচ্ছি না আমি।’

‘কেন?’ জানতে চাইল কুয়াশা।

‘যথেষ্ট ধকল গেছে ওর উপর দিয়ে। তা ছাড়া এসবের জন্য ট্রেইনড্ নয় মেয়েটা।’

‘ভুল বললে। রেড ব্রিগেড থেকে এ-ধরনের কাজেরই ট্রেইনিং পেয়েছে ও। আর ধকল-টকল… ওসব আপাতত সহ্য করে নিতে হবে। রাতের জন্য তৃতীয় একজনকে দরকার আমাদের; ও ছাড়া হাতে আর কেউ নেই এ-মুহূর্তে।’

‘জানি,’ শ্রাগ করল রানা। ‘তবু…’

‘ওসব চিন্তা আপাতত দূর করো মাথা থেকে,’ কুয়াশা বলল। ‘আমাদের প্ল্যান অভ অ্যাকশনই তো ঠিক হলো না এখনও! এসো… হাতে সময় নেই বেশি।’

টেবিলের উপর আবার ঝুঁকে পড়ল দু’জনে। লণ্ডন শহরের স্ট্রিট ম্যাপ বিছিয়েছে ওখানে।

‘বেলগ্রাভিয়া থেকে আসবেন লংফেলো… ফরেন সেক্রেটারিকে নিয়ে,’ ম্যাপে আঙুল রাখল কুয়াশা। ‘কনৌট হোটেলে আসবার জন্য ডাইরেক্ট রাস্তা হলো এটা।’

‘উঁহুঁ, এ-পথে আসবেন না,’ রানা মাথা নাড়ল। ‘বিএসএস হেডকোয়ার্টারে যাবার কথা বলে রওনা হবেন। কনৌট হোটেলের দিকে ঘুরবেন শেষ মুহূর্তে, যাতে আগেভাগে কিছু টের না পান উইটিংহ্যাম।‘

‘তা হলে হাইড পার্ক পেরুনোর পর ঘুরবেন উনি।’ চঞ্চল চোখে ম্যাপ জরিপ করল কুয়াশা। ‘অনেকগুলো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি; তার মধ্যে যে-কোনোটা বেছে নিতে পারেন।’

‘সেটা শুধু বেসও অটর ক্রস করা পর্যন্ত। কার্লোস প্লেসে আসতে হলে এজওয়্যার রোডে আসতে হবে ওঁকে।’

‘ওখানে অ্যামবুশ করা একটু রিস্কি হয়ে যায় না?’ ভুরু কোঁচকাল কুয়াশা! ‘অনেক বড় রাস্তা, মনুষ আর গাড়িঘোড়ার অভাব নেই।’

‘আজ রবিবার,’ মনে করিয়ে দিল রানা। ট্রাফিক অনেক কম থাকবে রাস্তায়। তবে হ্যাঁ… তারপরেও জায়গাটা সুবিধের না। অন্য স্পট খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরকে।‘

‘এটা?’ ম্যাপে আবার আঙুল রাখল কুয়াশা। ‘এজওয়্যার রোড থেকে কার্লোস প্লেসে যাবার সরাসরি রাস্তা এটা। খুব বড় নয়।’

‘জর্জ স্ট্রিট,’ নাম পড়ল রানা। ‘হুঁ, বেটার। তবে আরেকটু দেখা যাক।

মিনিট পনেরো ব্যয় করল দু’জনে ম্যাপ স্টাডি করায়, কিন্তু আর কোনও ভাল জায়গা খুঁজে পেল না। পুরো রুটে জর্জ স্ট্রিট-ই একমাত্র সুবিধাজনক স্পট। তাই ওখানেই ফাঁদ পাতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

‘ওকে, জায়গা ঠিক হলো,’ সোফায় হেলান দিয়ে বসল কুয়াশা। ‘গাড়ি?’

‘অফিশিয়াল না, ব্যক্তিগত গাড়িতে আসবেন লংফেলো,’ জানাল রানা। ‘ওটা একটা অ্যাসটন মার্টিন। ধূসর রঙা। লাইসেন্স নাম্বার জিবি-১০৯৮’

‘সিকিউরিটি?’

‘গোপন মিটিঙে আসছেন ওঁরা, সঙ্গে সিকিউরিটি থাকার কথা না। মি. লংফেলোকে মানাও করে দিয়েছি আমি।’

‘খুব ভাল। তা হলে আমাদের প্ল্যান ফাইনাল করে নেয়া যাক। সোনিয়া প্রাথমিক ব্যারিকেডে থাকবে- গাড়ি থামানো, এবং লংফেলোকে নিউট্রালাইজ করা শুর দায়িত্ব। এরপর অ্যাসটন-মার্টিন দখল করব আমি, উইটিংহ্যামকে নিয়ে আসব অস্ত্রের মুখে।‘

‘আমি?’ রানা জিজ্ঞেস করল।

‘মি. লংফেলোর গাড়ি চেনো তুমি, কাজেই স্পটার এবং কো-অর্ডিনেটর হিসেবে থাকতে হবে তোমাকে… সেইসঙ্গে থাকবে আমাদের ব্যাকআপ হিসাবে,’ জানাল কুয়াশা। ‘দ্বিতীয় একটা গাড়ি থাকবে তোমার কাছে। সোনিয়াকে পিকআপ করে আমার পিছু নেবে তুমি!’

‘সোনিয়ার কাজটা একটু কঠিন হয়ে গেল না?’

কিছু করার নেই। লংফেলোর সামনে পরিচিত কাউকে পাঠানো যাবে না। ফাইলে আমার ছবি দেখেছেন তিনি, তোমাকে তো এক মাইল দূর থেকে চিনবেন। শুধু সোনিয়াকেই চেনেন না ভদ্রলোক। ও ছাড়া আর কেউ কাছে ঘেঁষতে পারবে না।’

‘কিন্তু ওঁকে কাবু করবে কীভাবে সোনিয়া?’

‘ইঞ্জেকশন হলে কেমন হয়? ছোট্ট একটা খোঁচা… একটা মেয়ের জন্য অতখানি কাছে যাওয়া কঠিন নয়।‘

ভেবে দেখল রানা। ভাগ্যের একটু সহায়তা লাগবে, সেইসঙ্গে দক্ষ অভিনয় আর ঠাণ্ডা মাথা… হয়তো উৎরে যাবে সোনিয়া। তা ছাড়া কাছাকাছি ও আর কুয়াশা তো থাকছেই। মনের মধ্যে একটু খুঁতখুঁতানি থাকলেও রাজি হয়ে গেল।

‘ঠিক আছে,’ বলল ও। ‘আসুন, এবার কী কী জিনিসপত্র দরকার, সেগুলো ঠিক করে নিই…..’

.

রাত সোয়া আটটা।

জর্জ স্ট্রিট আর এজওয়্যার রোডের মোড় থেকে সামান্য দূরে একটা বিল্ডিঙের ছাতের উপর বসে আছে রানা। চোখে লাগিয়ে রেখেছে বিনকিউলার। রোডলাইটের কারণে রাস্তা আলোকিত, তারপরেও একটা নাইট ভিশন রেখেছে সঙ্গে। কানে লাগিয়ে রেখেছে মিনিয়েচার কমিউনিকেশন ডিভাইস-রেঞ্জ দু’মাইল! একই জিনিস রয়েছে কুয়াশা আর সোনিয়ার কাছে জর্জ স্ট্রিটের একশো গজ ভিতরে ছায়ায় লুকিয়ে আছে এর পজিশন নেবার আগে সাইলেন্সার-অলা পিস্তলের গুলিতে বেশ কয়েকটা রোডলাইট নষ্ট করে দিয়েছে, অ্যামবুশের জায়গাটা যেন বেশ কিছুটা অন্ধকার হয়ে যায়।

রানা এজেন্সির সেফ হাউস থেকে সমস্ত ইকুইপমেন্ট এনেছে রানা। কোনও সমস্যা হয়নি। এখন পর্যন্ত প্ল্যান মোতাবেক এগোচ্ছে সব। ওর ধারণাই ঠিক, সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে রাস্তায় গাড়িঘোড়ার সংখ্যা কম, জর্জ স্ট্রিটকে মোটামুটি নির্জনই বলা চলে। কদাচিৎ একটা-দুটো গড়ি হচ্ছে, কিংবা উদয় হচ্ছে নিঃসঙ্গ পথচারী। এভাবে চলতে থাকলে সহজেই কার্যোদ্ধার হবে।

‘রানা!’ খড়খড় করে উঠল কানে লাগানো রেডিও—কুয়াশার গলা। ‘কিছু দেখতে পাচ্ছ?’

‘না,’ জবাব দিল রানা। ‘তবে সময় হয়ে এসেছে। তৈরি থাকুন। সোনিয়ার কী অবস্থা?’

‘আমি রেডি, রানা,’ বলল মেয়েটা। ‘কিচ্ছু ভেবো না।’

‘যে-ভাবে বলেছি, সে-ভাবেই কোরো সব। বাড়তি কিছু করতে যেয়ো না।’

‘আচ্ছা।’

দূরে একজোড়া হেডলাইট চকচক করে উঠল এ-সময়। বিনকিউলার ঘোরাল রানা। অ্যাসটন-মার্টিন। লাইসেন্স নাম্বার চেক করল—ভুল নেই, মারভিন লংফেলোরই গাড়ি ওটা। ঘণ্টাখানেক আগে ফোনে কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। জানিয়েছেন, ইংল্যাণ্ডের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনৈক এশিয়ান কন্ট্যাক্টের সঙ্গে মিটিঙের অজুহাত দিয়েছেন। তিনি ফরেন সেক্রেটারিকে, বিএসএস হেডকোয়ার্টারে গোপনে যাবার জন্য রাজি করিয়েছেন। কথা বলার সময় বহু কষ্টে নিজেকে সংযত রেখেছে রানা, ইচ্ছে করছিল মি. লংফেলোকে সতর্ক করে দেয়… জানায় কী করতে চলেছে ওরা। পরিস্থিতির জন্য পারেনি। তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে ধোঁকা দিতে চলেছে ও… কীভাবে তা মেনে নেবে? কিন্তু উপয়ও তো নেই!

ভাবাবেগ চাপা দিয়ে রেডিওতে সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগ করল রানা। ‘কুয়াশা, সোনিয়া… গেট রেডি। আসছে গাড়িটা।’

এজওয়্যার রোড থেকে মোড় নিয়ে জর্জ স্ট্রিটে ঢুকল অ্যাসটন-মার্টিন। বিনকিউলারে সামনে-পিছনে দেখে নিল রানা—না, সিকিউরিটির জন্য আর কেউ নেই! নাইট-ভিশনের সাহায্যে দেখে নিল গাড়ির ভিতরটাও। দু’জন মাত্র আরোহী। তারমানে সব ঠিকঠাক আছে। সঙ্গীদের জানিয়ে দিল সেটা।

মোড় ঘোরার সময় গতি কমাতে বাধ্য হয়েছেন লংফেলো, জর্জ স্ট্রিটে ঢুকে ধীরে ধীরে আবার বাড়াতে শুরু করলেন। কয়েক সেকেণ্ড নীরবে নজর রাখল রানা, অ্যাসটন–মার্টিন ওর প্রত্যাশিত পজিশনে পৌঁছুতেই রেডিওতে নির্দেশ দিল, ‘এবার, সোনিয়া… এবার?’

বিনা নোটিশে রাস্তার পাশের গলি থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল মেয়েটা। পরনে শতচ্ছিন্ন জামা-কাপড়, হাত দিয়ে ঠেলছে একটা ভাঙাচোরা শপিং কার্ট—সেটা বাতিল জিনিসপত্রে ঠাসা গৃহহীন উদ্বাস্তুর সাজ, দেখে মনে হবে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পৌঁছে গেল গাড়ির সামনে।

ব্রেক কষলেন মারভিন লংফেলো, দেরি করে ফেলেছেন, রাস্তার অ্যাসফল্টে কর্কশ আওয়াজ তুলল টায়ার। ঘষটাতে ঘষটাতে ছুটে গেল সামনে। একটা চিৎকার দিয়ে গাড়ির সামনে থেকে সরে গেল সোনিয়া, অ্যাসটন-মার্টিনের বাম্পারের আঘাতে ছিটকে গেল ওর শপিং কার্ট। ভিতরের জিনিস ছড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।

স্কিড করে বিশ ফুট যাবার পর থামল গাড়ি। ঝট্ করে খুলে গেল ড্রাইভারের পাশের দরজা, বিএসএস চিফের পরিচিত অবয়বকে নেমে আসতে দেখল রানা। হন্তদন্ত হয়ে তিনি ছুটে গেলেন রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে থাকা সোনিয়ার দিকে।

‘তোমার কোথাও লাগেনি তো?’ আন্তরিক কণ্ঠে জানতে চাইলেন লংফেলো। নিখাদ উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে তাতে!

‘হাঁটু ছড়ে গেছে,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সোনিয়া। ‘কিন্তু আমার জিনিসপত্র… ওহ্, কত কষ্ট করে জমিয়েছি ওগুলো…’

ঘাড় ফিরিয়ে রাস্তার উপরে তাকালেন বিএসএস চিফ। ছেঁড়া কাপড়চোপড়, খালি টিন আর কাঁচের বোতল, পুরনো বইখাতা… এমন হরেক রকম জিনিস ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। তাঁর চোখে জঞ্জাল, কিন্তু সন্দেহ নেই, গৃহহীন দরিদ্র মানুষের জন্য এগুলোই সাত রাজার ধন!

‘কোনও অসুবিধে নেই,’ নরম গলায় বললেন তিনি, ‘এসো, আমি সব কুড়িয়ে নিচ্ছি তোমাকে।‘

‘বড় ভাল মানুষ আপনি,’ একটু হাসি ফোটাল সোনিয়া ঠোঁটের কোনায়।

ঝুঁকে রাস্তা থেকে জিনিসপত্র কুড়াতে শুরু করলেন লংফেলো, পায়ে পায়ে তাঁর পিছনে এসে দাঁড়াল সোনিয়া। সাবধানে পোশাকের আড়াল থেকে বের করে আনল একটা হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ — চেতনানাশক ইঞ্জেকশন রয়েছে ওটার ভিতর।

‘মুভ!’ বিল্ডিঙের উপর থেকে কুয়াশাকে রেডিওতে নির্দেশ দিল রানা।

ছায়া থেকে বেরিয়ে এল কুয়াশা। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল অ্যাস্টন-মার্টিনের দিকে। ওর অংশটা বেশ সহজ—দরজা খুলে উঠে পড়বে ড্রাইভিং সিটে, পিস্তল দেখাবে উইটিংহ্যামকে, তারপর গাড়ি চালিয়ে সোজা কেটে পড়বে ওখান থেকে। কিন্তু কয়েক পা এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল পরিস্থিতি, দ্রুত ঘটতে শুরু করল ঘটনা।

পিছনে সোনিয়ার উপস্থিতির ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠলেন মারভিন লংফেলো, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তারস্বরে বিপদসঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালেন। সিরিঞ্জটা তাঁর বাহুতে গেঁথে দেবার চেষ্টা করছিল সোনিয়া, তার আগেই খপ্ করে ধরে ফেললেন ওর কবজি। হাত মোচড়াল সোনিয়া, মুক্ত করতে চাইল নিজেকে, পারল না। বরং ঝাঁকি দিয়ে ওকে সিরিঞ্জ ফেলে দিতে বাধ্য করলেন বিএসএস চিফ। তারপর এক ঝটকায় ঘুরিয়ে ফেললেন লাটিমের মত, ওর পিঠ নিজের দিকে আসতেই পিছন থেকে জাপটে ধরে ফেললেন, ডানহাত মুচড়ে ধরেছেন পিঠের উপরে। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সোনিয়া।

‘বিরাট ভুল করে ফেলেছ, মেয়ে,’ কঠিন গলায় বললেন লংফেলো। ‘কে তুমি?’

বিনকিউলার দিয়ে সবই দেখতে পাচ্ছে রানা। ‘শিট!’ গাল দিয়ে উঠল ও। ‘সোনিয়া ধরা পড়ে গেছে!’

কুয়াশাও দেখতে পেয়েছে। দাঁড়িয়ে পড়ল। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কী করব এখন?’

‘দাঁড়াবেন না! মি. লংফেলো ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই কেটে পড়ুন উইটিংহ্যামকে নিয়ে। সোনিয়াকে আমি দেখছি।’

ছুটতে শুরু করল কুয়াশা। কপাল ভাল, এদিকে পিঠ দিয়ে রেখেছেন লংফেলো, ওকে দেখতে পাচ্ছেন না। আশপাশে নজর বোলাল, কৌতূহলী লোকজন জড়ো হতে শুরু করেছে রাস্তার দু’পাশে। হাতে সময় নেই।

হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে অ্যাস্টন-মার্টিনের দরজা খুলল কুয়াশা, লাফ দিয়ে উঠে পড়ল ড্রাইভিং সিটের পিছনে। নাইজেল উইটিংহ্যাম বসে আছেন যাত্রীর আসনে, মাথা ঘুরিয়ে হতভম্ব চোখে তাকালেন ওর দিকে। চেঁচাবার জন্য মুখ খুলে থেমে গেলেন, কুয়াশার পিস্তলের চকচকে কালো নল তাকিয়ে আছে তাঁর কপাল বরাবর।

‘একটুও আওয়াজ করবেন না! হিসিয়ে উঠল কুয়াশা। চুপচাপ বসে থাকুন।’ হাত বাড়াল ইগনিশনের দিকে

ইঞ্জিন চালু করতে পারল না ও। তার আগেই দ্বিগ্বিদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল হাই-পাওয়ার রাইফেলের আওয়াজে। অ্যাস্টন-মার্টিনের উইণ্ডশিল্ড চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল, উইটিংহ্যামের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল কাতর আর্তনাদ।  

ছিটকে আসা কাঁচের টুকরোর মুখ-হাত কেটে গেছে কুয়াশার। ইনস্টিঙ্কটের বশে মাথা নামিয়ে ফেলল, ওখান থেকে তাকাল ফরেন সেক্রেটারির দিকে। দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে আছে ভদ্রলোকের, বুকে বিশাল এক ক্ষত… গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে সেখান দিয়ে আবার গুলি হলো। সিটের উপর ঝাঁকি খেলো তাঁর দেহ, নতুন দুটো গর্ত সৃষ্টি হলে বুকে। তারপরই এলিয়ে পড়লেন উইটিংহ্যাম।

রানা এসবের কিছুই দেখেনি, বিল্ডিঙের ছাত থেকে সিঁড়ি ধরে দ্রুত নেমে আসছে ও সোনিয়াকে সাহায্য করবার জন্য। গুলির আওয়াজ শুনে রেডিওতে চেঁচাল, ‘হচ্ছেটা কী, কুয়াশা?’

‘স্নাইপার!’ রুদ্ধশ্বাসে বলল কুয়াশা। ‘গুলি করছে আমাদের দিকে। উইটিংহ্যাম মারা গেছেন! আমরা একা নই, আরও কেউ অ্যামবুশ পেতেছে এখানে।’

চমকে উঠল রানা। মস্ত ভুল করে ফেলেছে। লংফেলো আর ফরেন সেক্রেটারির পুরো যাত্রাপথে জর্জ স্ট্রিট-ই একমাত্র অ্যামবুশ-যোগ্য স্থান। কাজে নামার আগে এখানে আর কেউ ঘাপটি মেরেছে কি না, দেখা উচিত ছিল। কিন্তু এখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

‘হায় খোদা!’ ফিস ‘সোনিয়া। মি. লংফেলো! ওদেরকে সরিয়ে নিতে হবে ওখান থেকে, কুয়াশা…!’

‘জানি,’ বলল কুয়াশা। ‘আমি দেখছি কী করা যায়।

ইগনিশন ঘুরিয়ে অ্যাসটন-মার্টিনের ইঞ্জিন চালু করল ও। ব্যাক গিয়ার দিয়ে ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করল গাড়ি। চারদিকে তখন নরক ভেঙে পড়েছে। মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠছে পুরো রাস্তা, দু’পাশে জড়ো হওয়া আতঙ্কিত মানুষ ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে।

একের পর এক গুলিতে ফুটো হয়ে যাচ্ছে অ্যাসটন-মার্টিনের চেসিস, যতদূর সম্ভব পিছাল কুয়াশা, তারপর ব্রেক কষল। হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল পিছনের সিটে। সেখান থেকে দরজা খুলে নেমে পড়ল রাস্তায়। মারভিন লংফেলো আর সোনিয়ার খোঁজে রাস্তার উপর নজর বোলাল, চমকে উঠল জড়াজড়ি করে রক্তাক্ত দুটো মানবদেহকে পড়ে থাকতে দেখে।

‘সোনিয়া! মি. লংফেলো!’ চেঁচিয়ে উঠে ওদের দিকে ছুটে গেল ও।

নিথর হয়ে আছেন বিএসএস চিফ, শরীরের একপাশে গুলি লেগেছে, অঝোর ধারায় বেরিয়ে আসছে রক্ত। তাঁর নীচে চাপা পড়েছে সোনিয়া, ধস্তাধস্তি করছে বেরিয়ে আসার জন্য। ওকে সাহায্য করল কুয়াশা, টান দিয়ে নিয়ে এল গাড়ির পিছনে।

‘গুলি লেগেছে তোমার?’ মেয়েটার রক্তে ভেজা কাপড়ের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল ও।

‘ন্‌… না,’ কাঁপতে কাঁপতে বলল সোনিয়া। ‘এগুলো মি. লংফেলোর রক্ত। গুলি শুরু হতেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে শুরু করেছিলেন, তখনই গুলি খেয়েছেন… ছিটকে পড়েছেন আমার গায়ে।’

হতাশায় দাঁত পিষল কুয়াশা। রেডিওতে বল্ল, ‘রানা, আমাদের সাহায্য দরকার! কোথায় তুমি?’

দশ সেকেণ্ডের মধ্যে পৌঁছুচ্ছি,’ সিঁড়ির ধাপ টপকাতে টপকাতে জানাল রানা।

ওর কথা শেষ হতেই রাস্তার মাথায় কালো একটা ভ্যানকে উদয় হতে দেখল কুয়াশা। ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি পৌঁছে ব্রেক কষল, থামল একেবারে ওদের পাশে এসে। ঝটপট খুলে গেল সাইড-ডোর। স্নাইপারের গুলি থেমে গেল, স্কি-মাস্ক পরা ষণ্ডামার্কা চারজন লোক করে এল ভ্যান থেকে, ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়াশা আর সোনিয়ার উপর।

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে রানা দেখল, জোর-জবরদস্তি করে ওদেরকে ওঠানো হচ্ছে ভ্যানে। চেঁচিয়ে উঠল ও, শোল্ডার হোলস্টার থেকে সিগ-সাওয়ার বের করে ছুটল বাধা দিতে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল সুইপারের রাইফেল। রানার পায়ের কাছে রাস্তার অ্যাসফল্টে মাথা কুটল বুলেট। ঝাঁপ দিল রানা, এক গড়ান দিয়ে সোজা করল পিস্তল। কোত্থেকে গুলি করা হচ্ছে, জানে না; আন্দাজের উপর ভর করে দু’বার ট্রিগার চাপল।

কাজ হলো না ওতে। আবারও গুলি চালাল আততায়ী। মুখের কাছে ছিটকে ওঠা অ্যাসফল্টের গুঁড়োয় দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল, পিছাতে বাধ্য হলো রানা। পেভমেন্টের উপর দাঁড়িয়ে থাকা মেইলবক্সের পিছনে আশ্রয় নিল ও। ওখান থেকে তাকাল ভ্যানের দিকে। ধস্তাধস্তি করে চার প্রতিপক্ষের সঙ্গে পেরে ওঠেনি কুয়াশা আর সোনিয়া, ওদেরকে তুলে ফেলা হয়েছে ভিতরে। দরজা বন্ধ হয়ে গেল, টায়ার পুড়িয়ে সবেগে আগে বাড়ল ভ্যান : সিগ-সাওয়ার তুলে ওটার চাকার দিকে গুলি করল রানা, লাগাতে পারল না। হতাশায় ছেয়ে গেল অন্তর।

হঠাৎ থেমে গেল গোলাগুলি। আতঙ্কিত মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই এখন। কাজ শেষ করে স্নাইপারও সম্ভবত পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে। ভ্যান সরে যাওয়ায় রাস্তাতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহটা চোখে পড়ল রানার। বুকটা ধক্ করে উঠল।

আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এল ও। পাগলের মত ছুটে গেল বিএসএস চিফের দিকে। তাড়াতাড়ি চেক করল পালস্। বেঁচে আছেন লংফেলো, কিন্তু নাড়ির গতি অতি মন্থর। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ তাঁর জীবনীশক্তি কেড়ে নিতে শুরু করেছে। আঘাত পরীক্ষা করল রানা–বুকের ডান পাশে লেগেছে গুলি, একটুর জন্য মিস করেছে হৃৎপিণ্ড তার ফুসফুস পাংচার হয়ে গেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ক্ষতস্থানে গুঁজে দিল রানা, গা থেকে নিজের কোট খুলে পেঁচাল লংফেলোর শরীরে, গিঁঠ দিল রুমালের উপরে। রক্তপাত থামানোর চেষ্টা।

প্রাথমিক আতঙ্ক কেটে গেছে পথচারীদের মধ্য থেকে। ধীরে ধীরে ভিড় জমাতে শুরু করেছে তারা রানা আর লংফেলোর কাছে।

‘অ্যাম্বুলেন্সের জন্য খবর দিন, প্লিজ!’ চেঁচাল রানা জনতার দিকে তাকিয়ে। ‘হাসপাতালে নিতে হবে এঁকে

হাত-পা কাঁপছে ওর, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে না কিছু। পিছনে সাইরেনের আওয়াজ শুনল—পুলিশ না অ্যাম্বুলেন্স কে জানে, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল না। কোলের মধ্যে জাপটে ধরে রেখেছে মারভিন লংফেলোর নিস্পন্দ দেহ। হঠাৎ খেয়াল করল, সভয়ে পিছাতে শুরু করেছে লোকজন। কী ব্যাপার দেখার জন্য ঘাড় ফেরাতে শুরু করল, কিন্তু মাথা পুরোপুরি ঘোরার আগেই ঘাড়ের উপর পড়ল প্রচণ্ড এক রদ্দা।

মাথা ঝিমঝিম করে উঠল রানার, কাত হয়ে পড়ে গেল একপাশে। দু’জোড়া শক্তিশালী হাত দু’পাশ থেকে চেপে ধরল ওকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে শুরু করল অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে। পিছনের দরজা খুলে তাতে ওঠানো হলো ওকে

‘সুইট ড্রিমস্‌, মি. রানা!’ বলে উঠল খসখসে একটা কণ্ঠ । পরমুহূর্তে চোয়াল বরাবর আরেকটা ঘুসি খেলো ও। দুনিয়া আঁধার হয়ে গেল চোখের সামনে!

.

গাড়ির মৃদু ঝাঁকিতে অনেকক্ষণ পর চোখ মেলল রানা। উল্টোদিক থেকে পার হতে থাকা বেশ কয়েকটা হেডলাইট চোখে পড়ল ওর, নিজেকে আবিষ্কার করল পুলিশ কারের পিছনের সিটে, হ্যাওকাফ পরা অবস্থায়, অস্ত্র-শস্ত্র সব কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফ্রন্টসিট আর ব্যাকসিটের মাঝখানে রয়েছে লোহার নেট, তার ওপাশে একা বসেছে ড্রাইভার। ইউনিফর্মধারী দ্বিতীয় পুলিশ বসে আছে ওর পাশে।

‘ওয়েলকাম ব্যাক,’ নীরস গলায় বলে উঠল লোকটা।

ঘাড় ফেরাতেই তার রিভলভারের নল দেখতে পেল রানা, তাক করে রাখা হয়েছে ওর দিকে। আলোছায়ার মাঝে ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না লোকটার চেহারা। তবে কণ্ঠটা চেনা। নাইটসব্রিজের রেস্টুরেন্টে এই কণ্ঠই শুনেছিল টেলিফোনে

‘স্মিথ, রাইট?’ বলল রানা।

হাসল লোকটা। ‘আপনার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করছি, মি. রানা। তবে এটা আমার আসল নাম নয়।’

‘বুঝতে পারছি, সিটের উপর সোজা হয়ে বসল রানা। ‘ইউনিফর্ম থেকে নেমপ্লেট খুলে রেখেছ এজন্যেই।

‘আপনার নজর চোখা, মি. রানা।’

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা?’ রানা জানতে চাইল।

‘এ-মুহূর্তে আপনাকে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আমাদেরকে। জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল স্মিথ। ‘খুব খারাপ একটা কাজ করেছেন আপনি, মি. রানা। গ্রেট ব্রিটেনের ফরেন সেক্রেটারিকে খুন করেছেন… গুলি চালিয়েছেন ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের চিফের উপরেও।

প্রতিবাদ করল না রানা। বোঝা যাচ্ছে, নতুন করে ওকে ফাঁসাবার চেষ্টা করছে ফেনিস। শুধু প্রশ্ন করল, ‘মি. লংফেলো…’ উনি বেঁচে আছেন?

‘এখন পর্যন্ত… হ্যাঁ। কপাল ভাল, ঠিক সময়ে অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছে গেছে তাঁর কাছে। তবে শেষ পর্যন্ত টিকবেন কি না, এখুনি বলা যাচ্ছে না।

‘আর আমার বন্ধুরা?’

‘কুয়াশা আর ওই মেয়েটা? ওরাও বেঁচে আছে, একটা বিমানে তুলে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদেরকে। আপনি যতক্ষণ আমাদের সহযোগিতা করবেন, ততক্ষণ আয়ু থাকবে ওদের।’

‘সহযোগিতা?’

‘এখনও শ্বাস ফেলছেন দেখে বুঝতে পারছেন না সেটা? কেউ একজন আপনাকে জীবিত দেখতে চায়।

‘কী চায় সে আমার কাছে?’

‘আমার জানা নেই। আমরা খুবই নীচের লেভেলের লোক। স্রেফ একটা নির্দেশ নিয়ে এসেছি আপনার জন্য।’

‘কী নির্দেশ?’

‘আমেরিকায় যেতে হবে আপনাকে। ম্যাসাচুসেটসে…ওখানকার বিশেষ একটা শহরে। আমার ধারণা, শহরের নাম আপনি জানেন।‘

‘বস্টন?’ বলল রানা। ‘কেন?’

‘ওই বিশেষ মানুষটি দেখা করতে চান আপনার সঙ্গে। রিটজ্ কার্লটন হোটেলে উঠবেন…. সোমনাথ চ্যাটার্জি নামে। ক্লিয়ার?’

‘তারমানে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাওয়া হচ্ছে না আমার?’

‘উঁহুঁ। একটু পরে গাড়ি থামাব আমরা, আপনি নেমে যাবেন।’

‘ফরেন সেক্রেটারির খুনিকে ছেড়ে দিচ্ছ, ওপরঅলার কাছে কী জবাব দেবে?’

‘ওসব নিয়ে আমাকে মাথা ঘামাতে দিন। গল্প সাজানোয় আমি একটা ছোটখাট প্রতিভা… মেটেরিয়াল এভিডেন্সও পয়দা করতে জানি। লোকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবে—কৌশল খাটিয়ে পুলিশের গাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন আপনি।

‘কিন্তু পুরো ব্রিটেনে আমার নামে হুলিয়া জারি হবে। আমেরিকায় যাব কীভাবে?’

মুখ বাঁকাল স্মিথ। ‘এ-ব্যাপারে কিছুই করার নেই আমাদের। তবে আপনি বুদ্ধিমান লোক, একটা না একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলবেন। আমি শিয়োর! একটা কথা মনে রাখুন, আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি বস্টনে না পৌঁছান, তা হলে মারভিন লংফেলো, কুয়াশা, আর ওই মেয়েটা… সবাই মারা যাবে।’

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রানার। ‘একটা প্রশ্ন করব? মি. লংফেলো আর নাইজেল উইটিংহ্যাম যে ওই রাস্তায় যাবেন, তা কীভাবে জেনেছ তোমরা?’

‘নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবেন আপনি, মি. রানা, আসলে তা. নন,’ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল স্মিথ। বিএসএস চিফ স্ক্র্যাম্বলড় লাইনে ফোন করেন, তাতে কথা বোঝা যায় না, কিন্তু কোথায় ফোন করছেন না করছেন, তা ঠিকই ট্রেস করা যায়। আজ সন্ধ্যায় আপনাকে কনৌট হোটেলে ফোন করেছিলেন তিনি, সম্ভবত মিটিঙের ব্যাপারটা কনফার্ম করতে। উইটিংহ্যাম নিজেই আমাদেরকে ওই মিটিঙের ব্যাপারে জানিয়েছেন। মারভিন লংফেলোর নাম শুনে আমরা বুঝতে পারি, আসলে ওঁর মাধ্যমে আপনিই দেখা করতে চাইছেন করেন সেক্রেটারির সঙ্গে। উপর থেকে তাই নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, কিছুতেই তাঁকে আপনার হাতে পড়তে দেয়া যাবে না। তাই মি. উইটিংহ্যামকে সরিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রুটের সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় আক্রমণ চালিয়েছি আমরা; ওখানে আপনাকেও পেয়ে যাব, তা ভাবিনি। তবে… ফরচুন ফেভারস্ দ্য ব্রেভ, এ-কথা কে না জানে!’

‘শটগুলো কে নিয়েছে?’ রানার গলা থম থম করছে।

‘আজ্ঞে… আমি!’ একগাল হাসি দিয়ে বলল স্মিথ। ‘প্ল্যানটা চমৎকার না? গুলি চালালাম, তারপর আবার তড়িৎগতিতে রেসপণ্ড করলাম অকুস্থলে… কে সন্দেহ করবে, বলুন?’

নির্জন একটা রাস্তায় এসে পড়েছে পুলিশ কার। গতি কমিয়ে রাস্তার পাশে, একটা গাছের তলায় থামল ড্রাইভার। বলল, ‘এটাই ভাল জায়গা।‘

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল স্মিথ। বড় একটা পার্ক দেখা যাচ্ছে, ভিতরটা অন্ধকারে ছাওয়া। ওখান দিয়ে সহজেই কেটে পড়তে পারবে রানা। সন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, পারফেক্ট।’ রানার, দিকে ফিরল। ‘এবার আপনাকে যেতে হয়, মি. রানা। আর বোধহয় কোনোদিন দেখা হবে না আমাদের। বিদায়।

চাবি নিয়ে একহাতে রানার হ্যাণ্ডকাফ খুলতে শুরু করল সে।

‘একটা বিষয় পরিষ্কার করে নিতে চাই,’ নির্বিকার ভঙ্গিতে ‘বলল রানা। ‘বললে তোমরা লোয়ার লেভেলের লোক। তারমানে গুরুত্বহীন, রাইট? তোমাদের বাঁচামরায় কিছু আসে-যায় না ফেনিসের, আমার বন্ধুদের উপর প্রভাব পড়বে না তার।’

ভুরু কোঁচকাল স্মিথ। ‘এ-কথা কেন বলছেন?’

‘এ-জন্য!’ হ্যাণ্ডকাফ খুলে গেছে, সাপের মত ছোবল দিল রানার দু’হাত। বাঁ হাতে লোকটাকে চেপে ধরল সিটের উপর, ডান হাতে খামচে ধরল পিস্তল-ধরা হাতটার মুঠি। অস্ত্রটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করল না, তার বদলে তর্জনী ঢুকিয়ে দিল ট্রিগার গার্ডের ভিতরে। পিস্তলটা ড্রাইভারের দিকে ঘোরাল, স্মিথের আঙুলের উপর দিয়েই চেপে দিল ট্রিগার।

গাড়ির বদ্ধ জায়গায় বোমা ফাটার মত আওয়াজ হলো, নেটের ফাঁক দিয়ে চলে গেল বুলেট, ড্রাইভারের মাথার খুলির পিছনটা উড়ে গেল। একরাশ রক্ত আর মগজ ছিটিয়ে স্টিয়ারিঙের উপর এলিয়ে পড়ল তার শরীরের ঊর্ধ্বাংশ।

হতভম্ব হয়ে গেছে স্মিথ, হাত ঘুরিয়ে রানা পিস্তলটা তার থুতনিতে ঠেকাতেই বাস্তবে ফিরে এল। দু’চোখের তারায় দেখা দিল আতঙ্ক।

‘প্লিজ, মি. রানা!’ ফ্যাসফেঁসে গলায় অনুনয় করল সে। ‘আমি স্রেফ হুকুমের দাস…’

‘আর আমি প্রতিহিংসার,’ আবেগহীন গলায় বলল রানা। ‘এটা মি. লংফেলোর জন্য।’ ট্রিগার চেপে দিল ও।

চোয়ালের নীচ দিয়ে ঢুকল বুলেট, মগজ ভেদ করে… খুলির উপরের অংশ বিস্ফোরিত করে বেরুল। রানার মুখ-হাত ভিজে গেল তাজা রক্তে! স্মিথের নিথর মুঠি থেকে পিস্তলটা মুক্ত করে নিল ও। নিল নিজের সিগ-সাওয়ারটাও। ওটা লোকটার কোমরে গোঁজা ছিল। লাশের দিকে তাকাল না… তাকাল না আশপাশে কেউ আছে কি না, সেসব দেখার জন্যও।

গাড়ি থেকে নেমে পার্কের অন্ধকারে মিশে গেল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *