সেই কুয়াশা ২.৮

আট

আর্কাইভের মেটাল র‍্যাক থেকে ঢাউস দুটো খতিয়ান নামালেন শেভচেঙ্কো, তুলে দিলেন কুয়াশার হাতে। এর আগে আরও ষোলোটা বই দেখা হয়েছে, কিন্তু পাওয়া যায়নি প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিন সংক্রান্ত কোনও তথ্য।

‘কাজটা মস্কোতে করা গেলে অনেক দ্রুত সারা যেত,’ হাত থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন তিনি। ‘ওখানে কম্পিউটারাইজড্ ইনডেক্স বানানো আছে। সহজে দরকারি তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়।’

‘সঙ্গত কারণেই ওখানে যেতে পারছি না আমরা,’ বলল কুয়াশা। ‘এখানেই চেষ্টা করে দেখতে হবে।’

বইদুটো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল দু’জনে। হলদেটে পাতাগুলো উল্টে চোখ বোলাল প্রাচীন রেকর্ডে।

‘পেয়েছি!’ একটু পর বলে উঠলেন শেভচেঙ্কো।

‘কী?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা।

ভারাকিন পরিবারের ইতিহাস। এই তো… এখানে আছে সব।’

‘দেখি।’

বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানের পাশে চলে এল কুয়াশা। পড়তে শুরু করল লেখাটা। পরিষ্কার, গুটি গুটি হরফে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সব। প্রিন্স ভারাকিনের পিতা আর পিতামহের কথা আছে ওতে। সাধারণ জনতার শত্রু বলে বর্ণনা করা হয়েছে তাদেরকে। দেয়া আছে অপরাধের বিবরণ—প্রিন্সের পূর্বপুরুষদের কারণে মারা পড়েছে বহু মানুষ, ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক; একটা সময়ে গোটা রাশা জুড়ে দেখা দেয়। অর্থনৈতিক মন্দার জন্যও দায়ী করা হয়েছে তাদেরকে। প্রিন্স আন্দ্রেই ভারাকিনকে দক্ষিণ ইয়োরোপে পাঠানো হয়েছিল উচ্চশিক্ষার জন্য, পাঁচ বছর বিদেশে কাটিয়ে সে ফিরে আসে পূর্বপুরুষদের স্থাপন করা ঐতিহ্যকে আরও সুসংহত করবার মানসিকতা নিয়ে।

‘কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল কুয়াশা। ‘কোথায় লেখাপড়া করেছে ও?’

পাতা ওল্টালেন শেভচেঙ্কো। ‘ক্রেফেল্ড… ইউনিভার্সিটি অভ ক্রেফেল্ড। এই তো, লেখা আছে এখানে।’

‘তারমানে জার্মানি।’ একটু ভাবল কুয়াশা। ‘মনে হচ্ছে এটাই আমাদের ব্লু।

‘কীসের ক্লু?’

‘ভারাকিনের নতুন পরিচয়ের। আসুন, পুরোটা পড়ে দেখি।’

পড়ল ওরা। তিন বছর ক্রেফেন্ডে পড়াশোনা করেছে প্রিন্স, তার মধ্যে দু’বছর ছিল ডুসেলডর্ফে… গ্র্যাজুয়েট হবার জন্য। ভবিষ্যৎ জার্মান-ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট গুস্তাভ ফন বোলেনহলবাখ, ফ্রেডরিখ শট আর উইলহেলম্ হ্যাবারনিশ-এর মত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সে-সময়ে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার।

বিখ্যাত এসব ব্যবসায়ী সম্পর্কে কী জানে, ভেবে দেখল কুয়াশা। ‘জার্মানির এসেন-কেন্দ্রিক ব্যবসা ছিল ওদের, বলল ও, ‘মনে হচ্ছে ওখানেই পাড়ি জমিয়েছিল ভারাকিন। আফটার অল, ওখানে বন্ধুবান্ধব ছিল তার, ভাষাটাও ভাল করে জানত। টাইমিং-ও ছিল চমৎকার। রাশায় বিপ্লব, ইয়োরোপ জুড়ে যুদ্ধ… গোলমালের মাঝে হারিয়ে যাওয়া সহজ ছিল খুব। আমি বলব, এসেনের আর্মামেন্ট কোম্পানিগুলোর একটায় ঢুকে পড়েছিল সে।’

‘ক্রুপ?’

‘অথবা ভর্গেন… ক্রুপদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।’

‘কীভাবে?’

‘পিছনের দরজা দিয়ে… নতুন পরিচয় নিয়ে। সে-আমলে জার্মান ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এক্সপ্যানশন চলছিল পূর্ণোদ্যমে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট এত ঘন ঘন বদলাত যে, ঠিকমত ট্র্যাক রাখতে পারত না কেউ। পরিস্থিতি ভারাকিনের অনুকূলে ছিল।’

‘এক মিনিট.’ বলে উঠলেন শেভচেঙ্কো, খতিয়ানের একটা অংশে চোখ আটকে গেছে তাঁর। ‘এই তো প্রিন্সের মারা যাবার বিবরণ! স্যরি, কুয়াশা, তোমার থিয়োরি আর বিশ্বাসযোগ্য থাকছে না।’

বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল কুয়াশা। হ্যাঁ, বিবরণই বটে… রাশান বিপ্লব শেষে বউ, দুই ছেলে আর এক মেয়ে-সহ প্রিন্স ভারাকিনের নিহত হবার বিবরণ। স্লোভিয়াঙ্কা নদীর তীরে, ভারাকিনদের ব্যক্তিগত এস্টেটে হামলা করেছিল উন্মত্ত জনতা। বাড়ির ভিতরে আটকা পড়ে প্রিন্স ভারার্কিন আর তার পরিবার! আত্মসমর্পণের প্রস্তাব মেনে না নিয়ে চাকর-বাকরদেরকে বের করে দেয় বাড়ি থেকে। তারপর শুরু করে লড়াই। শেষ পর্যন্ত বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা, সে আগুনে পুড়ে মরে সবাই। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা কঙ্কালের মাধ্যমে মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে।

‘এটা মানতে পারছি না আমি,’ মাথা নাড়ল কুয়াশা। মরেনি ভারাকিন… এই রেকর্ড ভুয়া।’

‘তোমার এ-ধারণা ভুল, কুয়াশা, নরম গলায় বললেন- শেভচেঙ্কো। ‘এটা সরকারি আর্কাইভ। প্রতিটি তথ্য অনেক যাচাই-বাছাই করে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

‘সরকারি রেকর্ড জাল করাই বরং সহজ,’ কুয়াশা বলল। ‘আমি অস্বীকার করছি না, ভারাকিনদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল; কিন্তু ওরা যে মারা গিয়েছিল, তার কোনও প্রমাণ নেই। কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছিল… সেটা যে কারুরই হতে পারে। আমার তো মনে হয়, সবার চোখে ধুলো দেবার জন্য নাটক করা হয়েছিল ওখানে।’

‘এত নিশ্চিত হচ্ছে কীভাবে?’

‘লেখাটা ভাল করে পড়ুন। লক্ষ করেছেন, সবকিছু কেমন ভাসা ভাসা ভঙ্গিতে লেখা?’ পাতা উল্টে খতিয়ানের পিছনদিকে গেল কুয়াশা। ‘এই যে… এখানে আরেকজন উচ্চবংশীয় ভদ্রলোকের মৃত্যুর বিবরণ আছে। এটার সঙ্গে মেলান। প্রতিটা বর্ণনা নিখুঁত। কখন কী ঘটেছিল, কতজন লোক গিয়েছিল, কার নেতৃত্বে… কার আদেশে গিয়েছিল, কতগুলো গুলি করা হয়েছে-কোনও কিছুই বাদ দেয়া হয়নি। আগের বইগুলোতেও একই কায়দা লক্ষ করেছি আমি। অথচ ভারাকিনের অংশটাতে একটাও খুঁটিনাটি নেই। পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন? আসলে ঘটেইনি যে-ঘটনা, সেটার খুঁটিনাটি আসবে কোত্থেকে?’

নাকের উপর চশমাটা ভাল করে বসালেন শেভচেঙ্কো। গম্ভীর হয়ে মেলালেন দুটো এন্ট্রি-ই। চেহারা বদলে গেল তাঁর। বললেন, ‘বোধহয় ঠিকই ধরেছ। গোলমাল আছে এতে।’

‘শুধু গোলমাল না, মহা-গোলমাল,’ বইটা বন্ধ করল কুয়াশা। ভারাকিন পরিবারের কিছু হয়নি সেদিন। বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে ওরা।’

.

লাইব্রেরিয়ানের অফিসে ফিরে এল ওরা। কুয়াশার কথামত আবার একবার কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের অফিসে ফোন করলেন শেভচেঙ্কো। গলায় কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে ডিউটি অফিসারকে বললেন, ‘কমপ্লেইন জানাবার জন্য ফোন করেছি আমি। তখন আপনাকে বলে দিলাম, আর্কাইভের কাজ শেষ করতে সময় লাগবে… চাবি যিনি আনবেন, তিনি যেন একটু দেরি করেন এখানে…. অথচ কী ঘটেছে, জানেন? কাজের হাত থেকে বাঁচার জন্য চাবিটা আমার দরজার তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন উনি, দেখা না করেই কেটে পড়েছেন! এ-ধরনের আচরণ কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না! অফিশিয়ালি কমপ্লেইন পাঠাব আমি… আর হ্যাঁ, দয়া করে চাবিটা নিয়ে যাবার জন্য পাঠান কাউকে।’

ওপাশের লোকটাকে কথা বলবার সুযোগ দিলেন না তিনি, রাগী ভঙ্গিতে নামিয়ে রাখলেন রিসিভার। তারপর কুয়াশার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হলো অভিনয়?’

‘চমৎকার… পুরস্কার পাবার মত. ‘ হাসল কুয়াশা। ‘এখন আর কেউ সন্দেহ করতে পারবে না আপনাকে। পিঠ বাঁচল আপনার।’

‘লাশটা?’

‘ফার্নেসের পিছনে ফেলে দিয়ে আসব। আপনি ওটার ব্যাপারে কিচ্ছু জানেন না… লোকটাকে দেখেনই-নি কখনও। টিভিটাও লুকিয়ে ফেলুন আশপাশের কোনও স্টোররুমে! ক্লিয়ার? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে এলে আকাশ থেকে পড়বেন।

কিন্তু কালচারাল অ্যাফেয়ার্সের লোকেরা তো লাশটাকে চিনবে!’

উঁহু। কী বললাম আপনাকে? এ-লোক চাবি নিয়ে আসেনি ওখান থেকে। অন্য সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবে ওরা-চাবি ফেরত পেয়েছে, কিন্তু মানুষটা কোথায়? ফার্নেসের পিছনে পাওয়া লাশের সঙ্গে ব্যাপারটার সম্পর্ক খুঁজে পেতে অনেক সময় লাগবে ওদের।

‘আর ফেনিস? ওদের লোকও তো ফিরছে না। ওরা চিন্তায় পড়বে না?’

‘পড়রে, তবে এখুনি না। ওদের খুনি ব্যর্থ না সফল হয়েছে, সে-রিপোর্ট পাবার অপেক্ষায় থাকবে। যা-ই ঘটুক। বেশ কিছুটা সময় পাচ্ছি আমরা… সেটাই চাই।’

‘কেন?’

‘জার্মানিতে যেতে হবে আমাকে। এসেন-এ।’

‘স্রেফ অনুমানের উপর ভিত্তি করে এগোতে চাইছ তুমি।’

‘অনুমান না, স্যর। ক্যালকুলেটেড স্টেপ বলতে পারেন। আর্কাইভের রেকর্ডে যাদের নাম আমরা দেখেছি, তার মধ্যে দুটো নাম আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। শট আর বোলেনহলবাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে দেশ থেকে মুদ্রা পাচারের অভিযোগ ওঠে ফ্রেডরিখ শটের নামে। পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই অজ্ঞাতনামা আততায়ীর হাতে খুন হয় সে, খুনিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ঘটনাটার মধ্যে ফেনিসের গন্ধ পাচ্ছি আমি। মনে হচ্ছে শটের মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিল ওরা, যাতে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে কোনও গোমর ফাঁস না হয়। আর বোলেনহলবাখ… ক্রুপ পরিবারের শেষ বংশধরকে বিয়ে করেছিল সে, ওদের অস্ত্র-ব্যবসার দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে এদের পক্ষে ভারাকিনকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব।’

‘ষাট-সত্তর বছরের পুরনো ভূতকে তাড়া করছ তুমি।’

‘দেখা যাক ভূতটার ছায়া এখনও আছে কি না। এনিওয়ে, আর কোনও প্রমাণ চান আপনি?’

‘না, আমি কনভিন্সড। কিন্তু তোমার জন্য আমার ভয় হচ্ছে, কুয়াশা। যাদের পিছনে লেগেছ, তারা সহজ পাত্র না। রীতিমত সুইসাইড-স্কোয়াড পাঠিয়েছে ওরা তোমার পিছনে… সংগঠনের পরিচয় লুকানোর জন্য খুনিরা আত্মহত্যা করছে! এ তো ফ্যানাটিসিজম!’

‘ফ্যানাটিক-ই এরা… কাউন্ট গিলবার্তো বারেমির ফ্যানাটিক। তার দর্শন আর আদর্শ এদের ধর্ম। এই ফ্যানাটিকদেরকে ঠেকাতে না পারলে পৃথিবীর ধ্বংস অনিবার্য।’

‘সেটার জন্যই কাজ করছ তুমি, তাই না?’ অন্যচোখে কুয়াশার দিকে তাকালেন শেভচেঙ্কো। ‘এতদিনে আমি তোমার সত্যিকার রূপ দেখছি, কুয়াশা। সমাজ তোমাকে অপরাধীর খেতাব দিয়ে কতবড় ভুল করছে, তা-ও বুঝতে পারছি। দুঃখিত… আমিও ভুল বুঝেছিলাম তোমাকে। এগিয়ে যাও তুমি, আমার আশীর্বাদ থাকবে তোমার সঙ্গে।’

‘ধন্যবাদ, স্যর।’

‘এসেনে যাবে কীভাবে?’

‘হেলসিঙ্কি হয়ে।’

‘বর্ডারে সমস্যা হবে না?’

‘উঁহুঁ। আমাকে সাহায্য করবার লোক আছে।

‘রওনা হবে কখন?’

‘কাল সকালে?’

‘রাতটা চাইলে আমার বাড়িতে কাটাতে পারো।’

‘না, তাতে আপনার বিপদ হতে পারে।’

ভুরু কোঁচকালেন শেভচেঙ্কো। কিন্তু টেলিফোনে আমার অভিনয় দেখে তুমিই তো বললে, লোকের সন্দেহ দূর করে দিতে পেরেছি।’

‘আমার তা-ই বিশ্বাস,’ বলল কুয়াশা। ‘অন্তত আগামী কিছুদিন আপনাকে বিরক্ত করবে না কেউ। এরপরে হয়তো নিখোঁজ চাবিঅলাকে নিয়ে পুলিশ তদন্ত শুরু করবে, কিন্তু ততদিনে সমস্ত ব্লু ঝাপসা হয়ে আসবে।’

‘তা হলে?’

‘আমার হিসেবে ভুলও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো মরণ ডেকে এনেছি আপনার। দুঃখিত, আর কারও কাছে তথ্য পাবার উপায় ছিল না আমার।’

‘থাক, ওভাবে বলতে হবে না,’ হাসলেন শেভচেঙ্কো। বয়স্ কম হয়নি আমার, ক’দিন-ই বা আর বাঁচব? মরার আগে দু’একটা ভাল কাজ করে যেতে চাই। তাতে যদি জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়, আপত্তি নেই। যাও এখন, ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।

বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরল কুয়াশা। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল লাইব্রেরি থেকে।

.

ফোনবুথ থেকে সিমকিনের মোবাইলে ফোন করল কুয়াশা। জানতে চাইল, ‘কোথায় তুমি?’

‘তোমার কথামত একটা হোটেলে উঠেছি,’ বলল রাশান পুলিশ অফিসার। ‘এখুনি আবার বেরুতে হবে নাকি? আমার কিন্তু শরীর আর চলছে না। সারাদিনে এক ফোঁটা বিশ্রাম পাইনি, একটু ঘুমিয়ে নেয়া দরকার।’

‘ঘুমাও, কোনও অসুবিধে নেই। আমার মেসেজের কী হলো?’

‘অলরেডি পাঠিয়ে দিয়েছি। চাইলে হেলসিঙ্কিতে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।’

‘প্রয়োজন হলে নেব। আর হ্যাঁ, লেনিনগ্রাদে আমার কাজ শেষ, কাল ভোরে হেলসিঙ্কিতে ফিরব। তুমি আমাকে বর্ডারে পৌঁছে দেবে। ভোর চারটের সময় আনিচভ ব্রিজের কাছে থেকো, ওখানে পাবে আমাকে।’

‘আবার!’ প্রায় হাহাকার করে উঠল সিমকিন। ‘কম তো করিনি তোমার জন্য, এখন একটু রেহাই দাও আমাকে!’

‘রেহাই তো দিচ্ছিই! বর্ডারে পৌঁছুনোর পর… বাকি জীবনের জন্য! সুসংবাদ, কাজটা ঠিকমত করে দিলে তোমার গোমর ফাঁস হবে না আমার কাছ থেকে।’

‘তোমার মুখ বন্ধ করানোর আরও তরিকা জানা আছে আমার, ‘ ফুঁসে উঠল সিমকিন। কুয়াশার ব্ল্যাকমেইলিং তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

‘ভাবছ গুলি করবে আমাকে?’ হাসল কুয়াশা। ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারবে—মুখ তো বন্ধ করবেই, তারপর আবার আমার লাশ দেখিয়ে বাহবা কুড়াবে সবার? আমাকে শিকার করা অত সহজ নয়, বন্ধু।’

‘না, না, তাড়াতাড়ি বলল সিমকিন। ‘অমন কিছুই ভাবছি না আমি।’

‘গুড। তা হলে চারটেয় জায়গামত থেকো।’

‘অত ভোরে গাড়ি নিয়ে বের হলে যদি টহল পুলিশ আটকায় আমাকে? কী জবাব দেব?’

‘আই.ডি. দেখালেই ছেড়ে দেবে ওরা। টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার, সিমকিন। নিজেই যে পুলিশ অফিসার, সে-কথা ভুলে গেছ। ঘুম দাও একটা, জেগে ওঠার পর সব ঠিক হয়ে যাবে। বিদায়।’

.

মাঝরাত পেরিয়ে যাবার পর ট্যাক্সি নিয়ে পুরনো হাউজিং ডিস্ট্রিক্টে গেল কুয়াশা। সরাসরি নাতালিয়ার বিল্ডিঙে ঢুকল না, চার বিল্ডিং পরের স্টেয়ারকেসের দিকে এগোল। দুপুরেও এটা দিয়েই বেরিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে তাকাল নাতালিয়ার ফ্ল্যাটের দিকে। জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে, তারমানে ডিউটি থেকে ফিরে এসেছে মেয়েটা।

ধীরে-সুস্থে সিঁড়ি ভাঙল কুয়াশা, যেন সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ক্লান্ত একজন মানুষ বাড়ি ফিরছে। বিল্ডিঙের সদর দরজা খুলে ফয়েই-এ ঢোকার পর ক্ষান্ত দিল অভিনয়। চকিতে দেখে নিল আশপাশ, তারপর সেলারের দিকে পা বাড়াল। নীচে নেমে একটা দেশলাই জ্বালল, চোখ বোলাল সেলারের পিছনের কোনায় … চমকে উঠল পরমুহূর্তে।

লাশটা নেই! এখানেই ইংরেজ লোকটাকে ফেলে রেখে গিয়েছিল ও—সারা গায়ে ঢেলে দিয়েছিল ভদকা, ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছিল দু’হাতের শিরা। অথচ এখন সে-সবের কিছু দেখা যাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে পরখ করল জায়গাটা—এক ফোঁটা রক্তও নেই মেঝেতে। নিখুঁতভাবে সব পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে।

শরীর আড়ষ্ট হয়ে উঠল কুয়াশার। কিছু একটা ঘটে গেছে ওর অনুপস্থিতিতে…. ভয়ানক কিছু! ভুল করেছে ও… মহা-ভুল! ভেবেছিল একবার ব্যর্থ হবার পর আর কাউকে পাঠানো হবে না এখানে… তাতে দ্বিতীয়জনের ফাঁদে পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু ওর ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে আবার লোক পাঠিয়েছে ফেনিস। আর তার অর্থ….

নাতালিয়া!

চরম অমঙ্গল আশঙ্কায় কেঁপে উঠল কুয়াশার বুক। সেলারের কানেক্টিং প্যাসেজ ধরে ছুটতে শুরু করল ও। হাতে বেরিয়ে এসেছে পিস্তল। কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেল নাতালিয়ার বিল্ডিঙে। বেজমেন্টের সিঁড়ি ধরে দ্রুত উঠে এল নীচতলার ফয়েই-এ।

হাসির শব্দ ভেসে আসছে সামনে থেকে একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। ছায়ার মাঝে শরীর লুকিয়ে সন্তর্পণে উঁকি দিল ও। অল্পবয়েসী একজোড়া তরুণ-তরুণী উঠছে সিঁড়ি ধরে, ঠাট্টা মশকরা করছে পরস্পরের সঙ্গে। কয়েক মুহূর্ত ওদেরকে নিরীখ করল কুয়াশা, তারপর উঠে এল পিছনে। পিস্তলটা লুকিয়ে ফেলেছে কোটের পকেটে।

‘কিছু মনে কোরো না,’ চোস্ত রাশানে বলে উঠল ও। ‘আমাকে একটু সাহায্য করবে?’

থেমে গেল তরুণ-তরুণী। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ওকে। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, আঙ্কেল?’

‘আমার গার্লফ্রেণ্ডকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়েছি,’ বিব্রত চেহারা বানিয়ে বলল কুয়াশা। কিরভ থিয়েটারে আজ সন্ধ্যায় অপেরা দেখতে যাবার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ভীষণ খেপে গেছে ও। ফোন-টোন ধরছে না। মাফ চাইতে এসেছি, কিন্তু আমার গলা শুনলে হয়তো দরজাই খুলবে না। তোমরা আমার হয়ে একটু নক করে দেবে দরজায়?’

মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুচকি হাসল তরুণ-তরুণী। তারপর ছেলেটা বলল, ‘ক’তলায় থাকে আপনার বান্ধবী?’

‘তিনতলায়। চলো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’

তরুণ-তরুণীকে নাতালিয়ার ফ্ল্যাটের সামনে নিয়ে গেল কুয়াশা। দরজা দেখিয়ে দিয়ে সরে গেল দেয়ালের আড়ালে। ঠোঁটের সামনে আঙুল তুলে ইশারা দিল ওদেরকে। মাথা ঝাঁকিয়ে পাল্লায় করাঘাত করল ছেলেটা। পকেটে হাত ঢোকাল কুয়াশা।

কোনও সাড়া পাওয়া গেল না ভিতর থেকে। কুয়াশার দিকে তাকাল তরুণ। ইশারা পেয়ে আবার করাঘাত করল—এবার আগের চেয়ে জোরে। ফলাফল একই।

‘মনে হচ্ছে বাসায় কেউ নেই,’ বলল ছেলেটা!

‘আপনাকে ছাড়াই অপেরা দেখতে চলে গেছে হয়তো, ঠাট্টা করল মেয়েটা, ‘নতুন কোনও বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে।

রসিকতায় হাসার চেষ্টা করল কুয়াশা, কিন্তু পারল না। খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে, দরজার ওপাশে কী অপেক্ষা করছে।

‘‘আমি অপেক্ষা করব,’ বলল ও। ‘কষ্ট দেবার জন্য দুঃখিত। তোমাদেরকে ধন্যবাদ।’

ওর কণ্ঠে বোধহয় কিছু একটা মিশে ছিল, তা থেকে তরুণী বুঝতে পারল, ঠাট্টা করা উচিত হয়নি। তাই লজ্জিত গলায় বলল, ‘আমি দুঃখিত।

‘আমি কিছু মনে করিনি।’

শুভকামনা রইল আপনার জন্য,’ বলল তরুণ। সঙ্গিনীকে নিয়ে উপরতলায় চলে গেল

উপরে দরজা বন্ধ হবার শব্দ শোনা পর্যন্ত স্থির রইল কুয়াশা তারপর নড়ল। পকেট থেকে বের করে আনল পিস্তল, সাবধানে হাত রাখল নাতালিয়ার দরজার নবে, আস্তে মোচড় দিল। মনে মনে প্রার্থনা করছিল, দরজা যেন তালাবদ্ধ থাকে; কিন্তু সে-প্রার্থনা কবুল হলো না। নব মোচড়াতেই মৃদু ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে খুলে গেল পাল্লা!

ভিতরে পা রাখতেই চোখে পড়ল তাণ্ডবের দৃশ্য। সামনের কামরা পুরো তছনছ করে ফেলা হয়েছে। ভেঙেচুরে ফেলা হয়েছে আসবাবপত্র-সোফার কুশন ছিঁড়ে তুলো বের করা হয়েছে, গুটিয়ে ফেলা হয়েছে কার্পেট, দেয়াল থেকে নামানো হয়েছে সবক’টা পেইন্টিং আর ছবির ফ্রেম। কাবার্ডের দরজা কজাসহ খুলে ফেলা হয়েছে। দেরাজগুলো খোলা, ভিতরের সব জিনিস মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ব্যাপারটাকে ডাকাতি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা আর কী। কিন্তু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে প্রতিপক্ষ, এতটা-না করলেও চলত। অভিজ্ঞ চোখে কুয়াশা বুঝল, ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল তাদের।

সামনের কামরার ধ্বংসস্তূপ মাড়িয়ে বেডরুমের দিকে এগোল ও। দরজা পেরিয়েই থমকে দাঁড়াল… অপ্রত্যাশিত কিছু দেখছে না, তারপরেও বুক কেঁপে উঠল।

বিছানার উপর পড়ে আছে নাতালিয়া সিমোনোভার নিষ্প্রাণ দেহ। উদোম… গা থেকে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে সমস্ত কাপড়। পড়ে থাকার ভঙ্গি বলে দিচ্ছে— মারা যাবার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে ওকে। দৈহিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য নয়, কুকীর্তিটা স্যাডিস্ট কোনও ডাকাতের বলে পুলিশের চোখে ধুলো দেবার জন্য। পুরো মুখে কালসিটে পড়েছে নাতালিয়ার, ফুলে আছে রক্তাক্ত ঠোঁট, চোখদুটো বুজে গেছে। বিছানা আর মেঝেতে পড়ে আছে কয়েকটা : ভাঙা দাঁত। নাকের ফুটো আর ঠোঁটের কোনা দিয়ে নেমে আসা রক্তে ভিজে গেছে বিছানার একটা অংশ।

মুখ ফিরিয়ে নিল কুয়াশা। দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল নীচের ঠোঁট। তীব্র ক্রোধে ভরে উঠেছে অন্তরাত্মা। প্রতিশোধ নিতে হবে ওকে… ভয়ানক প্রতিশোধ। মনে মনে শপথ নিল ও, তারপর আবার তাকাল নাতালিয়ার দিকে। অব্যক্ত, এক বেদনায় বুকটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে ওর। নির্যাতনের বহর দেখে বোঝা যাচ্ছে, চরম ইন্টারোগেশনের মাঝেও মুখ খোলেনি মেয়েটা। বলে দেয়নি, কোথায় পাওয়া যাবে কুয়াশাকে। যদি বলেই দিত, তা হলে সল্টিকভ-শেদ্রিন লাইব্রেরিতে মাত্র একজন খুনি হাজির হতো না; দলবল নিয়ে আসত ওকে হত্যা করবার জন্য।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই আঁতকে উঠল কুয়াশা। নাতালিয়ার ফ্ল্যাটে দ্বিতীয়বার লোক পাঠানো হয়েছে, তা হলে আইভান শেভচেঙ্কোর কাছেও কি পাঠানো হবে না? বিছানার পাশে, সাইড-টেবিলের উপর শোভা পাচ্ছে নাতালিয়ার টেলিফোন; ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে নিল ও, কাঁপা কাঁপা হাতে ডায়াল করল শেভচেঙ্কোর নাম্বারে। এই লাইনে আড়ি পাতা হয়েছে কি না কে জানে, কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ানকে এখুনি সতর্ক করে দিতে হবে।

একবার মাত্র রিং হলো, তারপরই রিসিভ করা হলো কল। ওপাশ থেকে খসখসে একটা কণ্ঠ বলল, ‘হ্যালো?’

লাইব্রেরিয়ানের কন্ঠ নয় ওটা। কুয়াশা বলল, ‘মি. শেভচেঙ্কোকে দিন, প্লিজ।’

‘কে বলছেন?’

‘আমি ওঁর কলিগ—আন্তন রুদিনেস্কি। সন্ধ্যায় শুনেছিলাম শরীর ভাল না ওঁর। ডাক্তার পাঠাব কি না জানা দরকার

‘ভাল আছেন উনি,’ কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে জানানো হলো।

‘তা হলে কথা বলতে দিন ওঁর সঙ্গে। একটা বই চেয়েছিলেন আমার কাছে… ওটা পাওয়া গেছে। খবরটা জানাতে চাই ওঁকে।’

নীরবতা।

‘হ্যালো?’ একটু পর শেভচেঙ্কোর ক্ষীণ কণ্ঠ শোনা গেল ইয়ারপিসে। তাঁকে ফোন ধরতে দিয়েছে লোকটা, সম্ভবত পরিস্থিতি স্বাভাবিক বোঝানোর জন্যই।

‘আপনি ঠিক আছেন, সার? কে ধরেছে ফোন—শত্রু, নাকি মিত্র? ইশারায় বলুন আমাকে।’

ইশারা করতে গেলেন না শেভচেঙ্কো। তার বদলে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘পালাও, কুয়াশা। এখুনি পালাও!! ওরা…’

কথা শেষ হলো না বৃদ্ধের, তার আগেই কানে তালা লাগানো একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে এল ইয়ারপিসে। গুলির আওয়াজ! পরমুহূর্তে কেটে গেল লাইন।

রিসিভার কানে ঠেকিয়ে মূর্তির মত বসে রইল কুয়াশা। খুন করেছে… ওর প্রিয় দু’জন মানুষকে খুন করেছে ফেনিস। বিনা অপরাধে। শুধুমাত্র ওকে সাহায্য করবার জন্যে। উপলব্ধিটা আসতেই রাগে অন্ধ হয়ে গেল ও, পাগলের মত ছুঁড়ে ফেলে দিল টেলিফোনটা। একটা শব্দই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।

প্রতিশোধ!

প্রতিশোধ!!

প্রতিশোধ!!!

নাতালিয়ার শরীর একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিল কুয়াশা, তারপর বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট থেকে। রাস্তায় নেমে একটা ফোনবুদ খুঁজে নিল, রিং করল সিমনিকে। সময় নষ্ট করা চলবে না, যত দ্রুত সম্ভব ভাইনিকালা পৌছুতে হবে ওকে। সেখান থেকে হেলসিঙ্কি, তারপর এসেন। ভারাকিনের সূত্র ধরে ফেনিসের মাথাগুলোকে খুঁজে বের করবে ও, নিজ হাতে খুন করবে মানুষরূপী ওই পিশাচদের।

‘ইয়েস?’ ঘুমজড়িত গলায় ফোন রিসিভ করল সিম কিন।

‘এখুনি বেরিয়ে পড়ো, নির্দেশ দিল কুয়াশা। ‘রেল স্টেশনে আসতে হবে তোমাকে। প্রথম এন্ট্রান্সের সামনে অপেক্ষা করব আমি।’

‘এখন?’ বিরক্ত গলায় বলল সিমকিন। ঘড়ি দেখল বোধহয়। ‘একটাও তো বাজেনি। তুমি না বলেছিলে…’

‘কী বলেছি ভুলে যাও। যা বলছি, সেটা শোনো। বর্ডারের ওপাশে একটা গাড়ি ম্যানেজ করতে পারবে? যা টাকা লাগে দেব।’

‘দেখি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে।’

‘কথা পেঁচিয়ো না। পারবে কি না বলো।’

ধমক খেয়ে সিধে হয়ে গেল সিমকিন। ‘পারব। তবে কয়েকটা ফোন করতে হবে আমাকে। পনেরো মিনিট সময় দাও!’

যত খুশি সময় নাও, কিন্তু আধঘণ্টা পর রেল স্টেশনে তোমাকে দেখতে চাই আমি।’

ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট পর সিমকিনের পোবেদা ছুটল রাশা-ফিনল্যাণ্ড সীমান্তের পথে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *