সেই কুয়াশা ২.২০

বিশ

‘তুমি সন্তুষ্ট?’ জিজ্ঞেস করল মাসিমা গুইদেরোনি। আগের চেয়ে অনেকটাই শান্ত তার কণ্ঠ। উদ্বেগ থাকলেও তা দমিয়ে রেখেছে।

রাস্তার পাশের একটা ফোনবুদ থেকে সিনেটরকে রিং করেছে রানা। ম্যাহোনি হল্ থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা।

মাসিমোর প্রশ্নের জবাব দিল না ও। পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কুয়াশা কতটা আহত?’

‘রক্ত হারিয়েছে ও। দুর্বল।

‘তা আমি দেখেছি। চলাফেরা করতে পারবে?’

‘হেঁটে গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারবে… যদি ওটাই জানতে চাও আর কী।’

‘হ্যাঁ, সেটাই জানতে চেয়েছি। কুয়াশা আর সোনিয়াকে গাড়িতে তুলে ম্যাহোনি হল থেকে বেরিয়ে আসব আমি! গেট দিয়ে বের হয়ে আপনাদের হাতে তুলে দেব এক্স-রে-গুলো।

‘জিয়োভান্নি গুইদেরোনির সঙ্গে দেখা করবার কথা তোমার।’

তাও করব। আমার মনে বেশ কিছু প্রশ্ন জমা হয়েছে। .. সেগুলোর জবাব পাওয়া দরকার!

‘পাবে। কখন দেখা করবে?

‘রিটজ কার্লটনে আপনাদের নির্দেশ মোতাবেক ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। সোমনাথ চ্যাটার্জি… মনে আছে? আজই উঠব। মি. গুইদেরোনিকে বলবেন, ওখানে যেন ফোন করেন আমাকে। সাবধান করে দিচ্ছি, সিনেটর, শুধুই ফোন… সৈন্য-সামন্ত বা গুণ্ডা- পাণ্ডা নয়। রিটজ কার্লটনে এক্স-রে নিয়ে উঠব না আমি।’

‘তা হলে কোথায় রাখছ ওগুলো?’

‘সেটা আমার মাথাব্যথা। রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। পাশের বুদে ঢুকে ফোন করল অ্যাডমিরাল হ্যামিলটনের কাছে। ইতিমধ্যে ডেন্টাল রেকর্ডগুলো পেয়ে গেছেন তিনি। কাজ কতটা এগোল, তা জানা প্রয়োজন। রাতের অ্যারেঞ্জমেন্টের ব্যাপারেও নিশ্চিত হতে হবে

অ্যাডমিরাল না, ফোন ধরল চার্লি। জানাল, ‘মি. রানা, অ্যাডমিরাল এখনও হোয়াইট হাউসে। আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আপনার ফোন এলে রিসিভ করার জন্য। একটা মেসেজ দিয়েছেন—সব ঠিকঠাক আছে। তিনটে সময় বলেছেন: সাড়ে এগারোটা, পৌনে বারোটা আর সোয়া বারোটা। ওগুলো ফাইনাল তো?’

‘হ্যাঁ। ধন্যবাদ, চার্লি।’

ফোনবুদ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চড়ল রানা। এক টুকরো হলুদ কাগজ নিয়ে তাতে মার্কার দিয়ে বড় বড় করে একটা মেসেজ লিখল, সেটা ভরল একটা ম্যানিলা এনভেলাপে। ওটা নিয়ে চলে গেল নিউবেরি স্ট্রিটে। ফোনবুদের ডিরেক্টরি থেকে একটা মেসেঞ্জার সার্ভিসের ঠিকানা নিয়ে এসেছে। খুঁজে বের করল ওটা।

শুকনোমত এক মহিলা বসে আছে ফ্রন্ট ডেস্কে। তার সামনে গিয়ে পুলিশের একটা ভুয়া পরিচয়পত্র দেখাল রানা। বলল, ‘আমি বস্টন পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি—ইন্টার-ডিভিশনাল এগজামিনেশন সেকশন।

‘পুলিশ?’ আঁতকে উঠল মহিলা। হা যিশু! এখানে তো কোনও…’

‘রিল্যাক্স, ম্যা’ম। দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’ হাত তুলে তাকে আশ্বস্ত করল রানা। ‘আমরা একটা মহড়া দিচ্ছি। যে-কোনও ইমার্জেন্সিতে পুলিশের রেসপন্স কেমন, তা পরীক্ষা করে দেখব। তাই আজ রাতে এই এনভেলাপটা পৌঁছে দিতে হবে বয়েলস্টোন স্টেশনে। এটা পাবার পর থেকে শুরু হবে রিঅ্যাকশন টাইমের হিসাব। পারবেন আপনারা? ‘

‘নিশ্চয়ই, অফিসার।’

‘গুড। চার্জ কত পড়বে?’

‘তার দরকার হবে না, অফিসার। নাগরিক হিসেবে পুলিশকে এটুকু সাহায্য করতে পারলে খুশি হব আমরা।’

‘ধন্যবাদ, কিন্তু ফ্রি সার্ভিস নিতে পারব না আমরা। তা ছাড়া অফিশিয়াল রেকর্ডের জন্য এখানকার রিসিট আর আপনার নাম দরকার হবে।’

ঠিক আছে। আমার নাম এডিথ হ্যালোরান। আর নাইট ডেলিভারির জন্য লোকাল এরিয়ায় আমরা দশ ডলার নিই।’

পকেট থেকে টাকা বের করে দিল রানা। রিসিট দিন আমাকে। আর হ্যাঁ… ডেলিভারিটা হতে হবে আজ রাত পৌনে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। লিখে রাখুন। টাইমিংটা খুব ইম্পরট্যান্ট। আপনি ওটা নিশ্চিত করবেন তো?’

‘অবশ্যই। আমি নিজেই ডেলিভারি দিয়ে আসব। বারোটা পর্যন্ত এমনিতেই আমার শিফট কিনা

‘ধন্যবাদ, এডিথ।’

‘ইটস্ মাই প্লেজার,’ হাসল মহিলা।

.

রাত ন’টা বিশে হোটেল রিটজ কার্লটনের লবিতে ঢুকল রানা। রিসেপশনে সোমনাথ চ্যাটার্জির নাম বলতেই রুমের চাবি পাওয়া গেল। এলিভেটরের দিকে পা বাড়িয়েছে, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল একজন পোর্টার।

‘এক্সকিউজ মি. মি. চ্যাটার্জি… একটা মেসেজ আছে আপনার জন্য।

পোর্টারের হাত থেকে একটা খাম নিল রানা। ওটা খুলতে খুলতে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যাচাই করল লোকটার মুখ। ভাবলেশহীন; নিম্নআয়ের একজন মানুষের মধ্যে যতটা বিনয় থাকা উচিত, তা লক্ষ করা যাচ্ছে না। ফেনিসের লোক সম্ভবত। শার্ট খুললে হয়তো দেখা পাওয়া যাবে বৃত্তাকার উল্কির।

খামের ভিতর থেকে একটা চিরকুট বেরুল। তাতে একটা ফোন নম্বর। কাগজটা মুঠোর মধ্যে দলা পাকিয়ে ফেলল রানা!

‘কোনও সমস্যা?’ ভুরু কোঁচকাল পোর্টার।

হাসল রানা। ‘তোমার বসকে গিয়ে বলো, নম্বর দেখে ফোন করি না আমি নাম দেখে করি। যাও, ভাগো!’

হতভম্ব লোকটাকে পিছনে ফেলে এলিভেটরে উঠল ও। নামল ছ’তলায়। স্যুইটে গিয়ে রুম সার্ভিসের মাধ্যমে ডিনারের অর্ডার দিল।

খাওয়াদাওয়া করছে ও, এমন সময় বাজতে শুরু করল স্যুইটের ফোন। ধরল না রানা, তাড়াহুড়োও করল না। ধীরে-সুস্থে ডিনার শেষ করল, সিগারেট ধরাল। শেষ পর্যন্ত যখন তৃতীয়বারের মত চিৎকার শুরু করল যন্ত্রটা, তখনই রিসিভার তুলল ও।

‘হ্যালো?’

‘তুমি একটা গোঁয়ার লোক, মাসুদ রানা!’ গমগম করে উঠল চড়া, ভারী কণ্ঠ। ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে কেন তুলনা করা হয়, বুঝতে অসুবিধে হলো না। আসলেই গলার স্বরে দুরন্ত ঝঞ্ঝার তেজ মিশে আছে জিয়োভান্নি গুইদেরোনির।

হাসল রানা। ‘তা হলে ভুল করিনি আমি? ওই পোর্টার আসলে রিটজ কার্লটনের কর্মচারী নয়, বুকের মাঝখানে উল্কিকরা একটা চক্কোর আছে ওর!

‘ওই চক্র আমাদের গর্ব, মিস্টার। যারা ওই চিহ্ন ধারণ করছে, তাদেরকে ছোট করে দেখো না। অসাধারণ একদল নারী-পুরুষ ওরা, আমাদের অসাধারণ লক্ষ্যের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে।

‘আরেকটা নাম আছে এদের—সুইসাইডাল ম্যানিয়াক,’ বিদ্রূপ করল রানা। ‘কোত্থেকে জোগাড় করেন এ-সব পাগল-ছাগল? কোনও মানসিক হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছেন বুঝি?’

রেগে গেলেও, গলার স্বরে কিছু বোঝা গেল না। শান্ত কণ্ঠে গুইদেরোনি বলল, ‘যত ঠাট্টাই করো, তাতে সত্যটা বদলাবে না, রানা। ধর্ম আর আদর্শের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে পারে, এমন মানুষ পৃথিবীতে অতীতেও ছিল, আজও আছে।’

‘কাদের কথা বলছেন? হাসাসিন? শেখ হাসান, ইবনে আল-সাবাহ্র খুনি গোজ?’

আই সি! পাদ্রোনির ব্যাপারে স্টাডি করেছ তুমি!’

‘খুবই নিবিড়ভাবে।’

‘স্বীকার করছি, হাসাসিনদের সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল এবং ফিলোসফিক্যাল দিক দিয়ে অনেক মিল আছে আমাদের। কিন্তু আল্টিমেট গোল সম্পূর্ণ ভিন্ন।’

‘বিশ্বজয়? মানবজাতির উপর প্রভুত্ব? হাহ্!’

‘এসব নিয়ে টেলিফোনে আপনার সঙ্গে তর্কে নামতে চাই না আমি,’ বিরস গলায় বলল রাখাল বালক। ‘দেখা হওয়া প্রয়োজন আমাদের। একটা গাড়ি পাঠাব?’

‘না, ধন্যবাদ!’

‘কাম অন, একরোখামির কোনও দরকার নেই।

‘একরোখা নই আমি, সতর্ক। চাইলে ভীরুও বলতে পারেন। কিন্তু নিজস্ব একটা শিডিউল আছে আমার, সেই অনুসারে দেখা করব আপনার সঙ্গে। ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় আসব। যত বক্তৃতা দিতে চান, দিতে পারবেন তখন। সোয়া বারোটায় আমার বন্ধুদেরকে নিয়ে বেরিয়ে আসব। একটা সঙ্কেত দেয়া হবে, আমরা গাড়িসহ গেটে পৌঁছুলে এক্স-রে-গুলো চলে আসবে ওখানে ওগুলো গার্ডের হাতে দিয়ে চলে যাব আমরা। এই-ই আমার প্ল্যান, মি. গুইদেরোনি। সামান্য যদি এদিক-সেদিক হয়, চিরকালের মত এক্স-রে-গুলো হারাবেন আপনি। ওগুলো উদয় হবে অন্য কোনও বিশেষ জায়গায়।’

‘কিন্তু জিনিসগুলো পরীক্ষা করার অধিকার আছে আমাদের!’ প্রতিবাদ করল রাখাল বালক। ‘অ্যাকিউরেসি আর স্পেক্ট্রো- অ্যানালিসিসের জন্য সময় দরকার?’

টোপ গিলেছে লোকটা। মুচকি হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ইতস্তত করবার অভিনয় করল ও। বলল, ‘যুক্তি আছে আপনার কথায়। ঠিক আছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জাম গেটে রাখার ব্যবস্থা করুন। ভেরিফিকেশনে চার-পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না। ততক্ষণ ওখানে দাঁড়াব আমরা। তবে হ্যাঁ… গেট ওই সময় খোলা রাখতে হবে।

‘আমি রাজি।’

মুখের হাসি আরও বিস্তৃত হলো রানার। পাঁচ মিনিট খোলা থাকবে গেট, এস্টেটের ভিতরে কমাণ্ডো ঢোকানোর জন্য সময়টা যথেষ্ট-র চেয়েও বেশি।

‘বাই দ্য ওয়ে, রানা বলল, ‘আপনার ছেলেকে যা বলেছি, তা সত্যি…

‘আশা করি তুমি সিনেটর ম্যাহোনির কথা বলছ?

‘হ্যাঁ। ওঁকে তো বলেছি, এক্স-রে-গুলো ইন্ট্যাক্ট অবস্থায় পাবে আপনারা। কপি-টপি তৈরি করে বিপদ বাড়াবার ইচ্ছে নেই আমার।’

‘শুনে খুশি হলাম। কিন্তু তোমার এই অ্যারেঞ্জমেন্টে একটা গলদ চোখে পড়ছে আমার।

‘গলদ?’

‘হুঁ। সাড়ে এগারোটা থেকে সোয়া বারোটা… মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমাদের আলাপের জন্য সময়টা মোটেই যথেষ্ট নয়।

‘আপাতত তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে আপনাকে,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা। ‘যদি দ্বিতীয়বার কথা বলবার খায়েশ জাগে আমার মনে, আপনাকে কোথায় পাওয়া যাবে, তা তো জানা থাকছেই। তাই না?’

খনখনে গলায় হেসে উঠল রাখাল বালক। ‘অবশ্যই! সো সিম্পল! তুমি দেখছি খুব যুক্তিবাদী মানুষ, রানা।

‘চেষ্টা করি আর কী। সাড়ে এগারোটায় দেখা হচ্ছে তা হলে। রিসিভার নামিয়ে রাখল রানা। মূর্তির মত বসে রইল কিছুক্ষণ। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, প্রস্তুতিপর্ব এত সহজে সমাপ্ত হয়েছে। সমস্ত পদক্ষেপের জন্য রয়েছে ব্যাকআপ… সমস্ত ব্যাকআপের জন্যও রয়েছে বিকল্প। রাতের অভিযানের জন্য এখন পুরোপুরি তৈরি ও।

.

কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা ঊনত্রিশে গাড়ি নিয়ে ম্যাহোনি হলের মেইন গেটে পৌঁছুল রানা। হর্ন বাজাতেই খুলে গেল পাল্লা, কয়েক সেকেণ্ডের জন্য দাঁড়াতে হলো গার্ড পোস্টের পাশে। টর্চের আলো ফেলে ওর চেহারা দেখল ইউনিফর্মধারী একজন লোক, তারপর হাতের ইশারায় সামনে এগোবার নির্দেশ দিল।

এস্টেটের বিশাল লনের মাঝ দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা রাস্তা, ওটা ধরে বাড়ির সামনে ড্রাইভওয়েতে পৌছুল। বিশাল গ্যারাজটার দরজা খোলা; পেরুনোর সময় কৌতূহলী দৃষ্টি দিল ও, বিস্মিত হয়ে লক্ষ করল—ভিতরে অনেকগুলো লিমাজিন দাঁড়িয়ে আছে, সংখ্যায় পনেরোটার কম নয়। ধোপদুরস্ত শোফাররা রয়েছে কাছাকাছি, গল্পগুজবে মত্ত। সম্ভবত পরস্পরের পরিচিত তারা। ভুরু কোঁচকাল রানা। অতিথি রয়েছে ম্যাহোনি হলে? কারা?

চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল বিশাল বাড়িটার উপর চোখ পড়ায়। কাছ থেকে এখন ম্যাহোনি হলকে দেখতে পাচ্ছে ও। একই সঙ্গে ভয় এবং শ্রদ্ধা জাগাবার মত চেহারা। কালো আকাশের পটভূমিতে মাথা তুলে রেখেছে সগর্ব ভঙ্গিতে। মিসেস ম্যাহোনির কথাই ঠিক, এখান থেকে পুরো বস্টন নগরী দেখা যায়। দেয়ালের ওপারে, দূরে মিটমিট করছে ব্যস্ত নগরীর শত-সহস্র বাতি। পাহাড়ের মাথায় বসা, ম্যাহোনি হল্ যেন রাজপ্রাসাদ, অবজ্ঞার দৃষ্টি ফেলছে সাধারণ জনপদের দিকে

পোর্চের তলায় পৌছুলে অস্ত্রধারী দু’জন লোক এগিয়ে এল। রানা গাড়ি থেকে নামতেই উল্টো ঘুরবার ইশারা করল। পা ফাঁক করে, গাড়ির হুডের উপর দু’হাত মেলে দাঁড়াতে হলো ওকে। দক্ষ হাতে চালানো হলো শরীরতল্লাশি। মান-ইজ্জতের ধার ধারল না, অস্ত্র লুকানোর মত যত জায়গা আছে, সব আঁতিপাঁতি করে খুঁজল তারা। কিছু আনেনি রানা, তাই রেহাই পেল মিনিটদুই পর এসকর্ট করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো বাড়ির ভিতরে।

ম্যাহোনি হলের অভ্যন্তরে পা রেখে টের পেল রানা, কেন এ-বাড়িটা কিনে নিয়েছে জিয়োভান্নি গুইদেরোনি। স্টেয়ারকেস, ট্যাপেস্ট্রি আর ঝাড়বাতি মিলিয়ে শুধু হলঘরের সৌন্দর্যই অতুলনীয়। এ-ধরনের কাঠামো আর একটামাত্র জায়গায় দেখেছে রানা-পোর্তো ভেচিয়োয়… ভিলা বারেমির পোড়া ধ্বংসস্তূপে ও-রকম একটা আবাসে থাকতে চাইবে রাখাল বালক, এটাই তো স্বাভাবিক।

‘এ-দিকে আসুন, প্লিজ।’ হলঘরের পাশে একটা দরজা খুলে ধরল গার্ড। ‘তিন মিনিট পাবেন আপনি।’

মাথা ঝাঁকিয়ে কামরায় ঢুকল রানা, দেখতে পেল সোনিয়া আর কুয়াশাকে। ছোট একটা খাটে শুইয়ে রাখা হয়েছে বাঙালি বিজ্ঞানীকে-বিকেলে যা দেখেছিল, তারচেয়েও খারাপ অবস্থা; পুরো শরীর এখন রক্তে ভেজা। বোঝা গেল, খুব বেশিক্ষণ হয়নি আরেকদফা অত্যাচার চালানো হয়েছে তার উপর। সোনিয়া পাশে বসে শুশ্রূষা করছিল ওর, দরজা খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল মেয়েটা, তারপরই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল রানাকে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করছে ওর নাম, চোখে নামছে অশ্রুর অঝোর ধারা। ফোঁপানোর সময় কেঁপে উঠছে সারা দেহ।

‘শান্ত হও,’ ওর কপালে আলতো চুমো দিয়ে বলল রানা। ‘আমি এসে গেছি। একটু পরেই তোমাদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যাব, কিচ্ছু ভেবো না।‘

নিজেকে সামলে নিল সোনিয়া। হাত ধরে টানল রানাকে। ‘এদিকে এসো। কুয়াশা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।‘

কাছে যেতেই বুক টনটন করে উঠল রানার। ভয়াবহ অবস্থা কুয়াশার। মারের চোটে চোখদুটো বুজে গেছে প্রায়, মুখের একপাশে চামড়া বলতে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই আর। দগদগ করছে ঘা। ব্যাণ্ডেজের তলায় কী অবস্থা, কে জানে। শ্বাস টানছে খুব কষ্ট করে। দ্রুত হাসপাতালে নিতে না পারলে ওকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। অব্যক্ত ক্রোধে দাঁত পিষল রানা।

রানাকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে উঠল কুয়াশা, ঠোঁট ফাঁক করে কী যেন বলতে চাইল, কিন্তু গোঙানি ছাড়া আর কিছু বেরুল না গলা দিয়ে।

‘কথা বলবার দরকার নেই, বিশ্রাম নিন আপনি,’ তাড়াতাড়ি বলল রানা। ‘কষ্ট করে আর ঘণ্টাখানেক টিকে থাকুন, কুয়াশা। এরপরই হাসপাতালে পৌঁছে যাবেন আপনি। আমি কথা দিচ্ছি।’ সোনিয়ার দিকে ফিরল ও। এসব ঘটল কী করে? বিকেলেও দেখেছি ওঁকে… এত খারাপ অবস্থা ছিল না।’

‘আধঘণ্টা আগে উপরতলা থেকে এখানে আনা হয়েছে আমাদেরকে,’ জানাল সোনিয়া। ‘সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কী যেন ভূত চাপল মি. কুয়াশার মাথায়… ঝাঁপিয়ে পড়লেন এক গার্ডের উপর। তাকে নিয়ে গড়াতে গড়াতে নামলেন নীচে। টুটি চেপে ধরেছিলেন লোকটার। অন্য গার্ডরা পিছন থেকে লাথি-গুঁতো আর, রাইফেলের বাট দিয়ে যত আঘাতই করল, কিছুতেই ছাড়লেন না; গলা টিপে একেবারে খুনই করে ফেললেন। কিন্তু ততক্ষণে ওঁর নিজের অবস্থাও সঙ্গীন হয়ে গেছে… দেখতেই পাচ্ছ।’

‘এ-রকম পাগলামির মানে কী?’ বিস্মিত দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকাল রানা।

হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকল কুয়াশা। কানে কানে কিছু বলতে চায়। রানা তার শরীরের উপর ঝুঁকতেই চাদরের তলা থেকে কী যেন একটা বের করে আনল, গুঁজে দিল কোমরে। চমকে উঠল রানা। একটা পিস্তল! এবার বুঝল কুয়াশার ওই কাণ্ড ঘটানোর কারণ। মরা গার্ডের হোলস্টার থেকে হাতসাফাই করে অস্ত্রটা নিয়ে নিয়েছে সে।

‘আপনি একটা জিনিয়াস, কুয়াশা, নিচুগলায় বলল রানা।

ব্যথাতুর একটা হাসি ফুটল কুয়াশার ঠোঁটে। অনেক কষ্টে ফিসফিস করে বলল, ‘ওরা… সবাই… আজ এখানে, রানা। এই সুযোগ… নষ্ট করা… যাবে না।’

‘কাদের কথা বলছেন?’

‘কাউন্সিল…’

‘ফেনিসের কাউন্সিল?’

মাথা একটু ঝোঁকাল কুয়াশা। ঠোঁটের কাছে দুটো আঙুল তুলল।

‘সিগারেট চাইছেন? পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করল রানা।

সিগারেট নিল না কুয়াশা, শুধু দেশলাই। মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে ফেলল বাক্সটা।

দরজা খুলে গেল ঝট্ করে। গার্ড ফিরে এসেছে। কর্কশ গলায় বলল, ‘সময় শেষ। মি. গুইদেরোনি অপেক্ষা করছেন।’

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল রানা। উল্টো ঘোরার আগে ওভারকোটের তলায় ভাল করে লুকাল পিস্তলটা। সোনিয়াকে বলল, ‘তৈরি থেকো। খুব শীঘ্রি তোমাদের নেবার জন্য ফিরে আসব আমি।’

.

বৃহদায়তন লাইব্রেরির একটা বড় ডেস্কের পিছনে বসে আছে জিয়োভান্নি গুইদেরোনি। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, মাথাভর্তি সাদা চুল চোখে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। পঁচাশি বছর বয়স, অথচ এখনও কাঠামোটা লাইটপোস্টের মত ঋজু। গলার চামড়া শুধু সামান্য ঝুলে পড়েছে, চেহারায় বলিরেখা নেই বললেই চলে। হাবভাবে মনে হলো, দুনিয়ার সবাইকে সে তুচ্ছ জ্ঞান করে।

রানাকে দেখে চওড়া হাসিতে উদ্ভাসিত হলো রাখাল বালকের মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম টু ম্যাহোনি হল, মি. মাসুদ রানা। শিডিউলটার ব্যাপারে আরেকটু ভেবে দেখবে নাকি? চল্লিশ মিনিট বড্ড কম সময়। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে আমার।’

‘পরে কখনও শুনব,’ চাঁছাছোলা গলায় বলল রানা। ‘আজকের শিডিউল নড়চড় হবে না।’

‘আই সি!’ চেয়ারে বসে পড়ল গুইদেরোনি। রানাকেও ইশারা করল বসতে। ‘আমাকে বিশ্বাস করছ না তুমি!

বসল রানা। বাঁকা সুরে বলল, ‘করা কি উচিত? ফেনিসের চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে আমার।’

তা তো জানবেই। প্রায় চারদিন পেয়েছি আমরা কুয়াশাকে ইন্টারোগেট করবার জন্য। প্রথমে মুখ খোলেনি, তবে কেমিক্যাল ইনজেক্ট করার পর গড়গড় করে বলে দিয়েছে সবকিছু। বড় বড় বেশ কটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সঙ্গে আমাদের সংগঠনের কানেকশন খুঁজে পেয়েছ তোমরা। ধারণা করছ, ওদের মাধ্যমে দুনিয়ার বিভিন্ন টেরোরিস্ট গ্রুপের খরচ জোগাচ্ছি আমরা। তাই না? ভুল হয়নি তোমাদের। খুব কম ফ্যানাটিক দলই আমাদের সাহায্যের কথা অস্বীকার করতে পারবে।

‘আশা করি একটা পরিকল্পনা আছে আপনাদের? শুধু বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দুনিয়া জয় করা যায় না।’

‘এখানেই তুমি ভুল করছ, রানা। হাসল গুইদেরোনি। ‘পুরনো একটা কাঠামোর জায়গায় নতুন কাঠামো তৈরি করতে চাইলে প্রথমে কী করতে হয়? আগেরটা ভেঙে ফেলতে হয়… ঠিক? সামনে ঝুঁকল একটু’। ‘পৃথিবীর বর্তমান শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার জন্য টেরোরিজমের চেয়ে ভাল পথ আর দ্বিতীয়টি নেই। সন্ত্রাসের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলব আমরা। বেঁচে থাকা যখন কঠিন হয়ে উঠবে, তখন সাধারণ মানুষ নেমে আসবে রাস্তায়-অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে। কীভাবে ঠেকাবে ওদেরকে সরকার? নিজেদের অস্ত্রভাণ্ডার দিয়ে? সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহার করে? না, রানা, পদত্যাগ করতে হবে ওদেরকে। ছেড়ে দিতে হবে ক্ষমতা। আর তখনই দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের জায়গায় আসবে যুক্তিবাদীরা। সন্ত্রাস আর বিশৃঙ্খলা হটিয়ে ফিরিয়ে আনবে স্বাভাবিক পরিস্থিতি।’

‘যুক্তিবাদী?’

‘এগজ্যাক্টলি,’ মাথা ঝাঁকাল রাখাল বালক। ‘আজকের যুগে বর্তমান সরকার-ব্যবস্থা অচল, রানা। মানবজাতির পুরো ইতিহাস জুড়ে ওর যেভাবে চলেছে, সেভাবে আর চলতে দেয়া যায় না। যদি চলে, তা হলে এই গ্রহ আগায়ী শতাব্দীর মুখ দেখবে না। সরকার বলতে আমরা যা বুঝি, তাকে প্রতিস্থাপন করতে হবে।’

‘কী দিয়ে?’

যুক্তিবাদী… দার্শনিক-সম্রাটদের একটি নতুন জাতি দিয়ে। এমন সব মানুষ, যারা প্রগতির জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত; জানে, কী অমিত সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে এ-গ্রহের সম্পদ, প্রযুক্তি আর উৎপাদন-ক্ষমতার মাঝে। কারও ধর্ম-বর্ণ বা জন্মগত শিকড় নিয়ে মাথা ঘামায় না এরা, মাথা ঘামায় শুধু যোগ্যতা নিয়ে—পৃথিবী নামের এই বিশাল বাজারকে চালাবার জন্য কার কতখানি অবদান, সেটা নিয়ে।

‘মাই গড! আপনি কর্পোরেট ব্যবসার কথা বলছেন!’

তাতে কোনও সমস্যা আছে? কর্পোরেট স্ট্রাকচারের চেয়ে কার্যকর আর কোনও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কি সৃষ্টি হয়েছে দুনিয়ায়? নিজেই ভেবে দেখো, শাসনক্ষমতা যদি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া হয়; তারা যদি বিশাল এক কোম্পানির মত চালাতে শুরু করে পৃথিবীকে — কতখানি বাড়বে আমাদের প্রোডাক্টিভিটি! অপচয় বন্ধ হবে… বন্ধ হবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর সরকারি দুর্নীতি। তেল দেয়া একটা মেশিনের মত চলবে শাসনযন্ত্র, প্রগতি আর উন্নতির শিখরে উঠতে পারব আমরা।’

‘থিয়োরি হিসেবে মন্দ নয়,’ মন্তব্য করল রানা। ‘তবে… শুধুই থিয়োরি।’

‘হতাশ হলাম, রানা,’ বিতৃষ্ণা ফুটল গুইদেরোনির চেহারায়। ‘ভেবেছিলাম আর কেউ না হোক, তুমি বুঝবে আমাদের আদর্শ আর তার প্রয়োজনীয়তা। যে-দেশ থেকে এসেছ, মানে বাংলাদেশের কথা বলছি, সেটা ব্যর্থ শাসন-ব্যবস্থার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।’

‘কিন্তু ওই দেশে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারছি আমি।

‘স্বাধীনতা? ওটা আমাদের সিস্টেমেও থাকবে। প্রতিটা মানুষ সমান সুযোগ পাবে তার সুপ্ত প্রতিভা আর প্রোডাক্টিভিটিকে জাগিয়ে তোলার জন্য। যে যত সাফল্য দেখাবে, ততই বাড়বে তার আয় এবং স্বাধীনতা।’

‘আর কেউ যদি প্রোডাক্টিভ হতে না চায়? চাহিদা যদি অল্প হয় তার? সাফল্যের পিছনে না ছুটে যদি শুয়ে-বসে কাটাতে চায় জীবন?’

‘অমন মানুষ পৃথিবীর বোঝা, রানা। তাদের স্থান হবে না আমাদের সমাজে।‘

‘কে দেবে সেই সিদ্ধান্ত? আপনি?’

‘না। পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হবার ইচ্ছে আমার নেই। ম্যানেজমেন্ট পার্সোনেলের ট্রেইণ্ড ইউনিট থাকবে আমাদের, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দুনিয়াকে পরিচালনা করবে তারা।’

‘দিবাস্বপ্ন আর কাকে বলে!’ হেসে উঠল রানা।

চেহারা নিষ্ঠুর হয়ে উঠল গুইদেরোনির। বিদ্রূপ করে তুমি শুধু সময়ই নষ্ট করছ, রানা। আমাদের সিস্টেমে কোনও গলদ নেই। দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ কোম্পানি চলছে আধুনিক ম্যানেজমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে। তাদের কেউ পথে বসছে না। কারণ, ধ্বংসের পথে চলে না ওরা। হিংসাবিহীন, প্রতিযোগিতার পন্থা অবলম্বন করে। নতুন পৃথিবীও সেভাবেই চালানো হবে। সরকারের উপর আর নির্ভর করা চলে না। অস্ত্র প্রতিযোগিতা আর যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে ওরা। কিন্তু কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকাও, বুঝবে। ফোক্সওয়াগেনের সঙ্গে ক্রাইসলার কি যুদ্ধ বাধিয়েছে? পেপসি কি বোমা মেরেছে কোকা-কোলার ফ্যাক্টরিতে? পেন্টিয়াম কি হামলা করেছে অ্যাথলনের কর্মচারীদের উপর? না, মি. রানা। রক্তপাতের কোনও স্থান নেই ব্যবসাজগতে। ঠিক তা-ই প্রতিষ্ঠা করা হবে নতুন পৃথিবীতে। আমাদের একমাত্র লড়াই হবে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং উন্নয়নের লক্ষ্যে। এভাবেই রক্ষা পাবে পুরো মানবজাতি। মাল্টিন্যাশনাল বিজনেস কমিউনিটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভয়াবহ প্রতিযোগিতা আছে ওখানে, আগ্রাসন আছে… কিন্তু কোনোটাই সহিংস নয়। ব্যবসায়ীরা অস্ত্র ধরে না।’

কিন্তু ফেনিস ধরছে। দিব্যি খুন করছে নিরীহ মানুষকে।’

‘ওদের কেউই নিরীহ নয়, রানা। আমাদের সাফল্যের পথের কাঁটা, অথবা ওদের মৃত্যু আমাদের লক্ষ্য অর্জনের সহায়ক,’ ভাষণ দেবার ঝোঁক চেপে বসেছে গুইদেরোনির মধ্যে। ‘শান্তি আর সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌছুনোর জন্য এ-মুহূর্তে নিষ্ঠুর না হয়ে উপায় নেই আমাদের। কী ধারণা তোমার, সরকার আর রাজনৈতিক নেতারা কি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে? ওদেরকে বাধ্য করবার ‘জন্যই এ-পথ বেছে নিয়েছি আমরা। আমাদের কর্মকাণ্ডে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছে ওরা একে একে হারাচ্ছে জন-সমর্থন, কিংবা করছে পদত্যাগ। সে-সব জায়গায় নিজেদের লোক বসাচ্ছি আমরা। ইটালিতে পার্লামেন্টের প্রায় বিশ শতাংশ আমাদের দখলে। জার্মানিতে বারো, জাপানে একত্রিশ, চিনে পাঁচ আর ইংল্যাণ্ডে পনেরো শতাংশ! রেড ব্রিগেড, বাদের মেইনহফ, আল-কায়েদা বা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সাহায্য ছাড়া কি এসব সম্ভব হতো? সন্ত্রাসের প্রতিটা ঘটনায় লক্ষ্যের কাছে এক পা করে এগোচ্ছি আমরা—শান্তিময়, সুশৃঙ্খল পৃথিবীর দিকে!’

‘পঁচাত্তর বছর আগে এমন দর্শন ছিল না গিলবার্তো বারেমি-র,’ বলল রানা।

‘খুব একটা পার্থক্য ছিল তা-ও বলা যায় না,’ গুইদেরোনি বলল। দুর্নীতিবাজদেরকে খতম করতে চেয়েছিলেন তিনি, আজকের যুগে সে-কাজ করতে গেলে পুরো সরকার-ই ধ্বংস করে দিতে হয়। আমরা তা-ই করছি : একটা নিয়ম দেখিয়ে গেছেন তিনি–রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পথ। আমাদের সরবরাহ করা খুনিরা হত্যা আর রাহাজানির মাধ্যমে শত্রুতা সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মধ্যে। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করতে শুরু করেছে। কিন্তু পাদ্রোনির পরিকল্পনার সমাপ্তিটা ঠিক গোছানো ছিল না। সরকার ধ্বংসের পর কীভাবে ক্ষমতা দখল করা হবে, কীভাবে চালানো হবে নতুন পৃথিবীকে … ছিল না সেসবের দিক-নির্দেশনা। ওটাই খুঁজে নিয়েছি আমরা। পূর্ণতা দিয়েছি তাঁর স্বপ্নের। এখন শুধু সেটাকে সফল করবার অপেক্ষা

‘স্বীকার করছি, আপনার কথায় যুক্তি আছে.’ লোকটাকে খুশি করবার জন্য বলল রানা। ‘কিছুটা কনভিন্স হয়েছি বললেও ভুল হবে না। হয়তো আরও আলাপ করব আপনার সঙ্গে…. মানে, আমার বন্ধুরা মুক্তি পাবার পর।’

‘আমার কথায় যুক্তি খুঁজে পাচ্ছ শুনে ভাল লাগছে,’ হাসিমুখে বলল গুইদেরোনি, পরমুহূর্তে শীতল হয়ে গেল কণ্ঠ। ‘তারচেয়েও ভাল লাগছে একজন অবিশ্বাসীর প্রতিক্রিয়া দেখতে পেয়ে রিয়েলি, রানা, খুব ভাল অভিনয় জানো তুমি।

‘অভিনয়!’

‘নয়তো কী?’ গর্জে উঠল রাখাল বালক। এসবের অংশ হতে পারতে তুমি। শুরুতে তোমার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেও পরে আবার মত পাল্টাই আমি। রক ক্রিক পার্কের ওই ঘটনার পরে কাউন্সিলের সভা ডাকি, তাদেরকে নতুন করে তোমার আর কুয়াশার মূল্যায়নের নির্দেশ দিই। ওরা জানায়-কুয়াশা আমাদের কাজে আসবে না; কিন্তু তুমি একটা অমূল্য সম্পদ, মাসুদ রানা। তোমার সাহায্যে বড় বড় বহু সংগঠনকে হাতের মুঠোয় নিতে পারতাম আমরা। এমনকী তুমি আমাদের নিরাপত্তাও দিতে পারতে। দিনের পর দিন তাই চেষ্টা চালিয়েছি আমরা-তোমার নাগাল পেতে, তোমাকে দলে টানতে। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। বড্ড ঘাড়ত্যাড়া লোক তুমি, একবার যেটা মাথায় ঢোকে, তা বের করতে চাও না। অপরিণামদর্শী আদর্শবাদী। এখনও আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছ। না… তোমাকে বিশ্বাস করা চলে না। তোমাকে কোনোদিনই বিশ্বাস করা যাবে না!’

খেপে গেছে অর্ধোন্মাদ লোকটা। রানা প্রতিক্রিয়া দেখাল না। শান্ত গলায় বলল, ‘আমার ব্যাপারে যে-কোনও ধারণা পোষণ করবার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে আজ এখানে এসেছি আমি, সেটা না ভুললেই ভাল করবেন।’

‘হাহ্, উদ্দেশ্য?’ ঠোঁটের কোনা বেঁকে গেল গুইদেরোনির। ‘উদ্দেশ্য অবশ্যই সফল হবে তোমার। কুয়াশা আর ওই মেয়েটাকে চাও তো? পাবে। মিলন ঘটবে তোমাদের, আমি কথা দিচ্ছি। এই বাড়ি থেকেও বেরুবে…. কিন্তু এরপরে দুনিয়ার আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না তোমাদেরকে।’

‘বোকামি করবেন না, গুইদেরোনি, সতর্ক করল রানা। ‘আপনার ছেলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে চলেছে… তবে সেটা ডেভিড ম্যাহোনির পরিচয়ে। আমাকে যদি খুন করেন, তা হলে মুখোশ খুলে যাবে তার। আসল ডেণ্টাল রেকর্ডগুলো রয়েছে আমার লোকের হাতে।’

কচু আছে তোমার হাতে!’ চরম বিদ্রূপ প্রকাশ পেল গুইদেরোনির কণ্ঠে। ডেস্কের উপর রাখা ইন্টারকমের বোতাম টিপল। কাকে যেন নির্দেশ দিল, ওকে নিয়ে এসো ভিতরে।’ মিটিমিটি হাসি নিয়ে চেয়ারে হেলান দিল এরপর।

কয়েক মুহূর্ত পর খুলে গেল লাইব্রেরির দরজা। হুইলচেয়ারে বসিয়ে একজন মানুষকে নিয়ে আসা হলো কামরার ভিতরে। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠল রানা।

অ্যাডমিরাল হ্যামিলটন! প্রায়-অচেতন দশা তাঁর। কপালের একপাশে বিশ্রী একটা কালসিটে।

যে-লোক হুইলচেয়ার ঠেলছে, তাকেও ভাল করে চেনে ও।

‘হ্যালো, মি. রানা!’ মুচকি হেসে অভিবাদন জানাল চার্লি — নুমা চিফের শোফার-কাম-দেহরক্ষী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *